বরিশালে প্রতিরোধের বিবরণ
সাক্ষাৎকারঃ মহিউদ্দীন আহমদ, প্রাক্তন এম-টি
২৮-০৮-১৯৭৩
২৫মে মার্চের ঘটনা আমি জানতে পারি টেলিফোনযোগে রাত সাড়ে নটা-দশটার দিকে। আমরা মঞ্জুর ভাই সহ বসলাম আলাপ-আলোচনার জন্য। অয়ারলেস মারফত আমরা বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করে ঢাকার পুরা খবর পেলাম। রাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই পাকসেনা আসার আগেই আমরা সমগ্র প্রশাসনযন্ত্র তথা অস্ত্র আমাদের হাতে নিয়ে আসবো।
মার্চ মাসের শুরু থেকেই আমিসহ আমার দলের লোকজন বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে জনমত গঠন করে। পাক- আক্রমণ ঘটলে যেকোন জবাবের জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকবে হবে। সমগ্র বরিশাল জেলার বিভিন্ন থানা, ইউনিয়ন, গ্রামে সভা করে বেড়াই। মানুষ প্রস্তুত ছিল যেকোন অবস্থার জন্য।
২৬শে মার্চ আমি এবং নূরুল ইসলাম মঞ্জুর মিলে পুলিশ লাইনে পুলিম রিজার্ভ ফোর্সের সামনে বক্তৃতা করি। তারা সবাই হাত উঠিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুত বলে জানায়। এস-পি’র সাথে আলাপ-আলচনা করি। আমরা সমস্ত জেলার দায়িত্ত্ব নিই। পাকসেনা ওয়াপদা কলোনীতে কিছু ছিল, তারা আমাদের ফোন পেয়ে পালিয়ে যায়।
২৭শে মার্চ আমরা এসপি’র কাছে থেকে চাবি নিয়ে ট্রাকে করে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে যাই। লাকুটিয়া জমিদার বাড়ী কাশীপুর, মঞ্জুর সাহেবের বাসাতে অস্ত্রশস্ত্র রাখি এবং ছাত্র, পুলিশ, আনসার, সাধারণ লোক, ছাত্রলীগ কর্মী, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, শ্রমিক সব মিলে ৪/৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা তৈরী করি।২৭/২৮শে মার্চ থেকে পুলিশ লাইনে এবং বেলস পার্কে(বঙ্গবন্ধু পার্ক) আর্মস ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। উজিরপুর থানাতে মেজর জলিলের বাড়ী। জনসভা করে বের হওয়ার সময় মেজর জলিলের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। সে আমাদের বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে বলে, “আমি ছুটিতে আছি, যদি কোন কাজে লাগে ডাকবেন।” ২৮শে মার্চ আমরা চিঠি পাঠিয়ে মেজর জলিলকে নিয়ে আসি এবং কাজে লাগাই। আমরা ডিসির বাংলোতে আলাপ-আলোচনা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, এম-পি-সিভিল প্রধান; মহিউদ্দীন আহমদ এম-পি খাদ্য এবং যোগাযোগ; আমির হোসেন আমু; এম-পি-সাহায্য; আমিনুল হক চৌধুরী-বিচার বিভাগ; এম-পি সার্জেন্ট ফজলুল হক, মেজর জলিল ও এস-পি-ডিফেন্স; আবদুল মালেক খান, আওয়ামী লীগ সভাপতি-অর্থ বিভাগ; সর্দার জালাল, এডভোকেট ইউসুফ, হুমায়ুন এমপি-প্রচার বিভাগ; কাজী মহিউদ্দিন-নদীপথ যোগাযোগ; হেমায়েত উদ্দীন এডভোকেট-সমন্বয় বিভাগ। প্রত্যেক বিভাগের সাথে ডিসি, এসপি, এডিসি, যাবতীয় বিভাগীয় প্রধানরা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ডিসি ছিলেন হাবিবুর রহমান, এমপি ফখরুদ্দিন আহমেদ, এডিসি কাজী আজিজুল ইসলাম (শহীদ), অতিরিক্ত জেলা পুলিশ প্রধান গোলাম আহমদ (শহীদ), জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আসমত আলী, আনসার এ্যাডজুটেন্টরাও আমাদের সহযোগী ছিলেন। তালতলী, সাগরদি, কাশীপুর এলাকা, লাকুটিয়া ইত্যাদি স্থানে ডিফেন্স দেওয়া হয়। শহরের ভিতরেও আমাদের গোপন সেল ছিল।
ইতিমধ্যে ঢাকা, খুলনার বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার শরণার্থী তথা আহত লোক আসা শুরু করে। তাদেরকে কলেজসহ বিভিন্নস্থানে রাখার ব্যবস্থা করি এবং পরে তাদেরকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা আমি নিজে করি। ফোন মারফত আমাদের বাগেরহাট, ফরিদপুর, মাদারীপুর, পটুয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর ইত্যাদি স্থানের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে মঞ্জুর সাহেব (এমপি) আগরতলা যান। তিনি আগরতলা থেকে ফিরে আবার কলকাতা যান অস্ত্রের জন্য। তাঁর অনুপস্থিতিতে আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে ডিফেন্সের। আমি ১৫০ জনের মত যোদ্ধাকে অস্ত্র, খাদ্য, ওষুধ সহ লঞ্চযোগে চাঁদপুর পৌঁছি মিজানুর রহমান চৌধুরীর অনুরোধে। এই বাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস আক্রমণ করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। আমাদের বাহিনীর ৩০ জনের মত শহীদ হয় ওখানে।
বাগেরহাটেও আমরা পাঠিয়েছিলাম ৬০ জনের মত যোদ্ধাকে। খুলনার যুদ্ধে আমাদের ৩/৪ জন শহীদ হন। আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি ছিল যারা মোটরসাইকেল এবং মোটর সহযোগে যোগাযোগ রাখতো। প্রতি থানাতে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। থানার সাথে আমাদের সব সময় যোগাযোগ থাকতো। বরিশালের সকল মহকুমায় আমরা নির্দেশ এবং যোগাযোগ রাখতাম।
২৬শে এপ্রিল বরিশালের পতন ঘটে পাক বাহিনীর হাতে।ইতিমধ্যে এপ্রিল মাসের ১০/১২ তারিখে এবং ১৯/২০ তারিখে পাক বিমান দু’বার হামলা চালিয়ে আমাদের একটি লঞ্চ ডুবিয়ে দেয় এবং বোমার আঘাতে ২০ জনের মত লোক মারা যায়। বহু আহত হয়। পথিমধ্যেও বহু লোক মারা যায়। মঞ্জুর সাহেবের কথা মত মেজর জলিল এবং ক্যাপ্টেন হুদাকে অস্ত্রের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। মঞ্জুর ভাই ইতিমধ্যে ২২ এপ্রিল কিছু অস্ত্র নিয়ে বরিশাল আসেন।
২৫শে এপ্রিল ভোরবেলা থেকে পাকসেনারা শেলিং করতে করতে আসে মুলাদির দিক থেকে। খুলনার দিক থেকেও আসতে থাকে। ফরিদপুর থেকেও স্থলবাহিনী মার্চ করে আসতে থাকে। ৪টি জেট অনবরত বোমা ফেলা শুরু করে। পর মুহুর্তে ৬টি হেলিকাপ্টারযোগে অসংখ্য ছত্রীসেনা নামিয়ে দেয়। মঞ্জুর তখন তালতলী (উত্তর দিকে) ও আমি দক্ষিণ দিকে যুদ্ধ পরিচালনা করি। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন ফিরুর গুলি লাগে। পাশাপাশি মঞ্জুরও ছিল। মঞ্জুর আমাকে মেসেজ দেন ফোর্স নিয়ে লাকুটিয়া রওয়ানা হবার জন্য। আমি নিজে বাহিনীর ডাক্তারসহ লাকুটিয়া রওনা হই। কিন্তু অনবরত বোমা ফেলার জন্য লাকুটিয়া না যেতে পেরে সরদার জালাল, আমিনুল হক চৌধুরী এবং কিছু ছেলে নিয়ে কাশীপুর ক্যাম্পে চলে যাই। এর আগেই অবস্থা বুঝতে পেরে শহর থেকে বেসামরিক লোকদের সরে যেতে বলি। সরদার জালালকে রুহাতে (গ্রাম) রেখে একটি জীপ নিয়ে দু’জন মুক্তিযোদ্ধাসহ বিকাল ৫টার দিকে শহরে চলে আসি অবস্থা দেখার জন্য। শহরে ঢোকার সময় গ্রামসংলগ্ন রাস্তার দু’পাশে বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধাকে পজিশন নিয়ে থাকতে দেখি। আমি কিছু মুক্তিবাহিনীকে নদীর ওপারে (কীর্তনখোলার ওপারে) পজিশন নিয়ে গানবোটে সুযোগ বুঝে আক্রমণ করতে বলি।
শহর তখন শূন্য। কিছুক্ষণ পরপরই আবার ব্যাপকভাবে বোমা ফেলা শুরু হয়। আমি ও ড্রাইভার দু’জন বাংকারে আধ ঘন্টা বসে থাকি। বোমা ফেলা একটু কমলে গাড়ী নিয়ে রুহা গ্রামে রওনা হই। ছত্রীসেনা নেমে গিয়েছিল। তারা আমার গাড়ী লক্ষ্য কররে গুলি ছোড়ে। আমরা অল্পের জন্য বেঁচে যাই। রুহা গ্রামে পৌঁছালে মঞ্জুরের মেসেজ পেলাম যে আমাদের লাকুটিয়া ঘাঁটির পতন ঘটেছে। তিনি স্বরূপকাঠির দিকে যোদ্ধা নিয়ে রওনা হয়েছেন। আমাকে রাতেই তার সাথে দেখা করতে বলেন। রাতেই কিছু যোদ্ধা, জালাল আহমেদসহ রওনা হয়ে পরদিন ভোরবেলা স্বরূপকাঠি (থানা) গিয়ে পৌছাই। ২৬ তারিখে রাত ৩টার দিকে কাউখালীতে মঞ্জুরের সাথে আলাপ করি। আমরা অখান থেকে গানবোটের শেলিং শুনতে পাচ্ছিলাম।
২৭শে এপ্রিল রওনা হয়ে আমরা ৩টি বড় লঞ্চে বহু পরিবারসহ (২০০/৩০০) সুন্দরবন হয়ে হাসনাবাদ পৌঁছাই ২৯শে এপ্রিল। বিশ্রাম সিংহ তখন সীমান্ত রক্ষী বাহিনী প্রধান ছিলেন। তিনি আমাদের সাদরে গ্রহণ করেন। কলকাতার বালিগঞ্জে মঞ্জুরসহ মন্ত্রী পরিষদের সাথে দেখা করে আলাপ-আলচনা করি। বরিশালের সব কথা বলি। জেনারেল ওসমানীর সাথেও ওখানে সাক্ষাৎ হয়। বিশ্রাম সিংহ মিঃ মুখার্জী, নেভাল কমান্ডার কে,বি, সিংহ- এদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। এদের আন্তরিকতা ও সাহায্য-সহানুভূতি ভোলা যায় না।
১লা মে থেকে ৭ই মে পর্যন্ত হাসনাবাদ, ব্যারাকপুর পাগলের মত আমি এবং মঞ্জুর ঘোরাঘুরি করে দুই লঞ্চ আধুনিক অস্ত্র, অষুধ, ড্রাই ফুডসহ কয়েক লক্ষ টাকার জিনিস সরকারী চুক্তি ছাড়াই কমান্ডার মুখার্জী, কে,বি, সিংহ গোপনে আমাদের হাতে তুলে দেন। ৬/৭ দিন আমাদের ছেলেদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে প্রতি গ্রুপকে বিভিন্ন অস্ত্রে বিশেষ শিক্ষা দিই। আমরা নিজেরাও শিক্ষা নিই। আমি, মঞ্জুর, সরদার জালাল, প্রায় ৮০ জন যোদ্ধা, মেজর জলিল, ক্যাপ্টেন রহমান, লেঃ নাসের সহ ২টি লঞ্চ ভর্তি অস্ত্র ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে বরিশালের দিকে রওনা হই। ৪০ হর্স-পাওয়ারের স্পীডবোটও ছিল আমাদের সাথে।
দুপুর ২টার দিকে আমরা হাসনাবাদ থেকে রওনা হই। ২টি ভারতীয় নেভাল শীপ আমাদের পৌঁছে দিয়ে সালাম করে চলে যায়। একটি লঞ্চে মেজর জলিল, ক্যাপ্টেন রহমান এবং অন্যটিতে আমি, মঞ্জুর, লেঃ ময়নুল ছিলাম। আমরা সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করি।
খুলনা জেলার সুন্দরবন এলাকায় গাবুরিয়া ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনীর নিকটে তিনটি পাক গানবোট আমাদের আক্রমণ করে। আমরাও পাল্টা আক্রমণ করি। এক ঘন্টা যাবৎ দু’পক্ষে গোলাগুলি হয়। আমাদের আক্রমণে একটি গানবোট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন ওরা দূরে চলে গিয়ে কামান ছুড়তে থাকে। রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। আমাদের দু’টি লঞ্চে পিছনে যে পেট্রোল ছিল তাতে শেল পড়ে আগুন লেগে যায়। ওখানে আমাদের কয়েকজন যোদ্ধা শহীদ হয়। আমরা পানিতে ঝাঁপ দিই। আমরা কিছু সাঁতরিয়ে পাড়ে উঠি। ওয়াপদা বাঁধে আমরা পজিশন নিই। কিছু মুক্তিযোদ্ধাসহ আমি এবং মঞ্জুর পিছু হঠতে থাকি। পাকসেনারা অনবরত শেল ফেলতে থাকে গ্রামের দিকে। আমরা যে কোন স্থানে তার কিছুই বুঝছিলাম না।
গাবুরিয়া ইউনিয়নের ঐখানে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন খবর দিয়ে পাক গানবোট নিয়ে আসে। তখন ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। মাঠের ভেতর আমি নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে হারিয়ে ফেলি। আমি এবং আবুল হোসেন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা বিচ্ছিন্নভাবে একদিকে এগোতে থাকি। ভোরবেলা সর্দার জালাল, কানু, মকসেদ আলী, বাদল, ফিরোজসহ কিছু লোককে মাঠের মধ্যে দেখতে পাই এবং তাদের সাথে মিলিত হই আমরা ১৭ জন লোক। আর কারো কোন খোঁজ পাইনি। একদিকে বিদ্যুৎ, সার্চ লাইটের আলো, অন্যদিকে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ক্রিলিং করে এগোচ্ছিলাম। আমরা ১৭ জনই কমবেশী আহত ছিলাম। আমরা ১৭ জন গ্রামের দিকে রওনা হচ্ছিলাম। বৃষ্টি তখন সামনে হচ্ছে। আমরা পাইকগাছা থানার ভিতরে মদিনাবাদ গ্রামে কয়রা ইউনিয়নে পৌঁছাই। আমরা আমাদের পরস্পরের নাম বদল করি। গ্রামের অবস্থাও বুঝি যে তা আমাদের পক্ষে হবেনা। মওলানা সালাম ওখানে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল। মওলানা আবদুস সালাম তার দলবল এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ঘেরাও করে বন্দী করে ফেলে।
———————————————-