You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১২৮। বাংলাদেশ কে স্বীকৃতির প্রশ্নে “বাংলাদেশ” প্রবলেমস অফ রিকাগনিশনঃ বি এল শর্মার পর্যালোচনা অমৃত বাজার পত্রিকা ৭ই মে ১৯৭১

 রাজনৈতিক ফোরামঃ
বাংলাদেশঃ প্রবলেমস অফ রিকগনিশন
– বাই বি এল শর্মা

একমাস এর বেশি সময় ধরে ধরে পাকিস্তানি বাহীনি সারা বাংলাদেশে হিংস্র কার্যকলাপ চালাচ্ছে। তারা মানুষকে গুলি করছে, মহিলা ও শিশুদের উপর বেয়নেট চার্জ করছে এবং বাসাবাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করছে।

আক্রান্ত এলাকাসমুহে পাকিস্তানী বিমান বাহীনি দ্বারা আক্রমন করছে এবং গানবোটের সাহায্যে কামানের গোলা ছুড়ছে। কেউই হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা জানেনা তবে যতদুর হিসাব করা হয়েছে এর সংখ্যা কয়েক শত হাজার।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, গনগত্যা হয়েছে এবং চলছে একটি নির্বাচিত সরকার কে বাতিল করার জন্য এবং ভারত মনে করছে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা দরকার। বেশ কিছু দেশ যেমন ব্রিটেন এই ঘটনাকে নাকচ করে বলেছে এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন সমস্যা। পিকিং আরো এক ধাপ এগিয়ে, তারা ইসলামাবাদকে পূর্ণ সমর্থন দেয়ার কথা বলেছে। এটা সত্যি যে প্রদগনি ইয়াহিয়া খান কে একটি শক্তিশালী পত্র পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তার ফলাফল ছিলো নেতিবাচক। এবং এখনো বিশ্ব জনমত তাদের সরকারের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। একটি পরিকল্পিত গনহত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের নেতৃত্ব ও অর্থনীতিকে ধ্বংস ও জনগনের উদ্দিপনাকে দমন করার জন্য পাকিস্তান দ্বিধা করেনি।

এই পরিস্থিতিতে আমাদের সীমান্ত জুরে চলা ভয়াবহতা ও রক্তপাত বন্ধ করতে ভারত সরকার কি করতে পারে? পরামর্শ দেয়া যায় যে, ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশ বিষয়ে কোন ভাবে হস্তক্ষেপ করা।

ভারতের উচিৎ বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া। দুরভাগ্যজনক এই যে স্বীকৃতির বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন অনেক জটিল একটি ব্যাপার। কোন দেশকে স্বীকৃতি দেয়া অনেক ঝামেলার বিষয়। উদাহারন হিসেবে বলা যায়, যেমন বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য স্বীকৃতির উভয় ধরনের রুপই জড়িত, এখানে বিধিসম্মত ভাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রয়োজন নেই এবং এখানে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও সাক্ষর হতে পারে যেমন ভারত ও পূর্ব জার্মানির মধ্যে সাক্ষরিত হয়েছে বানিজ্য চুক্তি। বহুজাতিক রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে যোগ দিতে খুব বেশি স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই।

শর্তসমূহ

একটি রাস্ট্র কে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আইনবিশারদরা নানা শর্ত প্রস্তাব করেছেন। এর মধ্যে আছে নির্দিষ্ট অঞ্চলের দখল এবং একটি স্বাধীন সরকার দ্বারা অর্থনৈতিক, কারিগরি ও সামরিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ও অধীনস্ত অঞ্চলের জনগনের উপর পূর্ণ কতৃত্ব। বিপরীতে, একটি সরকারকে স্বীকৃতি দেবার জন্য শুধুমাত্র এর দখলকৃত অঞ্চল ও ঐ এলাকার জনসাধারনের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রন করাকেই বোঝায় না তা রক্ষা বা স্থিতিশীল রাখার ক্ষমতাকেও বোঝায়, সুতরাং এটা আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা প্রবেশ করতে পারে এবং বৈধতা দেয়ার শর্তসমুহ পুরন করতে পারে। বাস্তবে, কিছু শক্তিশালী দেশ এইসব বিবেচ্য বিষয় গুলোকে মেনে চলছে না। যেমন আমেরিকা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবার পর ইসরায়েল নিজের স্বাধীনতা ঘোষনা করেছে। একইভাবে যখন প্রেসিডেন্ট কাসাভুবু জেনারেল মোবুতুর কাছে সরকার পরিচালনার ভার প্রদান করেন তখন ফ্রান্স ও বেলজিয়াম জেনারেল বোবুতু কে স্বীকৃতি দেয়।

লেখক ভারতীয় সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ও পরে সরকারে বহিঃসম্পর্ক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ভারত যদি বাংলাদেশকে তখন একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতো তাহলে কি কি সমস্যার সৃষ্টি হতো তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

উপরোক্ত দুটি ক্ষেত্রেই সমস্যাগুলো ছিলো রাজনৈতিক, এগুলো ন্যায়সঙ্গত ছিলোনা। আমেরিকার প্রতিনিধি ইসরায়েলের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, এটি ছিলো স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে ” একটি উচ্চ রাজনৈতিক আয়িন বা পন্থা”। কঙ্গোতে বেলজিয়াম ও ফ্রান্স তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছে রাজনৈতিক নীতির আড়ালে।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমটিও রাজনৈতিক। যদি এটি ঘোষনা করা হতো তবে নিম্নোক্ত ঘটনাগুলো ঘটতে পারতো বলে অনুমান করা যায়।

ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তো এবং এরপর অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া সহ নানা ধরনের সমস্যার সুত্রপাত হতো।

ভারত ও পাকিস্তান রাস্ট্র দুটি পরষ্পরের সাথে মারাত্তক যুদ্ধে জড়িয়ে যেতো এবং যা থেকে হতে পারতো অর্থনৈতিক সংকট। এমনকি যুদ্ধের ফলে দুটি দেশের মধ্যে বৈরিতার অবসান কখনোই হতোনা। ভারতও বাংলাদেশে অস্ত্র সরবরাহ করা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করতে পারতো না যেমন আমেরিকা ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ দেয়াটা প্রয়োজনীয় বলে মনে করে। আজ হোক কাল হোক এটি নিয়ে একটি সশস্ত্র সংঘাত তৈরি হতো।

এর ফলে পাকিস্তান ঠিক যা চাচ্ছিলো তাই সেই সুযোগ পেয়ে যেতো। তারা নিরাপত্তা পরিষদে এই ব্যাপারটি উত্থাপন করতো শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয় তারা কাশ্মীর ইস্যু নিয়েও দাবী তুলতো। ভারত নিরাপত্তা পরিষদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করেছে এবং এটি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের কাছ থেকে কোনো সমর্থন পাওয়াও দুষ্কর হয়ে যেতো। এর ফলে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে সহায়তা করার পথ বন্ধ হয়ে যেতো।

এটি প্রস্তাব করা হয়েছে যে ভারত নিরাপত্তা পরিষদে বা সাধারণ পরিষদে এই বিষয়টি উত্থাপন করার নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া জাতিসংঘের কতগুলো সদস্য দেশ বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের সমর্থন দেয়া নিয়ে কথা বলেছেন? এর কারন হলো সরকারগুলো যতটা না রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত হয় ততটা মানবিকতার স্বার্থে পরিচালিত হয়না।

মুসলিম দেশগুলো সম্ভবত একটি মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে ভেঙ্গে যাওয়াটা ঘৃণার চোখে দেখছে তবে তারা এটা ভুলে গিয়েছে এর ফলে আরেকটি মুসলিম দেশের জন্ম হচ্ছে। কিছু কিছু বিশ্ব শক্তি এই অঞ্চলের সামরিক ভারসাম্যের এর পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত এবং তারা ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের দুর্বল হয়ে যাওয়াকে মেনে নিতে পারছেন না। অনেক দেশই অন্যত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিয়ে দুঃস্বপ্নে ভোগে। কিন্তু তারা এটা ভুলে যায় যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু লোকেরা নয় সংখ্যাগুরু জনগন স্বাধীনতা চাচ্ছে যা একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনে প্রমান হয়েছে।

একথাও ঠিক যে এই প্রস্তাবগুলো কোনটাই খুব শক্তিশালী নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পাকিস্তান বাংলাদেশে যে নৃশংসতা করছে এটা তারা দর্শক হিসেবে নিরবে দেখে যেতে পারেন না। একমাত্র পন্থা যা ভারত গ্রহন করতে পারে বাংলাদেশেকে সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে না যেয়ে এবং তা হচ্ছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া।

একটি নতুন হুমকি

ইতিমধ্যেই লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এ নিয়ে আমাদের অর্থনীতি ও প্রশাসন একটি নতুন হুমকির সম্মুখীন। কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বে যারা আছেন তারা নির্বাচিত হয়েছিলেন দারিদ্রকে সমূলে উৎপাটন করবেন এই কর্মসূচির ঘোষনা দিয়ে। পূর্বে অবস্থিত ভারত পাকিস্তান বর্ডারে ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে গিয়ে যে সম্পদ ব্যয় হচ্ছে তা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহৃত হবার কথা ছিলো। আমাদের ভুলো যাওয়া উচিত নয় যে আমাদের নিজেদের দরিদ্র জনগনের জন্য আমাদের প্রয়োজন ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসালয়, রান্নাঘর, উলঙ্গদের প্রয়োজন কাপড় গৃহহীনদের জন্য প্রয়োজন বাসস্থান।

এখন সময় এসেছে ভারতের বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বড় আকারে সহায়তা নেয়ার এর সাথে বিশ্বের বড় বড় সাহায্য প্রদানকারী সংস্থা যেমন, এফ এ ও, ডব্লিও এইচ ও, রেড ক্রস, ইউনেস্কো কেয়ার সহ অরো অনেকের সহায়তা নেয়ার। কিন্তু কি বিশেষ উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক বৃহৎ শক্তি ও তথাকথিত আফ্রো এশিয়ান দেশগুলো এই সাহায্য পাওয়া থেকে আমাদের বাধা দিচ্ছে?

রিলিফ অপারেশনে আইনি এবং রাজনৈতিক বিষয় জড়িত না। যদি হাজার হাজার মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত জীবন মেরামত করতে হয়, বিশ্বের সব দেশ তো ভারতের উপরে এর বোঝা চাপিয়ে দিতে পারেনা এবং বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করতে পারেনা। এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিকা করার জন্য আমরা কেন আমাদের এসব তথ্য সবাইকে জানাচ্ছি না এবং আমাদের কূটনৈতিক যন্ত্রগুলো সচল করছি না!

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!