শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২৯। বিরোধী নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকঃ বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতি দানের সম্ভাবনা নেই। | স্টেটসম্যান | ৮ মে ১৯৭১ |
বিরোধী নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকঃ বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতি দানের সম্ভাবনা নেই।
নয়াদিল্লী, ৭ই মে সন্ধ্যায় বিরোধীদের বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি প্রদানের জোরালো দাবীর বিষয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় একটি অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা ছিলো বিস্তারিত ও খোলামেলা, কিছু সদস্যের বিশ্বাস ছিলো তারা তাদের দাবী আদায় করতে পারবে। কিন্তু কোন নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়নি।
সরকার কেন দ্রুত স্বীকৃতি দেবেনা তা কিছু ইঙ্গিতের মাধ্যমে ব্যখ্যা করা হয়েছে।
সরকার পাকিস্তানের একটি প্রচারনা উল্লেখ করেছে যেখানে পাকিস্তানিরা বলছে, ১৫ মিলিয়ন উবাস্তু যারা ভারতে প্রবেশ করেছে তারা আসলে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ছিলো যাদের ফেরত যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
ইতিপূর্বে, বিরোধীদলের চাপ থাকা স্বত্বেও, সরকার বাংলাদেশের সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করেছে যেখানে সরকারের কাছে আধিক ভালো মনে হয়েছে “অপেক্ষা করা এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা”।
মিসেস গান্ধীর বিরোধী দলের নেতাদের সাথে ৩ ঘন্টার আলোচনায় এটি স্পষ্ট হয় যে, আজকের আলোচনায় তাদেরকে প্রবাসী সরকারের সর্বশেষ উন্নতি সম্পর্কে ধারনা দেয়া হয় এবং এই বিষয়ে আরো চিন্তা করতে বলা হয়। ” সরকারের সিদ্ধান্তগুলো দুর্বলতা থেকে আসছে “বা প্রভাবিত হচ্ছে পাকিস্তানীদের থেকে আসা যুদ্ধের হুমকি বা চীনের সাথে নতুন সংঘাতে জড়ানর ভয় থেকে বিরোধীদের এধরনের বক্তব্যকে অস্বীকার করা হয়। মিসেস গান্ধী বলেন ” এরচেয়ে গুরতর কারন রয়েছে ” কিন্তু তিনি কারগুলো ভেঙ্গে বলেন নি। মিসেস গান্দী বলেন, ভারতে থেকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার রয়েছে কিন্তু অবিলম্বে এই ব্যবস্থা নিলেও তা কোন প্রভাব ফেলবেনা। তার এই ইঙ্গিতই এ বিষয়ে সরকারের চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরেছে।
এটি জানা যায় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যারা অন্যতম বন্ধুত্বপূর্ণ শক্তি ও যাদের সাথে নয়াদীল্লির সম্পর্ক ঘনিষ্ট এবং মস্কোও পূর্ব বাংলা সম্পর্কে ভারতের মুল্যায়নকেই গ্রহন করেছে। জানা গেছে তা ছিলো বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি মঞ্জুর না করার ব্যাপারে।
প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান থেকে বুঝতে পারা যায় বিরোধীদলের এই অবস্থান তাদের প্রত্যাশিতই ছিলো। বিকানের ডাঃ কামি সিং ও মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট জনাব মোহাম্মদ ইসমাইল ছাড়া প্রায় সব বিরোধী নেতা অবিলম্বে স্বীকৃতি চেয়েছিলেন এবং এটি বিলম্বিত করার জন্য সরকারকে তিরষ্কার করেছিলেন। জন সংঘের সভাপতি জনাব অটল বিহারী বাজপেয়ী ছিলেন এ ব্যাপারে সবচেয়ে সপ্রতিভ যেখানে ডিএমকে এর জনাব মনোহরন ছিলেন সতর্ক। সমালোচকরা চেয়েছিলো, তাদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার পরিবর্তে সরকার অন্য সরকারগুলোর নেতৃত্ব দেবে। ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক কারন ছাড়াও যেহেতু পূর্ববাংলায় পাকিস্তানিদের দ্বারা গনহত্যা সংগঠিত হচ্ছে। ভারতের এখানে বিশেষ দায়িত্ব আছে, তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়া অনুভুতি গুলো প্রকাশ পেয়েছে জনাব বাজপেয়ির কথায়। তিনি অভিযোগ করেছেন ভারত বাংলাদেশের জনগনকে হতাশ করে দিচ্ছে।
অপরদিকে ডাঃ কামি সিং ও জানাব ইসমাইল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে যে জটিলতাগুলো হতে পারে তা নিয়ে কথা বলছেন। জনাব মনোহরন এই পদক্ষেপের প্রভাব নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষনার প্রস্তাব দেন।
আন্তর্জাতিক নীতি
মিসেস গান্ধী বাংলাদেশ ইস্যুটিকে শুধুমাত্র স্বীকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে আরো বৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরতে চান। তিনি বলেন, ভারত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও আচরণের মধ্যে থেকেই সম্ভাব্য সকল উপায়ে স্বাধীনতার সংগ্রামে পূর্ববাংলার জনগনকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পাকিস্তান মিথ্যাচার করেছে ভারতকে কলঙ্কিত করার জন্য এবং পূর্ববাংলায় বাস্তবতা সম্পর্কে বিশ্বকে ভুল ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছে। তিনি দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করার জন্য পাকিস্তানের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিরোধী নেতাদের সতর্ক করেন ও এধরনের সমস্যা মোকাবিলায় তাদের সাহায্য কামনা করেন।
শরণার্থীদের পুনর্বাসন, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিকটে সাহায্য চাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সভায় আলোচনা করা হয়। মিসেস গান্ধী ১৫০০০০০ শরণার্থীর ভারতে প্রবেশের ব্যাপারে তথ্য প্রদান করেন। এদের ৫০ শতাংশকে ইতিমধ্যেই ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং অবশিষ্টরা খোলা জায়গায় অবস্থান করছে। উপরে প্রকাশিত সংখ্যাটিতে যারা বিহার বা অন্যান্য রাজ্যে গিয়েছেন তাদের সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তিনি আরো বলেন, সরকার এই ধরনের বিশাল সংখ্যার উদ্বাস্তুদের আন্তপ্রবাহের আর্থ-সামাজিক প্রভাব নিয়ে সচেতন ছিলো এবং সবচেয়ে ভালোভাবে তাদের দেখাশোনা করার কাজটি করেছে।
তারা শরণার্থী নয় উদ্বাস্তু
তিনি এটি পরিষ্কার করে বলেছেন যে, যারাই ভারতে এসেছে প্রত্যেককেই যুদ্ধের পরে দেশে ফিরে যেতে হবে। এই কারনেই তিনি তাদের শরণার্থী না বলে উদ্বাস্তু বা উৎখাতের শিকার হওয়া বলে উল্লেখ করেছেন। জনাব শরন সিং ও বাংলাদেশকে এখনই স্বীকৃতি না দেয়ার ব্যাপারে সরকারের মতামতকে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ” অপেক্ষা করা ও দেখা ” ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। তিনি পরামর্শ দেন ভারতের এই বিষয় জাতিসংঘে তোলা উচিত। মিসেস গান্ধী অন্যান্য দেশের বিবেককে জাগ্রত করার জন্য তার সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের বিষয় তুলে ধরেন এবং এটি করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলকে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার জন্য।
এই আলোচনায় মিসেস গান্ধী, জনাব শরন সিং, জনাব জাগজিবান রাম, জনাব চেভান, জনাব ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ, জনাব রাজ বাহাদুর, জনাব আর কে খাতিলকার ও জনাব ওম মেহতা ভারত সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন।
সতন্ত্র দলের প্রতিনিধিরা ছাড়া সকল বিরোধী দল এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। স্বতন্ত্র পার্টির প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই সভায় উপস্থিত হতে না পারার অপারগতা জানিয়ে একটি পত্র প্রেরন করেন এবং তাদের অন্যত্র ব্যস্ত্যতা রয়েছে বলে জানান। বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সিপিএল থেকে জনাব ইন্দ্রজিত গুপ্তা এবং এস এম ব্যানারজি, সিপিএল (এম) থেকে ছিলেন জনাব এ কে গোপালান, পিএসবি থেকে ছিলেন, জনাব এম জি গোরাই ও জনাব সমর গুহ, ডিএমকে থেকে ছিলেন জনাব মনোহরন, আইএনডি থেকে ছিলেন জনাব ফ্রাঙ্ক এন্থনি, জে এস থেকে ছিলেন জনাব বাজপেয়ী, এবং উপস্থিত ছিলেন ডাঃ কামী সিং ও জনাব ইসমাইল।