You dont have javascript enabled! Please enable it!

নওগাঁ- রাজশাহীর সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার- ব্রিগেডিয়ার গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী

(১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি তাঁর মেজর থাকাকালীন গৃহীত। এই প্রকল্পের জন্য ২০-০৯-১৯৮৩ তারিখে তার লিখিত ইংরেজী প্রতিবেদনের প্রথমাংশ প্রাসঙ্গিক বোধে এই সাক্ষাৎকারের সাথে সংযোজন করা হলো। প্রতিবেদনের বাকি অংশ দশম খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে)

মার্চ মাসে (১৯৭১) আমি রাজশাহীর নওগা’তে বিডিআর (তৎকালীন ইপিআর)-এর উইংয়ের সহকারী উইং কমান্ডারের দ্বায়ীত্ব পালন করছিলাম। ১৮ই মেজর নাজমুল হক (বাঙালি) সাহেবকে উইং কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ঐ পদে এর আগে একজন পাঞ্জাবী অফিসার বহাল ছিলেন। নাজমুল হক সাহেব সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নওগাঁতে আসেন এবং দায়িত্ব বুঝে নেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাঞ্জাবী অফিসারটি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে কিছুটা টালবাহানা শুরু করেন। কিন্তু তখন সেই এলাকায় গোলযোগপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আমার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের দরুণ পাঞ্জাবী মেজর আকরাম দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে বাধ্য হন।

মেজর আকরাম ২৩শে মার্চ ঢাকার পথে ক্যাপ্টেন নবীদ নামে সেই উইংয়ের আরেকজন পাঞ্জাবী অফিসার সহ রওয়ানা হন কিন্তু পথিমধ্য ফেরীর লোকজন তাদেরকে পার করতে অসম্মতী প্রকাশ করায় তারা ফিরে আসতে বাধ্য হন। ফিরত আসার পর আমি তাদের নিরাপত্তার অজুহাতে আমার বাসার উপরের তলায় প্রকৃতপক্ষে নজরবন্দী করে রাখি। এবং একই অজুহাতে নিচে সশস্ত্র প্রহরী মোতায়েন করি।

২৩শে মার্চ এবং ২৫শে মার্চের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমি আমার উইং-এর কমপক্ষে ১০০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআর, জেসিও এবং অফিসারদেরকে রাখার ফাঁদ রচনা করি। কেননা আমি বুঝতে পারি যে, তারা সবাই উইং হেডকোয়ার্টারে টালবাহানা করে একত্রিত হবার চেষ্টা করছে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। ২৪শে মার্চ আমি উইং-এর উপপ্রধান হিসেবে অধিকাংশ অস্ত্রাগারে পাঞ্জাবী প্রহরী অধিনায়কদের সরিয়ে ফেলি এবং বেশীরভাগ বাঙালিকে নিয়োগ করি।

২৫শে মার্চ পর্যন্ত আমরা বাইরের কোনো খবর পাইনি। ২৬শে মার্চ ভোর ছয়টায় সুবেদার মেজর চুপি চুপি আমার বাসায় এসে বলে যে, আমাকে কে যেনো ঢাকা ইপিআর অয়ারলেস স্টেশন থেকে ডাকছে এবং তার মনে হচ্ছে ঢাকায় কিছু একটা ঘটেছে।

অয়ারলেসে কথা বলার সময় একজন বাঙালি ইপিআর সিগন্যালার আমাকে বললো যে, ঢাকায় গত রাতে রাজারবাগে পশ্চিম পাকিস্তানীরা হামলা চালিয়েছে এবং পিলখানার ইপিআর’রা বিদ্রোহ করেছে এবং তারা অধিকাংশ ইপিআর ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে, আপনারা যে যেখানে আছেন আপনাদের নিজেদের কাজও শুরু করুন। কিন্তু আমি তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সে পরিচয় দিতে অসম্মতি জানায়। যদিও এ খবরের সত্যতা প্রমাণ করার কোনো উপায় ছিলো না তথাপি কিছু সত্য থাকতে পারে একথা মনে করে নিজে বিদ্রোহ করতে মনে স্থির করি।

বেশ কিছুক্ষণ পরে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে খবর শুনতে চাইলে কোনো জবাব পাওয়া গেলো না। বেশ কিছুক্ষণ পর বলা হয় ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিবেন। কিছুক্ষণ পর ইয়াহিয়ার ভাষণ শোনা গেলো এবং সামরিক নির্দেশনাবলীও প্রচার করা হলো।

বিদ্রোহের দাবানল চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। চারিদিকে বিহারী-বাঙালি দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেলো। বিশেষ করে সান্তাহারে, যেখানে ছয় হাজার বিহারী বাস করতো। আমরা দাঙ্গা বন্ধ করতে চেষ্টা করছিলাম এবং এ নিয়ে মেজর নাজমুল হক সহ কিছু স্থানীয় এমসিএ এবং এসডিও’র সাথে আমরা বৈঠক করি। মানুষের মনে যাতে কোনো সন্ত্রাসের সৃষ্টি না হয় তার চেষ্টা করি। ইয়াহিয়ার ভাষণ এবং সামরিক নির্দেশনাবলী শুনে সেদিন আমাদের মনে ক্ষোভ ও ভীতির সঞ্চার হয়।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় যখন সন্ধ্যার সময় বেতার কেন্দ্র খুলি তখন হঠাৎ করে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। বেতারের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। মনে সাহস হলো যে, অন্ততঃপক্ষে একজন অধিনায়ক হিসেবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সকলের মনে সাহসের সঞ্চার হলো এবং আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরোপুরিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম।

আমি আমার অপারেশনাল হেডকোয়ার্টার অফিস স্থাপন করলাম এবং মেজর নাজমুল হক সহ স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিকল্পনা শুরু করলাম। আমাদের পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে ছিলোঃ

(ক) অয়ারলেস স্টেশন সারাদিন খোলা থাকবে এবং ইপিআর-এর ১৭উইং-এর খবরাখবর মনিটর করা এবং সেগুলো অপারেশনাল হেডকোয়ার্টারে জানানো।
(খ) নিজের হেডকোয়ার্টার থেকে কোনো কথাবার্তা না বলা, শুধু শোনা।
(গ) পুলিশের অয়ারলেসগুলোতেও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং সেগুলোর মাধ্যমে যোগাযোগ করা কেননা সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অবস্থান ছিলোনা।
(ঘ) টেলিফোন ডিপার্টমেন্টকে বলা হয় যেনো বগুড়া এবং যে সমস্ত রাস্তা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের আসার সম্ভবনা আছে সে সমস্ত জায়গায় অন্ততঃপক্ষে পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত কয়েকটা প্রান জায়গার সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখে এবং সেখানকার স্থানীয় ছাত্রনেতা অথবা আওয়ামী লীগ নেতা যেনো আমাদেরকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত রাখে তার ব্যবস্থা করা।
(ঙ) সমস্ত বাস ট্রাক রিকুইজিশন করা হলো।
(চ) ছাত্রদের মধ্য থেকে ভলান্টিয়ার নেয়া হলো এবং কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে ডাকা হলো যেমন- জনাব বয়তুল্লাহ (বর্তমান ডেপুটি স্পীকার) এবং ছাত্রনেতা মোহাম্মদ আব্দুল জলিলকে ডাকা হলো।
(ছ) ছাত্রদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো এবং তাদেরকে রাইফেল দেয়া হলো।
(জ) অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ স্টোর থেকে সরিয়ে কিছু কিছু মাটির নিচে রাখা হলো যাতে করে জঙ্গী বিমানের হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
(ঝ) প্রধান হেডকোয়ার্টারের কিছু দূরে পেট্রোলিংয়ের ব্যবস্থা করা হলো এবং খবরাখবর সরবরাহের জন্য রানার নিয়োগ করা হলো।
(ঞ) এবং স্থির হলো যে নওগাঁ’কে আপাতত আমাদের রিয়ার হেডকোয়ার্টার করা হবে যেহেতু এটা শত্রুবাহিনীর জন্য দুর্গম স্থান।
(ট) এদিকে আমি ৬নং ইপিআর যেটা রাজশাহী ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারের অধীনে নওয়াবগঞ্জে অবস্থিত ছিলো তাদেরকে অয়ারলেসে বাংলায় কিছু নির্দেশাবলী দিতে শুরু করলাম। সেই উইংয়ে কোনো বাঙালি অফিসার ছিলো না। তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ছিলো। ২৬/২৭শে মার্চ রাত্রের গোলযোগের পর তারা উইং হেডকোয়ার্টার ছেড়ে রাজশাহীতে পালিয়ে আসে। সেই সুযোগে আমি সমস্ত উইং-এর লোকজনকে নওয়াবগঞ্জে একত্রিত হতে বলি বিওপি ছেড়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় তার নির্দেশ দেই।
(ঠ) সেখানে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ সরিয়ে ফেলে নিরাপদ জায়গায় রাখার নির্দেশ দেই। দেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাদের অবহিত করা হয় এবং তাদের উপর বিওপিতে হামলা হবার সম্ভাবনা আছে সে কথাও অবহিত করি।

২৭শে মার্চ পর্যন্ত আমাদের প্রস্তুতি চলে এবং রাজশাহী এবং রাজশাহী সেক্টরের নওগাঁ এবং নওয়াবগঞ্জের সমস্ত ইপিআরকে এক জায়গায় নিজ নিজ হেডকোয়ার্টারে একত্রিত করা হয়।

২৭শে মার্চ আনুমানিক বেলা ১১টার সময় আমাকে পুলিশের অয়ারলেসেযোগে রাজশাহীর ডিসি ডাকেন। তার সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন যে, রাজশাহী পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ঘেরাও করে আছে এবং পুলিশদের আত্মসমর্পণ করতে আদেশ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কেউই আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত নয়। তিনি এবং এসপি তাদের সাথেই আছেন। যদি সম্ভব হয় কিছু ইপিআর-এর লোক যেন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আর আধঘণ্টা সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে পুলিশ লাইনের উপর আক্রমণ চালাবে এবং তার মর্টার ইত্যাদি স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু আমি তাকে বললাম কি করে এত অল্প সময়ের মধ্যে ৬০ মাইল কাঁচা রাস্তা (নওগাঁ থেকে রাজশাহী) যাওয়া সম্ভব? একথা শেষ হতে না হতে ডিসি অয়ারলেস ছেঁড়ে দিলেন এবং আমি অপারেটরের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। সে বলছিল, গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে- এরপর আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অনেক চেষ্টার পরও কোন খবর পাওয়া গেল না। এদিকে আমরা খবর পেলাম যে বগুড়ার আর্টিলারী রেজিমেন্ট-এর একটা ব্যাটারী আছে যেটাকে এখন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ডিউটির জন্য মুভ করানো হয়েছে এবং তারা সেখানকার গার্লস স্কুলে অবস্থান করছে।

প্রতিরোধের পরিকল্পনাঃ আমি মেজর নজমুল হক সহ পরিকল্পনা করলাম যে ২৮শে মার্চ প্রথমতঃ এক কোম্পানী ইপিআর ফোর্স নাটোরের রাস্তা দিয়ে সারদায় পাঠাব ক্যাডেট কলেজের এডজুট্যান্ট মেজর রশিদের কাছে। এবং রংপুর থেকে রাজশাহী যাবার রাস্তা বগুড়ায় বিচ্ছিন্ন করে দেব। অন্যথায় মেজর রশিদ তার ফোর্সসহ ঢাকা থেকে রিইনফোর্সমেন্ট নিয়ে রাজশাহী আসার রাস্তা বিচ্ছিন্ন করে দেবে।

২৮শে মার্চ বিকেলে আমি পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার লোকজন নিয়ে বগুড়ায় পৌঁছে গেলাম যার দূরুত্ব আনুমানিক ৩০ মাইল। কিন্তু রাস্তায় ব্যারিকেড থাকাতে আমাকে সকাল দশটায় রওয়ানা হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় পৌঁছতে হয়েছিল। সেখানে গিয়ে দেখি শহরের লোকজন নেই বললেই চলে। সব মিলে হাজার খানেক লোক হবে কি না সন্দেহ। পরিবার বলতে কারোরই ছিল না। একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল এবং গাড়ীর আওয়াজ শুনে এবং লাইট দেখে সবাই পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগেও এখানে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে স্থানীয় লোকের সামান্য গোলাগুলি হয়েছিল, সন্ধ্যা হতে না হতেই শহর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেল এবং শহরের রাস্তাগুলো ছিল ব্যারিকেডপূর্ণ।

বগুড়ায় সংঘর্ষঃ আমি প্রথমে পুলিশ লাইনে গেলাম। সেখানে একজন বেশ সাহসী রিজার্ভ পুলিশ ইন্সপেক্টর এবং শ’দুয়েক পুলিশ দেখতে পেলাম। আমাদেরকে দেখতে পেয়ে তারা অনেকটা সাহস পেল এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমাদেরকে জ্ঞাত করল। আমি জানতে পারলাম যে তারা (আর্টিলারী ব্যাটারী) আপাততঃ রংপুর থেকে কোন ফ্রেশ সাপ্লাই পাচ্ছে না যেহেতু রাস্তাঘাট বন্ধ। তবে তারা প্রায়ই গ্রামের পথে গাড়ী নিয়ে যায় এবং তরিতরকারি ও মাংস সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। আমার জানা ছিল যে আর্টিলারী ব্যাটারীতে ৫০/৬০ জনের বেশী লোক হতে পারে না এবং তাদের ততোটা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হবার নিপুণতা নেই। সেহেতু প্রথমতঃ পরিকল্পনা করলাম যে গ্রামে যাবার পথে অথরা পেট্রলিং-এর সময় তাদেরকে এমবুশ করা সহজসাধ্য হবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৯/৩০শে মার্চ রাতে একটা এমবুশ পার্টি করলাম। এতে ছিল নওগাঁ থেকে আসা কয়েকজন ছাত্র ও ইপিআর ও পুলিশের লোকজন। তিনখানা ৩ টনী গাড়ীসহ সেনাবাহিনীর কয়েকজন কমপক্ষে এক প্লাটুন পেট্রলিংয়ে বের হয় এবং রাস্তার মধ্যে আমাদের লোকজন তাদের কে এমবুশ করে। তিনটি গাড়ী বিধ্বস্ত হয়। তিনটি অয়ারলেস সেট দখল করা হয় এবং ২৩ জন নিহত হয়। বাকি লোক ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় রংপুরের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। এই এমবুশে আমাদের সৈনিকদের মনোবল অনেক বৃদ্ধি পায়।

বগুড়াতে তখন একটা এমুনিশন ড্যাম্প ছিল, যেটা একজন ক্যাপ্টেন কমাণ্ড করছিল। ওখানে মাত্র ২০/২৫ জন সৈনিক প্রহরা দিচ্ছিল। আমি সবাইকে একত্রিত করে কিভাবে এমুনিশন ড্যাম্প দখল করতে হবে, বিশেষ করে এর চারিদিকে ঘেরাও করে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করতে হবে তার ব্যবস্থা করি। ঘেরাও করার জন্য গ্রাম থেকে কিছু লোক যোগাড় করা হল। এবং এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ঘেরাও করে গোলাবারুদ বের করে নেয়ার জন্য নির্দেশাবলী দিয়ে আমি আমার সুবেদার সাহেবকে রেখে নওগাঁ চলে আসি, যেহেতু আমার সেখানে যাবার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

পরিকল্পনা অনুযায়ী এমুনিশন ড্যাম্প ঘেরাও করা হয়েছিল এবং ক্যাপ্টেন তার লোকজনসহ আত্মসমর্পণ করে। অধিকাংশ গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে নিয়ে যায় এবং বাকিগুলো পানিতে ফেলে দেয়া হয়।

বগুড়া থাকাকালীন সময়ে অয়ারলেসে মেজর শফিউল্লাহর সাথে আমার কথা হয়। তিনি বললেন যে, কিশোরগঞ্জের কাছে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে যমুনা নদীর কাছে তিনি আছেন, আমরা যেন ওখানে গিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করি। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, উত্তরাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার। সেখান থেকে একজন লোক পাঠিয়েছিলাম তাঁর কাছে। কিন্তু খবর পাওয়া গেল তিনি সিলেটের দিকে রওয়ানা হয়ে গেছেন।

নওগাঁতে মেজর নজমুল হকসহ আবার পরিকল্পনা শুরু করলাম। এদিকে খবর পাওয়া গেল যে, ইপিআর কোম্পানী রাজশাহীর পথে মর্টার এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাঠানো হয়েছে। সেটা রাজশাহীর নিকটবর্তী আড়ানী নামক রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ২৫ পাঞ্জাবীর এক কোম্পানীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে ২৯/৩০ মার্চ রাতে তাদের সাথে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা এবং গ্রামের লোক যোগ দিয়েছে। এই পাকিস্তানী কোম্পানীটি পাবনা থেকে পশ্চাদপসরণ করে তাদের নিজের ব্যাটালিয়নের দিকে পদব্রজে রাজশাহী আসছিল। কোম্পানীটি সম্পূর্ণরূপে ঘেরাও হয়ে যায় এবং ইপিআর কোম্পানী তাদের উপর ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলা বর্ষণ করতে শুরু করে। শত্রুবাহিনী দিশেহারা হয়ে গোলাগুলি শুরু করে এবং অনেকক্ষণ গোলাগুলি বিনিময় হয়। শেষ রাতের দিকে শত্রুবাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায় এবং প্রাণ বাঁচাবার উদ্দেশ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক সেদিক পালাতে শুরু করে। কিন্তু গ্রামের লোক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রায় সবাই ধরা পড়ে এবং তারা গ্রামবাসিদের হাতে নিহত হয়। মেজর আসলাম এবং ক্যাপ্টেন রেজা (উপঅধিনায়ক) মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়ে এবং আড়ানী স্টেশনের কাছে নিহত হয়।

শত্রুবাহিনীর মনোবল খুবই ভেঙ্গে পড়ে এবং সেই সুযোগে আমি এক কোম্পানী ইপিআর নিয়ে নওগাঁ থেকে ৩১শে মার্চ রাজশাহীর পথে রওয়ানা হই। নওয়াবগঞ্জের উইংকে নির্দেশ দিই তারা যেন নওয়াবগঞ্জ থেকে পদব্রজে অগ্রসর হয় এবং শত্রুও মোকাবেলা করতে যেন প্রস্তুত থাকে। অনেক ব্যারিকেড অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত রাজশাহীর অদূরে নওহাটা (মত্রঘাটি হতে মাত্র দুই মাইল দূরে) আমি আমার লোকজন নিয়ে অবস্থান নেই এবং অন্যদিকে অগ্রসরমান নওয়াবগঞ্জের ইপিআর উইং (যেখানে ৫০০ সশস্ত্র লোক ছিল)-এর সাথে যোগাযোগ করি।

সেই রাতে আমি কিছু লোক নওহাটায় রেখে রাজশাহী থেকে ছয় মাইল দূরে খরচক্কা (রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জ রাস্তার উপর) নামক স্থানে ইপিআর-এ অগ্রসরমান লোকদের সাথে দেখা করি এবং সম্পূর্ণ সেনাবাহিনীকে আমার অধীনে নিয়োজিত করি। সেই রাতে ২৫ পাঞ্জাবের একটি পেট্রল বাহিনী তিনখানা গাড়ী নিয়ে সেই রাস্তায় আসে এবং আমাদের বাহিনী অতর্কিতে তাদেরকে এমবুশ করে। আমরা ওদের ৭ জনকে নিহত এবং একজনকে জীবিত ধরতে সক্ষম হই। সেই বন্দীর কাছ থেকে জানা যায় যে ক্যাপ্টেন সালমান নামক এক অফিসার তাদের পেট্রল পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছিল এবং একটা প্লাটুন পেট্রলিংএ এসেছিল। ওদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং আহত-নিহতদের অধিকাংশকে নিয়ে চলে যায়। এতে আমাদের লোকজনের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। এবং আমার লোকজন ত্বরিত বেগে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়।

১লা এপ্রিল ভোর ছটার মধ্যে আমরা রাজশাহী শহরের অদূরে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করি। আমাদের পেট্রোল বাহিনী নিয়োগ করি খবরাখবর আনার জন্য। আমার পূর্বদিকে মেজর রশীদের নেতৃত্বে যে সমস্ত লোকজন পাঠানো হয়েছিল তাদের তাদের সাথেও যোগাযোগ করি এবং তাদেরকে বলা হয় যেন তারা সারদা থেকে অগ্রসর হয়ে রাজশাহীর পূর্বদিকে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে।

এদিকে আমার সশস্ত্রবাহিনীর সংখ্যা পুলিশ; আনসার মুজাহিদ; ছাত্র; ইপিআর মিলে একহাজারের ওপরে পৌছে যায়। শত্রুবাহিনী রাজশাহীর চারিদিকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ আরো শক্তিশালী করে এবং তাদের স্বয়ংক্রিয় ভারী অস্ত্র প্রধান পথে মোতায়েন করে, শত্রুবাহিনী আমাদের শক্তি এবং সংখ্যা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয় এবং তাদের জংগী বিমান ঢাকা থেকে সাহায্যের জন্য আসে। ১লা এপ্রিল থেকে ৫ই এপ্রিল প্রত্যহ দু’একবার করে বিমান হামলা চলে; কিন্তু রাজশাহীর চতুর্দিকে আম্রকুঞ্জ থাকায় এবং তার নীচে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি হওয়ায় শত্রুবাহিনীর বিমান গুলো আমাদের অবস্থান নির্ণয় করতে পারেনি এবং আমাদের বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারেনি। তবে বেসামরিক অনেক লোকজন মারা যায় এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।

৩রা এপ্রিল ভারত থেকে বিএসএফ-এর একজন লেঃ কর্নেল সেন এবং মেজর ত্রিবেদী নামে দুজন অফিসার আমার সাথে দেখা করতে আসেন এবং আমার কি প্রয়োজন জিজ্ঞেস করেন। আমি তাদেরকে কিছু আর্টিলারী ফায়ার-এর সাপোর্ট দিতে বলি তাদের সীমানা থেকে। সীমান্ত নিকটে থাকায় এটা সম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি জানালেন যে; এটা তাদের দ্বারা সম্ভব নয়; তবে তিনি কতৃপক্ষকে বলবেন তবে যদি কোন রাইফেল এলএমজি চান দিতে পারি। কিন্তু আমি তাঁকে বললাম যে; এখন আমার কাছে ১২টা ৩ ইঞ্চি মর্টার; একশোর উপর এলএমজি-এমজি এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ আছে। তাই আমার এগুলো দরকার নেই। বিমান হামলা মোকাবেলা করার জন্য ভারতীয় সীমান্ত থেকে কিছু বিমান বিধ্বংসী কামান দিয়ে সাহায্য করতে অনুরোধ করলাম। আমি তাকে আরো বললাম যে ৬ই এপ্রিল আমি রাজশাহী আক্রমণ করব বলে স্থির করেছি, সে দিন যেন আমাকে আর্টিলারী ফায়ার সাপোর্ট দেয়া হয়।

রাজশাহী যুদ্ধঃ আমার পরিকল্পনা ছিল শহরে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালানো এক ব্যাটালিয়ন নিয়ে। আর কিছু লোক উত্তর পশ্চিম দিকে শত্রুকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কিছু গোলাগুলি করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে ব্যাটালিয়নকে দক্ষিণ দিকে মুভ করিয়ে আনি এবং আক্রমণের প্রস্তুতি নিই; এদিকে জানতে পারলাম বন্ধুরাষ্ট্র থেকে সাহায্য পাবার কোন সম্ভাবনা নেই এবং তা কখনো আসেনি।

আক্রমণ শুরু হয় ৬ই এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টা-৭টার দিকে। শত্রুবাহিনী আমাদের উপর প্রবল গোলাবর্ষণ এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে গুলি বর্ষণ করতে শুরু করে। অদম্য সাহস মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মুখে ঠেলে নিয়ে যায় এবং শত্রুদের ব্যূহ ভেদ করে তারা শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। প্রায় যার ঘণ্টা লড়াইয়ের পর রাজশাহী শত্রুমুক্ত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহীর চতুর্দিকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে ফেলে। পশ্চিম বাহিনীর বেশ কিছুসংখ্যক লোক নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ৩০/৩৫ জন হতাহত হয়। রাজশাহী পুলিশ লাইন প্রভৃতি জায়গা থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করি। রাজশাহী পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার থেকে প্রায় তিন হাজার অস্ত্র, তিন লাখ গুলি উদ্ধার করা হয়। বাকি শত্রুবাহিনী তাদের ছাউনি পশ্চাদপসরণ করে এবং সেখানে একত্রিত হয়ে আরো শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে। ছাউনির চারিদিকে মাইন পুঁতে রাখে এবং কাঁটা তারের বেড়া দিতে শুরু করে। শহরের লোকের মধ্যে উল্লাস সৃষ্টি হয়। এবং আমাদের পূর্ববতী কর্মসুচী ঐ ছাউনি দখল করার কাজে নিযুক্ত হয়। এদিকে শত্রুবাহিনী বিমান হামলা আমাদের উপর অব্যাহত রাখে।

৭ই এপ্রিল থেকে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত আমরা শত্রুবাহীর অতি নিকটে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলি এবং ছাউনির ৩০০/৪০০ গজের মধ্যে পৌছে যাই। কিন্তু শত্রুবাহিনীর মাইন এবং কাঁটা তারের বেড়া ডিংগিয়ে ভিতরে গিয়ে আক্রমণ চালানো বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। শত্রুবাহিনী সমস্ত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশত্র; ট্যাঙ্কবিধ্বংসী কামান; তিন ইঞ্চি মর্টার ইত্যাদি বাইরের দিকে মুখ করে বসিয়ে রাখে। সেই সময় আমরা জানতে পারি সেখানে শত্রুবাহিনীর ২৫০ থেকে ৩০০ সৈন্য আছে। বাকি নিহত; আহত অথবা নিখোঁজ। আরো জানতে পারি যে তাদের ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল শওকত; বেলুচ; সিতারা-ই-জুরাত যিনি ৭ই এপ্রিল আমাদের সাথে যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন; এবং তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। প্রচণ্ড আক্রমনের সম্মুখে শত্রুবাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণভাবে ভেংগে যায়। শত্রুবাহিনী সে এলাকায় সমস্ত বিহারীকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র বিতরণ করে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে তাদেরকে সাহায্য করতে নির্দেশ দেয়।

এদিকে আমরা ছাউনি দখল করার শেষ প্রচেষ্টায় নিজেদের নিয়োজিত করি। তখন খবর পাওয়া গেল যে; পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই ডিভিশন সৈন্য নগরবাড়ী ঘাটে অবতরণ করার চেষ্টা করছে হেলিকপ্টার; স্টীমার ফেরীর মাধ্যমে। অতর্কিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রিইনফোর্সমেন্ট-এর কথা শুনে সকলের মনোবল ভাঙ্গতে শুরু্ করে। কিন্তু সকলকে আশ্বাস দিয়ে আমি বলি যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারা যেন তাদের কাজ চালিয়ে যায়।

আমি দুটো কোম্পানি সেখান থেকে উঠিয়ে নগরবাড়ীর দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিই। ১১ই এপ্রিল বিকেল বেলায় আমাদের বাহিনী যখন পাবনার অনতিদূরে পৌছে তখন পাবনা শহরের উপর শত্রুবাহিনীর মর্টার এবং আর্টিলারী ফায়ার হচ্ছিল। তখন ঐ দুই কোম্পানি মুলাহলী নামক স্থানে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে কিন্তু তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তারা শত্রুবাহিনীর জংগী বিমানের হামলা এবং আর্টিলারীর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র ও অসংখ্য সশস্ত্র সৈন্যদের বিরুদ্ধে কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর টিকতে না পেরে পশ্চাদপসরণ করে।

এদিকে আমি ১২ই এপ্রিল সকাল বেলায় আমার সেনাবাহিনীর মনোবল অটুট রাখার জন্য নিজে এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে পাবনার দিকে অগ্রসর হই এবং বাকি সংগ্রামী সৈনিকদের ছাউনির উপর তাদের চাপ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিই। ১০মাইল পথ অতিক্রম করার পর আমি খবর পেলাম যে শত্রুবাহিনী অতি নিকটে পৌছে গেছে এবং আসার পথে দু পাশে বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অগ্রসর হচ্ছে এবং আমি নিজেও তাঁর ধোয়া দেখতে পেলাম। এমতাবস্থায় আমি সারদা এবং রাজশাহী যাওার মোড়ে আমার শেষ প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করি।

১২ই এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে আমাদের প্রতিরক্ষার এক হাজার গজ দূরে রাস্তা কেটে দেয়া হল এবং বড় গাছে কেটে ব্যারিকেডের মধ্যে বুবিট্র্যাপস ও কিছু মাইন দু পাশে পুঁতে রাখলাম। ১২ই এপ্রিল সন্ধ্যা নাগাদ পাকিস্তান সেখানে পৌছাল এবং ব্যারিকেড সরাতে চেষ্টা করল। বুবিট্র্যাপ ফেটে বেশ কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়। আমাদের ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে অগ্রসরমান শত্রুবাহিনীর উপর গুলিবর্ষণ করা হল। সারা রাত দু’পক্ষের তুমুল লড়াই চলে এবং সারদার কাছে সারদা ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক এ;বি;সিদ্দিকী যাকে আমি বীর বিক্রম (মৃত্যুর পর) উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

এরপর ১৩ই এপ্রিল ভোরের দিকে পাক সেনাবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌছে যায় এবং অবস্থান করতে থাকে। আমার সৈন্যরা তখনও মনোবল অটুট এবং শহরের চারিদিকে প্রতিরক্ষা ব্যূহ অব্যাহত রাখে। ছাউনি দখল করার জন্য তখনও তাদের চাপ অব্যাহত থাকে।

১৩/১৪ এপ্রিল রাত দুটোর দিকে বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ শুরু হয় এবং শত্রুর গোলন্দাজ বাহিনী বিপুলভাবে গোলাবর্ষণ শুরু করে। যতোই ভোর হতে থাকে আমার লোকদের সাথে আমার অয়ারলেস এবং টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক ব্রিগেড সৈন্য আমার সৈন্যদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমার সৈন্যদের অপসারিত করা হয় এবং তারা নওয়াবগঞ্জের দিকে সরে আসে।

নওয়াবগঞ্জের প্রতিরোধঃ বেলা প্রায় দুই ঘটিকার সময় আমি আমার এক হাজার সেনাবাহিনীর মধ্যে মাত্র ৩ শতকে খুঁজে পাই এবং তাদের নিয়ে রাজশাহী এবং নওয়াবগঞ্জের মাঝখানে গোদাগাড়ী নামক স্থানে আমার প্রতিরক্ষা ব্যূহ পুনরায় তৈরি করি। এটা রাজশাহী থেকে ১৮ মাইল এবং নওয়াবগঞ্জ থেকে ১১ মাইল দূরে ছিল। রাজশাহীর যুদ্ধে আমার ৩৫/৪০ জন নিহত হয়। এতে আমাদের সৈন্যদের মনোবল একেবারে ভেংগে পড়ে।

আমার সাথে নুরুল ইসলাম নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ১৫ই এপ্রিল সে ভারতে চলে যায় এবং ১৬ তারিখ সে আমাকে এসে খবর দেয় যে মুর্শিদাবাদ জেলার জেলা প্রশাসক এবং বিএসএফ-এর কমান্ডার আমার সাথে জরুরী কাজে দেখা করতে চান এবং তিনি আমাকে সাহায্য দিতে প্রস্তুত আছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নুরুল ইসলাম নামের সেই ছাত্রটির সাথে ১৬ই এপ্রিল মু্র্শিদাবাদে ওদের সাথে দেখা করতে গেলাম। কিন্তু এতে কোন ফলই হল না। কোন সাহায্যই পাওয়া গেল না। নিরাশ হয়ে ফিরে আসলাম।

১৭ই এপ্রিল সকালের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের অবস্থানের উপর এবং নও্যাবগঞ্জ শহরের উপর হামলা চালাল। জংগী বিমানের সাহায্যে রকেট এবং মেশিনগানের প্রচণ্ড হামলা চালায়; কিন্তু আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেংগে নওয়াবগঞ্জ পৌছতে তখনও সক্ষম হয়নি।

২১শে এপ্রিল খুব ভোরের দিকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু হল আমাদের অবস্থানের উপর এবং শত্রুবাহিনী আক্রমণ চালাল। আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ শত্রুবাহিনী ভেদ করতে সক্ষম হল বেলা দশটার দিকে। প্রতিরক্ষা ব্যূহের নিকতেই ছিল পদ্মা নদী। সেখানে আমার সাবেক ইপিআর-এর দু খানা স্পীড বোট ছিল; যাতে করে আমি লড়াই চলাকালে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র; গোলাবারুদ নদী পার করে বাংলাদেশের ভেতরেই চর এলাকায় পৌছে দিয়েছিলাম। শত্রুবাহিনী ত্বরিত গতিতে নওয়াবগঞ্জসহ প্রায় সমস্ত এলাকায়; নওয়াবগঞ্জের চর এলাকা ছাড়া শত্রুকবলিত হয়। সেখানেই আমার সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি।

ক্ষোভে; দুঃখে এবং হতাশায় আমি যখন নিমজ্জিত তখন বিএসএফ-এর কয়েকজন লোক আমাকে খবর দিল যে; আমাকে মেজর দারাস বলে একজন অফিসার আমার সাথে দেখা করতে চান। অগত্যা তার সাথে দেখা করতে গেলাম। সে আমাকে বললো; আমি যেন আমার সমস্ত জিনিস এবং অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদসহ লালগোলায় (মুর্শিদাবাদ) পৌছে যাই। ২২শে এপ্রিল আমি আমার তিন হাজারের উপর রাইফেল; স্টেনগান; এল-এম-জি এবং গোলাবারুদ নিয়ে লালগোলায় পোঁছালাম। পৌঁছুতে না পৌঁছুতে বিএসএফ-এর দুখানা ট্রাক এসে আমাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ নিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে গেল। তবে সামান্য কিছু রাইফেল আমাদের কাছে রেখে গেল।

এদিকে আমাকে খবর দেয়া হল যে কর্নেল ওসমানী আমাদের সাথে বালুর ঘাটে (দিনাজপুর) ২৩শে এপ্রিল দেখা করতে চান। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা সেখানে পৌছলাম এবং এই প্রথম এম-সি এর সাথে দেখা হয়। কর্নেল ওসমানী সেদিন আমাকে সে এলাকার অধিনায়ক নিযুক্ত করেন এবং বলেন যে বিএসএফ আমাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ খাদ্য প্রভৃতি দিয়ে সাহায্য করবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!