সশস্ত্র প্রতিরোধে দিনাজপুর
সাক্ষাৎকারঃ হাবিলদার বাসারত উল্লাহ
১৬-১১-১৯৭৪
২৫শে মার্চ আমি দিনাজপুর ৪নং সেক্টর কুটিবাড়ীতে ৮নং উইং এর ‘সি’ কোম্পানীতে ছিলাম।আমরা তখন উইং হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। ৮নং শাখার কমান্ডার ছিল মেজর আমীন তারিক (পাঞ্জাবী)। সহ উইং কমান্ডার ছিল বাঙালি নজরুল ইসলাম এবং অপরজন পাঞ্জাবী ছিল।উইং হেডকোয়ার্টারে ‘সি’ কোম্পানী ছিল। কমান্ডার ছিল আতাউল হক। ‘বি’ কোম্পানী হিলি এলাকাতে ছিল, কমান্ডার ছিল সুবেদার আবদুস শুকুর। ‘এ’ কোম্পানী ছিল চাপাসারে, কমান্ডার ছিল আখতারুজ্জামান। ‘ই’ কোম্পানী ছিল বিরলে, কমান্ডার ছিল সুবেদার বাদশা আহমদ (বিহারী)।
দিনাজপুর সার্কিট হাউসে বেলুচ রেজিমেন্টের এক প্লাটুনের কিছু বেশী পুরা আধুনিক অস্ত্রে জানুয়ারী থেকে অবস্থান করছিল।পাক আর্মির ৩জন অয়ারলেস সেট নিয়ে উইং হেডকোয়ার্টারের মধ্যে থাকতো।৩জন আর্মির মধ্যে একজন বাঙালি সিগন্যালম্যান ছিল।আমি ওখানে গেলে তারা কথাবার্তা বন্ধ করে দিত।বাঙালি অপারেটরটি অপর দুজন পাঞ্জাবীকে ২৮ তারিখ দুপুরে ‘তোমরা অগ্রসর হও আমি যাচ্ছ’, এই বলে আমাদের সিগনাল সেন্টারে আসে এবং বলে ‘যদি পাকিস্তানীদের আক্রমণ করতে হয় তবে এখনই করো, পাকসেনারা কিছুক্ষনের মধ্যে তোমাদের উপর আক্রমণ করবে’। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আক্রমণের।
হাবিলদার ভুলু মিয়া, নায়েক সুবেদার মোসলেম, সুবেদার মোমিনুল হক এদের নেতৃত্বে ২৮শে মার্চ রবিবার প্রায় ২টা৪৫মিনিটে উইং –এর সকল অবাঙালি ইপিআরদের উপর আক্রমণ করি। আমরা উইং এবংসেক্টর হেডকোয়ার্টার দখল করে নিই সন্ধ্যার মধ্যে। সকল অস্ত্র আমরা আমাদের আওতায় নিয়ে আসলাম। ঐ তারিখেই পাকসেনারা আমাদেরকে আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় ।
৩১শে মার্চ পর্যন্ত আমরা কুটিবাড়ীতেই (উইং হেডকোয়ার্টারে) ছিলাম।সীমান্ত এলাকার কোম্পানীগুলো কুটিবাড়ীতে চলে আসে। ৩১শে মার্চ বিকাল থেকে হাবিলদার নাজিমউদ্দিন ৬পাউন্ডার ছুঁড়তে থাকে পাক ঘাঁটির উপর।একই সাথে আমরা ব্যপকভাবে আক্রমণ করি। ঐ তারিখ রাতেই পাকসেনারা দিনাজপুর থেকে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা পার্বতীপুরের দিকে যায়। পথে বহু পাকসেনা জনতার হাতে নিহত হয়।
নায়েক সুবেদার কাউসারের নেতৃত্বে একটি প্লাটুন রংপুরের বদরগঞ্জ পৌঁছায়। সৈয়দপুর থেকে পাকসেনারা যাতে দিনাজপুরে না আসতে পারে সেজন্য বদরগঞ্জে ডিফেন্স নিই।আমাদের সামনে নদীর পাড়ে এক প্লাটুনের মত বেঙ্গল রেজিমেন্টের অংশ ছিল।
অনুমান ৮/৯ ই এপ্রিল বদরগঞ্জের পতন ঘটে পাক বাহিনীর হাতে। আমরা পিছু হটে ফুলবাড়ীতে আসলাম। ওখানে সুবেদার শুকুর সাহেব তার ফোর্স নিয়ে আগে থেকেই ছিল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈন্য ও ছিল। পরদিন আমরা দিনাজপুর চলে আসলাম। এরপর কাউঘর মোড়ে যাই। হাবিলদার আবদুস সোবাহানের নেতৃত্বে ঐ মোড়ে ডিফেন্স নিই।নায়েক সুবেদার মোমিনুল হক সাপোর্ট প্লাটুন নিয়ে আমাদের পিছনে থাকলো। ফুলবাড়ী- দিনাজপুর আমরা ডিফেন্স নিলাম। এখান থেকে শিয়ালগাজী মাজারের পার্শ্বে নায়েক সুবেদার মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে ডিফেন্স নিই।
১৩ই এপ্রিল সাড়ে ১২ টার সময় রাজবাড়ীর দিক থেকে শহরের পূর্বপাশ দিয়ে সৈয়দপুর- দিনাজপুর রাস্তার বাম দিক থেকে পাকবাহিনী আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্টিলারী ও ট্যাঙ্ক নিয়ে। পাকবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে এখানকার বিভিন্ন আমাদের লোকেরা বিচ্ছিন্নভাবে পিছু হটতে থাকে ।সন্ধ্যার পূর্বেই পাকসেনা দিনাজপুর শহর দখল করে নেয়।
শহর পতনের পর আমরা নদীর অপর পাড়ে আশ্রয় নিই। আমরা বিরল সীমান্তের দিকে অগ্রসর হই। বিরলে (ভারতীয় সীমান্ত থেকে ৬ মাইল ভিতরে) ডিফেন্স নিই। বিরলে ২০০ মত ইপিআর আসে।
১৭/১৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী আমাদের বিরল ডিফেন্সের উপর আক্রমণচালায়। মুসলিম লীগ ও জামায়েত ইসলামীর লোকেরা আমাদের অবস্থানগুলো পাকবাহিনীর কাছে প্রকাশ করে দেয়। এই যুদ্ধে বিরলের পতন ঘটে।এখান থেকে কিশোরীগঞ্জ এলাকাতে ডিফেন্স নিই।
২০/২১শে এপ্রিল পাকসেনা আমাদের কিশোরীগঞ্জ ডিফেন্স আক্রমণ করে। কিশোরীগঞ্জের পতন ঘটলো পাকবাহিনীর হাতে।আমরা আরও পিছু হটলাম।একদম সীমান্ত বরাবর আমরা ডিফেন্স লাগালাম। পাকসেনারা কিশোরীগঞ্জ থেকে মাইকযোগে আমাদের গালাগালি করতে থাকে। ৮নং শাখার সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন চিমা, নায়েক সুবেদার নিয়ামতউল্লা আমাদের গালাগালি করতে থাকে। পাকসেনারা প্রতিটি জায়গা দখলের পর আগুন লাগিয়ে সমগ্র এলাকা ধ্বংস করে হত্যাযজ্ঞ চালায়, তারা হাজার হাজার মণ চাউল পুড়িয়ে দেয়।
অনুমান ২৪শে এপ্রিল ফ্ল্যাগ মিটিং হয়। সেখানে পাকসেনারা ইপিআর’দের হ্যাণ্ডওভার করার জন্য জানায়। ২৫/ ২৬ শে এপ্রিল রাধিকাপুর এবং আমাদের অবস্থানের উপর বিমান হামলা চালায়। বি এস এফ অবস্থানের উপরও বোমা ফেলে।আমরা ভারতে আশ্রয় নিলাম এক আমবাগানে। আমাদের সাথে প্রচুর গোলাবারুদ ছিল। ডালিমগাঁও যাই,সেখানে সকল অস্ত্র জমা দেই।ট্রেনিং ক্যাম্প খুলে দেওয়া শুরু হয়। দেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে থাকি।
——————————————–