You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিচিত্রা

২১শে মার্চ ১৯৭৫

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বিচিত্রার বিশেষ সাক্ষাৎকারে উপাচার্য আবুল ফজল

আমার কোন মোহ নেই তাই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারি  

ক্যাম্পাসে মহিলা ক্লাবের একটা অনুষ্ঠান ছিল। সেখান থেকে রাত আটটার দিকে সস্ত্রীক ফিরে এসেছেন মাত্র। ঠিক তক্ষুণি আমরা গেলাম তার বাসায় প্রাসাদোপম উপাচার্য ভবনে নয়। জুবিলী রোডে তার সেই পুরোনো বাসায় ঃ সাহিত্য নিকেতনে। খবর পেয়ে এলেন তিনি বসবার ঘরে। সাদা দাড়ি, চুল, সৌম্য চেহারার প্রবীণ জ্ঞানতাপস কথাশিল্পী আবুল ফজল। কিন্তু আমার সাহিত্যিক আবুল ফজলের কাছে আসিনি। এসেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেল আবুল ফজলের কাছে।

বিচিত্রা’র পক্ষ থেকে আমরা তাকে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করি। তিনি আমাদের সব প্রশ্নেরই জবাব দেন। শুধু জবাব দেননি একটা প্রশ্নের। প্রশ্নটি ছিল রাজনীতি সংক্রান্ত। প্রশ্ন করেছিলাম, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্পর্কে আপনার কি মত? তিনি বললেন, শেখ সাহেব ঠিক কি করতে চাচ্ছেন তা এখনো আমার কাছে পরিষ্কার নয়। তাই এক্ষুণি পরিষ্কার নয়। তাই এক্ষুণি কোন মন্তব্য করবো না।

পরণে ঘিরে রঙের পাঞ্জাবী, সাদা লুঙ্গী। আবুল ফজল সাহেব বসেছেন তাদের বসবার ঘরে। নানা রকম বইপত্রে ঠাসা এই কামরা। দেয়ালে ঝুলছে

জয়নুল আবেদীনের আকা ছবি। একটা শেলফে আবুল ফজলের নিজের প্রতিকৃতি। টেবিলে ছড়ানো নানা রকম পত্রপত্রিকা। লেখকদের কাছ থেকে উপহার পাওয়া বই।

আমাদের এক প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য আবুল ফজল বললেন ঃ এখন আমাদের সমস্যাটা হলো যাওয়া-আসার সমস্যা। আগে বাসে করে ছাত্রছাত্রীরা আসতো। এই বাবদ বছরে খরচ হয়ে যেতো সাত-আট লাখ টাকা। আমি আসার পর রেলওয়ের সাথে একটা ব্যবস্থা করে শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা করি। তারজন্যে রেলওয়েকে মাসে দিতে হয় ১২ হাজার টাকা। ছাত্রদের থেকে আমরা নিই মাসে ৫ টাকা। সেটা রেলের জন্য নয়। স্টেশন থেকে ফ্যাকাল্টির দুরত্ব এক মাইল। এই পথটুকু ছাত্ররা যায় বাসে করে। বছরে আট মাস ক্লাস চলে। এই আট মাসের জন্য রেলওয়েকে দিই ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।

আমাদের প্রশ্ন ঃ তাহলে এই আনা-নেওয়ার সমস্যার স্থায়ী সমাধান কি হতে পারে? উপাচার্য বলেন, সম্পূর্ণ আবাসিক করাই স্থায়ী সমাধান। সরকার আমাদের যে টাকা দেয় তা দিয়ে নতুন নতুন হল নির্মাণ করা যায় না।

তাহলে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা কদ্দুর? উপাচার্য বলেন, প্রায় এক কোটি টাকা আমাদের এখনো দেনা আছে। নির্মাণকাজের জন্য কন্ট্রাক্টররা নির্মাণকাজের অগ্রাধিকার বিচারে সুবিবেচনা হয়নি। অতীতে প্রচুর টাকা বিশ্ববিদ্যালয় খরচ হয়েছে কিন্তু তার বেনিফিট বিশ্ববিদ্যালয় পায়নি। নতুন নতুন ভবন নির্মাণের আগে আমাদের দরকার বকেয়া ১ কোটি টাকা শোধ করা। এই দেনার দায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে বাচাতে হবে।

আমরা যে দিন ভিসি’র সাথে কথা বলছিলাম ঠিক তার আগের দিন চ্ট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। সেই পরীক্ষায় ২০৮১ জনের মধ্যে ৩৩ জন পাস করেছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা উপাচার্যের মত জানতে চাইলাম, তিনি বললেন আমরা পরীক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে খুবই সীরিয়স। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা বাইরের সব কলেজে পালা করে গিয়েছেন। এই পর্যবেক্ষকদলের সফর খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। অবশ্য পর্যবেক্ষকদলের তৎপরতায় মফস্বলের বহু পরীক্ষার্থী পরীক্ষা ড্রপ করেছে। যারা দিয়েছে তাদের মধ্যে পাস করেছে মোট তেত্রিশ জন। 

তাকে প্রশ্ন করা হলো, ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আপনি কি অবহিত?

ভিসি বললেন, কোন অকৃতকার্য ছাত্র এ পর্যন্ত আমাকে এসে কিছু বলে নাই। যদি কেউ বলতে আসে তাকে বোঝাতে পারবো এই বিশ্বাস আমার আছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে প্রাথমিক মার্কিংয়ে ৭ জন মাত্র পাস করেছিল। পরে ২৫ নম্বর গ্রেস দিয়ে পাস করানো গেছে ৩৩ জনকে। বিএসসি’র ফল প্রকাশের পর ক্যাম্পাসে কতিপয় ছাত্র একটি মিছিল বের করে যে এই ফলাফলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকেই পার্টটাইম বিশ্ববিদ্যালয় মনে করে। বিজ্ঞানের কিছু ক্লাশ ছাড়া পরো ক্যাম্পাস দুপুর দেড়টার মধ্যে ফাকা। এর কারণ কি?

উপাচার্য বলেন, সমস্যাটা যাতায়াতের জন্যেই। ফুলটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার প্রস্তাব আমাদের আছে। তবে রেলওয়ের ট্রেন ব্যবস্থার সাথে এই সময়সূচী নির্ভর করবে। ট্রেনেরও বগী কম। তারাও আমাদের চাহিদা মেটাতে পারে না। তাছাড়া ক্যাম্পাসে সস্তা খাবারের দোকান নেই। সেই ব্যবস্থা আমরা করতে পারিনি। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি এখানে পড়াশুনার সময় অপ্রতুল। লাইব্রেরীর সুযোগ পুরোপুরি পাচ্ছে না ছাত্রছাত্রীরা। ক্লাশের সময় ১০টা-৫টা করার কথা আমরাও ভাবি। কিন্তু প্রার্থিত সুযোগ-সুবিধা না দেয়া গেলে তা হয়তো করা যাবে না। অভিযোগ উঠেছে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিভাবান শিক্ষকরা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। অভিযোগ আরো আছে, প্রতিভাবান শিক্ষকদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রশাসন কোন উদ্যোগ নেয় না। এসব কি সত্য?

উপাচার্য বললেন, সেটা অনেকখানি সত্য। তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ইয়ং শিক্ষক আছেন যারা যথেষ্ট মেধাবী। ফিজিক্স-এর প্রফেসর শামসুল হক সাহেব মাষ্টারী ছেড়ে প্রশাসনে চলে গেছেন। তাছাড়া ঢাকা লাইফের একটা অতিরিক্ত আকর্ষণ আছে। যেটা আমাদের নেই। আমরা গত তিন-চার বছর ধরে শিক্ষকদের জন্য কোন নতুন কোয়ার্টার করতে পারিনি। থাকার অস্থায়ী জায়গা দিতে পারছি না। আইন-কানুনের ফাক পেরিয়ে কোন বাড়তি সুযোগ দিতে পারি না। তারপরও কিছু কিছু সিনিয়র অধ্যাপক বৃত্তি নিয়ে বিদেশে গেছেন, আর আসেননি। কোন কোন বিভাগের জন্য আমরা সিনিয়র ও যোগ্য লোক খুজছি। কিন্তু পাচ্ছি না। যেমন পরিসংখ্যান বিভাগ।

উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আপনি কি কোন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন?

এ পর্যন্ত তেমন হইনি। তবে চাকসুর নির্বাচন না করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন বলেছিল। আমি তা শুনিনি। যথারীতি ইলেকশান করেছি।

আঞ্চলিকতা নিয়ে কোন বিরোধ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে উপাচার্য বললেন, এ পর্যন্ত আমি কোন ঘটনা শুনিনি।

শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে আমি একটা সমস্যার মুখোমুখী হয়েছিলাম। যেমন ঃ বাংলা বিভাগে আবু হেনা মোস্তফা কামালের নিয়োগ খুব সহজভাবে হয়নি। ওকে বাসা দেয়ার সময়ও অনেক আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু আমি জানি আবু হেনা মোস্তফা কামাল বাংলা সাহিত্যের একজন সেরা শিক্ষক। আমি জানতাম ওকে আনতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে। তাই বিরোধিতা সত্ত্বেও আবু হেনাকে আমি এনেছি। গুণী শিক্ষকদের আনার জন্য আমি বরাবর উৎসাহী।  

ক্যাম্পাসে প্রচুর খালি জায়গা পড়ে আছে। এগুলোর সদ্ব্যবহার করার কোন প্ল্যান কি আপনাদের আছে?

আমরা কিছু চাষবাসের কাজ করছি। তবে পরিকল্পিত কোন চাষ এখনো হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ চাষ করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে আপনি ক্যাম্পাস থেকে ১৩ মাইল দুরে শহরে থাকেন কেন? আপনার জন্যে তো চমৎকার বাড়ি রয়েছে ক্যাম্পাসে।

আবুল ফজল বললেন, আমি এখানে থাকার ফলে দেশের বহু কাজকর্মের সাথে যুক্ত থাকতে পারি। (এই সময় ঢাকা থেকে একটা ফোন আসে তার কাছে আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক সভায় তাকে প্রধান অতিথি হবার অনুরোধে। ফোনে কথা শেষ করে তিনি এসে আবার বসলেন চেয়ারে।) তখন বাইরে বৃষ্টি। অসময়ের বৃষ্টিপাত নিয়ে দুএকটি মন্তব্য করে আবার কথা শুরু করলেন। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলার দরুন তিনি তখন ক্লান্ত। পূর্ব প্রসঙ্গের রেশ টেনে জনাব আবুল ফজল বলেন, ক্যাম্পাসে থাকলে আমি সব কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো। আমি বিচ্ছিন্ন থাকতে অভ্যস্ত নই। তাছাড়া আমার স্ত্রী (উমরতুল ফজল) এখানে এই পাড়ায় মহিলাদের একটি প্রাইমারী স্কুল চালায়। উনি এটা ছেড়ে যেতে চাইবেন না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জিওলজি, জিয়োগ্রাফির মত বিভাগ নেই অথচ এখানে দর্শন বিভাগ রয়েছে—এ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?

আমার মনে হয়, যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন অবশ্যই পড়ানো উচিত। তাছাড়া চাটগা ফরেস্ট্রীর একটা চাহিদা আছে। এগ্রিকালচার ও ভূগোল বিভাগও আমি খোলার পক্ষপাতি।

এই বৃদ্ধ বয়সে উপাচার্যের দায়িত্ব আপনার কেমন লাগছে?

আবুল ফজল বলেন, আমি বেশ উপভোগ করছি। ছাত্রদের সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘকালের। চৌদ্দ বছর অবসরজীবন কাটালেও ছাত্রদের সাথেও ছিল। আমি বরাবর ছাত্রদের সঙ্গ পছন্দ করি। তারাও আমাকে শ্রদ্ধা করে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার জন্য আসিনি। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু করার তাগিদেই এসেছি। আমার কোন মোহ নেই বলে আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারি। কারো দ্বারা প্রভাবিত হই না।

আপনি বঙ্গবন্ধুর কাছে কখনো দেশের শিক্ষা সমস্যা বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার কথা তুলছেন কি? তিনি নিশ্চয়ই আপনাকে বিমুখ করবেন না।

আবুল ফজল বললেন,‘আমি ঢাকা গেলেই তার সাথে দেখা করার চেষ্টা করি। আমাদের সমস্যার কথা বলি। বিশ্ববিদ্যালয় রুটে বিআরটিসি বাসের জন্য আমার সামনেই বঙ্গবন্ধু হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু তা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এছাড়াও আমি শিক্ষা বিষয়ক অনেক প্ল্যান তার কানে তুলেছি। আমি বঙ্গবন্ধুকে বাংলা একাডেমী প্রসঙ্গেও বলেছি। আমি বলেছি ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম একজন মহিলা। তাকে একসাথে এত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যেকোন একটা গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা পরিচালনা করাই একজনের সার্বক্ষণিক কাজ হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধু অবশ্য আমাকে বলেছেন, ব্যবস্থাটা সাময়িক। আবুল ফজল বললেন, ‘কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যবস্থাটা স্থায়ী হয়ে গেছে।

ভিসি’র দায়িত্ব নেয়াতে আপনার সাহিত্য কর্মের কি ক্ষতি হয়েছে?

‘হ্যা, ক্ষতি হয়েছে তা ঠিক। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পরিবেশে আছি এটাই সান্ত্বনা।’

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শুধু যাওয়া শুধু আসা

বিচিত্রা রিপোর্ট মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর 

হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটি চলতে শুরু করলো। তখন আমাদের ঘড়িতে সকাল সাতটা কুড়ি মিনিট। তিন বগীর একটি শাটল ট্রেন। চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ট্রেন চলতে চলতে প্রথমবার এসে থামলো ষোলশহর স্টেশনে। কিছ ছাত্রছাত্রী এখান থেকে উঠলো। তারপর আর থামার সুযোগ নেই। তিন বগী ভর্তি ছাত্রছাত্রী নিয়ে শাটল ট্রেনটি চললো চট্টগ্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। হেলতে দুলতে রেলগাড়ী চলছে নানা পথঘাট পেরিয়ে। কামরার ভেতর বসে কেউ কেউ বই পড়ছেন। কোন পরীক্ষার্থী আবার নোটে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন শেষবারের মতো। আমরা যেদিন ক্যাম্পাসের ট্রেনযাত্রী সেদিন থেকে শুরু হল ইকনমিক্সের অনার্স পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরু হবে দশটার সময়। পরীক্ষার্থীরা রওয়ানা হয়েছেন সকাল সাতটা কুড়ির ট্রেনে। একজন পরীক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করলাম ঃ আপনি এই ট্রেনে চড়ার জন্যে কখন থেকে প্রস্তুতি নিয়েছেন? তার জবাব,‘এজন্যে আমাকে ঘুম থেকে জাগতে হয়েছে ভোর সাড়ে পাচটায়। আমার বাসা ডবলমুরিং। তৈরী হয়ে স্টেশনে ঠিকমত পৌছতে হলে এই সময়েই রোজ উঠতে হয়।’

ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ট্রেনটি এসে পৌছলো ক্যাম্পাস স্টেশনে। মাঝখানে খানিক লেট করাতে ট্রেনটি এসে যখন থামলো তখন সোয়া আটটা। স্টেশনে নেমে দেখি দুটো বাস অপেক্ষমান। তা মুহূর্তেই ভর্তি হয়ে গেলো ট্রেনে আগত ছাত্র দ্বারা। ট্রেন থেকে ‍হুড়মুড় করে সবাই নামলো বাসের জায়গা দখলের জন্য। কেউ জায়গা পেলো। কেউ পেলো না। ছাত্রছাত্রী সবাই দাড়িয়ে, বসে ঝুলে বাসে চেপে পালা করে পৌছলো মূল ভবনে। কেউ কেউ এত নিরীহ যে তারা গাদাগাদি করে বাসে যেতে আদৌ রাজী নয়। তারা ট্রেন থেকে নেমে সোজা হাটা শুরু করে দিয়েছে। সকাল নটার রোদ ক্যাম্পাসের মধ্যে এক মাইল রাস্তা পেরিয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে তারা অবশেষে যখন ফ্যাকাল্টিতে পৌছালে ততক্ষণে ক্লাসের বক্তৃতা বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে।

একদিন প্রতিদিন

এর নাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্ণনা করলাম তা ব্যতিক্রম একদিনের ব্যাপার নয়, প্রতিদিনের ঘটনা।

এর নাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম শহর থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে জোবরা গ্রামে চতুর্দিকে পাহাড় বেষ্টিত নিসর্গে এর অবস্থান। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন ১৩৫০ একর। তার মধ্যে ৫০০ একর হলো সমতল ভূমি। বাকী এলাকা পাহাড়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হয়েছে ১৯৬৬ সনের নবেম্বর মাসে। মোট ৭৮টি ডিগ্রী কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত। বিভাগ রয়েছে ১৮টি। ছাত্র সংখ্যা ৩২৮৮। অধ্যাপক সংখ্যা ২১৮ জন। আবাসিক হল ৪টি। হলে ১০৯০ জন ছাত্রছাত্রী থাকেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হয় সকাল সাড়ে আটটায়। কিন্ত এই ক্লাস খুব কম বিভাগেই হয়। মূলতঃ সাড়ে নয়টার ক্লাস দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্কিং আওয়ার শুরু হয়। স্টেশন থেকে ছাত্রদের নিয়ে বাসগুলো ফ্যাকাল্টির সামনে এসে পৌছালে তারপর অধ্যাপক এগুতে থাকেন চক ডাস্টার নিয়ে। কলা অনুষদের একটা ক্লাসে গিয়ে বসলাম। স্যার এলেন। স্যার তাকিয়ে রইলেন দূর পাহাড় ঘেরা ক্যাম্পাস নিসর্গের দিকে। সরু রাস্তা চলে গেছে কয়টি। এমন সময় দৃষ্টিতে ধরা পড়লো একটা বাস। স্যার অপেক্ষা করলেন কিছুক্ষণ এই আশায় যদি এই বাসে তার কিছু ছাত্রছাত্রী থাকে। দুএকজন এলো। এবার বক্তৃতা শুরু হবে। এমন সময় একজন ছাত্র প্রস্তাব করে বসলেন,‘স্যার, থার্ড বাসটা এক্ষুনি আসবে, যদি আর একটু অপেক্ষা করেন’।

কুমিল্লা বনাম চাটগা

বিতর্কটা বেশ জোরেসোরে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় চাটগায় হবে না কুমিল্লায় হবে। পাকিস্তান আমলের কথা। চট্টগ্রামের (মরহুম) বজলুল কাদের চৌধুরীর তখন বেশ দাপট। প্রায়ই অস্থায়ী প্রেসিডেণ্ট হবার সুযোগ পাচ্ছেন। ঘন ঘন চাটগা আসেন। তার আগে ছিলেন পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী। শুধু তার বদৌলতে বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়েছে এমন কথা বলবো না। তবে তার যে একটা সক্রিয় অবদান ছিল তা আবুল ফজলও এক প্রবন্ধে (শুভবদ্ধি, পৃঃ ১৩৯) উল্লেখ করেছেন।

শহর থেকে ১২ মাইল দূরে জনবিরল গ্রামে, পাহাড়ঘেরা বনভূমিতে এই ক্যাম্পাস নির্মাণের পিছনে ছিল স্পষ্ট রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি। তখনকার ছাত্রসমাজ ছিলো সর্বতোভাবে রাজনীতি কেন্দ্রিক। ছাত্রদের রাজনীতি থেকে সরাবার বাসনায় তৎকালীন সরকার নির্বাসিত ক্যাম্পাসের পরিকল্পনা নেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে জোবরা গ্রামে তৈরী করার জন্য যারা সিদ্ধান্ত নেন তাদের মধ্যে একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি রয়েছেন। তিনি ডঃ মুহম্মদ শহীদল্লাহ। তিন কমিটির বিশিষ্ট স্থান নির্বাচন কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার এই স্থান অনুমোদন করেন। অভিযোগে প্রকাশ, এই কমিটি শহরে বসে, সাইটে না গিয়েই, স্থান অনুমোদন করেন। তাদের অনুমোদনের ফলশ্রুতি আজকের এই ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ পর্যন্ত কুমিল্লায় হলো না, হলো চট্টগ্রামে। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরে এই মহতী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন স্পন্দন আজ নয় বছর পরেও অনুভূত হচ্ছে না।

এক কোটি টাকা বকেয়া পাওনা

লাগাম ছাড়া দালান একটার পর একটা তোলা হয়েছে। কিন্তু কন্ট্রাক্টরদের বিল শোধ করা হয়নি। বকেয়া পাওনার পরিমাণ প্রায় এক কোটি টাকা। কন্ট্রাক্টরদের বকেয়া পাওনা না দিলে তারা নতুন নির্মাণ কাজে হাত দেবে না। ১৯৬৬-৬৭ সনে কাজ হয়েছে তারই বকেয়া বাকী রয়ে গেছে এখনো। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য যে টাকা দিচ্ছেন তা বকেয়া শোধ করতে করতে চলে যায়। এখন সরকার যদি বিশেষ গ্রান্ট দিয়ে এই বকেয়া শোধ করেন তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কোন উন্নয়ন কাজ সম্ভব হবে। নতুবা নয়।

গোড়ায় গলদ

আজ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এই ক্যাম্পাসের নানা ভুল বের করা হচ্ছে। কিন্ত গোড়ায় এর গলদ। তা কখনো আর দরকার পড়ে না (১) অত্যন্ত ভুল জায়গায় নির্মাণ করে এবং একই সাথে দীর্ঘকালের জন্য অনাবাসিক করে রেখে এর সমস্ত সম্ভাবনাকে চাপা দিয়ে দেয়া হয়েছে। (২) উচ্চমার্গের পরিকল্পনা বাস্তবোচিত নয়। শুরুতে যারা এর নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন তারা ক্যাম্পাসের সীমানা বাড়িয়েছেন। কেন্দ্রবিন্দু ঠিক করেনি। একটা নিউক্লিয়াসে ক্যাম্পাস গড়ে ওঠেনি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভবনের পর ভবন উঠেছে, তাতে নেই কোন পরিকল্পনার ছাপ।

মযহারুল ইসলামের কীর্তি

স্থাপত্য কত পরিকল্পনাহীন ও অবিবেচনাপ্রসূত হতে পারে তার দর্শন পেতে হলে চাটগা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। জানা গেছে, সাবেক গবর্নর মোনেম খান কর্তৃক নিযুক্ত স্থপতি মহারুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আদিতে কোন ক্লু প্রিণ্ট সরবরাহ করেননি। তিনি থাকতেন ঢাকায়। যেতেন মাঝে মাঝে চট্টগ্রামে। গিয়ে কন্ট্রাক্টর, মিস্ত্রীদের যখন যা নির্দেশ দিতেন তখন সেই বিল্ডিং সেইভাবে উঠতো। পরিকল্পিত ক্লু প্রিণ্ট না থাকাতে সারা ক্যাম্পাসে এতো বৈসাদৃশ্যে চোখে পড়ে তা হিসাব করলে এখন, এই বাজারে, কোটি টাকার উপর অপচয় ধরা যেতে পারে। এইরকম অসংখ্য ভুলের মাশুলের একটি হলো ঃ বিজ্ঞান ভবনের একটা আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর। এটি কেন করা হয়েছিল তা কেউ জানেন না, একমাত্র স্থপতি ছাড়া। এখনকার বিজ্ঞান ভবনটি দৈর্ঘ্যে ৭১০ ফুট। চারতলা। এই ভবনটিতে মযহারুল ইসলামের ইচ্ছা ছিল বিজ্ঞানের একটি বিভাগ হবে। গরীব বিশ্ববিদ্যালয়ে তা হয়নি। সেই ভবনটিতে এখন বিজ্ঞান অনুষদের সাতটি বিভাগই জায়গা করে নিয়েছে। বিজ্ঞান বিল্ডিং হবার কথা ছিল ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে। স্থপতির এমনই প্ল্যান, ইতিমধ্যে ১ কোটি টাকা ব্যয় করে ফেলেছে, ভবনটি সম্পূর্ণ করাই যায়নি। উল্লেখ্য যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিজ্ঞান নির্ভর আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবার কথা ছিল।

বিমুখ মৃত্তিকা

একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুতল বিশিষ্ট বাড়ীঘর নির্মাণ হয়। তারজন্যে চাই উপযুক্ত মাটি। বলবান ভিত্তিভূমি। এই বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের আগে মাটি পরীক্ষা (সয়েল টেস্ট) করা হয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা তখন রায় দিয়েছিলেন নির্মাণের বিপক্ষে।

প্রতিবাদহীন স্বেচ্ছাচারিতা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই একটা বিষয় একমত ঃ এর স্থাপত্যকলা ছাত্র স্বার্থের প্রতি একেবারে ‘কলা’ দেখিয়ে ছেড়েছে। যেমন ফ্যাকাল্টি ভবন তেমনি আবাসিক হলগুলোতে। এতো অপরিকল্পিত, এতো পাশ্চাত্য ঘেষা, এতো ব্যয়বহুল, এতো আনকমফরটেবল প্ল্যান এই বিশ্ববিদ্যালয় কার্যকরী হয়ে গেছে যার প্রতিক্রিয়া ভোগ করতে হচ্ছে যেমন এখনকার ছাত্রদের তেমনি অনাগত ছাত্রদেরও তা উত্তরাধিকার সূত্রে ভোগ করতে হবে। সচনা লগ্নে প্রজেক্ট ডিরেক্টর ছিলেন ডঃ এ আর মল্লিক। তাদের চোখের সামনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুলের পাহাড় বড় হয়েছে। কেউ প্রশ্ন তোলেনি। একা, একজন, স্থপতির খেয়াল, খুশী ও স্বেচ্ছাচারিতার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক সবাই এর সমালোচনায় উচ্চকণ্ঠ।

তবুও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্পণে এই ক্যাম্পাসকে কেউ বিচার করলে ভাল করবেন। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠুক এটাই বাঞ্ছিত। ঢাকা ঢাকার মতই হবে। জাহাঙ্গীর নগরের চরিত্র ভিন্ন। ভিন্ন চট্টগ্রামেরও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তার অবস্থানে, তার চরিত্রে ও তার সম্ভাবনার ব্যাপ্তিতে স্বতন্ত্র। এর ছাত্র সংখ্যা কখনো পাচ হাজার ছাড়িয়ে যাবে না। আস্তে আস্তে একে করা হবে পূর্ণ আবাসিক। পূর্ণ আবাসিক হয়ে উঠলে এই বিশ্ববিদ্যালয় হবে ব্যতিক্রম, আদর্শ ক্যাম্পাস, অবাণিজ্যিক ও প্রচুর সম্ভাবনায় সমৃদ্ধ একটি শান্ত শিক্ষা পল্লী।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কি নেই?

নয় বছর যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুব বৃদ্ধি পাবে এমন আশা করাও সঙ্গত নয়। তবু একটা ক্যাম্পাসে কিছু চাহিদা থাকবে যা সূচনালগ্নে পার্বণ হওয়া বাধ্যতামূলক। যেমন ঃ কলা ভবনে অধ্যাপকদের জন্য কোন নিজস্ব কামরা নেই। বিজ্ঞান ভবন কোন কোন অধ্যাপকের বরাতে জুটেছে। পৃথক রুম না থাকাতে ছাত্র শিক্ষক সুসম্পর্কের বড় অভাব। ছাত্রদের জন্য কোন প্রশস্ত ক্যাফেটেরিয়া নেই। আবাসিক অধ্যাপকদের জন্য কোন ক্লাব নেই। সমগ্র ক্যাম্পাসে একটা বুকস্টল নেই। চ্ট্টগ্রাম শহরের সাথে যোগাযোগের কোন ডাইরেক্ট টেলিফোন লাইন নেই (উপাচার্য অফিস ছাড়া)। ছাত্রীদের স্বতন্ত্র আবাসিক হল নেই। ইন্টার ফ্যাকাল্টি বাস নেই। একটা বাজার নেই। বুকস্টল নেই। টেলিগ্রাফ অফিস নেই। গেষ্ট হাউস নেই—তবে পাহাড়ের উপরে উপাচার্যের যে বাসাটি আছে বর্তমানে দু’তিনজন অতিথি সেখানে থাকতে পারেন (উপাচার্য থাকেন শহরে, নিজের বাসায়)। শিক্ষক মিলনায়তন নেই। শিক্ষক ক্লাব নেই। উপাচার্যের কোন সভাকক্ষ নেই। ফ্যাকাল্টিতে ছোট বড় কোন সভাকক্ষ নেই। ডাক বিলির সুবন্দোবস্ত নেই।

পার্টটাইম ক্যাম্পাস

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হয় দৈনিক মোট তিন ঘণ্টা। অবশ্য বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করেন। ক্যাম্পাস স্টেশন থেকে প্রথম ট্রেনটি ছাড়ে দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে। সেই ট্রেনে জায়গা নেবার জন্য ছাত্ররা ক্যাম্পাস ছাড়তে শুরু করেন দুপুর ১২টা থেকেই। এছাড়া দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে আর একটা শাটল ট্রেন ছাড়া হয়। এতে খুব বেশী ছাত্র যায় না। আগেরটিতে মোটামুটি সবাই রওয়ানা হয়ে যায়। দুপুর একটার মধ্যে ক্যাম্পাস জনশূন্য হয়ে পড়ে। দুপুর দেড়টায় ছাড়ে অধ্যাপকদের বিশেষ দুটি বাস। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় নেমে আসে অদ্ভূত নির্জনতা। সকাল বেলার কোলাহল মুহূর্তেই যেন বিলীন। হল থেকে দুপুরের ভাত খেয়ে কড়া রোদ মাথায় নিয়ে দু’চারজন ছাত্রছাত্রীকে হয়তো পাহাড়ী পথ বেয়ে আসতে দেখা যায় বিজ্ঞানের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে। তাদের উপস্থিতি এতকম যে তা ক্যাম্পাসে কোন শব্দের ঢেউ তোলে না। বিকেল পাচটায় তাদের নিয়ে শেষ ট্রেনটি ফিরে আসে শহরে। বিজ্ঞানের একজন ছাত্র যখন শহরে বাসায় পৌছেন তখন আকাশ কালো হয়ে যায়। সন্ধ্যা নামে। সারাদিনের ক্লাস ক্লান্ত ছাত্র হয়তো এসেই ঘুমিয়ে পড়েন ক্লান্তিতে। কিন্তু পরদিন সকাল সাতটা কুড়ির ট্রেন ধরার জন্য তাকে আবার জাগতে হবে ভোর পাচটায়।

সময়সূচী নিয়ে বিতর্ক

কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই এরকম পার্টটাইম চলতে পারে না। কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হয় তার ব্যবহার হবে দৈনিক তিন ঘণ্টা এ ভাবা যায় না। অথচ বিজ্ঞানের কিছু ক্লাস ছাড়া পুরো ক্যাম্পাস কাজ করছে আংশিকভাবে। পূর্ণদিন ক্লাস রুটিন করার পক্ষে বিপক্ষে নানা মতামত ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক, অফিসার ও কর্মচারীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রেখেছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু লোকের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছি। তাতে আমাদের মনে হয়েছে, বেশীরভাগ লোকই বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীরা ‘ফুলটাইম’ বিশ্ববিদ্যালয় চায়। বর্তমান সময় সূচীতে তারা সন্তুষ্ট নয়। কিছু কিছু অধ্যাপক যদিও এতেই সন্তুষ্ট তবু বেশীরভাগ অধ্যাপকের মতই হলো পূর্ণদিন বিশ্ববিদ্যালয়। বিজ্ঞান ভবনের অধ্যাপকেরা ও ছাত্ররা এখনই পূর্ণদিন ক্লাস করছে। ফলে তারা তো চাইবেনই সারা বিশ্ববিদ্যালয় ফুলটইম হয়ে উঠুক। বেকে আছেন অফিসাররা। তারা এটা কিছুতেই কামনা করেন না।

ছাত্রদের দাবী

ছাত্ররা অবশ্য আরো একটা দাবী যুক্ত করেছেন। তাদের মতে, ফুলটাইম বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে। কিন্তু তার আগে পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থা চাই। অনাবাসিক ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্যদামে খাওয়ার সুবিধা দিতে হবে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো টিএসসি প্রতিষ্ঠার দাবী জানান। তাতে খাওয়ার সুবিধা হবে। ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কের দূরত্ব কমিয়ে আনারও একটা অবকাশ ঘটবে।

ছাত্ররা মনে করেন, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তা পায় না। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী শ্রী ফনী মজুমদারের নির্দেশ সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ রেশনিং চালু করা যায়নি। আবাসিক হলের রেশন এখন আংশিক, অনিয়মিত। হলের ছাত্রছাত্রীদের একটা টুকরো জিনিস কিনতেও ১২ মাইল দূরে শহরে যেতে হয়। এই অবস্থার অবসানের জন্য তারা ক্যাম্পাসে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর দেয়ার জন্য দাবী জানান। একজন অনাবাসিক ছাত্র জানান, তিনি পুরো অনার্স কোর্সে মাত্র ৫ দিন লাইব্রেরীতে পড়েছেন। এই ছাত্রটি অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। তার প্রস্তাব ঃ যেহেতু বেশীরভাগ ছাত্রছাত্রী ‘শহরে’ থাকেন সেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীর একটা এক্সটেনশন শহরে খোলা হোক। উল্লেখ্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যারিন বায়োলজী বিভাগীট চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত।

এক সময় ক্যাম্পাস ইন্টার ফ্যাকাল্টি বাস চালু ছিল। এখন তা বন্ধ। ফলে ছাত্রছাত্রীদের দূরের হল থেকে পাহাড়ী পথ বেয়ে রোজ ক্লাসে আসতে হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলো অন্য নিয়মে নেয়া হয়। পরীক্ষার উপর কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিভাগই সর্বেসর্বা। প্রত্যেক বিভাগ পরীক্ষার্থীদের ‘মত’ অনুযায়ী পরীক্ষার তারিখ স্থির করে। বিভাগেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। শুধু বিভাগীয় অধ্যাপকেরাই ইনিভিজিলিশন দেন। ক্যাম্পাসের কোন বিশেষ এলাকা—পরীক্ষা এলাকা বলে স্বতন্ত্র মর্যাদা পায় না। পরীক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বাসের ব্যবস্থা রয়েছে। ছাত্রদের মত জানতে চেয়েছিলাম, তারা এই ব্যবস্থায় খুব খুশী। একটা কেন্দ্রীয় পরিদর্শক টীম আছে। যারা সব বিভাগের পরীক্ষা কেন্দ্রে ঝটিকা সফর করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অনুমোদিত কলেজগুলোতে প্রতিটি পরীক্ষায় পরিদর্শক পাঠানো হয়। তারা কলেজে উপস্থিত থেকে পরীক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। নকল-মুখী ছাত্ররা এদের উপস্থিতিকে উৎপাত মনে করলেও অভিভাবকরা এই ব্যবস্থায় খুশী।

পানির অভাব

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পানি থাকে না। পানির জন্যে ক্যাম্পাসে যে ৬টি পাম্প আছে এখন তার সব কটি বিকল। কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে সোয়া লাখ টাকা দিয়ে একটা পাম্প নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পানির অভাবে এই পাহাড়ী অবস্থিত আবাসিক ছাত্রছাত্রী ও কোয়ার্টারের লোকজনের কি যে অবস্থা হয় তা আর বলবো না। বিজ্ঞান ভবনের যাবতীয় এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ থাকে। রসায়ন বিভাগ এ ব্যাপারে সবচে বড় ভূক্তভোগী। রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান কিছুদিন আগে উপাচার্য সমীপে একটা আবেদনপত্র পাঠিয়েছেন। তাতে তিনি ১লা জানুয়ারী থেকে ২৭শে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত রসায়ন বিভাগে কতক্ষণের জন্য পানি ও বিদ্যুৎ ছিল না তার তালিকা দেন। তালিকায় দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘন্টার জন্য পানি বন্ধ ছিল। বেশীরভাগ সময় দুপুর দেড়টা থেকে পানি বন্ধ হয়। যখন প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস শুরু হয়।

লাইব্রেরীর নতুন ভবন হবে

একটা বেখাপ্পা জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী ভবনটি (অস্থায়ী) মাথা উচু করে ভাষায় দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ, পুথি ও পাণ্ডুলিপি ৪৫০। মূল লাইব্রেরী  ভবন তৈরী হবে বর্তমান কলা ভবনের সামনে রাস্তার বিপরীতে। মজর ব্যাপার হলো, ৬৬ সনে যখন বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হচ্ছিল তখন লাইব্রেরী বলে একটা ব্যাপার পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল না। লাইব্রেরী বিহীন একটা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী হতে যাচ্ছিল। এখনো লাইব্রেবীর কোন প্ল্যান নেই। শুধু জমি আছে।

ব্যতিক্রম

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নতুন বিভাগ হচ্ছে ফাইন আর্টস বিভাগ। শিল্পী রশীদ চৌধুরীর ভাষায় ফাইন আর্টস বিভাগ হলো জমিদার বাড়ির টিয়ে পাখি। ভবনের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য নাকি এই বিভাগ। ফাইন আর্টস বিভাগের এখন ছাত্রসংখ্যা ৪২। গত সেশন থেকে অনার্স খোলা হয়েছে। এছাড়া এমএ পড়ানো হচ্ছে। অনেকেই ফাইন আর্টসকে সাবসিডিয়ারী হিসেবে পড়ছেন। এই বিভাগের আড়াই লাখ টাকার সরঞ্জাম এসে পড়ে রয়েছে। জায়গার অভাবে সেগুলো বসানো যাচ্ছে না। ম্যারিন বায়োলজী নামে একটি বিভাগও গত বছর চালু হয়েছে। এই বিভাগটি কাজ করছে শহরে।

ভুলের মাশুল নয়, নতুন দৃষ্টিভঙ্গী চাই

শহর থেকে দূরে, জোবরা গ্রামের শান্ত পাহাড়ী এলাকায় যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নাগরিক কোলাহল এড়িয়ে দিন দিন বড় হচ্ছে তাকে গড়ে উঠবার সুযোগ দিতে হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে যেন ভুলের মাশুল গুণতে না হয় চিরকাল। বরং এককালের ‘উদ্দেশ্যমূলক’ ভুলকে প্রয়োজন উপযোগী পরিকল্পনার অধীনে এনে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি সম্পূর্ণ আবাসিক ও গবেষণাধর্মী ক্যাম্পাসে পরিণত করা যেতে পারে। ডিগ্রী তৈরীর কারখানা দেশে আরো কয়টি আছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়কে তার সীমিত ছাত্রবল নিয়ে প্রকৃত জ্ঞানচর্চায় নিবেদিত হবার সুযোগ দিলে দেশে উচ্চশিক্ষার নতুন পরিমন্ডল সৃষ্টি করার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকি

আবু হেনা মোস্তফা কামাল

আমার এই আত্মজৈবনিক পদ্মার শীষ নামটি ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও মুখের ভেতরে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চেখে দেখতে পারেন—কিন্তু স্বাদের তারতম্য হবে। তারতম্য না হলে এরকম একটি লেখা আমার কলমে কখনো আসতো?

আজন্ম সমতলের মানুষ আমি—জন্ম হয়েছে ছোট্ট শহর পাবনায়—ইছামতি নদীর তীরে ছোট্ট একটি বাড়িতে। বেশীর ভাগ চাকুরী করেছি মাঝারি শহর রাজশাহীতে বিশাল পদ্মার তীরে। গ্রহনক্ষত্রের স্থান বদল হয়েছিলো নিশ্চিত, নইলে ৬৯ সালে যখন সৈয়দ আলী আহসান চাটগা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে বলেছিলেন, উচ্চতর পদে, তখন অতো দেমাক দেখিয়েছিলাম কেন? রাজশাহী ছেড়ে আমরা সমতলবাসীরা এই পার্বত্য অঞ্চলে আসবো কোন দুঃখে? ৭৩ সালে—নিশ্চয় আমার বিধাতা আস্তিনের নীচে মুখ রেখে হাসছিলেন—সেপ্টেম্বরে চাটগায় এলাম—উচ্চতর পদে নয়, একই পদে—বরং রাজশাহীতে স্থায়ী ছিলাম চাটগায় অস্থায়ীভাবেই আসতে হলো।

মনের ভেতরে যেটুকু অস্বস্তি ছিলো, বিভাগীয় প্রধান আনিসুজ্জামানের সৌহার্দ্যে এবং উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজলের স্নেহে সেটুকু অচিরেই মিলিয়ে গেলো। কিন্তু দেহের অস্বস্তি কি অত সহজেই মিলিয়ে যায়?

এই ক্যাম্পাসে আপনি যেদিকে তাকাবেন, পাহাড়, সবুজ পাহাড়। খুব ভোরে শীতের সকালে অনেক দূরে কুয়াশার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা পাহাড়, কোনো শ্রাবণের দুপুরে তুমুল বৃষ্টির ভেতরে বাসার পেছন দিকের উঠোনে জড়ো-সড়ো পাহাড়, ফাল্গুনের সন্ধ্যায়, যখন মৃদু বাতাস আসতে থাকে সমুদ্র থেকে, একটি গোলাপ রেকাবির মতো চাদের নীচে শান্ত সুন্দর পাহাড়।

কিন্তু খা-খা রোদের ভেতরে এই পাহাড় পেরিয়ে কোথাও যেতে হলে, বন্ধুগণ এবং বিচিত্রা সম্পাদক, আগেই বলে রাখছি, আপনার পা এবং হাড় কোনোটিই খুব প্রীতি লাভ করবে না। এবং মজার ব্যাপার হলো এই চমৎকার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাহাড় না পেরিয়ে আপনি কোথাও যেতে পারবেন না।

বিশ্বাসে কৃষ্ণ মেলে হয়তো বা—কিন্তু প্রয়োজনের সময় রিকশা মেলে চাটগা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে—নৈব নৈবচ—সেটি হচ্ছে না। ফ্যাকাল্টি অথবা প্রশাসন ভবন থেকে হাড়গোড় ভাজাভাজা করে করে যদি বাসায় এসে দেখেন যে আপনার স্নানঘরটি চীনেবাদামের খোসার মতো শুকনো—এক ফোটা পানি নেই—তখন কাকে বলবেন এসো, করুণা ধারায় এসো……ইঞ্জিনীয়রকে? ক্ষমা করবেন—তিনি পনেরো মাইল দূরে তার শহর স্থিত ফ্লাটে এতোক্ষণ স্নিগ্ধ শীতল বারিধারায় নিজেকে সমর্পণ করেছেন—আগামী ১৭/১৮ ঘণ্টা তাকে ক্যাম্পাসে পাওয়া যাবে না। সহকারী প্রকৌশলীর কাছে গিয়েই কী হবে যদি জলোত্তলন যন্ত্রটির আকস্মিক, স্নায়বিক নয়, যান্ত্রিক দৌর্বল্য ঘটে থাকে! আপনি অপেক্ষা করতে থাকুন। কদ্দিন? তা, চার-পাচ দিন পানি না থাকলে আর এমনকি অসুবিধা! পানি তো আর অন্ন নয়—পানি খেয়ে কেউ বাচে নাকি? বিলেতে তো শুনি অনেকেই সাতদিনে একবার গোসল করে—করে না? হ্যা করে বৈকি—তবে তাদের গার্লফেন্ড টেকসই হয় না। হাজারো বোডী মিস্ট লেপন সত্ত্বেও শরীরের বনেদী সুবাসটুকু যখন বান্ধবীর নাসারন্ধ্রে পৌছে তখনই বিচ্ছেদের দলিল স্বাক্ষরিত হয়ে যায়।

আর আমাদের স্নানঘর থেকে যে সুগন্ধ উৎসারিত হতে থাকে তার ফলে দেহ ও আত্মার বিচ্ছেদই পরম কাম্য হয়ে দাড়ায়।

কিংবা সবাইকে চমকে দিয়ে, ধরুন, সন্ধ্যের সময় শহর থেকে আগত বেশ কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করতে বসেছেন—নিভে গেলো আলো, বন্ধ হলো পাখা, কয়েক হাজার মশা আক্রমণ করলো আপনাকে, ফ্রিজের ভেতরে মাছের ভ্যাপসা গন্ধ উঠলো, বন্ধুরা মনঃক্ষুন্ন হয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন—বন্ধু পত্নীর মুখ একটি নতুন শাড়ি অর্জনের মহৎ অভিজ্ঞতার কাহিনী সমাপ্ত করতে না পারার বেদনায় ম্লান-আপনার মন অবশ্যই বলবে ‘যেতে নাহি দিব’—কিন্তু কাকে? ইলেকট্রিসিটিকে অথবা অতিথিকে?

তারপর হয়তো চললো একাদিক্রমে ৩/৪ দিন বিদ্যুৎবিহীন অবস্থা। পানি না থাকলে অনেকে শহরে গিয়ে (১৫ মাইল দূরে মনে রাখবেন) শীতল হয়ে আসতে পারেন, কিন্তু আলো না থাকলে শহরে গিয়ে কিছু বিদ্যুৎ তো আর বুকের ভেতরে নিয়ে আসতে পারেন না। অতএব এমনিই চলতে থাকে—বুকের জেনারেটরে ক্ষোভ থেকে, হতাশা থেকে, দুঃখ থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তারই আবেগে দিন যায়। কিন্তু কোন প্রতিকার নেই—এখানে সবাই একটা বাক্য খুব ভাল রপ্ত করেছেন দি ফেল ইজ ভাল রপ্ত করেছেন দি ফল্ট ইজ নট ইন মাই কোট! বলটি তাহলে সর্বদাই শূন্যেই দোদুল্যমান বোধ করি?

সপ্তাহে দুদিন আমাদের গৃহিণী মলে মহোৎসব লেগে যায়—মঙ্গলবার ও শুক্রবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস বেলা তিনটায় শহরে যায় ঐ দুদিন—ফিরে আসে পৌণে সাতটায়। ক্যাম্পাসে পৌছতে পৌছতে সাড়ে সাত। বাজার থেকে প্রায় গোটা বাজারই আমরা উপড়ে নিয়ে আসি। চাল, ডাল থেকে মাছ শবজি, আবার শাড়ি জামা থেকে স্নো-পাউডার বই-খাতা, কাগজ-কলম সব। নইলে ২৫ পয়সার একটা জিনিস কিনতে আপনাকে কমপক্ষে ১০ টাকা খরচ করে শহরে যাতায়াত করতে হবে। অতএব ইচ্ছে থাকুক আর নাই থাকুক, সপ্তাহে অন্তত একদিন শহরে যাওয়া রপ্ত করতে হবেই। যাওয়াটা বেশ আরামদায়কই হয়–,তখন সবাই গোসল খাওয়া সেরে চকচকে, পরিপাটি। তদুপরি মেয়েদের বদৌলতে রেভলন শ্যানেলের গন্ধে গাড়ির ভেতরের বাতাসটা গাঢ়। কিন্তু ফেরার সময় একে পরিশ্রমের ক্লান্তি, জিভের ডগায় দোকানীর সঙ্গে দর কষাকষির কটু স্বাদ, তারপরে মাছের সৌরভ ও ঘামের ঘ্রাণ মিশে এক বিচিত্র পরিস্থিতি। তার সঙ্গে যুক্ত হয় শিশুদের অহিষ্ণু কান্না। বাস যখন ক্যাম্পাসে এসে থামে তখন আরোহী প্রত্যেকেই পরাজিত না হলেও গুরুতর পরিক্লান্ত সৈনিক। কোথায় সেই প্রসন্নতা আর তৃপ্তির জেল্লা—দ্রব্যমূল্যের আঘাতে আর পথশ্রমের ক্লান্তিতে সবাই তখন ধরাশায়ী।

বাসায় ফিরে তখন যদি দেখেন—সারা ক্যাম্পাস অন্ধকার? কিছুই করার নেই—ভাগ্যকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে হবে—যেমন গত দেড় বছর আমি মেনে নিয়েছি। মোমবাতি জ্বেলে রান্না করতে হবে—মোমবাতির আলোতেই ভাত খেতে হবে। এবং মোমবাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়তে হবে। পরদিন ক্লাসের জন্যে পড়াশোনা?

সেটি না করলেও চলবে। তার জন্যে সকালের দু’ঘণ্টা তা থাকলোই। গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের অসুবিধা মিলিয়ে আমাদের ক্যাম্পাস। শহরের কোন সুবিধা এখানে পাবেন না—মাঝে মাঝে ইলেকট্রিসিটি আর ওয়াটার সাপ্লাই ছাড়া অবশ্য—তবে গ্রামের যাবতীয় অসুবিধাই আছে। এখানে খাটি দুধ পেতে পারেন এবং টাটকা শবজিও—কিন্তু তাদের দাম ষোলো আনাই নাগরিক। কারণ বিক্রেতা ব্যক্তিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে যথেষ্ট বিদগ্ধ হয়ে গেছেন কিনা, তাই। আশপাশের গ্রাম থেকে কয়েকবার ভৃত্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছি—আংশিক সফল হয়েছি—কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ভৃত্য দুদিন যেতে না যেতেই জানতে দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ পাহাড়ের ও প্রান্তরের মালিক তার পূর্বপুরুষ অথবা সে নিজে। কী সর্বনাশ, আমি আমার প্রভুকেই ভৃত্য বানিয়ে বসে আছি? অচিরেই তাকে অব্যাহতি দিয়ে সম্ভ্রম রক্ষা করি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দক্ষিণ-পূর্ব পাড়ায় আমরা চৌত্রিশ ঘর পড়শী বসত করি। এর ভেতরে তিনটি ভবনে থাকেন নয়জন অবিবাহিত শিক্ষক। অর্থাৎ এ পাড়ায় আমরা মোট অধিবাসী ৪২ জন। তার ভেতর দুজন ডাক্তার, অবশিষ্ট চল্লিশজন অবশ্যই রোগী।

এখানে অবসরবিনোদনের ব্যবস্থাটি চমৎকার—খোলা আকাশের নীচে কালভার্টের ওপরে আমাদের গ্রীষ্মকালীন অধিবেশন বসে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায়। কাউকে চাদা দিতে হয় না—কোন সেক্রেটারী নেই কাউকে সভাপতিত্ব করতে হয় না। এখানে আলোচনার জন্যে সবার অবারিত সুযোগ—রাজা উজীর থেকে নিরীহ সহকর্মী সবাই অবলীলায় নিহত হচ্ছেন প্রত্যেকদিন—তবু সৎকারের বালাই নেই। কারো কথার জন্যে কোন কর দিতে হয় না। ভাগ্যিস দিতে হয় না!

দুঃখের বিষয় বর্ষা ও শীতে এই সার্বজনীন ক্লাবটি বন্ধ হয়ে যায়। নিউমোনিয়াকে আমরা সবাই ভয় করি—এমন কি প্রতি একুশ জনে একজন ডাক্তার থাকলেও! দীর্ঘ ছুটিতে হঠাৎ করে সব কেমন ঝিমিয়ে আসে। কর্তাদের ক্লসে যাবার তাড়া থাকে না। যাদের বাড়ি কুমিল্লা-ফেনী-নোয়াখালী-ঢাকা, তারা লম্বা পাড়ি জমান। আমার মতো বিদেশিকে পড়ে থাকতে হয় মাটি কামড়ে—কোথায় যাবো এই ক্যাম্পাস ছেড়ে? চারদিক খা খা করে। রিকশার টুং টাং নেই, ছাত্রছাত্রীদের আসা-যাওয়া একেবারে বন্ধ, গিন্নীরা আলস্যে হাই তোলেন। অনেকে ক্যাম্পাস ছেড়ে যান না ভয়ে—এই দুমূর্ল্যের বাজারে প্রতিবেশী লাইব্রেরীয়ানের সাময়িক অনুপস্থিতির জন্যে দুটি বিদেশি মুরগী চুরি হয়ে গেছে, নাহ বাবা দরকার নেই বাড়ি ছেড়ে বেড়াতে গিয়ে। মনে হচ্ছে বাগানের শবজি আর ঘরের হাস মুরগীর জন্যে আসন্ন গ্রীষ্মে ক্যাম্পাস একটুও খালি হবে না।

অবশ্য তাতে ক্যাম্পাসের মহিলাদের খুব বেশি মন খারাপ হবে না। তাদের একটি সমিতি আছে, প্রতি বুধবারে তাদের সাপ্তাহিক অধিবেশন বসে এবং কালভার্টের ওপরে মুক্ত আকাশের নিচে নয়, রীতিমতো একটি সুন্দর একতলা বাড়িতে তার চারদিকে ফুলের কেয়ারি, সবুজ না হলেও প্রায়-সবুজ লন। সেদিক থেকে তারা সুবিধা ভোগী শ্রেণী সন্দেহ নেই। কিন্তু দীর্ঘ ছুটিতে মহোদয়রা কি করবেন? কী আর করবেন, পরীক্ষার খাতা দেখে বইয়ের প্রুফ সংশোধন করে, আগামী ক্লাসের প্রস্তুতি নিয়ে সময় কাটাবেন! খুব বেশি খারাপ লাগলে এদিক ওদিক অর্থাৎ রাঙামাটি-কক্সবাজার ঘুরেও আসা যায়। কিন্তু না, গ্রীষ্মের ছুটিতে ভ্রমণ খুব আরামপ্রদ হবে না। সুতরাং দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী এবং দীর্ঘ মাস আমাদের এখানেই কেটে যাবে। এই ক্যাম্পাসে।

ক্যাম্পাস কি আমার খুব খারাপ লাগছে?

এতোক্ষণ যে জীবনযাত্রার বর্ণনা দিয়েছি—তাতে হ্যা বোধক উত্তর দেয়াটাই তো স্বাভাবিক ছিলো, নয় কি?

অথচ আমি বলবো না; ক্যাম্পাস আমার ভালোই লাগছে।

ভালো লাগছে কারণ আমরা সবাই এখানে পরস্পরের সুখ দুঃখ এমনভাবে ভাগ করে নিয়েছি যে খারাপ লাগার অংশ প্রত্যেকের ভাগেই অতি অল্প পরিমাণে পড়েছে।

একদিনের কথা বলি।

সকাল ৯টা ২০-এ ক্লাশ ছিলো। ব্যস্তসমস্ত হয়ে গাড়ি বের করলাম—কারণ ৯টা ১০ বাজে। পথে গাড়িতে উঠলেন সহকর্মী দুজন—ভূইয়া ইকবাল ও সজলেন্দু দে। ফ্যাকাল্টি তখনো আধ মাইল পথ মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় স্টিয়ারিংয়ের ওপর থেকে আমার হাত সরে যেতেই গাড়ি প্রবল বেগে আঘাত করলো এক রিকশাকে উইন্ড শিল্ড ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো, রিকশার যাত্রী দুজন ছাত্র ও রিকশাওয়ালা তখন ছিটকে পড়েছে রাস্তার এক পাশে, গাড়ি তখনো সচল, আরো দুজন ছাত্র লুটিয়ে পড়লো রাস্তার ওপরে—কখন যে কিংকর্তব্য বিমূঢ় আমি ব্রেকের উপরে পা রেখেছি, গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি, কিছুই মনে নেই! শুধু মনে আছে, আমার মাথার ভেতরে তখন সহস্র আগুনের স্ফূলিঙ্গ জ্বলছে আর নিভছে—এখন কি হবে? আহতদের কারো মাথা রক্তাক্ত, কেউ আর্তনাদ করছে, কেউ অজ্ঞান—দেখতে দেখতে ছাত্রদের ভিড় জমে গেলো—আমি কাকে কী জবাবদিহি করবো? এমন সময় দেখি, আমার কাছে এগিয়ে আসছে ছাত্ররা—তাদের মুখে ক্রোধ নেই, ক্ষোভ নেই, সহপাঠিদের জখম করেছে যে অবিবেচক তার প্রতি বিদ্বেষ নেই—তাদের সবার চোখে শুধু উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ—‘স্যার, আপনি ভালো আছেন তো? আপনার কিছু হয়নি তো?’

না, আমার কিছু হয়নি—আমি ভালো আছি। আমি ভালোই আছি এই ক্যাম্পাসে।

আপনারা কী বলবেন বলুন?

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞান গবেষণা

আজিমউদ্দিন মল্লিক

১৯৬৬ সালে বাংলা, ইংরেজী, ইতিহাস ও অর্থনীতি এই চারটি বিভাগ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। ৬৬ থেকে ৭৫ এই ১১ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি আশানুরুপ প্রসার লাভ করেনি। দেশের দারুণ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ধীর অগ্রগতিতে আরও মন্থরতা দান করেছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ চালু হয় ১৯৬৭ সালে। অংক ও পরিসংখ্যান বিভাগ দুটোকে নিয়ে বিজ্ঞান ভবনের দ্বার উন্মোচিত হয়। অতঃপর ১৯৬৯ এ পদার্থ ও রসায়ন শাস্ত্র খোলা হয়। উদ্ভিদ বিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা সামুদ্রিক জীব বিদ্যা খোলা হয় ১৯৭৩ সালে। সামুদ্রিক জীববিদ্যা ছাড়া বিজ্ঞানের অন্যান্য সবগুলো বিভাগই একটিমাত্র অট্টালিকার মধ্যে অবস্থিত। বিজ্ঞান ভবনের গবেষণাগারগুলোতে গবেষণার পরিবেশ ও ব্যস্ততা তেমন একটা লক্ষ্যণীয় নয়। এর কারণ বহুবিধ। যাহোক এর মধ্যেও কিছুসংখ্যক গবেষণা কর্মীর প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে যে সামান্য গবেষণা চলছে তার বিষয় ও ফলাফল সম্পর্কে খুব সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি।

পদার্থ বিদ্যা ঃ

গত সাত বছর সময়ের মধ্যে মোট ছয়জন ছাত্র এই বিভাগে এমএসসি শেষ পর্বে গবেষণা করে ৬ খানা থিসিস পেশ করেছেন। এ বছর কোন ছাত্র এ বিভাগে গবেষণা করছেন না।

পদার্থ বিদ্যা বিভাগের একজন রিসার্চ ফেলো জনাব মুহম্মদ নুরুল মোস্তফা একটা দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার কাজ আরম্ভ করেছেন। তার কাজটা মোটামটি দু’ভাগে বিভক্ত। (ক) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বায়ূমন্ডলে দূষিত পদার্থের (এটমস্ফোরিক কন্টামিজেশন) পরিমাণের তারতম্য নির্ণয়। এ কাজ করতে তিনি বছরের বিভিন্ন সময়ে এখানকার বাতাসে কি পরিমাণ আলফা ও গামা রশ্মি আছে তাই নির্ণয় করবেন। এই গবেষণার ফলে ঐ সকল ফিজিক্যাল প্যারামিটারের সাথে মানুষের স্বাস্থ্যহানির একটা সম্পর্ক নির্ণয় করা সম্ভব হবে। এতে করে জানা সম্ভব হবে যে কোন এলাকার বাতাসে কি পরিমাণ দূষিত রশ্মি আছে তা মানুষসহ অন্যান্য জীবজন্তু এই রশ্মির প্রভাবে কতটা প্রভাবিত হয় এবং কি উপায়ে এর প্রভাব থেকে তাদেরকে রক্ষা করা যায়। জনাব মোস্তফার কাজের আর একটা অংশে তিনি পরীক্ষা করছেন বাঙালীর নিত্যনৈমিত্তিক খাদ্যে কি পরিমাণ রেডিও এ্যাকটিভ পদার্থ আছে। এই সমস্যা সমাধানের পর আমাদের খাদ্য তালিকার একটা বাছাই প্রদান করা সম্ভব হবে। তবে জনাব মোস্তফার গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক প্রফেসর শামসুল হক সাহেবের অনুপস্থিতিতে তিনি ইদানীং বেশ অসুবিধেয় আছেন।

রসায়ন শাস্ত্র ঃ

রসায়ন শাস্ত্রে এ যাবৎ ৫টা এমএসসি থিসিস প্রকাশিত হয়েছে। এ বিভাগের চারটি শাখায়ই (ভৌত, জৈব অজৈব ও ফলিত রসায়ন) বর্তমানে গবেষণার কাজ চলছে। এ বছর আট জন ছাত্র এই চারটি শাখার বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করছেন। তাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন প্রফেসর এ কে এম এস আহমেদ, ডঃ এ কে এম আনিসুজ্জামান ও ডঃ মোহাম্মদ আবু সালেহ। ভৌত রসায়ন গবেষণার দুটি দিক আছে। (১) দুটি যৌগের বিভিন্ন মিশ্রণে ডাই ইলেকট্রিক ধ্রুবক, ভিসকোসিটি, রিফ্রাকটিভ ইনডেক্স ও ঘণত্ব মাপনের সাহায্যে যৌগদ্বয়ের সাংগঠনিক পরিবর্তন সম্বন্ধে তথ্য অনুসন্ধান করা। (২) রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিবেক মাপনের সাহা্য্যে বিক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ বিশ্লেষণ করা।

ফলিত রসায়ন গবেষণা রয়েছে বাশ, পাটের নিম্নাংশ ও কাঠ হতে লিগনিন নামক রসায়নিক পদার্থ আলাদা করে তার ভৌত—রসায়নিক ধর্ম সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে কিভাবে তা কাজে লাগান যায় তার প্রয়াস।

জৈব রসায়নে (১) কতকগুলো নিউক্লিসাইড যৌগের সংশ্লেষণ এবং তাদের এ্যান্টিটিউমার সক্রিয়তা অনুসন্ধান করার প্রয়াস ঃ (২) ডাই এসিটোন গ্লুকোজকে হাইপোক্সেটনিউজারন করে যে যৌগ পাওয়া যায় তার সাংগঠনিক কাঠামো সম্বন্ধে তথ্য অনুসন্ধান করা।

অজৈব রসায়ন (১) কতকগুলো নাইট্রোজেন বিশিষ্ট লিগান্ডের ধাতব চিলেটের স্থিতি ধ্রুবক নির্ণয়করণ এবং উহার বৈশ্লেষিক প্রয়োগ। (২) সন্ধিগত ধাতব জটিল যৌগের বিয়োজনের তথ্য ও বিক্রিয়ার গতি নির্ণয়করণ এবং উহার বৈশ্লেষিক প্রয়োগ।

উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ ঃ

শহর থেকে ১৫ মাইল দূরে জঙ্গলাবৃত, পাহাড় ঘেরা পরিবেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান উদ্ভিদ বিজ্ঞানে শিক্ষাদান ও গবেষণার জন্য একটা ভাল সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বিভাগটি নতুন। এর অধিকাংশ শিক্ষকগণও বয়সে তরুণ, কর্মপ্রেরণায় উজ্জীবিত। দেশী-বিদেশী নানা প্রকার ফলমূল ও শস্যাদির উপর তারা কাজ করছেন। এ বিভাগের শিক্ষক জনাব আবদুল মালেক চৌধুরী, বিভাগীয় প্রধান ডঃ মহাম্মদ আবদুল আজিজ খান সাহেবের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পাহাড়ে নানা জাতের কমলালেবুর একটি পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করেছেন। এক বছর আগে সিলেটের ছাতক, জয়ন্তিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সাজেক উপত্যকা থেকে ১৩ জাতের কমলার চারা এনে রোপণ করেছেন। শিশু গাছগুলোর স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধি দুই-ই আশাপ্রদ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কমলা-লেবু, মালটা, মোসাম্বি, কিম প্রভৃতির বীজ সংগ্রহ করে চট্টগ্রামের পাহাড়ে পরীক্ষামূলক চাষ করবার পর তারা সবচেয়ে ভাল এবং মিষ্টি জাতের কমলা-লেবু যা এখানকার মাটিতে ভাল জন্মে তার চাষ ও পরিচর্যাপ্রণালী সাধারণ্যে প্রকাশ করবেন যাতে করে ঐ ফলের চাষ এদেশে ব্যাপকতা লাভ করে।

এই বিভাগের মিঃ সত্যজিৎ কুমার ভদ্র গবেষণা করছেন পাটের মিউটেশন প্রজননের উপর। পাটের বীজে গামা রশ্মি প্রয়োগের ফলে বেশী ও উন্নত মানের আশযুক্ত কোন নতুন পাটের উদ্ভব করার প্রয়াসে তিনি কাজ করছেন। উল্লেখ্য যে এ কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অর্থ যোগান দিচ্ছেন। এছাড়া রাসায়নিক মিউটেজেনিক পদার্থ দিয়ে টমেটো, বেগুন প্রভৃতির উপর দিয়ে তিনি গবেষণা করছেন।

বর্তমান নিবন্ধের লেখকও এই বিভাগের একজন শিক্ষক। তার হাতে রয়েছে কয়েকটি গবেষণা প্রকল্প। দু-একটির ফলাফল ইতিমধ্যেই নির্ণিত হয়েছে। ভারত ও আমেরিকা থেকে আনা বিভিন্ন জাতের সয়াবিনের পরীক্ষামূলক বাছাই চাষ করছেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। আমেরিকার ব্রাগ, লি, ইম্প্রুভড পেলিকেন ও ভারতে—পাঞ্জাব ও ইউপিএসএস— ৩৮ শেষোক্তটি এখানকার মাটিতে সর্বাপেক্ষা ভাল জন্মে। তাছাড়া এই জাতটি অন্যান্য জাতের তুলনায় একমাস আগে পাকে। ফলে অনেক কম সময়ে এটা জন্মানো যায়। পরবর্তী পর্যায়ে এই সকল জাতের সয়াবিনের বীজের তেল ও আমিষের পরিমাণ নির্ণয় করা হচ্ছে। দেখা গেছে, শীতকালে ফসলটি এখানে ভাল জন্মে না।

আর এক পর্যায়ে প্রবন্ধকার দেখছেন বিভিন্ন মাদ্রার গামা রশ্মি প্রয়োগের ফলে ইউপিএসএস-৩৮ শেষোক্তটি জাতের সয়াবিনটার আরও কোন উন্নতি সম্ভব কিনা। দেখা গেছে ৩০ কে আর গামা রশ্মি প্রয়োগের ফলে একটি ভাল মিউটেন্টের উদ্ভব হয়েছে। অবিশ্যি এটার সার্বিক সাফল্য আরও গবেষণা সাপেক্ষ। তবে সব মাদ্রার গামা রশ্মির প্রভাবেই গাছের বৃদ্ধি কমে যায় কিন্তু গাছগুলোর পাতা অনেকদিন সবুজ থাকে ফলে জীবনচক্র দীর্ঘায়িত হয়। এই রশ্মির প্রভাবে সয়াবিনের ফলন ভাল হয়নি।

গামা রশ্মির এই বৃদ্ধির প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দমন করে একে স্বাভাবিক করে তোলার ক্ষেত্রে বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক হরমনের কোন ভূমিকা আছে কিনা এই বিষয়েও লেখক কাজ করছেন। দেখা গেছে এক্ষেত্রে পটাশিয়াম নেফথেনেট নাম রাসায়নিক দ্রব্যের উল্লেখযোগ্য প্রভাব আছে।

এ বিভাগের শিক্ষক জনাব মোস্তফা কামাল পাশা এ অঞ্চলের ওষুধি উদ্ভিদের উপর কাজ করছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা বিভিন্ন প্রকার ওষুধি উদ্ভিদে খুবই সমৃদ্ধ।

প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ঃ

বিভাগীয় অধ্যক্ষ ডঃ শফিক হায়দার চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে বিভাগীয় শিক্ষকবৃন্দ কর্ণফুলী নদীর প্রাণিকূলের উপর শিল্প দূষিতের প্রভাব পরিলক্ষণ সম্পর্কিত একটি দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা কাজ শুরু করেছেন। পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী কাগজের কল, কর্ণফুলী রেয়ন প্রকল্প প্রভৃতি থেকে নির্গত দূষিতের ফলে কর্ণফুলী নদীর মাছ এবং অন্যান্য প্রাণী বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাছ এবং অন্য প্রাণীর মাধ্যমে এই দূষিত প্রভাব মনুষ্যকূলকেও যে প্রভাবান্বিত করতে পারে সে বিষয়ে চিন্তার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে কর্ণফুলী নদীতে দূষিত প্রভাবের জৈবিক বিশ্লেষণই এই গবেষণার মুখ্য উদ্দেশ্য। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এ কাজে আর্থিক সাহায্য বরাদ্দ করেছেন।

সামুদ্রিক জীববিদ্যা বিভাগ ঃ

এই বিভাগটি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ১৫ মাইল দূরে চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে কর্ণফুলীর তীরে অবস্থিত। এরকম একটি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা বাংলাদেশে এই প্রথম। ডিগ্রী শ্রেণী না খুলে প্রথমবারেই এখানে এমএসসি ক্লাস শুরু করা হয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যে সবাই প্রাণিবিদ্যার ছাত্র। এ বিভাগে বিজ্ঞানের আরও বিভিন্ন শাখার শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন আছে। আশা করা যাচ্ছে ভবিষ্যতে তা হবে। এ বিভাগের শিক্ষক জনাব শাহজাহান হাওলাদার কাজ করছেন গলদা চিংড়ির জীবনচক্রের উপর। এই চিংড়ির কৃত্রিম প্রজনন এবং এর ব্যাপক চাষের উপর দীর্ঘমেয়াদী কাজে তাকে পরামর্শ দান করছেন বিভাগীয় প্রধান ডঃ আবদুল লতিফ ভুইয়া। এই বিভাগেরই জনাব নূরুদ্দিন মাহমুদ নদীর মোহনা ও সমুদ্রে বিভিন্ন এলাকার পানির তাপমাত্রা, লবণ ও অক্সিজেনের পরিমাণ লক্ষ্য করবেন। ভাসমান সামুদ্রিক প্রাণীর উপর এর প্রভাব দেখবেন জনাব ইউসুফ শরিফ।

গবেষণার সুযোগের চেয়ে সমস্যা এখানে বেশী একথা যেমন সত্য তেমনি শিক্ষকদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাদের মধ্যে গবেষণায় কোনই উৎসাহ দেখা যায় না এটা মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। তদুপরি বাসস্থান, যাতায়াত, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, কমিটি ও মিটিং-এর অধিক্য প্রবীণ শিক্ষকগণের প্রশাসনিক ব্যস্ততা ও বিদেশ গমন প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। সবচেয়ে বড় যে অভাবটি আমাদের আছে তা হল শিক্ষা ও গবেষণায় আনন্দবোধশূন্যতা। তবে আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করলে অর্থাৎ কমিটি ও মিটিং-এর জটিলতা ও প্রশাসনপ্রিয়তা ছেড়ে শিক্ষা ও গবেষণার দিকে স্থির ও একাগ্রচিত্তে সাধনা করলে এ সব সমস্যা কাটিয়ে ওটা মোটেই কঠিন হবে না।

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

যাতায়াত সমস্যার কারণে পার্টটাইম চলছে

মাহমুদ-উল-আলম

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শহর থেকে প্রায় চৌদ্দ মাইলের মতো ব্যবধানে। মনোরম পাহাড়ী পরিবেশ চারপাশে। সবুজে সবুজে ছাওয়া সবটা এলাকা। আকর্ষণীয়—এক কথায়। কিন্তু সেটা শুধু দু-একদিনের দর্শকদের জন্য। এখানে এখানকার ‘পাঠাভ্যাস’কারীদের কথা আসে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উচ্ছ্বাসটা চলে গেলে তারা ধীরে ধীরে বোঝে যে এখানে পড়া বড় কষ্টের।

এ কষ্ট শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়াতে। কেননা বিস্তর সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে থেকে বিশেষ করে শহর থেকে আসতে যেতে হয়। হিসেব মতে, একজন ছাত্র বা ছাত্রী বা শিক্ষককে মাসে ৮০০ শত মাইল শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসাতে ভ্রমণ করতে হয়। এতে কি পরিমাণ মানসিক ও দৈহিক ক্ষতি হয় তা বলা বাহুল্য। এ জন্য দায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরে অবস্থিতি।

কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকদের আনা-নেয়ার ব্যাপার তদারকির সার্বিক দায়িত্ব দিয়ে ‘ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্ট’ সৃষ্টি করেন। কিন্তু এ বিভাগ সুচারু হতে পারেনি এখনও। সেখানে যথেষ্ট শৃংখলা ও দক্ষতার অভাব আছে। যার জন্য প্রথম থেকেই যাতায়াত সমস্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচে প্রকট সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। যার মাশুল সমানভাবে ছাত্রশিক্ষক এবং প্রশাসন কর্তৃপক্ষকে যথেষ্ট দিতে হচ্ছে। অহরহ বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তেজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু এখনও এ সমস্যার কোন সমাধান হয়নি।

‘শাটল ট্রেন’ পদ্ধতি চালু করার আগে শহরের ছাত্রছাত্রী আনা-নেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ স্থানীয় ‘পাবলিক বাস সমিতি’ থেকে দিন ২৫ থেকে ৩০টি বাস ভাড়া করতেন। এসব বাস শহরের একটা নির্দিষ্ট স্টপেজ থেকে বিভিন্ন সময়ে (সকাল সাড়ে সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত) বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওয়ানা হতো। আবার ১-৫টার মধ্যে শহর ফেরত আসতো। গড়পড়তা হিসেবে এজন্য খরচ পড়তো দৈনিক আড়াই হাজার টাকার মতো। কিন্তু এ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ও সুষ্ঠু ছিলো না এবং টেকেনি। পরিসংখ্যান মতে জানা যায়, আনুমানিক ৩৫টা বাস যেখানে প্রয়োজন সেখানে ২৫টি এবং মাঝে মাঝে ৩০টি বাস ভাড়া করা হতো। তার ফলে ভিড়, সীট নিয়ে কলহ ইত্যাদির সূত্রপাত হতো। প্রায়ই জায়গার অভাবে ছাত্ররা ছাদে চড়ে বসতো।

আবার সেসব বাস নিয়মিত ছিলো না। সাধারণ যাত্রী টেনে ‘টু পাইস’ কামানোর লোভে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাড়া খাটার প্রতি কোন উৎসাহ প্রকাশ করতো না। তাই সময় মতো ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা-নেয়াতে সায় দিতো না। সে জন্য সুযোগ পেলেই তারা বেকে বসতো। অজুহাত ঃ হয়তো ছাত্রদের ধমক বা টাকা দিতে দেরী অথবা ভাড়া কম ইত্যাদি। অবশ্য এ জন্য যে প্রশাসন কর্তৃপক্ষের গাফিলতি নেই এমন নয়।

অথচ এই খাতে খরচের পরিমাণ কখনোও কম নয়। যেমন ১৯৭৩-৭৪ শিক্ষাবর্ষে কয়েকটি খাতে খরচ—ট্রান্সপোর্ট বিভাগের কর্মচারীদের বেতন বাবদ প্রায় দু’লাখ টাকা। যানবাহনাদির সংরক্ষণ, মেরামত ও তেল খরচে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। পাবলিক বাস ভাড়ার জন্য প্রায় তিন লাখ টাকা এবং অন্যান্য খরচের সব খরচ মিলিয়ে মোট প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা খরচ হয়েছিলো। কিন্তু সমাধান কিছুতেই আসেনি বরঞ্চ সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এরপর কর্তৃপক্ষ গত বৎসর মার্চ মাসে শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা করেন। এতে কর্তৃপক্ষ কিছুটা আর্থিক সুবিধে পেয়েছেন। এজন্য কর্তৃপক্ষকে মাসে ১০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। তবুও রেলে চড়ে ক্লাসে আসতে এবং আবার ফিরে যেতে ছাত্রছাত্রীদের কম ঝক্কি পোহাতে হয় না। যেমন ঃ (১) ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় (কেননা ছাত্রসংখ্যা বরাবর বাড়ছে) রেলের বগী অপর্যাপ্ত। তাই রেলে প্রচুর ভিড় লক্ষ্য করা যায়। প্রসঙ্গত বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌছানোর জন্য সকালে একটি মাত্র ‘শাটল ট্রেন’ রয়েছে। (২) অনির্দিষ্ট সময়ে মত না পৌছা। যার ফলে ক্লাসে সময় মত পৌছা যায় না বা ক্লাস মিস হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এছাড়া (৩) সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রেল লাইন না থাকায় স্টেশন থেকে ফ্যাকাল্টির দূরত্ব প্রায় দেড় মাইলের মতো। এ দূরত্ব অতিক্রম করে ক্লাসে পৌছানোর জন্য কর্তৃপক্ষ শাটল বাসের উপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। কিন্তু এখানেও অপ্রতুল বিশেষণ ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলশ্রুতি হিসেবে স্টেশানে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হয় বাসও ট্রেন দুটোর জন্যই। বর্ষাকালে এভাবে অপেক্ষা করার কষ্টের কথা বলাই বাহুল্য।

শুধু এই রকম করে যাতায়াত সমস্যার জন্যই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বলতে গেলে ‘পার্ট টাইম’ হিসেবেই চলছে। এর দুটো দিক রয়েছে। প্রথমে, যাতায়াত অবস্থার জন্য সাধারণতঃ সকাল ৯-২০/৩০ মিনিটের আগে ক্লাস নেয়া সম্ভব হয় না। অথচ নিয়মানুযায়ী ৮-৩০ মিনিটে ক্লাসের আরম্ভ হওয়ার কথা। কিন্তু শহর থেকে ছাত্র-শিক্ষক কেউই এ সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌছুতে সক্ষম হন না। দ্বিতীয়ত, বেলা ১টা থেকে ২টার মধ্যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যান। কলা, সমাজবিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদ এ সময়সীমার মধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ খালি হয়ে যায়।

এই সময়ের মধ্যে একজন শিক্ষককে ক্লাস নিতে হয়, ছাত্রদের পরামর্শ দিতে হয়, বিভাগীয় সমস্যার ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হয়, লাইব্রেরীর কাজ এবং প্রশাসনিক ভবনের কাজ সব সারতে হয়। বোঝা যাচ্ছে কত কম সময়ে কত দ্রুত একজন শিক্ষককে তার যাবতীয় কাজ সারতে হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের বেলায়ও ঠিক একই কথা বলতে হয়।

বিজ্ঞান অনুষদের অল্পসংখ্যক ছাত্রসংখ্যা নিয়ে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসগুলো ছাড়া আপাতত দৃষ্টিতে এভাবেই একটি ‘শিক্ষা দিনের’ শেষ হয় এবং বস্তুতঃ এ শিক্ষা দিনকে ‘পার্ট টাইম’ বললেও অত্যুক্তি হয় না।

যাতায়াত সমস্যা নিয়ে ফলপ্রসূ চিন্তা করার ও সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য একটি ট্রান্সপোর্ট ‘কমিটি’ রয়েছে। ট্রান্সপোর্ট অফিসার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি নিয়ে এ কমিটি গঠিত। কিন্তু এ কমিটি এখনও কোন ফলপ্রসূ সিদ্ধান্তে পৌছাননি বলবো। কেননা, চমক দিতে পারে এমন কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি এ পর্যন্ত। শুধু কিছু ‘মিটিং’ এ এদের কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা। এর বেশী নয়।

এবার ‘ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্ট’ সম্বন্ধে কিছু বলা যাক। এ বিভাগকে অনাবাসিক ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-কর্মচারী এদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার ব্যাপারে তদারকি ও ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। সর্বমোট ৪২ জনকে নিয়ে এ বিভাগের অস্তিত্ব।

কিন্তু এ বিভাগ যথেষ্ট তৎপর নয়। কাজে অবহেলা ও অযত্নের ছাপ প্রকট। কাজেই যে জন্য এ বিভাগের উদ্ভব সে কাজে কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। কোন সুস্পষ্ট ফল দিতে পারেনি। এবং যার ফলে এ বিভাগ সম্পূর্ণ অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছে। এর জন্য দায়ী শুধু এ বিভাগের কর্মচারী নয় প্রশাসন কর্তৃপক্ষও দায়ী।

ট্রান্সপোর্ট বিভাগে কিছু অসম্পূর্ণতা আছে। যেমন (১) গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হিসেবে এখানে একটি টেলিফোনের সংযোগ প্রয়োজন ছিলো। (২) বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গাড়ীগুলোর জন্য গ্যারেজ নেই। (৩) ওয়ার্কশপ নেই।

‘সবেধন নীলমণি’ ছোটবড় সবরকমের ১৯টি গাড়ীর মধ্যে প্রায় সময় কিছু বিকল থাকে। গেল ১৩ই ডিসেম্বর হিসেব করে দেখা যায় সেদিন প্রায় সব গাড়ীই বিকল ছিলো। এর জন্যও কারণের অভাব নেই। প্রথমতঃ মেরামত কাজে সঙ্গত বিলম্বের জন্য একটি গাড়ী অনেকদিন বিকল থাকে। দ্বিতীয়তঃ গাড়ী কেনার সময় প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের কথা না ভাবা, তৃতীয়তঃ খুচরা যন্ত্রাংশের অভাব এবং কোন কোন ক্ষেত্রে দুষ্প্রাপ্যতা।

মোটামুটি এগুলোই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাতায়াত সমস্যা। বোঝাই যায় এককভাবে এ জন্য কেউই দায়ী নয়। তবুও এর ক্রমবর্ধমান বিস্তার অস্বীকার করার মত নয়। অথচ এর সমাধান খুজে নেয়া খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবুও সমাধানতো চাই-ই।

প্রকৃতপক্ষে যতদিন না এটাকে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা যাচ্ছে ততদিন এই যাওয়া-আসার সমস্যার শেষ হবে না। কোন রকম বিকল্প পদ্ধতির মাধ্যমে এর সুরাহা হবে না। যে কোন বিকল্প পদ্ধতি মানেই আরেকটা সমস্যার সৃষ্টি এবং জলের ধারার মতো খরচের অবাধ সুযোগ করে দেওয়া। সর্বোপরি ছাত্রছাত্রীদের অশেষ ভোগান্তির দ্বার খুলে দেওয়া।

(চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘ট্রান্সপোর্ট রিপোর্ট’)।

(এপ্রিল, ১৯৭৩) অবলম্বনে।

০০০০

বাড়ী থেকে রিকশা। তারপর ট্রেন কিছুটা পথ হেটে। অবশেষে বাস। বাস থেকে ক্লাসরুম।

আমি আমার স্বগোত্রীয়রা অধিকাংশই শহর থেকে চৌদ্দ মাইল দূরে পড়াশোনা করতে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইদানীং যাতায়াতে নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। বাড়ী থেকে রিকশা, তারপর ট্রেন, কিছুটা হেটে। অবশেষে বাস। বাস থেকে ক্লাসরুম। ক্লাশ শেষে বাস-ট্রেন-রিকশা। রিকশা থেকে নেমে আসে অস্থিমজ্জায় দলাবাধা একতাল ক্লান্তি। বইখাতার পাতায় যে ভারমুক্ত হতে চেয়ে জীবনকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়। এই ধ্বংসের মাঝেও সৃষ্টির প্রেরণা উকি মারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে কখনো আলোর ঝলকানির মত আনন্দ উপচে পড়ে। কোলাহল মুখর হয়ে ওঠে মাঠ করিডোর বিশেষ করে বিজ্ঞান ভবন। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অডিটোরিয়াম নেই। যেকোন অনুষ্ঠান বিজ্ঞান গ্যালারীতেই সম্পন্ন হয়। তবে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য বিরাট মাঠ সবাইকে সমাবেশের আহ্বান জানালেও শহরের দূরত্ব অধিকাংশ ছাত্রকে (বিশেষতঃ ছাত্রীদের) দূরে সরিয়ে রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ্যাত্ব জীবনের বিচ্যুতি সবাইকে উপভোগের এ এক বিরাট অন্তরায়। কিন্তু তবুও এখানে প্রাণ আছে জীবন আছে।

এই বুদ্বুদউল্লাস থেকে ছাত্রীরা নিজেদের সযত্নে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়াস পান। পরীক্ষার জন্য তারা তৈরী হতে থাকেন। তারা যেন পরীক্ষা পাশের জন্যই চৌদ্দ মাইলের সেতু পেরিয়ে আসেন। ফলে তাদের সীমিত দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হতে হয় গুটিকতক ছাত্রীকে। তারা প্রাণময় জীবনরসে উজ্জীবিত। তাদেরকে তীব্র সমালোচনার পাল্লায় পড়তে হয়। ফলে প্রতিটি কাজেই সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব আর দ্বিধা।

দ্বন্দ্ব-দ্বিধার দোলায় দুলছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। ধীরে অতি ধীরে তা ক্রমশঃ কেটে যাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রী সমাজের যে পরিবর্তন ঘটছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রকাশ দ্রুত হলেও চাটগা বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটছে মৃদুভাবে। কেননা যুগের হাওয়াকে অস্বীকার করা যেমন কষ্টকর স্বীকার করাও তেমনি বেদনাদায়ক।

–জান্নাত সুলতানা 

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ছাত্রছাত্রীরা কি ভাবছেন?

হাসানুজ্জামান চৌধুরী, অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ

[বর্তমান নিবন্ধটি সমাজতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর পরিচালিত একটি তথ্যানুসন্ধান জরীপের প্রাথমিক ফলাফলের ভিত্তিতে রচিত। স্বভাবতই এতে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণার সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ প্রত্যাশা করা যায় না। বস্তুতঃ সীমিত পরিসরে একটি দুটি সমস্যার ও যথার্থ বিশ্লেষণ সুসাধ্য নয়, তেমন প্রচেষ্টা সুবিবেচিতও নয়। তাই কয়েকটি বিষয়ের প্রাথমিক ফলাফলের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত সাধারণ আলোচনার সূত্রপাত করছি মাত্র। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পর্যায়ে সর্বতোভাবে সহযোগিতা পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, বিভাগীয় প্রধান জনাব মীজানুর রহমান, সুহৃদ সহকর্মীবৃন্দ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে।]

গবেষণার উদ্দেশ্য ঃ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে আজ তরুণসমাজ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে আশা-নিরাশার ভাবনা-দুর্ভাবনার যে ঘূর্ণায়মান দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি তার সার্বিক প্রকাশ আর প্রতিনিধিত্ব তরুণসমাজের ভাবনাচিন্তা আর কার্যকলাপের মধ্যেই সবচেয়ে বেশী পরিলক্ষিত একথাও প্রায় নির্দ্বিধায় বলা চলে। অন্যান্য দেশের মত, বিশেষতঃ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও যুব সমাজ—এক কথায় আমাদের জাতীয় চেতনা ধারক-বাহক (বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলন ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে যুব সমাজের ভূমিকা স্মর্তব্য) আর তাই তাদের ভাবনাচিন্তার ওপর তথ্যানুসন্ধান নিয়ে এগুলোর সময়োযোগী ও বিশ্লেষণ ও অনুধাবন সমাজ-কাঠামো ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সম্পর্কে ছাত্র, শিক্ষক, প্রশাসক, পরিকল্পনাবিদদের জন্য সবিশেষ গুরুত্ববহ।

মৌল প্রসঙ্গ ঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা তিন হাজারের কিছু বেশী। অনুষদ রয়েছে মোট চারটি—সমাজ বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান অনুষদ। গবেষণার উদ্দেশ্যে সর্বমোট ৯০৮ জন অর্থাৎ ৩০ শতাংশের মত ছাত্রছাত্রীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। প্রতিটি সাক্ষাৎকারদানকারী ৬৪টি প্রশ্ন সম্বলিত একটি প্রশ্নমালা তাৎক্ষণিক ও ব্যক্তিগতভাবে পূরণ করে দেন। মোটামুটিভাবে প্রশ্নগুলো তিনটি শ্রেণীভূক্ত ছিল। যেমন—

(ক) সামাজিক-অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যা বিষয়ক,

(খ) ব্যক্তিগত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সমস্যাদি সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের সচেতনতা ও মতামত বিষয়ক এবং

(গ) ছাত্রছাত্রীদের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গী বিষয়ক।

বিভিন্ন শ্রেণীর প্রশ্নোত্তর থেকে এখানে কিছু কিছু ব্যাখ্যার চেষ্টা করব। আর যদিও সবক্ষেত্রেই প্রশ্নোত্তরের শ্রেণীবদ্ধ পরিসংখ্যানসূচী, প্রামাণ্য দলিল তবু স্থানাভাবহেতু বর্তমান নিবন্ধে সবক্ষেত্রে ওগুলো ব্যবহার করব না, শুধু সারাংশটুকুই তুলে ধরব।

সাক্ষাৎকারদানকারী ছাত্রছাত্রীদের ৪৭ শতাংশ স্থানীয় অর্থাৎ চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাস, অবশিষ্ট ৫৩ শতাংশ নোয়াখালী, সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, ফরিদপুর ও বরিশাল থেকে আগত। এদের ৭৩ শতাংশের বয়সসীমা ২০ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে, ২২ শতাংশের বয়স ২৪ বছর ও তার ওপরে এবং ৫ শতাংশের ২০ বছরের নীচে। শতকরা ৮৬ জনেরই বাড়ি গ্রামাঞ্চলে, অবশিষ্ট ১৪ জনের শহরে। এদের মধ্যে শতকরা মাত্র ৩ জন স্বনির্ভর অর্থাৎ লেখাপড়ার যাবতীয় ব্যয়ভার নিজেরাই বহন করেন, বাকী সবাই পিতামাতা ভাই অথবা অন্যদের ওপর নির্ভরশীল।

আমাদের গ্রাম-প্রধান সমাজে পরিবার-কাঠামোর মধ্যে কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলেও এমন কিছু মৌল পরিবর্তন এখনো সংঘটিত হয়নি যাতে করে পরিবার ব্যবস্থা আমাদের জন্মহার হ্রাস, সংস্কারমুক্ত পরিবেশ, স্বনির্ভরতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও উদ্যোমশীল ব্যক্তিত্বের প্রেরণার উৎস হয়ে সার্বিক সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রগতির সহায়ক হতে পারে। পক্ষান্তরে বর্তমান গবেষণা থেকে দেখা যায় যে মোট উত্তরদানকারী ছাত্রছাত্রীদের ৭১ শতাংশেরই ৮ থেকে ১৩ জন এবং ২৬ শতাংশের ১ থেকে ৭ জন পর্যন্ত ভাইবোন রয়েছে—যদিও এদের ৬০ শতাংশের একক পরিবারের এবং তুলনামূলকভাবে কম অর্থাৎ ৩৭ শতাংশে যৌথপরিবারের সদস্য। এত অধিকসংখ্যক সন্তান-সন্ততির যাবতীয় প্রয়োজন মিটিয়ে তাদেরকে আবার জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার উপযুক্ত সুযোগ দেয়া (বিশেষতঃ স্বাধীনতাত্তোর অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে) যে অধিকাংশ গ্রামবাসী মাতাপিতার পক্ষে কতটা দুঃসাধ্য তা অতি সহজেই অনুমেয়। এটা পরিষ্কার যে আমাদের সমাজে সম্পূর্ণভাবেই প্রাচীন সংস্কার ও সনাতন মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সন্তান জন্মদানের ব্যাপার এখানে সামাজিক দায়িত্ববোধ বা বৈজ্ঞানিক বিচক্ষণতার আদৌ কোন অবকাশ নেই।

ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিজেদের বিয়ে, পরিবার ইত্যাদি সম্বন্ধে যে দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করেন তাতেও সনাতন মূল্যবোধের প্রভাব, প্রচ্ছন্নভাবে হলেও বর্তমান। মোট সাক্ষাৎকারদানকারী ছাত্রছাত্রীদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশী ৭৯% বিয়ের ব্যাপারে নিজ ও অভিভাবকদের যৌথ পছন্দের ওপর আস্থাশীল এবং অর্ধেকের কিছু বেশী ৫১% যৌথ পরিবারের পক্ষপাতি। বিয়ে এবং পরিবারের মত প্রথা-প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন সাধারণত-সমাজের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মৌল কাঠামোর পরিবর্তনের ওপর নির্ভরশীল। আর যেহেতু আমাদের সমাজে এ ধরনের মৌল কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া খুব বেশীদূর এগোয়নি সেহেতু ছাত্রছাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গীতেও সনাতন সংস্কারবোধের প্রতিফলন থাকবে এটি অপ্রত্যাশিত নয়। অবশ্য জনসংখ্যা সমস্যা সম্পর্কে এদের সচেতনতা রয়েছে। জনসংখ্যা যে খুব দ্রুত বাড়ছে এবং এই দ্রুত বৃদ্ধির হার যে বিপজ্জনক ৫৯ শতাংশ সাক্ষাৎদানকারী। তা স্বীকার করেন। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ৭৪% ছাত্রছাত্রী পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা সম্বন্ধেও ওয়াকেফহাল এবং এও মনে করেন যে প্রত্যেক দম্পতিরই এটি গ্রহণ করা উচিত।

বৃত্তি নির্বাচনের শতাংশ বন্টন ঃ

অনুষদ
বৃত্তি কলা সমাজ বিজ্ঞান বাণিজ্য বিজ্ঞান মোট
রাজনীতি
চাকুরী ১৭ ২৬ ২৫ ৩১ ২৬
ব্যবসা ১১ ১৬ ২৮ ১১ ১৮
শিক্ষকতা ৬২ ৪৬ ৩৭ ৫০ ৪৬
অন্যান্য
মোট ১০০ ১০০ ১০০ ১০০ ১০০

১ নম্বর টেবিল 

ব্যবহারিক জীবনের বৃত্তি নির্বাচনে ছাত্রছাত্রীরা অন্য কোন পেশার চাইতে শিক্ষকতাকেই বেশী পছন্দ করেন ৪৬% [১ নম্বর টেবিল]। চাকুরী পছন্দ করেন ২৬ শতাংশ। কিন্তু বৃত্তি হিসেবে রাজনীতিতে রয়েছে একেবারে ন্যূনতম আস্থা (মাত্র ৩%)। শিক্ষকতার প্রতি সর্বাধিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় কলা অনুষদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। এই পেশার প্রতি তুলনামূলকভাবে অধিক প্রবণতার মধ্যে ও সনাতন মূল্যবোদের আভাস মেলে প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের সমাজে এই পেশাবলম্বিরা বিশেষ শ্রদ্ধার্হ। কিন্তু বর্তমানেও শিক্ষকতার প্রতি এই যে শ্রদ্ধাবোধ তা শুধুমাত্র ঐতিহ্যগত ও আদর্শগত বলা চলে। সাম্প্রতিককালে যে দুটি পেশা বাস্তব উদ্দেশ্য সাধনে সবিশেষ সহায়ক তা হলো ঃ রাজনীতি ও ব্যবসা। একথা অনস্বীকার্য যে যদিও এ দুটি পেশার সাথে কিছু কিছু অপযশ বা দুর্নীতির অভিযোগ মাত্রাভেদে সব দেশেই আছে তবু বর্তমানে আমাদের দেশে এ ধরনের অভিযোগের মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশী। আর সম্ভবতঃ সে কারণেই এগুলো ছাত্রছাত্রীদের তত পছন্দ নয়, অন্তত এখন নয়।

জীবনে সাফল্য সম্পর্কে মতামতের শতাংশ বন্টন ঃ

অনুষদ
কারণ কলা সমাজ বিজ্ঞান বাণিজ্য বিজ্ঞান মোট
অদৃষ্ট ৪০ ৫৪ ৪৮ ৪০ ৪৮
নিজ চেষ্টা ৬০ ৪৪ ৫১ ৬০ ৫১
অন্যান্য
মোট ১০০ ১০০ ১০০ ১০০ ১০০

২ নম্বর টেবিল

ব্যবহারিক জীবনে সাফল্যের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ৪৮% সাক্ষাৎকারদানকারী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অদৃষ্টবাদী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় (২ নম্বর টেবিল)। মোট সাক্ষাৎকারদানকারীদের ৫১ শতাংশ নিজ চেষ্টার ওপর আস্থাশীল। কলা আর বিজ্ঞান অনুষদ্বয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সর্বনিম্ন ৪০% অদৃষ্টবাদ এবং সর্বোচ্চ ৬০% নিজ চেষ্টায় আস্থাশীলতা পরিলক্ষিত হয়। সাধারণভাবে অদৃষ্টবাদিতা অনুন্নত বা অনগ্রসরমান সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচিত হয়। বস্তুতঃ যে সমাজে ব্যক্তির সাফল্য যোগ্যতার চাইতে তার পরিবারিক সম্পর্ক, দল বা শ্রেণীগত আনুগত্য বা অন্যবিধ প্রভাব-প্রতিপত্তির মানদন্ডে নিরূপিত হয় সেখানে বিড়ম্বিতেরা দলে দলে অদৃষ্টবাদের পতাকাতলে সমবেত হয়। এটি সামাজিক অবক্ষয়েরই সুস্পষ্ট লক্ষণ। আমাদের সমাজদেহে সর্বসাধারণ্যে এর ক্রম-বিস্তার ঘটছে বৈকি!

শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের ব্যাপারে মতামতের শতাংশ বন্টন ঃ

অনুষদ
মতামত কলা সমাজ বিজ্ঞান বাণিজ্য বিজ্ঞান মোট
কোন পরিবর্তন নয়
কিছু পরিবর্তন ২৭ ১৬ ১৬ ১৬ ১৮
আমূল পরিবর্তন ৭৩ ৮২ ৮৪ ৮৩ ৮১
অন্যান্য/নিরুত্তর
মোট ১০০ ১০০ ১০০ ১০০ ১০০

৩ নম্বর টেবিল

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের ব্যাপারে সাক্ষাৎকারদানকারী ছাত্রছাত্রীরা সবাই একমত (৩ নম্বর টেবিল)। ৯৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই এই মত পোষণ করেন যদিও ৮১ শতাংশ একেবারে আমূল তথা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পক্ষপাতি। তাদের মতে (টেবিলান্তরে পরিলক্ষিত) প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা না বাস্তবমুখী না একটি নতুন সমাজে। প্রয়োজনমুখী। ছাত্রছাত্রীদের এ ধরনের মতামত বলা যায় সর্বসাধারণের ইচ্ছারই প্রতিধ্বনী। স্বাধীনতার মুহূর্ত থেকে যে সমস্ত আইন জাতীয় লক্ষ্য আমরা আমাদের সম্মুখে নির্দিষ্ট করে রেখেছি সেগুলো অর্জনে সর্বতোভাবে সহায়ক তেমন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদল শুধুমাত্র একটি অনুকূল ও বাস্তবমুখী শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই প্রত্যাশা করা যায় এবং যেহেতু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সেই উদ্দেশ্যেই সার্থক ভূমিকা নিতে পারছে না তাই এটাকে জাতীয় স্বার্থেই পরিবর্তিত করতে হবে বৈকি।

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ব্যাপারে মতামতের শতাংশ বন্টন ঃ

অনুষদ  
মতামত কলা সমাজ বিজ্ঞান বাণিজ্য বিজ্ঞান মোট
সন্তোষজনক ৫৫ ৬৫ ৬৮ ৬৬ ৬৫
সন্তোষজনক নয় ৪৫ ৩২ ৩৪ ৩৪ ৩৫
অন্যান্য/নিরুত্তর
মোট ১০০ ১০০ ১০০ ১০০ ১০০

৪ নম্বর টেবিল

সাক্ষাৎকারদানকারী ছাত্রছাত্রীদের ৬৫ শতাংশ মনে করেন যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সন্তোষজনক। অবশিষ্টরা (৩৫%) মনে করেন এটা ততটা সন্তোষজনক নয় ৪ নম্বর টেবিল। অনুষদ সাপেক্ষে এ ধরনের মতামতের বিশেষ পার্থক্য নেই। তাই ছাত্র-শিক্ষকদের পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার কারণেই বর্তমানে শিক্ষার মান নেমে যাওয়া অথবা পরীক্ষায় ফেলের হার দ্রুত বেড়ে যাওয়া ইত্যাকার অভিযোগগুলো অন্ততঃপক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ৬৫ ভাগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন এটা প্রমাণ সাপেক্ষেই বলছি। কিন্তু তাই বলে বর্তমানে এদেশে ‘শিক্ষার মান নিম্নমুখী’ এবং ‘ফেলের হার উর্ধ্বমুখী’ এমন বাস্তব সত্যগুলো অস্বীকার করার মূঢ়তা দেখাচ্ছি না। তবে আসল সত্য জানার জন্যে সাম্প্রতিককালের সামাজিক অবস্থার দিকে দৃষ্টি দিতেই পাঠকবর্গকে শুধু অনুরোধ করবো। সত্য সেখানেই নিহিত। স্বাধীনতাত্তোর আরো অনেক সমস্যার মত বর্তমান শিক্ষাসংকটও একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা, আর সমাজকাঠামোর বিশেষ অবস্থা থেকেই এ সমস্যার উদ্ভব হয়েছে যেমনটি হয়েছে অন্যবিধ সমস্যাগুলোর বেলাতেও। শিক্ষাব্যবস্থাটাই পুরে সমাজ নয়, বস্তুতঃ এটা শুধু একটি অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সামাজিক পরিবর্তন বা প্রগতির জন্যে এ প্রতিষ্ঠান বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে এটা অনস্বীকার্য, কেবলমাত্র বৃহত্তর সমাজ যদি এই প্রতিষ্ঠানকে তার যথাপ্রাপ্য স্বীকৃতি দেয়! নতুবা এই প্রতিষ্ঠানের কার্যধারাকে শুধু বৃহত্তর সমাজের বহুমুখী কার্যধারার অনুবর্তী উপাদান হিসেবে বিবেচনা এবং সেই পারম্পর্যেই বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিৎ।

শিক্ষাবহির্ভূত কার্যকলাপে অংশ মতামতের শতাংশ বন্টন ঃ

অনুষদ
কার্যকলাপ কলা সমাজ বিজ্ঞান বাণিজ্য বিজ্ঞান মোট
কোন কিছুতে নয় ৩১ ৩৫ ২৬ ৩৭ ৩২
খেলাধুলা ও গান বাজনা ৩৫ ৩৯ ৪৭ ৩৯ ৪১
রাজনীতি
অন্যবিধ ২৮ ২৩ ২৩ ২২ ২৩
নিরুত্তর
মোট ১০০ ১০০ ১০০ ১০০ ১০০

৫ নম্বর টেবিল

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতিবিমুখ ৫ নম্বর টেবিল। সাক্ষাৎকারদানকারী ছাত্রছাত্রীদের ৯৭ শতাংশই রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেন না। বস্তুতঃ এদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ৩২% শিক্ষাবহির্ভূত কোনপ্রকার কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেন না। অবশিষ্টরা রাজনীতি ব্যাতিরেকে ৬৪% খেলাধুলা, গান-বাজনা, সমাজসেবা, সাহিত্যচর্চা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এবং এসব ব্যাপারে বিভিন্ন অনুষদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই, অর্থাৎ শিক্ষাবহির্ভূত কার্যকলাপে ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ করা-না-করা একটি অনুষদ নিরপেক্ষ ব্যাপার। ইতিপূর্বে ১ নম্বর টেবিলে দেখা গেছে, এবং এখানেও দেখা যাচ্ছে যে, ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতিতে কম উৎসাহী। ফল হিসাবে অর্থাৎ ছাত্র-রাজনৈতিক কার্যকলাপের দরুণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার ব্যাঘাত হয় ন্যূনতম। শিক্ষাবহির্ভূত অন্যবিধ কার্যকলাপে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ছাত্রছাত্রীর অনুৎসাহের কারণ হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থিতি, প্রয়োজনীয় সংখ্যক ছাত্রাবাসের অভাব, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার অশেষ হয়রানি, সময়াভাব, ভ্রমণের ক্লান্তি ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কারণগুলো যে শুধু ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাবহির্ভূত কার্যকলাপেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাই নয়-এগুলো সমভাবে, বস্তুতঃ আরো প্রকটভাবে তাদের লেখাপড়ারও বিঘ্ন ঘটায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ লাইব্রেরী-সমস্যার কথা বলা যায়। প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব সংখ্যাস্বল্পতা সত্ত্বেও লাইব্রেরী ব্যবহারের যেটুকু সুযোগ এখানে রয়েছে তাও উপরোল্লিখিত কারণগুলোর জন্যে ছাত্রছাত্রীরা সদ্ব্যবহার করতে পারেন না। এসব প্রকট সমস্যাদির কথা সাক্ষাৎকারদারীদের প্রায় সবাই ব্যক্ত করেছেন।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রাজনৈতিক কার্যকলাপের প্রতি ঔদাসীন্য লক্ষ্য করা গেলেও রাজনৈতিক সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ বা দায়িত্বশীল দেশপ্রেম-বলতে যা বুঝায় তার কোনই অভাব নেই। মোট সাক্ষাৎকারদানকারীদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশী (৭৭%) জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মোট ৫০ শতাংশ প্রত্যক্ষভাবে এবং ২৭ শতাংশ পরোক্ষভাবে এতে অংশগ্রহণ করেন। মাত্র ২৩ শতাংশ বলেছে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক সচেতনতার ইঙ্গিত বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের ব্যাপারেও লক্ষ্যণীয় ৬ নম্বর টেবিল।

বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের ব্যাপারে মতামতের শতাংশ বন্টন ঃ

অনুষদ
বৈদেশিক সাহায্য কলা সমাজ বিজ্ঞান বাণিজ্য বিজ্ঞান মোট
কোন দেশ থেকেই নয় ৮৩ ৮৭ ৮৭ ৭৮ ৮৩
সব দেশ/গোষ্ঠী থেকে ১৭ ১৩ ১৩ ২২ ১৭
অন্যান্য/নিরুত্তর
মোট ১০০ ১০০ ১০০ ১০০ ১০০

৬ নম্বর টেবিল

মোট সাক্ষাৎকারদানকারীদের ৮৩ শতাংশই বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের পক্ষপাতী নন। অবশিষ্টরা অর্থাৎ ১৭ শতাংশ দেশ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সাহায্য গ্রহণের পক্ষপাতী। প্রথমোক্তরা সম্ভবতঃ বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের রাজনৈতিক সামাজিক পরিণতির কথা বিবেচনা করে স্বনির্ভরতায় আস্থাবান। আর শেষোক্তরা দেশের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে এরূপ সাহায্যের অপরিহার্যতারই ইঙ্গিত দিচ্ছেন। বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করা বা না করার উপকারিতা ও অপকারিতা যাই থাকুক, কিংবা বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল জাতির পক্ষে বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ যত অপরিহার্যই বিবেচিত হোক, এধরনের সাহায্যের রাজনৈতিক সামাজিক পরিণতি সম্পর্কে দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজের সচেতনতা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার ঃ রহমান এম মিজানুর, হোসেন মোশাররফ ও চৌধুরী এ এফ হাসান।

সমাজ তত্ত্ব বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মার্চ, ১৯৭৫

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এতো ছাত্র পরীক্ষায় ফেল করছে কেন?

চাকসু নেতার তদন্ত দাবী

(বিচিত্রা প্রতিনিধি)

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি এস এম ফজলুল হক এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছেন ঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গৃহীত পরীক্ষাগুলোতে এতো বেশী সংখ্যক পরীক্ষার্থী কেন অকৃতকার্য হচ্ছে তার কারণ উদঘাটনের জন্য আমরা তদন্ত করার দাবী জানাচ্ছি। তিনি বলেন, এরকম ঢালাও অকৃতকার্যতার জন্য এককভাবে পরীক্ষার্থীরাই দায়ী একথা আমরা মনে করি না। উপযুক্ত কমিটির মাধ্যমে তদন্ত হলে মূল গলদ কোথায় তা স্পষ্ট হবে।

চাকসুর ভিপি ফজলুল হকের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি চাকসু কার্যালয়ে। ফ্যাকাল্টি বিল্ডিং-এ ঢোকার মুখেই চাকসু কার্যালয়। বেশ বড়সড় কামরা। চাকসুর সাবেক জিএস (শহীদ) আবদুর রবের একটা ছবি আছে। এক টেবিলে দৈনিক পত্রপত্রিকা ছড়ানো। ছাত্রছাত্রীরা আসছে। যাচ্ছে। নানা গল্পগুজবে মুখর থাকে চাকসু অফিস।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাসমূহ ও তার সমাধান সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলা হলে ছাত্রনেতা জনাব হক বলেন, ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক সমস্যাই প্রধান সমস্যা। তিনি বলেন, প্রচুর টীনসেডের ব্যারাক করে দিলে আপাতত ছাত্রাবাস সমস্যা মেটানো যায়। বিআরটিসি বাস যদি মূল রাস্তার বদলে আমাদের ক্যাম্পাস ঘুরে গেলে একটা বিরাট সমস্যার সমাধান হতো। তিনি বলেন, এসব সমাধানের উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে নিতে হবে।

ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক শূন্যতার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, মূল মিলনায়তন সম্পূর্ণ করা না হলে এর সমাধান হবে না। তিনি বলেন, আমাদের জিমন্যাসিয়াম নেই। ছাত্রীদের জন্য ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর নেই। ক্যাফেটেরিয়া নেই। আমরা মেডিক্যাল ব্লকের আরো সম্প্রচার চাই। চাই একটি মিনি হাসপাতাল।

যদি কখনো চাকসু নিষিদ্ধ হয় আপনারা কি করবেন? ফজলুল হক বলেন, ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব যখন আমাদেরই তখন দায়িত্ব পালন করে যাব। যদি এই দায়িত্ব পালন করার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায় তখন সাধারণের একজন হয়ে থাকব। ছাত্র সমাজের মধ্যে ফিরে গিয়ে স্থির হবে আমাদের পরবর্তী ভূমিকা।

চাকসুর সহ-সভাপতি ফজলুল হক এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম পর্বের ছাত্র। এর আগে ইতিহাসে তিনি এম এ পাশ করেছেন। ফজলুল হকের বাড়ী চাটগায়।

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সম্পর্কে গোলাম জিলানী চৌধুরী বলেন, আমাদের ক্যাম্পাসের যাবতীয় কার্যপদ্ধতি এমনই যে একমাত্র ক্লাসরুম ছাড়া ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের আর কোন সুযোগ নেই। ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কের জন্য একই বাসে, একই ট্রেনে যাওয়া-আসা খুব কাজে লেগেছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো হল, আরো স্টাফ কোয়ার্টার, একটি শিক্ষক মিলনায়তন স্থাপনের দাবী জানান।

ছাত্রছাত্রীরা সাংস্কৃতিক তৎপরতায় মোটেও অনুৎসাহী নয়। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম্পূর্ণতাই ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টির পরিপন্থী।

এছাড়া জিলানী চাকসুর ভিপির বহু বক্তব্যের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

গোলাম জিলানী চৌধুরী বর্তমানে ইতিহাস নিয়ে এম এ পড়ছেন। এর আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ পাশ করেছেন। জিলানীর বাড়ী ফেনীতে।

চাকসু নির্বাচন

গত বছর ১৯শে অক্টোবর চাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্র লীগ, ছাত্র লীগ (র-সি), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অংশ নেন। ছাত্র লীগ (রব-সিরাজ) নির্বাচনে বিজয়ী হন।

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পরিচিতি

শামসুল হোসাইন

চট্টগ্রাম শহর থেকে রাঙামাটি সড়ক ধরে যাবেন দশ মাইল। আলাওলের দীঘি পার না হতেই হাতের বাম পাশে একটি চওড়া সোজা রাস্তা। ফলক ঃ পড়ুন ঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সড়ক নম্বর ঃ দুই। পশ্চিমের দূর দিগন্তে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিন ঃ দেখবেন, পাহাড়ের গায়ে ছবির মতোন কিছু অট্টালিকা। হাতের বায়েও আর একটি বিজ্ঞাপন ফলক ঃ আপনার শত্রুকে চিনেন কি? ভড়কাবেন না—এটি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতাধীন ইরি ক্ষেতের পোকা-মাকড় সম্পর্কে হুশিয়ারী। রাঙামাটি সড়কে আপনার অবস্থান থেকে পশ্চিমের পাহাড়ের দূরত্ব দু’মাইলের কাছাকাছি। বা হাতের রাস্তা ধরে সোজা এগুলেই আপনি পৌছে যাবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইচ্ছে হলে রাঙামাটি সড়ক পথে আরও সামনে যেতে পারেন। আলাওলের দীঘি পেরুতেই হাতের বায়ে পড়বে আকাবাকা আরও একটি রাস্তা। রাস্তার পাশের ফলক আগের মতোই, শুধু নাম্বারের জায়গায় ঃ এক। এ রাস্তা দেখেও আপনি যেতে পারবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ রাস্তা প্রাচীন। দু’নম্বর সড়ক নতুন।

আলাওলের দীঘির উত্তর পাড়ে আছে এক প্রাচীন মসজিদ। এ মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে সুলতান রুকুনুদ্দীন বারবক শাহের আমলে রাস্তিখান নামক জনৈক মজলিস আলা মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন বলে শিলালিপি উৎকীর্ণ আছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হাটহাজারী থানার ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। ফতেহপুরের পাশের ফতেহাবাদ গ্রাম একসময় চট্টগ্রামের রাজ-প্রতিনিধিদের প্রধান কর্মস্থল ছিল। ফতেহপুর এলাকার প্রাচীনতত্ত্ব সন্দেহাতীত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যে পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত, স্থানীয় লোকেরা তাকে বলে রাজবাড়ীর পাহাড়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ভবন নির্মাণের সময় মাটি খুড়তে অনেক গভীরে পাওয়া গেছে দু’খানা তাম্র নির্মিত প্রাচীন থালা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের আগে-আগে জঙ্গাল ফতেহপুরের এ পাহাড় এলাকা হল জনবিরল। শোনা যায় অনার্স ব্লকের সামনে মরা আম গাছটির তলায় বাঘের হাতে লোক মরেছে অনেক। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হরিণের আনাগোনা প্রাথমিক কালের পুরানো ছাত্রদের নিকট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

এমন এ প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। যার বয়েস এখন দশ। চট্টগ্রাম শহরে সরকারী কলেজকে কেন্দ্রে করে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। কিন্তু ১৯৬৬ সালে যখন চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আলোচনা আরম্ভ হলো তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত অত্র বিভাগের সব জেলা নিজ নিজ এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের জোর দাবী তুলতে লাগলো। কিন্তু তদানীন্তন সরকার চট্টগ্রামেই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর এম ও গনি প্রমুখের সমন্বয়ে একটি স্থান নির্বাচন কমিটি গঠন করলেন। স্থান নির্বাচন কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্যে ফতেহপুরের নির্জন পাহাড়ী এলাকাকেই বেছে নিয়েছিলেন। শহর থেকে দূরে জনবিরল এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে স্থান নির্বাচনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। শহরকে ছাত্র রাজনীতির ‘কলুষ’ মুক্ত রাখা। জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্বাচনেও একই উদ্দেশ্য কাজ করেছিল।

প্রাথমিক পরিকল্পনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আবাসিক। ১৯৬২ সালে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক পরিকল্পনার খসড়া তৈরী করেন জনাব ফেরদৌস খান। তিনি তখন প্রাদেশিক জনশিক্ষা বিভাগের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সহযোগী পরিচালক ছিলেন। এ পরিকল্পনায় ৬২.৬৭৫ মিলিয়ন টাকা আনুমানিক খরচ ধরা হয়। কিন্তু ১৯৭০ সালে অনুমোদিত ১৯৬৫-৬৬ থেকে ১৯৮৪-৮৫ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশসালা মহাপরিকল্পনায় খরচের আনুমানিক হিসাব ধরা হয় ২৩৭.৩১৬ মিলিয়ন টকা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আয়তনও ৭৫০ একর থেকে ১৭১৮.৪৭ একরে বর্ধিত করা হয়।

মহাপরিকল্পনার মোট একুশটি হল নির্মাণের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। এ পর্যন্ত চারটি হল ও মেয়েদের জন্য একটি হোস্টেল নির্মাণ করা হয়েছে। কলা ভবনের নির্মাণ অর্ধ সমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে। বিজ্ঞান ভবনের নির্মাণ কাজ ৯৫% শেষ হয়ে গেছে। একটি বড়ো অডিটোরিয়াম-এর নির্মাণ কাজ অর্ধপথে এসে বন্ধ হয়ে আছে। প্রশাসনিক ভবন হিসেবে নির্মিত চারতলা কংক্রিট দালানে এখন তিনতলা জুড়ে আছে লাইব্রেরী এবং চতুর্থ চারুকলা বিভাগ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু বিশেষ বিভাগ খোলার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। প্রথম উপাচার্যের উদ্বোধনী বক্তৃতায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত্ব হিসেবে সামুদ্রিক জীববিদ্যা, সমুদ্রতত্ব, গভীর সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ, চারুকলা, প্রত্নতত্ব, নৃতত্ব ইত্যাদি বিশেষ বিভাগ চালু করার প্রস্তাব ছিল। ইতিমধ্যে চারুকলা ও সামুদ্রিক জীববিদ্যা বিভাগ খোলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব উদ্যোগে চট্টগ্রাম এলাকায় একটি সাধারণ যাদুঘর প্রতিষ্ঠাও একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ছাপাখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। অনার্স ব্লক হিসেবে পরিচিত প্রেস ভবনে ছাপার যন্ত্র সংযোজনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে।

শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসিক ভবনের নির্মাণের কোন নতুন উদ্যোগ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নেয়া হয়নি। মোটামুটি পঞ্চাশ জনের মতো শিক্ষক ও কর্মচারী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাসা পেয়েছেন যেখানে বর্তমানে শিক্ষকের সংখ্যাই দু’শর উপরে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। চারজন ডাক্তার শিক্ষক কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজন মেটান। কিন্তু কোন বড়ো রকমের অসুখ-বিসুখ বা দুর্ঘটনায় তেরো মাইল দূরে শহরেই দৌড়াতে হয়। এ কাজে চিকিৎসা কেন্দ্রে একটি এম্বুলেন্স আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রয়োজন মেটানোর জন্যে একটি স্কুলও স্থাপন করা হয়েছে। আশেপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা মেধার ভিত্তিতে এ স্কুলের অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করতে পারে।

চারটি বিভাগে দুশ ছাত্র-ছাত্রী এবং সাত জন শিক্ষক নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস আরম্ভ হয় ১৯৬৬ সালের ২৮শে নবেম্বর। তবে নবেম্বরের ১৮ তারিখই সরকারী উদ্বোধনী দিবস। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ডঃ এ আর মল্লিক প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত হন এবং ১৯৬৬ সালের পহেলা অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ ত্বড়িৎ গতি লাভ করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে একটি উপশহর গড়ে তোলার কথা ভাবা হয়েছিলো। বিশ বছরে যে সব ভবন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গড়ে উঠার কথা তার মধ্যে রয়েছে ঃ

১। প্রশাসনিক ভবন

২। কলা ভবন (দটি)

৩। বিজ্ঞান ভবন (চারটি)

৪। বড়ো অডিটোরিয়াম

৫। ছোট অডিটোরিয়াম (৩টি)

৬। গ্রন্থাগার

৭। ফ্যাকাল্টি ক্লাব

৮। যাদুঘর

৯। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র

১০। মসজিদ

১১। প্রকৌশল দফতর

১২। চিকিৎসা কেন্দ্র

১৩। প্রেস ভবন

১৪। স্কুল কমপ্লেক্স

১৫। সেন্ট্রাল স্টোর্স

১৬। ছাত্রাবাস (২৪টি)

১৭। সায়েন্স ওয়ার্কশপ

১৮। উপাচার্য ভবন

১৯। শিক্ষক-কর্মচারীদের আবাস

২০। ভৃত্যদের আবাস

২১। ইউওটিসি ভবন

২২। রিসার্চ ইনস্টিটিউট

২৩। বিপনি কেন্দ্র সিনেমা হল, ব্যাংক, বাজার

২৪। শরীর চর্চা কেন্দ্র

২৫। খেলার মাঠ (বিভিন্ন মাপের বিভিন্ন মাপের ৪৮টি)

২৬। জল-ক্রীড়ার জন্য আচ্ছাদিত জলাধার ইত্যাদি।

শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্বের কথা বিবেচনা করে বাজার, সিনেমা, বিপনি, পেট্রোল পাম্প, ব্যাংক ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্থাপনের প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে উল্লেখ করা হয় যে, এসব আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নির্বাহের ব্যয় অত্যাধিক বেড়ে যাবে। এছাড়াও বিভিন্ন সংযোগ সড়ক খাল, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, পোস্ট অফিস, জেনারেটর রুম, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়কেই করতে হয়েছে। মহাপরিকল্পনানুযায়ী অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পাচটি ফ্যাকাল্টিতে তিরিশটি বিভাগ থাকার কথা। এর মধ্যে কলা ও মানবিক অনুষদে ঃ ইংরেজী, বাংলা, ইতিহাস, প্রাচ্য ভাষা, ইউরোপীয় ভাষা, চারুকলা ও ফিলসফি। আইন অনুষদ। সমাজ বিজ্ঞান অনুষদে ঃ অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজতত্ব, ভূগোল, বাণিজ্য ও ব্যবসা প্রশাসন। মৌল বিজ্ঞান অনুষদে ঃ রসায়ন, পদার্থ বিদ্যা, অংক, উদ্ভিদ বিদ্যা, প্রাণী বিদ্যা, ভূবিদ্যা, মৃত্তিকা বিজ্ঞান ও অণুজীবতত্ব। ফলিত বিজ্ঞান অনুষদে ঃ ফলিত পদার্থবিদ্যা, ফলিত রসায়ন, বনিবিজ্ঞান, আবহাওয়াতত্ব, ফার্মেসী, সমুদ্রতত্ব, সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান, জৈব রসায়ন, সংখ্যাতত্ব ও ফলিত গণিত। ১৯৮০-৮৫ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪২১ জন শিক্ষক ও .৬৬০০ জন ছাত্রছাত্রী থাকার কথা। এর মধ্যে বিজ্ঞান অনুষদগুলোতে শতকরা ৬০% ভাগ ছাতছাত্রী ভর্তি করার পরিকল্পনা ছিল। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮টি বিভাগ চালু রয়েছে। ছাত্রসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার।

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

কয়েকজন অধ্যাপকের অভিমত

এই বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থানান্তরিত না করে বরং বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আদর্শের সঙ্গে মিল রেখে নতুনভাবে গড়ে তোলা উচিৎ

–ডঃ এখলাসউদ্দীন আহমদ সভাপতি, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ডীন বিজ্ঞান অনুষদ

বিচিত্রা ঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান সমস্যা কি এবং উন্নয়নের অন্তরায় কি?

ডঃ আহমদ ঃ বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি বিদ্যাপীঠ যেখানে সর্বোচ্চ মানের শিক্ষা ও গবেষণা করার সকল প্রকার সুযোগ ও সুবিধা পাওয়া যাবে। এ উদ্দেশ্য সফল করতে হলে মেধাবী ও অনুরাগী শিক্ষক এবং বিদ্যানিষ্ট ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও প্রয়োজন প্রশস্ত পাঠাগার, শ্রেণীকক্ষ, পরীক্ষাগার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং সর্বোপরি ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য যথোপযুক্ত বাসস্থান। বস্তুতঃ, এটি এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক ছাত্র ও শিক্ষক ছাড়া যার কল্পনা করা দুরূহ।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, আজ অবধি এ বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঠাগারের নীল-নকশাটি পর্যন্ত তৈরী হয়নি। ছয়-সাত বছর পর্যন্ত এর পাঠাগারটি এমন জায়গায় ছিল যেখানে পঞ্চাশ-ষাটটি ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষে একত্রে পাঠ করা দুষ্কর ছিল। বছর দু’এক ধরে এটি স্থানান্তরিত হয়েছে। তবে এটিকেও কোনমতেই বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগার বলা যায় না। বলতে গেলে একটি সর্বাঙ্গ—ভরপুর পাঠাগারই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। আমাদের পাঠাগারটির একাধিক সমস্যা আজও দূর করা সম্ভব হয়নি।

এ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের সমস্যা খুবই শোচনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যূন তিন হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে মাত্র এক হাজার ছাত্র-ছাত্রী কোন প্রকারে ক্যাম্পাসে বসবাস করতে পারে। বাকী সবাইকে পনের মাইল দূরবর্তী শহর অথবা অনুরূপ দূর-দূরান্ত থেকে আসতে হয়। প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে এবং যেতেই প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে শারীরিক পরিশ্রম মানসিক অশান্তি ও পুষ্টিকর আহারের অভাব সত্ত্বেও তারা যেভাবে এ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে থাকে তা ভাবতে আশ্চর্য লাগে।

দুইশতেরও অধিক শিক্ষকদের মধ্যে অনধিক চল্লিশজন ক্যাম্পাসে বাস করতে পারেন। বাকী সবাইকে শহর থেকে প্রতিদিন এসে গিয়ে অধ্যাপনা করতে হয়।

তাড়াহুড়োর মধ্যে সকাল সাড়ে আটটা থেকে দুপুর দেড়টার মধ্যেই সকল পাঠ্যক্রম চুকিয়ে তাদেরকে শহরে চলে যেতে হয়। দৈনিক প্যাসেঞ্জারীর নানারকম অসুবিধা তাদের পোহাতে হয়। স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কাছ থেকে পুরোমাত্রায় সহযোগিতা পেতে পারছে না।

শিক্ষকদের সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীও দুপুরের মধ্যেই শহরে ফিরে যায়। পাঠাগারের কাজ তারা প্রায় করতেই পারে না। এরকম তাড়াহুড়োর মধ্যে কোনদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন-অধ্যাপনা চলতে পারে না। অবশ্য এখানে বলা প্রয়োজন, বিজ্ঞান অনুষদ-এর ব্যতিক্রম। এখানে যথারীতি সকাল সাড়ে আটটা হতে বিকাল সাড়ে পাচটা পর্যন্ত অধ্যয়ন-অধ্যাপনা ও পরীক্ষাগারের কাজ চলে থাকে।

উন্নয়নের মূল অন্তরায় অর্থ, বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি, সঠিক অগ্রাধিকার নির্বাচন ও সর্বোপরি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

বিচিত্রা ঃ এই সকল সমস্যা সমাধানে প্রশাসনিক আর্থিক নীতিগত ও বাস্তব সমাধান কি কি?

ডঃ আহমদ ঃ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রতিষ্ঠাতারা যে উদ্দেশ্যেই শহর থেকে এত দূরে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করে থাকুন না কেন, বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে। এটিকে সহজেই স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা যায়। শহরের কোলাহল হতে দূরে শান্ত সমাহিত প্রাকৃতিক পরিপার্শ্বের মধ্যে এটাকে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা যায়, যেখানে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক যারা আসবেন, তারা কেবল জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা চর্চা করার জন্যেই এখানে আসবেন।

সেইদিকে লক্ষ্য রেখে দেশ স্বাধীন হবার পরপরই এ বিশ্ববিদ্যালয়টির ভবিষ্যৎ রূপ-রেখা নিয়ে প্রশাসন ও শিক্ষকদের মধ্যে নানারূপ আলোচনা হয়। অধিকাংশের মতে এই বিদ্যাপীঠটিকে স্থানান্তরিত না করে বরং বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আদর্শের সঙ্গে মিল রেখে নতুনভাবে গড়ে তোলাই উচিত।

তাই ঠিক হলো, এটিকে বেশী বড় না করে বরং ছোটর মধ্যেই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান কাঠামোতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা পাচ হাজারের বেশী হবে না। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের জন্যে ক্যাম্পাসে আবাসিক হলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রায় চারশত শিক্ষকদের শতকরা পচাত্তর ভাগের জন্যেও আবাসিক বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তার জন্যে দরকার অর্থের। বর্তমানে উন্নয়ন খাতে প্রতি বছর আমরা যে অর্থ পাই তা দিয়ে লক্ষ্য টাকার দেনাই শোধ করা সম্ভবপর হচ্ছে না। নতুন পরিকল্পনা হাতে নেয়া দূরে থাক।

এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে স্বনির্ভর একটি পরিপূর্ণ বিদ্যাপীঠে পরিণত করতে হলে, এর অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ আর্থিক বরাদ্দ দিতে আমাদের বকেয়া দেনার ভারটি তুলে নিতে হবে। তারপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অন্তত তিন হাজার ছাত্র-ছাত্রীর জন্যে আবাসিক হল ও দুইশত শিক্ষকের জন্যে আবাসিক গৃহনির্মাণ করে দিতে হবে। এটিকে যত তাড়াতাড়ি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার ব্যবস্থা করা যাবে, ততই তা দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক।

অর্থলাভের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রশাসন—ব্যবস্থাকে সকল জড়তা কাটিয়ে যত শীঘ্র সম্ভব এটিকে পূর্ণাঙ্গ করার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশাসনকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থা ও বৈশিষ্ট্য বিচার করে সকল ব্যাপারে অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। যে সকল উর্ধ্বতন কর্মচারীর ক্যাম্পাসে থাকা একটি উন্নয়নশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অপরিহার্য তাদেরকে অবশ্যই নিজেদের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগ করতে হবে। সভ্যতা থেকে বহু দূরে একটি নির্ণীয়মান পরিকল্পে যেখানে কর্মকর্তাদের দিনরাত থাকা দরকার সেখানে যদি তারা অতিথির মত দৈনিক ছয় সাত ঘণ্টা কাটিয়ে চলে যান, তবে তার নির্মাণের বিশেষ অগ্রগতি আশা করা যায় না।

তাই আজ দরকার বহু বছরের পুঞ্জীভূত দেনার বোঝা হতে মুক্তি। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশেষ বরাদ্দ যাতে করে এটি শীঘ্রই তার স্বনির্ভর রূপ নিতে পারে। সর্বোপরি প্রশাসনকে এ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাবিধ সমস্যার মাঝখানে থেকে তাদের সমাধান করতে হবে।

বিচিত্রা ঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবীণ ও মেধাবী শিক্ষক সংখ্যা কম কেন? এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে মেধাবী ও ভালো শিক্ষকরা কেউ কেউ বাইরে চলে যাচ্ছেন বা চলে যাবার কথা ভাবছেন কেন?

ডঃ আহমদ ঃ প্রবীণরা সর্বদাই নিজেদের সুস্থিত স্থান ছেড়ে সাধারণতঃ কোথাও যেতে চান না। ঢাকা রাজধানী। পরন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রবীণতম বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ, জাহাঙ্গীরনগর বাদ দিলে, চট্টগ্রৃাম বিশ্ববিদ্যালয়ই দেশের কণিষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয়। তাছাড়া যে স্থানে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছে, তার নানারূপ অসুবিধার কথাও ভুললে চলবে না। এ সকল কারণ প্রথম থেকেই এখানে আসার প্রবণতা প্রতিষ্ঠিত প্রবীণদের মধ্যে খুব কম দেখা যায়। একই কারণে, মেধাবী শিক্ষকরাও এখানে আসার বিশেষ কোন কারণ খুজে পান ন। সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই আর্থিক সুযোগ-সুবিধা মোটামুটি সমান। কাজেই রাজধানীর আকর্ষণ ও নানারূপ সুযোগ-সুবিধার সম্ভাবনা ছেড়ে বিশেষ কেউই এ পাড়াগায়ে আসতে চান না। সত্যি কথা বলতে আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আর কজনইবা শিক্ষকতা করেন? তবে বলা যায় যে, তুলনামূলকভাবে প্রবীণ শিক্ষকের চাইতে মেধাবী শিক্ষকের সংখ্যা এখানে অনেক বেশী।

উপযুক্ত শিক্ষক না পাওয়া গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিভাগ খোলা উচিত নয়। কিন্তু নানা কারণে এখানে কোন কোন বিভাগ খোলা হয়েছে, ছাত্র ভর্তি করা হয়েছে। কাজেই যে সকল শিক্ষক এখানে আসতে ইচ্ছুক তাদের নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। তীব্র প্রতিযোগিতা ছাড়া ভাল শিক্ষক পাওয়া যায় না। এখানে অনেকক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার প্রশ্নই উঠে নাই।

মেধাবী ও ভাল শিক্ষকদের কেউ কেউ এ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কেন বাইরে চলে যাচ্ছেন বা যেতে চাচ্ছেন, তা বলা মুশকিল। তবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এখানে অধ্যাপনা করার আনন্দ বা চ্যালেঞ্জ কম আকষর্ণীয় নয়। হয়ত বা যারা এখান থেকে চলে যেতে চাচ্ছেন, তারা অন্য বিশ্ববিদ্যালয় হতেও চলে যেতে চাইতেন। হয়ত বা দেশের বর্তমান আর্থিক অবস্থায় তারা ভাবছেন দেশের বাইরে গিয়ে সাময়িকভাবে নিজেদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করা যাক। তবে এমন ইঙ্গিত করা সঙ্গত হবে না যে, যারা গেছেন তাদের সবাই মেধাবী এবং ভাল এবং যারা আছেন তাদের সবাই সাধারণ বা খারাপ।

বিচিত্রা ঃ আমরা জানতে পেরেছি এখানে বেশকিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত ও অযত্নে পড়ে আছে। তার আর্থিক মূল্য কত? আর এসব যন্ত্রপাতির উপযোগিতাই বা কি?

ডঃ আহমদ ঃ প্রায় নয় লক্ষ টাকা দামের একটি বিশেষ গবেষণার যন্ত্রপাতি একাত্তরের যুদ্ধের সময় এসে পৌছায়। পরবর্তীকালে আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির অভাবে এটিকে যথাবিহিত চালু করা সম্ভব হয়নি। মাত্র কিছুদিন পূর্বে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কারিগরেরা এসে এটা সংস্থাপন ও চালু করে দিয়ে গেছেন। আর একটি বিশেষ গবেষণার যন্ত্রপাতি এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি উপযুক্ত বিশেষ ধরনের গবেষণাগারের অভাবে। সিমেন্টের অভাবে আজ অবধি অসম্পূর্ণ এ গবেষণাগারটির কাজ সম্পূর্ণ করা যায়নি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আমদানী করাও খুব দুরূহ ব্যাপার হয়ে পড়েছে। অথচ, এছাড়া এ সকল বিশেষ গবেষণাগারের কাজ চলতে পারে না। তবে বলা চলে, এ সকল যন্ত্রপাতি এ যাবৎকালে অব্যবহৃত ছিল কিন্তু অযত্নে ছিল না। পর্যাপ্তসংখ্যক শীতাতপ নিয়ন্ত্রক এবং ডিহিউমি ফাইয়ার না হলে এ সকল বিশেষ যন্ত্রপাতির কার্যক্ষমতা অনেকাংশে লোপ পায় এমন কি শেষ পর্যন্ত এগুলো কাজের অযোগ্য হয়ে যেতে পারে।

বিচিত্রা ঃ বিজ্ঞান অনুষদে বিভিন্ন বিভাগে কয়টি প্রফেসর পদ খালি আছে? এগুলো পূরণের জন্য কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না কেন?

ডঃ আহমদ ঃ বিজ্ঞান অনুষদে বর্তমানে সাতটি বিভাগ আছে। তার মধ্যে ছয়টি বিভাগে একটি করে অধ্যাপকের পদ আছে। এ ছয়টি পদের পাচটি পদই পূর্ণ। যে বিভাগটিতে অধ্যাপকের পদটি শূন্য আছে, সেটি একটি নতুন বিভাগ। বর্তমানে ঐ বিভাগে কোন অধ্যাপক পাওয়া যাবে না এবং প্রয়োজনও হবে না যেনেও কেবল সঙ্গতির জন্যে ঐ বিভাগে অধ্যাপকের পদ খোলা হয়েছিল।

পাচটি পূর্ণ অধ্যাপক পদের মধ্যে দুটির অধ্যাপক বিজ্ঞান—অনুষদে এখনই আছেন। তিনটি পদের অধ্যাপকরা ছুটিতে উচ্চ শিক্ষালাভ করছেন বা অন্যত্র চাকরি করছেন। তারা ঐ পদ ত্যাগ না করা পর্যন্ত ওগুলো পূরণের কোন প্রশ্ন ওঠে না।

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকার বিদ্যাপীঠ করতে হলে শতকরা একশ জন ছাত্র শিক্ষকের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে

–প্রফেসর আবদুল করিম (পিএইচডি) চেয়ারম্যান ইতিহাস বিভাগ, অধ্যক্ষ কলা অনুষদ

বিচিত্রা ঃ আপনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা থেকে যুক্ত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?

প্রফেসর করিম ঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা অনেক। বলতে গেলে জন্মলগ্ন থেকেই এইসব সমস্যার উদ্ভব। শহর থেকে ১৫ মাইল দূরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে কর্তৃপক্ষ তখন যে ভুল করেছিলেন তার জের আমরা এখনও টানছি। এই একটিমাত্র ভুল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য সমস্যার জন্ম দিয়েছে এবং এর মধ্যে যানবাহন ও বাসস্থান সমস্যা প্রকট। শহরে বা শহরের নিকট-উপকণ্ঠে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে যানবাহন সমস্যা থাকতো না বললেই চলে; সেখানে শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীদের শতকরা পঞ্চাশ ভাগের থাকার ব্যবস্থা করলেই বাসস্থান সমস্যার অনেকটা সুরাহা হতো; কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকার বিদ্যাপীঠ বা উচ্চতর গবেষণার উপযোগী করতে হলে শতকরা একশজন ছাত্র-শিক্ষকের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার মনে হয় আজ পর্যন্তও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শতকরা ২৫ জন ছাত্র-শিক্ষকের থাকার ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় করতে পারেননি। একবার এক ছাত্র সংগঠন হিসাব করে দেখিয়েছিলেন যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ক’জন ছাত্রের গড়পড়তা মাসিক ব্যয় বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়রত একজন ছাত্রের গড়পড়তা মাসিক ব্যয়ের তিনগুণ বেশী। শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেলায়ও এই হিসাব প্রযোজ্য।

ছাত্র-শিক্ষকদের দুপুরে খাওয়ারও সুব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখনও শহর গড়ে ওঠেনি, অদূর ভবিষ্যতে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এই সমস্যাও নেই। শহরে অসংখ্য ভালো রেস্তোরা বা হোটেল পাওয়া যায়, যার যেখানে খুশী, সঙ্গতি মোতাবেক খেয়ে নিতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য কেন্টিনের ব্যবস্থা করেছেন, কিন্তু খাবারের মান উন্নয়ন করা কিছুতেই সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

উপরে উল্লিখিত কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশে ব্যাহত হচ্ছে। এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় খন্ডকালীন বা পার্ট-টাইম বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো সেমিনার, বক্তৃতামালা বা সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে সকাল বেলায়ই করতে হয় যাতে সমস্ত ছাত্র-শিক্ষক উপস্থিত থাকতে পারে, তা করতে গেলে আবার ক্লাশ নষ্ট হয়। আবার বিকেলে অনুষ্ঠান করতে গেলে শহর থেকে ছাত্র-শিক্ষকদের আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয়।

ক্যাম্পাসে অবস্থানকারী ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের সমস্যাও কম নয়; কাছে ভালো এবং উন্নত মানের বিপণি বিতান না থাকায় সবাইকেই ছুটতে হয় শহরে। এমনকি আবাসিক হলসমূহের ছাত্রছাত্রীদের দৈনন্দিন কাচাবাজারের জন্যও শহরে যেতে হয়। এটা ব্যয়সাপেক্ষ খরচ বটেই, সময় এবং শক্তির অপচয় হয় এর ফলে।

বলা চলে যে ক্যাম্পাসবাসীরা সভ্যজগতের বাইরে বনবাসে দিন কাটায়। তাদের চিত্তবিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এই একঘেয়ে জীবনযাপন যে কতো কষ্টকর, কতো বিরক্তিকর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ তা বুঝতে পারবে না।

আর্থিক অস্বচ্ছলতার দরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল মহাপরিকল্পনার রূপায়ণ সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন তহবিলে ১ কোটি টাকার উপরে ঘাটতি; বিশ্ববিদ্যালয় এই বিরাট অংকের ঋণের বোঝা নিয়ে এখন খুড়িয়ে চলছে। সরকারী উন্নয়ন গ্র্যান্ট বর্তমানে বাৎসরিক ৭০/৮০ লক্ষ টাকার বেশী হয় না; অথচ নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য যে পরিমাণে বেড়েছে, সে তুলনায় এই অংক অতি নগণ্য।

বিচিত্রা ঃ  এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবীণ ও মেধাবী শিক্ষকদের আকৃষ্ট করার উপায় কি?

প্রফেসর করিম ঃ প্রথম প্রশ্নের উত্তরের পরে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর সোজা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে এবং সমস্যাসমূহের সমাধান করতে পারলে প্রবীণ ও মেধাবী শিক্ষকরা নিশ্চয়ই আকৃষ্ট হবেন।

বিচিত্রা ঃ এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে মেধাবী ও প্রবীণ শিক্ষকরা চলে গেছেন ও যাবার কথা ভাবছেন। আপনি কি মনে করেন, এখানকার কর্তৃপক্ষীয় নীতি প্রবীণ ও মেধাবী শিক্ষকদের নিশ্চয়তা দানের পরিপন্থী?

প্রফেসর করিম ঃ এটা ঠিক যে শিক্ষকের—শুধু শিক্ষকদের কথাই বলি কেন বর্তমানে প্রায় সকল স্তরের লোকই রাজধানীতে থাকার ইচ্ছা করেন। তাছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সমস্যার কথা যা ১ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, সেই কারণেও কোনো কোনো শিক্ষক এখানে থাকতে চান না। বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতনের হার সমান, কিন্তু উপরে উল্লিখিত কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ বেশী হয়, সেদিকে কেউ লক্ষ্য করেন না। এই কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যরত শিক্ষকদের এই অসুবিধার প্রতি সরকারের এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের দৃষ্টি দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

আমি মনে করি না যে এখানকার কর্তৃপক্ষীয় নীতি প্রবীণও মেধাবী শিক্ষকদের নিশ্চয়তা দানের পরিপন্থী।

বিচিত্রা ঃ উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা কি রকম?

প্রফেসর করিম ঃ উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা এখনও সীমিত। গবেষণার জন্য সর্বপ্রথম যা দরকার তা হচ্ছে উন্নত ও আধুনিকমানের লাইব্রেরী এবং ল্যাবরেটরী। এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোটাই এখনও উপযুক্তরূপে গড়ে ওঠেনি। প্রথম দিকে লাইব্রেরী এবং ল্যাবরেটরীর জন্য যা ব্যয় বরাদ্দ ছিল, এখন তা অনেক কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার স্বল্পতার দরুন বিদেশ থেকে আমদানীও ব্যাহত হচ্ছে।

গবেষণার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। গবেষণা পত্রিকা আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত, এই অবস্থার প্রতিকার করা উচিৎ। এছাড়া গবেষণার জন্যে গবেষকদের উৎসাহ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কাউকে কটাক্ষপাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়, তবে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পদোন্নতি বা আর্থিক পুরস্কার দেয়ার বেলায় সবসময় গবেষণার দিকে লক্ষ্য রাখা হয় না। যারা জীবনে এক লাইনও লেখেননি বা প্রকাশ করেননি, এমন লোকও পদোন্নতির বেলায় প্রাধান্য পেয়েছেন এমন নজীর খুব কম নয়। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলিতে এমনটি হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং প্রকাশনার সুযোগ এবং উৎসাহ যোগানোর ব্যবস্থা করলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও উচ্চতর গবেষণার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।

বিচিত্রা ঃ  ১৯৬৬-৬৭ সালের তুলনায় উন্নয়নের গতি এখন শ্লথ কেন? সম্ভাবনা কি?

প্রফেসর করিম ঃ ১ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে প্রকারান্তরে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। তবে আমার মনে হয় স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়ন কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমিত সম্পদকেও উপযুক্তভাবে কাজে লাগানো হয়নি। স্বাধীনতার পূর্বের অসমাপ্ত কাজগুলি সমাপ্ত হয়নি, এবং একমাত্র একটি অস্থায়ী ছাত্রাবাস এবং কিছু ছাত্রীর থাকার জন্য একটি হোস্টেল ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন কাজে হাত দেওয়া হয়নি।

উন্নয়ন কাজে (অগ্রাধিকার) বিবেচনা না করে অনেক সময় অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় কাজে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।

০০০০

সমস্যার আশু সমাধান না হলে এই বিশ্ববিদ্যালয় অচিরেই প্রাইমারী স্কুলে রূপান্তরিত হবে

–প্রফেসর মুহাম্মদ আবদুল আজিজ খান (পিএইচডি) সভাপতি, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ

বিচিত্রা ঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাবলী এবং তার সমাধান সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?

ডঃ আজিজ খান ঃ ১। গবেষণামূলক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবই হচ্ছে প্রধান সমস্যা।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নত হবে না। এমতাবস্থায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্ত শিক্ষকদের গবেষণামূলক প্রশিক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থার আশু প্রয়োজন। গবেষণামূলক প্রশিক্ষণ বলতে আমি বুঝাতে চাই পিএইচডি। এর নীচের কোন ডিগ্রী হলে চলবে না।

এটা সমাধানের জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় একশ শিক্ষকের পাচ বছরের মধ্যে গবেষণামূলক (পিএইচডি) ডিগ্রী করার ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক বছরে বিশজন শিক্ষকের ট্রেনিং ব্যবস্থার প্রয়োজন। ১৯৭৬ সাল থেকে এটা শুরু করতে হবে। নির্বাচন চাকুরীর বয়স সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রয়োজনের ভিত্তিতে হবে (পেছনের শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন হিসাব থাকবে না কারণ তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সকলেরই মান উন্নত করার প্রয়োজন আছে)।

(ক) শিক্ষকদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন স্কলারশীপ থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের লোন দেবার ব্যবস্থা থাকবে এবং প্রত্যেক বছরে সাতজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের লোনে প্রশিক্ষণ নেবে।

(খ) বিদেশী সরকারগুলো যত স্কলারশীপ দেবে তার সবগুলোকেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হবে। এতে করে প্রতি বছর প্রায় দশজন শিক্ষক প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবে।

(গ) জাতীয় সরকারের স্কলারশীপে প্রতি বছর অন্তত তিনজন শিক্ষক প্রশিক্ষণ নেবে।

(ঘ) যে সমস্ত বিষয়গুলোতে পিএইচডি করার সুযোগ বাংলাদেশে আছে সেগুলোর জন্য শিক্ষকেরা স্কলারশীপসহ ৩ হতে ৪ বছরের প্রশিক্ষণজনিত ছুটি নিয়ে ডিগ্রী করবে।

২। বিজ্ঞান ভবনে সর্বক্ষণের জন্য পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের প্রয়োজন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ছেলেখেলার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর অভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস ছাত্রগণ প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে এসে ফিরে যাচ্ছে।

এটা অতি সহজ ব্যাপার কিন্তু সেহেতু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের (……) একটি অট্টালিকা (……….) তাই বিভাগীয় প্রধান (…………..) করতে পারে না। ব্যাপারটি (………..) কর্তৃপক্ষ ও প্রকৌশল বিভাগের শিথিলতার জন্য পড়ে আছে।

অবশ্য বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা কলা বিভাগগুলোতেও সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন।

৩। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতে সমস্ত ক্লাসগুলো ঠিক মত হচ্ছে কিনা তা দেখাশুনা অভিভাবকত্বের অভাব—শিক্ষক আছে অথচ ক্লাস হয় না এরকম ঘটনা ঘটে। বিষয়টা খুবই মর্মান্তিক।

৪। শিক্ষকদের মিটিং ও কমিটির হিড়িক ঃ মিটিংগুলি অহেতুক অতি দীর্ঘস্থায়ী হয়। এগুলো ক্লাসের সময়েই অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষকগণ এতে উপস্থিত থাকেন এতে করে ক্লাসের খুব ক্ষতি হয়। মিটিংগুলো সন্ধ্যার পরে, রবিবারে অথবা ছুটির মধ্যে করতে হবে।

৫। কলেজ ও পরীক্ষা পরিদর্শন ঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাফিলিয়েশন রিনিউ নামক একটা প্রথা প্রচলিত আছে। এতে প্রবীণ শিক্ষকদের প্রায়ই কলেজ পরিদর্শনে যেতে হয়। গত দু’বছর হল ভিজিলেন্স টিম নামে শিক্ষকদের একটি দল গঠিত হয়েছে যার ডিগ্রী পরীক্ষার সময়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহের জন্য কলেজের পরীক্ষা দর্শনের জন্য যান। বিশ্ববিদ্যালয় ইচ্ছা করলেই এই প্রথা বন্ধ করতে পারে। আমি মনে করি এতে আমাদের পড়াশোনার বিঘ্ন ঘটছে।

৬। বিজ্ঞান ও কলাভবনে নির্মিয়মান ঠিকাদারের অবস্থিতি ঃ ঠিকাদারদের কাজের মন্থরতার অট্টালিকাগুলোর সামান্য অসম্পূর্ণ কাজ আর যেন শেষ হয় না। ছয় মাসের একটা প্রোগ্রাম নিয়ে খুটিনাটি যা কাজ আছে সেগুলোর শেষ করিয়ে ঠিকাদারদের অট্টালিকা থেকে বের করে দেয়া যায়।

৭। ছাত্রাবাস সমস্যা ঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় তিন হাজার ছাত্র আছে। এর মধ্যে এক হাজার ছাত্রের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকবার মত হল আছে। বাকী প্রায় দু’হাজার ছাত্র শহর বা অন্যত্র হতে আসে। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা নিজস্ব ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা রয়েছে।

(…………………………..) নির্মাণ (…………..) মুহূর্তে (…………….) সামর্থ নাই যে (…………….) অট্টালিকা নির্মাণ করে (…………) ব্যবস্থা করতে পারে।

এ সমস্যার মোকাবিলা জরুরীভিত্তিতে করতে হবে। তদানীন্তন ঢাকার নীলক্ষেতের ব্যারাকের মত বাসের ব্যারাক নির্মাণ করতে হবে। হয়তো ১৫/২০ লক্ষ টাকার মধ্যে এরকম ঘর তৈরী করে এ সমস্যার মোকাবিলা করা যেতে পারে। এর ফলে অতি শীঘ্র অল্প টাকায় লেখাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সাথে সাথে ট্রান্সপোর্টসহ অনেক সমস্যার সমাধান হবে। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয় ঠান্ডা মস্তিষ্কে কাজ করতে পারবে এবং ধীরে ধীরে স্থায়ী বাসস্থান তৈরী করবে।

৮। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সকল শ্রেণীর কর্মচারীদের বাসস্থান—এরা সকালে ৯/৯.৩০টায় বাসে আসে ১২/১টার মধ্যে আবার বাসেই ফিরে চলে যায়। মাঝখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটু কোলাহল সৃষ্টি হয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ছাত্রদের ন্যায় এদেরও বাসস্থান নির্মাণের প্রয়োজন আছে এদের জন্য সিআই সিটের চালসহ ইটের দেয়াল অথবা তরজার বেড়া দিয়ে ঘর নির্মাণ করে দেয়া প্রয়োজন। এতে ২০/২৫ লক্ষ টাকার মধ্যে এ সমস্যারও সমাধান হতে পারে।

৯। বাজারের অভাব ঃ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটা বাজার বসানো আবশ্যক। অবিশ্যি বিষয়টি কঠিন নয়। পূর্ণ আবাস নির্মাণ হলেই ব্যবসায়ীদের জায়গা বরাদ্দ করে দিলেই বাজার গড়ে উঠবে।

১০। ট্রান্সপোর্ট সমস্যা ঃ এ সমস্যায় বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনৈতিক দিক থেকেও দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত। ছাত্র শিক্ষকদের কর্মচারিগণের বাসস্থান নির্মাণের পরে ট্রান্সপোর্ট বিভাগ লোপ করে দিতে হবে।

মন্তব্য ঃ সমস্যাগুলির আশু সমাধান প্রয়োজন। অন্যথায় এ বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাইমারী স্কুলে রূপান্তর সম্পূর্ণ হতে বেশী দেরী হবে না।

০০০০

পূর্ণাঙ্গ আবাসিক না হলে বর্তমান ক্যাম্পাস তার যৌক্তিকতা হারিয়ে ফেলবে

–মুহাম্মদ ইউনুস

চেয়ারম্যান অর্থনীতি বিভাগ

বিচিত্রা ঃ আপনার মতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যা ও তার সমাধান কি?

ডঃ ইউনুস ঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটিই মাত্র বিশেষ সমস্যা। আবাসিক সমস্যা। বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন ভঙ্গীতে এই সমস্যাটির উল্লেখ করা হয়—দূরত্বের সমস্যা, যাতায়াত সমস্যা, খাবার সমস্যা, পূর্ণকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার সমস্যা, নিঃসঙ্গতার সমস্যা, ছাত্র-শিক্ষক যোগাযোগহীনতার সমস্যা, প্রতিভাবান শিক্ষক আকর্ষণের সমস্যা, গবেষণার সমস্যা ইত্যাদি।

জনপদ থেকে দূরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার সময় যুক্তিযুক্তভাবেই একে পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সে-সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হয়নি বলেই এর বিশ্ববিদ্যালয়-চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। অবিলম্বে আবাসিক করা না-গেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাস তার যৌক্তিকতা হারিয়ে ফেলবে। রোজ সকালে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক কর্মচারীকে সংগ্রহ করে একাজ ব্যয়বহুল ক্লান্তিকর, অপ্রীতিকর এবং অনিশ্চিত ব্যবস্থার মাধ্যমে ১৪ মাইল দূরে নিয়ে গিয়ে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে কয়েকঘন্টার জন্য একত্র করা এবং একই দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে আবার ফেরৎ আনা শুধু হাস্যকর নয়, অপচয়মূলক।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নসূচী এ সমস্যার প্রতি সুবিচার করেনি। ব্যবহারিক যোগ্যতার বিবেচনা স্থপতির সচেতন চিন্তায় বিশেষ কোন ভূমিকা পালন করেছিলো বলে মনে হয় না। প্রথম দর্শনে চমক লাগানোর ঐকান্তিকতা সর্বত্র সোচ্চার। বাইশটি ছাত্রাবাস নিয়ে ছাব্বিশ কোটি টাকা ব্যয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় যে পরিপূর্ণ রূপটি ধারণ করবে বলে স্থপতি স্বপ্ন দেখেছিলেন তারই বাস্তবায়নে সোৎসাহে তিনি লেগে পড়েছিলেন। ক্রমবিকাশের নিজস্ব অপ্রতিরোধ্য দাবী সম্বন্ধে অবহিতির কোন পরিচয় স্থপতি দিতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সবকিছু সহজ দূরত্বে রেখে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ নিউক্লিয়াস গড়ে তোলা এবং ক্রমে ক্রমে তার সম্প্রসারণ করার প্রয়োজনীয়তা তিনি বোধ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমীকে প্লানিং-এর সঙ্গে ফিজিক্যাল প্লানিং-এর সঙ্গতি রক্ষিত হয়নি।

সমাধান ঃ

দু’রকমে এর সমাধান চিন্তা করা যেতে পারে ঃ

(এক) বর্তমান সুযোগ সুবিধার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে ছাত্রসংখ্যা, বিভাগসংখ্যা কমিয়ে ফেলা, অথবা (দুই) ছাত্র-শিক্ষক কর্মচারীর সংখ্যা নির্ধারিত করে নিয়ে প্রয়োজনীয় সুবিধাদির ব্যবস্থা করা।

যারা বর্তমান ক্যাম্পাস থেকে দু’একটি বিভাগ কিংবা অনুষদ শহরে স্থানান্তরিত করার প্রস্তাব দেন তারা প্রথম সমাধানটিই চান। এ ধরনের সমাধান বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক ধারণার পরিপন্থী। যে সামগ্রিকতার নাম বিশ্ববিদ্যালয় ভৌগোলিক দূরত্বের বিচ্ছিন্নতায় সেটা টিকে থাকতে পারে না। জ্ঞানের সকল প্রশাখার সহঅবস্থান ও সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে জ্ঞানের পথে অগ্রসর হওয়া সহজ হবে না।

বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তব সমাধানটি হবে ছাত্রসংখ্যা বর্তমান পর্যায়ে স্থির রেখে প্রয়োজনীয় সুবিধাদির সংযোজন করা।

অর্থের অভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত নির্মাণ কার্য একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে যে সমস্ত নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয়েছে তার দেনা বিশ্ববিদ্যালয় এখনও শোধ করতে পারেনি। প্রায় এক কোটি টাকার দেনা নিয়ে এখন এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারী বিশেষ মঞ্জুরী সাপেক্ষে এ-দেনা থেকে মুক্ত হতে না-পারলে বিশ্ববিদ্যালয় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। তাছাড়াও অসমাপ্ত নির্মাণকার্য সমাপ্ত করা এবং আবাসিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারী অর্থসমর্থনের প্রয়োজন হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌল সমস্যার সমাধানে অর্থ সংস্থানের মতই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন উন্নয়ন সংক্রান্ত অতীতের যাবতীয় সিদ্ধান্তের পুনর্বিচার। অতীতের উচ্চাভিলাষী পর্যায় থেকে বর্তমানের কঠিন বাস্তবে আকস্মিকভাবে নিক্ষিপ্ত হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় লক্ষ্যের স্পষ্টতা হারিয়ে ফেলেছে। অর্থের আয়োজনের পরেও একটি থাকবে হয়ত। যে রাজসিক উদ্যোগের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ স্বাধীনতা লাভের সময় পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছিল তারই নীল নকশার কাঠামোতে বাধা আছে সমস্ত প্রশাসনিক চিন্তাধারা, ক্রিয়াকর্ম। সে-রাজসিকতার অপ্রাসঙ্গিকতা, প্রহসনধর্মিতা উপলব্ধি করতে বর্তমান উপাচার্যের বিলম্ব হয়নি। তার নির্দেশে স্বল্প ব্যয়ে স্বল্প সময়ে যে-সমস্ত নির্মাণ কার্য সমাপ্ত হয়েছে তা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। কিন্তু সামগ্রিক নীল নকশায় এ পর্যন্ত সেগুলো নেহায়েত ব্যতিক্রম হিসেবেই চিহ্নিত। সামগ্রিক পরিকল্পনায় অতীতের দার্শনিক ভিত্তিকে পরিবর্জন করার এবং নতুন ভিত্তির উপর নতুন মহাপরিকল্পনা রচনা করার কোন সুসংহত প্রচেষ্টা এখনো করা হয়নি। ফলে প্রাইয়রিটির অসংলগ্নতা, চিন্তার অপরিচ্ছন্নতা এবং বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে সমস্যার জটিলতর হবার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। পুরনো মহাপরিকল্পনাকে মনে মনে বাতিল করা হয়েছে বটে কিন্তু তার অফিসিয়াল দাপট বহাল রয়েছে। এই সংঘাত থেকে মুক্তির উপায় অবিলম্বে তার অফিসিয়াল বিলুপ্তি ঘোষণা করা।

নতুন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসেরও কিছু প্রয়োজন আছে। বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামোয় উপাচার্যকে অনেকগুলি প্রায়-স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রশাসনিক দফতর পরিচালনা করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মসৃণ কার্যকারিতা অক্ষুন্ন রাখার ক্ষেত্রে এ সমস্ত দফতরের কোনটিরই ভূমিকা গৌণ নয়। একা উপাচার্যের পক্ষে সবগুলি বিভাগের উপর একযোগে সমান মনোযোগ দেয়া সম্ভব নয়। সাধারণত বিভিন্ন কমিটির সহযোগিতায় তিনি এই প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু কমিটির সদস্যগণ বহুরকম দায়িত্বে নিয়োজিত থাকায় তাদের পক্ষে প্রয়োজন মত সময় দেয়া অনেক সময় সম্ভব হয় না। বাসস্থান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্বের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সময়’ একটি বহুমূল্য সামগ্রী।

লোকালয় থেকে দূরে এই নির্মাণাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন এত গুরুত্বপূর্ণ যে কমিটি ছাড়াও সংশ্লিষ্ট দফতরসমূহের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষার জন্য উপাচার্যের একজন বিশেষ সহকারী উপাচার্যের নির্দেশ ও সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবেন এবং দৈনন্দিন অগ্রগতি সম্বন্ধে উপাচার্যকে অবহিত রাখবেন।

রক্ষণাবেক্ষণ যে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের চাইতেও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিনতর কাজ এ-কথার স্বীকৃতি আমরা আমাদের চিন্তায়, সিদ্ধান্তে, প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব বন্টনের ছকে দিতে সম্পূর্ণ নারাজ। এই দৃষ্টিভঙ্গী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে-পরিমাণ খাটি, সারাদেশের জন্যেও সে-পরিমাণ খাটি। আমরা হাজারে হাজারে বাস কিংবা জলসেচের পাম্প কেনার জন্য যত চেষ্টা তদবির ও উৎসাহ প্রদর্শন করি তার একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ- ও সেগুলো তাদের নির্মাতা-নির্ধারিত বয়সকাল অবধি চালু রাখার ব্যাপারে প্রদর্শন করি না। দেশে ডাকসাইটে প্লানিং কমিশন আছে, ডাকসাইটে বাস্তবায়ন ব্যুরো আছে, কিন্তু কোন আকারের মেইন্টেনেন্স ব্যুরো নাই-ই উন্নয়নের অর্থ যারা শুধু স্থাপনা বা যোজনা হিসেবে গ্রহণ করতে চান তারা কেবল উদ্বোধনী দিবসের গৌরবেই উদ্যোগের সার্থকতা খুজে পেতে চান। উন্নয়নের নিগূঢ়ার্থ ঃ যোজিত সুযোগ সুবিধাকে পূর্ণদক্ষতায় ব্যবহারের যোগ্যতা অর্জন।

অর্থনৈতিক তত্বে পুজির বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে। কারণ, যে সমস্ত দেশে এই তাত্বিক কাঠামো রচিত হয়েছে সেখানে পুজির স্বাভাবিক মৃত্যুই স্বাভাবিক ঘটনা। ফলে পুজির অকাল মৃত্যু কিংবা শৈশবমৃত্যুর কোন আলোচনা সেখানে জায়গা পায়নি। অথচ এদেশে সে-আলোচনাই প্রাসঙ্গিক। আমরা পাশ্চাত্য অর্থনৈতিক ট্রাডিশানে পুজি গঠনের চিন্তায় নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখতে অভ্যস্ত, পুজির মড়ক নিবারণের জন্য কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবি না। পুজি বাড়তে পারে নতুন পুজি গঠনের মাধ্যমে—এটা জানা কথা। কিন্তু জন্মমৃত্যুর হার একেবারে গায়ে গায়ে লাগানো হলে সেকথা আর খাটে না। তখন পুজি বৃদ্ধির প্রধান উপায় হতে হবে মৃত্যুর হার কমানো। আমাদের ক্ষেত্রে এই শেষোক্ত পন্থাটিই অগ্রসরের পথ। বিশ্ববিদ্যালয় এ পথে অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনে সাহা্য্য করতে পারে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকল বাস এবং গাড়ীর সারি দর্শনীয় বস্তু। যেগুলো চালু আছে তাদের অধিকাংশ সামর্থ্য ব্যয়িত হয় গাড়ীর ডাক্তারখানায় আসতে যেতে। পানির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় যেকোন সময়। পানির পাম্পগুলির একযোগে বিকল হয়ে পড়ে বলে। দিন গড়িয়ে সপ্তা হয়—পানি পাওয়া যায় না। ল্যাবরেটরীর কাজ বন্ধ থাকে। জীবনযাত্রা দুঃসহ হয়ে উঠে। আবার পানি বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় বলে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় টেলিফোনের খামখেয়ালীপনায়। আনকোরা নতুন ক্যাম্পাসের বাড়ীঘর, ছাত্রাবাস, অফিস, ক্লাসরুম দেখলে মনে হয় সময়ের বহু ধকল সয়েছে বহুকাল ধরে। নতুন বানানো রাস্তা পুরনো হতে সময় লাগে না। সদ্য সমাপ্ত সেতু ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে রাতারাতি। মনোযোগের অভাবে বেঞ্চি, ব্ল্যাকবোর্ড রোদবৃষ্টির কাছে আত্মাহুতি দেয়।

দেশের সামগ্রিক অবস্থার তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবস্থা মোটেই ভয়াবহ নয়। কিন্তু এটি বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে ঃ যেখানে সমাজের সব বিজ্ঞজনের স্থান—সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অবস্থা হলে দেশের কি অবস্থা হবে?

গুরুত্বের ক্রমসূচীতে রক্ষণাবেক্ষণকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। ক্ষণিকের সিদ্ধান্তে উপযুক্ত অর্থানুকূল্যে বিশেষ সুবিধা দেয়া যেতে পারে, কিন্তু তাকে পরিকল্পিত ও সক্ষমভাবে চালু রাখতে হলে স্থায়ী, সমবেত এবং সমন্বিত আয়োজনের প্রয়োজন হয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠকে সে বিষয়ে সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে এবং সে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতার পরিচয় দিতে হবে।

০০০০

পঠন-পাঠনের ব্যবস্থায় এবং পরীক্ষা ব্যবস্থায় নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা যায় কিনা সে চিন্তা আমার আছে

–সৈয়দ আলী আহসান প্রফেসর, বাংলা বিভাগ

বিচিত্রা ঃ আপনি আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছেন। এই সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?

সৈয়দ আলী আহসান ঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই। সুতরাং এ বিভাগে আমার পুনরাগমন অনেকটা আপন গৃহে প্রত্যাবর্তনের মতো এ বিভাগটি বিভাগীয় সকল অধ্যাপকের সহায়তায় নির্মাণ করেছিলাম এবং চেষ্টা ছিলো যাতে পাঠক্রমের সঙ্গে, গবেষণা এবং সাহিত্যকর্ম ও প্রকাশনার কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়। বর্তমানে বিভাগটি তার গবেষণা এবং সাহিত্যকর্মের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে। আমি চেষ্টা করবো যাতে সর্বতোভাবে এ বিভাগটি সফলকাম হয় এবং বিভিন্ন কর্মে সার্থকতা অর্জন করে।

বিচিত্রা ঃ  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে উপাচার্য হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কতটুকু কাজ দেবে?

সৈয়দ আলী আহসান ঃ যতদিন উপাচার্য ছিলাম আমি আমার কর্মকান্ডকে দু’ভাগে ভাগ করতাম—একভাগে ছিলো প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং অন্যভাগে শিক্ষাগত কার্যক্রম। শিক্ষাগত কার্যক্রমকে আমি সর্বদাই গুরুত্ব দিতাম। বর্তমানে এ অভিজ্ঞতা উপাদান হিসেবে আমাকে সর্বক্ষণ সাহায্য করবে। পঠন-পাঠনের ব্যবস্থায় এবং পরীক্ষা ব্যবস্থায় নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা যায় কিনা সে চিন্তা আমার আছে। বিদেশে শিক্ষাকে সময়ের সঙ্গে এবং যুগের কর্মধারার সঙ্গে সমন্বিত করেছে। আমাদের দেশে সে প্রকৃতির সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা এখনো হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তা আছে।

তাছাড়া জীবনে কোনও অভিজ্ঞতাই অর্থহীন হয় না। সকল অভিজ্ঞতাই জীবনকে সমৃদ্ধ করে এবং রূপ দান করে।

০০০০

এখানে ভালো কিছু করার উপায় নেই

রশীদ চৌধুরী

চেয়ারম্যান, চারুকলা বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্পী রশীদ চৌধুরীর কাছে আমাদের প্রশ্ন ছিল দুটি। ১। চারুকলা বিভাগের সমস্যা কি? ২। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক সমস্যা সমাধানের উপায় কি?

কথপোকথনের মাধ্যমে তিনি আমাদের দুটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ফাইন আর্টস বিভাগ প্রথম দৃষ্টিতে চমক সৃষ্টি করলেও এর ভেতরটা তেমন সমৃদ্ধ নয়। আমরা অনেক কিছু করতে চাই। অনেক প্ল্যান আছে আমাদের। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয় এমনই যে, তার কাছে আমাদের বিভাগের তেমন কোন গুরুত্ব নেই। এখানে অনেকে আছেন যারা আর্টকে একটা এ্যাকাডেমিক বিষয় বলেই ভাবতে পারেন না। তারা মনে করেন, এটা তো স্বভাব কবির মতো একটা ব্যাপার। তার আবার কি ক্লাস। এরকম প্রতিকূল মনোভাবের মধ্যে চাটগা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন আর্টস বিভাগ চলছে। আবুল ফজল সাহেব ভাইস চ্যান্সেলর থাকতে আমাদের পক্ষে খানিক সুবিধা হয়েছে। তিনি শিল্পকর্মের মর্যাদা কি তা জানেন। আমাদের সমস্যা কোথায় তা বুঝতে চান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেলে ফাইন আর্টসও বুঝি উঠে যাবে—ভয় হয়।

রশীদ চৌধুরী বলেন, চারুকলা বিভাগের যত কামরা দরকার তা নেই। আমাদের বহু দামী মেশিনপত্র জায়গার অভাবে পড়ে আছে। এগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়তেও দেরী নেই।

আমাদের সাধ্য সীমিত বলে আমরা খুব কম ছাত্রছাত্রীকে পড়াই। আমাদের ছাত্রসংখ্যা কোনদিন খুব বেশী বাড়ানো হবে না। তবু আমাদের চাহিদা মত সরঞ্জামাদি আমরা পাই না।

তিনি বলেন, এভাবে খুড়ে খুড়ে আমরা চলতে চাই ন। আমাদের একটা প্ল্যান আছে, ইনস্টিটিউট করা। উপাচার্যকে আমরা পরিকল্পনা বলেছি। চট্টগ্রামের চারুকলা কলেজ নিয়ে পরিকল্পিত এই ইনস্টিটিউট হলে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবো। তবে তা কখন হবে, বা আদৌ হবে কিনা জানি না। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনের প্রতি।

আমাদের দেশে বহু জিনিস তৈরী হয়, যেমন চায়ের কাপ, প্লেট, চামচ, নানা ধরনের পাত্র, গ্লাস এরকম বহু ব্যবহারিক জিনিসপত্র অথচ এসব জিনিস তৈরী করার সময় শৈল্পিক ডিজাইন তেমন প্রাধান্য পায় না। একটা সাধারণ বিদেশী এ্যাসট্রে যত আকর্ষণীয় হয় দেশে প্রস্তুত দামী এ্যাসট্রেও ঘরে রাখতে মন সায় দেয় না। এর কারণ ডিজাইন। এখানে ডিজাইন, রং ব্যবহার এসবকে কেউ আমল দেয় না। আমাদের ইচ্ছা, আমরা এমন কিছু শিল্পী কর্মী সৃষ্টি করি যারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনের ক্ষেত্রে বিপ্লব আনবে। একমাত্র ইনস্টিটিউট হলেই আমরা স্বাধীনভাবে এ ধরনের পরিকল্পিত কাজে হাত দিতে পারবো।

রশীদ চৌধুরী বলেন, শিল্প শুধু দেয়ালে ঝুলানোর জিনিস নয়। ব্যবহারিক জীবনেও একে কাজে লাগাতে হবে।

আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল ছাত্রদের আবাসিক সমস্যা। রশীদ চৌধুরী একটা ভিন্ন পরামর্শ দিলেন। তার মতে, আর্থিক কারণে যদি এখন নতুন করে হল নির্মাণ করা না যায় তাহলে বর্তমান হলগুলোতে সীট সংখ্যা বাড়িয়ে আবাসিক সমস্যার কিছুটা সমাধান করা যায়। তিনি বলেন, এখন হলের একটি সীটে দু’জন ছাত্র থাকে। তাদের বিছানার সাথে সীট করে উপরে আর একটি বিছানার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাংক করে ডাবল ডেকার বিছানা।

আমরা প্রশ্ন করেছিলাম, তাতে ক্ষুদ্রাকৃতির একটা রুমে চারজন ছাত্রের থাকা, পড়াশুনা, আনুষঙ্গিক অন্যান্য অসুবিধা হবে না? তিনি বলেন, হ্যা অসুবিধা মনে হতে পারে। আমার মনে একটা প্ল্যান আছে। আমি সেই রকম ডিজাইন করে দিতে পারি, যদি আমাকে বলা হয়।

এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু কাজকর্ম আছে যাতে আমি অনেক পরামর্শ দিতে পারি। কিন্তু আমাকে এসব ব্যাপারে ডাকা হয় না। তিনি বলেন, আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের জন্য এখানে একটা কলার বাগান করেছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে সব গরু পালেন সেইসব গরু এসে আমাদের কলার বাগান শেষ করে দিয়েছে। এখানে ভাল কিছু করবো তার জো নেই।

০০০০

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতনামা শিক্ষকদেরকে আকর্ষণ করার মতো কোন অতিরিক্ত জৌলুস এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই

–ডঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল

অধ্যাপক বাংলা বিভাগ

বিচিত্রা ঃ আপনার মতে প্রধান প্রধান সমস্যা ও তার সমাধান কি?

ডঃ আবু হেনা ঃ বস্তুতঃ এই বিশ্ববিদ্যালয় সমস্যাকন্টকিত। চাটগা শহর থেকে ১৩ মাইল দূরে এর অবস্থান। ক্যাম্পাসে এক-তৃতীয়াংশ ছাত্র কোনো রকমে থাকতে পারে। দু’হাজারেরও বেশী ছাত্র প্রতিদিন শহর থেকে ক্যাম্পাসে আসে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়। চাটগা স্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে ছাত্রদের সুবিধার চেয়ে অসুবিধা বেশি হচ্ছে বলে মনে হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাদেরকে আসতেই হয়। আবার ক্লাস চলাকালেই ঘড়ি দেখতে হয় ঘন ঘন—কারণ ট্রেন ছেড়ে দিলে সারাদিনের মতো অভুক্ত থাকতে হবে। ক্যাম্পাসে অল্পমূল্যে ছাত্রদের পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের কোনো আয়োজন নেই।

শিক্ষকদের সামান্য কয়েকজন থাকেন ক্যাম্পাসে। ফলে ছাত্রদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় গড়ে ওঠার অবকাশ কম। অধিকাংশ শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রদের পরিচয় নেই। নিতান্তই পেশাদার কর্মচারীর মতো শিক্ষকরা শহর থেকে এসে রুটিনমাফিক বক্তৃতা দিয়ে দেড়টার সময় শহরে ফিরে যান। তাদের দোষ দেয়া যাবে না। কারণ সবারই তো স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য আছে।

এইসব অসুবিধার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া ভয়ানক রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। পাঠাগার যদিও সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে—দুপুরের বিরতির পর সেখানে জনপ্রাণীর দেখা মেলে না।

ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকদের কোনো সাংস্কৃতিক জীবন নেই। এখানে যেসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় তার উপলক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, ছাত্র ও শিক্ষকদের আগমন অথবা গমন। এবং অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারিত হয় অনিবার্য কারণেই বেলা ১০টায়। ফলে সেদিন আর কোনো ক্লাস হতে পারে না। সন্ধ্যায় কোনো অনুষ্ঠানের কথা এখানে অকল্পনীয়। শ্রোতা-দর্শক শিল্পী কোথায় পাওয়া যাবে? তাছাড়া কোনো অডিটোরিয়াম নেই,–সেক্ষেত্রে সায়েন্স গ্যালারীই একটু বড়ো ধরনের অনুষ্ঠানের জন্যে একমাত্র ভরসা। মাইক্রোফোন ব্যবহার করলে সেদিন গোটা ফ্যাকাল্টির লেখাপড়া কাঠগড়ায় উঠবে।

সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ভীষণ অর্থসংকটের মধ্যে আছে শুনেছি। আমি প্রশাসনের সঙ্গে আদৌ যুক্ত নই। অতএব টাকা পয়সা ইত্যাদির চাহিদা সম্পর্কে সঠিক অংক বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

আরো হাজারো অসুবিধার কথা বলা যায়।

যেসব সমস্যার উল্লেখ করেছি তার সমাধান করতে হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একান্তই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করতে হবে অবিলম্বে। সরকারী-বেসরকারী সব রকম সাহায্য নিয়ে ক্যাম্পাসে সমস্ত ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা করতেই হবে। হলে সীট না থাকলে কোনো ছাত্র ভর্তি করা উচিত হবে না। প্রথম প্রথম এতে করে বিক্ষোভ হৈ চৈ হতে পারে—কিন্তু কালক্রমে এই ব্যবস্থার সুফল ফলবেই।

বিচিত্রা ঃ মেধাবী ও প্রবীণ শিক্ষক কম কেন? আকর্ষণের কী কী উপায়?

ডঃ আবু হেনা ঃ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিষ্ঠিতও খ্যাতনামা শিক্ষকদেরকে আকর্ষণ করার মতো কোনো অতিরিক্ত জৌলুষ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। বরং উল্টোটা। এখানে দ্রব্যমূল্য সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে দ্বিগুণ বেতন দিলেও জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্যের কথা ভেবে এবং জীবন-যাপনের অন্যান্য অসুবিধার কথা চিন্তা করে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষকেরা কেউ স্থান বদলের এই অহেতুক ঝুকি নিতে চাইবেন না। তাছাড়া একই পদে এলে, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রীডার যদি চট্টগ্রামে রীডার হয়েই আসেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বেশি বেতন নীতিগতভাবে দেবেন না।

এই অবস্থার উন্নতি হতে পারে দুইভাবে।

এক, বিশ্ববিদ্যালয়কে খেয়াল রাখতে হবে, উপযুক্ত স্বীকৃতির অভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষক যেন অন্যত্র চলে না যান। দুই, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বোর্ডের মাধ্যমে শিক্ষক-বিনিময় কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষক তাহলে এই কর্মসূচীতে স্বল্পমেয়াদী চুক্তিতে চাটগায় আসবেন—চাটগার শিক্ষক যাবেন রাজশাহী; রাজশাহীর শিক্ষক একইভাবে যাবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিচিত্রা ঃ এখানকার ছাত্রদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

ডঃ আবু হেনা ঃ ভালো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র বিনয়ী, শিষ্ট এবং অত্যন্ত আইনানুগত।

বিচিত্রা ঃ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, উচ্চতর পর্যায়ে, পঠন-পাঠনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মতামত কী? উন্নয়ন প্রসঙ্গে আপনার মত?

ডঃ আবু হেনা ঃ বাংলা ভাষার জন্যে যতো অশ্রর প্লাবন বয়ে গেছে, ততো কাজ হলে আমরা সবাই খুশি হতাম। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা পঠন-পাঠন নানা কারণেই বিঘ্নিত হচ্ছে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর মৃত্যুর পরে গোটা দেশে তাদের স্তরের শিক্ষকের সংখ্যা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। আমাদের ভালো শিক্ষক নেই; তাই আতঙ্কিত হই এই ভেবে যে দশ বছর পরে কি আমরা ভালো শিক্ষক পাবো? সবাই ভেবে রেখেছেন বাংলা হলো সর্বশেষ আশ্রয়। অন্য কোনো বিষয়ে ভর্তি হতে না পারলে বাংলা পড়তে হবে। তাহলে আগামী দিনে প্রতিভাবান বাংলার অধ্যাপক কোত্থেকে আসবেন?

বাছাই করে ছাত্র ভর্তি করতে হবে। কোনো বিশেষ সুপারিশে ভর্তি করা চলবে না। বাংলা ব্যাকরণর চেয়ে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসের পঠন-পাঠনের ওপরে জোর দিতে হবে। সন তারিখের মুদ্দাফরাস গবেষকের মুকুট না-পরিয়ে যথার্থ সাহিত্যের ছাত্রকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।

বিচিত্রা ঃ নকল প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মতামত কী? নকল প্রতিরোধে শিক্ষকদের তৎপরতায় কী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানকার্য ব্যাহত হচ্ছে?

ডঃ আব হেনা ঃ নকল প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে ভূমিকা গ্রহণ করেছেন তার আন্তরিকতা সম্পর্কে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু যধার্থ্য সম্পর্কে আমার আপত্তি আছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কতোদিন এই পলিশি দায়িত্ব পালন করবেন? এবং নকল প্রবণতার কারণ আমরা অনুসন্ধান করে দেখেছি কি? সেটা কি এমনি বিচ্ছিন্ন ব্যাপার যে দু/তিন বছর পুলিশি তত্ত্বাবধান চালালেই ঐ অসুখ সেরে যাবে?

পরীক্ষা তত্ত্বাবধানের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাইরের কলেজে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটিয়ে আসেন—তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

০০০০

ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক শূন্যতা

রুহুল আমিন জাহাঙ্গীর

ছোট বড় পাহাড়ের নির্জন পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে পা দিতেই যে-কোন শিল্পী-মন আপ্লুত হয়ে উঠে। শিল্প এবং সাহিত্যরসিকদের জন্যেই যেন এ পরিবেশটা তৈরী।

প্রায় একদশক আগে ১৯৬৭-৬৮তে গুটিকয়েক ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম ঘটেছিল আজ পচাত্তরে এসে তার অনেক পরিবর্তন। ছাত্রছাত্রীদের কলকাকলীতে ক্যাম্পাস মুখরিত। তবুও যেন অতীতের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে টেনে বর্তমানকে দিয়ে বিচার করলে হতাশ না হয়ে উপায় নেই।

সম্ভবতঃ শহর থেকে অনেক দূরে লোকালয় নির্বাসিত পাহাড়ী পরিবেশের ফলে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও এখানটায় একদিন ছাত্র রাজনীতির চেয়ে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রাধান্য পেতো বেশী। আর এর জন্যে দাবীদার এখানকার পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠন অতি সাম্প্রতিক সংগঠন অতি সাম্প্রতিক আমরা এবং অনেক সূর্যের আশা। ঊনিশ শ’ আষট্টি থেকে তিয়াত্তর পর্যন্ত এ দুটো সংগঠন প্রচুর উন্নতমানের রুচিশীল কবিতা ও গল্প সংকলন প্রকাশ করেছিলো—যা আঙ্গিকের দিক থেকে নতুনত্বের দাবীদার এবং ব্যতিক্রম। অনেক সূর্যের আশার মোহাম্মদউল্লাহ সম্পাদিত মিনি কবিতা সংকলন ‘বিন্দু’ আত্মজ ও নিজামউদ্দীন মাহমুদ সম্পাদিত ইংরেজী জার্নাল আই এবং অতি সাম্প্রতিক আমরার কংকনন্দী ও নাজনীন সুলতানা সম্পাদিত ‘সবুজাভ সংলাপ’, ‘বৃষ্টির অপর নাম’ ও মাহমুদুল হাসান সম্পাদিত ক্যাম্পাস প্রচুর প্রশংসা পেয়েছিলো।

অতি সাম্প্রতিক আমরা একটি ব্যতিক্রম ধর্মী সাংস্কৃতিক সংগঠন-এর কার্যক্রম ব্যাপক এবং বিস্তৃত। এ সংগঠনটি কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে পরিচয় অর্জন করেছে। আবহমান বাংলা এবং বাঙালী শীর্ষক একশত আট ফিট বাংলাদেশের বৃহত্তম এই মুর‌্যাল তৈল চিত্রটি ঊনিশ শ’ বাহাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে এবং একই বছর কোলকাতায় ভারত-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক এবং মৈত্রী মেলায় ও তিয়াত্তরের একুশের ফেব্রুয়ারীতে ঢাকায় বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে প্রদর্শিত হয়। এ তিনটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে অতি সাম্প্রতিক আমরা। এই দীর্ঘ চিত্রটিতে সবিউল আলম, শেখর দে শওকত হায়দারসহ সাতজন শিল্পী কাজ করে। চিত্রটি দেশ বিদেশের হাজার হাজার দর্শক কর্তৃক নন্দিত।

এছাড়া চুয়াত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যাবলীর উপর এরা কার্টুন প্রদর্শনীর আয়োজন করে। চট্টগ্রামে এটা ছিলো প্রথম কোন কার্টুন প্রদর্শনী।

অথচ আজ পচাত্তরে এসে যেন অতি সাম্প্রতিক আমরা এবং অনেক সূর্যের আশা দুটো সংগঠনই মৃতপ্রায়—দীর্ঘদিন থেকে তাদের কার্যক্রমের কোন সাড়া শব্দ নেই। স্বদেশ গোষ্ঠী ও সমস্বর এ দুটি সংগঠন আগে মাঝে মধ্যে দু-একটি অনুষ্ঠান করতো, বর্তমানে এগুলো নিষ্ক্রিয়।

চুয়াত্তরের প্রথম দিকে আত্মপ্রকাশ করলো স্পার্ক জেনারেশন। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক’জন তরুণ সাহিত্যকর্মী।

এসব সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আজ ঝিমিয়ে পড়লো কেন? এটা সবার প্রশ্ন। পর্যালোচনা করলেই এটাই দেখা যায় এসব সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা অনেকেই পাস করে চলে গেছেন এবং বর্তমানে যারা জড়িয়ে আছেন তারা কেউ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছেন না। অতীতে এসব সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা কেউই প্রত্যক্ষভাবে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু বর্তমানে এসব সংগঠনগুলোতে যারা আকড়ে আছেন তারা কোন না কোন রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী। আর সম্ভবত এ কারণেই সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কাজের প্রতি তারা খুব একটা মনোযোগ দিচ্ছেন না। দ্বিতীয়তঃ আর্থিক অনটনই এসব সংগঠনগুলোর কাজের প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়িয়েছে—কাগজের দুষ্প্রাপ্যতা প্রিন্টিং খরচের উর্ধ্বগতির ফলে এখন আর কেউ রুচিশীল সাহিত্য সংকলন প্রকাশের সাহস করছে না।

দেশের বৃহত্তম বন্দরনগরী চট্টগ্রামে আজ যেসব তরুণ শিল্পী কবি ও সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে তারা অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। চট্টগ্রামের নাট্য আন্দোলনে দুটি নাট্য সংগঠন, থিয়েটার ’৭৩ এবং অরিন্দম-এর অধিকাংশ অভিনেতা, অভিনেত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। অথচ এরা আজ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটা নাট্য সংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি।

বাংলা সাহিত্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদ’ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। ক’দিন আগে আবদুল্লাহ আল মামুনের নাটক ‘সুবচন নির্বাচনে’ মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে তারা মঞ্চস্থ করে। এছাড়া তারা সাহিত্য সংকলনও প্রকাশ করে আসছে। সাম্প্রতিক তাদের সাথী দাস সম্পাদিত কবিতা সংকলন বেরিয়েছে। ইংরেজী সাহিত্য বিভাগ এই তো ক’দিন আগে ইউসিস লাইব্রেরী হলে রোমিও জুলিয়েট, হ্যামলেটসহ চারটি ইংরেজী নাটক করলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিভাগ কর্তৃক এটা প্রথম নাট্য আন্দোলন এবং প্রথম ইংরেজী নাটক। সপ্তাহব্যাপী প্রতিটি নাট্য সন্ধ্যা ছিল জমজমাট এবং এর জন্যে এককভাবে প্রশংসা পেতে পারেন ইংরেজী বিভাগের অতিথি অধ্যাপক মাইকেল বুমেন। এরপর পর সেন্টমেরী হলে সমাজতত্ত্ব বিভাগের সংসদ অভিষেকে ‘তৈল সংকট’ এবং অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র সংসদ অভিষেকে ‘বিজন বাড়ি নেই’ নাটকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে মঞ্চস্থ হয়।

চারুকলা শিল্পে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চ ডিগ্রী দেয়া হয়—আর সম্ভবত এ কারণেই বাংলাদেশের বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সমাবেশ এখানে। এ বিভাগে আছেন রশীদ চৌধুরী, জিয়া হায়দার, দেবদাস চক্রবর্তী, মুর্তজা বশীরের মতো নামী দামী ব্যক্তিরা এবং বাংলাদেশের যেসব তরুণ শিল্পী ইতিমধে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছে তারা অনেকেই এ বিভাগের ছাত্র। অথচ অত্যন্ত দুঃখজনক, কলাভবনে একটি চিত্রপ্রদর্শনী ছাড়া মনে ধরে রাখার মতো তেমন কোন কার্যক্রম তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাখতে পারেননি।

কিছুদিন আগে চাকসু এবং হল সংসদগুলোর নির্বাচন হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে চাকসু সাহিত্য পরিষদ ও নাট্য চক্র গঠন করেছে এবং বিভিন্ন কার্যক্রমের পরিকল্পনা তৈরী করেছে। অনুরূপভাবে প্রতিটি হল সংসদ বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়েছে। এদের কার্যক্রম শুরু হলে ক্যাম্পাসের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন আবার মুখরিত হয়ে উঠবে।

অত্যন্ত লজ্জাজনক হলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন হল বা অডিটোরিয়াম নেই। কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামটি গত পাচ বছর ধরে নির্মাণাধীন। কবে এর কাজ শেষ হবে কেউ বলতে পারছেন না। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষ্ঠান ক্যাম্পাসের বাইরে-শহরের পাবলিক হলগুলোতে ভাড়ার বিনিময়ে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। অধিকাংশ সময় মুসলিম ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে অস্থায়ী প্যান্ডেল করে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

খেলাধুলা

শামসুল হুদা

চিত্তের সুস্থ পরিচয়ের তাগিদে খেলাধুলার ভূমিকাকে খাটো করে দেখার দিন ফুরিয়ে গেছে। মানসিক বিকাশের ফলপ্রসূ মাধ্যম হিসেবে খেলাধুলার স্বীকৃতি আজ সর্বত্র। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়াঙ্গনের স্তিমিত ও নিস্পন্দ পরিবেশ ব্যঙ্গ হয়ে কটাক্ষ করছে এই সত্যকে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় দশ বছর আগে, ১৯৬৬ সালে। অথচ খেলাধুলার মান উন্নয়নের জন্যে কর্তৃপক্ষ আজ অবদি কার্যকর কোন পদক্ষেপই নেননি। যার ফলশ্রুতি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়াঙ্গনে নেমে এসেছে অকাল বন্ধ্যান্ত্ব। এই বন্ধ্যাত্ব সংক্রামিত হচ্ছে ক্রীড়ানুরাগী ছাত্রছাত্রীদের চেতনায়, মানসিকতায়। ফলে খেলাধুলার মান উন্নয়নে ব্রতী হওয়ার পরিবর্তে নৈরাশ্যের অতলে নিঃশেষ হচ্ছে তাদের উদ্যম, প্রেরণা।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম সর্বস্ব সবেধন নীলমণি যে একটি মাঠ রয়েছে, তা ফুটবল, হকি, ভলিবল এবং গো-চারণের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবত সংস্কারের অভাবে এই মাঠ খেলার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সামনেই ফুটবল মৌসুম প্রয়োজনীয় সংস্কার করা না হলে এই মাসে খেলা সম্ভবপর হবে না বলে জনৈক ফুটবল খেলোয়াড় অভিমত প্রকাশ করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে তিন হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে খেলোয়াড়দের জন্যে মাত্র ১টি স্টাইপেন্ড এবং ১টি ফ্রি স্টুডেন্টশীপ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ফলে বিশ্বাস করুন, চলতি সালে বাংলাদেশের দ্রুততম মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত মোশাররফ হোসেন শামীমের মত কৃতি এ্যাথলেটও এই ন্যূনতম সুযোগ লাভে বঞ্চিত হলেন। এই অভিমানেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় দলের পক্ষ ছেড়ে বস্ত্রশিল্প সংস্থার প্রতিযোগী হিসেবে জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলাধুলা সম্পর্কে আলাপ হয়েছে শরীরচর্চা বিভাগের সহকারী পরিচালকের সাথে। তিনি তিনটি সুপারিশের কথা জানালেন ১। বর্তমান মাঠের সংস্কার সাধন, ২। খেলাধুলার পর্যাপ্ত সরঞ্জামের ব্যবস্থা এবং ৩। ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বৃত্তির বিধান রাখা।

প্রত্যেক বছর আলাদাভাবে হল এ্যাথলেটিক ফি নেয়া হয় ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে। অথচ এর জন্যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থাও নেই। শুধুমাত্র সারা বছরে একদিন দায়সারাগোছের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করেই কি হল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব চুকে যায়। মৌসুম অনুযায়ী সব ধরনের খেলাধুলার ব্যবস্থা করা উচিত। এতে ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন অবসর বিনোদনের সুযোগ পাবে তেমনি খেলার মান উন্নয়নেও সচেষ্ট হতে পারবে।

ক্রীড়াঙ্গনের বন্ধ্যাত্ব এবং নিস্পন্দ পরিবেশের সমস্ত দায় কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে এককভাবে চাপিয়ে দেয়াও আবার অযৌক্তিক। ছাত্রছাত্রীদের ক্রীড়াবিমুখতাও উল্লেখ্য। দুটি ঘটনার উল্লেখ করছি। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হাইজাম্পে মাত্র একজন প্রতিযোগিনী। খালি ফিল্ডে গোল দেয়ার মত অবস্থা দেখে আরেকজন ছাত্রী এগিয়ে গেলেন। কিছুতেই তৃতীয় একজন ছাত্রী পাওয়া গেল না তৃতীয় পুরস্কারের জন্যে। ফজলুর রহমান হলের ক্রীড়ানুষ্ঠানে পোল ভল্ট প্রতিযোগিতার তিন পুরস্কারই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের শেষেও টেবিলে রক্ষিত ছিল। প্রতিযোগীর অভাবেই গোল ভল্টের আইটেম বাদ দেয়া হয়।

সমস্যায় পীড়িত থেকেও খেলাধুলার সাথে একাত্মতা হয়ে নিয়মিত অনুশীলন করছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাত্র। রেজা, ফরহাদ, ইব্রাহিম, খোরশেদ, গোমেজ, মানিক, মিজান, মনসুর, বেলায়েত, অনিমা, মাগফী, শামসুন্নাহার, ছবি, জান্নাত—এরা যদি আরো যত্নবান হন, নিষ্ঠার সাথে অনুশীলন করেন রীতিমত, তাহলে ক্রীড়ার মান উন্নয়নে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

শুধুমাত্র প্রতিযোগিতার দিন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আশ্বাস বাণী না শুনিয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত বাস্তবতার নিরিখে সমস্যার বিশ্লেষণ করে তার যথা সমাধানে সচেষ্ট হওয়া উচিত। তার সাথ ছাত্র-ছাত্রীদের নিষ্ঠা পরিশ্রম ও খেলোয়াড়সুলভ মনোভঙ্গীও চাই। চাই ফলপ্রসূ সংগঠনী উদ্যম এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক মঞ্জুর।

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

যাদুঘর

চট্টগ্রামে একটি সাধারণ যাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি যাদুঘর স্থাপনের প্রাথমিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় মহাপরিকল্পনায় যাদুঘর স্থাপনের প্রস্তাব রাখা  হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক কালেই প্রস্তাবিত যাদুঘরের জন্য প্রত্নসামগ্রী সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রাক্তন ন্যাশনাল ব্যাংকের অর্থানুকূল্যে এ রকম এক বিরাট সংগ্রহ ১৯৬৬ সালের নবেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং ১৯৬৬ সালের ১৮ই নবেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধনী দিবসে এ সংগ্রহের একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ প্রস্তাবিত যাদুঘরের জন্যে সংগ্রহ কাজ অব্যাহত রাখে। যাদুঘর সামগ্রীর অনুসন্ধানে জরীপ কাজ চালানোর ফলে চট্টগ্রামের প্রাচীন সুলতানী আমলের দুটি মসজিদ আবিস্কৃত হয় এবং মিরশরাইস্ত ছটি খানের মসজিদের ভ্গ্নাবশেষ থেকে দুখানি শিলালিপিসহ আরও কিছ প্রত্নসামগ্রী সংগৃহীত হয়।

১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময় প্রকৃতপক্ষে যাদুঘরের কাজ প্রাথমিকভাবে শুরু হয়। আর্থিক অস্বচ্ছলতার দরুন সংগ্রহের বিঘ্ন ঘটে। কিন্তু সব রকম প্রতিকূলতার মধ্যেও যাদুঘরের প্রাথমিক সংগ্রহ বেশ উৎসাহব্যঞ্জন।

যাদুঘরের প্রথম বৎসরের কার্যকালে আড়াইশয়েরও বেশী বিভিন্ন যাদুঘর নির্দশন সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে আছে প্রাচীন মুদ্রা, পাথরের দেবমূর্তি, শিলালিপি, প্রাচীন পোশাক, ব্রোঞ্জ মূর্তি টেরাকাটা তাতিতাত্ত্বিক নির্দশন ইত্যাদি।

বাংলাদেশ আন্দোলনের দলিলপত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রেও যাদুঘরের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য আন্দোলনের স্বপক্ষেও বিপক্ষে ব্যবহৃত প্রচারপত্র, পুস্তিকা, পুস্তক, সংবাদপত্রের কাটিং সাময়িকী, চিঠিপত্র, বস্তু নির্দশন ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। যাদুঘরের উদ্যোগে এ সংগ্রহের একটি বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ২৬, ২৭ ও ২৮শে মার্চে চট্টগ্রাম কলাভবনে প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজল। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম ব্রিগেডের তৎকালীন প্রধান ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী।

এছাড়া কিছু কিছু জীববিদ্যা সম্পর্কিত নির্দশন সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু এগুলো সংরক্ষণের জন্যে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্য ও কাচের পাত্র যাদুঘরে না থাকার দরুন নিদর্শনসমূহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কাছে সংরক্ষণের জন্যে সমর্পণ করা হয়।

এতদ অঞ্চলে আরবী, ফারসী এবং বাংলা প্রাচীন পান্ডুলিপি প্রচুর পাওয়া যায়। পান্ডুলিপি ইতিহাস ও সংস্কৃতির গবেষণায় বিশেষভাবে সহায়ক। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এসব মূল্যবান পুরাতাত্ত্বিক বস্তু ক্রমেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দেশের বর্তমান অবস্থায় এসব সাংস্কৃতিক নির্দশন দিন দিন বিনষ্ট হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যাদুঘর এ যাবত দুশয়েরও বেশী প্রাচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছে। এতে আরবী, ফারসী, বাংলা, সংস্কৃত, পালি ও উড়িয়া ভাষার পান্ডুলিপি রয়েছে।

উৎসাহী গবেষক এবং ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনার্থে প্রাচীন দলিলপত্র সংগ্রহের এক বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ক্যাম্পাসে ছাত্রদের জীবন যে রকম কাটে

–মহীউদ্দীন শাহ আলম

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে আপনাদের কেমন লাগে জানি না। আমার কিন্তু বেশ লাগে। কিছুটা অসুবিধা অনুভূত হলে তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। গত ক’বছরের উন্নয়নও এর সহায় বলতে পারেন। অথচ সত্তর সালে প্রথম যখন ভর্তি হয়ে এলাম—তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সবেমাত্র চার বছরে পা দিয়েছে। চারদিকে উন্নয়নের কাজ চলছে। সারাদিন শুধু খট-খট, ঠুক-ঠুক শব্দ।

সেদিন একমাত্র কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবনটাই ছিল। বিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদের ক্লাসগুলো হত বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল ভবনটাতে। ধীরে ধীরে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদের আলাদা ভবন তৈরী হল। বর্তমান বিজ্ঞান অনুষদ ভবন পুরোটাই শুধুমাত্র রসায়ন বিভাগের জন্য তৈরী করা হয়েছিল।

আর ছাত্রাবাস ছিল একটাই। আলাওল হল। অবশ্য এর বিস্তৃতি ছিল অনেক বড়। এক নজরে দেখা যেত না এবং অনেকটা ছেড়া ছেড়া ধরনের। মেন বিল্ডিংটা ছাড়াও অনার্স ব্লক, মেডিক্যাল সেন্টারের পার্শ্বের ছাত্রাবাস (মেডিক্যাল ব্লক), নর্থ ব্লক, মহিলা ছাত্রাবাস আলাদা আলাদা নাম নিয়েও এক হয়ে মিশে ছিল আলাওল হল নাম নিয়ে। ছাত্রীবাসটা ছিল টিনশেডের, অবশ্য এখনও তাই। মাত্র তিরিশ জনের স্থান সংকুলান হত। তারও পূর্বে ঐ টিনশেডগুলোতে ছেলেরা থাকতো। ঐ ব্লকটাকে বলা হত নর্থ ব্লক। তারপর সেই নর্থ ব্লকের চারপাশে উঠলো দেয়াল। সামনে লাগানো হল বিরাটকায় লোহার গেট তারপর থেকেই মহিলা ছাত্রাবাস। আ ফ রহমন হলের কাজ শেষ হেয় এসেছিল। এলট এর আগে হল জবর-দখল। ক্রমে ক্রমে আরো দুটি ছাত্রাবাস হল। শাহজালাল হল আর সোহরাওয়ার্দী হল। আলাওল হল, আ ফ রহমান হল, শাহজালাল হল একই পরিকল্পনায় তৈরী হলেও সোহরাওয়ার্দী হল বন্ধ করে দেয়ার হুমকিতে অনেকটা তাড়াহুড়োর মধ্যে করা হয়েছে। নতুন আঙ্গিকে। সরকারী কলোনীর মত। তাই কেউ কেউ রসিকতা করে বস্তি বলে আখ্যায়িত করেন। বর্তমানে আলাওল হলের বিস্তৃতি অনেক কমে গেছে। নর্থ ব্লক এবং মেডিক্যাল ব্লক চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীদের দখলে। অনার্স ব্লকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাপাখানা বসতে যাচ্ছে।

হল জীবনে ভোর বেলা নাস্তা করা আপনার চাই-ই। যেহেতু হলের ত্রিসীমানায় কোন ক্যান্টিন নেই সুতরাং আপনি চললেন দূর সৈয়দিয়া, তৈয়বীয়া, চানক্য ও জেডার হোটেলে। অথবা পাহাড় ডিঙিয়ে শীলার ক্যান্টিনে। এতে করে সকালের পড়া থেকে কম করে হলেও একটি ঘন্টা চু্রি হয়ে গেল।

সাড়ে আটটায় ক্লাস। নাস্তা করে এসে সবাই মিলে রওয়ানা হলেন দেড় মাইল দূরের ক্লাস ভবনের উদ্দেশ্যে। তারপর অপেক্ষা শহর থেকে ছাত্রদের ট্রেন আর শিক্ষকদের বাস না আসা পর্যন্ত। ক্রমশ বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন মুখরিত হয়ে ওঠে। কলাভবন ক্যান্টিনে চায়ের টেবিলে ঝড় ওঠে। সেখানে সেলফ-সার্ভিস প্রক্রিয়ায় লাইন দিয়ে নাস্তা নেয়ার ঝামেলায় কেউ কেউ ভিড় জমায় বিজ্ঞান ভবনের আন্ডর-গ্রাউন্ড ক্যান্টিনে।

কলা ভবনের নীচ তলায় চাকসু কার্যালয় এবং ক্যান্টিনের মধ্যবর্তী করিডোরে রাজনৈতিক হাওয়া। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার পড়বে। নতুন পোস্টার। পুরনো পোস্টার ছেড়া হবে কিছুটা ইচ্ছায়—কিছুটা অনিচ্ছায়।

চারুকলা বিভাগের ছেলেমেয়েদের সহজে চোখে পড়বে। কাধে ব্যাগ। হাতে বোর্ড তুলি। দল বেধে চলাফেরা করে। ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে—একান্তে ছবি আকে।

সাড়ে বারোটা থেকে শুরু হয় ফেরার পালা। কাঠফাটা রোদে হেটে এসে সোজা ডাইনিং হলে। কিসমতে কি আছে (?) গন্ধযুক্ত ধান মিশ্রিত রেশনের চালের ভাত। সাথে মাছ বা মাংস ও ডাল। তাও মাছ বা মাংস ডালের মত ঝোল থেকে খুজে নিতে হয়। আর ডাল নয়তো যেন চাল ধোয়া পানি।

ছাত্রাবাসে বিকালের নাস্তা আর রাতের খাবার বাংলাদেশের বহু ছবির মত সকলের নাস্তা আর দুপুরের খাবারের কার্বন কপি। অথচ তবুও আপনাকে শুধু দু’বেলা ভাতের জন্য মাসে রেশন পেলে ১৩০—১৫০ টাকা আর রেশন না পেলে ২০০ টাকা দিতে হবে। অবশ্য খরচ কমানোর জন্য কিছুদিন আগে ছাত্রাবাসগুলোতে রুটির প্রচলন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। দুদিন যেতে না যেতেই ছাত্ররা এর বিপক্ষে রায় দিয়েছে।

সারাদিন ক্লাসের পর আসে অবসর। অবসরে উপযুক্ত বিনোদন চাই। গড়ে প্রতিদিন হলের দুশো বাসিন্দা শহরে যায়। ছবি দেখতে, বেড়াতে, কেনাকাটা করতে। ফেরা হবে সন্ধ্যায়। বিপনি বিতান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বাসে অথবা রাতে ট্রেনে। ইদানীং অনেকে ক্যান্টনমেন্টে ছবি দেখতে যাচ্ছে। ভারতীয় ছবি। ছাত্রাবাসের বাসিন্দাদের বিরাট অংশ অবসর কাটায় ক্যাম্পাসেই। ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করা। বিকালে খেলোয়াড়রা সবাই মাঠে যায়। লন টেনিস একমাত্র ভাগ্যবানরাই খেলে যাদের নিজস্ব রেকেট আছে। বাস্কেটবল এবং ভলিবল মাঠে প্রায়ই জায়গা পাওয়া যায় না। দর্শক হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

অসমতল মাঠে ফুটবল আর হকি খেলতে নেমে হয়রানি হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। আর ক্রিকেট খেলতে নামা মানে কিছু বাম্পার বলের সম্মুখীন হওয়া অর্থাৎ জীবনের সঙ্গে পাঞ্চার লড়া।

যাদের খেলাধুলার প্রতি কোন উৎসাহ নেই তাদের একমাত্র ভরসা প্রধান ক্যাফেটেরিয়ার রুম, বেলকনি, ছাদ সবখানে একই অবস্থা। কোন কোন প্রেমিক-প্রেমিকাকেও অবশ্য অবসরটায় কোন পাহাড়ের পাদদেশে বসে থাকতে অথব মেডিক্যাল সেন্টারের কাছের নিরিবিলি রাস্তায় পায়চারি করতে দেখা যায়।

কিছু ছেলে আছে, যারা প্রতিদিন তাদের সন্ধ্যাটা কাটায় ছাত্রীনিবাসের ওয়েটিং রুমে।

মাঝে মাঝে ছাত্র সংসদগুলো অথবা কোন বিভাগ আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতে বৈচিত্র্য পাওয়া যায়। অবশ্য সমস্যাক্রান্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু করার একটা সমস্যা। কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়াম মূল পরিকল্পনা থেকে অনেক কাটছাট করে করা হচ্ছে। তবে শম্ভূক গতি দেখে সন্দেহ হচ্ছে আমাদের উত্তমপুরুষরাও ব্যবহার করতে পারবে কিনা। অনুষ্ঠানের স্থান নির্বাচন বোধ হয় সবচাইতে জটিল কাজ। আপনাকে ক্যাম্পাস অথবা শহর যে কোন এক জায়গার দর্শককে নিরাশ করতে হবে। ক্যাম্পাসে একমাত্র ভরসা বিজ্ঞান গ্যালারী তাও দুপুর বারোটার পর দর্শক ধরে রাখতে পারবেন না। রাতে ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান করতে চাইলে আপনাকে প্যান্ডেল তৈরী করা ছাড়া উপায় নেই। এবং পরে হিসাব নিলে হয়ত দেখা যাবে আপনার অনুষ্ঠানের সিংহভাগ খরচ হয়েছে প্যান্ডেল তৈরীতে। অবশ্য নতুনও পুরাতন ক্যাফেটেরিয়া এবং বর্তমান লাইব্রেরী ভবনের নীচ তলায়ও দু-একটা অনুষ্ঠান হয়েছে।

হয়ত ভাবলেন, শহরে অনুষ্ঠান করবেন, তার জন্য আবার হলের ছেলেদের জন্য বাসের ব্যবস্থা করতে হবে? অবশ্য ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান করলেও একই রকম ব্যবস্থা নিতে হবে শহরের ছেলেদের জন্য।

কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে অবসর কাটে লাইব্রেরীতে। পড়ায় বা গল্পে। এখানে তেমন শুরু হয়নি। একে তো লাইব্রেরীতে আসনস্বল্পতা তার ওপর আপনার অবসরটা যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। দুপুরে পর লাইব্রেরী খালি। শহরের ছাত্ররা চলে যায়। হলের ছাত্ররাও যাতায়াতে সুবিধা করে নিতে পারে না। তবুও অনেকে যায়। এক ঘন্টা লাইব্রেরী ওয়ার্কের জন্য যাতায়াতে দু ঘন্টা সময় নষ্ট হয়, সেই সঙ্গে আসা-যাওয়ার চার মাইল—পায়ে হাটার শ্রমও। কেউ কেউ লাইব্রেরী যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের অভিযোগ—বই নেই। কোন কোন বইয়ের কনফাইন্ড কপিও। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর অনেক বই পাওয়া যায়নি। নতুন কোন বইও আনা হচ্ছে না।

টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ছোট কক্ষটাতেও অনেকের অবসর কাটে। বিকাল চারটার পর ভিড় হয়। রাত ন’টার পর্যন্ত একই টেলিফোনের নন-স্টপ সার্ভিস। রিসিভারের শুধু হাত বদল হয়। দু’একটা পরিচিত মুখ প্রতিদিন দেখবেন। বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিনিধিরা আসে রাত ন’টার পর। খবর পাঠায়। কদাচিৎ ছাপা হয়।

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্রাবাসের মত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর রাতের খাবার কিন্তু সন্ধ্যার পর পরই পাবেন না। বাজার আসে হাটহাজারী অথবা কখনো কখনো চট্টগ্রাম শহর থেকে। তাই এ সময়ে হল মিলনায়তনগুলোর যথাযথ ব্যবহার শুরু হয়। মাঝে মাঝে আপনি দেখবেন বেলকনি থেকে নীচে অর্থাৎ ডাইনিং হলের দিকে উকি মারছে ছেলেরা। টেবিলে খাবার এলেই মিলনায়তন খালি। সুতরাং টেবিলে খাবারের ওপর নির্ভর করে মিলনায়তনের কোলাহলের স্থায়িত্বকাল।

মাঝে মাঝে হলের প্রভোস্ট এবং আবাসিক শিক্ষকরা আসেন (আবাসিক শিক্ষকরা সবাই বাইরে থাকেন)। মিটিং হয়। সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়। কদাচিৎ সমাধান হয়। বাথরুমের ট্যাপগুলো পাল্টিয়ে দেয়া হয়। পানির চাপে আবার খুলে যায়। অবিরাম পানি পড়ে। ইলেকট্রিসিয়ান বাথরুম এবং করিডোরের বাল্ব পাল্টিয়ে দিয়ে যায়। আবার নষ্ট অথবা অদৃশ্য হয়ে যায়।

হলের একতলা, দু-তলা স্যাৎস্যাতে অন্ধকার মশকালয় তিনতলা—চারতলা এমনিতে চলনসই কিন্তু বৃষ্টি এলে জলে জলে জলটুঙ্গি। বিছানা, বালিশ, বইগুলোর নির্ভেজাল স্নান। বাগানে প্রতিদিন মালি আসে। সকাল-বিকাল ফুলগাছগুলোতে পানি দেয়, তবুও ফুল বড় একটা ফোটে না।

রাতের বেলা বেশী রাত জেগে পড়বেন বা গভীর ঘুমে অচেতন হবেন তার কোনটাই সম্ভব নয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুনবেন শিয়াল বা অন্যান্য জন্তুর ডাক।

নতুন ছেলেমেয়ের ভিড় বিশ্ববিদ্যালয়কে যেমন চঞ্চল করে তুলেছে হলগুলোতেও তা সমভাবে প্রতিফলিত। প্রত্যেক রুমেই প্রায় ডাবলিং-ট্রিপলিং। চারতলার একাকী রুমগুলোতে খুজলেও রাত্রিবেলা চার-পাচজনকে একই রুমে থাকতে দেখা যাবে।

একদিন পরীক্ষা শেষ হবে। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। পরীক্ষা করবে ফলাফলের। তাও বের হবে একদিন। কেউ দুঃখ পাবে। কেউ আনন্দ করবে। সবাই চলে যাবে। কেউ কেউ থেকে যাবে কিছুদিনের জন্য। তারপর আবার চলে যাবে। এই আসা-যাওয়া—এই তো জীবন। এই তো বৈচিত্র্য। সবাই আসে আবার সবাই চলে যায়। এই ক্যাম্পাস শুধু তার কিছু স্মৃতি ধরে রাখে। বেদনাময় অথবা নির্মল আনন্দের। ক্যাম্পাস তাই সব ছাত্রেরই স্মৃতিময় ভুবন।

০০০০

চলতি কথা

রাজীব বাহার

আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে মনোভঙ্গী প্রকাশের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে আমরা শব্দকে ব্যবহার করি। আমাদের অনুভব বাঙ্ময় হয় শব্দের ঝংকারে, চেতনা দ্যুতিময় হয় শব্দের প্রাখর্যে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু শব্দ প্রচলিত রয়েছে ইঙ্গিতবাহী অভিব্যক্তি হিসেবে। যেমন, শাহজালাল হলের পাশ ঘেষে স্টাফ কোয়ার্টার অভিমুখী রাস্তাকে বলা হয় অয়েল রোড। বোরকাপরা ছাত্রীরা আখ্যায়িত হয় ফরটি টু মডেল হিসেবে। মেয়েদের দেখে যে ছাত্র ওভারস্মার্ট হয়ে পড়ে তার নাম হাম লাইট। প্রেমিক যুগলকে সম্বোধন করা হয় আশ্চর্য মুরগীর তিন ঠ্যাং বলে। প্রেমিক বন্ধুকে হিতৈষীরা সাবধান করে দেয়, না-দুরস্ত কাজ করিচ্চা, হরে কাগজ টোকাবি (ছ্যাক খেয়ে প্রেমপত্র ভেবে রাস্তায় রাস্তায় কাগজ কুড়ানোর আশংকায় বন্ধুর এই সতর্কবাণী)। নদীয়া শান্তিপুরী স্টাইলে কথা বলার নাম ‘দাড়ি-কমা-সেমি কোলন মার্কা কথা’। অস্বাভাবিক কোনো কাজে ব্যাপৃত ছাত্রকে বলা হয় পোক্কাইয়া। মেয়েদের সাংকেতিক ভাষায় ডাকা হয় সজ্জু মিয়া। এছাড়া রয়েছে আরো কিছু শব্দের ব্যবহার। এসব শব্দ নতুনতর আঙ্গিকে, নতুনতর প্রেক্ষিতে হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে ছাত্রছাত্রীদের।

অধুনা দুটো কথা বেশ প্রচলিত। ছাত্রমহলে কে গো আ শিক্ষকমহলে জীবনটা কে-জি হয়ে গেলো। কথা দুটোর মর্মার্থ প্রকাশে উভয় মহলই অনিচ্ছুক। স্ট্রীক্টলী কনফিডেন্সিয়াল, নট ফর পাবলিক।

০০০০

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের জীবন যেরকম কাটে

লায়লা জামান

বর্তমানে চারটে হল রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এগুলো সবই ছেলেদের জন্য নির্দিষ্ট। মেয়েদের যে নিবাসটি সেটা পুরোপুরি হলের মর্যাদা পায়নি। এখনও ছেলেদের একটা হলের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে। ফ্যাকাল্টি থেকে খানিকটা দূরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার এক কোণে এর অবস্থান। বর্তমানে এই হলের ছাত্রী সংখ্যা দেড়’শর কাছাকাছি। মাত্র ৭ জন ছাত্রী নিয়ে ১৯৭০ সালে এ হলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তখন আসন সংখ্যা ছিল ৪০। এরপর আস্তে আস্তে ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকে কিন্তু সেই হারে আসন বাড়ানো হয়নি, ফলে চলে ডাবলিং ট্রিপলিং ও ফ্লোরিংয়ের পালা। ১৯৭৪ সালে এই ছাত্রী নিবাসের একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে, আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ১২৮-এ আনা হয়। ফলে ৪০ জন ছাত্রী যে ক্ষুদ্র পরিসরে ছিল সেটা অপেক্ষাকৃত বৃহৎ আকার ধারণ করে। বর্তমানে আরও ‍রুম তৈরী হচ্ছে ফলে ভবিষ্যতে ছাত্রী সংখ্যা বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। হলের আসন সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে অগ্রণী ছাত্রীরাই। উপাচার্যকে ঘেরাও করে তারা তাদের এ দাবী আদায় করেছে।

সকালে উঠে ছাত্রীদের প্রধান কাজ হচ্ছে হাড়িচুলো ঠেলা। প্রত্যেক রুমে ষ্টোভ রয়েছে আর রয়েছে নাস্তার উপকরণ। সকালে উঠে মেয়েরা নিজেই নাস্তা তৈরী করে নেয়। এছাড়া উপায় নেই। কারণ শহর থেকে দূরে বলে দোকান-পাঠের ভাল ব্যবস্থা নেই, আর যাও আছে বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে বেশী পয়সা খরচ হওয়ার ভয়ে দোকানের খাবার বিশেষ কেউ কেনে না। এর-পর শুরু হয় ফ্যাকাল্টি যাওয়ার পালা। ৮-৩০ মিনিটে যাদের ক্লাস, তাড়াতাড়ি কিছু মুখে গুজে তারা বেরিয়ে পড়ে। ৯-২০ মিনিট থেকে যাদের ক্লাস তারা খেয়ে দেয়ে ধীরে সুস্থে কাপড়-চোপড় পরে বেরোয়। ফ্যাকাল্টি যাওয়ার ব্যাপারে প্রতিদিন ছাত্রীদের ঝামেলা ঝক্কি পোহাতে হয়। প্রতিদিন হেটে যাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয়না, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের ফ্যাকাল্টি পৌছানোর জন্য বাসের ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু সেটা নিয়মিত নয় এবং প্রায়ই দেরী করে। দেরী করাটাকে গায়ে না লাগিয়ে ছাত্রীদের বাসটির জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করতে দেখা যায় কারণ রিকশায় উঠতে তারা নারাজ। তারপর অধিকাংশ ছাত্রী দুপুরবেলায় পা দুটোকে সম্বল করে হলে ফিরে আসে। হাটার পক্ষে ছেলেদের হলগুলো অতিক্রম করার সময় কানে ভেসে আসে কুকুরের ডাক, শেয়ালের ডাক, আরও বিভিন্ন রকমের ডাক। কলা অনুষ্ঠানে ছাত্রীদের তুলনায় বিজ্ঞানের ছাত্রীদের কষ্ট অনেক বেশী। ফ্যাকাল্টি থেকে দুপুর বেলায় ফিরে নাকে মুখে কিছু গুজে আবার প্র্যাকটিক্যালের জন্য তাদের বেরিয়ে পড়তে হয়।

হলের খাবার ভাল নয়, এ ধারণা সবার। তবে দুপুরের খাবার এখানে অত মন্দ না, দুপুরের ভাতের সাথে থাকে ডাল, মাছ বা গোস্ত, মাঝে মাঝে থাকে ডিম, কিন্তু রাত্রে নিরামিষ যা একখানা থাকে, সেটা দেখে সবার উর্ধ্বগতি খিদে নীচের দিকে নামতে থাকে। হলের একটা আনন্দায়ক বস্তু হচ্ছে ফিষ্ট। মাসের শেষের এ দিনটি ছাত্রীদের একটা বিশেষ আনন্দ দেয়। হলে যারা খাবার পরিবেশন করেন, ছাত্রীদের কাছে তারা কখনো কখনো খালা, মাসী। এদের যদি কখনো খাবার পরিবেশনে দেরী হয়, রগচটা ছাত্রীরা তখন প্লেট, গ্লাস ভেঙ্গে তাদের রাগের বহরটা প্রকাশ করে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীবাসে পড়াশোনার পরিবেশ ভালই। কিন্তু এটা নির্ভর করে সম্পূর্ণ নিজের ওপর। কারণ কেউ কেউ সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকে, কেউ মাঝে মাঝে আর কিছুসংখ্যক ছাত্রীকে শুধুমাত্র টিউটোরিয়াল পরীক্ষার আগের রাত্রেই বই খাতা হাতে নিয়ে বসতে দেখা যায়।

ভিজিটর নিয়ে একটা প্রহসন চলে ছাত্রীনিবাসে। কারণ হলের নিয়মানুসারে বাবা ও ভাই ছাড়া অন্যান্য সবার এমনকি মামাতো ভাইয়ের আগমনও নিষিদ্ধ। কিন্তু বিকেল থেকে ছাত্রীনিবাসের সামনে যে ভীড় জমে, তার মধ্যে ক’জন সহোদর, সেটা খুজে বের করা মুশকিল। যারা আসেন তাদের মধ্যে ক্লাসমেটরাই বেশী আর আসেন কিছু বন্ধু-বান্ধব। এদের মধ্যে কেউ নিছক গল্প করতে আসে, কেউ আসে বান্ধবীদের খোজ-খবর নিতে, আর কারও কারও উদ্দেশ্য থাকে ভিন্ন। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত অভিভাবক যে আসেন না তা নয়, তবে তার সংখ্যা খুব কম থাকে। কারণ শহর থেকে দূরে বলে অভিভাবকদের ঘন ঘন আসা সম্ভব হয় না। কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী সন্ধ্যা ৬-৩০ মিনিটে হলের গেট বন্ধ হয়।

হলে ডাকপিওনের আগমন ছাত্রীদের একটা খুশীর ঘটনা। আত্মীয়-স্বজন বর্জিত অবস্থায় থাকে বলে বোধহয় কারও নামে চিঠি এলে সে খুশী হয়ে ওঠে। তবে একটা ব্যাপারে তাদের মন খারাপ হয়ে যায়, কারণ অধিকাংশ সময়ই অক্ষত অবস্থায় চিঠি পাওয়া যায় না, প্রায়ই দু-এক পাতা উধাও হয়ে যায়। মাসের প্রথমে ছাত্রীদের কাছে ডাকপিওনের গুরুত্ব আরও বেশী, কারণ প্রত্যেকের হাত তখন খালি হয়ে যায়, দিনগুলো খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলে। বাবার কাছ থেকে মনিঅর্ডার এসে পৌছালে দিনগুলি স্বচ্ছন্দ গতি ফিরে পায়। হলে মেয়েদের সময় কাটানোর জন্য লুডু, কেরাম, দাবা এবং টেবিল টেনিসের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে সিনিয়র মেয়েদের সঙ্গে জুনিয়র মেয়েদের মোটামুটি সদ্ভাব আছে। সববর্ষে ছাত্রীদের খেতাব দেয়া হয়, তবে খেতাবগুলো কখনো শালীনতা ছাড়িয়ে যায় না।

০০০০

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1975.03.21-bichitra-copy.pdf” title=”1975.03.21 bichitra copy”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!