You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯৯। বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে পশ্চিম বঙ্গের লেখক ও বুদ্ধিজীবিদের বিবৃতি দৈনিক যুগান্তর ২৮ মার্চ, ১৯৭১

আমরা প্রতিবাদ জানাই, আমরা তীব্র নিন্দা করি

“স্বাধীন বাংলাদেশ’’- এর উন্নত-শির নাগরিকগণ এবং তাঁদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবর রহমান ইতিমধ্যে আমাদের হৃদয় জয় করেছেন। অসম সাহস, অফুরন্ত প্রাণশক্তি এবং অতি-সীমিত অস্ত্রবল নিয়ে তাঁরা মোকাবিলা করছেন নবতম অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েক ডিভিশন সেনাবাহিনীর সঙ্গে। বিশ্বের বিধানে সত্যের জয়, শুভের জয় সর্বদাই হয় তা বলতে হয় তা বলতে পারি না; কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে হয় তা আমরা বিশ্বাস করি। তাই আমরা বিশ্বাস করি যে, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’- এর জয় হবেই। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়েছে সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের সত্তর হাজার যুদ্ধপটু সৈনিকের দ্বারাঃ তাদের ক্ষমতামদমত্ত সেনাপতির আদেশে তারা ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে, কামান-মেশিনগান-স্টেন গান নিয়ে হাজার হাজার শান্তিপ্রিয় স্বাধীনতাকামী যুবক এবং আবালবৃদ্ধবণিতার দক্তে পূর্ব বাংলার নগর-গ্রাম, পথমাঠঘাট লাল করে দিচ্ছি। এই বেপরোয়া গণহত্যার ফলে হতাহতের সংখ্যা কিছু দিনের মধ্যে কয়েক লক্ষ্য পোঁছাবে বলে আমরা আশঙ্কা করি।

সভা ও সংস্কৃতিবান দেশের উপর বলবান, যুদ্ধরাজ, বর্বরদের আক্রমণ ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে, একাধিকবার পশুশক্তির সামরিক আধিপত্য দেখা দিয়েছে; বর্বর বিজেতারা সভ্য মানুষের ছিন্নমস্তক স্তূপিকৃত করে তাঁর চারিদিকে দাঁড়িয়ে অট্টহাসি করেছে। আজ ১৯৭১ সালেও কি আমরা তারই পুনরাবৃত্তি দেখব?

পৃথিবীতে আজ বহু দেশ আছে, বহু জাতি আছে যারা নিজেদের সুসভ্য বলে দাবি করে। সে দাবি অনেকাংশে স্বীকার্য। তাদের বিবেক কি আজ সাড়া দেবে না? আমরা পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতি কর্মীরা বিশেষ করে আবেদন জানাই পৃথিবীর সব দেশের শিল্পস্রষ্টা ও জ্ঞানতপস্বীদের কাছে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে এই বীভৎস বিরাট নরহত্যার সংবাদ তাঁরা পেয়েছেন নিশ্চয়ই। তাঁদের সকলের তীব্র প্রতিবাদ ঘোষিত হোক, তাঁদের সরকারকে তাঁরা উদ্বুদ্ধ করুন এই অর্থহীন নৃশংসতার নিন্দা করতে, প্রতিরোধ করতে, এ বিষয়ে তাঁদের যথোচিত কর্তব্য পালন করতে। আমাদের সরকার কবে স্বাধীন বাংলাদেশ-এর রাষ্ট্রিক মর্যাদা স্বীকার করবেন, ঐ দেশের সংগ্রামী নিপীড়িত মানুষকে সর্ব প্রকার অসামরিক সাহায্য দানে উদ্যোগী হবেন?

আমাদের পশ্চিম বঙ্গের শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষাসেবীদের বেদনা বিশেষ রূপে গভীর। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির খুব বড় অংশ গিয়ে পড়েছে সমগ্র বাংলার সেই অংশে যাকে ২৬শে মার্চে তার অপ্রতিদ্বন্দ্বিত সর্বজনপ্রিয় নেতা মুজিবর রহমান সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশ বলে ঘোষণা করেছেন। গত দুই দশক ধরে এ দেশের নবজাগরণ, নব উদ্দীপনা, নব কর্মশক্তি কর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বিষয়ে নব চেতনা এবং কাব্যে উপন্যাসে প্রবন্ধে এ সবের বলিষ্ঠ প্রকাশ দেখে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি, অনেক আশা বুকে বেঁধেছি। যাদের নিয়ে সেই আনন্দ ও আশা তাদের উদ্বুদ্ধ জীবনের সাধনা ও সিদ্ধিকে বুটের তলায় মাড়িয়ে দিতে এসেছে এক বিরাট বর্বর সেনাবাহিনী। এতে কি আমাদের বেদনা সকলের অপেক্ষা তীব্র হবে না, কণ্ঠ সকলের অপেক্ষা সোচ্চার হবে না?

তারা শঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, মৈত্রেয়ী দেবী, আবু সায়ীদ আইয়ুব, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, শম্ভু মিত্র, সুশোভন সরকার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, প্রবোধচন্দ্র সেন, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, অম্লান দত্ত, গৌরকিশোর ঘোষ, সন্তোষ কুমার ঘোষ, নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী।
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!