You dont have javascript enabled! Please enable it! প্রতিরোধ যুদ্ধে যশোর ও অন্যান্য এলাকা | বাংলা একাডেমির দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

প্রতিরোধ যুদ্ধে যশোর ও অন্যান্য এলাকা
যশোর রণাঙ্গণে
(সত্যন সেন রচিত ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

২৩শে মার্চ তারিখে ইপি-আর বাহিনীর জওয়ানরা তাদের ক্যাম্পে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলল, আর সেই পতাকার সামনে শ্রেণীবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে “গার্ড অব অনার” দিল। অবাঙালিরা প্রতিবাদ তুলেছিল, কিন্তু তাদের সেই আপত্তি টিকল না। ২৫শে মার্চ তারিখে ঢাকা শহরে ইয়াহিয়ার জংগী-বাহীনির বর্বর আক্রমণের খবর যখন পৌছাল, যশোরের মানুষ তাতে ভয় পাওয়া দূরে থাক, বিক্ষোভে ফেটে পড়ল, ক্রোধে গর্জন করে উঠল- এর উপযুক্ত প্রতিশোধ চাই। যশোর ক্যান্টনমেন্টে কামান , মর্টার আর মেশিনগানে সজ্জিত হাজার হাজার পাক সৈন্য মোতায়েন আছে, যে কোন সময় তারা অগ্নিস্রাবী প্লাবন নিয়ে নেমে আসতে পারে, এ কথা চিন্তা করেও তারা ভয়ে পিছিয়ে গেল না। ২৬, ২৭ ও ২৮শে মার্চ এই তিনদিনে ইপিআর এর চারটি ক্যাম্পে জওয়ানরা প্রতিরোধের দৃঢ় সংকল্প নিল।

প্রথম সংঘর্ষ ঘটল ২৯শে মার্চ তারিখে- শহরের উপরে নয়, শহর থেকে বাইরে যশোর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। সেদিন ক্যান্টনমেন্টের ভেতর বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যকে নিরস্ত্র করা হয়েছিল। দিনের অবস্থা বদলে গেছে, মুক্তি আন্দোলনের হাওয়া ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেও এসে ঢুকেছে- নিরস্ত্র বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘোষনা করল। এর পরিণাম কি হবে, তা তারা ভাল করেই জানত, তা সত্ত্বেও এই লাঞ্ছনাকে তারা মাথা পেতে নেয়নি।

সতর্কতামূলক ব্যাবস্থা হিসেবে ওরা আগেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের ম্যাগাজিনের চাবিটা কেড়ে নিয়েছিল। বিদ্রোহীরা তাতেও দমল না, তারা ম্যাগাজিন ভেঙ্গে কিছু অস্ত্র বার করে নিয়ে এল। তারপর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই দু’পক্ষে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। একদিকে কামান, মর্টার, মেশিনগান প্রভৃতি ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য অপর দিকে হাল্কা হাতিয়ার সম্বল করে এক ব্যাটালিয়ন বাঙালি সৈন্য। এই যুদ্ধ কতক্ষন চলতে পারে! স্বাভাবিক ভাবেই এই সংঘর্ষে বহু বাঙালি সৈন্য মারা গেল। বাকী সৈন্যরা যুদ্ধ করতে করতে ক্যান্টনমেন্টের বন্ধ দরোজা ভেঙ্গে বাইরে পালিয়ে গেল।

এই সংবাদ দেখতে দেখতে শুধু যশোর শহর নয়, সারা জেলায় ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বুঝল, এবার মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে, আর বসে থাকার সময় নেই। ইপি-আর বাহিনী আগে থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে তৈরী হয়েছিল। এবার শহরের পুলিশ বাহিনী যুদ্ধ ঘোষনা করল। এই পুলিশ বিদ্রোহে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনটি নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা হলেন হিমাংশু ব্যানার্জী, আকমল হোসেন আর পীযুষ। শহরের বিশিষ্ট ফুটবল খেলোয়ার হিসেবে হিমাংশু ব্যানার্জী পুলিশদের মধ্যেই নয়, শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যেও জনপ্রিয়। সেই জনপ্রিয় খেলোয়ারটি এবার নতুন এক খেলায় নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন।

পুলিশ ম্যাগাজিনের চাবি ছিল অবাঙালি জমাদারের হাতে। হিমাংশু, আকমল ও পীযুষ তাকে বন্দী করে তার হাত থেকে চাবি কেড়ে নিয়ে ম্যাগাজিন খুলে ফেললেন। সেখান থেকে তাঁরা সাতশ রাইফেল, ছয়শ শটগান, কিছু সংখ্যক ব্রেনগান এবং যথেষ্ট পরিমাণ কার্তুজ উদ্ধার করলেন। তারপর এই অস্ত্রগুলিকে বিদ্রোহী পুলিশ আর বিদ্রোহী জনতার মাঝে বিলি করে দেয়া হল। স্থির হল, এদের এখনই অস্ত্র চালনা শিক্ষা দেয়া হবে। মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য ব্যাগ্র পুলিশ আর জনতা নিউ টাউনের নোয়াপাড়ার আমবাগানে ঘাঁটি করে বসেছিল। এখানে জনতার মাঝে তিনশ জনকে বাছাই করে নিয়ে ষাটজন পুলিশ তাদের রাইফেল চালনা শিক্ষা দিল। মাত্র একঘন্টার মত সময় পেয়েছিল তারা। এইটুকুর মধ্যেই তারা রাইফেল চালনার অ, আ, ক, খ টুকু আয়ত্ত্ব করে নিল।

সেদিন সেই আমবাগানেই এই নবদীক্ষিত শত শত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। জনসাধারণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাদের আহার্য-দ্রব্য জোগান দিয়েছিলেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! ঘরের মেয়েরা বেরিয়ে এসে এই স্মরণীয় আমবাগানের মধ্যে তাঁদের এই মুক্তিসংগ্রামী ভাইদের জন্য রান্না করেছিলেন। এই স্বেচ্ছাসেবী নারী বাহিনীকে পরিচালনা করছিলেন হিমাংশু ব্যানার্জীর স্ত্রী।

সেই দিনই ইপি-আর বাহিনী, ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা বেঙ্গল রেজিমেন্টের দু;শর উপরে সৈন্য, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ এবং ছাত্র-যুবকদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হল।

ক্যান্টনমেন্ট থেকে চারটি সৈন্যবাহী জীপ সম্ভবত শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষন করতে বেরিয়েছে। মুক্তিবাহিনী তাদের মধ্যে তিনটি জীপকে খতম করে দিল। এখান থেকে মুক্তিবাহিনীর সংগ্রাম শুরু। সেদিন রাত দু’টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্টের শালতলা এলাকায় পাক-সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে প্রচুর গুলি বিনিময় হয়।

সেই রাত্রিতেই যশোর জেলের কয়েদীরা বাইরের খবর শুনে চঞ্চল হয়ে উঠে। তারা জোর করে জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায় এবং তাই নিয়ে জেল প্রহরীদের সাথে দাঙ্গা হাঙ্গামা হয় ও গুলি চলে। শেষ পর্যন্ত তার পরদিন রাত্রিতে সেখানকার ১৩৭৫ জন বন্দী জেলের দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। তাদের মধ্যে সতের জন ছিলেন নিরাপত্তা বন্দী। এতা ৩০ তারিখ রাতের ঘটনা।

৩০শে মার্চ ভোরবেলা দু’দল পাক-সৈন্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে জীপে করে দু’দিকে যাত্রা শুরু করে। একদন এখানকার চাঁচড়ার দিকে, আরেকদল খুলনার দিকে। মুক্তিবাহিনীও দু’দলে ভাগ হয়ে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। খুলনার দিকে যে দলটি যাত্রা করেছিল, তাদের সাথে পুরাতন কসবার পুলের কাছে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ ঘটল। এই সংঘর্ষে পুলিশদের নেতা হিমাংশু ব্যানার্জী নিহত হলেন। চাঁচড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে আচ্ছামত ঘা খেয়ে পাক-সৈন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ঢুকে পড়ল। মুক্তিবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট অবরোধ করে রইলো।

৩১শে মার্চ শহর থেকে চারমাইল দূরে যশোর –মাগুরা রোডের ধারে হালিমপুর গ্রামে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়। ইপি-আর বাহিনীর জওয়ানদের নেতৃত্বে এই ট্রেনিংদানের কাজ চলতে থাকে। শোনা যায় জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা প্রায় পাঁচশ কয়েদী স্বেচ্ছায় এই ট্রেনিং সেন্টারে যোগ দিয়েছিল।

কিন্তু প্রতিরোধ সংগ্রামের সমরসজ্জা শুধু যশোর শহরেই সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং একই সাথে মহকুমা শহরগুলোতেও প্রতিরোধের প্রস্তুতি চলছিল। নড়াইলের এসডিও এবং এখানকার বিশিষ্ট নাগরিকদের উধ্যগে এক শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। যশোর শহরে সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে, এ খবর পেয়ে তারা শত্রুদের আক্রমন করার জন্য যশোর শহরের দিকে মার্চ করে চলল। নড়াইল মহকুমার হাজার হাজার লোক যার হাতে যা ছিল তাই নিয়ে এই যুদ্ধ মিছিলে যোগ দেয়। যশোর-নড়াইলের দু’ধারের গ্রামগুলো তাদের ঘন ঘন জয়ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠতে লাগল।

নড়াইল মহকুমার লোহাগড়া অঞ্চলেও একটি শক্তিশালী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের জন্য প্রতুতি নিচ্ছিল। নোউ বিভাগের প্রাক্তন অফিসার শামসুল আলমের উদ্যগে এই শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী টি গড়ে ওঠে। শামসুল আলম সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রনের পরে একটি বযাঙ্কে চাকরি নিয়ে দশজনের মত সাধারণ জীবন যাপ ই করছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার আহবানে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি চাকরীর মায়া ছেড়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেখতে দেখতে তাঁর নেতৃত্বে প্রায় ৫০০ জনের এক মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠল। এই বাহিনীর জন্য থানা এবং বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে দুশর উপরে রাইফেল ও বন্দুক সংগ্রহ করা হয়েছিল।

যশোর শহরের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোহাগড়ার এই মুক্তিবাহিনীও যশোরের দিকে দ্রুত মার্চ করে চলল। শামসুল আলম নিজ হাতে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিবাহিনীদের তৈরী করে তুলছিলেন। এখানেও হাজার হাজার লোক তাদের যুদ্ধ যাত্রার সাথী হয়েছিল। তারা তাদের ভীমগর্জনে পথঘাট মুখরিত করতে করতে যুদ্ধের উন্মাদনায় উন্মত্ত হয়ে ছুটে চলেছিল।

এই যুদ্ধ-মিছিল সম্পর্কে একতা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগারজন মেয়ে নিয়ে গঠিত একটি নারী বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অংশ হিসেবে এই যুদ্ধ-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল। এরা সবাই স্কুল-কলেজের ছাত্রী। মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের জন্য রান্না করা এবং যুদ্ধের সময় আহতদের সেবা শুশ্রুষা করা, এটাই ছিল তাঁদের কাজ। এই এগারটি বীরকন্যা মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে মুক্তিবাহিনীর সাথে দির্ঘপথ অতিক্রম করে যশোরে গিয়েছিল।

মাগুরা ও ঝিনাইদহ মহকুমায় যাঁরা মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন এবং মুক্তি সংগ্রাম পরিচালিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একটি লোকের নাম বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, তিনি হচ্ছেন মাগুরার তরুণ এসডিও ওয়ালীউল ইসলাম। এই ব্যাপক অঞ্চলের প্রতিরোধ সংগ্রাম কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

১লা এপ্রিল থেকে ৩রা এপ্রিল, এই তিনটা দিন হাজার হাজার পাকসৈন্য খা৬চার পাখির মত ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে রইল। ইতিপুর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বারকয়েক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে ওরা একেবারে ঘর নিয়েছে, বেরোবার নামটি করে না।

সৈন্যসংখ্যার দিক থেকে এবং আধুনিক অস্ত্রসজ্জার দিক থেকে শক্তি ওদের প্রচণ্ড। তাহলেও মুক্তিযোদ্ধাদের মরিয়া আক্রমনে, আর তাদের চেয়েও বেশী হাজার হাজার ক্ষিপ্ত জনতার ভিমগর্জনে ওরা যেন স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে ওদের মনোবল হারিয়ে ফেলেছে।

যশোর শহর মুক্তিবাহিনীর হাতে। এই তিনটি দিন শহরের মানুষ খুব অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছে। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। গ্রামাঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ, কখনও দলে দলে, কখনো বিচ্ছিন্ন ভাবে যে যার হাতিয়ার উঁচু করে শহরের দিকে ছুটে আসছে। আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রতিরোধের বাণী ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। তাদের সেই সংগ্রামী আহবান ব্যার্থ হয় নি। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে দলে দলে ছুটে আসছে মানুষ। তারা এই বর্বর হামলাকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে এই সোনার দেশকে মুক্ত করবে, স্বাধীন করবে।

ঘরের মেয়েরাও এগিয়ে আসতে চাইছে। এই মুক্তিসংগ্রামকে সফল করে তুলবার জন্য তাঁরাও কিছু করতে চায়। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘরে ঘরে রান্নার আয়োজন চলছে। কেউ তাদের বলুক আর নাই বলুক, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘরে খাবার তোইরী করে চলছে। যে যা পারছে সে তাই দিয়ে চলেছে। নিজেরা এগিয়ে গিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই সুযোগ থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায়না।

পরপর তিনদিন ধরে অবরোধ চলছে। হাজার হাজার লোক ঘিরে আছে ক্যান্টনমেন্টকে। দিনরাত্রি অষ্টপ্রহর পাহারা দিয়ে চলেছে। ক্যান্টনমেন্টের পিছন দিকে বিল অঞ্চল। সেখানেও পাহারা চলছে, যাতে এরা কোনভাবেই বেরোবার পথ না পায়। রাইফেল বন্দুক আর ক’জনের হাতেই বা আছে! গ্রামের মানুষ হাতিয়ার বলতে যার যা সম্বল তাই নিয়ে ছুটে এসেছে। বর্শা, বল্লম, রামদা, লেজা থেকে শুরু করে লাঠিসোঁটা পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, পথের মোড়ে মোড়ে গাছের উপরে অনেকে তীর ধনুক নিয়ে বসে আছে। দুশমনরা একবার শুধু ওদের কট ছেড়ে বেরোলেই হয়। একটাকেও জ্যান্ত ফিরে যেতে দেয়া হবে না।

যশোর ক্যান্টনমেন্ট বিরাট ঘাটি। এখানে প্রায় সতের হাজার সৈন্য থাকার ব্যাবস্থা আছে। তাছাড়া ট্যাঙ্ক ও ভারি অস্তশস্ত্রে এরা সুসজ্জিত। কয়েকশ রাইফেল, কয়েকটা লাইট মেশিনগান আর কেবল্মাত্র একটা পাচপাউণ্ড গোলা কামান দিয়ে এদের প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। যুদ্ধের ব্যাপারে সাহস অত্যন্ত প্রয়োজন, কিন্তু এ যুগে শুধু সাহস দিয়েই যুদ্ধ জয় করা চলে না। এই প্রতিরোধ সংগ্রামে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারা হয়ত এ ব্যাপারে পুরোপুরি সজাগ ছিলেন না।

তাছাড়া মুক্তিবাহিনীর আরেকটা দুর্বলতা ছিল তাদের যোগাযোগের অভাব। বীর জনতা তিনদিন ধরে যশোর কযান্টনমেন্টে পাক বাহিনী কে অবরুদ্ধ করে রাখল, অথচ সেই খবর টা সময় মত তাদের সদর দফতর চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছাল না। আর যদি পৌঁছেও থাক, মূল নেতৃত্ব তাতে সাড়া দেয়নি। সে গুরুত্বপূর্ণ সংকট মুহূর্তে তাদের শক্তি সম্পদ এনে যশোরে সমাবেশ করা প্রয়োজন ছিল। তাহলে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অভিজ্ঞ যোদ্ধারা থাকতেন এবং আরো কিছু ভারী অস্ত্রশস্ত্রও ব্যাবহার করা যেত। অবশ্য তাহলেই যে তারা যুদ্ধ জয় করতে পারতেন, এমন কথা বলছি না। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে , তার ফলে যশোর শহর এক প্রচণ্ড যুদ্ধক্ষেত্রে পরিনত হতে পারত এবং তারা বহু শত্রুসৈন্যকে খতম করতে পারত।

অবরোধের তৃতীয় দিনে অবরোধকারীদের সংখযা কমতে কমতে অবরোধের বেষ্টনিটা একটু পাতলা হয়ে এসেছিল। উপযুক্ত সময় বুঝে অবরুদ্ধ পাক-সৈন্যরা কামানের গোলায় পথ করতে করতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর দু’পক্ষে চলল যুদ্ধ। কামান, মর্টার আর মেশিনগানের বিরুদ্ধে রাইফেলের লড়াই, এ এক দুঃসাহসিক অথচ মর্মান্তিক দৃশ্য। এই যিদ্ধে দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা অদ্ভুত বিরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু এ সব অগ্নিস্রাবী কামান আর ভারী মেশিনগানের সামনে এই প্রতিরোধ কতক্ষন টিকতে পারে? যশোরের রাজপথ রক্তে লাল হয়ে গেল, কত দেশপ্রেমিক এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন তার হিসেব কেউ দিতে পারবে না। যুদ্ধ সমস্ত শহরময় ছড়িয়ে পড়ছিল, শহ্রের পথগুল অসংখ্য দেশভক্তের মৃতদেহে বিকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা বেঁচে ছিলেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে পুনর্গঠিত করার সংকল্প নিয়ে শহর ছেড়ে বাইরে চলে গেল। এইভাবে যশোরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটল।

এপ্রিলের মধ্যভাগ। ইতিমধ্যে পাকসেনারা যশোরের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করে চোরা-গোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। যশোর শহর থেকে দশ-বারো মাইল দূরে মুরাদপুর গ্রাম। বারো বাজারের পাশেই মুরাদগড়। এখানে মুক্তিবাহিনীর একটা গোপন খাঁটি ছিল। খবর পাওয়া গেল যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিছু পাকসেনা মুরাদগড়ের দিকে আসছে। সুখবর! এই শিকার যেন ফসকে না যায়। স্থির হলো এদের উপরে অতর্কিত হামলা দিতে হবে। ভাগ্যক্রমে এদের হাতে একটা লাইট মেশিনগান ছিল। এমন সুযোগ কি সবসময় মেলে? কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় মাত্র তিনজন। একজন ক্যাপ্টেন আর দুইজন তার সহকারী। খবর পাওয়া গেছে ওদের পাঁচখানা জীপ, একটা ট্রাক। সৈন্য সব মিলিয়ে শ খানেক হবে। একশজনের বিরুদ্ধে তিনজন। তা হোক, এ নিয়েই তারা ওদের বাধা দেবে।

যথাসময়ে ওদের সেই ‘কনভয়’ মুরাদগড়ে পৌছালে ওরা কালীগঞ্জের দিকে চলছিল। মুরাদগড়ের পুলটার একপাশে অনেক ঝোপঝাড়, তারই আড়ালে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা গা ঢাকা দিয়ে বসে ছিল। পাকসেনারা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে চলছিল। ওদের বাধা দেবার মত কারো দুঃসাহস থাকতে পারে, তা তারা স্বপ্নেও ভাবে নি। সবে তাদের দু’টো জীপ পুল পেরিয়ে ওপাশে গেছে, এমন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগানটি তাদের লক্ষ্য করে গর্জন করে উঠলো।

এভাবে অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনারা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এদিকে ওদের মেশিনগান অবিরল ধারায় গুলি বর্ষন করে চলেছে। ফলে আতঙ্কিত হয়ে তারা যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই ছুটে পালাল।

একটু পরেই এই ভগ্নদূতের দল হাঁপাতে হাঁপাতে ক্যান্টনমেন্টে এই সংবাদ পৌছুলো। দেখতে দেখতে এক বিপুল বাহিনী বেরিয়ে এল ক্যান্টনমেন্ট থেকে। তারা মুরাদগড়কে কেন্দ্র করে বিরাট একটা অঞ্চল ঘেরাও করে ফেলল। মুক্তিযোদ্ধারা এই ঘেরাও এর ভেতরে আটকা পড়ে গিয়েছিল। বেরোবার পথ ছিল না। শেষ পর্যন্ত সেই তিন বীরযোদ্ধা যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হলো।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হবার ঠিক অল্প কিছুকাল আগেই কর্তৃপক্ষ আবদুর রউফ কে পাকিস্তান থেকে তাঁর স্বদেশে নিয়ে আসে। তারপর থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে বেঙ্গল রেজিমেন্টের দলভুক্ত হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন উত্তাল তরঙ্গ নিয়ে গর্জন করে উঠেছে। স্বাধীনতার এই দুর্বার কামনা কে দমন করার জন্য সামরিক সরকার ২৫শেমার্চ রাতে ঢাকা শহরের বুকে হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সারা প্রদেশময় এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল জনতা, দিকে দিকে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠতে লাগল।

যশোর ক্যান্টনমেন্টে তখন বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য। পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার ও বেলুচ বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্যের মধ্যে তারা একেবারেই সংখ্যালঘু। তাই ভেতরে ভেতরে বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও তারা প্রথম দিকে অসন্তষ বা বিদ্রোহের ভাব প্রকাশ করেনি।

কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক অফিসারেররা তাদের বিশ্বাস করতে পারেনি। ২৯শে মার্চ পর্যন্ত মানুষের মনের অবস্থা যাই থাকুক না কেন, যশোরে নাগরিক জীবন স্বাভাবিক ভাবেই বয়ে চলছিল। কিন্তু ৩০শে মার্চ এ যশোর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বাঙালি- অবাঙালি সৈনিকদের মধ্যে এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটল। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররা বেঙ্গল রেজিমেন্টের অস্ত্রাগারের চাবি কেড়ে নিয়ে সমস্ত বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করে ফেলল। তার মিনিট কয়েক পরেই বিক্ষুব্ধ বাঙালি সৈন্যরা মরিয়া হয়ে বিদ্রোহ ঘোষনা করল এবং জোর করে তাদের নিজেদের অস্ত্রাগার দখল করে নিল।

এবার দু’পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পাকিস্তানী সৈন্যদের সংখ্যা বাঙালিদের চেয়ে বহুগুণে বেশী। তাছাড়া কামান, মর্টার, ভারী অস্ত্রশস্ত্র সবকিছুই তাদের হাতে। ফলে যা পরিণতি ঘটা স্বাভাবিক তাই ঘটল। ঘন্টাকয়েক ধরে যুদ্ধ চলল। দু-তিনশ বাঙালি সৈন্য নিহত হল। অবশিষ্ট বাঙালি সৈন্যরা ছত্রভংগ হয়ে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে গেল। যশোর জেলার মুক্তিসংগ্রামের এটাই হল সুচনা।

এই পালিয়ে আসা বাঙালি সৈন্যদের মধ্যে কোন শৃঙ্খলা ছিল না। যে যেদিকে পারল সেদিকে পালাল। আবদুর রউফ ও তাঁর দুজন সাথী তাদের সবার মধ্যে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন অবস্থাতেও তাঁরা মনোবল হারাননি। তাঁরা এই তিনজন মিলে নিজেদের একটা ইউনিট গঠন করলেন। এবং শপথ নিলেন যে, তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করে যাবেন। এই সঙ্কল্প লইয়ে তাঁরা যশোর শহরে ফিরে মুক্তিবাহিনী তে যোগদান করলেন। তখন যশোর শহর মুক্তিবাহিনীর অধিকারে এসে গেছে। মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের পর থেকে আবদুর রউফ ও তাঁর দুজন সাথী একই সঙ্গে লড়াই করে এসেছেন এবং আবদুর রউফ আহত হয়ে রণক্ষেত্র ছেড়ে চলে আসার আগ পর্যন্ত তাঁরা একই সঙ্গে ছিলেন।

৩রা এপ্রিল তারিখে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে পাকসেনারা যশোর শহর পুনর্দখল করে নিল। মুক্তিবাহিনী শহর ত্যাগ করে নিড়াইল গিয়ে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করল। কিন্তু যশোর শহ্র ছেড়ে গেলেও মুক্তিবাহিনীর একটা অংশ শহর থেকে মাত্র মাইল দেড়েক দূরে দুই তালা ফতেহপুরে পাকসেনাদের প্রতিরোধ দেবার জন্য তৈরী হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। তাদের সাথে ছিল তিনটা মেশিনগান। এই তিনটা মেশিনগানের মধ্যে একটা ছিল আবদুর রুফ ও তাঁর দুই সাথীর হাতে। ইপি-আর বাহিনীর ৮/১০ জন যোদ্ধা বাকি দুইটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। এদের সাহায্য করার জন্য গোটা পঞ্চাশেক ছাত্রও ছিল। এই প্রতিরোধের দলটি দুইতালার যেখানে ঘাটি করেছিল, সেখানে অপেক্ষা করতে লাগল।

আবদুর রউফ বলেছিলেনঃ ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত শত্রুপক্ষের কারো সাথে আমাদের দেখা হয়নি। ১২ই এপ্রিল বেলা একটার সময় যখন আমরা খেতে বসেছি, এমন সম লক্ষ্য করলাম শহরের দিক থেকে একটা কালো রঙ এর জীপ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। একটু দূরে থাকতেই জীপটা থেমে গেল। মনে হল, জীপের আরোহীরা আমাদের দেখতে পেয়েছে, তাই ওখানে থেমে গিয়েছে। আমরা দেখা মাত্রই খাওয়া ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম। সাথে সাথে আমাদের তিনটা মেশিনগান একই সাথে গর্জন করে উঠল। কিন্তু ওরা আগে থেকেই হুশিয়ার হয়ে জীপটা একটা গাছের পিছনে দাড়া করিয়েছিল। তাই আমাদের গুলী ওদের স্পর্শ করতে পারল না। জীপটা কিছুক্ষন ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। বোধহয় আমাদের অবস্থান টা পর্যবেক্ষন করে নিচ্ছিল। তারপর গাড়িটা যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই দ্রুতবেগে চলে গেল।

জীপটা চলে যাবার মিনিট কয়েক পরেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে কামানের গোলা বর্ষন শুরু হল। গোলাগুলি আমাদের সামনে এসে পড়ছিল। আমরা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নিয়ে আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নিলাম। ঘন্টাখানেক ধরে এভাবে গোলাবর্ষন চলল। ওরা মনে করল, এই গোলাবর্ষনের পরে রাস্তা নিশ্চয়ই পরিস্কার হয়ে গেছে, তাদের প্রতিরোধ করার মত কেউ নেই। তাই ওদের একটা পদাতিক দল নিশ্চিন্ত মনে যশোর নড়াইল সড়োক দিয়ে আসতে লাগল। আমরা ধ্যোইর্য ধরে অপেক্ষা করছিলাম, আসুক, অরা আরো কাছে এগিয়ে আসুক, তারপর ওদের একবার দেখে নেয়া যাবে। উপযুক্ত সময় আসতেই আমরা মুহুর্তের মধ্যেই পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে মেশিনগান চালাতে শুরু করলাম। ওরা এ জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, তাই আমাদের তিনটা মেশিনগানের অবিরল গুলিবর্ষনের ফলে ওদের প্রচুর লোক মারা গেল। বাকী সবাই উর্ধ্বশ্বাসে প্রাণ নিয়ে পালালো।

ওরা পালিয়ে গেল বটে, কিন্তু আমাদের নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম নিতে সুযোগ দিল না। একটু বাদেই ওদের একটা বড় দল আমাদের উপর এসে হামলা করল। ওরা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়েই এসেছিল, সঙ্গে মেশিনগানও ছিল, কিন্তু ওরা এবার বরাবর সোজা পথ ধরে আসে নি। আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে দেখলাম, ওরা দুটো দলে ভাগ হয়ে দুদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ করেছে এবং আমরা প্রায় ঘেরাও হয়ে যেতে বসেছি।

আমাদের উপর দুদিক থেকে গুলিবর্ষন চলছে, আমরা যেন গুলির বেড়া জালের মধ্যে আটকে পড়তে বসেছি। আমাদের সাহায্য করার মত যারা ছিল সবাই ছত্রভংগ হয়ে পালিয়ে গিয়েছে। আমাদের মধ্যে একে একে পাঁচজন যোদ্ধা শহীদ হলেন। কিন্তু তবু আমরা মনোবল হারাইনি। আমাদের তিনটি মেশিনগান অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে গুলি করতে করতে পিছিয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা যথেষ্ট কৌশলের পরিচয় দিয়ে সেই মৃত্যুফাঁদ থেকে বেরিয়ে এলাম।

শত্রুপক্ষ বুঝল, লড়াইয়ের পথ এখনো তাদের জন্য কণ্টকমুক্ত নয়। তাই তারা আর বেশীদুর না গিয়ে যশোর শহরে ফিরে গেল। ইতিমধ্যে নড়াইলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে, পাকসৈন্যদের এক বিরাট বাহিনী নড়াইল আক্রমন করতে রওনা হয়েছে। শহরের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পালাতে শুরু করল। আবার সেই রাত্রিতেই ওরা নড়াইলের উপরে মারাত্মক রকম বোমা বর্ষন করল। বিস্ফোরনের আগুনে জ্বলতে লাগল নড়াইল শহর। অবস্থা গুরুতর দেখে মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইল ছেড়ে লোহাগড়ার দিকে চলে গেল।

পরদিন যশোর থেকে বিরাট মিলিটারি বাহিনী এসে নড়াইলে হামলা করল। তাদের সঙ্গে ছিল তাদের বিহারী ও বাঙালি দালালরা। ওরা লুতের লোভে উন্মত্ত হয়ে ছুটে এসেছে। ওদের বাধা দেয়ার মত কেউ ছিল না। ওরা নিশ্চিন্ত মনে নড়াইল শহরে লুটপাট চালিয়ে ফিরে গেল যশোর শহরে। তখন নড়াইলে সামরিক-বেসামরিক কোনরকম শাসনই রইল না। কুখ্যাত গুন্ডা টগর সেই সুযোগে সারা শহরের উপরে তার আধিপত্য বিস্তার করে যা খুশি তা’ই করে চললো।

মূল মুক্তিবাহিনী চলে গেছে লোহাগড়া। আমাদের সঙ্গে যারা ছিল তারাও ছত্রভংগ হয়ে কে কোথায় চলে গেছে। এবার আমরা তিনজন মুক্তিবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম, আমরা স্থির করলাম আমাদের নিজেদের এবার নিজেদের পথ বেছে নিতে হবে, নিজেদের উদ্যগে মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শত্রুপক্ষ যতই প্রবল হোক না কেন, বা অবস্থা যতই প্রতিকুল হোক না কেন, আমরা কিছুতেই এই সংগ্রাম ছেড়ে পিছু হটে যাব না। আমরা তিনজন আর আমাদের মেশিনগানটি, এই আমাদের সম্বল। এই নিয়ে আমরা নতুন পথে যাত্রা শুরু করলাম।

আমাদের প্রথম কাজ হল নড়াইল গিয়ে টগর গুন্ডা কে উচিত শিক্ষা দেওয়া। আমরা সোজা গিয়ে তার মোকাবিলা করলাম। টগর তার দলবল নিয়ে অবাধে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের সাথে বাক্যবিনিময়ের ইচ্ছা বা সুযোগ কোনটাই আমাদের ছিল না, দেখা হওয়া মাত্রই গুলি বিনিময় চলল, কিন্তু আমাদের মেশিনগানের সামনে ওরা কি করে দাঁড়াবে? টগর প্রাণের ভয়ে আত্মসমর্পন করল। আমরা দেশের শত্রু সেই শয়তানের মৃত্যুদন্ডের ব্যবস্থা করলাম। তার পরপই তার মতই কয়েকটি দেশদ্রোহী কে হত্যা করা হলো।

এবার আমরা নড়াইল ছেড়ে লোহাগড়ার কাছে দীঘলিয়া গ্রামে চলে গেলাম। আমরা স্থির করেছিলাম, এবার আমরা নিজেদের উদ্যগে একটা নতুন মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলব। এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের ইচ্ছুক ছাত্র ও যুবকের অভাব ছিল না। সামরিক ট্রেনিং পাবার জন্য তারা অধীর হয়ে উঠেছিল। আমার ডাকে দেখতে দেখতে অনেক ছাত্র ও যুবক এসে জুটল। আমি দীঘলিয়াতে ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করে এই সমস্ত শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং দিয়ে চললাম। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা চল্লিশ-পঞ্চাশ জনে দাড়াল।

এদিকে পাকসেনাদের জয়লাভের ফলে স্থানীয় দালালেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল চোর, ডাকাত, লুটেরা আর গুন্ডা বদমাসের দল। ওরা এই সুযোগে নিজেদের ফায়দা উসুল করে নিচ্ছিল। ওদের পিছনে সামরিক সরকার সমর্থন রয়েছে, তাই তারা নিশ্চিন্ত ছিলযে, তারা যাই করুক নাকেন, কেউ তাদের বাধা দিতে সাহস পাবেনা। দীঘনিয়ার কুখ্যাত চেয়ারম্যান নওশের আলী ছিল তেমনই এক নামকরা দালাল। আমাদের মুক্তিবাহিনীর কথা শুনে তার টনক নড়ল। সে টাকাপয়সা ছড়িয়ে চারদিক থেকে হাজারদুয়েক গুন্ডা এনে আমাকে ধরতে এলো। আমাকে ধরা এত শজ নয়, তা সে বুঝতে পেরেছিল, তাই এত তোড়জোর। আমি খবর পেয়েই দীঘলিয়া বাজারে “কারফিউ” জারি করে দিয়েছিলাম। আমাদের মুক্তিবাহিনীর ছোট একটা গ্রুপ নিয়ে ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করলাম। কিন্তু যুদ্ধ করার প্রয়োজন হলো না, আমাদের মেশিনগানের আওয়াজ শুনেই দালাল নওশের আলীর ভাড়াটে গুন্ডাগুলি দেখতে দেখতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল।

কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যে, জায়গাটা আমাদের পক্ষে আর নিরাপদ নয়। আমাদের অন্যত্র সরে যাওয়া টাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু যাবার আগে দালাল নওশের আলির লীলাখেলা শেষ করে দিয়ে যাব। এই সঙ্কল্প নিয়ে তখনকার মত আমার বাহিনী কে ভেঙ্গে দিলাম। তারপর সে অঞ্চলে পনের ষোল দিন আত্মগোপন করে ছিলাম। একদিন উপযুক্ত সুযোগে নওশের আলীকে হত্যা করা হয়। তারপর আমি আর আমার দুই সাথী সেই অঞ্চল ছেড়ে এলাম ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে।

আমরা গোপালগঞ্জ মহকুমার চন্দ্রদিঘী গ্রামে এসে আশ্রয় নিলাম। দেখতে দেখতে এখানেও এক মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠল। আমাদের দৃষ্টি রইল গোপালগঞ্জ শহরের দিকে। সেখানে তখন মুসলিম-লিগপন্থী, জামাতপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দেশদ্রোহীদের অপ্রতিহত রাজত্ব চলছে। পুরানো এসডিও কে সরিয়ে দিয়ে অবাঙালি একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গোপালগঞ্জ শহর তখন শত্রুপক্ষের দুর্ভেদ্য দুর্গ স্বরূপ। পরিকল্পনা নিলাম, ওদের দুর্গের ভেতরে ঢুকে ওদের উপরে হামলা চালাব। এই পরিকল্পনা যদি সফল হয়, তবে সমস্ত মহকুমা জুড়ে মুক্তিবাহিনীর প্রভাব ও মর্যাদা বহুগুণে বেড়ে যাবে।

কিন্তু শুধু আমরা তিনজনই সেখানে যাব, যা করবার তিনজনই করব, বাহিনীর আর কাউকে সঙ্গে নেব না। এ কাজ করতে হবে অত্যন্ত কৌশলে। ওরা যদি আগে থেকে টের পেয়ে যায়, তাহলে একজনকেও আর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে হবে না। আমার প্যারাট্রুপারের ট্রেনিং এর অভিজ্ঞতা টা এবার কাজে লাগাতে হবে। খুবই দুঃসাহসের কাজ। আমরা তিনজন সেই বিপজ্জনক পথে পা বাড়ালাম।

গভীর রাত্রিতে অতি সন্তর্পনে আমরা তিনজন গোপালগঞ্জ শহরে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। শান্ত শহর ঘুমিয়ে আছে, কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। আমাদের ভাগ্য ভাল, আমরা কোথাও কোন পাহারাদারের নজরে পড়ে যাই নি। কি করে দ্রুত ও সতর্কতার সাথে শত্রুপক্ষের যোগাযোগ ব্যাবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হয়, সেই শিক্ষা আমার ভাল করেই জানা ছিল। এবার তা কাজে লেগে গেল। আমরা যন্ত্রের মত কাজ করে চলছিলাম। দেখতে দেখতে ওদের বেতার প্রেরণ ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিলাম, কেটে ফেললাম টেলিফোন আর টেলিগ্রামের তার। গোপালগঞ্জ শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কিন্তু এমন সতর্কতার সাথে এই কাজগুলি করেছিলাম যে, একটি জনপ্রাণী ও টের পায়নি। এইভাবে আমাদের প্রাথমিক কাজ সমাপ্ত করে নিয়ে আমরা তিনটি নিশাচর প্রাণী দিবালোকের অপেক্ষায় রইলাম।

অবশেষে রাত্রির অন্ধকার কেটে দিনের আলো দেখা দিল। ক্রমে বেড়ে উঠল বেলা। আমরা আমাদের গোপন আশ্রয় ছেড়ে প্রকাশ্যভাবে বেরিয়ে এলাম পথে। পথের মানুষ আমাদের দেখে চমকে উঠল। ভয় পেয়ে দু ধারে সরে গিয়ে আমাদের পথ করে দিল। আমরা আমাদের মিলিটারী বুটের খট খট শব্দে রাজপথ ধ্বনিত করে সোজা পুলিশ ব্যারাকে উঠলাম। ব্যারাকে ঢুকেই চমকে উঠলাম আমি। সংবাদ পেয়েছিলাম যে , মাত্র জনাকয়েক পুলিশ আছে। কিন্তু ঢুকে দেখি জনা তিরিশেক অবাঙালি পুলিস আমদানি করা হয়েছে। আমাদের পক্ষে ভয় পাবারই কথা। কিন্তু আমরা এক অগ্নিপরীক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে, আমাদের ভয় করলে চলবে না, এখন যা হবার তা হোক।

আমাদের দেখে ওরা সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল। ওরা আমাকে পাঞ্জাবী অফিসার বলে মনে করেছিল। অনেকেই এই ভুলটা করে থাকে। এরই উপরে ভরসা করে আমি দুঃসাহসিক প্ল্যান নিয়ে গোপালগঞ্জে এসেছি। বলতে গেলে জেনেশুনেই বাঘের মুখে দাঁড়িয়েছি। আমি মিলিটারি অফিসারের গাম্ভীর্য নিয়ে পরিস্কার উর্দু ভাষায় বললাম, আমি সামরিক হেডকোয়ার্টার থেকে এসেছি। তোমাদের উপরে নির্দেশ, তোমরা এখনই তোমাদের অস্ত্র আমার সামনে এসে জমা করবে।

ওরা আমার নির্দেশ শুনে অবাক হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। তারা এই অর্ডারের মানে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। তারাত বাঙালি পুলিশ নয়, তাদের এভাবে নিরস্ত্র করা হচ্ছে কেন? আমি তাদেরকে বেশী ভাববার সময় না দিয়ে বজ্রগর্জনে সেই নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করলাম। এবার ওরা ঘাবড়ে গিয়ে সুরসুর করে আমার নির্দেশ পালন করল। পাশেই ছোট একটা ঘর, সেই ঘরে রাইফেল স্তুপীকৃত হয়ে উঠল। এবার আমরা ওদের একটা হলঘরে ঢুকিয়ে দরজা তালাবন্ধ করে গট গট করে হেঁতে চলে এলাম বাইরে। এইখানে প্রথম দৃশ্যের শেষ।

এবার দ্বিতীয় দৃশ্য। আমরা যে পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম, তার মধ্যে ট্রেজারি আর ব্যাঙ্ক লুট করার কথাও ছিল। কিন্তু এখন বুঝলাম অবস্থা গুরুতর। আপাতত সোদের পরিকল্পনা থেকে সে দুটো ছাঁটাই করে দিতে হবে। এবার পুলিশ ব্যারাক পেছনে ফেলে নবনিযুক্ত এসডিও এর কুঠিতে গিয়ে উঠলাম। খবর পাঠাবার একটূ বাদেই সেই এসডিও হাপাতে হাপাতে আমাদের সামনে এলো। আমার দিকে চোখ পড়তেই সসম্মানে স্যালুট দিল। আমি তাকে উর্দুতে বললাম, য়ামি সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জরুরী নির্দেশ নিয়ে এসেছি। এখুনি মুসলিম লিগের আফসার উদ্দিন মোল্লা ও সিদ্দিক সিকদার কে ডেকে পাঠান। একটা বিষয় নিয়ে ওদের সাথে পরামর্শ করতে হবে। এসডিও অতি সমাদরে আমাদের একটা ঘরে নিয়ে বসালেন। একটু বাদেই যাদের ডেকে পাঠান হয়েছিল তারা এসে উপস্থিত হলো। ঘরে এসে ঢুকবার সাথে সাথেই আমরা তিনজন উঠে দা৬ড়িয়ে ওদের দিকে রাইফেল উচু করে ধরলাম। একই সাথে তিনটা রাইফেল গর্জে উঠল। ওদের কথা বলবার সময়টুকু পর্যন্ত ছিল না, একই সঙ্গে তিনটি দেহ ভূমিশয্যায় লুটিয়ে পড়ল। এমনি করে পর পর তিনবার গুলি ছুড়লাম, তারপর কাজ শেষ করে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম।

পেছনে লোকজনের কোলাহল আর হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। এতক্ষনে মনে পড়েছে, একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে; সেটিকে শেষ করে যেতে হবে। আমরা ছুটতে ছুটতে গিয়ে মুসলিম লিগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামানের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। সামরিক সরকারের বড় দালাল ওয়াহিদ্দুজামান। কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হতে হল। খবর নিয়ে জানলাম ওয়াহিদুজ্জামান বর্তমানে গোপালগঞ্জে নেই। না-ই বা থাকল ওয়াহিদুজ্জামান, তার ভাই ফায়েকুজ্জামান তো আছে। সেও তো এই অপকর্মে তার ভায়ের সাথী। আপাতত তাকে দিয়ে আমাদের কাজ চলবে। কিন্তু কি আশ্চর্য, ফায়েকুজ্জামান দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আমাদের মুখের দিকে তাকাতেই, কে জানে কি করে আমার আসল রূপ আর উদ্দেশ্য টা ধরে ফেলল। এতগুলি লোককে ঘোল খাইয়ে এলাম, কিন্তু তার সাবধানী চোখদুটিকে ফাকি দিতে পারিনি। আতঙ্কিত দৃষ্টি নিয়ে একলাফে ঘরে ঢুকে পড়ল সে, তারপর দরজার পাট দুটো আমাদের মুখের সামনে দড়াম করে বন্ধ করে দিল।

ইতিমধ্যে ঘরের ভেতর থেকে গুলিবর্ষন শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ও কেমন জিদ চেপে গেছে, বাইরে থেকে পালটা গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু একটু বাদেই নিজেদের ভুলটা বুঝতে পারলাম। ইতিমধ্যে সারা শহর চঞ্চল হয়ে উঠেছে। পথের মোড়ে মোড়ে ভীড় জমে যাচ্ছে। এর পর আর শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার উপায় থাকবে না। অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরে কাজ অসমাপ্ত রেখেই আমরা ছুটে বেড়িয়ে পড়লাম। আমরা ছুটছি, ফাকা আওয়াজ করছি, আর রাস্তা সাফ হয়ে যাচ্ছে।

নিরাপদে, সম্পূর্ণ অক্ষত দেহে শহরের বাইরে বেরিয়ে এলাম মৃত্যুর গহবর থেকে।

প্রকাশ্য দিবালোকে গোপালগঞ্জ শহরের বুকের উপরে এই ঘটনা ঘটে যাবার পর অবস্থা গরম হয়ে উঠল। সামরিক বাহিনী আর তাদের দালালেরা মুক্তিবাহিনী কে নির্মূল করার জন্য উঠেপড়ে লাগল। আমরা যে অঞ্চলে ছিলাম সেখানকার জনসাধারনের উপরে নানারকম জুলুম আর অত্যাচার চলল। শেষ পর্যন্ত আমরা তিনজন অই অঞ্চল ছেড়ে মাণিকহার গ্রামে চলে এলাম। আমরা যেখানেই যাই স্থানীয়ভাবে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠে। তাছাড়া দিঘলিয়া আর চন্দ্রদীঘলিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলাম।

মাণিকহারে এসে একটা মস্ত খবর পেয়ে গেলাম। নারায়নগঞ্জ থেকে আটটা ফ্ল্যাট প্রায় দেড়লক্ষ মণ পাট বোঝাই হয়ে খুলনার দিকে যাচ্ছে। আমাদের শত্রুরা আমাদের এই পাট বিদেশে রফতানি করে মুনাফা লুটবে, আর হয়ত সেইটাকা দিয়ে আমাদের মারবার জন্য অস্ত্র আমদানী করবে। ফ্ল্যাটগুলি এই মধুমতির তীর ঘেষেই যাবে।

এই খবর পেয়ে আমরা একদল মুক্তিযোদ্ধা এই ফ্ল্যাটগুলিকে অভ্যর্থনার জন্য মাণিকদা গ্রামে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। যথাসময়ে ফ্ল্যাটগুলি মাণীকদার কাছে তালাঘাটে ভিরল। আমরা আগে থেকেই ফ্ল্যাটগুলির উপর হামলা করার জন্যতৈরী হয়ে ছিলাম। ওরা পালিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করেছিল, পারল না। আমরা ওদের সব পাট পুড়িয়ে ছাই করে দিলাম।

১০ই মে নারায়নগঞ্জ থেকে রকেট স্টিমারটি সৈন্যদের রসদে বোঝাই হয়ে খুলনার দিকে যাচ্ছিল। তাছাড়া স্টিমারে একজন মেজরের নেতৃত্বে ৫০ জনের মত সৈন্যও যাচ্ছিল। এই সৈন্যদের সাথে অস্ত্রশস্ত্র তেমন ছিল নাএবং তারা সাদা পোশাকেই চলছিল। রকেট স্টিমারটি তালাঘাটে ভিরল। আমরা তখনও মানিকদা তেই ছিলাম। এই খবরটাও আমাদের কাছে পৌছে গিয়েছিল। স্টিমার ঘাটে ভেরার সাথে সাথেই আমাদের মুক্তিবাহিনী সেটা ঘেরাও করে ফেলে। ওদের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় ছিল না। আরোহীদের নদীর তিরে নামিয়ে দিয়ে স্টিমারটাকে ডুবিয়ে দিলাম। তারপর মেজর সহ সৈন্যদের খতম করে দেয়া হল।

সেই দিন রাত্রিতেই খুলনা থেকে একটা রসদ বোঝাই লঞ্চ এবং বরিশাল থেকে একটা সৈন্যবাহী লঞ্চ গোপালগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। আমরা প্রথমে খাদ্যবাহী লঞ্চ টা কে ডুবিয়ে দিলাম। তারপর প্রবল গুলিবর্ষনের ফলে সৈন্যবাহী লঞ্চ টাও ডুবে যায়। এই অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর উৎপাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। গোপালগঞ্জের এসডিও হত্যা, দেড় লক্ষমণ পাট পুড়িয়ে দেয়া, সৈন্যবাহী লঞ্চ ডোবানো।– পর পর এই সমস্ত ঘটোনা মুক্তিবাহিনীর প্রভাব বাড়িয়ে চলছিল; অপরপক্ষে সামরিক কর্তৃপক্ষের মর্যাদার হানি ঘটোছিল। তাই আমাদের নির্মূল করে দেয়ার জন্য তারা উঠে পড়ে লাগল।

সেই দিনটা ছিল ১১ই মে। এই তারিখটা আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। অদের গুপ্তচরের মুখে ওরা আমাদের অবস্থান টা জানতে পেরেছিল। সেদিন আমাদের জায়গা থেকে বেশ অনেকটা দূরে ওরা আমাদের অবস্থান টা জানতে পেরেছিল। সেদিন আমাদের জায়গা থেকে বেশ খানিকটা দূরে ওরা লঞ্চ বোঝাই করে সৈন্য নামাল। ব্যাপারটা আমরা একেবারেই টের পাইনি। যখন টের পেলাম, তখন প্রায় ঘেরাও হয়ে এসেছি। সেই ঘেরাও থেকে বের হয়ে আসা সহজ কথা নয়। আমার কথা বলি, আমি ওদের একটা সোইন্যদলের একেবারে কাছাকাছি গিয়ে পড়েছিলাম। আমার ভাগ্য ভাল, ওরা আমাকে ওদের একজন বলেই ভুল করে বসেছিল। ফলে আমার কাছ থেকে কোনরকম আক্রমণ ওরা আশা করেনি। আর আমিও ওদের অপ্রস্তুত অবস্থায় একপশলা গুলিবর্ষনের সুযোগ পেয়ে গেলাম। ফলে ওদের অনেক সৈন্য হতাহত হলো। সেদিন আমরা গুলি চালাতে চালাতে বহু কষ্টে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমি নিজে একেবারে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পারিনি। এতদিন এত সমস্ত সংঘর্ষ্র মধ্যেও আমার গায়ে এতটুকু আঁচড় পরেনি। কতবার কত গুলি কানের পাশ ঘেষে বেরিয়ে গেছে, কতবার কত গুলিবৃষ্টির মাঝে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে এসেছি। ফলে আমার মনে মনে এমন একটা বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, অদের গুলি আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু এবার যেন শত্রুরা আমার দেখে ওদের দাঁত বসিয়ে দিল। বেরিয়ে এসে দেখি আমার এই হাত থেকে অবিরাম ধারায় রক্ত ঝরছে, তিন তিনটি গুলি একই সাথে আমার হাতে এসে বিদ্ধ হয়েছে।

বলতে বলতে মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফ তাঁর ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতখানি আমার সামনে তুলে ধরলেন।

-কি করলেন তারপর? জখম হাতটার কি ব্যবস্থা করলেন? প্রশ্ন করলাম আমি।

-আমি যে জখম হয়েছি, ওরা এই খবর টা জানতে পেরেছিল। আমি কে সেটাও ওদের অজানা ছিল না। ইতিমধ্যে এখানকার মুক্তিযুদ্ধের নেতা হিসেবে আমার নামটা এখানকার সর্বত্র প্রচার হয়ে গিয়েছিল। ওরা মনে করেছিল, আমি নিশ্চয়ই আমার এই জখমটার চিকিৎসার জন্য কোন ডাক্তার খানায় অথবা ডাক্তারের কাছে যাব। তাই ওরা আমাকে ধরার জন্য সে সব জায়গায় ও হামলা করেছিল। ফলে আমার পক্ষে ওসব জায়গায় যাবার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আট-দশ দিন বিনা চিকিৎসাতেই কাটল। ফলে আমার হাতটা সেপটিক হয়ে পেকে উঠল। ঐ অবস্থায় আর কিছুদিন থাকলে নির্ঘাত মারাই যেতাম। তখন বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলেন জখম চিকিৎসার জন্য বর্ডারের ওপারে চলে যেতে হবে। আমার অবস্থা যে রকম দাঁড়িয়েছিল, তাতে এ ছাড়া আমার বাঁচার আর কোন উপায় ছিল না।

—————————————-