You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.28 | রণাঙ্গন ফুলবাড়ী মুক্তাঞ্চল সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠিত - সংগ্রামের নোটবুক

রণাঙ্গন ফুলবাড়ী মুক্তাঞ্চল সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠিত

(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক) বাংলাদেশে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রংপুর দফতর হইতে প্রাপ্ত রিপাের্টে জানা যায়, রংপুর জেলার ফুলবাড়ী থানা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ গণ-সংগ্রামের মহান দৃষ্টান্ত স্বরূপ অদ্যাবধি স্বাধীন বাংলার মুক্তাঞ্চল হিসাবে বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করিয়া রহিয়াছে। মুক্তি সংগ্রামের শুরু হইতেই ঐ এলাকায় আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিষ্ট পার্টির মিলিত ‘সংগ্রাম পরিষদ স্থানীয় জনগণকে বারবার পাক হানাদারদের আক্রমণ প্রতিহত করিয়া আসিতেছে, হাজার হাজার ছাত্র-যুবক-কৃষককে মুক্তিফৌজে পাঠাইতেছে, লড়াইয়ের পরিধি পার্শ্ববর্তী থানাগুলিতেও সম্প্রসারিত করিয়া চলিয়াছে।  ঐ এলাকার সর্বত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িতেছে, স্বাধীন বাংলার প্রশাসন চলিতেছে। কিন্তু যুদ্ধাবস্থা, প্রাকৃতিক ও ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের ফলে জনগণের আর্থিক সঙ্কট বৃদ্ধি পাইয়াছে। খাদ্যাভাব ও কলেরা মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা যাইতেছে। 

সম্প্রতি দুর্গত জনগণের জানে স্থানীয় জনসাধারণ একটি সর্বদলীয় সংযুক্ত রিলিফ কমিটি’ গঠন করিয়াছে। এই কমিটি ইত্যবসরে ২/৩ হাজার লােককে কলেরা প্রতিশেধক ইনজেকশন দিয়াছে। কমিটির সভাপতি ও থানা আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব ইউনুস আলী এবং কমিটির সম্পাদক ও থানা ন্যাপের সম্পাদক জনাব বদরুজ্জমান এক যুক্ত বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস, ভারতীয় রেড ক্রস ও বন্ধু দেশ গুলির প্রতি দুর্গত জনগণের সাহায্যে আগাইয়া আসার আবেদন জানান। খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ ও মহামারী প্রতিষেধক প্রয়ােজন।  দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বীর মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রহিয়াছে। এক্ষেণ তাহারা। স্থল যুদ্ধে বিমান আক্রমণকে ঠেকাইয়া অগ্রসর হইতে সক্ষম। গত এক পক্ষকালে বিভিন্ন ফন্টে ৫ শতাধিক পাক সৈন্য ও রাজাকার খতম ও বিপুল অস্ত্রশস্ত্র দখল হইয়াছে। ফরিদপুর বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ মুক্তি বাহিনী পাল থানায় অবস্থিত পাক সেনা ও রাজাকারদের ঘাটিটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। মুক্তিফৌজ গভীর রাত্রে এই আক্রমণ চালায়। মােট ৬৮ জন পাকসেনা ও রাজাকার খতম, ৫৫টি রাইফেল ও প্রচুর গোলা বারুদ দখল করা হয়। এই সংঘর্ষে মুক্তিফৌজের ২ জন বীর শহীদ হন। কুমিল্লা সম্প্রতি এই জেলার বিভিন্ন এলাকায় দুই শতাধিক পাকসেনা নিহত ও ততােধিক আহত হয়। ২৯শে ও ৩০শে সেপ্টেম্বরে কনলা চৌয়ারা সেক্টরে মুক্তি বাহিনী মর্টার ও মেশিনগানের সাহায্যে ৫০ জনেরও বেশী পাকসেনাকে খতম করে। বহু আহত হয়।

২রা অক্টোবর মুক্তিফৌজ বুড়িচং থানার আনন্দপুরে এক আক্রমণে ৭ জন পাকসেনা খতম করে। চান্দিনায় মুক্তিফৌজের পােতা মাইন বিস্ফোরণে ৩ জন পাকসেনা ও ৭ জন রাজাকার নিহত ও ২ জন পাকসেনা আহত হয়। দোতলা নামক স্থানে এই ঘটনাটি ঘটে। সম্প্রতি কতােয়ালী থানায় যশপুর গ্রামে ৩ জন পাকসেনা একটি যুবতীকে ধর্ষণ করিতে উদ্যত হইলে গ্রামের লােকজন তাহাদেরকে দা দিয়া কোপাইয়া হত্যা করে। তাহাদের অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর নিকট জমা দেওয়া হইয়াছে। ২০শে অক্টোবর পায়ালগাছায় এক অভিযানে মুক্তিফৌজ ২৯ জন পাক সেনা ও ১৩ জন রাজাকার খতম করিয়াছে। বহু আহত হইয়াছে। প্রকাশ, প্রায় ২ শত পাক সেনা ও ৫০ জন রাজাকারের দল এই এলাকায় লুটতরাজ, ধর্ষণ চালাইতেছিল। মুক্তিফৌজ এই খবর পাইয়া উক্ত অভিযান চালায়। ইহা ছাড়া, কোটেশ্বর, জামবাড়ী, আমরাতলা, আনন্দপুর, সালদা নদী, কসবা, মিয়া বাজার,  চৌদ্দগ্রাম প্রভৃতি এলাকায় মুক্তিফৌজ একাধিক অভিযান চালাইয়া শতাধিক পাক সৈন্যকে খতম করিয়াছে। এইসব এলাকায় ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র লীগ সমন্বয়ে শক্তিশালী সংগ্রাম কমিটি রহিয়াছে।

জানান হইয়াছে যে, বরুড়া থানার কুখ্যাত দালাল জামাতে ইসলামীর মৌলােভী মােকসেদ আলীকে খতম করা হইয়াছে। বরিশাল সম্প্রতি এই জেলার ফিরােজপুর থানায় মুক্তিফৌজ অভিনব কৌশলে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক পাক সেনাকে খতম করে। মুক্তিফৌজ একজন মহিলাকে দিয়া পাক সৈন্যদেরকে খবর পাঠায়। পাক সৈন্যরা নির্দেশিত স্থানে আসিলে তাহাদের খতম করা হয়। পরে পাক সৈন্যদের অপর একটি দল ঐ মহিলাকে মােটরের পেছনে বাধিয়া লইয়া যায়। যাওয়ার সময় মহিলাটির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাস্তাতেই খুলিয়া খুলিয়া পড়িতে থাকে।

গোপালগঞ্জ গত ৪ঠা অক্টোবর ফরিদপুর জেলার গােপালগঞ্জের অন্তর্গত ভাটিয়া পাড়ার পাক ঘাঁটিতে পাক সৈন্যদের সহিত মুক্তিফৌজের সারা দিন সংঘর্ষ হয়। নাজেহাল পাক সৈন্যদের সাহায্যের জন্য পর পর ৪টি “সেবার জোট’ ঢাকা হইতে আসিয়া গুলী বর্ষণ করিতে থাকে। কিন্তু তাহাতেও মুক্তিফৌজের আক্রমণ ব্যাহত হয় নাই। একটি জেট সৈন্যসহ নামার চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিফৌজের প্রতিরােধে নামিতে পারে নাই। বৈকাল ৪টার দিকে ঐগুলি ফেরৎ চলিয়া যায়। সংঘর্ষে মােট ৬০ জন পাক সেনা ও ৭০ জন রাজাকার খতম ও বিপুল অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত হয় । দিনাজপুর সম্প্রতি এই জেলার রুহিয়া হইতে ৪ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে ১৪ জন রাজাকার মুক্তিফৌজের নিকট অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করিয়াছে ।ভ তাহারা পূর্বেই মুক্তিফৌজকে খবর দেয়। মুক্তিফৌজ ঘটনাস্থলে পৌছিলে তাহারা প্রকৃত রাজাকারদের খতম করে ও অস্ত্রশস্ত্রসহ মুক্তিফৌজের সহিত চলিয়া আসে। সম্প্রতি বলিয়াডাঙ্গী থানার বামনিয়া গ্রামে এক অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিফৌজ ১ জনকে কর্ণেলসহ ১১ জন পাকসেনাকে খতম করে। এক অভিযানে মুক্তিফৌজ ঠাকুরগাঁও মহকুমার জামাতে ইসলামীর পাণ্ডা আজিমুদ্দীনকে সপরিবারে খতম করিয়াছে। | ইহা ছাড়া, দেবীগঞ্জ থানায় গত ৮ই অক্টোবর পাক সেনাদের মুক্তিফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ১৮ জন শত্রু হতাহত ও ২ জন আহত হয়। হাড়িভাঙ্গা হাটে মুক্তিফৌজের মাইন বিস্ফোরণে ৪ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। এখানে কিছু অস্ত্রও হস্তগত হয়।

রাজশাহী নওগাঁ মহকুমার মালঞ্চা ও পাহাড়পুর গ্রামে এক সংঘর্ষে মুক্তিফৌজের হাতে ৮৭ জন রাজাকার ও পাক সেনা নিহত হয়। এই সংঘর্ষ ৬ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। মুক্তিফৌজের ৪ জন শহীদ হন। গ্রামবাসী জনগণ তাহাদেরকে সমাহিত করেন। | মুক্তিফৌজ কাশীপাড়া-ধামুর রাস্তার চরকরামপুর পুলটি মাইন বিস্ফোরণে উড়াইয়া দিয়াছে। এখানে এক সংঘর্ষে ১২ জন পাক সেনা খতম হয়।  সম্প্রতি নওগাঁ-এর বান্দাইখড়া এলাকায় পাক সৈন্যরা লুট করার জন্য কয়েকটি নৌকা লইয়া গেলে মুক্তিফৌজ সেইগুলি ডুবাইয়া দেয়। পরে পাক সেনারা আশেপাশের গ্রামে নির্যাতন চালায়। ৩ জন গ্রামবাসী নিহত হয়। নাটোরের কেবাড়ীয়া হাটে এক সংঘর্ষে ৩ শত জন পাক সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। দলে ছিল সাড়ে ৩ শত। মুক্তিফৌজ তাহাদের চতুর্দিকে ঘিরিয়া আক্রমণ করে। বগুড়া। সম্প্রতি বারপুর পাওয়ার পাইলন বিধ্বংস, কুখ্যাত দালাল নাইসকে হত্যা ও ভালকির রেলওয়ে পুল উড়ান হইয়াছে।

নােয়াখালি সম্প্রতি ছাগলনাইয়ার শুভপুর ট্রাঙ্ক রােডের উপর ২টি মিলিটারী ট্রাকের উপর হামলা চালাইয়া মুক্তিফৌজ ২২ জন পাক সেনা ও বহু গােলা বারুদ খতম করে। ঢকিা সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় জোনাকী সিনেমার সম্মুখে জনৈক পাক মেজরের জীপে গ্রেনেড ছুড়া হয় এবং সে আহত হয়। এই মেজরটি শাহীন স্কুলে নারীদের উপর নির্যাতন চালাইত। অপর একদিন এক মিলিটারী জীপের উপরে গ্রেনেড চার্জ করা হয় ।

রংপুর ১৩ই অক্টোবর সুটিবাড়ী হাটের নিকটে এক অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিফৌজ কয়েকজন পাক সেনাকে খতম করে। একজন মেজর আহত হয়। তাহারা ট্রাকে ও জীপে করিয়া যাইতেছিল। ১৭ই অক্টোবর বালাপাড়া গ্রামে গ্রামবাসী ও রাজাকারদের মধ্যে সংঘর্ষে উভয়পক্ষে কয়েকজন আহত হয়। ঐ এলাকায় গ্রামবাসীরা নিজেদের উদ্যোগে এখন সক্রিয় প্রতিরােধ গড়িয়া তুলিয়াছে।  কুষ্টিয়া এক খবরে জানা গেল যে, দর্শনা ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সামনে একদল পাঞ্জাবী সৈন্য ২ জন বেলুচ সৈন্যকে গুলী করিয়া হত্যা করে। কারণ, বেলুচরা জনৈক গ্রেফতারকৃত বৃদ্ধকে মুক্তি প্রদান করে। মদনা গ্রামে এক সংঘর্ষে ১৩ জন পাক সেনা নিহত হয়। গােবিন্দপুর গ্রামে অপর এক সংঘর্ষে পরাজয় বরণ করিয়া ১৬ জন রাজাকার ১১টি রাইফেলসহ ধরা দেয়।

নতুনবাংলা ১: ১১।

২৮ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯