You dont have javascript enabled! Please enable it!

পুলিশ বাহিনী বনাম পুলিশ শক্তি

কোন নির্দিষ্ট ভূমিকায় কাজ করার জন্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত। আলাদা গোষ্ঠি হিসাবে অথবা রাষ্ট্রিয় কাঠামোকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য পুলিশকে একটি শক্তি হিসাবে ব্যবহার করা হবে। এ প্রশ্ন এ শতাব্দীর প্রথম থেকেই দেখা দিয়েছে। এক কথাই পুলিশ শক্তি না শান্তি?

এ প্রশ্নের জবাব সরাসরি দেওয়া সম্ভব নয়। অনেক দিক থেকে পুলিশ রক্ষক হিসাবে সমাজে পরিচিত। কিন্তু পুলিশ কাকে রক্ষা করবে? কি রক্ষা করবে? এ সুশঠু সীমারেখা নির্ধারণ করবে রাষ্ট্র। আর রাষ্ট্রিয় দর্শনের প্রেক্ষিতে গড়ে উঠবে পুলিশের ভূমিকা। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিবর্তনের সামগ্রিক ইতিহাস পর্যালোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত। সরকারের বিশেষ কোন নীতি রাষ্ট্রের কোন নীতি হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারে যদি সরকারের সে নীতির পেছনে জনগণের সহজাত সমর্থন থাকে। সরকারের নীতি আবার এর সামগ্রিক কল্যাণ করতে আজ স্বীকৃত আইনের প্রয়োজন। সে আইনকে প্রয়োগ করতে গেলেও শক্তির প্রয়োজন। সেই শক্তির ধারক পুলিশ। পুলিশের ভূমিকে হচ্ছে সামগ্রিক কল্যাণ সাধন। চরম ব্যক্তি স্বতন্ত্রবাদের বিশ্বাসীরা রাষ্ট্রের কার্যকালাপ, দেশরক্ষা ও অভ্যন্তরিণ শান্তী শৃংখলার ব্যাপারে সীমাবদ্ধ রাখতে গিয়ে রাষ্ট্রকে পুলিশ রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যায়িত করেছে কিন্তু অত্যাধুনিক রাষ্ট্রিয় মতবাদ হচ্ছে সমাজতন্ত্রবাদ। আর এর মূলে কল্যাণ রাষ্ট্র। আর কল্যাণ রাষ্ট্রের মূল কাঠামো হচ্ছে সমাজের প্রত্যেক মানুসের চরম ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুবর্ণ সুযোগ দেয়া এবং কারো ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ  করা নয়। যখনই সমাজ এক জনের ব্যক্তি স্বাধীনতা অপর জনের টিকে থাকার হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তখনি পুলিশ এ স্বাধীনতা রক্ষা কল্পে যে কজাও গুলো করে তা মুষ্টিম্নেয় লোকে স্বার্থের পরিপান্থ। তখনি দেখা দেয় পুলিশ আর মানুসের মধ্যে বিরোধ। এ বিরোধের সূত্র ধরে পুলিশ অপ্রিয় হয় লোকে ঘৃণা করে, আবার ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় পুলিশের উগ্রতার জন্য পরিস্থিতি আরোও অবনতি ঘটে। লর্ড একশনের ভাষায়, সর্ব প্রকার শক্তি কলুষিতরা পথে নিয়ে যায় চরম শক্তি, চরম কলুষিতা। আইন প্রয়োগের ক্ষগেত্রে কতটুকু শক্তি পুলিশ বিভাগকে হস্তান্তর করেয়া যায় তা নিয়েও মনিষিরা অনেক চিন্তা ভাবনা  করেছেন, অপরাধ আইনের ক্ষেত্রে সমাজ আইন চিন্তা ভাবনা করেছেন। অপরাধ আইনের ক্ষেত্রে সমাজ আইন সবাকে সামাজিক মূল্য রক্ষার জন্য ক্ষমতা দেয় আর পুলিশকে যে আইন যথাযগ্য ভাবে প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়। আইন প্রয়োগ করতে গেলেই সমাজ স্বীকৃত সকল মানুসের অধিকার কিছুটা সংকুচিত হবে এবং মুষ্টিমেয় লোক ক্ষতিগ্রস্থ হবেই। তাই কল্যাণ রাষ্ট্রের সর্ব প্রকার কল্যাণ সাধনে কিছুটা অকল্যাণ হলেও সুনাম দূর্নাম তা পুলিশের ভাগেই পড়বে। অধিকন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রের শান্তির সময়ে আমরা পুলিশের কাছে অনেক কাজ আশা করে থাকি। সে সব কাজ সমাজ স্বীকৃত উন্নতির চাবিকাঠি হিসাবে চিহ্নিত। অথচ সে কাজ করতে গিয়ে পুলিশ ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এ ক্ষমতা প্রয়োগ বিধানই পুলিশকে শক্তি হিসাবে ধরে নেই। এবং দুর্নামের বোঝা বইতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কোন রাজপথের মিছিলের কথা শুনে পুলিশের গাড়ি রাইফেল উচিয়ে রাস্তার পাড়ে বসে থাকতে দেখেই সাধারণ মানুসের ধারণা গন মানুসের লোকের উপর বল প্রয়োগের প্রস্তুতি এবং প্রয়োজন বোধে ক্ষমতা প্রদর্শনি। ফৌজদারী আইনে থাকে ‘শো অফ সোর্স’ অন্যায় বলে বর্ণিত। তারই একটা প্রতিচ্ছবি। তাছাড়া আধুনিক সমাজে চিন্তাবিদ, লেখক ও সমাজ বিজ্ঞানীর মধ্যে রাষ্ট্রিয় মূলনীতি ও সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ে তীব্র সমালোনার তীর বর্ষিত হচ্ছে সে বর্ষণ মূখর পরিস্থিতে পুলিশকে দাড় করালে প্রত্যেক মানুসের চিন্তার আলোকে পুলিশের ইমেজ ধরা পড়বে। কেউ বলবে পুলিশ শক্তি, কেউ বলবে না শক্তি না শান্তি ইত্যাদি। এখন ব্যাক্তি বিশেষে দৃষ্টিকোন থেকে পুলিশের ভূমিকার মূল্যায়ন করা যাক।

১। ম্যজিস্ট্রেট স্যার পেট্রিক ককোন এর মতে, পুলিশের প্রধান কাজ অপরাধ দমন, পরবর্তি কাজ অনুসন্ধান ও অপরাধী ব্যক্তিদের স্বাস্তি বিধান করা। প্রথমেই বুঝতে হবে, এ লক্ষ্যে পৌছাতে হলে অপরাধ দমনি হবে প্রাথমিক কাজ। অপরাধী ব্যক্তিকে খুজে বের করে শাস্তি প্রদানের চেয়েও মানুসের নিরাপত্তা, সম্পত্তি রক্ষা ও শান্তি বজায় রাখতে পারলেই অপরাধী ব্যক্তিরা অপরাধ কাজ হতে নিবৃত্ত থাকবে। পুলিশ শক্তির প্রত্যেক সদস্যকে মনে রাখতে হবে যে, অপরাধীকে গ্রেফতারের চেয়ে সমাজের প্রত্যেক মানুসের প্রতিরক্ষার বিধান কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

২। জনৈক পুলিশ প্রধান বলেছে যে, ব্যক্তির সরকারী চাকুরী চিহ্ন ফলক কাধে ওঠে সে ব্যক্তি সমাজের অন্য লোকের উপরে এক ধাপ ওঠেছে বলে মনে করে।

৩। মিঃ ফ্রাংক নরম্যান বলেছেনঃ আমার মনে হয় পুলিশের চাকুরিই শেষ চাকুরি যা উপষ থেকেও মৃত্যু ঘটলেও আমি করতাম না।

৪। ১৯২৭ সালে পাঞ্জাবে লাম্পসডেন কমিটি অনেক অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে মন্তব্য করেছেন “চিন্তাবিদ সাক্ষীরা থাকলে প্রায় এক মত যে, প্রত্যেক বিভাগে কলুষতা আছে। পুলিশের বিরুধে এতো সোচ্চার হবার কারণ হচ্ছে পুলিশ গ্রেফতারের, তল্লাশীর এবং অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থার ভয় দেখিয়ে টাকা পয়সা নেই। অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তারা কিছুটা উপকার ও সুযোগ প্রদান করে টাকা আদায় করে।

উক্ত কমিটির অসাধু পুলিশ শ্রেণীর বিন্যাস করে বলেছেন (ক) এমন কতিপয় পুলিশের কর্মকর্তা আছেন যারা শুধু ফাকি দিয়ে ভাওতা দিয়ে টাকা পয়সা আদায় করে এদের পদ্ধতি হচ্ছে সম্মনী মানুসের বাড়ি তল্লাসীর ভয় দেখিয়ে প্রকৃত অপরাধী কে ছেড়ে দিবে বলে, হালকা চার্জশীট দেবার অঙ্গীকার করা। ভদ্রলোকের আত্নীয় স্বজনের নামে মামলা তদন্ত প্রকাশের ভয়ে অথবা ক্রিমিনাল ইতিহাস লিখে দেবে না হয় এন্ট্রি পুলিশ রেকর্ড করে রাখবে চিত্র গুপ্তের খাতায়। একেবারে জঘন্যতম হচ্ছে যে কর্মচারী মিথ্যা মামলা সাজিয়ে, অথবা নিরীহ লোকের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। এ হচ্ছে কমিটির রিপোর্ট এর পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথা আছে। কেউ কেউ বলেছেন, আইনের ফাক আছে বলেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অসাধু হবার পথ খোলা আছে। আমাদের দেশের প্রচলিত দন্ডবিধির জন্ম তারিখ ৬ অক্টোবর ১৮৬০ সাল। কার্যবিধির জন্ম তারিখ ২২ শে মার্চ ১৮৯৮৭ সাল। স্বাক্ষ্য আইন ১৫ মার্চ ১৮৭২ সাল। তা হলে দণ্ডবিধি ও স্বাক্ষ্য আইনের ব্যবধান ১২ বছর আর কার্যবিধির তফাৎ ৩৮ বছর। এই দন্ডবিধির মূল উৎস হচ্ছে লিভিং স্টোনের লেখা লুসিয়ান। কোড ও ফ্রান্সের আইন। এ আইন প্রণয়নে কৃতিত্ব লর্ড ম্যাকলে, ম্যাকলিয়র্ড এন্ডারসন ও মিলার এর। এ আইন দেশের মানুসের অপরাধ পদ্ধতি ও কারণ গত বিশ্লেষণ থাকলেও আন্তরিক যোগাযোগ কম। যে কারণে এইচ এস গৌড়ের বক্তব্যের সাথে আমরা একমত হয়ে বলতে পারি, দণ্ডবিধি ধারা গুলো সুচারুরূপে বিন্যাস করা নেয়। তাছাড়া আরোও দেখি, স্বাক্ষ্য আইন ও কার্য পদ্ধতিতে কিছুটা ফাক থাকতে পুলিশের তদন্ত কাজে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন স্বাক্ষ্য আইনের ১৬৭ টি ধারা নীতিগত ভাবে সুস্পষ্ট। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এ গুলো এমন উদ্ভট  পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যে, অপরাধ প্রমাণের ভার সম্পূর্ণ রূপে তদন্ত কারী অফিসারের সৌজন্য ও ক্ষতিগ্রস্থ লোকের বিচার পাওয়ার ধৈর্য ও তীতিখার উপর। ফলে মামলা পুলিশ ও বিচারকের হাতে বছরের পর বছর ঘুরপাক খাচ্ছে। এক কথায় ডিলে ডিফিটস ইকিটি অর্থাৎ বিলম্বের সুবিচার বিফলে যায়।

নাগপুর হাই কোর্টের (১৯৩৫) মাননীয় বিচারকের ভাষায় ,পুলিশ ডাইরিতে কিছু লিখতে বিলম্ব করার একমাত্র কারন হচ্ছে “সন্দেহ জনক অবস্থার ইঙ্গিত ( সরকার বনাম মিঃ গুরুজী মামলা।) তদন্ত জনিত ফাক ও আইনের মার প্যাঁচায়ের পুলিশের লোক অসাধু হবার সুযোগ পায়।আর এই অসাধুতার ছিদ্র পথে পুলিশ একটা আলাদা শক্তি হিসেবে চিহ্নিত ।কারন, এই শক্তির কাছে কম বেশী সকলের মাথা নোয়াতে হয় ,বিশেষ করে অসাধু কর্মচারী আইনের অপপ্রয়োগে ভয়ে সম্মানী লোক অনেক সময় ভীত থাকে,আবার কিছু সংখ্যক অনভিজ্ঞ পুলিশ কর্মচারী অজ্ঞতার জন্য অন অরথ্যক মামলা তদন্ত জিইয়ে রেখে মানুষষকে হয়রান করে।

বেতন সমস্যার কথা ব্লতে হয় অতঃপর। অনেকে মনে করেন ঊর্ধতন কর্মচারীর তুলনায় পুলিশের অন্যান কর্মচারির বেতন কম বলে সাধারণ জীবন যাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এর ফলশ্রুতি উৎকোচ গ্রহণ। এই বেতন সংক্রান্ত ব্যাপারেও বিতর্কেরও অবকাশ আছে, ১৯১৭ সালে ইলিংটন কমিশন, ১৯৪৬ সালে ভারোদা করিয়ার কমিশন, ১৯৪৮ সালে মুনির কমিশন, ১৯৫৬ সালের দাশ কমিশন (ভারত), ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানী কমিশন (যে রিপোর্ট এখনও প্রকাশিত হয়নি) ১৯৬০ সালে মমতাজ হোসেন কমিশন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশন।

উল্লেখিত সব গুলি কমিশন তাদের তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করেছে। কিন্তু কত বেতন হলে একজন লোক সাধারণ ভাবে বাচতে পারে তার একটা কাঠামো নকশা দিয়েছেন। সরকার কমিশনের সুপারিশ কার্যকরিও করেছেন কিন্তু অবস্থার কতটুকু হয়েছে তারও জরীপ কার্য আধুনিক সমাজে জরুরী হয়ে পড়েছে। বেতন নির্ধারণ করতে গিয়ে অনেকে মন্তব্য করেছেন। ফ্রেডম্যান সুন (১৯৬৩) বলেছেন, মানুস টাকার জন্য কাজ করে সন্দেহ নেই। তবে বেশি টাকা পেলে বেশি কাজ করবে বলে ধরে নেয়া যায় না। কথা গুলো গুরুত্বপূর্ন। কবে কত টাকা হলে মানুস তার সর্বসাধ্য ক্রমে কাজ করবে তাও সুস্পষ্ট ভাবে বলা যাচ্ছে না। সে জন্য দাশ কমিশন উল্লেক করেছেন, লিভিং ওয়েজ আর মুনির কমিশন রায় দিয়েছেন রুক্রুট্মেন্ট টেস্ট। এরিই প্রেক্ষিতে ৩ টি প্রধান বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেনঃ (১) খোলা বাজারের জিনিস পত্রের দামের সঙ্গে বেতনের সামঞ্জস্য থাকতে হবে। (২) এমন কোন বেতন দেয়া যাবে না, নিজের খরচ পোষানো সম্ভন নয়, (৩) যেহেতু বেতন নির্ধারণ সরকারের একচেটিয়া সুতরাং সরকারের উচিৎ স্বাস্থ শিক্ষা ও শিক্ষানবিশ সময়ে সুনজর রাখা। শুধু বেতনের জন্য পুলিশ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করবে তা আশা করা যায় না। ১৯৬০ – ৬১ সালে পুলিশ কমিশন (বিচার পতি কন্সটানটেইন এর নেতৃত্বে) অবশ্য বেতন বৃদ্ধি কথা থাকার সুবন্দোবস্থ করার কথা উল্লেখ করেছেন, তব এসাথে সাথে পুলিশের প্রয়োজনের তুলনায় সংখ্যা লঘিঠের কথাও ও অনর্থক বাহিরের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করার কথাও সুপারিশ করেছেন।

পুলিশের ক্ষমতার উৎস সমাজ। আর সামাজিক কৃষ্টি ও সভ্যতাকে বাচিয়ে রাখবে পুলিশ। যেহেতু সমাজকে বাচাতে হলে অসামাজিক কার্যকালাপ বন্ধ করতেই হবে তাই অসামাজিক দমনের পুলিশের শক্তির প্রয়োজন। সে শক্তির অপচয় হলে পুলিশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে, কিন্তু সমাজ তার সুনির্দিষ্ট পথে এগোবে। হয়ত সমাজের সৃষ্ট সভ্যতা, মানিবিক মূল্যবোধ দুর্ভিক্ষ হতে পারে। আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সময় পুলিশ বলিষ্ঠ হয়ে সেটা প্রতিরোধ করুক এটা সমাজের কাম্য। এই প্রতিরোধ শক্তির জন্যই একদিন অবস্থান গুলো শান্তির আলয় হিসাবে চিহ্নিত হবে বলে আশা করা যায়।

ইতিহাসঃ পুলিশ বাহিনী

স্বাধীনতা কে নিজের খুশি মত ব্যবহার করতে চায়, তখনই পুলিশ ও সমাজের মানুসের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। রোমের সম্রাট অগাস্টাসের (৬৩ খ্রিস্টাব্দের পর্যন্ত) সময় পুলিশ বিভাগকে আলাদা একটা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত কতা হয়। সম্রাটের উত্তরাধিকারীরা শাসনের নামে জুলুম করার জন্য পুলিশ কে ব্যবহার করত। শুনাম ও দূর্নামের পালা অনেক ভারী হবার পর ৭৪২ থেকে ৮১৫ খ্রিষ্টাব্দ সম্রাট সারলামেন্তের সময় পুলিশ বিভাগের কিছুটা প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও সম্রাটের রাষ্ট্রিয় নীতি যখন নির্যাতন শাসনে পরিনত হয়, তখন পুলিশও পুতুলের মতন সম্রাটের হাতের ক্রিয়ানক হিসাবে ব্যবহারিত হয়েছে।

প্রাচীন গ্রিকেরা শহরকে পুলিশ, শাসনতন্ত্রকে পলিটিয়া নাগরিককে পুলাইটস এবং ল্যাটিন নীতিমালাকে পলিটিয়া বলত। তা হলে অর্থের দিক থেকে শহর, নাগরিক, শ্বাসনতন্ত্র অথবা কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালাই হবে পুলিশ শব্দের আদিরূপ।

পুলিশ শব্দের অর্থ যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন কাজের পরিধি ও প্রকৃতি পুলিশকে এমন পর্যায়ে দাড়  করিয়েছে যে, পুলিশ অর্থই ভয়ংকর অত্যাচারের একটি বিভাগ বিশেষ। কারণ বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, পুলিশের কার্য পদ্ধতি মানুসের স্বাধীনতা হরণ নয় কিন্তু সমাজের মানুস

ইংল্যান্ডঃ পুলিশ ইতিহাসের দিক থেকে বৃটেনে প্রথম এডওয়ার্ড (১২৮৫ খ্রীঃ) লন্ডনে শান্তি রক্ষার জন্য ওয়ার এন্ড ওয়ার্ড বিভাগ খোলেন। পর্যায় ক্রমে ১৫৮৫ সালে প্রথম পুলিশ আইন পাশ করা হয়। ১৭৩৭ সালে কিছুটা রদ বদল করা হয়। ১৭৭৭ সালে আরোও সংস্কার সাধিত হয়। বিশ্বকোষে বর্ণিত কথার উদ্ধৃতি তে দিলে তৎকালীন লন্ডন শহরে অপরাধের দিক থেকে কত ভয়াবহ ছিল তাও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐ সময়ে লন্ডন ও সমস্ত দেশের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ পর্যায়ে আসে, অপরাধ বেড়ে যায়, দস্যুরা রাস্ত্যায় একটা ভয়ংকর ভীতির সৃষ্টি করে। ঐ সময় রাস্তায় চলাফেরা নিরাপদ ছিল না। শীদের চুরি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। জল দস্যুরা টেমস নদীতে পায়কারি হারে দস্যুতা চালিয়ে যায়। নিযুক্ত প্রহরিরা ঘুষের বিনিময়ে অপরাধী ব্যক্তির সাথে যোগসাযোশ করে এহেন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

পরবর্তি পর্যায়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ আকার ধারণ করে। উনবিংশ শতাব্দিতে প্রতি ২২ জন লোকের মধ্যে ১ জন ছিল ক্রিমিনাল। জেলার প্রতি ১৫ বর্গ মাইলে ৩ জন কন্সটবল দিয়ে পাহারা কাজ চালানো হচ্ছিল। চোরেরা নাকি রাস্তার মোরে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত। অস্ত্রের মুখে পথিকের সর্বস্ব লুট করে নিত। এহেন অবস্থা যখন বিরাজ করছে তখনও কোন পাহাড়া বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করে জনগণ আত্নরক্ষা করার যোগ্যতা ও চোরের দয়ার উপর নির্ভর করে সমাজের লোক হিসাবে বসবাস করছিল। আরও দেখা যায়, সর্বসস লিন্ঠিত হবার পরেও ডাকাতদের সাথে আপোষ মিমাংসা করতে হত। জনগনোকে কিছু টাকা দিলে লুণ্ঠিত দ্রব্যের কিছু অংশ ফেরত দিত। ডাকাতের বিরুদ্ধে কোন মামলা ঋজু করাতে পারত না।

১৮২৯ সাল রবার্ট পিল পুলিশ বিভাগের সংস্কার করেন। লন্ডনে নাকি তখন ৮০০০ গৃহে চোরাই মাল রাখা হতো। চুরি ডাকাতিতে জন সাধারণের প্রায় ২০ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি হাত ছাড়া হয়ে গিয়েছিল। প্রায় ৩০ হাজার লোক চুরি ডাকাতিতে লিপ্ত ছিল। থিমস এর ৫০০০ লোক অপরাধী পরিবেশে থেকে অপরাধে লিপ্ত হয়।

রবার্ট পিলের সংস্কারের বিরিদ্ধে তখন কার মানুস সচ্চার হয়ে উঠেছিল সরকারী অত্যাচারের হাতিয়ার হিসাবে পুলিশকে ব্যবহার করবে ও মানুসকে দাশে পরিণত করবে এই ছিল অনেকের আশঙ্কা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৩৩ সালে পুলিশ ও জনসাধারণের মধ্যে ডাঙ্গা সৃষ্টি হয়। কিন্তু পুলিশের সে সময়ের নিষ্ঠা পুলিশ বিভাগকে বাচিয়ে রাখে। চুরি ডাকাতি বন্ধ হয় মানুস নিরাপত্তার আশ্বাস পায়।

ওয়ারস্থ রবিদাশ পাড়ায় বাংলা পরবর্তি পর্যায়ে কিভাবে পুলিশের সংস্কার ও প্রয়োজণীয়তা স্বীকৃত হয় তার হিসাব দেয়া হলোঃ –

১। ১৮৩৫ সালে লন্ডন মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন আইন পাশ হয়। বরগুলুতু কন্সটটেবল এর সৃষ্টি হয়।

২। ১৮৮২ সালে সংস্কার আইন পাশ হয়। সেই আইনে পুলিশের সাধারণ কর্তব্য সম্পর্কে একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা রচিত হয়।

৩। ১৮৩৯ ও ১৮৪০ সালের আইন বলে কাউন্টিতে বেতন ভুক্ত পুলিশ সৃষ্টি হয়।

৪। ১৮৫৬ সালের আইনে ইংল্যান্ডে ও ওয়েলসে অপরাধ দমন ও তদন্তের জন্য পুলিশ বাহিনী সৃহশটি হয়।

৫। ১৮৫৭ সালের আইনে স্কটল্যান্ডেও পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি হয়।

৬। ১৮৬২ সালের আইনে স্কটল্যান্ডের বড় পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়।

৭। আয়ারল্যান্ড ও ডাব্লিনে পুলিশ বাহিন্মীর সৃষ্টি হওয়ার মূলে ছিল ১৮০৮ সালের আইন ও ১৮২৯ সালের রবার্ট পিলের সংশোধনি আইন।

৮। ১৮৩৬ সালে পুলিশ ও বিচারক বিভাগের মধ্যে বিভাগীয় কর্তব্যের সীমারেখা টেনে দেওয়া হয়।

এমনি করে পুলিশ নিজের সত্তা ও স্বীকৃত নিয়ে প্রতিষ্টিত হয়।

ফ্রান্সঃ ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই এর আমল থেকে পুলিশকে জুলুমের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু রাষ্ট্রের কাঠামোর সঙ্গে পুলিশের কার্যকালাপ সীমাবদ্ধ তাই ত্বাত্বিক দিক থেকে  রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিবর্তনের সঙ্গে পুলিশের কার্য পদ্ধতি ও আদর্শ জড়িত। রাষ্ট্রের মূখ্য উদ্দেশ্য, গৌণ উদ্দেশ্য ও চূড়ান্ত উদ্দেশ্য সঙ্গে সঙ্ঘতি বিধান করে যে আইন সৃষ্টি হবে বা প্রথার নির্দেশ থাকবে তাকে বলবত করা হচ্ছে পুলিশের কাজ। যে পুলিশকে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, তাকে কার্য নির্বাহ পদ্ধতিতে কোন হেরফের হয় না। রাষ্ট্রের প্রথম কাজ নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করা। সেকাজে নিয়োজিত রয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি ও শ্রংখলা রক্ষার পুলিশের কাজ দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সার্বজনীন কল্যাণ সাধন ও শেষ বা চূড়ান্ত উদ্দ্যেশ মানব স্বত্তাকে বিকাশ বা বিশ্বজনীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম। এ সব মূল উদ্দেশ্য হতে বিচ্যুতি সৈরাচার বা ফ্রান্সের ২য় সাম্রাজ্যের শাসন আমলে প্রচলিত ছিল। তাই পুলিশের কার্যাকালাপের ফলশ্রিতি হিসাবে সুনাম ভূলন্ঠিত হচ্ছে।

ফ্রান্সে সংক্ষিপ্তভাবে পুলিশের ইতিহাস হলোঃ –

১। ১৬৯৭ সালে একট অব ডাইরেক্টরী পাশ হয়, তাতে পুলিশ আলাদা মন্ত্রণালয়ের কর্তৃতাধীনে আসে।

২। ১৮১৮ সালে আরো সংশোধনীতে পুলিশ স্বাধীন বিভাগে পরিণত হয়।

৩। ১৮৫২ সালে পুলিশ বিভাগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় আসে।

৪। পুলিশ কার্য পদ্ধতি অনুসারে দুটি বিভাগ ভাগ করা হয়ঃ –

(ক) প্রশান্সনিক পুলিশ ও সক্রিয় পুলিশ। তাছাড়াও ছটি কেন্দ্রীয় ব্রিগেড সৃষ্টি করা হয়। তাদের মধ্যে অবসর প্রাপ্ত চতুর ও সুদক্ষ সৈন্য ছিল বেশী। তারা কুচকাওয়াজে খুবই পটু ছিল। উৎকৃষ্ট মানের পোষাক পচিচ্ছদ ব্যবহার করতেন। প্যারিসের লোকেরা তাদের বলত ভাইসু অর্থাৎ জাহাজ, যেহেতু তারা কলার ব্যাজে পুরাতন জাহাজের প্রতিকৃতি ব্যবহার করত। গীয়েন্দা পুলিশের নাম ছিল এন বুর্জ পুলিশ বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের আওতায় এলে কাজের পরিধি বেড়ে গেল। সরাইখানা পরিদর্শন ও মানুসের নৈতিকতার উপর ও কর্তৃত্ব করার সুযোগ পেল। ব্রিটেনিকা বিশ্বকোষের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায় পুলিশের কর্তব্য হচ্ছেঃ –

১। আইনের প্রতি আনুগত্য পরিদর্শন।

২। সরকারী আইনের বরখেলাপকারীদের সঙ্গে মোকাবিলা করা।

৩। অপরাধ অনুসন্ধান, অপরাধী ব্যক্তিকে খোঁজ করে বের করা ও গ্রেফতার করা।

৪। আইন শৃংখলা বজায় রাখা।

৫। সম্মানিত ব্যক্তির সম্মান রক্ষা করা।

৬। দাঙ্গা হাংগামা প্রতিরোধ করা।

৭। সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হাজার এক বিধি নিষেধ অমান্য কারী রাস্তার মিছিল বন্ধ করা।

এমনি করে পুলিশ সরকারের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিতে রূপান্তরিত হয়।

আমেরিকাঃ ১৬২০ সালে ১০১ জন যাত্রী নিয়ে ‘মে ফ্লাওয়ার’ জাহাজটি আমেরিকায় যায়। এ সাত্রীদল ইংল্যান্ডেরই বাসিন্দা কিন্তু দেশ ত্যাগি বর্তমান আমেরিকা বাসীর পূর্ব পুরুষ। সে দেশে পুলিশের গোড়া পত্তন হয় ১৭৪৪ সালে নিউইয়র্ক শহরে পরে অন্যান্য রাষ্ট্রেও আইন করে পুলিশ স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অবশ্য পোষাকধারী পুলিশের বিরুধে জনমতও গড়ে উঠে। সমালোচনার ঝড় প্রবাহিত হয়। কারণ তারা পুলিশকে মনে করেছিল অ-গবতান্ত্রিক ও আমেরিকার জন সাধারণের রীতিনীতি বিরুধে প্রতিষ্ঠান।

ভারতবর্ষঃ সমগ্র ভারতে শাসনতান্ত্রীক ঐতিহাসিক চিত্রের ভিত্তি হচ্ছেঃ জাতকের কৌট্যিলের অর্থসাস্ত্র মনুর আইন। ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাং এর ভ্রমণ বর্ণনা আর তদানিন্তন সম্রাটদের রেখে যাওয়া প্রস্তর ফলক। জেমস এইচ জেমস ভারতের ইতিহাস গ্রন্থের এক জায়গায় লিখেছেন, তদানিন্তন ভারতের গ্রাম গুলোতে গ্রামীণ পরিদর্শকেরা শাসন কার্য চালাতেন। অবশ্য রাজা যুদ্ধ কালে গ্রাম রক্ষা করতেন আর শান্তির সময় খাজনা আদায় করতেন। তাছাড়া গ্রামীণ পরিদর্শকের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতেন না। এই গ্রামীণ মাতব্বেরা ন্যায় দণদের প্রতিক। বিচার শাসন তাদের হাতেই ছিল।

খীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে লিখিত জাতকে গণ পিটনীর একটা নজির আছে। বর্তমানে রাজপথে সার্ন্দর্ধ ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার যে দৃশ্য প্রাচীন ভারতে পিটিয়ে হত্যা করত না তবে ভপ্ররকতা করে গৃহ থেকে বাহির করে দিত।

কথিত আছে, গ্রামীণ আইন কর্তা কোন একটা অপরাধ করে এবং হাতেনাতে ধরা পড়ে। সে গ্রামের পরিদর্শক বলে নিজেকে পরিচয় দেয় কিন্তু তাকে পিটিয়ে জেলির মত করে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়। ছয় অনুতার আইনের কথা লিখেন ৫০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে। তার মতে তদানিন্তন রাজার কর্তব্য ছিল আক্রমণ প্রতিহত করা। অপরাধীকে শাস্তি দেয়া, পাহাড়া নিযুক্ত করা এবং রাজ্যের হাল হকিকত সম্পর্কে গোপন খবর নেয়া। কৌটিন্যের অর্থসাস্ত্র ৩০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে লেখা।

তার মতে, রাজারা গোপন সূত্রে খবর নিয়ে যে কোন ভায়োলেন্সের মোকাবেকা করতেন। এ ধরণের গুপ্ত সংবাদ সরবরাহের ব্যাপারে ন’ধরণের সংস্থা কৌটিল্য উল্লেখ করেছেন।

ফা হিয়েন গুপ্ত সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির কথা হিয়েন সাং লিখেছেন রাজা হর্ষ বর্ধন রাজ্য শাসনের কথা। তবে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্য নেই। হিয়েন সাং তার যাত্রা পথে দুবার দস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন।

আরব খলিফা উমরের সময় প্রথম নৈশ্য পাহারার ব্যবস্থ্যা করা হয়। এ পাহাড়াদার দের বলা হত ‘আল হের দাস’। খলিফা আলীর সময়ে নগর পাহাড়াওয়ালাকে বলত সূরতাহা আর প্রধানকে বলা হত ‘সাহাবী উস সূর তাহা’। এ সূরতাইরা বাজার হাহারা ও জিনিস কেনা বেচার সময় ওজন দেয়ার পদ্ধতি পরদর্শন করতেন। উমাইয়াদের সময়ে ঐ পুলিশ প্রথা প্রচলিত ছিল তবে সে আমলে বলা হত ‘হেরদাস’। সে সময়ে পুলিশের কাজের সীমা পরিবর্ধিত করে আধা সামরিক কার্যাকালাপে নিয়জিত হতে লাগল। আব্বাসীয় আমলে আবার পুলিশের নাম বদলিয়ে ‘সুরতাহ’ রাখা হয়। এবার পুলিশের ক্ষমতা আরোও বেড়ে গেল। পুলিশ প্রধান প্রায় মন্ত্রীর পদ মর্যাদা সম্পন্ন্য হয়। খলিফার দেহ রক্ষী ও মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী ফাসি দেয়া পর্যন্ত পুলিশের কাজের আওতায় এসে যায়। অপরাধ তদন্ত করে শুধু রায় দিতেন না। রায় দেবার মালিক কাজী। অপরাধ তদন্ত শেষে পুলিশ স্বাক্ষ্য প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত হলে দোষী ঘোষণাও করতে পারতেন। দোষী সাব্যস্তের ব্যাপারে আষামীর স্বীকারোক্তি আদায়ে পুলিশ জুলুমওম করত। যেতাকে বলা যায় তৃতিয় পদ্ধতি। আব্বাসীয় আমালে এক ধরণের পুলিশের উল্লেখ আছে, যাদের বলা হয় ‘মোহ তাসিব’। তারা সমাজের কর্মী ও রাস্তার ফকির তারাত, ঔষুধের ব্যবস্থা দেখা শোনা করত, রাস্ত্যার কেও জোর দখল করলে উঠিয়ে দিত, দাশ দাশীর প্রতি মালিকের ভালো ব্যবহারে বাধ্য করত। নামাজ পড়ে কিনা দেখত। মদ জুয়া আফিম যাতে লোকেরা না খায় তা দেখা শোনা করত।

ভারতের মুসলিম শাসনঃ পুলিশের ভূমিকা ৭১২ খীষ্টাব্দ

ইমাদ উদ্দিন মোহাম্মাদ বিন কাশেম সিন্ধু জয় করে ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত করেন। কিন্তু ৭১২  থেকে ১২০৬ প্রায় ৫০০ বছর মুসলিম শাসনের কোন নিশানা পাওয়া যায় না। শাসন তান্ত্রিক প্রথম প্রশাসক কুতুব উদ্দিন আইবেক। তা সত্ত্বেও বলবন ছিলেন ডাকাতি রাহাজানি বন্ধ করে জনগনের নিরাপত্তা বিধানে প্রথম  উৎসাহী শাসক। ১২৬৬ থেকে ১২৮৬ সাল পর্যন্ত তার রাজত্ব কায়েম থাকে। পরবর্তি ১৫২৬ থেকে ১৮৫৮ পর্যন্ত মোঘল আমল বলে ইতিহাসে চিহ্নিত।

শের শাহের আমলে গ্রামীণ পরিষদের চেয়ারম্যান কে মোকাদ্দেম বলা হত। তাদের সীমানায় চুরি ডাকাতি বন্ধ করাই হলো প্রধান কাজ। এই প্রথম পুলিশ নিয়ন্ত্রণ আইন পাশ করা হয়। ব্যতিক্রম হচ্ছে মোকাদ্দেম এতো দায়িত্ব প্রাপ্ত পদ ছিল, যদি তার এলাকায় কেও চুরি ডাকাতিতে ক্ষতিগ্রস্থ লোককে ক্ষতি পূরণ দিতে হত। মোঘল আমলে পুলিশের কর্তৃত্ব সীমা আরও বর্ধিত হয়। তখনকার সময়ে ৩ ধরণের নামের সাথে পরিচিতঃ

১। কোতয়াল

২। ফোজদার

৩। সিকদার

কোতয়াল শব্দের সঠিক অর্থ নিয়ে কিছুটা ম্নতবিরোধ আছে, কারোও মতে কোতয়াল হিন্দি শব্দ, তার মূল শব্দ হচ্ছে ‘কোত’ অর্থাৎ দূর্গ। তাহলে কোতয়াল হচ্ছে দূর্গ রক্ষক। আবার কেও কেও বলেন, কোত হলো বন্দুকের সারী, তাহলে কোতয়াল মানে বন্ধুক স্তুপ রাখা এখনও পাক ভারত বাংলাদেশের শহরে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত থানা গুলোর নাম কোতয়ালী। সে কালে কোতয়াল খুবই সম্মানীত পদ ছিল। সম্রাট নিজেই দিলির কোতয়াল নিয়োগ করতেন। প্রধান লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, কোতয়াল শুধু শান্তী রক্ষক, পাহাড়াদার নয়, বিচারক ও তার অধীনের সোয়ার (ঘোড়া আরহী স্বর্ণ) ভরকন্দাজ থাকত। কোতয়ালের বিচারালয় ছিল, যাকে বলা হতো, ‘চাবুত্র’। অর্থের দিক থেকে চাবুত্র ঊচু স্থান, শব্দটি হিন্দি। কোতয়ালের কার্য কালাপ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যের উল্লেখ আছে আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি, ক্যামার ফেয়ার, কাফি খান রচিত পুস্তাকাদীতে। সব তথ্য গুলো সংক্কগিপ্ত করে দেখা যায় কোতয়াল নিম্ন লিখিত কার্যাদি সম্পাদন করতেনঃ

১। শহরের পাহারা দেয়া, খেয়া ঘাট পরিদর্শন করা।

২। অপরাধ তদন্ত ও দমন কাজ।

৩। স্থানীয় লোকের নামে একটা খতিয়ান লেখা, দুষ্ট লোকের গতিবিধি লক্ষ্য করা।

৪। পান্থশালা গুল পরিদর্শন করা।

৫। ভ্রুণ হত্যা ও সতিদাহ বন্ধ করা।

৬। বেশ্যালয় গুলো পরিদর্শন করা।

৭। বেওয়ারীশ সম্পত্তি দেখাশোনা করা।

৮। অগ্নী নির্বাপন করা।

৭৯। মদ্য তৈয়ারী বন্ধ করা।

১০। ঠগী (প্রতারক) খুজে বের করা।

১১। শুল্ক পরিদর্শন করা, বাজার দর নিয়ন্ত্রণ, বেওরীশ লাশের সৎকার করা, হারানো  ব্যক্তির সম্পত্তির লিস্ট করা, রাজপথে শিশু হত্যা বন্ধ করা, রাজকোষ পাহারা দেয়া।

প্রকৃতিপক্ষে কোতয়াল পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা কাজীর অধীনে কাজ করতেন। মামলার বিচার ও কঠর শাস্তিযোগ্য মামলাগুলো কাজীর দরবারে পাঠাতেন। কোতয়ালের অনেক টাকা বেতন ছিল। ছোট খাটো শহরে কোতয়ালের সম পর্যায়ের ব্যক্তি ছিলেন শিকদার। অনেক সময় শিকদার যদিও রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা, তবুও অপরাধ দমন ও বিচারের ব্যাপারে ফৌজদার বা কোতয়ালের কর্তব্য পালন করতে হত।

শহর যেমন কোতয়াল গ্রামে ছিলেন ফৌজদার। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সময় পাঠাম সেনারা এ পদেই নিযুক্ত হতেন। তারা অপরাধ দমর কাজে ব্যপৃত ছিলেন। এখনও এ ফৌজদারদের নাম অনুসারে দেশে প্রচলিত আইনকে ফৌজদারী আইন ও কার্যবিধি বলা হচ্ছে।

ফৌজদারের অধীনে গ্রাম পর্যায়ে এক শ্রেণীর লোক নিয়গ করা হত, তাদের বেতন দেয়া যখন জনসাধাররণের সংগৃহীত অর্থ থেকে। তারাই হচ্ছে চৌকিদার। আর ফৌজদারে ঘৌড় সওড়ার সৈন্যরা হচ্ছে বরকন্দাজ। এদের সাহায্য করত ছোট ছোট বিভক্ত সংস্থা যেমনঃ –

থানা, আর এ থানার অফিসারকে বলা হত থানাদার, বর্তমানে অফিসার-ইন-চার্জ।

পুলিশ শক্তি (১৯৭৪)

সর্বমোট সংখ্যা ৫১,৬৯৩

পুলিশ সুপারিটেনডেন্ট – ৮৫

সহকারী সুঃ – ১৬৯

ইনস্পেকটর – ৫৯৫

সাব ইন্সপেক্টর – ৩৯৬০

সার্জেন্ট – ৯৭

সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর – ১৯০৫

হাবিলিদার – ২৪২৬

নায়েক – ১৫০১

কনস্টেবল – ৪০,৯৫৫

বাংলাদেশের প্রাচীন পুলিশ

মৌর্য আমলে এ দেশ সরাসরি সম্রাটেরা শাসন করতেন না, কোন প্রতিনিধি দিয়ে শাসন চালাতেন তার কোন সঠিক তথ্য নেই। তবে অশোকের শাসনামলে সরকারী খাদ্য গুদাম ও কৌটিল্য অর্থসাস্ত্রে উল্লেখিত সরকারী খাদ্য সংরক্ষণ সম্পাদক কর্তৃক উৎপাদিত খাদ্য শস্যের অর্ধেক জরুরী অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য রক্ষিত থাকত। দুর্ভিক্ষ বা অন্যান্য নৈসর্গিক পরিস্থিতি আয়ত্তে আনায় এ সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য। তৎকালীন সরকার জনসাধারণের সুখ সুবিধা বিধান করার কার্যে  লিপ্ত ছিল। তবে শাসন কার্য সুবিধার জন্য সারা দেশকে কয়েক টি শাসন তান্ত্রিক এলাকায় বিভক্ত করে নিয়েছিলেন। ঐ সমস্ত এলাকাকে ভুক্তি বলা হত। আধুনিক কালে আমরা সেটাকে বিভাগ বলি। ভুক্তি আবার বিশ্ব মন্ডল ভীতি ও গ্রামে বিভক্ত ছিল। বিশ্বকে বর্তমানে জেলা পর্যায়ে চিহ্নিত। ভুক্তির শাসক ছিল গভার্নর। প্রত্যেক বিভাগের উপ-বিভাগে অধিকর্ন অফিস ছিল। অধিকর্ণীয়া কি কাজ করত সে বিষয়ে বিষদ কোন বর্ননা নেই। তবে দামাদোর পুরের ফলক চিহ্নের লিখিত তথ্য থেকে বীঝা যাই, অধিকোর্নিয়া রা শহরে থাকত এবং তার সহকর্মী আরও ৪ জন ছিল। একজন টাউন কর্পরেশন বা ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, দ্বিতিয় জন বণিক সম্প্রদায়ের সভাপতি, একজন প্রকোশলী চতুর্থ জন সেক্রেটারী। তার উপাধি ছিল ‘প্রথম কায়স্থা’।

অধিকর্ণের সংগে উল্লেখিত সভাপতির সম্পর্ক কি ছিল এবং তাদেরকে কি ভাবে নিয়োগ করতেন তারো কোন সঠিক তথ্য নেই। তবে নারদ ও বৃহস্পতি ধর্ম সূত্রে থেকে আচ করা যায়, উক্ত সভাপতিরা নির্বাচনের মাধ্যমে পদাধিকার পেতেন।

গ্রাম পর্যায়ে গ্রামীক এবং ক্ষুদ্র সমাজের মহাতারাস এরাই জনস্বার্থ এবং শাসন কার্যে সংযুক্ত ছিল। এখনও গ্রামের বৃদ্ধকে মোড়ল বা মাতুব্বর বলে। মাতুব্বর আসলে আর্বি শব্দ শুতাবার অর্থাৎ বিশ্বাসী লোক, সুনাম যার আছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মাতব্বর আরবি শব্দ নয় বরং মহাতারো বর থেকে অপ্রভংশ হয়ে মাতব্বর হয়েছে। সে তর্কে অবতীর্ণ না হয়ে আমরা মোটামুটি ধারনা করতে পারি গ্রামে শাসন গ্রামের মাতব্বর রা করত্রেন।

গুপ্ত পরবর্তিকালে দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলায় স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। এবং শাসন বিভাগের কিছু কিছু পরিবরতন আছে কিন্তু বিশকপতি বা জেলা প্রশাসক সরাসরিভাবে রাজা নিজেই  নিয়োগ করতেন। তব এওনেক ক্ষেত্রেই গভর্নরও জেলা প্রশাসক নিয়োগ করতেন।

পাল শাসনামলে প্রায় ৪০০ বছর বাংলায় স্থানীয় সরকার কায়েম হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার শক্তিশালী ছিল এবং পাল বংসের শাসন কালে প্রথম কেন্দ্রিয় পরিচালক পদের সৃষ্টি হয়। আধুনিক কালে যে পদ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পরিচিত তবে কালিম্পুর পাল স্মৃতি ফলকে যে মন্ত্রীর উল্লেখ আছে তাকেই প্রধান মন্ত্রী বা সচিব বলা হয়েছে।

গুপ্ত ও পাল শাসনামলে আমরা গ্রাম ভিত্তিক সমাজের সন্ধান পাচ্ছি আবার শাসনের দিক থেকে রাজ তন্ত্র এবং তাও উত্তরাধিকার সূত্রবলে প্রচলিত। স্মৃতি ফলকে প্রাপ্ত সূত্রে দেখা যায়, যে তখনকার রাজা বা সম্রাট শুধু ধর্মকে অবমল্বন করে রাজ্য শাসন করেন নি বরং রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মিয় ও নৈতিক ব্যাপারে সর্ব বিদ কল্যাণের উপর ভিত্তি করে রাজ্য শাসন প্রণালী প্রতিষ্ঠিত।

তখনকার পুলিশের কি ভূমিকা ছিল, তা সঠিক করে বলা যায় না। তবে কাজের উপর নির্ভর করে যদি শাসন কার্যের বিভাগ হুলো সৃষ্টি হয়ে তাহকে আমরা দৃঢতার সাথে বলতে পারি ভোগ প্রতি যে সব কর আদায় ক্করতেন তা শুধু চুরি ডাকাতি হতে গ্রাম বাসীদের রক্ষা করার অভিপ্রায়ে। দশপ্রদ শব্দের অর্থ হবে ফৈজদারী অপরাধের জরিমাণা মহাকশ্ব পাটালিকা প্রধান হিসাব রক্ষক বরতমানে এ জিপি। পুলিশ বিভাগে তেমনি অনেক অফিসারের উল্লেখ আছে যেমনঃ মহা প্রতিহার দন্দিক দন্দ প্রশিকা ও দন্দ শক্তি কোলা গুপ্তচর প্রধান। প্রথমোক্ত ব্যক্তি মহা প্রতিহার রাজা প্রাসাদের রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল বলে মনে হয়।

পরিশেষে প্রাচীন বাংলার পুলিশ বিভাগ সম্পর্কে রাজা গোপাল চন্দের আমলে তাম্রফল্কে লিখিত অফসারদের নাম তালিকাতে একটি শব্দের উল্লেখ আছে, তা হচ্ছে চোর ধরণিকা। ঐতিহাসিকেরা কেও কেও মনে করেন এ শব্দ পুলিশ বিভাগের কোন ঊর্ধতন কর্মকর্তার পদবী হবে। পাল রাজাদের সময়কার আরেক স্মৃতি ফলকে দশ পরাধিকা শব্দটি কোন অফিসারের স্মৃতি বহন করে যিনি ১০ ধরনের ফৌজদারি অপরাধের জন্য অর্থ দন্ড সংগ্রহ করতেন। উক্ত ফলকে অফিসারদের নাম দেয়া আছে। আরও দেখা গেছে যে, কন্দর্কষ এর অর্থ (আট মগধি অভিধান অনুসারে) কাস্টম ইন্সপেকটির অথবা সুপারিন্ডেন্ট অফ পুলিশ। তেমনি মহাপতিহার অর্থ প্রধান স্থাবর রক্ষক। সে অর্থে পাহাড়া বা স্থার রক্ষক হতে পুলিশ শব্দের সৃষ্টি বলে মনে হয়, প্রাচীন কালের প্রতিহার আধুনিক কালের পুলিশের পূর্ব পুরুষ।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1975.03.07-bichitra-copy.pdf” title=”1975.03.07 bichitra copy”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!