শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৮৭। পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় সর্বসম্মত প্রস্তাবঃ বাংলাদেশকে স্বীকৃত দিন | পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার কার্যবিবরণী | ৮ মে ১৯৭১ |
জনাব স্পিকারঃ আমি এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাবটি পেশ করছি এবং এর পর আমি সবাইকে অনুরোধ করব নিজ নিজ আসন থেকে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের নিহত শহীদদের স্মরণে ২ মিনিট নীরবতা পালন করতে।
শ্রী অজয়কুমার মুখার্জী: স্পীকার মহাশয়, আপনার অনুমতি নিয়ে আমি এই প্রস্তাবটা আনছি।
বিগত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামীলীগ এর অসামান্য ও ঐতিহাসিক সাফল্যর মধ্যে প্রকাশিত জনগণের সুস্পষ্ট রায়কে পদদলিত করিয়া বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র যে নারকীয় গণহত্যাভিযান চালাইতেছে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা তাকে তীব্র ধিক্কার জানাইতেছে এবং বাংলাদেশের জনগণ পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যে মরণপণ সশস্ত্র সংগ্রাম চালাইতেছেন তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও সেই সঙ্গে সংগ্রামী জনগণকে অভিনন্দন জানাইতেছে।
পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র যাহাতে অবিলম্বে এই বর্বর গণহত্যা বন্ধ করিতে এবং বাংলাদেশ হইতে তাহার সমস্ত সামরিক বাহিনী তুলিয়া লইতে বাধ্য হয় তাহার জন্য উপযুক্ত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এই বিধানসভা ভারত সরকারসহ অন্যান্য দেশের সরকারের নিকট আবেদন করিতেছে।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা এই বিশ্বাস রাখে যে, তাহাদের সংগ্রাম যতই কঠোর ও প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হউক না কেন বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ শেষ পর্যন্ত জয় লাভ করিবেনই। এই সভা আর ও আশা রাখে যে, যেহেতু এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম সর্বপ্রকার আধুনিক মরাণাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র কর্তৃক বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে এবং ইহা জাতীয় স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম, সেই হেতু ইহা শুধু ভারতীয় জনগণের নিকট হইতে নহে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের এমনকি পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজ্যের জনগণের নিকট হইতেও ক্রমবর্ধমান সক্রিয় সমর্থন লাভ করিবে।
বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় স্বাধীনতার জন্য মরণপণ সংগ্রামের প্রতি ভারতের আশু ও জরুরি কর্তব্যের কথা বিবেচনা করিয়া এই বিধানসভা ভারত সরকারের নিকট দাবি জানাইতেছে যে, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও তাহার সরকারকে স্বীকৃতি এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় কার্যকরী সাহায্য দিতে হইবে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নরনারী যখন বুকের রক্ত দিতেছেন তখন পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ইহার কমে কিছুতেই রাজী হইতে পারেন না।
এই ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করিতে যতই দেরি হইতেছে ততই বাংলাদেশের জনগণের দু:খ, দুর্গতি ও লাঞ্ছনা বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহাতে পশ্চিম বঙ্গের বিধানসভা ও জনগণ গভীর উদ্বেগ বোধ করিতেছে। এই অবস্থায় যাহাতে অবিলম্বে উক্ত দাবিগুলি স্বীকৃতি হয় তাহার জন্য ভারত সরকারের উপর প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিধানসভা, পশ্চিমবঙ্গের জনগণ সরকারের নিকট আহবান জানাইতেছে।
ব্যাপক নরহত্যার মুখে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ সীমান্ত পার হইয়া পশ্চিম বাংলায় চলিয়া আসিতে বাধ্য হইতেছেন। সৌভ্রাতৃত্বের ও মানবতার অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে তাহাদের জন্য সর্বরকম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা একান্ত দরকার। ইহা পশ্চিমবঙ্গের ও উহার পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির আর্থিক ক্ষমতার বাহিরে। এই কঠিন সত্য বিবেচনা করিয়া পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভারত সরকারের নিকট এই বিষয়ে যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দাবি জানাইতেছে।
মিঃ স্পীকারঃ পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামের জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের সম্মানার্থে সবাইকে দাঁড়িয়ে দু’ মিনিট নীরবতা পালন করবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
[সদস্যরা উঠে দাঁড়ালেন ও ২ মিনিট নীরবতা পালন করলেন]
শ্রী অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়ঃ আমার প্রস্তাবে অতি বিস্তৃতভাবে সবই বলা হয়েছে, আর বলার বেশী কিছু নাই। আপনারা সবাই জানেন যে, পাকিস্তানের দুটি অংশ – পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান – পরস্পর বিচ্ছিন্ন বহু দূরে অবস্থিত। পূর্ব পাকিস্তানের আধিবাসীদের বরাবরই এই অভিযোগ ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়েও পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে সংখ্যায় তারা কম হয়েও পূর্ব পাকিস্তানের উপর প্রভুত্ব করছে, শোষণ করছে। এই অভিযোগ তাদের ছিল। এমনকি, মাতৃভাষা পর্যন্ত বিলোপ করার চেষ্টা করেছে। সেজন্য পূর্ব – পাকিস্তানের বাংলাভাষা নিয়ে সংগ্রাম হয়, অনেক জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে। এবং আনন্দ ও গৌরবের বিষয়, বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি পূর্ব- পাকিস্তানে খুব ভাল হয়েছে।
শ্রী সুবোধ ব্যানার্জিঃ মূখ্যমন্ত্রী মহাশয় পূর্ব পাকিস্তান না বলে বাংলাদেশ বলুন।
শ্রী অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়ঃ আমি তাতে আসছি, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? তারপর ওদের অনেক আন্দোলনের পর সেখানে স্বৈর শাসন পরিসমাপ্তি করার জন্য ঘোষণা করা হয় যে, গণতন্ত্র অনুযায়ী গণভোটে সেখানে সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। যথানিয়মে সেখানে স্বৈরতন্ত্রের নেতৃত্বে গণভোট গৃহীত হল এবং তাতে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ শুধু পূর্ব-বঙ্গে নয় সমস্ত পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেন, কেন্দ্রীয় সরকারে, কেন্দ্রীয় বিধানসভায়, আইনসভায়। সাধারণ গণতন্ত্রের নিয়ম অনুসারে সমস্ত পাকিস্তানে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বসতে দেওয়া উচিৎ ছিল। এবং আইনসভায় কাজ করার এবং মন্ত্রীমন্ডলী গঠন করার সুযোগ দেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা না দিয়ে সেখানে স্বৈরশাসক সেটা জোর করে ভেঙ্গে দিলেন, ভেঙ্গে দিয়ে তিনি চরম অত্যাচার শুরু করলেন।
জনগনের যে সুস্পষ্ট রায় অর্থাৎ তাঁরা যে রকম ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন এ রকম ভোট পৃথিবীতে কে কোথায় পেয়েছে আমার জানা নেই। কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করে যখন জবরদস্তি স্বৈরশাসন চালান হল তখন অগত্যা পূর্ববাংলা স্বাধীনতা ঘোষণা করল। তাঁরা প্রথমে পূর্ণ স্বাধীনতা চাননি তাঁরা চেয়েছিলেন পূর্ববাংলায় পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন এবং সেটা পাকিস্তানের মধ্যে থেকেই। কিন্তু এই অত্যাচারের ফলে তাঁরা পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন এবং তারপর বললেন এটা বাংলাদেশ সরকার। তারপরই ভীষণ অত্যাচার শুরু হল- অর্থাৎ গণহত্যা, নারী নির্যাতন, গৃহদাহ প্রভৃতি অমানুষিক অত্যাচার দিনের পর দিন ধরে চলছে। এই অবস্থায় প্রতিবেশী রাজ্য হিসেবে আমরা চুপ থাকতে পারিনা বিশেষ করে আমাদের সঙ্গে যখন তাঁদের নাড়ীর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের প্রস্তাবে যেকথা বলা হয়েছে আমি তার আর পুনরুল্লেখ করতে চাই না। আমরা ভারত সরকারকে বলছি যত শীঘ্র সম্ভব এই যে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকে স্বীকৃতি দিন এবং তাঁদের সর্বপ্রকার সাহায্য দিন। এই সর্বপ্রকার সাহায্যের মধ্য দিয়ে আমরা অস্ত্রশস্ত্রের কথাও বলেছি। আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার এটা বিবেচনা করে দেখবেন অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা মানে যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে কিনা। কিন্তু আমাদের দাবি অর্থাৎ বিধানসভার দাবি অবিলম্বে তাঁদের সর্বপ্রকার সাহায্য করা হোক। আমরা তাঁদের বীরত্বের জন্য প্রশংসা করেছি। আশ্চর্যের বিষয় একক নেতৃত্বের অধীনে থেকে এ রকমভাবে জনগণের সংগ্রাম করা এটা পৃথিবীতে দুর্লভ। এইজন্যই আমরা তাঁদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছি এবং তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা দেখেছি হিন্দু- মুসলমান মিলে ১২-১৩ লক্ষ লোক এখানে এসছে যাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে, আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে তাদের বসবাস অসম্ভব করে তোলা হয়েছে এবং নিষ্ঠুরভাবে মানুষকে খুন করা হচ্ছে। আপনারা জানেন আমাদের পশ্চিম বাংলা অত্যান্ত জনবহুল। ভারতবর্ষের মধ্যে যে দুটি প্রদেশ বর্তমানে জনবহুল তার মধ্যে একটি হচ্ছে কেরালা এবং আর একটি হচ্ছে আমাদের এই পশ্চিমবাংলা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের এই পশ্চিমবাংলায় আমরা তাঁদের সাদরে আশ্রয় দিচ্ছি এবং তাঁদের বাস করার, থাকা খাওয়ার খরচ যতদূর সম্ভব কেন্দ্রীয় সরকার দিচ্ছেন। আমরা যে খুব ভালভাবে পারছি তা নয়। হঠাৎ দিনের পর দিন যদি হাজার হাজার লোক আসতে থাকে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের আশ্রয় এবং খাওয়া- দাওয়ার ব্যবস্থা করা এটা সম্ভব নয়। কাজেই তাদের হয়ত কষ্ট হচ্ছে। কতদিন এই যুদ্ধ চলবে এবং কত লোক আসবে তার কোন ঠিক নেই। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারকে বলেছি পশ্চিম বাংলায় যত লোক আসবে তাদের দেবার মত স্থান আমাদের নেই অর্থাৎ এমন ভূমি নেই যেখানে তাদের জন্য শিবির তৈরি করতে পারি। কাজেই আমরা তাদের অনুরোধ করেছি আমাদের এখানে ৫ লক্ষ লোকের স্থান রেখে অর্থাৎ ট্রানজিট ক্যাম্পের মত করে তারা যদি অন্যান্যদের অন্য প্রদেশে নিয়ে যান তাহলে ভালো হয়। এটা পশ্চিম বাংলার কথা নয়, এটা সারা ভারতবর্ষের কথা এবং সারা পৃথিবী থেকে তাদের জন্য সাহায্য এবং সহানুভূতি আসছে।
শ্রী জ্যোতি বসুঃ মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়, বাংলাদেশ সম্পর্কে মূখ্যমন্ত্রী যে প্রস্তাব এনেছেন আমি তাকে সমর্থন জানাচ্ছি। সমর্থন জানাতে গিয়ে আমি বলব যে, আমরা সকলে মিলে চেষ্টা করেছি যাতে করে সরকার পক্ষ এবং বিরোধী পক্ষ এক হয়ে এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারি। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয় এটা জানেন যে, আমাদের এখানকার কি মতপার্থক্য আছে। এবং সেটা ভয়ংকর মতপার্থক্য। আমরা যারা বিরোধী দল এখানে আছি কংগ্রেস দলের সঙ্গে এবং তাঁদের যারা সমর্থন করছেন তাঁদের সঙ্গে কোন বিষয়ে আমরা একমত নই। তথাপি এই বিষয়ে যা নিয়ে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে তা আমরা সকলেই সমর্থন করি। এর পাশে এসে দাঁড়াবার জন্য আহবান জানাচ্ছি। এটাকে আমি মনে করি যে এমন একটা বিষয় শুধু পৃথবীর পক্ষে নয়, আমাদের গণতন্ত্রের পক্ষে, আমাদের আগিয়ে যাবার পক্ষে ঐ যে একসঙ্গে হয়ে এইরকম একটা আন্দোলন, সংগ্রাম, লড়াই হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য তাকে যদি জেতাতে না পারি তাহলে আমাদের সমূহ বিপদ, নিজেদের দেশের গণতন্ত্রের হবে- এই জন্যই আমরা চেষ্টা করছি। তাতে যদি আমাদের ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তা আমাদের করতে হবে এবং ঐ বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ তারা নিশ্চয় তাদের বিচার করবেন শুধু এই প্রস্তাব পড়ে নয়, দেখে নয়, ভবিষ্যৎ এই প্রস্তাব কার্যকরী করার জন্য আমরা কি ব্যবস্থা অবলম্বন করেছি। তাই দেখে তাঁরা বুঝবেন যে, আমাদের কি আন্তরিকতা আছে এর পিছনে। এই প্রস্তাব যাতে কাগজের প্রস্তাব না হয়ে থাকে সেই প্রচেষ্টা আমাদের করতে হবে দৃঢ়তার সঙ্গে আমি একথা ঘোষণা করছি যে, এটা শুধু কাগজের প্রস্তাব হবে না এই প্রতিশ্রুতিতেই আমরা একসঙ্গে এই প্রস্তাব গ্রহণ করছি। এই প্রস্তাবকে কার্যকরী করার জন্য আমরা সচেষ্ট হব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি এটা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, অনেক দিন হয়ে গেল প্রায় এক- দেড় মাস হল এই সংগ্রাম বাংলাদেশে হচ্ছে। এইরকম বহু আবেদন নিবেদন ঐ গণতান্ত্রিক মানুষ সমস্ত সরকারের কাছে করেছে যাতে আমরা তাদের সমর্থন জানাই যাতে তাঁদের বিপদের সময় পাশে এসে দাঁড়াই। যাঁরা এই প্রস্তাব সমর্থন করছেন তারা নিশ্চয় এই কথা মনে করেন যে, বাংলাদেশের মানুষ একটা ন্যায়ের লড়াই করছেন, অন্যায় কিছু করছেন না- তাদের দেশকে বাঁচাবার জন্য, বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার জন্য তাঁদের স্বাধীনতা, তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য তারা লড়াই করছেন। এটা সবাই জানেন যে, কিছু কিছু প্রচার হচ্ছে যেটা অন্যায় প্রচার যে, ওখানকার মানুষ যারা আওয়ামীলীগ বা অন্যান্য বাংলাদেশের মানুষ তারা হয়ত পাকিস্তানকে এক অংশ থেকে আর এক অংশে বিচ্ছিন্ন করবার জন্য লড়াই করছে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। আমি লক্ষ্য করেছি অনেক মুসলিম ভাই আছেন যাঁদের মধ্যে এই প্রচার চলেছে যে, পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানকে টুকরোটুকরো করার জন্য এই লড়াই শুরু হয়েছে। এটা একেবারেই ঠিক নয়, তা আমরা এই প্রস্তাবে রাখবার চেষ্টা করেছি। এটা আমরা জানি পৃথিবীকেও জানতে হবে যে, এই পাকিস্তান টুকরোটুকরো হচ্ছে সাময়িকভাবে তার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী হচ্ছে ওখানকার মিলিটারি শাসকগোষ্ঠী ঐ ইয়াহিয়া গোষ্ঠী। বহুদিন ধরে তারা এইরকম করছে। তারা মিলিটারি শাসন চালাচ্ছে। তারা গণতন্ত্রকে মেনে নিতে চায় না এবং এই জন্যই পাকিস্তান টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
কারণ একটা অংশ এবং তারাই হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেই অংশের মানুষের সামান্যতম অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার, তাদের ভাষার অধিকার, তাদের অন্যান্য যেসব বিষয়ে অধিকার আছে সেগুলি যদি না মানেন ২৩৪ কোন সরকার – স্বৈরাচারী সরকার, সেই শাসকগোষ্ঠী, যারা সেখানে মুষ্টিমেয়র প্রতিনিধিত্ব করছেন তাহলে এটা কি আশা করা যায় যে, এক হয়ে সে দেশ এইভাবে থাকতে পারে। সেজন্য আমরা মনে করি যে, পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষ যতই তাঁরা এই ঘটনা বুঝবেন ততই বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামকে তাঁরা সমর্থন করবেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ সহ। পশ্চিম পাকিস্তানেও আজ বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ আছে, বিভিন্ন ইউনিট সেখানে আছে এবং তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মানুষও আছেন। আজ হয়ত তাদের দু’চারজন এর ক্ষীণ কণ্ঠস্বর বা তাদের কথা আমরা শুনেছি। তাঁদের বক্তব্য আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক মানুষ যাঁরা আছেন তারা বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে আগের দিনে যেমন বহু লড়াই করবার চেষ্টা করেছেন তাঁরা তা করবার চেষ্টা করবেন। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণ, তাঁরা সবাই ভুট্টো নন, ইয়াহিয়া নন বা সবাই মিলিটারি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নন, তাঁরা সাধারণ মানুষ – মজুর, কৃষক, মধ্যবিত্ত, মেহনতি মানুষ তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষের এই স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন করবেন, পৃথিবীর গণতান্ত্রিক মানুষের সঙ্গে এক হয়ে। এ থেকে আমাদেরও কিছু শিক্ষার আছে। অনেক সময় আমরা দেখেছি, পৃথিবীতে এটা হয়েছে, এটা নতুন নয়, দু:খজনক হলেও এ ঘটনা ঘটেছে যে, পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোট বা জনমত পদদলিত হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের মানুষ রায় দিয়ে যা চাইলেন তাঁরা তা পাননি। কারণ শাসকগোষ্ঠী, ঐ শাসকগোষ্ঠী, যারা জমিদারদের প্রতিনিধিত্ব করে, পুঁজিপতিদের প্রতিনিধিত্ব করে যা মুষ্ঠিমেয় লোকের প্রতিনিধিত্ব করে তারা তা করতে দেয়নি। ইতিহাসে আমরা দেখেছি জনমতকে তারা পদদলিত করেছে। এখানেই সেই একই ঘটনার পুনারাবৃতি আমরা দেখতে পেলাম, বিশেষ করে পাকিস্তানে যা যা ঘটছে তার মধ্যে দিয়ে। সেখানে জনমত সুস্পষ্ট। এটা মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় ঠিকই বলেছেন যে, এ রকম রায়, এত সংখ্যায়, এ সংসদীয় গণতন্ত্রে খুব কমই দেখা যায় তারা যে সুস্পষ্ট রায় দিয়েছেন তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই, তথাপি আমরা দেখেছি যে, সমস্ত কিছু পদদলিত হয়ে গেল। শুধু পদদলিত হল না সেখানে মিলিটারির অতর্কিত আক্রমণ হলো, আকাশপথ, স্থলপথে, সমুদ্রপথে বিভিন্ন দিক থেকে সে আক্রমণ সেখানে শুরু হল তখন আর কোন উপায় ছিল না, বাংলাদেশের মানুষ, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আর কোন পথ ছিলনা, সেই জন্যই সেখানে তাঁদের স্বাধীনতার লড়াই, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই সব এক হয়ে মিশে গিয়েছে। এ ছাড়া অন্য কোন পথ তাঁরা নিতে পারতেন না, অন্য কোন দিকে ও যেতে পারতেন না। এইভাবে কোণঠাসা হয়ে। তাছাড়া তাঁরা প্রস্তুতও ছিলেন না এটা সুস্পষ্ট, তাঁদের নেতৃবৃন্দরা ও মনে করতে পারেন নি যে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। সেজন্য তারা প্রস্তুত ও ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বারবার এ জিনিস দেখি- আমরা মার্ক্সবাদীরা একথা বারবার বলেছি যে, সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণ থেকে আক্রমণ আসে না, আক্রমণ আসে শাসকগোষ্ঠী থেকে, যারা মুষ্টিমেয়র প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশেও সেই একই জিনিস ঘটছে, এখানেও আমরা মিলিটারির আক্রমণ দেখতে পাচ্ছি। জানি না, কত সংখ্যক মানুষ – নরনারী, শিশু, বৃদ্ধ, যুবক সেখানে জীবন দিয়েছেন, এর কোন হিসেব নিকাশ পাওয়া যাচ্ছে না এমন কি বর্ডার পেরিয়ে যারা এখানে আস্তে পেরেছেন এবং এখানে এসে বিবৃতি দিয়ে বা আলোচনা করে যা বলেছেন তাতেও তাঁরা সবটা যে জানেন তা নয়। কিন্তু তার ভয়াবহতা ওরা নিজেরা দেখে এসেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তারা এসেছেন। আমাদের সঙ্গে তাদের আলোচনায় তারা যে বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, কি ধরনের নারকীয় ঘটনা সেখানে ঘটেছে এবং এই অবস্থার মধ্যে পাকিস্তানের যে শাসকগোষ্ঠী, মিলিটারিতে যে গোষ্ঠী আছেন তারা মনে করছেন যে, তার জয়ী হয়েছেন। তবে হ্যাঁ, কিছু স্থান এখানে ওখানে তারা পুনর্দখল করেছেন। যারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন তাদের পক্ষ থেকে এখনও সেখানে আছেন। সেজন্য তারা জানেন যে, শুধু মিলিটারি কোন সলিউশন নয়। সে সমাধান শুধু মিলিটারি দিয়ে হবে না, এটা সেই মিলিটারি গোষ্ঠী ভালো করে জানেন। একটা জাতিকে মিলিটারি দিয়ে পিষে মারা যায়, শ্মশানে পরিণত করা যায়। কিন্তু আজ না হয় কাল আবার যখন সেখানে মানুষের উত্থান হবে তখন সেই মিলিটারিকে তারা খতম করবে, এটাও। সেই মিলিটারি গোষ্ঠী, যারা সেখানে শাসন চালাচ্ছে তারা জানে। সেজন্য তারা কি চেষ্টা করছে? আমরা দেখছি যে, তারা আবার সেখানে নতুন করে দালাল তৈরি করবার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। আজ না হয় কাল কাউকে বসাতে হবে, শুধু মিলিটারি দিয়ে রাজত্ব করা যাবে না। আমরা কি দেখছি? আমরা দেখছি একজনের নাম, আমার খুব পরিচিত অবশ্য তিনি নিজে কিছু করছেন কিনা আমি বলতে পারব না। সংবাদপত্র থেকে জানতে পেরেছি, নূরুল আমিন সাহেব। তিনি আমাদেরই এখানে বসতেন। স্পীকার ছিলেন ১৯৪৬ সালে, মুসলিম লীগের আমলে যখন আমরা এই সভায় ছিলাম। আমার যতদূর মনে আছে তার পার্টি সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়েছিল। উনি বোধহয় একাই নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই ব্যক্তিকে খুঁজে বার করে বক্তৃতা দেওয়ানো হচ্ছে সেই বলছে যে, জোর করে দেওয়ানো হচ্ছে, আবার কেউ বলছেন ইচ্ছাকৃতভাবে দিয়েছেন। সে যাই হোক, এই রকম মানুষের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে, এই হচ্ছে চরম দূর্গতি। মিলিটারি নির্যাতন সেখানে চলছে এবং তার সঙ্গে মুসলিম লীগ? যারা পাকিস্তান তৈরি করেছিল, যারা পাকিস্তানের স্রষ্টা, কোথায় গেল সেই মুসলিম লীগ? সব ধুয়ে মুছে গেছে দেশ থেকে। শুধু যে একটা পার্টি হিসেবেই তা নয়, তাদের যে আইডিওলজি বা ভাবধারা, যা তারা প্রচার করেছিলেন, হিন্দু মুসলমান ভাগ করা প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মের দিক থেকে কোথায় সে সব ভাবধারা? আজকে আর সে সব কিছু নেই। আজকে আর কিছু না হোক, এইসব ছেলেরা যারা এসেছে, যুবকরা যারা এসেছে, সাধারণ মানুষ যারা সেখান থেকে এসেছে, এমনকি অফিসারও কিছু কিছু এসেছেন, আমরা তাদের দেখেছি, অনেক দিন তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। তাদের দেখে আমার আশ্চর্য মনে হয়েছে এই জন্য যে, অনেক খবর ওদের দেশের আমরা রাখতাম না। তাদেরও রাজনীতি আজ কত উর্দ্ধে, কত স্বচ্ছ, কত প্রসারলাভ করেছে, কত গণতান্ত্রিক হয়েছে। এইসব নতুন নতুন যুবক, ছাত্র, যারা ওখান থেকে এসেছেন তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন মাত্র নেই। এইসব কল্পনাও তাদের মধ্যে কোনদিন আসেনি এই সমস্ত নতুন যুবক সম্প্রদায়, একটা নতুন জাতি, যেন মনে হচ্ছে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ সমস্ত নিয়ে একটা সত্যিকারের জাতি তৈরি হয়েছে। আমরা এখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলি। রায়টে রায়টে সমস্ত ভারতবর্ষ ভরে গেছে। লজ্জার সঙ্গে, দু:খের সঙ্গে, ক্ষোভের সঙ্গে বলতে হচ্ছে গত ৩-৪ বছর ধরে এত অব্যবস্থা সত্ত্বেও, এত প্ররোচনা সত্ত্বেও আমরা বোধ করি সেজন্য ঐ পূর্ব পাকিস্তানে, বাংলাদেশে সেই ধরনের রায়ট বহুদিন ধরে সেখানে দেখিনি। এই সমস্ত নতুন নতুন রাজনৈতিক মানুষ সেখানে তৈরি হয়েছে। আজকে সেখানে ঐ সব দল ধুয়ে মুছে গেছে। মানুষ থেকে যারা বিচ্ছিন্ন, হয়েছে বিতাড়িত সেই সমস্ত মুসলিমলীগ নূরুল আমীনের দল এদের ধরবার চেষ্টা হচ্ছে। যদি কোনরকমে বেঁচে থাকতে পারা যায়। আজকে আমরা সেজন্য একথা মনে করব, এই প্রস্তাবের মধ্যে আমরা যে কথা বলেছি, যদি আরো আন্তরিক ভাবে এই প্রস্তাবকে সমর্থন করি, তাহলে একথা আমাদের বলতে হবে। করি কিনা জানি না, সে ভবিষ্যতে আমরা বিচার করব। মানুষ বিচার করবে ভারতবর্ষে, পাকিস্তানে, বাংলাদেশে সমস্ত জায়গায়, পৃথিবীর মানুষ সেটা বিচার করবে। কিন্তু আমাদের এটা মনে হয় যে, আন্তরিকতা আছে কিনা। আমরা সকলে মিলে সমর্থন জানাই।
সরকার সমর্থন জানিয়েছেন। ভিন্ন প্রদেশের বিধানসভা ও আইন সভাগুলিতেও আমরা দেখেছি সেখান থেকে সমর্থন করে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেও সংসদে প্রস্তাব এনেছিলেন এবং সেটা গৃহীত হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে খানিকটা যদি সন্দেহ হয় তাহলে আমাদের এখানকার কিছু সদস্য, মাফ করবে, উপায় কিছু নেই, কিন্তু আমাদের প্রথমে মনে হচ্ছে একটি প্রস্তাবের পিছনে যদি আন্তরিকতা না থাকে আমরা যদি এটা মনে না করি যে, এই প্রস্তাব কাগজে হবে না, একে আমাদের কার্যকরী করতে হবে, এই আমাদের কার্যকরী করতে হবে, এই আমাদের জীবনমরণ সংগ্রাম ওদের মতো, যারা ওখানে সংগ্রাম করছেন, যারা ওখানে বুকের রক্ত ঢেলে দিচ্ছেন, যারা ত্যাগ স্বীকার করছেন- যদি তা হয়, তাহলে আমাদের পরিষ্কার করে নিতে হবে যে, আন্তরিকতা কোথায় সেটা ঠিক করতে হবে। কিন্তু একটু সন্দেহ হয়, এটা আপনারা সবাই বিবেচনা করে দেখবেন। আমাদের জানতে ইচ্ছে করে যে, এখনকার সরকারপক্ষ থেকে এই প্রস্তাব তারা এনেছেন, এই প্রস্তাব মুখ্যমন্ত্রী নিজে এখানে রেখেছেন, যে সরকারের মধ্যে মুসলিম লীগ আছে, ওরা কি আন্তরিকতার সঙ্গে সমর্থন করেন বাংলাদেশের এই সংগ্রামকে, এই স্বাধীনতার আন্দোলনকে আমরা এখনো তার প্রমাণ পাইনি। কাজেই আমরা নিশ্চয়ই জানতে চাই তাদের বক্তৃতা শুনব। কিন্তু আমাদের মনে হয় এখানে যদি আমরা সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিই এবং অনেক সময় ইয়ং পিপল যারা বাংলাদেশ থেকে এসে আমাদের বলছে এখানে আবার মুসলিম লীগ, ওখানে তো সব শেষ হয়ে গেছে, ওদেরকে আমরা তো শেষ করে দিয়েছি, ওখানে যাতে গণতন্ত্র প্রসার লাভ করে তার ব্যবস্থা করছি, অথচ এখানে এখন বেঁচে রয়েছে, নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে, এই কথা তাঁরা আমাদের বললেন। আমরা বললাম, আপনাদের ওখানে সংবাদপত্র যায় না এবং সুযোগ না থাকায় আপনারা অনেক খবর জানেন না, আপনারা নিজেরা ঘুরে ঘুরে সমস্ত দেখুন, আপনাদের অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হবে। কিন্তু এটা তো সত্যিকারের প্রশ্ন যে, মুসলিম লীগ যারা ধর্মের বিচারে মানুষের রাজনীতি করেন, মানুষকে ভাগ করবার চেষ্টা করেন, সেই পুরানো জিনিস আজও চলছে এবং নতুন করে তার রিভাইভ্যাল বা পুনরুজ্জীবন আমরা দেখতে পাচ্ছি।
শ্রীমহঃ শামন বিশ্বাসঃ অন এ পয়েন্ট অর্ডার, স্যার, আমরা কোয়ালিশন মিনিষ্ট্রিতে অংশগ্রহণ করেছি জনকল্যাণের জন্য। আজকে বিরোধী দলের সভাপতি যে বক্তব্য রাখলেন, উই হ্যাভ গিভেন ইউ এ পেসেন্ট হিয়ারিং, এন্ড উই হোপ ইউ উইল অলসো গিভ আস এ পেসেন্ট হিয়ারিং।
মি স্পীকারঃ এতে পয়েন্ট অব অর্ডার হয় না। আমরা সর্বসম্মতিক্রমে একটা প্রস্তাব পাশ করবার জন্য রেজোলিউশন নিয়েছি। আপনি প্রিসাইজলি আমাকে বলুন।
শ্রীমহঃ শামন বিশ্বাসঃ উনি ডাইরেক্টলি আক্রমণ করেছেন। একজন লিডারের মুখ থেকে এইসব ভাষা আমরা শুনতে চাই না। এই রকম চিৎকার করে কোনদিন জনকল্যাণ করা যায় না। আই ডু নট লাইক টু সারেন্ডার মাইসেল্ফ।
মি: স্পীকারঃ ইট ইজ নট এ পয়েন্ট অব অর্ডার। প্লিজ টেক ইওর সিট।
শ্রীমহঃ শামন বিশ্বাসঃ আমরা গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী বলেই আজকে গণতান্ত্রিক কোয়ালিশন সরকারে অংশগ্রহণ করেছি।
মি: স্পীকারঃ আপনি বসুন। আপনার বক্তব্য যেটা আপনি বলেছেন দেয়ার ইজ নো পয়েন্ট অব অর্ডার। কাজেই মাঝখানে আপনি কমেন্ট করবেন এটা আমি চাইনা। আই উইল রিকোয়েস্ট ইউ টু টেক ইওর সীট। প্লিজ টেক ইওর সীট।
শ্রী সুবোধ ব্যানার্জিঃ স্পীকার মহাশয়, আজকে যে প্রস্তাব আমরা আলোচনা করছি সেখানে আমি সরকার পক্ষ এবং বিরোধী পক্ষের সদস্যদের অনুরোধ করব, যে বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করছি সেটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আমাদের কাছে এটা অতি প্রিয়। কাজেই এটা আমাদের গণআন্দোলনের সামনে একটা অতি বড় উদাহরণ উপস্থাপিত করেছে। সেইজন্য এইরকম একটা বিষয় নিয়ে সকলের যুক্ত চেষ্টায় ইউন্যানিমাস রেজোলিউশন করা হয়েছে। তাই আমি অনুরোধ করব সেই ফিলিং নষ্ট করে দেবেন না।
মি: স্পীকারঃ মি: ব্যানার্জী, আমি আশা করি প্রত্যেকটা সদস্যের তেমনি মনোভাবই থাকবে। আমরা যেন অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এই প্রস্তাব আলোচনা করি। কোনরকম উত্তেজিত না হয়ে আমাদের সামনে এই হাউসের সামনে যে প্রস্তাব রয়েছে, সেই সম্পর্কে আলোচনার সময় প্রস্তাবের উপর যথোচিত গুরুত্ব দিয়েই যেন মাননীয় সদস্যরা আলোচনা করেন এবং তাদের ব্যাবহারটাও যেন সেইভাবেই হয়। আমি হাউসের কাছে আপিল করছি, যে প্রশ্নই উঠুক না কেন আমরা হাউসেতে যেভাবে প্রস্তাব নিচ্ছি, তার গুরুত্ব যেন কোনরকমেই খর্ব না হয়।
শ্রী জ্যোতি বসুঃ মি স্পীকার, স্যার, আমি যেটা বলছিলাম- তার জবাব নিশ্চয়ই পাব যখন মুসলিম লীগের প্রতিনিধিরা বক্তৃতা দেবেন যদি আন্তরিকতা থাকে। এমনকি ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন সরকার সম্বন্ধে যদি তাদের আন্তরিকতা থাকে, বাংলাদেশকেও সমর্থন করবেন যদি আন্তরিকতা থাকে। সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেস দল তাঁরা সমর্থন করছেন এই প্রস্তাবকে। তাঁরা শুধু এই প্রস্তাবকে সমর্থন করছেন না, এখানকার কংগ্রেস সরকার বা ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন সরকার, কংগ্রেসের দ্বারা পরিচালিত সরকার- তারা যখন সরকার গঠন করেছিলেন, তখন প্রথমেই বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা প্রস্তাব করে দিল্লীতে পাঠিয়েছেন। আমরা দেখছি আনুষ্ঠানিক দিক থেকে এই কংগ্রেস সরকারের বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন আছে- সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আবার প্রশ্নটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুবোধবাবু যেমন বলেছেন মনে এক, মুখে আর এক রকম যেন না হয়। প্রস্তাব পাশ করে দিলাম বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যেন অন্যরকম না হয়। সে জন্য বলছিলাম আপনাদের আনুষ্ঠানিক সমর্থন থাকলেও আমার কতকগুলি প্রশ্ন জেগেছে মনে। এটা কি সম্ভব যে, আমাদের দেশে আমরা অন্য দেশের গণতন্ত্রকে সমর্থন করছি, পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি তাদের স্বাধীনতার জন্য অথচ আমাদের দেশের গণতন্ত্রকে আমরা সমর্থন করিনা, গণতন্ত্রকে যেখানে আমরা খতম করবার চেষ্টা করছি, গণতন্ত্রের উপর আমরা বারে বারে আক্রমণ করছি, তার নিয়ম কানুন আইন কিছুই আমরা মানি না। আমাদের নিজেদের দেশের গণতন্ত্রের ব্যাপারে সেখানে আমার মনে হয় এটা সম্ভব নয়। এর মধ্যে কোন আন্তরিকতা থাকতে পারে না। মার্ক্স বলেছিলেন, অন্য বিষয়ে বৃটিশদের বলেছিলেন, আয়ারল্যান্ড এর উপর তোমরা আধিপত্য করছ- এ নেশন হুইচ অপ্রেসেস এনাদার নেশন ক্যাননট বি ফ্রি। আমিও সেই কথা বলি অন্য দিক থেকে। যদি আমাদের দেশে গণতন্ত্র আমরা না মানি, তারা মানবেন অন্য জায়গায়? আমরা মনে করি না এই সম্পর্কে তাদের কোন আন্তরিকতা থাকতে পারে।
শ্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ঃ অন এ পয়েন্ট অব অর্ডার, আমরা কি বর্তমান ইস্যু থেকে সরে যাচ্ছি না? আমাদের দেশের সমালোচনা করবেন, না আজকের রেজোলিউশনটা যা আছে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার সমালোচনা করে বক্তৃতা করবেন।
মি: স্পীকারঃ পয়েন্ট অব অর্ডার তুলতে গেলে এখানে যা বলা হয়েছে তাতে কোন রুল ইনফ্রিজ করা হয়েছে এইরকম যদি হয়, তাহলে নিশ্চয়ই পয়েন্ট অব অর্ডার তুলবেন।
শ্রী সুব্রত মুখার্জিঃ আমি বলছি আমাদের যা রেজোলিউশন আছে এবং আপনি যে রেজোলিউশনের উপর বক্তৃতা করার অনুমতি দিয়েছেন, সেই রেজোলিউশনের উপর বক্তৃতা করা হচ্ছে না, আমাদের দেশের গণতন্ত্র কতখানি, তার মাপকাঠিতে সমালোচনা করা হচ্ছে।
মি: স্পীকারঃ যে প্রস্তাব এখানে এসছে, তাতে যিনি বক্তা, তিনি তাঁর আর্গুমেন্ট ডেভেলপ করতে গিয়ে যেটা ভাল বুঝবেন সেই রকমভাবে ডেভেলপ করবেন, সেইভাবে আর্গুমেন্ট পেশ করবেন। আপনার বলার সময় আপনিও তাই করবেন।
শ্রী জ্যোতি বসুঃ ধরুন, এই পশ্চিম বাংলায়, কারণ এখানকার বিধানসভার কাছ থেকে আমরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করছি- এখানে কি হচ্ছে, এখানে যতটুকু গণতন্ত্র ছিল আজ তা শেষ হতে বসেছে। কারা শেষ করছে, কংগ্রেস দল, কংগ্রেস সরকার, এখানে অসংখ্য পুলিশ আছে, ৬০ হাজারের ওপর পুলিশ আছে। তার ওপর এক বছরে দেখেছি, যেখানে শ্রীমতী গান্ধীর রাজত্ব ছিল, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির শাসন- এই এক বছর ধরে দেখেছি, নির্বাচন পর্যন্ত যেখানে সি আর পি এসেছে, অসংখ্য হাজার হাজার সি আর পি আনা হয়েছে। শুধু তাই নয় তারপর আমরা দেখলাম একটা অভাবনীয় জিনিস। সেই অভাবনীয় জিনিস আমরা দেখলাম যে, নির্বাচন যখন ঘোষণা করা হল, তারপর আবার মিলিটারি এল, ৬০ হাজার পুলিশ হবে না, হাজার হাজার সি আর পিতে হবে না, বাংলাদেশের পুলিশ দিয়ে হবে না, তার ওপর এল মিলিটারি। যেখানে একটা নির্বাচন হবে, সেখানে এল মিলিটারি এবং নানারকম জুলুম অত্যাচার তাদের দিয়ে করানো হল। কোথায় গণতন্ত্র? এ তো গণতন্ত্র এর যেটুকু ছিল তাকে শেষ করার ব্যবস্থা হচ্ছে। এবং শুধু তাই নয়, এখানে সাধারণ মানুষের উপর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর – গণতান্ত্রিক আন্দোলন যারা সংগঠিত করেন মজুর, কৃষক, ছাত্র- যুবক, তাদের উপর নানাভাবে অকথ্য অত্যাচার গুন্ডাবাহিনী তৈরি করে নকশালদের কাজে লাগিয়ে, অন্য সমাজবিরোধীদের কাজে লাগিয়ে পুলিশের একটা প্রধান অংশ, সরকার সমস্ত মিলিয়ে, এই আক্রমণ, এই অত্যাচার তারা চালিয়েছে, এই জিনিস আমরা দেখেছি। গত এক বছরে দেখেছি আমাদের সাথী ২৫০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আজও শুনলাম এখানে, যে ঘটনাগুলো বলা হল, একটা রাত্রের মধ্যে, ২৪ ঘন্টার মধ্যে – আমরা এখানে ৬ জনের কথা শুনলাম, তারা জীবন দিয়েছেন এবং গুন্ডারা আক্রমণ করছে। শুধু গুন্ডারা আক্রমণ করলে কিছু বলতাম না, তাদের পেছনে পুলিশ আছে, তাদের পিছনে সরকারী যন্ত্র আছে, এই জিনিস এখানে চলেছে। সুতারং এইভাবে কি করে গণতন্ত্র বাঁচবে। দুটো নির্বাচন হয়ে গেল, এরই মধ্যে নির্বাচন হল, কিন্তু নির্বাচনের আগে আমরা দেখেছি চারি ধারে ১৪৪ ধারা জারী করে রাখা হয়েছে, এটা কখনও শুনিনি ২৩ বছরের কংগ্রেসী রাজত্বেও। স্বাধীন যেদিন থেকে হয়েছি, সেদিন থেকে যে নির্বাচন হয়ে যাবার পর আমরা উৎসব আনন্দ করতে পারব না, নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করতে পারব না, পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে রাখতে পারব না, ১৪৪ ধারা দিয়ে আমাদের কণ্ঠরোধ করা হল। বলা হল আমরা এই বিষয়ে অনুমতি দিতে পারি না। এখন এই রকম একটা অবস্থার মধ্যে আমরা মনে করি যে, এখানে গণতন্ত্রকে আমরা এইভাবে হত্যা করব, গণতান্ত্রিক অধিকার যেটুকু আছে সেটাকে কেড়ে নেব, এইভাবে বিনা বিচারে মানুষকে আমরা আটক করে রাখব। আবার শুনছি পি ডি এক্ট হবে, তাতে হাজার হাজার ধরে রাখা হবে, প্রতিপক্ষকে এইভাবে ঘায়েল করবেন, তাদের এসেম্বলিতে আসতে দেবেন না, তারা বিচারাধীন হবে, একটা ভোট দেবার জন্য এই যদি চলতে থাকে এবং তারাই যদি আবার শাসক দলের হয়, তাহলে যদি সন্দেহের কিছু অবকাশ সেখানে আমাদের থাকে যে এরা কি সত্যিই আন্তরিকতার সঙ্গে এই প্রস্তাব রেখেছেন, না লোক দেখানোর জন্য এটা তারা করছেন। আমাদের পশ্চিম বাংলার মানুষের মত তারা জানে, এমন কি ভারতবর্ষের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক মানুষের মত তারা জানে, তাদের মত প্রতিফলিত হয়েছে এক মাস ধরে, সেইজন্য তারা এই প্রস্তাবটি নিচ্ছেন। এর মধ্যে আন্তরিকতা যদি থাকে তাহলে সেটা কার্যকরী ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাব। কিন্তু মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আমি ও পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি যে, ওরা যদি এই পদ্ধতিতে শাসনব্যবস্থা চালান, এর যদি খানিকটা পরিবর্তন না করেন তাহলে আমরা বুঝব যে, সত্যিকারের কোন সমর্থন হবে না, এ কাগজের প্রস্তাব তাদের কাছে থাকবে। এখানকার দাবিগুলি কি- আমরা সবাই পরিষ্কার ভাবে বলেছি যে, যে সরকার ওখানে হয়েছে তাকে মেনে নেওয়া হোক। মাননীয় স্পীকার মহাশয় আপনার মনে আছে, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সাধারণভাবে অনেক আগে বলেছিলেন, তখন বাংলাদেশ সরকার হয়নি, আমি কাকে রেকগনাইজ করব, কাকে মেনে নেব। তারপর সরকার গঠিত হয়েছে, এখন আর সেকথা বললে চলবে না। তারা আজ ওখানে গেরিলা কায়দায় লড়াই এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন, অসংগঠিত মানুষ আজ সংগঠিত হবার চেষ্টা করছেন, পরস্পর মিলেমিশে কাজ করবার চেষ্টা হচ্ছে, তাদের সেই লড়াইকে গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলেছে, সেজন্য আমরা চেয়েছিলাম আর বিলম্ব কেন, এই প্রস্তাব ১৫ দিনের মধ্যে আমরা দিল্লীকে বলি যে, তোমরা বাংলাদেশকে মেনে নাও, কিন্তু আমরা দেখলাম টাইম লিমিট না করাই ভাল, ওদের কিছু অসুবিধা করতে পারে, সেজন্য আমরা এই প্রস্তাবে লিখলাম যে, এক্ষুনি রিকগনিশন দেওয়া হোক। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যেটা এর সংগে ওত:প্রোতভাবে জড়িত, সেটা হচ্ছে ওদের আগে চাই অস্ত্রশস্ত্র। খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ সেসব তো আমাদের দিতেই হবে। কারণ অসংখ্য শরণার্থী আছে তাদের দিতে হবে। কেন্দ্রিয় সরকার সেগুলি করছেন বলে শুনেছি, বিভিন্ন কমিটি আছে তার জন্য, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আগে যেটা দরকার সেটা হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র গোলাগুলি। তাদের হয়ত কিছু রাইফেল আছে যেগুলি সৈন্যদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে, কিন্তু সেগুলি চালাবার মত গুলি নেই। তারা জীবন দেবার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু গুলী নেই। আমরা যদি তাদের সেটা দিতে না পারি, একটা হাওয়াইজাহাজ নিচে নেমে এসে গুলী করছে, তাকে প্রতিহত করার জন্য চাই এন্টিএয়ারক্রাফট গান, এসব তাদের নেই, এসব যদি তাদের না দিতে পারি তাহলে তারা কি করে লড়াই করবে। শুধু সহানুভূতি জানিয়ে, রেডিওতে গান করে ওদের সত্যিকারের সাহায্য করতে পারব না। সেজন্য আমরা একমত হয়ে এই প্রস্তাব দিচ্ছি। তৃতীয়ত যারা নাকি ওখান থেকে বাধ্য হয়ে চলে আসছে, পরিস্থিতি অন্য রকম হলে তারা বেশীরভাগ ফিরে যাবে, তাদের সম্বন্ধে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন। তাদের শুধু টাকা দিলে হবে না তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি বর্ষা এসে যাচ্ছে, আমরা জানি কি দুর্গতি হবে। ৬০ লক্ষ বাস্তুহারা পশ্চিম বাংলায় এসেছে, বেশিরভাগ বাইরে গেছে, এখানে কিছু আছে। সেজন্য খাদিল্কার দিল্লীতে বলেছেন আমাদের একশো কোঠি টাকা খরচ হবে, অতএব ইউএনও, আন্তর্জাতিক সংস্থা এর ভার নিক। কে করবে না করবে বলতে পারব না, আমাদের কথা হচ্ছে এটা কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ণ দায়িত্ব এবং তাদের এখানে লোক পাঠিয়ে ব্যবস্থা করা যাতে তাদের খেটে খাবার ব্যবস্থা হয়। যারা সক্ষম তারা যাতে এখানে কাজকর্ম করে খেতে পারেন শুধু বসে খেতে না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা আজ ওখানে লড়াই করছেন তারা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক মানুষের জন্য লড়াই করছেন, এজন্য আমাদের এইসব ব্যবস্থা করা দরকার। তারপর যেটা আছে সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেইখানে আসল বিচার হবে। আমি বলেছি প্রস্তাবের মধ্যে এক হয়ে বলেছি কেন্দ্রীয় সরকার যদি এই দাবিগুলি মেনে না নেন তাহলে আমরা বলছি এই প্রস্তাবের মধ্যে সরকার এবং জনগনকে এসেম্বলি থেকে ডাক দেওয়া হচ্ছে অর্থাৎ পশ্চিম বাংলার সরকার এবং জনগনকে ডাক দেওয়া হচ্ছে আপনারা চাপ সৃষ্টি করুন। ব্যবস্থা করুন যাতে ওরা এটা মেনে নেন। এইটা আমি জানি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখব, তাদের কি অসুবিধা আছে। আজকে প্রধানমন্ত্রী মিটিং ডেকেছেন দিল্লীতে। আমাদের প্রতিনিধিরা সেখানে গিয়েছেন। কি হবে না হবে সেটা নিশ্চয়ই বিরোধী দলের লোকেরা বিচার করবেন। অন্য কোন রকম রাজনীতি করতে চাই না। এটা করছেন না কেন তা বুঝতে পারছি না। আমরা কোন বড় রকমের ঝুঁকি আছে বলে মনে করছি না। আমরা মনে করি এটা মেনে নেওয়া উচিৎ। আমরা এটা প্রতিজ্ঞা করেছি এই প্রস্তাব গ্রহণ করে সে প্রতিজ্ঞা করেছি। এই কথা বলতে চাই যে, আমরা সদস্যরা যারা ভোট দিবেন এই প্রস্তাবের পক্ষে তারা বুঝেশুনে দেবেন, পরবর্তীকালে আমাদের আন্দোলন করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে বাধ্য করতে হবে। এই দাবিগুলো যা আছে তা যাতে মেনে নেওয়া হয়।
আমার এই বিষয়ে একটা সুপারিশ আছে। আমরা যেন শুধু একটা চিঠি পাঠিয়েই চুপ করে বসে না থাকি, অর্থাৎ প্রস্তাবের একটা কপি পাঠিয়ে দিয়েই শুধু এতে আমরা সন্তুষ্ট না হই। আমরা যারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করছি তার মধ্যে কয়েকজন প্রতিনিধি যদি দিল্লিতে গিয়ে সেখানকার সরকারের কাছে উপস্থাপিত করতে পারি এবং আমাদের এই প্রস্তাব নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারি। যদি তাদের কোন অসুবিধা থাকে তাহলে আমাদের বলবেন এবং আমাদের বক্তব্য যাতে এক সঙ্গে রাখতে পারি তার ব্যবস্থা করুন।
আমি বসবার আগে শুধু একটা কথা বলতে চাই, এই প্রস্তাব অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমরা মনে করি এটা আমাদের জীবনমরণের সংগ্রাম। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এই কথাগুলো বলে বলব আমি আশা করি এখানকার সদস্যরা ভূল বুঝবেন না এবং আমরা যারা এই বিরোধী দলে আছি, এই পক্ষে আছি আমাদের সরকারের সঙ্গে কোন একটি ক্ষেত্রেও মিল নেই, কোন মৌলিক ব্যাপারে কোন বিষয়ে মিল নেই। আমরা এই সরকারের যত তাড়াতাড়ি পতন হয় তাই চাই। কিন্তু যতদিন এই সরকার আছে যতদিন আমরা বিরোধী আছি এবং এর মধ্যে আমাদের উপর যত আঘাত হোক, আমাদের রক্ত ঝরিয়ে, আমাদের জেলে পাঠিয়ে, গুন্ডার আক্রমণ, পুলিশের আক্রমণ, কংগ্রেসি আক্রমণ – যত কিছুই হোক এবং এই রক্তাক্ত অবস্থায়, এই রকম অশ্রু বিসর্জনের সময় বাংলাদেশের মানুষের এই সংগ্রামে এই প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যা কিছুই হোক আমরা আছি তাদের সঙ্গে। এই কথা বলে এই প্রস্তাবকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
( এর পরে ২০ মিনিট বিরতি দেয়া হয়)
( বিরতির পর)
শ্রী আবদুস সাত্তার : মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ সম্পর্কে যে প্রস্তাব এই হাউস- এ এনেছেন তা আমি সমর্থন করছি এবং সমর্থনের পিছনে আমার যে কারণ তা আপনার সামনে রাখবার চেষ্টা করব। আমাদের বিরোধী দলের নেতার বক্তব্যর প্রথম অংশটা আমার সত্যিই ভাল লেগেছিল। তিনিবারবার বলেছেন এই রেজোলিউশন এর পেছনে কংগ্রেসের সত্যিকারের অনেষ্টি আছে কিনা সে সম্বন্ধে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবং তা আমি সরকারের তরফ থেকে বলছি আজ যে প্রস্তাব আনয়ন করা হয়েছে সেই প্রস্তাবের পেছনে আমাদের সম্পূর্ণ সমর্থন আছে এবং আন্তরিকতা আছে। আমাদের প্রথম যে ক্যাবিনেট মিটিং হয় সেই ক্যাবিনেট মিটিং এ আমরা এই প্রস্তাব নিয়েছিলাম এবং প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলাম। এটা ঠিক আমি তার সঙ্গে একমত যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান হয়েছিল। কিন্তু আজ ২৩ বছর পর এই তত্ব যে ভুল সেটা প্রমাণিত হয়ে গেছে। আজ আমরা যদি হিন্দু মুসলমান আলাদা ভাবে চিন্তা করি তাহলে গণতন্ত্র এর বিশ্বাসী কোন লোক তা মেনে নিতে পারে না। অনেক মুসলমান যারা ভাবছেন যে, বোধ হয় পাকিস্তান এই কথাটা উড়ে যাবে এই সন্দেহ তিনি প্রকাশ করেছেন, কিন্তু জানিনা কেউ এই মনোভাব পোষণ করেন কিনা। আমি সেদিন এক বক্তিতায় এই দ্বিজাতিতত্বের কথা বলেছিলাম। আমাদের প্রফেটের জীবনি যদি আলোচনা করি তাহলে দেখি যে, প্রফেট যখন মক্কা থেকে মদিনায় গিয়েছিলেন তখন সেখানে অনেক ইহুদী, খৃষ্টান বাস করত। অর্থাৎ সেখানে অনেক নন মুসলিম বাস করত। মক্কাবাসিরা মদিনা আক্রমণ করার ষড়যন্ত্র করে এবং তখন মদিনায় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোক বাস করত। তিনি তখন সেখানকার অধিবাসিদের বলেন, আমরা এক জাতি – ওয়ান নেশন- এবং আজ যদি কেউ মদিনা আক্রমণ করে তাহলে আমরা মুসলমান, ইহুদি, খৃষ্টান ইত্যাদি সকলে সমবেতভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করব।
সুতারং আমি বলতে চাই, যে তথ্যের ভিত্তিতে এটা হয়েছিল সেটা ভুল। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না কারণ আমরাও তার শরিক ছিলাম, আমরাও তা স্বীকার করে নিয়েছিলাম, আজকে সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাই সেদিক থেকে বলছি যে, আজকে বাংলাদেশ সম্পর্কে – যে বাংলাদেশের স্বাধিনতা, অর্থাৎ এটা বলা হয়েছে যে, বাংলায় প্রথম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে নির্বাচন হয়েছিল সেই নির্বাচনে যে কর্মসূচির ভিত্তি মুজিবুর রহমান সাহেব করেছিলেন সেই নির্বাচনের রায়কে আজকে ইয়াহিয়াশাহী, জঙ্গিশাহী, মানেননি, আজকে না মানার ফলেই এই অবস্থা হয়েছে আজকে আমি বলব ইসলামিক রাষ্ট্রের নাম নিয়ে ইয়াহিয়া সাহেব সেভাবে সেখানকার অধিবাসিকে, হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে হত্যা করেছেন এবং যেভাবে নারীর উপর পাশবিক অত্যাচার করছে, আজকে সেগুলি আমার মতে ইসলামবিরোধী কাজ ছাড়া আর কিছু বলা যেতে পারে না। আজকে ইসলামের নাম নিয়ে যারা এই জিনিসকে সমর্থন করে তারে আমি বলব তারা ইসলামের মূল কথা জানে না, এবং তা বিশ্বাসও করে না। তারা একটা গোঁড়ামির বশে, তারা একটা সেন্টিমেন্টের বশে কিম্বা না বুঝে এই সব করছে। কিন্তু দু:খের বিষয় আজকে এই বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালি অবাঙ্গালী কথাটা এসে পড়েছে। বাঙ্গালি অবাঙ্গালী কথাটা আসবার ফলে আজকে কলকাতায় কিংবা বাংলাদেশের বুকে যারা অবাঙ্গালী মুসলমান আছে কিংবা অবাঙালী হিন্দু পর্যন্ত তাদের মধ্যে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে, পরস্পর পরস্পরকে যেন একটা সন্দেহ করছে। এই জিনিসটা আমার মনে হয় দেশের পক্ষে অমঙ্গল। দেশের পক্ষে অমঙ্গল এইজন্য বলছি আজকে সেখানকার লড়াই বাঙ্গাল- অবাঙ্গালী বলে নয়, আজকে জঙ্গিশাহি ইয়াহিয়া খান কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তা যারা তারা বাংলাদেশের লোককে সমস্ত রকম জিনিস থেকে বঞ্চিত করে শাসন করতে চেয়েছিল। আজকে বৃটিশ আমলে গোটা ভারতবর্ষে যেভাবে শোষণ চালাতে হয়েছিল আজকে সেইভাবে শোষণ করার পরিকল্পনা তারা নিয়েছিল। আজকে তারা এই দেশের অর্থ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধশালী করতে চেষ্টা করেছিল তাই সেখানে তারা তাদের একটা অধিকার দাবি করেছিল, তারা যে জিনিস চেয়েছিল তারা একটা স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। আজকে যেখানে শতকরা ৯৯ জনের প্রতিনিধিত্ব পাওয়া সত্ত্বেও সেই দলকে ইয়াহিয়া খান তাদের সুযোগ দেননি তাদের অস্ত্রের বলে। আমি তাই আজকে যে নরহত্যা চলছে সেটা খুবই দু:খের কথা, এর সঙ্গে আমি বলব, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কথা, আজকে সহজেই দেখতে পাচ্ছি এই যে নরহত্যা, গণহত্যা চলছে, সংগ্রামী মানুষকে যে এইভাবে পিষে মারছে, আজকে তাদের পিছনে অনেকের সহানুভূতি আসছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। আমি বলব ভারতবর্ষ তবুও এগিয়ে এসেছে, এগিয়ে এসে সেই দু:স্থ লোকদের সাহায্য করছে। কিন্তু আজকে ভারতবর্ষের যে বাধা সেই বাধার একমাত্র বাধা হচ্ছে চীন। আজকে এই সংগ্রামকে, জঙ্গিশাহি শাসক ইয়াহিয়াকে যদি কেউ সমর্থন করে থাকে, আজকে আমার মনে হয় বিদেশী দেশের মধ্যে চীন দেশই তাকে সমর্থন করে। এটা খুবই দু:খের কথা। যারা সংগ্রামী মানুষের পিছনে যে দেশ বলে আমরা আছি, যারা সংগ্রামী মানুষের জন্য কুম্ভীরাশ্রু, ফেলে, তারা সেই চীন দেশের বলে বলীয়ান হয়ে আজকে ইয়াহিয়া খান এবং তার জঙ্গীশাহী এদের দমন পীড়ন করতে আরম্ভ করেছে এটা বড়ই দু:খের বিষয়। আশ্চর্যের বিষয় আজকে যিনি আমাদের বিরোধী নেতা, সেই কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা, গণতন্ত্র সম্বন্ধে তিনি অনেক উপদেশ আমাদের দিয়েছেন, কাকে বলে গণতন্ত্র, গণতন্ত্র কিভাবে হত্যা করা হচ্ছে, এইসব বলেন কিন্তু, তাঁকেই আমি বলছি, আপনার এই মোশনকে সমর্থন করছে বলে আমরা সত্যিই আপনার কাছে ঋণী। তবে আপনি আপনার অন্তরে অন্তস্তল থেকে তো আপনি সত্যিকারের রাজনীতি করছেন, না আপনি সত্যিকারের নিরপেক্ষভাবে এবং অনেষ্টলি এটাকে সমর্থন করেন।
এখানে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে, কারণ আমরা জানি যে, ইয়াহিয়া খানকে মোটামুটিভাবে কারা সমর্থন করেছেন অস্ত্র দিয়ে। এমন কি দেখা গেছে যারা এসেছেন ওপারে থেকে তারাই বলেছেন যে, সেখানে চীনা সৈন্য দেখ। তিনি গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, আমি বলব এই গণতন্ত্রের হত্যাকারী কে? ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭০ সালের মার্চ পর্যন্ত আপনার রাজত্ব করে গেছেন, কেবল রাজত্বই করেননি, আপনি হোম ডিপার্টমেন্টের মালিক ছিলেন। আপনার কি মনে নেই যে, সেই সময় সাধারণ লোক রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতে পারেনি। ( বিরোধী পক্ষের বেঞ্চ হইতে তুমুল হট্টগোল)। আপনি তো সবই জানেন। আজকে আপনি সি আরপি আনার কথা বলেছেন। আমি বলব এই সিআরপি আনা হয়েছে আপনাদেরই গার্ড দেওয়ার জন্য। আজকে আপনাদের বাড়ির চারপাশে, আপনাদের নেতাদের বাড়ির চারপাশে সি আরপি রাখার প্রয়োজন হয়েছে বলেই এই সি আরপি আনা হয়েছে। কাজেই ১৩ মাস রাজত্ব করার ফলেই আপনাদের এই সি আরপি রাখার প্রয়োজন হয়েছিল। তাই প্রেসিডেন্ট রুলের আমলে সি আরপি এনে আপনাদের বডিগার্ড দেওয়া হয়েছে। আর এই ১৪৪ ধারা কাদের জন্য? আজকে যারা গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারে না, মানুষকে খুন করা যাদের নেশা তাদের জন্যই এই ১৪৪ ধারা, সাধারণ মানুষ যাতে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে সেইজন্যই এই ১৪৪ ধারা করা হয়েছে।
মি: স্পীকারঃ মি: সাত্তার, ইওর টাইম ইজ আপ। প্লীজ ফিনিস।
শ্রী আবদুস সাত্তার: আচ্ছা স্যার, ঠিক আছে। তিনি একটা কথা বলেছেন যে, বড় রকমের কোন ঝুঁকি নেই সাহায্য করার। আমি বলব কোন ঝুঁকি নেই সাহায্য করার তবে একটু ভয় আছে- জ্যোতিবাবু কি দয়া করে চীনকে একটু নিষেধ করে দেবেন যাতে করে কোন ঝুঁকি না নিতে হয় বা কোন বিপদ না আসে। এই বলেই আমি আমার বক্তৃতা শেষ করলাম।
শ্রী সুবোধ ব্যানার্জি : স্পীকার মহাশয়, মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভার সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের উপর যে প্রস্তাব রেখেছেন আমি সর্বান্ত:করণে তাকে সমর্থন করছি। সীমান্তের ওপারে লক্ষ্য লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের বুকের রক্ত দিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করছেন। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ যে সংগ্রাম করছেন সেই সংগ্রাম সফল হবেই। আর সেই সংগ্রাম সফল হলে তার ঢেউ, তার প্রভাব, সীমান্ত পার হয়ে আমাদের দেশে আসবে এবং তার ফলে আমাদের দেশের শোষিত মানুষও ঠিক ওদের মতই সশস্ত্র পথে গণমুক্তির জন্য নামবে, পুঁজিবাদ খতম হবে এবং এখানকার মানুষ শোষণমুক্ত হবে। কাজেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু তাদের নয়, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এই সংগ্রাম আমদেরও সংগ্রাম, বিশ্বের যেখানে যত শোষিত মানুষ আছেন তাদের ও সংগ্রাম। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি এই সংগ্রামকে সমর্থন জানাই তার সাফল্য কামনা করি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের প্রতি সংগ্রামি অভিনন্দন জানাই।
স্পীকার মহাশয়, বাংলাদেশের এই স্বাধীনতার সংগ্রাম সম্পর্কে কতকগুলি প্রশ্ন উঠেছে এখানে। এ ব্যাপারে কিছু কিছু অপপ্রচার আমাদের দেশে চলেছে, আমাদের রাজ্যেও চলেছে। কেউ কেউ বলেছেন বাংলাদেশের এই সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম নয়, এই সংগ্রাম পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য এক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, যাকে বলে সিসেসনিস্ট মুভমেন্ট। না আমরা এই সংগ্রাম সেইভাবে দেখি না। এটা বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলন, না এটা জাতীয় স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম তা বিচার হবে কোন মাফকাঠি দিয়ে? কোন জনসমষ্টি হোমোজিনিয়াস নেশন অর্থাৎ একিভূত জাতি হিসাবে গড়ে ওঠার পর সেই জাতি থেকে জাতীয় স্বার্থবিরোধী সন্কীর্ণ স্বার্থের জন্য যখন একটা অংশ বিচ্ছিন্ন হবার উদ্দেশ্য আন্দোলন করে তখন সেটাকে বলা হয় সিসেসনিস্ট মুভমেন্ট। যেমন ঘটেছিল আব্রাহাম নিন্কনের সময় আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণ একটি জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। সেখানে দাসপ্রথা রাখার অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল দাবিতে দক্ষিণ অঞ্চলের কিছু লোক জাতীয় রাষ্ট্র হতে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিল। তাই সেটা ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সিসেসনিষ্ট মুভমেন্ট। বাংলাদেশের মানুষ আর পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে এক জাতীয়তাবোধই গড়ে ওঠেনি। পাকিস্তানী পিপল ডিড নত ডেভেলপ এজ এ মোর্মোজিনিয়াস নেশন। কি জীবনধারার দিক থেকেই দেখুন, কি ভাষার দিক থেকেই দেখুন, এক জাতি মানসিকতা থেকে বলা হয়ে থাকে ওয়ান নেশন সাইকোলজিক্যাল মেকআপ হুইচ কনস্টিটিউটস দি মেন ফ্যাক্টর ইন দি ফরমেশন অফ এ নেশন। তার কোনটাই পাকিস্তানের উভয় খন্ডের জনশাধারণের মধ্যে এক ও অভিন্ন নয়। এক ন্যাশনাল সাইকোলজিক্যাল মেকআপ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। এটা হয়ত কালক্রমে গড়ে উঠতি যদি উভয় খন্ড পরস্পর সংলগ্ন হত। তখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ ন্যাশনালিটি কর্তৃক সংখ্যালঘিষ্ঠ ন্যাশনালিটির উপর জাতীয় নিপীড়ন থাকত এবং তার জন্য বিক্ষোভও থাকতো যেমন আমাদের দেশে আছে। কিন্তু পাকিস্তানে তা নয়; যেখানে দুই খন্ডের মধ্যে ফারাক ১২০০ মাইল। যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের উপর শোষন চালিয়েছে তাই যখন যেটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে রূপ নিয়েছে একটা কলোনিয়েল এক্সপ্লয়টেশন, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শোষণ হিসেবে এক জাতি কর্তৃক ভিন্ন জাতিকে শোষন করা হিসাবে। এক জাতীয়তাবোধ ও মানসিক গঠন না গড়ে ওঠার ফল। বাংলাদেশের মানুষ তাই বারবার অনুভব করেছে যে, তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের দ্বারা ঔপনিবেশিক শোষন ও শাসনে ভুগছে। সেই বোধ থেকেই নতুন বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের জন্ম এবং সেই কারনে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য তাঁরা সংগ্রাম করছে। সেই সংগ্রাম এই কারনেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন; সেটা হচ্ছে স্ট্রাগল ফর কমপ্লিট ন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেন্স অর্থাৎ পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। উত্থাপিত প্রস্তাবে সে বক্তব্য রাখা হয়েছে। এই সত্য যেন আমরা না ভূলে যাই। ভূলে গেলে এর গুরুত্ব আর বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারব না। আর তা ঠিকভাবে বুঝতে না পারলে এই সংগ্রামের প্রতি আমাদের যে কর্তব্য তাও আমরা করতে পারব না।
একথা ঠিক যে, ভারতবর্ষ বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার সব মানুষ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশের সংগ্রামকে দেখছে না। কারও কারও মনে উঠিতে অয়ারে এই দুই বাংলা হোক এবং সেই কারনে তাঁরা বাংলাদেশের সংগ্রামের সমর্থক। কেউ কেউ মনে করতে পারে পাকিস্তান দুর্বল হোক এবং সেই মানসিকতার জন্য তারা বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করতে পারে। তবে আমি বলব যে এইভাবে ভাবলে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রামকে আমরা শক্তিশালী করার বদলে দুর্বলই করব। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলাকে যুক্ত করে আবার একটা অখন্ড বাংলাদেশ গড়ার জন্য লড়ছে না। তাঁরা এক জাতির মানসিকতা নিয়ে একটা স্বাধীন সার্বোভৌম জাতীয় রাষ্ট্র স্থাপন করার জন্যই সংগ্রাম করে চলছে। এ বোধ ও দাবি ভারতীয় জাতীয়তাবোধের প্রোডাক্ট নয়। একটি নতুন জাতি প্রতিষ্ঠা লাভের সংগ্রাম। আমাদের সঙ্গে মিলে অখন্ড বাংলা গড়ার জন্য তাঁরা লড়ছে না।
আমি কিছু কিছু সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় ও চিঠিপত্রের স্তম্ভ দেখেছি দুই বাংলা এক হোক, এই স্লোগান এখন দেওয়া হচ্ছে। এটা দেওয়া উচিত হবে না। আমার কথাকে ভুল বুঝে কেউ যেন না ভাবেন যে আমি দুই বাংলা এক হোক তা চাই না। নিশ্চয়ই চাই। তবে তা পারার পথ কি, তার পদ্ধতি কি হবে? তার পদ্ধতি কি হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দুর্বল করা? নিশ্চয় না। কোন সুদূরভবিষ্যতে দুই বাংলা এক হতে পারে, এখন নয়। ভবিষ্যতে যখন আমাদের দেশে ও বাংলাদেশে উভয় দেশেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হবে তখন উভয় দেশের মানুষ স্বেচ্ছায় যদি দুই বাংলাকে এক করতে চায় কেবলমাত্র তখন দুই বাংলা এক হবে। তাঁর আগে দুই বাংলার এক হবার সম্ভাবনার কণামাত্রও নেই। আর উভয় দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেই যে এটা হবে তাও না। জাতীয় মনোভাব ও জাতীয় রাষ্ট্রের সামজিক স্তর অতিক্রম করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ার পথেই তা সম্ভব হবে। একথা যদি আমরা আমাদের দেশের মানুষকে বোঝাতে পারি তাহলে আমি মনে করি যে, উভয় বাংলা এক হোক এই স্লোগান তোলার দ্বরা পাক সরকারের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাবার একটা হাতিয়ার তুলে দেওয়া হবে। তা যেন আমরা না করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা সাহায্য কতদূর কি করেছি তা নিয়ে বিতর্কে অবকাশ আছে, তবে তাঁদের সংগ্রামের কোন ক্ষতি যেন না করি। এ আবেদন আমি এই বিধানসভার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে রাখতে চাই।
মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আপনি জানেন যে, আরও কতগুলি প্রশ্ন এখানে উঠছে। আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করতে চাই। আমরা কি চাই আমাদের প্রস্তাব তা আছে। বাংলাদেশে যে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং তাঁর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত কিনা প্রশ্ন উঠেছে। আমি মনে করি ভারত সরকারের অবিলম্বে এই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কোন দেশ স্বীকৃতি, কোন দেশে সংগ্রামকে কি বলছে সেটা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই। ভারত সরকার কি করছেন সেটাই আমাদের বিচার্য বিষয় হওয়া দরকার। ভারত সরকার যদি স্বীকৃতি দিতে না চান বা গড়িমসি করেন তাহলে তার কঠোর সমালোচনা করা উচিত এবং ভারত সরকার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করা উচিত। আমি কংগ্রেস পক্ষের বন্ধুদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, এই প্রস্তাবে স্বীকার করা হয়েছে যে, ভারত সরকার ঠিকমত চলছেন না এবং আমরা প্রস্তাবে তার সমালোচনাও করেছি। এতোদিন হয়ে গেল তবু কেন ভারত সরকার সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও তার সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না? এখানে কেউলেউ চীনের সমালোচনা করেছেন। আমি মনে করি চীনের সমালোচনার বদলে ভারত সরকারের সমালোচনা করা উচিত। ভারত সরকার ভারতবাসীর কাছে দায়ী, ভারতবাসীকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য। ভারতবাসীরা চায় বাংলাদেশের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও তাঁর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। ভারত সরকার তা দিছেন না কেন? কি অন্তরায় আছে? ইন্টারন্যাশনাল না? আন্তর্জাতিক আইন? তাতে তো স্বীকৃতি দিতে বাধা নেই। ভূ খন্ড, জনসংখ্যা ও একটি সরকার হলেই আন্তর্জাতিক আইন একটি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে পারেন। এইসব বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আছে। আন্তর্জাতিক আইনেও যখন আটকায় না তখন ভারত সরকার স্বীকৃতি দিচ্ছেন না? কেন অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য দিচ্ছেন না ভারত সরকার? বলা হচ্ছে যে, অস্ত্রশস্ত্র দিইয়ে সাহায্য দিলে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়তে হতে পারে। কথাটাও ঠিক নয়, আপনাদের চোখের সামনে কি উদাহরণ নেই? স্পেনে যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল তখন সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক মানুষ স্পেন দেশের গণতান্ত্রিক মানুষকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য অস্ত্রশস্ত্র, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ইন্টারন্যাশনাল বিগ্রেডঃ কি পাঠায়নি? ভারত সরকারেরও যদি সত্যিকারের ইচ্ছা থাকে সাহায্য করার তাহলে তাঁরা পারেন না এই কাজ করতে? চীন কোরিয়াইয় মার্কিন আক্রমণ ঠেকাতে সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী পাঠায়নি? ভারত সরকার যদি সত্য সত্যি =ই সাহায্য করতে চাইতে তাহলে তুলে দিতেন না দেশের মানুষের হাতে অস্ত্র? যে আর্মস এক্ট দিয়ে গোটা জাতিকে নিবীর্য পঙ্গু করে রেখেছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা সেই অস্ত্র আইন চালু রেখে আজও জাতিকে পঙ্গু করে রাখা হচ্ছে না? সেই ঘৃণা আইন তুলে নিয়ে মানুষের হাতে অস্ত্র দিয়ে আওয়াজ তুলুন তোমরা স্বেচ্ছাসেবক হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করতে চলে যাও। দেখবেন হাজারে হাজারে স্বেচ্ছাসেবক যাবে। একেই বলে সক্রিয় সাহায্য করা। আমার মনে হচ্ছে ভারত সরকারের এই ব্যাপারে একটা কিন্তু আছে। এই কিন্তু অবিলম্বে দূর হওয়া দরকার যদি সত্যিকারের আমরা সাহায্য করতে চাই।
কিছু কিছু সমালোচনা এসে পড়ে। সরকার পক্ষের সদস্যরা ইন্দিরা শোড়কাড়েড় প্রগতিশীলতার কথা বলছেন। কিন্তু আমাদের দল বিশ্বাস করে না যে, ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস বা সরকার প্রগতিশীল। আমাদের স্থির স্বিদ্ধান্ত যে তিনি একটা প্রগতিশীলতার মুখোশের অন্তরালে থেকে ভারতবর্ষে ফ্যাসীবাদ কায়েম করার চেষ্টাই করছেন। আমরা সমাজ বিজ্ঞানের ভিত্তিতে এই স্বিদ্ধান্তে এসেছি। তার জন্য ভারত সরকারের ব্যাবহারে নানা উল্টাপাল্টা জিনিষ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি মৌখিক সমর্থন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে উল্টো ব্যাবহার – তার একটা প্রমান। যে সরকার বাংলাদেশের জন্য এত চোখের জল ফেলেও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছেন না সেই সরকার কিন্তু সিঙ্ঘলে অস্ত্র পাঠাতে বিলম্ব করেননি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিকদের অস্ত্র দিতে পারেন না। এটা ভন্ডামি নয়? ভিয়েতনামের মানুষ যেখানে স্বাধীনতার জন্য অতুলনীয় লড়াই করেছে সেই জায়গায় মানুষের সমর্থনে না এসে দক্ষিন ভিয়েতনামে যে মার্কিন পদলেহী সরকারআছে তার কাছে মোটর, ট্রাক ও আরও নানারকম সামরিক উপকরণ বিক্রয় করতে অনুমতি সেই সরকারই দিয়েছেন। এমনটা কেন হয়? হয় এই কারনে যে, ফরেন পলিসি ইজ আফটার অল দি প্রজেকশন অফ দি হোম পলিসি। যদি অভ্যন্ততীন নীতি প্রতিক্রিয়াশীল হয় তাহলে বৈদেশিক নীতিতে তা প্রতিফলিত হবেই। পুজিবাঁদকে শক্ত করাই যেখানে অভ্যন্তরীন নীতি সেখানে বৈদেশিক নীতি প্রগতিশীল হয় না। এই ভারত সরকারের এই ভাব। ভারত সরকার যে সাহায্যের কথা মুখে বলছেন এর একটা বিশেষ উদ্দ্যেশ্য এবং এক বিশেষ শ্রেণীর দৃষ্টি ও স্বার্থ নিহিত আছে, যে শ্রেণী শাসক ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণী। এটা যেন আমরা না ভূলে যাই। আর উদ্দ্যেশ্য হল, মৌখিক দরদ দেখিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করা। সে যাই হোক, আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশের আন্দোলনের গোড়ায় স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল না। প্রথমে মুজিব নেতৃত্বে চেয়েছিলেন প্রভিন্সিয়াল অটনমি উইদিন পাকিস্তান- পাকিস্তানের মধ্যেই পূর্ব প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন। যখন সে দাবি স্বীকৃত হল না, তখন এই দাবী পাকিস্তানের সামরিক চক্র মানল না বাধ্য হয়েই বাংলাদেশের মানুষ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করল এবং সেই শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনও বিশ্বের ইতিহাসে এক নজির সৃষ্টি করেছিল। গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে অশযোগ আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু সে আন্দোলনও এত ব্যালক রূপ ধারন করে নাই। মোট জনসংখ্যার তুলনায় সামান্য লোকই তাতে অংশগ্রহণ করেছিল; সর্বস্তরের মানুষ এতে যোগ দেয়নি। আর বাংলাদেশে দেখলাম সমস্ত স্তরের সাধারণ মানুষ শুধু নয়, সেখানকার পুলিশ, সেখানকার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, সেখানকার আমলাতন্ত্র এমনকি সেখানকার হাইকোর্টের জজরা পর্যন্ত এই অসহযোগ আন্দোলনে নেমে গেল, গোটা জাতি এই আন্দোলনে নেমে গেল। সেই আন্দোলনের তুলনায় ভারতবর্ষে গান্ধীজীর নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন নিঃসন্দেহে ম্লান। এমন অসহযোগ আন্দোলন পৃথিবীর আর কোথায়ও হয় নাই। তারপর তাতেও যখন হল না তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ বাধ্য হলেন সশস্ত্র সংগ্রামের পথে নামতে যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাঁদের উপর আক্রমণ শুরু করল, যুদ্ধ তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হল। যুদ্ধ মাত্রই খারাপ না। যারা প্যাসিফিস্ট বুর্জোইন ইলিউশনে ভূগেন তাঁরা যুদ্ধ মাত্রকেই ঘৃণা করেন। কিন্তু যুদ্ধ মাত্রই খারাপ নয়, এ ওয়ান মে আনিজাস্ট ওয়ার অফ এগ্রেশন, অর এ জাস্ট ওয়ার অফ ন্যাশনাম ইন্ডিপেন্ডেন্টস, এ জাস্ট ওয়ার ফর ইনম্যানসিপেশন অফ পিপ্ল ফ্রম সর্টস অফ এক্সপ্লয়টেশন অফ ম্যান বাই ম্যান।
ঘৃণা করতে হবে অন্যায় যুদ্ধকে, বিরোধিতা করতে হবে অন্যায় যুদ্ধকে, সমর্থন করতে হবে ন্যায় যুদ্ধকে। বাংলাদেশের মানুষ যে সংগ্রাম করছে, আমাদের এই প্রস্তাবে আমরা রেখেছি তা জাস্ট ওয়ার ফর ন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেন্স। জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ন্যায় যুদ্ধ। একে সমর্থন করতেই হবে আমাদের পশ্চিম বাংলার মানুষকে, পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী শান্তি আসতে পারে এই যুদ্ধবাজদের হীন চক্রান্ত পরাস্ত করে।
পাকিস্তানী সামরিক চক্র বাংলাদেশে যে কাজ সেটা যুদ্ধ নয়, গণহত্যা-জিনোসাইড। আন্তর্জাতিক আইনেও যা অপরাধ। কিন্তু এ কথাটা যেন না আসে যে, পাঞ্জাবী বিরুদ্ধে বাঙ্গালীরা লড়ছে বা বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে লড়ছে। লড়ছে স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিক মানুষ ফ্যাসিস্ট সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে। এখানে ধর্ম, বর্ণ উপজাতি প্রভৃতির প্রশ্ন আসে। তাই মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আমার বক্তব্য পরিস্কার। যে প্রস্তাব আমরা রেখেছি সেটা যে ন কাগুজে প্রস্তাবে না হয়। আর কাগুজে প্রস্তাবে যদি আমরা না করতেই চাই আমি আশা করব কংগ্রেস দলের সদস্যরাও আমাদের বিরোধী পক্ষের সদস্যদের সঙ্গে মিলে ভারত সরকারের উপর চাপ দেবেন। আমি মনে করি ভারত সরকার আজ পর্যন্ত মৌখিক সহানুভূতি ছাড়া বিশেষ কিছুই করেন নি। নৈতিক সমর্থন নিশ্চয় করতে হবে, কিন্তু তার দিন দীর্ঘদিন গত হয়েছে। আজকে স্বাধীনতা সংগ্রামকে অস্ত্র দিলে মেটিরিয়াল হেল্প বাস্তব কার্যকরী সাহায্য দেওয়া দরকার। এ লড়াই তাড়াতাড়ি শেষ হবে না। এ সংগ্রামকে জনযুদ্ধ হতেই হবে তাঁকে সফল হতে হলে; যার একদিকে সংগঠিত সশস্ত্র সেনাবাহিনী অন্যদিকে জনসাধারণ। এই জনযুদ্ধ স্থায়ী হতে বাধ্য। এই সংগ্রাম মদদ দিতে হলে আমাদেরও সেইভাবে সাহায্য দেবার দরকার আছে। ভারত সরকারকে যদি বাস্তব কার্যকরী সাহায্য দিতে বাধ্য করতে না পারি তাহলে আমরা কর্তব্যচ্যুত হব। এই প্রস্তাবে পশ্চিম বাংলা সরকার এবং মানুষকে সে কথা জানানো হয়েছে। একথা যেন মুখের কথা না হয়, এটা যেন কার্যকরী আন্দোলনে রূপ নেয়। সরকারপক্ষের সদস্য ও সরকার এবং সমস্ত মানুষকে এই অনুরোধ আমি করছি। আন্দোলন গড়ে তুলতে এ রাজ্যের মানুষকে আমি আহবান জানাচ্ছি।
শ্রী সামসুদ্দিন আহমেদঃ মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আজকে বাংলাদেশের উপর মাননীয় মূখ্যমন্ত্রী যে প্রস্তাব এনেছেন সেই প্রস্তাবে আমি সর্বান্তঃকরণে সমর্থক করে দু-একটি কথা বলতে চাই। স্যার, আমার কনস্টিটিউয়েন্সি একেবারে সীমান্তে অবস্থিত, তার নাম কালিয়া চক। এই কনস্টিটিউয়েন্সির ভেতর আমি নিজের চোখে দেখেছি অনেকগুলো শিবির সেখানে খোলা হয়েছে। এই সমস্ত শিবিরে ঘুরে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে যে বিবরণ আমি পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ঐ জঙ্গী শাসকগোষ্ঠী কি রকম অমানুষিকভাবে স্বাধীনতাকামী তথা গণতন্ত্রের বাহক বাঙ্গালী জনসাধারণের কন্ঠরোদ করতে কি অত্যাচার চালাচ্ছেন তার বিবরণ যারা এসেছেন তাদের কাছ থেকে আমি শুনেছি। এসব কথা বলতে গিয়ে তাঁরা অঝোরে কেঁদেছেন। স্বামী স্ত্রী হতে, শিশু মা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখানে এসেছেন। হয়তো স্বামী রয়ে গিয়েছেন বাংলাদেশে, স্ত্রী কোন প্রকারে চলে এসেছেন আমাদের পশ্চিম বঙ্গে। এ রকম করুণ বিবরণও আমি পেয়েছি।
আমি এই প্রসঙ্গে বলতে চাই যে, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী আমরা এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সেই শাসনের অধীনে বহুদিন থাকার পর নানারকম অনাচার, অত্যাচার সহ্য করার পর বাংলাদেশ তথা পূর্ব বাংলার জনমুখ উচ্ছসিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। সুযোগ পেয়েছিল নির্বাচনে মাধ্যমে এবং তার জবাব জনসাধারণ দিয়েছিল। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী আমরা এবং গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমরা বলতে চাই যেমন পৃথিবীর মানুষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে শান্তিতে এখন নিজের কথা চিন্তা করতে পারছে। তাদের মুখ থেকে শুনে আজ একথা বলতে চাই, তাদের অনেক এম এল এ, এম পি-র সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে যে বিবরণ পেয়েছি এবং অনেকে পেয়েছেন, আমার বিশ্বাস তাঁরা যে লড়াই করছে সে লড়াই তাঁরা করতে চায়নি সশস্ত্রভাবে। তাঁরা চেয়েছিল অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে, শান্তির মাধ্যমে গণতন্ত্রের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন, যাতে তাঁরা নিজেদের কথা নিজেরা চিন্তা করতে পারে সেইরকম সুযোগসুবিধা নেওয়ার কথা তাঁরা চিন্তা করেছিল। কিন্তু আমরা জানি এবং খবরের কাগজ থেকে দেখেছি এবং তাদের কাছ থেকে শুনেছি যে নেতা মুজিবুর রহমান যে প্রস্তাবগুলি রেখেছিলেন সে বিষয়ে আলোচনা করার অভিনয় করার জন্য জঙ্গীশাহী ইয়াহিয়া সাহেব এসেছিলেন এবং তার সারেদ ভূট্টো সাহেবও এসেছিলেন। তারপর আলোচনা চলতে চলতে হঠাৎ ভূট্টো সাহেব অন্তর্হিত হলেন এবং ইয়াহিয়া সাহেবও অন্তর্হিত হলেন এবং তার বদলে রেখে গেলেন- কি রেখে গেলেন? রেখে গেলেন সশস্ত্র ঐ সৈনিকদের যারা শিশু, মাতা, স্বামী, পুত্র সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলী করে মারল। সবচেয়ে দুঃখের কথা সেখানে যারা শিক্ষক, শিক্ষিত সমাজ এবং যারা ছাত্র যারা যুবক, যারা আইনবিদ, যারা বৈজ্ঞানিক, যারা ইঞ্জিনিয়ার, সবাইকে তারা গুলী করে মেরেছে। তাদের এক একটা করে ধরে শ্যুট ডেড করেছে। কোন প্রশ্ন নেই, কোণ ট্রায়াল নেই, তাদের গুলি করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে শোনা কথা যে, যাকে সন্দেহ করা হয়েছে রাস্তার উপর তাঁকে গুলী করে মারা হয়েছে। যাকে সন্দেহ করা হয়েছে ছাত্র তাঁকে গুলী করা হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে সন্দেহ হয়েছে যাকে যাকে, তাঁকে গুলী করে মারা হয়েছে। সাধারণ মানুষ, সবাই তো আর পার্টির সমর্থক নয়, প্রতিটি মানুষ তো পার্টির সভ্য নয়, তাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে তাদের নিজেদের মত ব্যাক্ত করেছিল। এই রকমভাবে তাঁরা বলি হয়েছে সেই জঙ্গী শাসনে কাছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, আমরা প্রবনতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এই আইনসভায় অনেক কথা বলে চলেছি। অনেক প্রশ্ন উঠেছে, অনেক সন্দেহের কথা উঠেছে। কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে যে প্রশ্নটা এখানে উত্থাপন করতে চাচ্ছি মাননীয় স্পীকার মহাশয় আপনার মাধ্যমে। আমরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যা দেখতে পাচ্ছি তা সকলেই জানেন যে, ইয়াহিয়া খান মদদ কোথা থেকে পাচ্ছে, কোন কোন দেশ অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে। আজকে দেখতে পাচ্ছি যে, গ্রামদেশে ছোট ছোট ছেলেরা মুজিবের লাল সেলাম বলছে, জয় বাংলা লাল সেলাম বলছে। কিন্তু আজকে বিরোধী দলের নেতা যিনি এখানে উপস্থিত আছেন তাঁকে আমার স্বঅনুরোধ জানাচ্ছি এবং তাঁকে দয়া করে বুঝতে বলছি, আজকে ইয়াহিয়া খান এই নিরপরাধ জনসাধারণকে অস্ত্রের দ্বারা গুলী করে হত্যা করছে তাঁকে লাল সেলাম কে জানাচ্ছে? জানাচ্ছে চীন। চীন আজকে মদদ জানাচ্ছে ইয়াহিয়া খানকে। তাই আমি বিরোধী পক্ষের নেতাকে অনুরোধ করছি যে, তিনি দয়া করে চীনের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিদের অনুরোধ করুন যাতে ইয়াহিয়া খানকে মদদ দেওয়াটা বন্ধ করেন। সর্বশেষে আমি এই প্রস্তাবকে সর্বান্তঃকরনে সমর্থন করে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
শ্রী সুধীন কুমারঃ মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়, যে প্রস্তাব মাননীয় সদস্য শ্রী অজয় মুখোপাধ্যায় আমাদের হাউসে পেশ করেছেন এবং সেটা আমাদের সদস্য শ্রী জ্যোতি বসু সমর্থণ করেছেন সেই প্রস্তাব সম্পূর্ণ সমর্থন করে আমি কয়েকটি কথা আপনাদের সামনে পেশ করতে চাই। আমাদের এই হাউসে অনেকে খুব উৎসাহের সঙ্গে বলছেন যে, এত বড় গণসমর্থন ইতিপূর্বে খুব কম দেশেই দেখা গেছে সেখানে আন্দোলন শুরু হবার পর থেকে এত ব্যাপক এবং এত ঐক্যবদ্ধ সমর্থন আন্দোননের পিছনে আছে। এখানে আরো অনেক তর্কের কথা উঠেছে। কিন্তু সেই তর্কের অবসান ঘটবে যদি আমরা আন্দোলনে ইতিহাসটুকু একটু দেখি। এই আন্দোলন হঠাৎ শুরু হয়হয়নি। নির্বাচনের উৎসাহের কথা আমাদের প্রস্তাবে দেওয়া আছে। কিন্তু সেই নির্বাচনের আগে দীর্ঘ ২০ বছরে সংগ্রামের ইতিহাস পূর্ব পাকিস্তানের আছে। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিন থেকে যেদিন জিন্না সাহেব ঢাকায় গিয়ে ঘোষনা করলেন যে, পাকিস্তানে একটি মাত্র ভাষা হবে, সে ভাষা হবে উর্দু ভাষা সেদিন থেকে পূর্ববাংলার গণআন্দোলন এটাকে স্বীকার করে নেয়নি। তাঁরা বুঝেছিল যে, তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টা পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী করছেন এবং সেদিন থেকে আন্দোলনের নানা দিক প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ভাষার ব্যাপারে আমরা আন্দোলনের ইতিহাস দেখেছি। ১৯৫০ সালে যে কৃষক আন্দোলন হয়েছিল, আমাদের এই হাউসে তার একজন অন্যতম নেতা উপস্থিত আছেন এবং তাদের আহবানে রাজশাহী জেলে যে গুলী চলেচিল সেই গুলী খাওয়া মানুষ এখনও আমাদের এই হাউসে উপস্থিত আছেন। গত হাউসে আর একজন ছিলেন যিনি ঐ আন্দোলনের নেতা ছিলেন। ১৯৫২ সালে সেই আন্দোলনে ১৩ জন ছাত্র এবং শ্রমিকদের মধ্যে কিঞ্চিত নিহত হয়েছিলেন। তারপরে ওরা প্রথম নির্বাচন করতে বাধ্য হয়। সেই সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ভোটাধিকারের মধ্যে নির্বাচন হয়। কিন্তু নির্বাচন হলে কি হবে- যে সরকার তখন গঠিত হয়েছিল, সেই সরকার বুঝতেন যে, চলতে দেওয়া হবে না এবং সেই নির্বাচনে- যে মুসলিম লীগের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, গণআন্দোলনের ফলে পূর্ববাংলার ইতিহাস থেকে তারা মুছে গেছে। সেদিন সেখানে জয়যুক্ত হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট, যে যুক্তফ্রন্টের মধ্যে সম্মানীয় ফজলুল হক সাহেব ছিলেন এবং আরো অন্যান্য নেতারা ছিলেন। এবং কৃষক শ্রমিক বাঁচার জন্য যে গভর্নমেন্ট গঠন করেন তাঁকে চলতে দেওয়া হয়নি, সেই কুখ্যাত সেকশান ৯২ ব্যাবহার করে তাঁকে বাতিল করে সেই গভর্নমেন্টকে ভেঙ্গে দিয়ে ইস্কান্দর মির্জাকে পাঠিয়ে সেখানে স্বেচ্ছাচারী শাসন কায়েম করেছিল। তার পরবর্তী ইতিহাস হচ্ছে ১৯৫৬ সালে সাধারণ নির্বাচন- তারপর সমস্ত পাকিস্তানে এই প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়েছে এবং সেখানে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। মুসলিম লীগের সে চেহারা ছিল না এবং আতাউর রহমান সেখানে চীফ মিনিষ্টার হয়েছিলেন এবং ফজলুল হক সাহেব গভর্নর হয়েছিলেন। পরবর্তী ইতিহাস আপনাদের স্মরণে আছে যে কেমন করে সেখানে গভর্নমেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে ভাসানী সাহেব, আবদুল গফফর সাহেব তাঁদের জেলে পাঠানো হয় এবং কেমন করে সেখানে গভর্নমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হয়। তারপর ১৯৬২ সালে সেখানে ছাত্ররা আন্দোলন করেছিলেন কুখ্যাত এডুকেশন রিপোর্ট বাতিল করার জন্য এবং তখন থেকেই গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের দাবীতে ঢাকার রাস্তায় আন্দোলন শুরু করেছিল। এবং তারই সেই প্রতিবাদের চেহারা দেখে আয়ুবশাহী সেখানে নতুন কনস্টিটিউশন এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবার গণতন্ত্রের নামে তার সেই তথাকথিত গণতন্ত্র, সেটা বেসিক ডেমোক্রেসি তাঁরা বলতেন, তাঁরা সেইটা দিয়ে চালাবার চেষ্টা করেছিলেন, পুরো গণতন্ত্র দেন নাই, সীমাবদ্ধ গণতন্ত্র দিয়েছিলেন তাই চালাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বিশেষ করে পূর্ববাংলায় গণআন্দোলন তীব্রভাবে দেখা দিয়েছিল। সেই আন্দোলনের ইতিহাস বেয়ে ১৯৬৩ সালে ইতিপূর্বে সিক্স-পয়েন্ট প্রোগ্রাম ইনিসিয়েট করেন অল্প দিনের মধ্যেই সেই ছ-পয়েন্ট ধরে তাঁদের ১১ দফা সাবী তাঁরা তুলে ধরেছিলেন। এই দীর্ঘ ইতিহাসের পরিণতি আজ পূর্ব বাংলায় বিরাট গণআন্দোলন তথামুক্তি আন্দোলন সেখানে শুরু হয়েছে। সুতরাং এটা হঠাৎ ঘটেনি। একজন ব্যাক্তির নেতৃত্বে হঠাৎ নির্বাচনে জয়ের ভেতর দিয়ে এটা ঘটেনি। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে রক্ত দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য বহন করেছেও, এ পারে বন করে নতুন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ভারতবর্ষ সৃষ্টি করেছিল ওপারেও তাঁরা সেই ঐতিহ্য বহন করেছে, স্বাধীনতাএ জন্য লড়াই করেছে, যেমন আমরা লড়েছিলাম। তাঁরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতার লড়াই এর জন্য অগ্রসর হয়ে এসেছিলেন। সেইজন্য আমরা দেখেছি এটা বিরাট আন্দোলনের চেহারা। দিত্বীয়ঃ এই আন্দোলনে একটা জিনিস এসেছে- ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছে। এই ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে লড়াই-এর চেহারা আর একটা টেনে নেওয়া দরকার- ন্যাশনাল কোশ্চেন সেখানে এখন আবির্ভূত হয়েছে। শোষনের ইতিহাস এই আচরণের মধ্য দিয়ে এখানে এসেছে। আমি সেটা এখানে তুলে ধরতে চাচ্ছি। পূর্ববাংলার অধিবাসীদের তারা জাতিগতভাবে কিভাবে অপেশান করছে, এক্সপ্লয়েট করেছে তাঁরা তার একটি বিবরণ দিয়েছেন। রাজস্ব খাতে ব্যায় যেখানে এক হাজার পাঁচ শো কোটি টাকা সেখানে পশ্চিম পাকিস্তান রাজস্ব খাতে ব্যায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়ন খাতে বাংলাদেশে ব্যায় তিন হাজার কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানে হচ্ছে ছয় হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক বাণিজ্যের আয় আসে শতকরা ২০ ভাগ বাংলাদেশে আর শতকরা ৮০ ভাগ যায় পশ্চিম পাকিস্তান। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির শতকরা ৮৫ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকারে আর শতকরা মাত্র ১৫ জন বাংলাদেশের অধিবাসী পায়। সামরিক বিভাগের শতকরা ৯০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী আর মাত্র ১০ জন বাংলাদেশের লোক। চালের দাম যেখানে ৫০ টাকা বাংলাদেশে সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে ২৫ টাকা। আটার দাম পশ্চিম পাকিস্তানে যেখানে ১১৫ টাকা, বাংলাদেশে সেখানে ২৫ টাকা। সরিষার তেল বাংলাদেশে হচ্ছে ৫ টাকা আর আড়াই টাকা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। সোনার দাম বাংলাদেশে ১৭০ টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানে সেই সোনার দাম ১৩৫ টাক এবং এই যে বৈষম্য তাঁরা তুলে ধরেছেন, এই যে জাতিগতভাবে তাঁদের উপর বৈষম্য দেখানো হচ্ছে- এই যে পক্ষপাতদুষ্ট সরকার এবং তার অত্যাচারের যে কাহিনী সেটা আরও অনেকে বলেছেন তার পুনরাবৃত্তি আমি করতে চাই না- সেই জন্য সেখানে এই জাতীয় প্রশ্ন এসে গেছে। যে জাতীয় প্রশ্ন আমাদের দেশে সেইভাবে নেই এবং এই জাতীয় প্রশ্ন থাকার জন্য সেখানে এই বিরাট সমর্থন দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস এবং এই অবস্থায় আমরা আজ তাঁদের সমর্থন জানাতে গিয়ে যে সমস্ত কথা বলেছি, আমরা আশা করি যে, যদিও উভয় পক্ষ থেকেই বলছি, তারা যা যে উদ্দ্যেশ্য নিয়েই বলে থাকুন আশা করা যায় আগামী দিনে তার পরীক্ষা তাঁরা নিবেন। আগামী দিনে, যারা আজ এখানে প্রতিবাদ করেছেন, তাঁরা সমর্থন আনান। তাঁরা বাস্তব পত্রে তার পরিচয় দেবেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত বা আজকে উঠেছে বলে উল্লেখ করার দরকার এবং যেটা আমাদের কর্তব্য, এখানে গভর্নমেন্ট পক্ষের সমস্ত দল এটা সমর্থন করেছেন, কিন্তু আমি যতদূর জানি যে গভর্নমেন্ট পক্ষের অন্ততঃ মুসলিম লীগের, যাদের ওখানে সে ভূমিকা। সেই ভূমিকা থেকে তাঁরা নিজেদের যদি পৃথক করতে চান, নিশ্চয় সেই অধিকার তাঁদের আছে এবং এটাকে সমর্থন করছে, আমি আশা করি তাঁদের ভূমিকা কোথায়, সেটা জানাবার জন্য, বাংলাদেশের যে একটিমাত্র মিশন আমাদের দেশে আছে, সেই মিশনে গিয়ে এরা তো তাঁদের সমর্থন জানিয়েছেন বলে শুনিনি। আমরা তো শুনিনি তাঁদের পক্ষে এই আন্দোলনে বাংলাদেশের সংবাদ আছে, মিটিং এর ক্ষেত্র আছে, বিরাট ময়দান আছে- অনেকেই তো সমর্থন জানিয়েছেন প্রকাশ্যে কিন্তু ওদের পক্ষ থেকে কাউকে তো সেই বিরাট আন্দোলনকে অভিনন্দন জানাতে শুনিনি। সেটা যদি আজও না শুনে থাকি কালকে যদি তার পরিচয় দেন তাহলে আমরা খুশি হব। কিন্তু সেই পরিচয় আমরা পাইনি। সেই জন্য এই হাউসের সামনে যদি আমাদের সকলের কর্তব্য স্মরণ করার সঙ্গে এটাও আমরা মনে করি যে, সরকার পক্ষ থেকে যখন এত অকুন্ঠ সমর্থনের কথা বলা হচ্ছে, তখন যে মুসলিম যোদ্ধার গাড়ি নিয়ে এসেছে এখানে, সেই গাড়ি কেন এসডিও বাজেয়াপ্ত করেছে সামান্য রেশন কার্ড চাইবার জন্য, তাঁরা আমদের এই হাউসের সদস্য গভর্নমেন্ট নেতাদের কাছে গেছেন, তাঁদের বলা হয়েছে দরখাস্ত করুন, মশারি চাওা হয়েছে যে সমস্ত যুবক সেখানে থেকে লড়ে এসেছে গায়ে ক্ষত আছে, যারা হাঁসপাতালে আছে তাঁরা কিছু সাহায্য চেয়েছে, তাঁদের বলা হয়েছে দরখাস্ত কএউন। একজন একটা সরকারী হাসপাতাল থেকে পরশুদিন আমার কাছে টেলিফোন করেছিলেন যে, তার ব্যাবহার্য একটু সাবানও তাঁরা পাননি। আমাদের সেটুকু যোগান দিতে হবে। সরকারী সদিচ্ছার প্রমান এর মধ্যে দিয়ে পাওয়া যায় না, যদি তা প্রমান করতে হয় তাহলে তার ব্যবস্থাতেও করা উচিত। প্রস্তাব ভাল জিনিষ, কিন্তু প্রস্তাবের সঙ্গে তার ব্যবস্থা নেবার দায়িত্ব আশা করি মূখ্যমন্ত্রী যিনি এই প্রস্তাব রেখেছেন তিনি লক্ষ্য রাখবেন। শেষ পর্যন্ত যদি কেন্দ্রীয় সরকার না মানেন- এখানে এই হাউসে আহবান করা হয়েছে যে, যেন বাংলাদেশে যে গণআন্দোলন চলছে কেন্দ্রীয় সরকারকে তাঁরা যেন চাপ দেন এবং বাধ্য করেন যাতে আমাদের দাবী মেনে নেন। সেখানে আমরা সেই সততার পরিচয় দিতে বলবো যে, যদি ধর্মঘট করার প্রয়োজন হয়, যদি বাংলাদেশের সাধারণ ধর্মঘট করার প্রয়োজন হয় বাংলাদেশের মানুষ গণআন্দোলননের মাধ্যমে যেভাবে তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে এবং রায় দিতে অভ্যস্ত সেই পথ যদি নিতে হয়, আশা করবো যে, সরকার পক্ষের সমস্ত দল যারা আজকে এই প্রস্তাবে পক্ষে, তারাও সেই সাধারণ ধর্মঘটে তাদেরো সমর্থন জানিয়ে, আজকের এই প্রতিশ্রুতির পরিচয়স্বরূপ রাখবেন।
শ্রী সংকর ঘোষঃ মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আজকে যে প্রস্তাব মূখ্যমন্ত্রী করেছে তা আমি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করছি। বাংলাদেশে যে আন্দোলন হচ্ছে, সেই আন্দোলনের নজীর ইতিহাসে নাই এবং এই যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, এই আন্দোলনের মাধ্যমে মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক সমাজবাদী ব্যাবস্থা করতে চেয়েছিলেন।
মুজিবুর রহমান প্রথমে সহস্ত্র বিলবের কথা ভাবেননি। মুজিবুর যখন আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তখন তিনি অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন। পাকিস্তানে তখন কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল না। মুজিবুর রহমানকে তাই গণআন্দোলন করতে হয়েছিল, তাতে আয়ুব খাঁ ক্ষমতা হারায়। তারপর ইয়াহিয়া খাঁ আসেন এবং সেই গণআন্দোলনের জন্য ইয়াহিয়া খাঁকে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। সেই নির্বাচনে মুজিবুর রহমানের দল বাংলাদেশে ১৬৯ টি আসনের ভেতর ১৬৭ টি আসন পায়।
এত বড় বিরাট জয় নির্বাচনের ইতিহাসে কোন দিন হয়নি। এর কারন আছে। মুজিবুরের যে সংগ্রাম সেই সংগ্রাম সর্বাত্বক ছিল। সেই সংগ্রাম কেবলমাত্র অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, রুটিরুজির সংগ্রাম ছিল না, কেবলমাত্র পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছিল না, সে সংগ্রাম সাংস্কৃতিক সংগ্রাম ছিল, যে সংগ্রামের ভিত্তি ভাষা আন্দোলন ছিল এবং সেই সংগ্রাম সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সংগ্রামের সমন্বয়। তারই জন্য বাংলাদেশ একটা অভূতপূর্ব একতা দেখা যায়। এই জন্য মুজিবুরের সংগ্রামকে সর্বস্তরের মানুষ সহায়তা করল। আজকে আমরা মুজিবুরের সংগ্রাম থেকে যে শিক্ষা লাভ করেছি সেটা হল এই যে, যে দেশে গণতন্ত্র নেই সেখানে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা আসে।
আমাদের ভারতবর্ষের ব্যবস্থা সম্বন্ধে অনেক বক্তা বলেছেন যে, এখানে ফ্যাসিজম রয়েছে, গণতন্ত্র নেই। আমি বলব তাঁরা বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে কথা বলছেন্না। মুজিবুর বাংলাদেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তিনি আশা করেছিলেন যে, সামরিক সরকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন। মুজিবুর বাংলাদেশে প্রথমে স্বাধীনতা ঘোষনা করেননি, সশস্ত্র বিপ্লবের পথ নেননি। ২৫শে মার্চ যখন মুজিবুরের দলকে বেআইনী ঘোষনা করা হল, মুজিবুরকে দেশদ্রোহী বলা হল তারপর মুজিবুর সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বললেন। সুতরাং মুজিবুরের আন্দোলন থেকে একথা আসে যে, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া কোন পথ নেই, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। মুজিবুর প্রথমে অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন এবং আশা করেছিলেন যে এই অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র স্থাপিত হবে।
আমাদের ভারতবর্ষে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের পর এই বাংলাদেশে কংগ্রেস সরকার পরাজিত হয়েছিলেন এবং যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করেছিলেন। তার জন্য কোণ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের দরকার হয়নি, সেটা সংবিধানের ভেতর দিয়ে হয়েছিল। সেই যুক্তফ্রন্ট সরকার যখন এলেন তখন তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, তাঁদের সংখ্যা ছিল ২১৮। এত বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোন সরকারের ছিল না। এই যুক্তফ্রন্ট সরকার যখন এলেন তখন কংগ্রেস দল তাঁদের বাধা দেয়নি, কোন রক্তপাত হপয়নি, বোমা, পিস্তল ছোঁড়া হয়নি।
এবারেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার এলেন গণতান্ত্রিক পথে। সুতরাং আজকে এই, গণতন্ত্র হত্যার কথা উঠেছে সেই হত্যা কারা করছে সেটা একটু অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করুন, বাস্তব অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখুন।
অত্যন্ত দুঃখের কথা এই যে, এই প্রস্তাব সমর্থনের ভিত্তিতে সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম প্রস্তাবটা সর্ববাদীসম্মতভাবে এসেছে, এর ভেতর কোন বিভেদ, আক্রমণ, সমালোচনা থাকবে না। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম বাংলাদেশের কথা ছেড়ে অনেক কথা এখানে হয়ে গেল। সুতরাং এই যে বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশের কথাই আমি বলতে চাই। এই বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করার জন্য এই সভা যে প্রস্তাব এনেছে তাকে সমর্থন করে আমি এই কথা চাই যে, এই গণহত্যাকে ধিক্কার দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রসংঘে ৯ই ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে। তখন রাষ্ট্রসংঘে একটা প্রস্তাব আনা হয়েছিল গণহত্যাকে বেআইনী ঘোষণা করে এবং তাতে একথাও বলা হয়েছিল যে, দেশে গণহত্যা চলবে রাষ্ট্রসংঘের অধিকার থাকবে যে সে দেশের গণহত্যা বন্ধ করবার জন্য ব্যাবস্থা নেওয়ার এবং সে প্রস্তাব যখন পেশ করা হয়েছিল তখন পাকিস্তানের যে সদস্য ছিলেন তিনি সেই প্রস্তাব বিশেষভাবে সমর্থন করেছিলেন এবং রাষ্ট্রসংঘের সেদিনের সভায় তিনি অনেক করতালি পেয়েছিলেন। সুতরাং পাকিস্তান বলছে যে, বাংলাদেশের যে গণহত্যা চলছে, জেনোসাইড চলছে তাতে রাষ্ট্রসংঘের কোন এখতিয়ার নেই হস্তক্ষেপ করার সেটা তার স্ববিরোধী। রাষ্ট্রসংঘের চ্যাপ্টার-সেভেনে আছে যে, সেখানে যুদ্ধের আশংকা রয়েছে, শান্তি বিঘ্নিত হবার আশংকা রয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রসংঘ ব্যাবস্থা নিতে পারেন। সুতরাং আমি আমরাশা করি রাস্ট্রসংঘ দেরীতে হলেও এ ব্যাপারের প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেবেন। আমরাও আশা করি যে, ভারত সরকার তাঁদের স্বীকৃতি দিবেন। দুঃখের বিষয়, লালচীন যে পিপল ও লিবারেশনের কথা বলে তাঁরা বাংলাদেশের পিপলের লিবারেশনের জন্য বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য একবারও এগিয়ে এলেন না।
শ্রীরাম চ্যাটার্জিঃ স্পীকার মহাশয়, আজ বাংলাদেশে পূর্ব বাংলায় যে স্বাধীনতা সংগ্রাম সেই মুক্তি সংগ্রামকে পুরোপুরি সমর্থন করতে গোটাকতক কথা বলবো। পূর্ব বাংলা আমার রক্ত আমার খুন, আমার প্রাণের বাংলা। সেখানে বাঙ্গালীরা লড়ছে, তাঁরা মরছে, তার মাথা নত করছে না মুক্তির জন্য। নাড়ীর যোগ আছে, রক্তের যোগ আছে তাঁদের সাথে। সাথে সাথে আছে নাড়ীর সম্বন্ধ। ওই যে পূর্ব বাংলার মানুষ করাচীর একটা কলোনীতে পরিনত হয়েছিল, ব্যাথায় ব্যাথায় মানুষ সেখানে নিষ্পেষিত হচ্ছিল। বলবো, হে পূর্ব বাংলার মানুষ, সমব্যাথী হিসাবে এখানকার এই পশ্চিম মানুষ দিল্লীর কলোনিতে পরিণত হয়েছে। পাঁচ শত কোটি টাকা এখান থেকে সমস্ত নিয়ে যাচ্ছে, মাত্র ৫০ কোটি টাকা দিয়ে দিচ্ছে। আর আমরা চাতক পাখির মতো ‘হা, হা, হা’ করে চেয়ে থাকি। আমাদের আকাশে বাতাসে কি দেখি? আমরা প্রতিনিধি হয়ে এসেছি, যখন নির্বাচিত হয়ে যাই, নির্বাচিত প্রতিনিধি গিয়ে কি দেখে, না খেয়ে মানুষ কুঁকড়ে পড়ে আছে, বিক্ষোভ আর বিক্ষোভ। চারদিকে বিক্ষোভ দেখছি, শুনছি, আরও দেখছি। হিমালয় থেকে নেমে এসেছে একদিকে গঙ্গা, আর একদিকে পদ্মা। পদ্মায় যে কারেন্ট রয়েছে, সেই কারেন্ট চলেছে পূর্ববাংলাকে বিধৌত করে, আর আমাদের গঙ্গায় চরা পড়ে গিয়েছে। সেই পদ্মায় বান ডাকবে, সেইদিন যারা নির্মম্ভাবে আমাদের উপর অত্যাচার করে যাচ্ছে তারা টিকবে না, ওই কারেন্টে ভেসে যাবে, আমাদের সরকারের সাহস হবে না। চীনের কথা বলবো না, রাশিয়ার কথা বলবো না, আমি এ দেশের মানুষ, ভারতবর্ষের কথা বলবো। আমার সরকার কি করছে? সাথে মানে প্রশ্ন জাগে, প্রশ্নয়টা হচ্ছে এই, কেন অস্ত্র দিচ্ছে না? কারন লুঙ্গি পরা মানুষগুলো, চাষী –মজুর তাঁরা একসাথে লড়ছে। তাঁদের হাতে অস্ত্র পড়লে না জানি কি হয়। পূর্ব বাংলা মুক্ত করে হয়ত সেই মানুষ এগিয়ে আসবে সেই অস্ত্র নিয়ে। এটা সন্দেহ জাগছে মনে। এটা কি সত্য? এতদিন হয়ে গেল। রেডিও মারফত চারদিকে আওয়াজ, কান্নার আওয়াজ, গানের আওয়াজ। ক্ষুদাতুর শিশু চায় না কিন্তু খালি দুটো ভাত, একটু নুন। কিন্তু সেখানকার মানুষ চায় অস্ত্র, বুলেট। কারণ তাঁরা চাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানী যারা তাঁদের উপর অত্যাচার করছে তাঁদের হাত থেকে বাঁচতে চায়। কিন্তু আমরা এখানে ত্রান করছি- তাঁদের আমরা ত্রানকর্তা নই। তাঁরা বলছে, আমাদের মুক্তির জন্য অস্ত্র দাও। আমাদের অভ্যাস আছেরিলিফ দেওয়া কিন্তু রিলিফ চায় না, অস্ত্র চায়, কিন্তু তা দেওয়া হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জনসাধারণ কত সুন্দর। বাচ্চা ছেলে দুলিটার নিয়ে যাচ্ছে কোথায়, না গাছতলায়, কেউ আবার জলখাবার থেকে দু’খানা কাপড় কিনে যাচ্ছে। কিন্তু আজকে পূর্ববাংলার অধিবাসীদের বলছি, মীর জাফরের দল রয়েছে- ঐ মুসলিম লীগ- যে দে উইল স্ট্যাব ফ্রম ব্যাক। আমরা জানি পশ্চিম ও পূর্ববাংলার আকাশে-বাতাসে বেঈমান ছড়িয়ে আছে- এসেম্বলী হাউসের ভিতরে কি বাইরে চারদিকে বেঈমান ছড়িয়ে আছে। তাই বলছি হুঁশিয়ার হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা এক কথায় নিশ্চয়ই সমর্থন করবো ভারত সরকার তাঁদের যা কিছু সশস্ত্র সাহায্য দিক এবং সাথে সাথে আমাদের অপোজিশন থেকে স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে যাবে রক্ত দান করার জন্য, আমার নিজের এক্সপিরিয়ান্স হচ্ছে, আমরা নিজেরা গিয়েছিলাম ডাইরেক্টর অব মেডিকেল কলেজের কাছে, ১০-১৫ হাজার লোক দরকার রক্ত দেবার জন্য। কিন্তু তিনি বললেন ৫০ জনের বেশি নিতে পারি না, কারন আমাদের রক্তে নাকি দোষ হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমাদের রক্ত গেলে যদি সেটা বিরুদ্ধে যায়, কারণ আমাদের রক্তে গেলে নাকি দোষ হয়ে গেছে। আজ আপনারা যে হাসছেন এ হাসি মিলিয়ে যাবে। কিছুদিন আগে আমি পাড়াগাঁয়ে গিয়েছিলাম সেখানে একজন বুড়ি বললে যে, তোমাদের দেশের লোক সব মাতাল হয়ে আছে। আগে একটা বোতল ছিল তাতে কিংকং মার্কা ছবি ছিল। সেটা একটা বিশ্রী ভদ্রলোকের ছবি ছিল বলে চলছিল না, সেজন্য তাঁরা সে বোতলে একটা ভাল ছবি দিল এবং লোকেও সে খেয়ে নিল। কিন্তু তাতে ভারতবর্ষের বেশিরভাগ আদিবাসীর নেশা কেটে গেল। তাই আজকে বুঝতে পারবেন এ ইন্দিরা মার্কা বোতল খেয়ে লোকের নেশা একদিন কেটে যাবে এবং সেদিন বুঝতে পারবে কোনটা কি? এটাই হবে চোলাই মদের জবাব। এই বলে আমি এইটাকে সমর্থন করছি।
শ্রী বিশ্বনাথ মুখার্জিঃ মাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহাশয় যে প্রস্তাব এখানে উত্থাপন করা হয়েছে আমি তাঁকে সমর্থন করে সোজাসুজি এই প্রস্তাবের মূল কথা সেটা সম্বন্ধে বলতে চাই। আমরা এই বিধান সভায় ভারত সরকারের কাছে দাবী করছি যে, “ অনতিবিলম্বে বাংলাদেশে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও তাহার সরকারকে স্বীকৃতি এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় কার্যকরী সাহায্য দিতে হইবে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নরনারী যখন বুকের রক্ত দিতেছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ইহার কমে কিছুতেই রাজী হতে পারেন না। ” তা আজকে আমরা সকলেই একমত যে, আমরা বাঙ্গালী সেইজন্যই নয়, আমরা সকলেই মানি যে, বাংলাদেশের লড়াই তাঁদের জাতীয় স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের লড়াই, প্রগতির লড়াই। পৃথিবীর যে- কোন দেশে গণতন্ত্র, প্রগতি এবং স্বাধীনতার লড়াই, এবং তাঁদের ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী, প্রগতিশীল জনসাধারণ চিরদিন সর্বান্তঃকরণে তাকে সমর্থন করেছে আর এ তো আমাদের পাশে, শুধু নয় আমাদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক আছে, সুতরাং আমাদের সকলে মিলে এখানে এই চেষ্টাই করা দরকার যে, কি করে এটা সফল হয় এবং যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি সফল হয়। যত লক্ষ লক্ষ লোক সেখানে মরছে। প্রাণ দিচ্ছে, আরো হয়ত অনেক দিতে হবে এবপং যত বেশী তাঁকে সাহায্য করা সম্ভব, যত তাড়াতাড়ি তাঁরা জিততে পারে সেটাই আমাদেরসকলের কাম্য। আমাদের সকলেই উদ্বিগ্ন যে, ওখানে কোটি কোটি মানুষের অভ্যুত্থান তাঁকে সামরিক শাসকচক্র অস্ত্র দিয়ে দমন করছে, তবু সেখানে নিরস্ত্র মানুষ যেটুকু অস্ত্র পেয়েছে তা দিয়ে তাঁরা বীরের মতো লড়ছে, আমরা উদ্বিগ্ন এই জন্য যে আমরা এত বড় রাষ্ট্র তার পাশে রয়েছি আমরা এই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে স্বীকার করছি না কেন? আমরা এই সার্বভৌম রাষ্ট্রের জনগন যাতে জয়যুক্ত হতে পারে তার জন্য যথেষ্ট সাহায্য দিতে অগ্রসর হচ্ছি না কেন? আমি বলছি না যে কিছুই সাহায্য দেওয়া হচ্ছে না। ভারত সরকার নানাভাবে সাহায্য সমর্থন জানিয়েছেন, সাহায্য হয়তো কিছু কিছু দিচ্ছেন কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন এই জন্য যে, যথেষ্ট সাহায্য দেওয়া হচ্ছে না। দিতে হবে এবং একথা ঠিক যে, শুধু চাল ডাল পাঠানোই নয়, ঔষধ কিছু দরকার হতে পারে, কিন্তু প্রধান সাহায্য তাঁরা চাচ্ছে অস্ত। যত লোক এসেছে, ফিরে গিয়েছে বা এখনও এখানে আছে, সকলের কাছ থেকে আমরা শুনছি যে আমাদের অস্ত্র দাও, বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দাও। এই সূত্রে আমি একটা কথা বলতে চাই, এই রকম লড়াই যখন হয় তখন বেছে মানুষ লড়ে না, তখন ব্যাপকভাবে মানুষ লড়তে চায় এবং তার সম্প্রদায় যাই হোক, তার রাজনৈতিক মতবাদ যাই হোক, সে যদি স্বাধীনতার জন্য লড়ে তাহলে তাঁকে লড়তে সাহায্য করতেই হবে। পূর্ব পাকিস্তানের, এখন বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি তাঁরা প্রকাশ্যে আহবান জানিয়েছে ওখানকার স্বাধীনতার যুদ্ধে সমস্ত স্বাধীনতাকামী দলের মোর্চা গঠনের এবং সেখানে আমাদের এ কর্তব্য নয় যে, কার কি রাজনৈতিক মত সেই বেছে সাহায্য করা। সেখানকার মানুষ যারা লড়ছে, লড়তে চায় এবং লড়বার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে, তাঁদের সাহায্য দিতে হবে। অবশ্য সেখানে গভর্নমেন্ট আছে, গভর্নমেন্টকে আমরা সাহায্য করবো, গভর্নমেন্টকে স্বীকার করবো, তার মারফত সাহায্য দেবো তাতে কোন কোন সন্দেহ নেই কিন্তু আমাদের গভর্নমেন্টের তরফ থেকেও বলা উচিত, পাকিস্তানের দলমত নির্বিশেষে সমস্ত স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা যেন ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে পারে, যাতে তাড়াতাড়ি জয়যুক্ত হতে পারে। একটি কথা উঠেছে যে, আমরা যদি স্বীকৃতি দিই তাহলে যুদ্ধ হবে কিনা, ঠিক কথা। পাকিস্তানের সামরিক চক্র তাঁরা যেকোন প্ররোচনা দিতে পারে। একথাও ঠিক যে, পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রের মধ্যে এক সোভিয়েত ইউনিয়ন তার রাষ্ট্রপতি পদর্গনি, তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবাদ করে হোক, দাবী জানিয়ে হোক, একটি চিঠি দিয়েছেন।
পাকিস্তান – এর সামরিক চক্র হয়তো কোন কোন বৃহৎ রাষ্ট্রের সমর্থন বা পেতে পারে কিন্তু তাই থেকে ভয় দেখানো হচ্ছে যে, যুদ্ধ বেজে যাবে। যুদ্ধ বেধে যাওয়া অত সহজ কথা নয় আজকালকার আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে কিন্তু আমি বলবো যে, সেই আশংকাতে আমরা স্বীকৃতি দেব না, অস্ত্র দেব না এবং নিরস্ত্র মানুষকে এইভাবে হত্যা করা চলবে, আর সেখানে যারা বীর যোদ্ধা তাঁদের বুলেট নেই, তাঁরা লড়বে, এইভাবে কতদিন চলতে পারে? আমি মনে করিয়ে দেব যে, ভারতেও ক্ষমতা আছে করাচী, লাহোরের উপর বোমা ফেলার কিন্তু আমি আপনাদের একটা কথা বলছি, আমাদের চেয়ে চেহারায় অনেক ছোট একটা রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্র ভিয়েতনামের স্বাধীনতার যুদ্ধকে সাহায্য করেছে অস্ত্রশস্ত্র সব কিছু দিয়ে, তার জন্য পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তানের চেয়ে শত গুনে শক্তিশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতা অর্জন করেছে এবং সমস্ত আন্তর্জাতিক নিয়মবিধি লঙ্ঘন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হ্যানয়ের উপর ভিয়েতনামের রাজধানীর উপর দিনের পর দিন বোমাবর্ষন করেছে। তার ফলে সেখানকার জনসাধারণ কি ভয় পেয়েছে? সেখানকার জনসাধারণ কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা নত করেছে, সেখানকার গভর্নমেন্ট কি পিছু ছুটে এসেছে- একটু নয়। ভিয়েতনাম আমাদের তুলনায় অনেক ছোট কিন্তু সেই ভিয়েতনাম যদি দক্ষিন ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসের সঙ্গে সাহায্য করে থাকতে পারে তাহলে ভারতবর্ষ কেন পারে না? আমরা জানি কমিউনিষ্টদের নেতৃত্বে পরিচালিত সেই রাষ্ট্র সেখানকার।
জনগণকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ করেছে তা ভারতবর্ষের পক্ষে সম্ভব নয়। বিরোধী নেতা জ্যেতিবাবু যখন বক্তৃতা করেন তখন তার মুখ থেকে আমি এ কথাটা শুনব আশা করেছিলাম কিন্তু নিশ্চয় করে বলতে পারি, এই আশ্বাস আমি ভারত সরকারকে দিতে পারি-সকলে দিতে পারি, সমস্ত পক্ষ থেকে দিতে পারি, বাংলাদেশের সমস্ত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল দিতে পারে, সমস্ত জনসাধারণ দিতে পারে যেন স্বীকৃতি দাও, অস্ত্র দাও, কার্যকারী সাহায্য দাও, তারা লড়ুক, তাদের লড়বার যথেষ্ট লোক আছে, তারা লড়ুক, তারা জিতুক, তার জন্য কোন বিপদ যদি ভারতের উপর আসে। আমারা সকলে আমাদের অনান্য বিষয়ে যে কোন মতপার্থক্য থাক, আমাদের শ্রেণীবিভেদ আছে, শ্রেণীর সঙ্গে লড়াই আছে, বিরোধী দলের মতভেদ আছে, আমাদের মধ্যে সংঘর্ষ আছে কিন্তু আমাদের মধ্য যাইথাকুক না কেন, আমরা সকলে জোট বেঁধে দাঁড়াব এবং আমরা মোকাবিলা করব। আমি মনে করি যখন বিরোধী পক্ষ এবং সরকার পক্ষ উভয়ে মিলে এই প্রস্তাব একজোট হয়ে এনেছি তখন নিশ্চয় এই বিষয়ে আমরা একমত আছি এবং এই আশ্বাস আমরা দিতে পারি, এই বিষয়ে আশংকার কোন কারণ নেই। তেমনি জরুরী পরিস্থিতির যদি সৃষ্টি হয় তখন নিশ্চয় আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াব তার সম্মুখীন হওয়ার জন্য। সেই বিষয়ে ভয় পাবার এবং পিছু হটবার কোন কারণ নেই। অনেক কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্বন্ধে বলার আছে-অনেকেই বলেছেন, আমি সেই সবের পুনরাবৃত্তি করতে চাইনা, আজকের দিনে এতকথাশুনবার আমাদের অবকাশ নেই-আজকের দিনে যখন তারা লড়ছে, মরছে, যখন ওদিকে লক্ষ লক্ষ লোক মরছে, আবার লক্ষ লক্ষ লোক যখন পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে আমাদের এখানে তখন যে কথাটা সবচেয়ে জোরে সঙ্গে এই প্রস্তাবের মধ্য বলবার চেষ্টা করা হয়েছে, আমাদের আইনসভার উদ্বেগ, আমাদের পশ্চিম বাংলার জনগণের উদ্বেগ এবং অবস্থার জরুরীত্ব সম্বন্ধে জোর দিয়ে যে কথাটা তুললাম নিশ্চয় আমরা সকলে মিলে ভারত সরকারের উপর প্রয়োজনীয় চাপ দেব কিন্তু আমি চাপ দেওয়ার কথাটা বলতে গিয়ে বলছি আমরা এই আশ্বাস ও দেব যে, হ্যাঁ স্বীকৃতি দাও, সাহায্য কর, তার জন্য যে-কোন ঝামেলা আসুক, ঝক্কি আসুক, বিপদ আসুক আমরা সমস্ত দল সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে তার সম্মুখীন হব এই আশ্বাস আমরা দিচ্ছ। শ্রী সুশীলকুমার ধাড়া: মাননীয় উপাধ্যক্ষ, আজকে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় যে প্রস্তাব এখানে উপস্থাপিত করেছেন তাকে সম্পূর্ণভাবে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে সমর্থন জানাচ্ছি। আমি এই প্রসঙ্গে দু’চারটি কথা বলার সুযোগ নিচ্ছি, এবং সেই সুযোগ এই কথা বলতে চাই, ওপার বাংলায় যে সংগ্রাম হচ্ছে সেই সংগ্রামে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের জীবন বলি দিয়েছে, সর্বস্ব হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে। তাই আমাদের প্রাণ, আমাদের মন তাদের কাছে চলে গেছে। এই লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্নাহুতির জন্য এপার বাংলার মানুষের একটা বিশেষ উদ্বেগ এবং আবেগ বোধ করছে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। সারা ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে সেটা হয়েছে। সেটা যত বেশিই হোকনা কেন, এপার বাংলার মানুষের অনুভূতি সেটা কিনা তা বলতে পারিনা। এটা দেখা গিয়েছে অধিকাংশ বিধানসভার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, সেই সংগ্রামকে সমর্থন করে এবং লোকসভায় ও প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে। এর তিনটি মৌলিক কথা হচ্ছে সিমপ্যাথি, সাপোর্ট, সলিডারিটি। এই সিমপ্যাথি কি জন্য, যাতে তারা এই সংগ্রামে জয়ী হতে পারে, সাপোর্ট দিতে হবে এই জন্য যাতে তারা সংগ্রামে জয়ী হতে পারে। এবং বলার পর তারা আশ্বাস পেয়েছে এবং তারা মুখে মুখে একথা বলছে যে তাদের যা কিছু বল তা হচ্ছে ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়া। তাই যদি হয় ইন্ডিয়া এবং ইন্দিরাকে আজ দেখতে হবে। একথা বলে আমি বলবো -আজকে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসছে তাদের প্রকৃত যত্ন নেওয়া হচ্ছে না। সমস্ত প্রচেষ্টা সত্বেও। আমি বিভিন্ন সময়ে সহকারী কর্মচারীদের টেলিফোন করেছি, খুব ভাল যে সাড়া পেয়েছি তা মনে করিনা। সেই গতানুগতিক ধারায় জবাব দিয়েছে, আর কি করতে পারা যায়। এদের স্বাগত করেছি, রিফিউজি বলে মনে করিনা, এবং বলে দেওয়া হয়েছে তোমরা রিফিউজি নও, কিন্তু তাদের যেভাবে ব্যাবহার করা উচিৎ সেভাবে করছে না। তাদের এখানে থাকার যে ব্যবস্থা তা অপ্রতুল, স্বাস্থ্যর ব্যবস্থা অপ্রতুল, খাদ্যের ব্যবস্থাও অপ্রতুল। এমনও দেখেছি যারা এসেছে এপারে তাদের দুইদিন দেড় দিন পরে একটা মিল পেয়েছে। এটা উচিৎ নয়। এটা অবিলম্বে দেখা উচিৎ। এবং সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলব মুক্তিফৌজের যেসব মানুষ এসেছে এপারে তাদের পরের দিন খাদ্যের দিতে পারিনি, এই খবর আমার কাছে আছে। এবং আরও অনেক ঘটনা আছে। আমি আজকে এই প্রস্তাব সমর্থন করে একথা বলতে চাই যে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যে চাপ দেওয়ার কথা উঠেছে, তাতে যেন এই দাবী থাকে যে, অবিলম্বে অর্থের সংস্থান করুন যাতে কোন অবস্থায়ই কোন দ্বিধা বা সংকটে আনা পড়াতে হয়। এই যে স্রোতের মত লোক আসছে তাদের জন্য কতগুলি ব্যবস্থা যদি না করতে পারি তাহলে অন্যায় হবে, পাপ করা হবে, যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তা থেকে দূরে আসা হবে। এটা একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলন অহিংস পথে হচ্ছে। আমাদের সুবোধবাবু একটা কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেদিন ভারতবর্ষে যে স্বাধীনতার সংগ্রামে করেছিলেন তাঁরা অধিকাংশ রাজনৈতিক কর্মী।
আমার মনে হয় অনেক দিনের কথা বলে সুবোধবাবু হয়ত ভুলে গেছেন। সেদিন অসংখ্য কৃষক এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছে এবং কৃষক রমণী মাতাঙ্গিনী হাজরা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। এ রকম অনেক উদাহরণ থাকলেও আজকে সেখানকার লড়াইয়ে তারা যে ত্যাগ, শৌর্য, বীর্যের উদাহরণ দেখিয়েছেন সেটা সত্যি ভারতবর্ষে মিলিবে না। আমি একদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষুদ্র সৈনিক ছিলাম এবং মাতঙ্গিনী হাজরা আমার কাছে প্রণম্য। কিন্তু রোসেনারা বেগম শৌর্যে, বীর্যে মাতঙ্গিনী হাজরাকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। জহরব্রতের কথা হয়েছে। পঞ্চাশটি ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল থেকে লাগিয়ে পড়ে যেভাবে মরেছে তা অতুলনীয়। কাজেই আমি মনে করি সেখানে তারা জহরব্রতের চেয়ে বড় ব্রত উদযাপন করেছেন। আমি তাদের নেতৃবর্গের কাছে শুনেছি এ রকম হাজার হাজার সুইসাইডিয়াল স্কোয়াড তৈরি হয়ে রয়েছে যারা জীবন দিতে পারবে। কাজেই আজকে তাদের মদদ দিতে হবে। আজকে যারা এসছে তারা অস্ত্র, শত্রু চেয়েছে, তারা কেউ খেতে চায়নি। আমরা যদি খাদ্যের দিতে চাই সেটা আমরা পৌঁছে দিতে পারব না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে, আমি তাদের কাছ থেকে নিজের শুনেছি একটি, ডাব খেয়ে দুই দিন যুদ্ধ করেছে, এতখানা আখ খেয়ে টানা তিনদিন যুদ্ধ করেছে, এর জন্য তারা তৈরি। তারা চায়, অস্ত্র, শত্রু, যুদ্ধের সরঞ্জাম। মুক্তিফৌজের জন্য যা প্রয়োজন তা যদি আমরা তাদের দিতে না পারি, তাদের যদি রিকগনিশন দিতে না পারি তাহলে কোন ফল হচ্ছে না এবং ঐগুলি পৌঁছান যাচ্ছেনা। আমি মনে করি, ভারত সরকার এই ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করছেন এবং ত্রতে কোন ফল হবে না। আমি আশা করি না আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার যারা জাতীয় সরকার বলে পরিচিত, তারা আর একটি জাতীয় সংগ্রামের জন্য পিছপা হবেন। ঝুঁকি আছে জানি। কিন্তু সেটা না নিয়ে অন্যদেশের অনুকরণ করা উচিৎ নয়। আমি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবী করেছি আমাদের পথ অন্যান্য দেশ অনুসরণ করুন এবং সেটা করাতে হলে অবিলম্বে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া সরকার এবং তার সঙ্গে সঙ্গে যা কিছু প্রয়োজন তা পৌঁছে দেওয়া দরকার। এক প্রাণ, এক জাতি তারা গঠনে করতে পেরেছি। সেটা আমরা পারিনি। তারা ভাষা আন্দোলন করেছিল এবং বাংলাদেশের মাটিকে, বাংলাদেশের গানকে জাতীয়কে তারা যেভাবে গ্রহণ করেছে আমরা তা পারিনি। আমাদের সরকারি দপ্তরে আজকেও বাংলা ভাষা ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়নি। আমরা বিধানসভায় সিন্ধান্ত করেছিলাম, কিন্তু তা পারিনি। কিন্তু ওখানে গাড়ীর নম্বর ইংরেজি বা উর্দু ভাষার নয় বাংলায় লেখা। কাজেই দেখা হচ্ছে ওঁরা যা পেরেছেন আমরা তা পারিনি। ওখানকার মানুষ হিন্দু- মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান, প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের উর্ধ্বে চলে গেছে। কিন্তু এখানে দেখছি এখনও সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত নি:শ্বাস ফেলা হচ্ছে। যা হোক, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য এবং সর্বপ্রকার সাহায্য করবার যে পথ আমরা নিতে চলেছি এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।
শ্রী শ্যামাচরণ মূর্মূ: মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়, আজকে মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় পূর্ববাংলা সম্বন্ধে যে প্রস্তাব এনেছেন আমি তাকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি। আজকে হাউসে যে সমস্ত আলোচনা হল তা আমি সবই শুনলাম। আমি আজকে সমস্ত সদস্যের কাছে আবেদন জানাচ্ছি আমরা আমাদের নিজেদের সমস্ত রাজনীতি ভুলে গিয়ে পাকিস্তানের অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষরা খেয়ে পরে বাঁচার জন্য জঙ্গীশাহীর সঙ্গে যে লড়াই করছে তাতে তাদের সাহায্য করবার জন্য আমাদের প্রত্যক্ষভাবে নামতে হবে। এখন যদি আমরা কোন রকম
রাজনৈতিক কারচুপি নিয়ে খেলা করি তাহলে ভুল করা হবে। বড় বড় বক্তৃতার মাধ্যমে কোন কাজ হয় না। একতাবদ্ধ হয়ে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। আজকে যে সেখান হাজার হাজার মানুষ মরছে সে সম্বন্ধে শুধু বক্তৃতা দিলেই হবে না। তাই আমি পশ্চিম বাংলা সরকার তথা ভারত সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি এই সমস্ত মানুষের মানুষের মত বেচেঁ থাকার জন্য যা কিছু সাজ-সরঞ্জাম প্রয়োজন তা দিতে হবে। পশ্চিম বাংলার অধিবাসীরা এবং পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের এক সময়ে ভারতবর্ষের মধ্যেই ছিলেন। মাহাত্না গান্ধী এবং জিন্নার ভুল বুঝাবুঝির জন্য হিন্দুস্থান এবং পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। হয়ত মুসলমানেরা পাকিস্তানের মধ্য গেলে কত সুখ শান্তি উপভোগ করব। কিন্ত বাইশ তেইশ বছর পর তারা দেখল জঙ্গীশাহীর লোকেরা এখান থেকে সব জিনিস নিয়ে যাচ্ছে। এবারে তারা মুজিবুরের নেতৃত্বে গণতন্ত্রের জয়লাভ করলেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল জঙ্গীবাহিনীর কায়েমী সরকার তাদের বিলোপসাধনের জন্য চেষ্টা করছেন। শেষ পর্যন্ত মুজিবর বাধ্যহল যুদ্ধ ঘোষণা করতে। আমি হয়তো খুব বেশি বলতে পারছিনা এই কথা বলেই আমি তাদের পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। আর একটা কথা হচ্ছে ঐ যে পূর্ব বাংলায় যে সমস্ত মানুষ লড়াই করছে কি হিন্দু কি মুসলমান কি আদিবাসী কি সাঁওতাল -সমস্ত শ্রেণীর লোক আজ এক প্রাণ, একক জাতি হয়ে লড়াই করছে। কাজেই আমাদের এখানে কর্তব্য সমস্ত রকম বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে সর্বান্তকরণে সাহায্য করা এই বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।
শ্রী গোবিন্দচন্দ্র মন্ডল:মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আমি মুসলিম লীগ পার্টির চীফ হুইপের তরফ থেকে বলছি আমি (গোলমাল) স্যার ও’রা যেভাবে আমাকে সন্দেহ করছে সেটা ঠিক নয়। তা ছাড়া আমাদের দলকে সাম্প্রদায়িক দল বলে যা বলছেন সেটাও ঠিক নয়, এসব সম্পূর্ণ্য অসত্য কথা। কেননা আমি কেরলের অনুকরণে মুসলিম লীগে এসেছি………. (গোলমাল) স্যার না নাগাল না পেলে আংগুড় টক হয়ে যায়। এরা এখন মুসলমানকে সাম্প্রদায়িক বলছেন। কিন্ত এর আগে গোর্খা লীগকে বলেননি। তাছাড়া বর্তমানে ঝাড়খণ্ড দলকেও সাম্প্রদায়িক দল বলে করছেন না। তবে আপনার যাই বলুন, আমি আশা রাখি আগামী দিনে নির্বাচনোত্তর কেরলের মত আপনাদের উল্টো প্রমোশন হবে। …….(গোলমাল)
শ্রী বীরেন্দ্র নারায়ণ রায়: অন এ পয়েন্ট অব অর্ডার স্যার ………. মি:ডেপুটি স্পীকার :হোয়াট ইজ ইউর পয়েন্ট অব অর্ডার? শ্রী বীরেন্দ্র নারায়ণ রায়:স্যার আমার পয়েন্ট অব অর্ডার হল, আজকে বাংলাদেশের উপর সমর্থনে একটা পার্টকুলার রেজুলিউসানের উপর বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু মাননীয় সদস্য যা বলছেন তার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। ওর যদি এর উপরে কিছু বলার না থাকে তাহলে উনি বসে পড়ুন।
মি:ডেপুটি স্পীকার :ইট ইজ নো পয়েন্ট অব অর্ডার। লেট হিম স্পিক ইন হিজ ওন ওয়ে। শ্রী গোবিন্দচন্দ্র মন্ডল :মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আজকে এসেম্বলিতে কোয়ালিশন গভর্নমেন্টের মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় বাংলাদেশ সম্পর্কে যে প্রস্তাব এনেছেন তা আমি সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি। শ্রী দেবী প্রসাদ বসু:স্যার যারা ইয়াহিয়ার সেই দাড়িওয়ালা মুসলমানকে বলতে বলুন। (গোলমাল)
শ্রী সুব্রত মুখার্জি:স্যার অবজেকশন দিচ্ছি। মাননীয় সদস্যকে এটাকে উইথড্র করতে হবে। আপনি উইথড্র করতে বলুন। গোলমাল মি:ডেপুটি স্পীকার :নো মেম্বার সুড মেক এনি স্টেটমেন্ট হুইচ এফেক্টস দি সেন্টিমেন্ট অব আর্দাস। ডা:জয়নাল আবেদীন :মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, অন এ পয়েন্ট অব অর্ডার। আপনি জানেন মুসলমানদের কিছু অবশ্য কর্তব্য আছে এবং আজকে যে উক্তি করলেন এবং বিরোধী দলের মাননীয় নেতা, উপনেতা এরা বসে আছেন, একটা ধর্মের উপর আঘাত করা হয় যেটা আমাদের ধর্ম বলে মনে করছি এবং সেটা গর্হিত বলে মনে করছি। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আজকে যে গুরুতর বিষয় অবতারণা করা হয়েছে, এটার এত বেশি গুরুত্ব যে আজকে এই টীকা টিপ্পনীতে মনোযোগ দেবার অবকাশ নেই। কিন্তু যে বক্তব্য উনি রেখেছেন, এটা গর্হিত বক্তব্য এবং এটা এখানে চলে না। আমি আপনাকে অনুরোধ করব যে, উনি যদি এই উক্তি প্রত্যাহার না করেন তাহলে এটা প্রসিডিংস থেকে এক্সপাঞ্জ করে দেবেন। এইটুকুই আমার সাব মিশন। মি:ডেপুটি স্পীকার :কোন সেনটেন্স এ- যদি অপর পক্ষের কারো সেন্টিমেন্টে কোথাও আঘাত লাগে এবং মনকষ্ট হয় তাহলে আমার মনে হয় এটা করা উচিৎ নয়। যদি কারো হয়ে থাকে তাহলে উইথড্র করা উচিৎ। শ্রী মনসুর হবিবুলস্না :মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশ্র, এই প্রসঙ্গে এখানে আলোচনা হবে কি? কার কিসে আঘাত লাগে, কে পার্টির নাম মুসলিম রাখে, কে হিন্দুমহাসভা করেন, তখন তার সেটা মনে রাখা উচিৎ পরে এটা নিয়ে সমালোচনা করা চলে না। (গোলমাল) তখন তাকে বুঝতে হবে, তখন মনে রাখা উচিৎ। কাজেই এখানে ঐ প্রসঙ্গে আলোচনা হবে না রেজলিউশন -এ আলোচনা হবে, এটা আগে ঠিক করুন….. শ্রী মতি গীতা মুখার্জি :মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, যে বিষয় এখানে আলোচনা হচ্ছে তার গুরুত্ব সমধিক নয়, হিন্দু -মুসলমানের দৃঢ়তম ঐক্যের ভিত্তিতে একমাত্র এখানে জয় সম্ভব। সে জন্য আশা করবো সকল পক্ষ থেকে যেন এই আলোচনার মধ্যে আর এই ধরণের কথা না হয় এবং প্রস্তাবের উপযুক্ত মর্যাদা থাকে। শ্রী দেবীপ্রসাদ বসু:স্যার, আমি মুসলিম লীগ সম্বন্ধে গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে থাকি। তার কারণ, আমাদের ভিতরে প্রচুর মুসলমান সদস্য রয়েছে, কংগ্রেসের মধ্যে আছেন, অন্য দলের মধ্য আছেন। কারো সমন্ধে কোন মুহূর্তে আমি কটাক্ষপাত করিনি কোন ধর্ম সমন্ধে, এটা মাননীয় মন্ত্রী জয়নাল আবেদীন মহাশয় জানেন। আমি যেটি বলতে চেয়েছিলাম সেটা হচ্ছে গোবিন্দ মন্ডল মহাশয়কে দিয়ে মুসলিম লীগের বক্তব্য না রেখে মুসলিম লীগের একজন দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন সদস্য তিনি এই বক্তব্য রাখুন। তাতে নাম বলতে না পেরে তাড়াতাড়িতে আমি বললাম যে, যার মুখে দাড়ি রয়েছে তিনি উঠে বলুর। এতে যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন তাহলে আমি এই এই কথা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। শ্রী রাধাগোবিন্দ বিশাল:মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়, আজকে সরকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে এবং স্বাধীনতার সমর্থনে তাদের সাহায্য দেওয়ার সমর্থনে সরকার পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব উথথাপন করা হয়েছে তাকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করে আমি দু-একটি কথা বলতে চাই। আমরা যারা এই প্রস্তাব সমর্থন করতে উঠেছি তাদের বক্তৃতার মধ্যে কেউ এই আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, আবার অনেক সাম্প্রদায়িকতার উক্তিও হচ্ছে, আবার পশ্চিম বাংলার কেন্দ্রীয় সরকারের ঠিক অনুরুপভাবে জেহাদ করার কথা কেউ কেউ বলেছেন। আমি এইসবের মধ্যে না গিয়ে এই কথা বলতে চাই যে যে, বৃহত্তর স্বার্থের জন্য, মহৎ আর্দশ পালনের জন্য সীমান্তের ওপারে আমাদেরই ভাইবোন যারা আত্নত্যাকরেছেন, যারা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখবার আছে। যেদিন আমাদের নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে আজাদ, হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন সেদিন এমনিভাবে এই বাংলাদেশের মত সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণ, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি সমস্ত কিছু বিভেদ অতিক্রম করে একটি মহত্ত্বের ঐক্য গড়ে উঠেছিল, আজকেপূর্ববাংলায় অর্থাৎ বাংলাদেশে তা সম্ভব হয়েছে। আমরা আজকে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে নিরাপদ দূরুত্বে বসে অনেক তর্ক করতে পারি অনেক উৎসাহ দিতে পারি, অনেক রকম সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু এই কথা মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি মুহূর্তে সেখানে জীবন যাচ্ছে, প্রতিটি মুহূর্তে সেখান জীবন কোরবানি হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের আর এইসব তর্ক, বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। যে সমস্ত মাননীয় সদস্য সর্বপ্রকার সাহায্য দেবার কথা বলেছেন, আমি তাদের সেই বক্তব্য কে অভিনন্দিত করি। আমাদের স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করেই হোক, যেমন করেই হোক, অর্থ, রসদ, অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি দেবার দাবী যেমন সরকারের কাছে দেব তেমনি বেসরকারিভাবে আমাদের যা কিছু করণীয় আছে তাই আমরা করবো। আমাদের পক্ষ আজকে এটা সৌভাগ্যর বিষয় এবং গর্বের বিষয় যে, স্বাধীনতা সংগ্রামী, স্বাধীনতাকামী শান্তিপ্রিয় মানুষসমর্থনের বিষয়ে আমাদের বক্তব্য আমরা রাখছি এবং যতটা করা দরকার ততটা করার চেষ্টা করছি। ভারত সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ যে, এই প্রস্তাব নিশ্চয়ই কার্যকারী করতে হবে এবং যাতে তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সত্বর লাভ করতে পারে এবং বাংলাদেশের এই নূতন সরকার আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মর্যাদা লাভ করতে পারে নিশ্চয় আমাদের সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সাহায্য দিয়ে, ত্রাণের ব্যবস্থা করে, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে সক্রিয়ভাবে যে ব্যবস্থা আমরা করতে যাচ্ছি সেটা কতদিন এই রকম চালিয়ে যেতে পারি তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ এবং যত শীঘ্র সম্ভব বাংলাদেশের সরকার স্বীকৃতি লাভ করে আবার এই সমস্ত ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে যেতে পারবেন তার ব্যবস্থা হতে পারে, সেই জন্যই আমাদের অবিলম্বে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ। সেইজন্য আমাদের অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ এবং এদের যুদ্ধে যাতে দ্রুত তারা সাফল্য লাভ করতে পারে, জয়যুক্ত হতে পারে তার জন্য প্রয়োজন হ’লে আমাদের যুদ্ধের মধ্যে যেতে হবে। আমরা যতঈ বৈষয়িক সমস্যায় জর্জরিত হই না কেন, এই সমস্যাকে আমরা কিছুতেই অবহেলা করতে পারিনা বা ফেলে দিতে পারিনা এবং দেখেও না দেখার ভান করতে পারিনা। বাইরের অন্যান্য বৈদেশিক রাষ্ট বাংলাদেশকে সরকারকে স্বীকৃতি দিতে দেরী করতে পারে কিন্তু আমাদের মোটেই দেরী করা উচিৎ হবেনা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা বৈষয়িক স্বার্থের কথা, রাজনৈতিক স্বার্থের কথা ভাবতে পারি। কিন্তু আমাদের বোঝ উচিৎ এই রাষ্ট একদিন আমাদেরই অঙ্গছিল। আমরা যারা উনিশশত ছয়চল্লিশ সালের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিনগুলি দেখেছি তা কখনো ভোলা যায় না। সেই দিনগুলি ছিল কি ভয়ংকর! কি রকম রক্তাক্ত অবস্থার মধ্যে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। আজকে কালের করাল প্রবাহে দ্বিজাতিতত্ত্ব যে কত অসার ও অর্থহীন তা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। মানুষকে মানুষের ভাষার ঐক্য সামাজিক ঐক্য, সাংস্কৃতিক ঐক্যই ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে। সীমান্তের ওপারে আমাদের ভাইবোনেরা নিরস্ত্র হয়ে যে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করছে সশস্ত্র এক পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে তা তুলনাবীহিন। আমরা তাদের সেই যুদ্ধে সমর্থন জানাচ্ছি, আগেও জানিয়েছি, আজকে এই সভায় সরকার যে প্রস্তাব এনেছেন তা আমি সমর্থন করছি। এই প্রস্তাবে কার্যকরী করবার জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সহায়তা করতে থাকবো। এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে গিয়ে সসাম্প্রদায়িকতার ধুয়া ধরে যে কথাকাটাকাটি হল তা বাস্তবিকই খুব দুঃখজনক। মাননীয় সুবোধবাবু যে কথাবলেছিলেন তা অতি মর্মস্পর্শী। তিনি বহুদিনের সভ্য, লেজিসলেচারের ব্যাপারে তাঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা রয়েছে। আমরা যারা নতুন নির্বাচিত হয়ে এসেছি, আমাদের এই হাউসের কাজকর্ম ভালভাবে দেখাদরকার, শেখা দরকার। আমরা যারা জনগণের দ্বারা প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে এসেছি, আমাদের উপর জনগণ গুরুতর দায়িত্ব দিয়েছে। সেই দায়িত্ব সম্পর্কে আমরা যেন সচেতন থাক। জয় বাংলা।
শ্রী হরেকৃষ্ণ কোনারঃমাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, বাংলাদেশের মানুষ লড়ছে। তারা তাদের বুকের রক্ত ঝড়াচ্ছে। আমাদের কর্তব্য হল একে শুধু সমর্থন করা নয়, একে আমরা কি করে শক্তিশালী করতে পারি, তাদের জয়ের পথকে কিভাবে সুগম করে তুলতে পারি, তার ব্যবস্থা করা। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, এখানে খবরের কাগজগুলি পড়লে মনে হয় বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমাদের এখানে প্রায় চোখের জলের এক প্রতিযোগিতা চলছে। তাঁর দাম আছে। যে মানুষ লড়ছে তার জন্য কিছু করতে না পেরেও যদি কাঁদতে পারা যায় তারও মূল্য আছে। কিন্তু আমাদের সীমান্তের ওপারে আমাদের ঘরের কাছে মানুষ যখন রক্ত দিচ্ছে তখন শুধু কান্নার প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কর্তব্য পালন করা যাবে না। সেজন্য আমাদের কয়েকটি কর্তব্য আছে। সেই কর্তব্য দু-রকম এক রকম বাংলাদেশের মানুষের লড়াইকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেবার অজুহাত হিসাবে পাকিস্তানের শাসকচক্র শুধু মিথ্যা প্রচার করে চলছে। এ কথা বললে ভুল হবে, যে নিজের মনকে ভুল বোঝান হবে-যদি মনে করি যে, পৃথিবীর কোথাও কোন মানুষকে তারা ভুল বোঝাতে পারছে না-এ কথা আমাদের বোঝা দরকার। একটা দেশের মানুষ লড়ছে, তাদের এই লড়াই এর দাবী যুক্তিসংগত, এ ছাড়া তাদের পথ ছিলনা, এটা যদি দুনিয়ার মানুষকে বোঝান যায়, তাদের সমর্থন যদি টানা যায়, তাহলে অনেক কাজ হবে। শুধু আমাদের মানুষের সমর্থন নয় পশ্চিম পাকিস্তান বলে যে জায়গা আছে, সেখানে যে মানুষ আছে, যদি সেখানকার মানুষের সমর্থন আদায় না করা যায়, তা’হলে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে লড়াই করা আর একটু কষ্টকর হবে। তারা পারবে না আমি সে কথা বলছিনা। কিন্তু যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষদেরও বোঝানো যায় এবং তাদের সমর্থন পাওয়া যায় তাহলে পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র আরও বেকায়দায় ফেলা যায় এবং তার ফলে বাংলাদেশের জনগণের সাহায্য হয়। যেমন করে ভিয়েতনামের লড়াইকে আমেরিকার অভ্যন্তরে সেখানকার ছাত্ররা এবং যুবকরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়, তারা ভিয়েতনামের মানুষদের এইভাবে সাহায্য করে। তাই বারে বারে ভিয়েতনামের জনগণের নেতা কমরেড হোচিমিন আমেরিকার জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছে, তাদের যারা ভিয়েতনামের সমর্থনে আমেরিকার সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করেছেন। এমনিভাবে বাংলাদেশের পক্ষেও প্রয়োজন আছে যাতে পাকিস্তানের সামরিক চক্র সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝাতে না পারে। তা ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশও আছে, সেখানের জনগণেরও সমর্থন প্রয়োজন। সেই জন্য আমাদের একটা কর্তব্য হচ্ছে এই য, বাংলাদেশের সংগ্রামের তাৎপর্য সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা। আমরা ভারতবর্ষের মানুষ কেন সমর্থন করছি সে সম্বন্ধেও স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। কারণ পাকিস্তানের শাসনচক্র দুনিয়াকে ভুল বোঝাবার চেষ্টা করছে যে, আমাদের যে সমর্থন এটা বাংলাদেশের মানুষ যার জন্য লড়ছে অর্থাৎ তাদের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের আমাদের দরদ তার জন্য নয় এরা ভারতবর্ষের লোক পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব থেকে সমর্থন করছে। এটা কিন্তু বোঝাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা যদি পাক সামরিকচক্র বোঝাতে পারে তাহলে স্বভাবত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোক কিছুটা বিভ্রান্ত হতে পারে এই ভেবে যে একটা দেশ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, আলাদা হয়ে যাবে এবং তার গভর্নমেন্ট এর পক্ষে মেনে নেওয়া মুশকিল। শুধু তাই নয়, আমাদের ভারতবর্ষের মধ্যেও বহু জাতির মানুষ আছে, বহু ধর্মের মানুষ আছে এবং তাদের সকলের ঐক্যেরও প্রয়োজন আছে। যদি পাকিস্তানের সামরিকচক্র এই কথা ভালভাবে প্রচার করতে পারে যে, একটা দেশকে টুকরো টুকরো করে দেবার জন্য বাংলাদেশের এই লড়াই তাহলে কি আমরা জোর করে বলতে পারি যে, আমাদের ভারতবর্ষের কোঅংশের মানুষের মনে কোন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারেনা? যদি তারা বোঝাতে পারে যে, এই সংগ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, এই বোঝাতে পারে, ভুল বোঝাতে পারে, তাহলে কি ওদের সংগ্রামকে দুর্বল করতে পারা যায়না? আমি এই কথাটার উপর জোর দিতে চাই যে, বাংলাদেশের মানুষেরা পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দেবার জন্য লড়াই শুরু করেনি। তারা চেয়েছিল গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসন। এই প্রসঙ্গে বলতে পারি যে, যদি কোন দেশের রাষ্ট্র শক্তি ইতিহাসের এক বিশেষ শিক্ষাকে গ্রহণ না করেন তাহলে তিনি নিজে ভুল করবেন। বক্তৃতা দিয়ে অন্য কিছু করা যায়না। সেই শিক্ষা হল যে, যদি কোন দেশ বহুজাতিভিত্তিক হয়, বহু জাতির সমন্বয়ে গঠিত হয়, সেই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার যদি সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে সমস্ত রাজ্যগুলির ওপর একেবারে একাধিপত্যর ও শোষণের রথ চালিয়ে যান, তাহলে সেই দেশ কালক্রমে ভাঙ্গতে বাধ্য। সেইসব দেশে বিভিন্ন জাতির ভিত্তিতে যে এক-একটি রাজ্য, সেই রাজ্যগুলিতে ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন এর অধিকার নেওয়া প্রয়োজন। এ না হলে দেশের ঐক্যকে রক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ এই স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। এ না হলে দেশের ঐক্যকে রক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ এই স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। এ না হলে দেশের ঐক্যকে রক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ এই স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। সেখানে তের বছর ধরে মিলিটারি বুটের দাপট পাক সরকার চালান, গণতান্ত্রিক অধিকার তাদের কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তবুও তারা মরেনি। পঞ্চাশ হাজার কি সত্তর হাজার মিলিটারি জনগণের বুকের উপর যদি বছরের পর বছর ধরে চাপিয়ে দেওয়া যায় তাতে কেউ যদি মনে করেন সেই দেশের প্রাণ শক্তি ভেঙ্গে দেওয়া যায় তাহলে তারা মূর্খের স্বর্গে বসবাস করছেন, যেমনভাবে পাক সামরিক চক্র মূর্খেস্বর্গে বসবাস করেছিল তের বছর ধরে। 25 শে মার্চের আগে মিলিটারি মেশিনগান চালিয়ে গণহত্যা শুরু করেনি, তের বছর ধরে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বুকের উপর তারা চেপে বসেছে, এই তারা করেছে। জনগণ চেয়েছিল তার থেকে বাঁচতে। তাদের ছয় দফা দাবি ছিল; এখন খবরের কাগজ পড়লে 6- দফা দাবি আর পাবেন না, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। তাদের কথা ছিল এই যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের হাতে দেশরক্ষার মত সাধারণ কয়েকটি জিনিস থাকবে। বাকী সমস্ত ক্ষমতা বাংলাদেশের রাজ্যর হাতে থাকবে। এই দাবি শুধু বাংলাদেশের জন্য ছিলনা, পাকিস্তানের, প্রত্যেকটি রাজ্যর অধিকারের কথা তারা বলেছিলেন। এতে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের অন্তরে সাড়া জেগেছিল। ওরা লড়াই চায়নি, ওরা চেয়েছিল ভোটের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন। পাকিস্তানের সামরিকচক্র তার জবাব দিল আক্রমণ করে। তারা মিলিটারিকে অর্ডার দিলেন যে মিলিটারি তের বছর ধরে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বুকের উপর চেপে বসেছিল তাদের অর্ডার দেওয়া হল, বাংলাদেশের উপর তোমরা গণহত্যা অভিযান শুরু করে দাও। শুধু কম্বিং করলে চলবে না, এনসার্কিলিং করলে চলবে না, একেবারে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান চালাও। ওখানে হচ্ছে তাই। দেড় মাসের মধ্য যদি এক থেকে দু লক্ষ খুন হয়ে থাকে তাহলে এটা গণহত্যা ছাড়া আর কি? তারা স্বায়ত্তশাসন, গণতন্ত্র চেয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে ভোটের ভেতর দিয়ে, তার জবাব এল মিলিটারিতে, মেশিনগানের গুলিতে। কি করতে পারত বাংলাদেশের মানুষ? যদি তাদের মনুষ্যত্ববোধ থাকে তাহলে তার একমাত্র উত্তর ছিল অস্ত্রের ঝঞ্চার উত্তর অস্ত্রের ঝঞ্চনার দিয়ে। তাই হয়েছে তাইতো স্বাধীনতার দাবি এল। এই বিষয় আমাদের তুলে ধরা উচিৎ। এইটুকু যদি তুলে ধরতে পারি তাহলে পৃথিবীর গণতান্ত্রিক মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে। কিন্তু এই সমর্থন একদিনে পাওয়া যাবে না-ভিয়েতনামের পক্ষে সমর্থনে একদিনে পাওয়া যায়নি সময় লাগবে। সে জন্য এটা নিয়মিত প্রচার করার দরকার আছে যে, বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান কে ভেঙ্গে দিতে চায়নি, তারা চেয়েছিল মানুষের মত মর্যাদা নিয়ে, গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে। তাদের খুন করে বাধ্য করা হল লড়তে। তাদের সামনে স্বাধীনতা ছাড়া বাচাঁর কোন পথ থাকল না। এটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরার প্রয়োজন আছে। পাকিস্তানের সামরিকচক্র প্রতিনিয়ত আর একটি বিরুদ্ধ প্রচার করছে এবং বাংলাদেশের ভেতরে কিছু দালাল সংগ্রহের চেষ্টা করছে। তাদের দু’একটি নাম আপনাদের কাছে এসেছে। যেসব ভাইরা এখানে এসেছে, যেসব ভাইরা এখানে এসেছেন তাদের কাছ থেকে খবর পাচ্ছি যে, সেখানকার কিছু কিছু মানুষকে ভুল বোঝাবার চেষ্টা হচ্ছে যে, ভারত বর্ষের যারা সমর্থক তারা পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চাইছে; বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয় তাহলে বাংলাদেশ ভারতবর্ষের একটা অনুগত দেশ হবে। আমি আপনাদের বলছি, বাংলাদেশের প্রতি আমাদের সমর্থনের কদর্য করে পাক সামরিকচক্র আমার এখানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে এটা যেন না হয়। পাকিস্তানের সামরিক চক্র কে এই কথা বলতে চাই যে, একটা দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যদি একবার অস্ত্র হাতে নিয়ে পাকিস্তানের আধুনিক অস্ত্রে সাজ্জিত সামরিক বাহীনিকে পর্যুদস্ত করতে পারে তাহলে আত্নমর্যাদাসম্পন্ন সে জাতি অন্য কোন জাতি বা অন্য কোন গভর্নমেন্টের কাছে, তা সে যত চেষ্টাই করুক না কেন, যার মনে যতই আশা থাকনা কেন, সে জাতি কোনদিন কারো কাছেমাথা নোওয়াতে পারেনা। এইভাবে যদি পাকিস্তানের মিথ্যা প্রচার ব্যর্থ করতে পারি, তাহলে আমার গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে পারবো।
মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আমার যা তৃতীয় বক্তব্য তা এবার আমি বলব। তবে তার আগে বলি কংগ্রেস বেঞ্চের সদস্যরা হয়ত মনে করবেন এটা আমি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যবহার করছি। কিন্তু আমি তার জন্য বলছি না। এখানে শাসকগোষ্ঠীর সন্তানের বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করতে জানি। ভারতবর্ষের সঙ্গে চীনের লড়াই চলে, আর আমাদের জেলে পুরে দেওয়া হলো। পাকিস্তানের সাথে ভারতের লড়াই হলো আমাদের জেলে পুরে দেয়া হলো। আমরা মার্ক্সবাদীরা শান্তিপূর্ণ মীমাংসা চেয়েছিলাম বলে। আমরা আমাদের নিজেদের সংগ্রাম করতে জানি। তারজন্য বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের সংগ্রাম কে ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা জানি পশ্চিম বাংলায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করতে হয়। সি আর পি মিলিটারি দিয়ে, পিভিএ বা পিডি দিয়ে আমাদের দাবান যায় না। তার জন্য আমাদের কারো উপর নির্ভর করতে হয় না। যদি আমাদের নিজেদের সংগঠনের ক্ষমতা থাকে, যদি পশ্চিম বাংলার সাড়ে চার কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারি, তাহলে এই সন্ত্রাস মূলক আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি। আপনারা ভুল বুঝবেন না। আমি অন্যকোনো উদ্দেশ্যে বলছি না। ধরুন, আপনারা সন্ত্রাসমূলক আক্রমণের সাফাই দিচ্ছেন শান্তি – শৃঙ্খলা’র কথা বলে। পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খান বলেছেন, ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় মিলিটারি দিয়ে অত্যাচার চালান হচ্ছে। এটা কিন্তু আমাদের জন্য বলছে না। ওরা বলছে বাংলাদেশের যে মানুষ লড়ছে তাদের ভুল বোঝাবার জন্য। তোমরা বাংলাদেশে মিলিটারির বিরোধীতা করছো, তাহলে পশ্চিম বাংলায় শান্তির সময় কেনো মিলিটারি আছে? কিন্তু চার ডিভিশন, তারমানে প্রায় ৫০ হাজার মিলিটারি আছে? বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিরুদ্ধে পাক সেনারা ব্যবহার করেছে ৭০ হাজার। মিলিটারি, এখন হয়ত একলক্ষ হবে। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় সাড়ে চারকোটি মানুষের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০ হাজার। এখানে চার ডিভিশন মিলিটারি আছে, এই চার ডিভিশন মানে ৫০ হাজার। এই প্রচার যদি ওরা করে? তাহলে পশ্চিমবঙ্গে সিআরপি ব্যবহার দ্বারা কি ইয়াহিয়া’র হাতকে শক্তিশালী করা হচ্ছেনা? আপনারা ভুল বুঝবেন না। ৫০ হাজার মিলিটারি সাড়ে চার কোটি মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে পাক সামরিক চক্রের আক্রমণের পক্ষে যুক্তি দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশকে কিছু রাইফেলের সাহায্য দেওয়ার চেয়ে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হবে যদি আমরা দেখাতে পারি, ইয়াহিয়ার কোনো কুৎসা করার সুযোগ নেই। এখানে সবাই জানেন বিশেষ করে যারা মন্ত্রী হয়েছেন তারা জানেন, আমরামরা মার্ক্সবাদীরা সরকারের আক্রমণ হতে রক্ষার জন্য ওইসবের উপর নির্ভর করি না, নিজেদের ক্ষমতার উপর নির্ভর করি। ক্ষমতা থাকলে লড়াই করবো একথা জানি কিন্তু পাকিস্তানের শাসনচক্র যখন লোককে বোঝায় যে, ভারতবর্ষের সমর্থন হলো একটা চালাকি, বাংলাদেশকে ভারতের একটা অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা -তখন এর কি জবাব দেবেন, এটা বিপদজনক। মিলিটারি পশ্চিমবঙ্গে থাকলে আমি আতঙ্কিত নই। মানুষের অভ্যাস হওয়া ভালো। ১৩ বছর ধরে পূর্ববাংলার লোকদের মিলিটারি দেখতে দেখতে অভ্যেস হয়ে গেছে, এবং তার জন্য তারা মিলিটারির বিরুদ্ধে রাইফেল ধরতে শিখেছে। সেজন্যে দেখবেন কোনোদেশের যারা বুদ্ধিমান গভর্নমেন্ট তারা সাধারণ অবস্থায় মিলিটারি করে না। আমাদের ভারতবর্ষের শাসকরা কেনো তা বুঝছেন না, তা জানি না। আমি বলছি পশ্চিমবঙ্গে মিলিটারি ব্যবহার বাংলাদেশের লড়াইকে কি দুর্বল করেনা? আমি যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলছি সেটা বোঝার প্রয়োজন আছে। জ্যোতিবাবু তাই বলেছিলেন আনাদের দরদ কোথায় আছে? কথায় বলে যে, ‘আপনি আচারি ধর্ম পরেরে শেখাও’। পূর্ববাংলায় মানুষ স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল বলে ইয়াহিয়া তার জবাব বুলেটে দিয়েছেন। ভারতবর্ষ বহু জাতির দেশ। এখানে ”স্বায়ত্তশাসন” শব্দটি এখনও ওঠেনি। শুধু এইইটুকু দাবী করা হয়েছিল যে, রাজ্যগুলির আরও অধিকাত পাওয়া উচিৎ। কিন্তু তার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বললেন যে, রাজ্যগুলির অধিকতর ক্ষমতার দাবীর মানে হলো কেন্দ্রকে দুর্বল করাএবং কেন্দ্র দুর্বল হওয়া মানে দেশ দুর্বল হওয়া। কিন্তু যখন ইয়াহিয়া খান বলেন যে, রাষ্ট্রগুলোর স্বায়ত্তশাসন চাওয়া -বিশেষ করে দুহাজার মাইল দূরের একটা রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন চাওয়া মানে পাকিস্তান কে দুর্বল করা তখন শুনতে খারাপ লাগে। মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী আমাদের দলের লোক নন, নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে ছিলেন, যখন রাজ্যের ক্ষমতার কথা বলেন তখন কি তিনি তাহলে দেশদ্রোহী? আমি হিন্দু ইত্যাদি পত্রিকায় বড় বড় হে’দ ললাইনে দেখেছি, তিনি বলেছেন যে, রাজ্যগুলি কে অধিকতর অধিকার না দেওয়া হয় তাহলে ইফ নট ইন দিস জেনারেশন পরবর্তী জেনারেশনে এ সমস্ত দেশ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। আমরা বললে আপনারা বলতেন দেশদ্রোহী, কিন্তু যেহেতু তিনি কংগ্রেস কে ১০ টি সিট পার্লামেন্ট এ দিয়েছেন অতএব তিনি তা নন। ইয়াহিয়া খান, আয়ুব সাহেব -স্বায়ত্তশাসন এর দাবী শুনে হেসেছিলেন, কিন্তু সেটা থাকেনি। তারা ভেবেছিলেন এখানে স্বায়ত্তশাসন এর দরকার নেই। শুধু রাজ্যগুলি তাদের প্রয়োজনে ইসলামাবাদের কাছে হাতজোড় করে দাড়িয়ে থাকবেন। এটাই ছিলো ওদের যুক্তি, যেটা আমাদের এখানেও দেখানো হয়। আমাদের বন্ধুস্থানীয় জনৈক সদস্যের পার্টির একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছে যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট পশ্চিম পাকিস্তানের ৬৯২ জন অফিসার আর পূর্ববাংলার মাত্র ৫২ জন। সেই তুলনামূলক হিসাব যদি সম্প্রদায় হিসাবে রাইটার্স বিল্ডিং অফিসার এর বেলায় ধরা হয় তাহলে এর দ্বারা খারাপ ফল হবে। উই উইল প্লে ওয়ানলি ইন্টু দ্যা হ্যান্ডস অফ আদারস। তাই এরকম যুক্তি ঠিক নয়। কিন্তু আমি যখন বলল যে পাক শাসক চক্রের দ্বারা বাংলাদেশের মানুষ কে লুট করা হচ্ছে, তখন আমরা কেনো ভুলে যাবো যে, পশ্চিমবঙ্গের মতো সমস্যাসংকুল রাজ্যে চতুর্থ পরিকল্পনার ৫বছরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার হতে আমরা পাবো মাত্র ২২১ কোটি টাকা, অথচ প্রতি বছর আমাদের এখান হতে সেন্টারল ট্যাক্স কেন্দ্রে যাবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এগুলো কি পাকিস্তান গভর্নমেন্ট দেখছে না? পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এক যুক্তি আর ভারতের ক্ষেত্রে উল্টো যুক্তি হতে পারেনা। জ্যোতি বাবু ওই অর্থে বলেছিলেন ইফ ইউ আর সিনিয়র, যদি সত্যিই বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম কে আমরা সমর্থন করি, যদি সেটা পাকবিরোধী মনোভাব থেকে নয়, এই মনোভাব থেকে হয় যে, তারা এমন একটা নীতির জন্য লড়ছে যার জন্য মানুষের প্রাণ দেয়া উচিৎ, তাহলে সেই নীতি ভারতেও প্রয়োগ করা উচিৎ। এবং যদি না হয় তাহলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর হাত শক্তিশালী করবো। তাদের দাবী যদি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে পশ্চিম বাংলায়ও তো সে দাবী কে মূল্য দেয়া উচিৎ আমাদের। ওখানে গণতন্ত্রের জন্য মানুষের লড়াই কে যদি শ্রদ্ধা জানাই তাহলে পশ্চিমবঙ্গেও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের আমরা বিরোধীতা করতে পারিনা, তাকেও শ্রদ্ধা জানাতে হবে। ওখানে যদি মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ এর অধিকার কে আমরা সেলাম জানাই, তাহলে এখানে অন্তত রাজ্যগুলির একটু অধিকতর থাকা উচিৎ। এগুলা হওয়া উচিৎ। এ যদি না হয় তাহলে ভুল কার হবে? দ্বিতীয় যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা একটু ভেবে দেখুন। আমাদের এখানে পশ্চিম বাংলায় ৫০ হাজার মিলিটারি যদি মাসের পর মাস থাকে, যদি মাসের পর মাস সিআরপি আমাদের এখানে থেকে উৎপীড়ন চালায়, তাহলে কি একথা বলা চলে যে আমরা সত্যিকারের বাংলাদেশের মানুষ কে আন্তরিকতার সঙ্গে সমর্থন করছি। আমি একথা বলতে চাই এজন্য, কারণ বাংলার হিন্দু, মুসলমান বাঙালী, অবাঙালী সমস্ত মানুষের অধিকার নির্ভর করছে আমাদের এখানকার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার উপর।
মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আমি আর একটা কথা বলব। বাংলাদেশের মানুষ দেড় মাস ধরে লড়ছে। এটা আপনিও জানেন, আমরাও জানি যে, এই লড়াই-এ যোদ্ধা বাহিনীর পিছনে কি ছিলো। এর পেছনে ছিলো জনগণের অপূর্ব সমর্থন কিন্তু প্রধানত যারা হাতিয়ার ধরে লড়েছে তারা হল পূর্ববাংলার পুলিশ, আনসার বাহিনী, বেঙ্গলী রেজিমেন্ট ইত্যাদি। এরা কিছু অস্ত্র পেয়েছিলো, কিন্তু তারা সোজাসোজি লড়তে জানত, স্বভাবতই তারা গেরিলাযুদ্ধের সব কায়দা জানে না। পাকিস্তানী মিলিটারির বিরুদ্ধে তারা এলোপাতাড়ি গুলি খরচ করল, ফলে অস্ত্রের অভাব পড়ল, অস্ত্রের খোড়াকের অভাব পড়ল। তখন তাদের জরুরী কি প্রয়োজন ছিলো? প্রয়োজন ছিলো চোখের জল নয়, ঐ সীমান্তে কিছু চিঁড়ে, গুড় দেওয়া নয় বা ট্রিপল অ্যান্টিজেন ইঞ্জেকশন দেওয়া নয়। কেউ কেউ বলেছিল ভলান্টিয়ার দিতে রাজি আছি। ওরা ভলান্টিয়ার চায়নি-সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রাণ দেবার জন্যে প্রস্তুতই, তারা ভারতবর্ষের কাছে ভলান্টিয়ার চাচ্ছি না; তারা চেয়েছিলো রাইফেল, মর্টার, অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান, যা নিয়ে তারা লড়তে পারে। কিন্তু দেড় মাস দেরী হয়ে গেল, আর কত দেরী হবে? সেখানে কি গেছে না গেছে, তারা কি পেয়েছে বা না পেয়েছে তা আমরা জানি না; কিন্তু গত দেড় মাস ধরে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটা আর্মির বিরুদ্ধে তারা লড়েছে, মরেছে, সেখানে অনেক জায়গা আর্মি দখল করে নিয়েছে। ওরা সেখানে থাকতে পারেনি।
ওদের অসুবিধা গ্রামগুলি এখনও সংগ্রামের ঘাটি হিসেবে তৈরী হয়নি। অবশ্য বাংলাদেশের মানুষের লড়াই কিভাবে চলবে না চলবে সেই বিষয়ে উপদেশ দেবার স্পর্ধা আমার নেই; কারণ ওরা লড়ছে মরছে – কাজেই তাদের উপদেশ দেয়া উচিত নয়। তবে আমি এ কথা বলবো যে এদের লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, অর্থাৎ কৃষক ওদের বাহিনীর ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে। এটা তারা শিখবে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে। এটা লেলিনের কথা যে, শান্তির সময় যে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে এক বছর সময় লাগে একটা সংগ্রামের মাঝখানে সেই অভিজ্ঞতা পাঁচ দিনে এসে যায়। ওরা নিজেদের প্রয়োজনেই শিখবে। আমার স্টেটসম্যান এবং অন্যান্য কাগজে দেখেছি তারা কি লিখছে। তারা লিখেছে এই লড়াই যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, এই লড়াই যদি গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে “একট্রিমিস্টস আর ওয়েটিং বিহাইন্ড দি স্ক্রীন” অর্থাৎ উগ্রবাদীরা পর্দার আড়ালে অপেক্ষা করছে; নেতৃত্ব চলে আসবে। এতে আমাদের বিচলিত হবার কি আছে? ওদের নেতৃত্বে কে থাকবে তা আমরা কেন বিচার করবো? এ ব্যাপারে আমরা মাস্টারী না-ই করলাম। আমরা সবাই জানি যে, আজকাল বিধানসভায় এই প্রস্তাব কেমন করে রচিত হয়েছে। প্রস্তাবে এই কথাটা দেয়া হয়েছে যে, প্রতিকূল অবস্থা যা-ই হোক না কেন বাংলাদেশের মানুষ শেষ পর্যন্ত জয় লাভ করবেনই। যারা লড়ছে তারা লড়বে, মরবে, জয়লাভ করবে কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে আমরা ওদের কার্যকরী কিছুই দিচ্ছি না। দেড় মাস দেরী হয়ে গেল, এখনো যদি দেরী করি তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। স্বীকৃতি তো এমন কিছুই নয় যে, শুধু তা ধুয়ে ধুয়ে তারা জল খাবে এবং তাতে তাদের পেট ভরে যাবে। স্বীকৃতির এই জন্য প্রয়োজন যে, তাহলে তাদের অস্ত্র দিতে পারেন, অস্ত্র বিক্রি করতে পারেন, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তাদের দিতে পারেন। কাজেই শব্দটা এই প্রস্তাবে আমার জন্য আমরা খুবই আনন্দিত এবং এরই জন্য আমরা একমত হতে পেরেছি। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, কিছু কিছু বন্ধু কটাক্ষ করবার জন্য জ্যোতিবাবুকে বলেছেন তার “বন্ধুদেশ” চীনতে বোঝাতে। আমি পার্টির একজন দায়িত্বশীল কর্মী হিসাবে এই কথা বলতে পারি যে আমাদের বলায় যদি কাজ হত তাহলে বাংলাদেশের লড়াইকে বাঁচাবার জন্য ও তাকে সমর্থন কঅঅরবার জন্য যা কিছু করবার প্রয়োজন তা করার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম। একথা সবাই জানেন এবং যিনি বমেছেন তিনিও জানেন, জয়নাল আবেদীন সাহেব ও জানেন যে, সোভিয়েট বা চীনের প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। আমরা কারো গুড বুকে নেই। উভয়েই আমাদের সমালোচনা করেন – একদল বলেন আমরাই আমরা কারো গুড বুকে নেই। উভয়েই আমাদের সমালোচনা করেন- এক দল বলেন আমরা বিভেদকাকামী, আরেকদল বলেন আমরা নয়া সংশোধনবাদী। কিন্তু আমি বলি আমরা নিজেদের পায়ে দাড়াতে শিখেছি এবং আমাদের মাথাটাকে কারো কাছে বন্ধক দিইনি। আমরা সব দেশকে শ্রদ্ধা করি। আর একজন সদস্য বললেন চীনকে না। ওরা কি জানেন না যে, চীন আমাদের কি চোখে দেখেন? আসলে এই সুযোগে একটু চীনবিরোধী রাজনীতি করছেন ওরা- এটা যদি বলি তাহলে কি অন্যায় চোখে বলা হবে? কই একবারও তো বললেন না আমেরিকার ট্যাঙ্কের কথা- শ্রীমতি গান্ধী নিকসন সাহেবকে একটু কম সেলাম করুন। আগে নিজেরা পরিচয় দিন, তারপর তো অন্য কথা বলবেন। কই, বললেন না তো দক্ষিন ভিয়েতনামে সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দিন। কাজেই আমি বলব আপনারা চীনবিরোধী রাজনীতি করছেন। বাংলাদেশকে আপনারা কার্যত সমর্থন করছেন না। তা যদি করতেন তাহলে আপনারা আমেরিকার ট্যাঙ্কের কথা বলতেন, সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড় হয়ে যে মিলিটারি যাচ্ছে তার কথা বলতেন, বলতেন ভারতবর্ষ থেকে কেন ট্রাক যাবে, জিনিসপত্র যাবে হত্যাকারীদের সাহায্যের জন্য? পূর্ব জার্মানির স্বীকৃতির কথা বলতেন। আমি সেজন্য বলছি এই যে বাংলাদেশের লড়াই সত্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। এর সমর্থনের জন্যে যে প্রস্তাব তাতে ভারতের আভ্যন্তরীন ব্যাপার আমি জানতে চাই না এবং আমরা প্রথমে যে ড্রাফট তৈরি করেছিলাম তাতেও আভ্যন্তরীণ ব্যাপারের কথা ছিলো না। আমি শুধু বলতে চাই যে বাংলাদেশের লড়াইকে বাঁচাতে গেলে শুধু ইয়াহিয়ার চক্রের কথা বলে লাভ নেই, কাজে সাহায্য করতে হবে। আমাদের পার্টির তরফ থেকে আমি এ কথা বলতে চাই যে, আমাদের সমর্থন শুধু মহানুভবতার জন্যে নয়, তাদের জন্য শুধু আমাদের প্রাণ কাদার জন্য নয়। আজকে বাংলাদেশের মানুষ যদি এগিয়ে যায় তাহলে ভারতবর্ষের মানুষ ও এগিয়ে যাবে, তারা যদি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে তাহলে আমাদের গনতন্ত্রের শক্তি বেড়ে যাবে এবং সেজন্য আমরা আছি, সমস্ত শক্তি দিয়ে আমরাও এগিয়ে যাব এবং সাহায্য করব। এই বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।
ডঃ জয়নাল আবেদীনঃ মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহোদয়, হঠাৎ বন্ধুরা চঞ্চল হয়ে উঠলেন কেন বুঝি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চা্ই আজকে এই বিতর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে হচ্ছে। এই বিতর্ক, আলোচনার সঙ্গে আমাদের জীবন-মরন সমস্যা জড়িত; শুধু ওপার বাংলার মানুষের নয়, আমাদেরও। তা্ই আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই যে, আজকে গভর্নরের এ্যাড্রেসের উপর আলোচনা হচ্ছে না।
মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহোদয়, আজকের এই এসেম্বলীর একটা শুভদিন। অন্ততঃ একটা বিষয়ে এই দুর্দিনে, এই দুর্দিনে শুধু সীমান্তের ওপারেই সীমাবদ্ধ নয়, যে ধারায় এই সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে, তার যে সম্ভাব্য পরিণতি তাতে আমরাও বিপদমুক্ত এ কথা বলতে পারি না। এই জন্য শুভদিন বলছি, বিরোধী পক্ষের বন্ধুরা একদিনের জন্য এই গরমিল নিয়েই আলোচনার সূত্রপাত করতে চাই। বাংলাদেশের সংগ্রাম প্রাথমিক পর্যায়ে অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলনই ছিল। জ্যোতিবাবু বলে গিয়েছেন দ্বিজাতিতত্ত্ব ধুয়ে মুছে গেছে। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই এই ভুল থিওরী দ্বারা যে একটা সংকট সৃষ্টি করা হয়েছিল তাতে যে পক্ষ ছিল সে পক্ষ স্বার্থান্বেষী পক্ষ ছিল। নিশ্চয় তারা মুছে গেছে। আমরাও গর্বিত। এই আন্দোলনে যারা বিরোধিতা করেছির সেই কংগ্রেস এই দ্বিজাতিতত্ত্ব বিশ্বাস করেনি বলেই, হিন্দু মুসলিম এই ভেদে বিশ্বাস করেনি বলেই আজকে কংগ্রেস দ্বিগুণ বলে বলীয়ান হয়ে এসছে সর্বত্র; এ কথাটা তিনি বলে গেলেন না্। কংগ্রেস আজকে এই তত্ত্বে বিশ্বাস করিনে বলেই একদিকে মুছার নিশানা আর এক দিকে বিপুল শক্তির সূচনা। এটার স্বীকৃতি দিলে খুশি হতাম।
এখন যে কথা বলছিলাম, এই সশস্ত্র বাংলাদেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সংগ্রাম অসহযোগ এবং ঐতিহাসিক পর্যায়ই রেখেছিল। হাইকোর্টের জজ, সুপ্রীম কোর্টের জজ গভর্নরের শপথ গ্রহণ করায়নি। সেজন্যই একদিন গান্ধীজী মন্ত্র দিয়েছিলেন আন্দোলন অসহযোগের দ্বারা, হিংসার দ্বারা নয়। কিন্তু আমাদের বিরোধী দলের বন্ধুরা হিংসা ছাড়া কোন সমস্যার সমাধান খুঁজে পান না। মাহাত্মা যে বানী দিয়ে গেছেন তা হল অহিংস অসহযোগ-এর পথই একমাত্র পথ, এই পথে পৃথিবীর সমস্যার সমাধান সম্ভবপর। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহোদয়, জোর করেই হোক আর যে রকম উপায়েই হোক এই সংগ্রাম সশস্ত্র পর্যায়ে চলে গিয়েছে। এর সম্ভাব্য পরিণতি কি হতে পারে? এই সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, মুক্তিফৌজের সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ইয়াহিয়া খাঁর বাহিনী একবার দখল করতে পারে, আবার মুক্তিফৌজ পাল্টা দখল করতে পারে। এই যে সংঘবদ্ধ অসম সংগ্রাম সাধারণ নাগরিক কৃষকমজর সংঘবদ্ধ হয়ে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে দেরী লাগতে পারে, এই সংগ্রাম ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হবার পথেই যাচ্ছে। এর আর একটা পরিনতি হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে দালাল লাগিয়ে, মুসলিম লীগের লোকদের হাত করে বা নুরুল আমিনপন্থী যারা আছে তাদের হাত করে বা ওই জাতীয় এজেন্ট যারা আছে তাদের হাত করে দেশের আন্দোলনকে নষ্ট করে দিতে পারে এবং বেয়নেট দিয়ে, প্রলোভন দিয়ে, ইয়াহিয়া বাহিনী সমস্ত দেশ দখল করতে পারে এবং তার ফলে আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। আমরা দেখছি আজকের এই যুদ্ধে মা এভং মেয়েরাওসামিল হয়েছেন। এইভাবে যদি তারাও সামিল হন অর্থাৎ স্বাধীনতা যুদ্ধের সামিল হন তাহলে এটা বাস্তব সত্য যে, এটা একটা পরিপূর্ণ রূপ নেবে। আজকে একটা জিনসি দেকছি আন্তর্জাতিক বৃহৎ শক্তিগুলি নির্বাক দর্শক হয়ে রয়েছে-কেউ কোন কথা বলছেন না এবং যদি বা কেউ কিছু বলেন তাহলে খুব সতর্কতার সঙ্গে বলছেন। আর একটা জিনিস দেখছি ওপারে যারা নিজেদের মহাশক্তি বলে বলছেন সেই মহাচীন এতে মদদ দিচ্ছেন এবং তাঁরা চাচ্ছেন এটাকে ডোর-স্টেপ ফর ইন্ডিয়া করতে। আজকে মহাচীনের কথা বলাতে কৃষ বাবু আপত্তি করেছেন। কিন্তু এর সম্ভাব্য পরিণিতি অস্বীকার করবেন কি করে?
আজকে ইয়াহিয়া খাঁনের যে পরোক্ষভাবে চীনেরই শক্তি সে কথা কি করে অস্বীকার করবেন? মাননীয় ডেপুটি স্পীকার
আজকে ইয়াহইয়া খাঁনের যে পরোক্ষভাবে চীনেরই শক্তি সে কথা কি করে অস্বীকার করবেন? মাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহাশয়, আমি আমেরিকার প্রশস্তি গাইছি না। আমেরিকানরা ব্রিটিশ ইম্পিরিয়ালিজম-এর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন করে স্বাধীন হোল অথচ আজকে যখন ওখানকার মানুষরা সেই একইভাবে সংগ্রাম করছে তখন তাদের মুখে টুঁ শব্দটি নেই। তারা যখন এইভাবে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করছে তখন তোমাদের কি বিবেক! মাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহাশয়, আমি যে সম্ভাব্য পরিণতির কথা বলছিলুম সেই প্রসঙ্গে আর একটা কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলি চেষ্টা করবে এই যুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী হোক যাতে করে এখান থেকে স্বার্থ লুট করা যায়। কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে, ভারতীয় হিসাবে আমাদের প্রধান কর্তব্য হবে বাংলাদেশের লোক শক্তিশালী হয়ে ইয়াহিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে এগিয়ে যাক এবং এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটুক। আজকে এই জন্যেই প্রয়োজন আমাদের যে-কোন প্রকার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া। যদি প্রয়োজন হয়, অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে নয়-অস্ত্রশস্ত্র্র ব্যতিরেকে শুধু স্বীকৃতি দিয়ে নয়, যে যে কার্যকরী পন্থা নিলে বাংলাদেশ জয়যুক্ত হয়, তা করা উচিত। আজকে এদের নিশ্চিত করুন এবং এটা ভারত সরকারের কর্তব্য। এ কথাও ঠিক, এ বিষয়ে ভারত সরকারের দায়িত্ব্য রহিয়াছে। বিরোধী দলের নেতা শ্রী জ্যোতি বসু বলেছেন যে, কাগজের প্রস্তাব না হয়ে দ্বাড়ায়। নিশ্চয়ই আমরা স্বীকার করেছি এবং প্রথম দিন যেদিন স্বীকৃতি দেবার দাবী এই বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে তোলা হয়েছে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যে প্রস্তাব এনেছেন, তাতে আমরা সকলে একমত হয়েছি। শুধু মুখ্যমন্ত্রীই নয়, শুধু পশ্চিম বাংলা নয়, বাংলাদেশের আশেপাশে যারা রয়েছেন তাঁদেরও এ বিষয়ে দেখা দরকার এবং ভারতবর্র্ষের মধ্যে আর যে রাষ্ট্রগুলি রয়েছে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীরা একজোট হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবী তোলা উচিত যে, বাংলাদেশের সংগ্রামকে এইভাবে শক্তিশালী মদদ করা উচিত যাতে বাংলাদেশবাসী জয়ী হয়। সেইজন্যে আমাদের প্রয়োজন কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর শুভ উদ্বেগ করা। আমরা এই প্রশ্নেকে যেন রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার না করি, এটা সামরিক প্রশ্ন। সুতরাং এত বড় একটা ঝুঁকি নেবার আগে নিশ্চয়ই ভারত সরকারের কর্তব্য রয়েছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে বৃহৎ শক্তি এবং ক্ষুদ্র শক্তির শুভ বুদ্ধিকে জাগ্রত করা। এই কাজ করলেই বাংলাদেশকে সাহায্য করা হবে যাতে করে তারা ঐ বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে পারে এবং সেই তৎপরতা ভারত সরকার চালিয়ে যাচ্ছে নানা প্রচেষ্টায় এবং আমরা মনে করি ভারত সরকার তার দায়িত¦ পালন করে চলেছে। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আপনি জানেন যে, আজকে বাংলাদেশবাসী কি দুর্দশায়, দুর্গতি ও লুন্ঠনের সম্মুখীন হয়েছে। এই অবস্থায় বিরোধী দলের বন্ধুরা সেখানে কিছু রাজনৈতিক স্বার্থ আদায় করার চেষ্টা করে চলেছে। আজকে হরেকৃষ্ণবাবু বলেই গেলেই ভারতের এই সাহায্য করা প্রথম দায়িত্ব আছে বলে আমরা মনে করি না। তিনি কেন্দ্রিয় সরকারের উপর চাপ দিয়ে যে কথা বলেছেন তার বেশি তাঁর আর কিছু বলার নেই, কারণ দেশের জনগণ কেন্দ্রিয় সরকারের সিলেন্ডার মেজরিটি দিয়ে দিয়েছেন-দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি দিয়ে তাঁরা দিল্লির পার্লামেন্ট করে দিয়েছে। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, ওরা মাঠে ঘাটে এই কথা বলেছিলেন যে, ইন্দিরা হঠাও। কিন্তু আজকে ওদের নাগালের বাহিরে চলে গেছে-ভারতবর্ষের মানুষ ইন্দিরাজীকে যে সংখ্যায় বসিয়ে দিল, তা এখন ওদের নাগালের বাহিরে। কিছুতেই নড়ান যায় না। ওদের কিছু উম্মা হয়েছে। সি.আর পি, মিলিটারি কেন এখানে আছে-সম্পূর্ণ নিরাপদজনক অবস্থা। কিন্তু এ কথা কি ঠিক? পশ্চিম বাংলা সীমান্তবর্তী রাজ্য।
(গোলমাল)
মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, পশ্চিম বাংলা যে সীমান্তবর্তী রাজ্য একথা অস্বীকার করলে চলবে না। এর অপর প্রান্তে রয়েছে চীন। এই কিছুদিন আগে চীনের রেসিয়াজিলম এমন কি তিব্বতকে গ্রাস করে নিল। আজকে বাংলাদেশের জন্য যে বন্ধুরা চোখের জল ফেলছেন, আমি তাদের সাধুবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু এই তিব্বতকে চীন যখন গ্রাস করল তো একটি প্রতিবাদও ওঠেনি। পরোক্ষে তাদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, সীমান্তবর্তী রাজ্য হিসাবে ভারতের কথা পশ্চিম বাংলার নিরাপত্তার জন্য এবং আর একটা শক্তির কাছ থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করার জন্য এখানে মিলিটারির প্রয়োজন আছে। একথা কি ও’রা অস্বীকার করতে পারেন? টু রেক দি কনস্টিটিউশন ফ্রম উইদিন একথা ওরা একাধিক বার বললেন গণতন্ত্রের কথা কিন্তু আজকে সেইজন্যই মিলিটারি ও সি আর পি-র প্রয়োজন আছে।
(গোলমাল)
আজকে দেখেছি ওদের রক্ষা করার জন্য সি আর পি বিপুল বাহিনীর প্রয়োজন হয়েছিল। বিরোধী দলের নেতাকে রক্ষা করার জন্য দু’হাজার টাকা ব্যয় হয় বলে জানা গেছে। শেষ কথা, এই প্রস্তাবে সরকারের আন্তরিকতা আছে কিনা, বিরোধী দলের নেতা তা বার বার বলেছেন। আমরা মুখে এক, আর মনে আর এক কথা বলি না- আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী নই। আমাদের গোবিন্দ ভাই (এম এল এ) বার বার সে কথা বলার চেষ্টা এবং আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। মাননীয় নাম্বুদ্রিপাদ সাহেব মুসলিম লীগের পিছনে ছুটে নাগাল পাচ্ছে না, এ কথা আমরা এখানে বলতে চাই না। আমি বলতে চাচ্ছি মাননীয় জ্যোতিবাবুর দল ঐ হারুন অর রশিদের পেছনে ঘোরাঘুরি করে হয়রান হয়ে গেলেন। এই আঙ্গুর কখন টক হল? তারপরে আমি ওকে জিঞ্জাসা করি গনতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থা থাকে তাহলে কোন সাহসে কোন ধৃষ্ঠতায়, কোন কৌশলে বা কি মনে করে ২৭৭ জনের হাউজে ১২৩ জনকে নিয়ে সরকার গঠনের দাবী করেন? আর এম এল এ-দের পণ্যের মত কেনা বেচার সংকল্প করেন-মুসলিম লীগের এম এল এ-কে দলে টানার চেষ্টা করেনই বা কি করে? কাজেই স্যার, আমি এই কথাই বলতে চাই যে, এ সমালোচনা জ্যোতিবাবুর সাজে না। মাননীয় সভাপাল মহাশয়, কার্যকরী ব্যবস্থার কথা সুবোধবাবু বলেছেন। সেই একই সুরে আমি বলতে চাই যে পশ্চিম বাংলার এই অবস্থা কেন করলেন আপনারা? আজকে তাদের ট্রেনিং দেওয়া যাচ্ছে না। কারন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের যেখানে ট্রেনিং দেওয়া হবে সেখানে জ্যোতিবাবুর দলের লোকেরা শিখে এসে গুলিটা চালাবে জয়নালের বুকে, নইলে গোবিন্দর বুকে কিম্বা দেশের নিরীহ মানুষের বুকে। স্যার, এ নজীর আপনি কি পাননি? আমি তাই আজকে জ্যোতিবাবুকে জিঞ্জাসা করি কেন এই অবস্থার সৃষ্টি আপনারা করলেন? সীমান্তে যেখানে আমাদের ভাইবোনেরা পড়ে রয়েছে সেখানে ত্রাণের জন্য ছুটে যাওয়া যাচ্ছে না। কারণ যাবার সময় ভাবতে হচ্ছে ঐ দমদম দিয়ে যেতে হবে যেটা জ্যোতিবাবুর এলাকা, সেখান দিয়ে যাওয়া যাবে না। এখানে গেলেই পাইপ গানের গুলি বা অন্য কিছু লাগতে পারে। কাজেই এই যে আভ্যন্তরীণ অরাজকতার সৃষ্টি আপনারা করেছেন তার চরম মূল্য আমাদের এই সংকটের সময় দিতে হচ্ছে। তবুও বলি স্যার, শুভ বুদ্ধির উদ্রেক হোক। স্যার, এই প্রসঙ্গে ওদের বলি, এই যে হানাহানির শিক্ষা বা প্রচলন যাতে আপনারা মনে করেছেন লাভবান হবেন, আজকে দিন এসেছে জ্যোতিবাবু খতিয়ে দেখুন লোকসানের হিসাবটা কি? তা না হলে আপনারা ওদিকে ছিলেন আমরা ওদিকে ছিলুম, আজকে গনতন্ত্র সেটা প্রমান করেছে বলেই আপনারা ওদিকে গিয়েছেন, আমরা এদিকে এসেছি। এই হুঁশিয়ারী বা সতর্কতা দিয়ে আপনাদের স্মরণ করিয়ে বলছি, গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে ভন্ডামি চলে না তার বিচার করেছে জনসাধারণ। একটা জাতি আজকে যেখানে বিপদে বা সংকটে পড়েছে যেখানে সমস্ত কপটতা ভুলে গিয়ে সমস্ত ভন্ডামীর ঊর্ধ্বে উঠে আসুন নিজেদের সংশোধন করে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই। ইতিহাসের শিক্ষা আপনারা স্মরণ করুন। আজকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন যাতে ঐ সমস্ত ভাইবোনের সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়। আপনারা এগিয়ে আসুন, আমাদের তরফে কোন কপটতা নেই, আপনারাও আপনাদের কপটতা বর্জন করুন। আর তা করে বাংলাদেশের সংগ্রামকে জয়যুক্ত করুন, অনুরোধ জ্যোতিবাবু, এ থেকে আপনারা অতিরিক্ত মুনাফা লোটবার চেষ্টা করবেন না। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আমার শেষ কথা হল, আজকে শুধু সাহায্য বা স্বীকৃতি নয়, আজকের এই আন্দোলন যাতে জয়যুক্ত হয় ভারত যেন কার্যক্রম গ্রহন করেন এবং সেটা করবার জন্য আমরা এই সরকার পক্ষে যতজন আছি, আমরা ঐকবদ্ধ, দৃঢ়বদ্ধ মত পোষণ করি যে, আমরা এটা সমর্থন করি। এটা জয়যুক্ত হবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি এবং তাই শুধু ওদের জীবনপণ নয়, আমাদেরও জীবনপণ করে আমরা সকলেই একে সমর্থন জানাচ্ছি। জয় হিন্দু।
শ্রী সব্রত মুখোপাধ্যায়: মাননীয় ডিপুটি স্পীকার মহাশয়, আমি প্রথমে মূখ্যমন্ত্রী কর্তৃক আনীত যে প্রস্তাব সেই প্রস্তাবকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানাচ্ছি। সমর্থন জানাচ্ছি আরও যাঁরা এখানে তাঁদের বক্তব্য রেখেছেন তাদের মধ্যে বিরোধী দলের অন্য সকলকে বাদ দিলেও সুবোধ বাবুর কিছু কিছু আ্যানালিসিসকে। যদিও তার সমস্ত বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারিনি তবুও তার বক্তব্য অন্যান্য বিরোধী দলের প্রবীণ অভিজ্ঞ নেতার চেয়ে অনেক দৃঢ় এবং প্রস্তাবের স্বপক্ষে অনেক কার্যকরী সহায়তা হবে এবং অনেকটা সহযোগিতা করেছে। আমি অবাক হয়ে দেখেছি যে, এই ঐতিহাসিক মুহুর্তে যখন আমাদের সদস্যদের একটা প্রচন্ড দায়িত্ব রয়েছে অত্যন্ত গভীরভাবে এটা চিন্তা করার, সেই মুহুর্তে আমরা অনেক জায়গায় সেটাকে লাইট করে দিয়েছি। অনেক জায়গায় প্রবীণ অভিজ্ঞ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তারা সেটাকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার অপচেষ্টা করেছেন, সেটা অস্বীকার করে লাভ নেই। অনেক বক্তব্য প্রস্তাবের স্পিরিটকে শক্তিশালী করার চেয়ে তাদের দলের স্বার্থে ব্যবহার করার চেয়ে তাদের দলের স্বাথে ব্যবহার করার চেষ্ট করেছেন, বা জয়নাল আবেদীন মহাশয় তার বক্ততায় বলেছেন। সেটা অত্যান্ত দুঃখের ব্যাপার। আপনারা প্রস্তাবকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। দলগত নির্বিশেষে এই প্রস্তাবকে গ্রহন করার জন্য আমি বিরোধী এবং সকল সদস্যকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। দরগত নির্বিশেষে এই প্রস্তাবকে গ্রহন করার জন্য আমি বিরোধী এবং অন্যান্য সকল সদস্যকে অভিনন্দন জানাই আর অভিনন্দন জানাই শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সম্পার্কত এ যাবত সমস্ত কার্যাবলীকে এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার জন্য। এটা আমার মুখের কথা নয়। হয়ত আমাদের দাবি আছে অনেক, অনেক আমাদের বক্তব্য আছে। আমাদের দাবি আদায়ের জন্য হয়ত জায়গায় একটু চাপ সৃষ্টি করতে হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাও সত্যি কথা, সীমান্তে গিয়ে দেখি আসুন যে, পূর্ব বাংলার একটা বিশেষ একটা অংশ একদিন সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা সত্ত্বে আজকে তারা শ্রীমতি ইন্দিরা নামে জয়ধ্বনি করেছে যখন ইন্দিরা গান্ধীর সাহায্য ওপার বাংলায় যাচ্ছে। আমি সীমানেত গিয়েছি। যারা সেখোনে গিয়ে তারাও নিশ্চয়ই দেখেছেন। অবশ্য সকলে গিয়েছেন কিনা আমি জানি না। তবে গেলে দেখবেন যে, এপারের বহু নরনারী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর দেশ থেকে দু’ হাত নেড়ে তাদের অভিন্দন জানাচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চযের কথা হচ্ছে যে, প্রস্তাবের সমস্ত অংশটাকে বাদ দিয়ে ‘অস্ত’ এবং ইন্দিরা গান্ধী এই দুটো শব্দকে প্রধান্য দিয়েছেন বিরোধীরা। কিসের জন্য বাংলাদেশের এই প্রস্তাবরক স্পিরিটকে আপনারা নিতে পারলেন না? নিলেন শুধুমাত্র দলীয় স্বার্থকে বড় করে দেখবার জন্য। আজকে ‘ইন্দিরা গান্ধী’ এই দুটো কথা বাংলাদেশের বুকে খবরের কাগজে বড় করে দেখবার প্রচেষ্টা করলেন। আমরা চেয়েছিলাম নেচার অফ দি মুভমেন্ট তাকে আ্যানালিসিস করা হবে। আমি বিরোধী দলের সদস্য বলে অপরাধ করিনি। অত্যান্ত ঐতিহাসিক রেজিলিউশন-এ একচটা সুযোগ চেয়েছিলাম যে আমরা পাইনি। আমি অত্যান্ত ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য ককেছি যে, বিভিন্ন জায়গায় জোর করে কংগ্রেসদল এবং ইন্দিরা গান্ধীরা সমালোচনার চেষ্টা হয়েছে আমি তার দু-একটা কথা এখানে বলতে চাই। যেখানে ইয়াহিয়ার দ্বারা মানুষ অত্যাচারিত হয়েছে সে কথা অজানা নয়। সেই মুক্তি সংগ্রামীরা কেমন সংঘাতিকভাবে লড়াই করেছে সেটা আমাদের আ্যানালিসিস করে দেখতে হবে। শুধু মুজিবর জিন্দাবাদই নয়। শুধুমাত্র বিরাট বিরাট প্রস্তাব ইত্যাদি বাংলাদেশের মানুষের সামনে তুলে দেওয়া নয়, সঙ্গে সঙ্গে এটাও সি পি এম সমর্থকরা চিন্তা করুন- জাতীয়তাবাদী শব্দটি ব্যঙ্গ করেছেন-বুর্জোয়াদের শোষণ করার শব্দ বলে আ্যানালিসিস করে বারবার বক্তৃতায় বলেছেন, ময়দানে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। সেই শব্দের যে কত জোর আ্যানালিসিস করে দেখুন। মুখ্যমন্ত্রী, আমাদের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী তখনকার গনতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে এই কার্জন পার্কে জাতীয়তাবাদী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক অধিকারে অনশন করেছিলেন। তখন আমি জানি সি পি এম বহু সদস্য প্র¯্রাব গায়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। এ কথা অস্বীকার করতে পারবেন? এখন আবার গণতন্ত্রের কথা বলছেন? আমরা বন্দে মাতনম বলি বলে এই অপরাধে স্কুলে যেতে পারব না, আমাদের মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হবে, আমাদের বাড়ি সাঁই পরিবারে পরিণত হবে। এরপরও কি মাননীয় সি পি এম সদস্যদের কাছ থেকে গণতন্ত্রের মত বড় বড় কথা শুনতে হবে? মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, মানব অভুত্থানের ¯্রষ্টা হিসাবে পৃথিবীর ইতিহাসে যে ক’টা নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে মহাত্মা গান্ধী এবং মহাত্মাজীর পরে আর একটি নাম যোগ করুন, তিনি হচ্ছেন জাতীয়তাবাদী মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। দুটোকে এক সঙ্গে দেখিয়ে আমরা বলেছি গণ-অভুত্থানের ব্যাপারে মহাত্মা গান্ধী পৌঁছতে পারেননি, সেখানে মুজিবুর রহমানর কোন কোন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন। আমরা মুজিবুর রহমানের সংগ্রামকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু তার চেয়ে বড় শ্রদ্ধা করি এই সংগ্রামের ক্যারেক্টারকে এবং নেচারকে। আমরা দেখেছিলাম ভিয়েতনামে লড়াই হচ্ছে। আজতে আপনারা চেঁচাচ্ছেন ভিয়েতনামে লড়াই হচ্ছে বলে। কিন্তু আপনারা বুকে হাত দিয়ে বুলন তো ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামের প্রতিই যদি আপনাদের সমর্থন হয় এবং সেই সমর্থনে সেদিন যে সুর আপনাদের কাছ থেকে শুনেছিলাম আপনারা ভাতের হাঁড়ির কাছ পর্যন্ত, বাচ্চা ছেলের কানের কাছে ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম গান পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং আপনাদের সমস্ত ক্রেডিট সেদিন ছিল, আমি আজকে তা অস্বীকার করছি না। সেদিন মুক্তি সংগ্রামীদের সমর্থনে হাজার হাজার মিছিল বেরিয়েছিল ব্রিগেড ময়দানে এবং কত লক্ষ টাকা খরচ করে তোরণ গেট নির্মাণ করা হয়েছিল এবং বহুবার ব্রিগেড ময়দানে মিটিং হয়েছিল। আজকে বাংলাদেশে শুধু একটি ভিয়েতনামবাসীর মত নয়, শত শত মুক্তি সংগ্রামী এগিয়ে আসছে দেখছি, তখন তো আপনাদের একটাও গেট দেখিনি, বাংলাদেশের স্বার্থে একটি শ্লোগানও তো দেখিনি যে, মিছিল ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে দেখেছিলাম, বিরোধী দলের নেতারা তো এখানে বসে আছেন, আপনারা বলুন ভিয়েতনামের জন্য ব্রিগেড যে ক’টা মিটিং করেছিলেন সেই হিসাব আজকে মিলিয়ে নিতে চাই। মুক্তি সংগ্রামই বড় কথা, না ইডিওলজি অ্যান্ড ইজম বড় কথা সেটা আপনারা পরিষ্কার করে বলুন। যদি ইডিওলজি অ্যান্ড ইজম বড় কথা হয় তাহলে আর আপনারা লোকদের ভাঁওতা দেবেন না। আর যদি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বড় কথা হয় তাহলে আমাদের সুরে সুর মিলিয়ে বলুন যে, ভিয়েতনাম যেমন যোগ্য সম্মান পাবে, বাংলাদেশের মুজিবুরের মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধও তেমনি যোগ্য পাবে। অনেক আন্তরিকতার অভাব দেখলাম, যে আন্তরিকতা তারা অনেক জায়গায় দেখিয়েছেন। তারা চাপ সৃষ্টি করবার কথা বলেছেন। তারা বলেছেন ইন্দিরা গান্ধীর কাছে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। ডেফিনেটলি সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু চাপ সৃষ্টির করার মানে এই নয় যে, আগামী ট্রাম, বাস পুড়িয়ে আপনাদের মসনদ ফিরিয়ে দেবার জন্য একই রকম চাপ সৃষ্টি যেন না হয় সেদিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন। এবং এদিকে লক্ষ্য রেখে সেইভাবে চাপ সৃষ্টি করবেন। আমি জানি এখানে মিলিটারির কথা আগে উঠেছিল। মাননীয় জ্যোতিবাবু তখন পুলিশমন্ত্রী। বিরোধী পক্ষ একবার মিলিটারি, সি আর পি-র কথা তুলেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন যে মিলিটারি সি আর পি আমাদের পয়সা পোষা হচ্ছে এবং প্রয়োজনে তারা আমাদের সার্ভিস দেবে। আমি বহু মাননীয় বিরোধী দলের নেতা, মাননীয় সদস্যদের জানি- বহু বাড়ি জানি- যেখানে শুধুমাত্র তাদের স্ত্রী-পুত্রদের সি আর পি পাহারা দেয়নি, তাদের স্ত্রী-পুত্রের পুতুলকে পর্যন্ত সি আর পি পাহারা দেয়। কলকাতা মহানগরীর বুকের উপর এমন বহু বিরোধী দলের নেতা আছেন, যাদের বাড়ি সি আর পি-তে পাহাড় দিচ্ছে আপনারা নিজেই গিয়ে দেখে আসবেন। আপনাদের নেতারা বলেছেন, “সি আর পি হঠাও, একটা বড় জুতো” একটি দেওয়ালে লেখা আছে। সঙ্গে সঙ্গে আর একটি দেওয়ালে দেখবেন সেখানে আমাদের মানে লেখা আছে “সি আর পি-র কোলে জ্যোতিবাবু দোলে” এবং সেখানে দুটি লেখার মানে সত্যিকারে মিলিয়ে নেবেন। তাই আমি মাননীয় সদস্যদের কাছে অনুরোধ করছি যে, আপনারা ইয়াহিয়ার সাথে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে এক করে দেখবেন না এবং এখানে অনেকে এক করে দেখবার চেষ্টা করেছেন।
(গোলমাল)
চিৎকার করে আমাকে বসাতে পারবেন না। আপনারা যদি আমাকে বলতে না দেন তাহলে জ্যোতিবাবুকে আমি কোনদিনও বলতে দেব না। তাই আমি অনুরোধ করছি যে, ইয়াহিয়ার সাথে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে এক করে দেখবেন না। আমি আপনাদের কাছে উদাহরণ দিয়ে বলছি যে, ইয়াহিয়া মুজিবুর রহমানের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছে। মুজিবুর রহমান মানুষের দ্বারা নির্বাচিত ইলেক্টেড প্রতিনিধি হওয়া অ্যাসেম্বলি বসিয়ে তাদের বক্তব্য রাখবার যে অধিকার সেদিন ইয়াহিয়া দেয়নি। কিন্তু আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার সে অধিকার ছিনিয়ে নেয়নি। তাহলে আপনারা কি করে বললেন যে, আপনাদের প্রধানমন্ত্রী আর ইয়াহিয়া এক? আজকে মুজিব যেভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন, আপনারা কি সেইভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন? সুতরাং আমি আর অধিক কথা বলব না। আমি শুধু একটি কথা বলছি যে, ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে সমস্ত ব্যক্তি স্বার্থের দলীয় স্বার্থের সমস্ত রকম রাজনৈতিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে আসুন দলে দলে তীর্থযাত্রীর মত সত্যিকারের সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে, একটি শব্দ বা দুটি শব্দ বড় করে না দেখে ‘অর্থ’, ‘ইন্দিরা গান্ধী’ অন্য জায়গায় দেখব, প্রয়োজনে সমালোচনা করব। আজকে অন্তত আমরা একটি প্লাটফর্মে সকলে এক হয়ে একে সমর্থন জানাই।
শ্রী মহ: ইলিয়াস রাজী: মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, মাননীয় মন্ত্রী মহাশয় যে প্রস্তাব নিয়ে আজকে এসেছেন, আমি সেই প্রস্তাব সমর্থন করছি। আজ আমরা যে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছি, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করছেন, এই সংগ্রাম দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত অন্যায় অত্যাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম। এই সংগ্রাম যারা আজকে পূর্ব বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছে ইয়াহিয়া এবং তার সামরিক শাসকগোষ্ঠী, তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করছে এবং বোঝাচ্ছে যে, পূর্ব বাংলা মানুষ এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে চাচ্ছে। এটা অত্যন্ত ভুল কথা, মিথ্যা কথা। আমরা জানি পূর্ব বাংলার মানুষ শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে যখন আওয়াজ তুলেছিলেন তখন তো তারা একথা কোনদিন বলেননি যে, এরা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায়। আজ যে ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, সেই ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ইয়াহিয়া খাঁ পদদলিত করেছে, উপেক্ষা করেছে, তার ফলে এখন যে সংগ্রাম চলেছে এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামকে পূর্ব পাকিস্তানের শসস্ত্র সামরিক বাহিনী পূর্ব বাংলার অগণিত মানুষকে হত্যা করছে। ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ মানুষকে হত্যা করেছে এবং আগামী দিনেও আরও অনেক শহরকে ধ্বংস করেছে, অনেক শিক্ষাকেন্দ্র, বাড়িও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। এইসব ধ্বংসলীলা, অত্যাচার ও নিষ্পেষণ কেন? এটা শুধু এই জন্য যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের যে অধিকার, বাঁচবার যে অধিকার, সেই অধিকারকে তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল, যার জন্য ইয়াহিয়া শাসকগোষ্ঠী ঐ রকম অন্যায় অত্যাচার করে যাচ্ছে। আমাদের কাছে অর্থাৎ ভারত সরকারের কাছে পূর্ব বাংলার সংগ্রামী মানুষ সাহায্য ও সহানুভূতি চাচ্ছে। যদিও সাহায্য ও সহানুভূতি আমরা তাদের কিছু কিছু দিচ্ছি। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার যে ব্যাপার-ভারত সরকার যদি সেই স্বীকৃতি দিতে দেরী করেন, তাহলে সেখানকার মানুষের দুঃখ কষ্ট দুর্গতি যা হয়েছে ও হচ্ছে, সেই দুঃখ-দুর্গতি আরও বাড়বে, বেশি হবে। সেইজন্য আজকে তাদের স্বীকৃতি দেওয়াটা বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়াটাই হচ্ছে জরুরী ব্যাপার আমাদের ভারত সরকারের কাছে। এটাই সমধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং এই আশা এবং ভরসা আমরা করছি যে, পূর্ব বাংলা জয়ী হবে সেখানে এমন একটা সরকার কায়েম করবে যেখানে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষ বাঁচবার মত সুযোগ পাবে, এই আশা এবং ভরসা নিয়ে আজকের এই প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
শ্রী কাশীকান্ত মৈত্র: মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আজকের এই ঐতিহাসিক এবং স্মরণীয় যে প্রস্তাবটি এসেছে, সেই প্রস্তাবটি আমি সমর্থন জানাচ্ছি এবং বিরোধী দলের যেসব নেতারা এই হাউস-এ একটা প্রস্তাব করার যে প্রচেষ্টা করেছেন তাদের আমি আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমাদের দু’পক্ষের ব্যবধান যতই হোক না কেন, আজকের দিনে যদি একমত হয়ে একটা প্রস্তাব নিই, সেই প্রস্তাবের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক এবং সেই প্রস্তাব পাস হওয়ার একান্তা প্রয়োজনীয়তা ছিল। আজকে সর্বাগ্রে আমি মনে করি যে, সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে স্বাধীন বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি আপনারা জানেন। যে কয়টি শর্ত স্বীকৃত হলে আন্তর্জাতিক আইনে একটা রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া চলে, আর প্রত্যেকটি টেস্ট বা পরীক্ষাতেই এই স্বাধীন বাংলা উত্তীর্ণ হয়েছে। আইনে আছে আপনারা জানেন টেরিটরি পপুলেশন, অর্গানাইজেশন সভেরন্টি বোথ এক্সটার্নাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল, এই চারটি শর্ত যদি উত্তীর্ণ হতে পারে তবে যে কোন রাষ্ট্র এবং যে কোন জাতি আত্মানিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে স্বীকৃতি পেতে পারে। বিগত বিশ্বযুদ্ধের সময় আমরা জানি এই পূর্ব এশিয়াতে নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দু সরকার গঠিত হয়েছিল, সেই আজাদ হিন্দু সরকারের স্বীকৃতি মিলেছিল আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে। পৃথিবীর ন’টি রাষ্ট্রের কাছ থেকে এবং সেখানেও এই পপুলেশন, অর্গানাইজেমন, সভরেন্টি, টেরিটরি এই চারটি পরীক্ষাতে তার সরকার উত্তীর্ণ হয়েছিল। গত যুদ্ধের সময় দেখেছিলাম ফ্রান্সের সরকার জেনারেল দ্য গল তার নিজের দেশ থেকে পালিয়ে এমিসার গভর্নমেন্ট করে গভর্নমেন্ট ইন এক্সাইল- ফরাসী থেকে ইংল্যান্ড এসে বসেছিলেন এবং সেখানে তার পেছনে এই সমস্ত টেস্টে উত্তীর্ণ হবার তার কোন কারণই ছিল না এবং সেদিন তিনি হননি। তা সত্ত্বেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দ্য গলের গভর্নমেন্ট ইন এক্সাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আজকে কেন বাংলাদেশের সরকার স্বীকৃতি পাবে না। স্বীকৃতি নিশ্চয়ই তারা পাবে এবং তার জন্য সমস্ত রকমের চাপ পশ্চিম বঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের পক্ষ থেকে আমরা দেবে এই বিষয়ে বিরোধী পক্ষের সঙ্গে একমত। কিন্তু আমি একটা প্রশ্ন করছি, মাননীয় সুবোধ বাবু কয়েকটি তাত্ত্বিক প্রশ্ন তুলেছেন। তাত্ত্বিক প্রশ্ন নিয়ে মতভেদ থাকবেই। কিন্তু আমি বলছি যে, ওপার বাংলায় যে বিরাট ঐতিহাসিক আন্দোলন চলেছে, তার সম্বন্ধে তারই দলের নেতা শ্রী শিবদাস ঘোষ মহাশয়ের বক্তৃতা আমি শুনিনি কিন্তু কাগজে পড়েছি, তাতেও স্বীকার করতে কোন দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে, ওপার বাংলায় এই যে বিরাট আন্দোলন সাড়ে সাত কোটি মানুষের হচ্ছে, এরা মার্কস পড়ে নেতৃত্বে দিচ্ছেন না, মার্কস, চেগুয়েভারা, স্ট্যালিন, লেলিন, ট্রটস্কি, মাও সে তুং এদের তত্ত্বের উপর নির্ভর করে লড়াই করছে না, অতি সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক তত্ত্বকে ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে লড়াইয়ে নেমেছে। জীবন তত্ত্বের চেয়ে অনেক বড়। তত্ত্বও নিয়ে আমরা পড়ে থাকি, তাহলে আমরা দেখব জীবন তত্ত্বকে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। জীবনের জন্য তত্ত্ব, তত্ত্বের জন্য জীবন নয়। মাননীয় সুবোধ বাবু তিনি স্পেনের সিভিল ওয়ারের কথা বলেছেন। স্পেনের সিভিল ওয়ারের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়েছি, আজকে এখানে স্মরণ করবার নানা কারণ আছে, আমি তাকে ধন্যবাদ দিই যে, তিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধের কথা তুলেছেন। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয় স্পেনের গৃহযুদ্ধে অন্যতম বড় শিক্ষা হয় যে, সেদিন পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক স্পেনের পিছনে আসেনি এবং সেদিন ফ্রাঙ্কো যে সমর্থন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রদ্বয়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন তারা হলেন জার্মানি ও ইতালি এবং তারই ফলে ফ্রাঙ্কো জিতেছিলেন এবং প্রজাতান্ত্রিক স্পেনের সংগ্রামী ভাইরা সেদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আর একদিক থেকে খুব ট্রাজিক হলেও স্বীকার করতে হয় যে, স্পেনের গৃহযুদ্ধের ইন্টারন্যাশনাল ওয়ারকিং ক্লাস সেদিন এগিয়ে আসেনি। বর্গানুর মত একজন কমিনিস্ট নেতা যিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল সেক্রেটারিয়েট ছিলেন তাঁর বিখ্যাত পুস্তক কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল তিনি স্বীকার করে গেছেন যেম স্পেনের গৃহযুদ্ধে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হচ্ছে যে পৃথিবীর কোন সমাজতান্ত্রিক কি বুর্জোয়া দেশের শ্রমিক শ্রেণি সেদিন এগিয়ে আসেনি যা তাদের আসা উচিত ছিল। অথচ একটি ফ্যাসিষ্ট রাষ্ট্র তার সমস্ত শক্তি নিয়ে প্রজাতান্ত্রিক স্পেনের বিরোদ্ধে সমর্থন জানিয়েছিল। এখানেও তাই ঘটেতে চলেছে। আজকে আমরা যদি গণতান্ত্রিক শক্তিকে সমর্থন না করি, আমরা যদি বাংলাদেশের যে বিরাট মুক্তিযুদ্ধ চলেছে তাকে সর্বতোভাবে সমর্থন না জানাই তাহলে ফ্যাসিবাদের যেখানে উদ্ভব হবে এবং আমরা ইতিহাসের কাঠগড়ায় উঠব। সুতরাং স্বীকৃতি আমাকে দিতেই হবে। তত্ত্বের কথা বলেছেন- তত্ত্বের সেই ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং ক্লাস সলিডারিটি কোথায়? এ তো সিংহালে কথা একজন সদস্য বলেছেন, আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, সিংহলে যুক্তফ্রন্টে হয়েছিল শ্রীমতি বন্দনায়কের নেতৃত্বে। সেখানকার ট্রটস্কিপন্থী এবং বিপ্লবী সমস্ত দল যুক্তফ্রন্ট তৈরি করে সরকার করলেন। যেদিন যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হল সেদিন ময়দানে প্রথম বিজয় উৎসবের সমাবেশে ডাঃ কটিশা সিলভা, সেখানে ট্রটস্কি দলের নেতা, আর্ন্তজাতিক বিশ্ব বিপ্লবের নেতা তিনি বক্তৃতা দিয়ে বলেছিলেন তালিম উদ্ভব ভারতবাসীরা তোমরা এবার চলে যাও, আমাদের দেশের সিংহলের মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। ওয়ার্কিং ক্লাস অফ দি ওয়ার্ন্ড ইউনাইটেড কোথায়? ভিয়েৎনামের একটি মাইলাই হয়েছিল, তাতে লক্ষ মানুষ মরেছে আমেরিকার সা¤্রাজ্যবাদীদের সামনে। কিন্তু কোথায় আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণী তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালো? নিউ লেফট লিবারেল যারা উদারপন্থী তরুণ যুবকের দল, শিক্ষা, অধ্যাপক, সাধারণ মানুষ তারা তো আমেরিকার যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি? কই আমেরিকার কারখানার শ্রমিকরা প্রোডাকশন বন্ধ করে দেয়নি যে, না, ভিয়েতনামের শ্রমিক কৃষক ছাত্র যুবক নারীর উপর নির্বিচারে আমেরিকার সেনাবাহিনী গুলী চালাচ্ছে, বোমাবর্ষন করছে, নেপাম বোমা ফেলেছে, আমরা এ মারণান্ত্র তৈরি করব না। ওয়ার্কিং ক্লাস সলিডারিটি এ কথা তো লেনিন বলেছিলেন, কিন্তু ইতিহাসের সে জীবন তত্ত্বের আমি তো কোন মিল দেখছি না। চীনে যাঁরা সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন তাঁরা আজকে ইয়াহিয়া খাঁনকে সম্পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছেন। মাননীয় সদস্য হরেকৃষ্ণ কোঙার মহাশয়কে আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলছি, তাঁকে কোন আঘাত করব না, রাজনীতে আমার সঙ্গে তার মতের তুমুল পার্থক্য আছে ও থাকবে। তিনি কয়েকটা প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি একটা তুলনামূলক বক্তৃতা ভারত সরকারের সঙ্গে করেছেন এবং সব সময় আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশের আন্দোলন সম্বদ্ধে যদি স্পষ্টভাবে প্রচার ঠিক না হয়ে তাহলে বিদেশী রাষ্ট্ররা তার সুযোগ নিয়ে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে যাবে। কিন্তু আমি তাকে দুঃখের সঙ্গে বলছি যে, তিনি যে বক্তৃতা করলেন সেই বক্তৃতা যদি ঝাপিয়ে বিলি করা যায় পাকিস্তান এমব্যাসি তার সবচেয়ে বেশি সুযোগ নেবেন। তবে আশার কথা এই যে, আমাদের বিধানসভার প্রসিডিংস ছেপে যখন বেরুবে তখন ২-৩ টা সরকার অদলবদল হয়ে যাবে, ২-৩ টা বিধনসভা বসবেএবং সেটা যাবে না, এটা আশার কথা। আরও তিনি বলেছেন কেন মিলিমিটারি থাকবে। আজযে যে মুহূর্তে স্বীকৃতি দেয়া হবে সে মুহূর্তে প্রস্তুত থাকতে হবে যুদ্ধের জন্য, যে কথা মাননীয় সদস্য বিশ্বনাথ মখার্জি তুলে ধরেছেন। আমি জিজ্ঞাসা করছি তখন কি মাননীয় সদস্য হরেকৃষ্ণ কোঙার এবং অন্যান্য দলেরা বললেন যে, না চীন সমাজতান্ত্রিক দেশ? মনে রাখবেন ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়ে গেছে এক কালে। কিন্তু ভেড়া চুরির অভিযোগে একটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিশ্বযুদ্ধের হুঙ্কার দিতে পারে সে এক চীন সম্রাজ্য দেখিছিল যে, ভারত চীনের ৯০০ ভেড়া চুরি করে নিয়ে গিয়ে ছিল। তার জন্য তারা ৯০ ঘন্টার আন্টিমেটাম দিলেন। আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন কারণ তাঁর শক্তি ছিল না। তখন কি আবার ভারতবর্ষ আক্রমণস্থলে আক্রমণকারী রাষ্ট্র এবং আক্রান্ত রাষ্ট্রের মার্ক্সিস্ট শ্রেণী চরিত্র নিয়ে বিচার বসবেন? জিজ্ঞাসা করছি বলতে হবে আপনাকে। ভারতবর্ষ স্বীকৃতি দিক আমরা চাই, কিন্তু স্বীকৃতি দিলে তার পরিণতি স্বরূপ যদি বিশ্বযুদ্ধ আসে, যদি চীন বা যে কোন রাষ্ট্র ভারতবর্ষের উপর হামলা করে তাহলে আমরা সবাই কি তখন হাত মিলিয়ে সরকারের পিছনে দাঁড়িয়ে লাড়াইয়ের জবাব দেব, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়তে বলব? বলুন না? তখন দেখবেন আবার শ্রেলীতত্ত্বের আলোচনা এসে যাবে। আজকে যখন লড়াই আসবে তখন সৈন্য আসবেই। আমি, জ্যোতিবাবু, হয়ে কৃষ্ণবাবু ধুতি-পাঞ্জাবী পরে লড়ব না।
(শ্রী হরেকৃষ্ণ কোঙারঃ দয়া করে আপনার সাথে আমার নাম জড়াবেন না। সি আই এর এজেন্ট। )
কে কার এজেন্ট? একটা কথা মনে পড়ছে শ্রদ্ধেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস দেবদাস লিখবার পর বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা সাহিত্য সমালোচক, তিনি আজ পরলোক। তিনি ঐ বইয়ের অত্যন্ত প্রশংসা শুনে সহ্য করতে না পেরে লিখলেন, “হ্যাঁ শরৎবাবু গণিকালয়ের যে ছবি এঁকেছেন বড়ই নিখুঁত এবং বড়ই বাস্তবগ্রাহ্য এবং চমৎকার। ” যখন শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের কাছে এই সমালোচনাটা পড়ে শোনানো হল তিনি তখন বললেন, “অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছেই ধরা পড়েছে-এইটাই আমার সান্ত্বনা। ” তা সি আই এ সম্বন্ধে এত খবর যারা রাখেন তাঁরা সি আই এ স্পেশালিস্ট। ওঁরা সি আই এ বলে দুনিয়াকে খেপাচ্ছেন। এই তো নকশালপন্থিদের সি আই এ বলছেন। সবাই সি আই এ; তবে আপনারা কারা? সুতরা! এত খবর রাখছেন কি করে? দালালের খবর দালালরাই রাখে। ‘দালালস্য দালাল’ যারা তারা রাখে।
সুতরাং মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আজকে যে ঐতিহাসিক প্রস্তাব এসেছে তাকে আমরা সর্বান্ত:করণে সমর্থন জানাচ্ছে। আমি………………………………….
(বিরোধী পক্ষের বাধাদান)
আমরা বক্তৃতার সময় যতই ওরা বাঘা দিন ও ‘দালাল’ বলে গালাগালি দিন আমি কখনই দাঁড়াইনি বা ভবিষ্যতেও করব না এ আশ্বাস প্রত্যেকে দিচ্ছি। কিন্তু মনে রাখবেন কাচের ঘরে বাস করে রাস্তার লোককে ইট মারলে বড় বিপদ হয়। রাস্তার ধারে কাচের ঘরে বাস করে লোককে ইট ছুঁড়লে যা পরিণতি হয় তার জন্য আপনারা প্রস্তুত থাকবেন। সরকারী আশ্রয় দালালী করে মেলে না। সত্য কথা বলে যাব। তাতে আপনাদের কাছে দালাল হতে পারি। চিরদিন ভারতবর্ষের আপামর জনসাধারণের দালাল হব। চীনের দালাল হব না, আমেরিকার দালাল হব না এবং বিড়লার দালাল হব না। মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয় খেয়েও পেট ভরছে না। আমেরিকার কাছ থেকে, চীনের কাছ থেকে, রাশিয়ার কাছ থেকে খেয়েও পেট ভরে নি, শেষকালে টাটা-বিড়লার কাছ গিয়ে হাত পাতছে। সুতরাং ওসব কথা বলে লাভ নাই।
(সরকার পক্ষের তুমুল হর্ষধ্বনি)
ওসব নাটক করে লাভ নেই। আমরা জানি হু ইজ হু অ্যান্ড হোয়াট ই হোয়াট। এখনও চ্যালেঞ্জ করছি হরেকৃষ্ণবাবু ও তার দলের কাছে- বলুন- ভারতবর্ষ অস্ত্র দিক, আমরা দাঁড়িয়ে বলছি পাকিস্তান কি চীন হামলা করলে আমরা এক সাথে দাঁড়িয়ে লড়ব। ঘরের লড়াই আমরা বিচার করব। কিন্তু সে উত্তর আসবে না। সুতরাং এখান থেকে ই বুঝবেন আসল লক্ষ্যটা কি।
আমি আমার বক্তব্য শেষ করবার আগে আবার বলছি যে, বাংলাদেশে……………..
(গোলমাল)
মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আপনাকে হাউসের শান্তি রক্ষা করতে হবে। তা না হলে এটা তো একতরফা যাবে না। আপনাকে তো আমাকে প্রোটেক্ট করতে হবে। তা না হলে প্রিভিলেজ আমারও ভায়োলেটেড হবে।
আজকে তাই বলছি, যে প্রস্তাব এসেছে তাকে সমর্থন করছি এবং ওপার বাংলায় যে ঐতিহাসিক লড়াই চলছে তাকে কেউ ব্যর্থ করে দিতে পারে না। যাঁরা বলছেন ওপার বাংলা থেকে আমাদের প্রেরণা পাবার কিছু নেই তাঁরা ভুল। যদি ভিয়েৎনাম থেকে প্রেরণা পাওয়া যেতে পারে, যদি রুশ বিপ্লব থেকে প্রেরণা পাওয়া যেতে পারে তাহলে আমি বলব ভারতবর্ষের ৫৩ কোটি মানুষ আজকে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা পাবে ওপার বাংলার বঙ্গবন্ধু মুজিবের নেতৃত্বে যে লড়াই হচ্ছে এবং সর্বশেষে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কথায় বলি:-
(বিরোধী পক্ষের হাস্যরোল)
বিশ্বকবির নাম হতেই এত ব্যঙ্গ কেন বুঝতে পারছেন। কারণ রবীন্দ্রনাথ ওদের কাছে বুর্জোয়া কবি।
“মৃত্যুর অন্তরে পশি অমৃত না পাই যদি খুঁজে
সত্য যদি নাহি মেলে, দু:খ সাথে যুঝে
পাপ যদি নাহি মরে আপনার প্রকাশ লজ্জায়,
অহঙ্কার নাহি মরে আপনার অসহ্য সজ্জায়। ”
মাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহাশয়, এই রকমভাবে একটা অশালীন আচরণ যদি একটা দল করে তাহলে অন্যায় হয়। …………..(এ ভয়েসঃ প্রেস লিখছে। ) প্রেস আমাদের লোক নয়। প্রেস আপনাদের ভয় করে, আমাদের করে না। আপনারা আনন্দবাজার —- যুগান্তরের সাংবাদিকদের মেরেছেন, ভ্যান জ্বালিয়ে দিয়েছেন। ঐ আনন্দবাজারের লোকদের সঙ্গে আপনাদের দলের নেতা জ্যোতিবাবু গ্র্যান্ড হোটেলে ভোজন করেছেন। ঐ আনন্দবাজার, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, যুগান্তর ইত্যাদিরা ফলাও করে আপনাদের খবর বের করে। ——–(গোলমাল) “বীরের রক্তস্রোত, মাতার অশ্রুধারা; এর যত মূল্য সে কি করার ধূলায় হবে হারা”এত রক্তস্রোত কখনও ব্যর্থ হবে না। মুজিবরের নেতৃত্বে যে আন্দোলন চলছে সেই আন্দোলন জয়যুক্ত হবেই। ওঁরা কারুর প্রেরণা পান, না পান তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা প্রেরণা পেয়েছি, গোটা বিশ্ব প্রেরণা পেয়েছে। জয় হিন্দ।
শ্রী অনিলকুমার মান্না: মাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহাশয়, আমি গণতান্ত্রিক কোয়ালিশন সরকারের মখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের যে প্রস্তাব এনেছেন সেই প্রস্তাব অন্তরের সঙ্গে সমর্থন করছি। সেই সঙ্গে সমর্থন জানাই আজ বিরোধী পক্ষ ও সরকার পক্ষ একত্রিত হয়ে এই বিরাট মানুষের অধিকার অর্জনের যে অধিকার সেই অধিকারকে আজ উভয় পক্ষ মেনে নিয়েছেন এবং তাই তাদের জানাই আমাদের অন্তরের আন্তরিকতা। আমি একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বিরোধী নেতা তার বক্তব্যে একটা কথা বলে গেছেন যে, আজ এই প্রস্তাব শুধু প্রস্তাব থেকে যাবে না। এর ভেতরে আন্তরিকতা আছে- আমি এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একমত। আমি বলতে চাই যে, আজ এক মাস অতিক্রম হয়ে গেল পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী শাসনের বর্বর অত্যাচারে ওপার বাংলার হাজার হাজার শিশু, বৃদ্ধ নরনারী তাদের জীবনের সমস্ত দিয়ে লুন্ঠিত হচ্ছে, নি ষ্পেষিত হচ্ছে। আজও তারা ঐ রকম জঙ্গীশাহী ট্যাঙ্ক, বুলেটের কাছে নিষ্পেষিত হচ্ছে, কিন্তু ঐ জঙ্গীশাহী শাসনের অবসান করতে পারে নি। কিন্তু আজও তারা পূর্ব বাংলার মানুষের ওপরে নির্যাতন এবং পশ্চিমশাহী জংলী শাসনের অবসান করতে পারে নি, তাদের সেই প্রস্তাব প্রস্তাবই থেকে গেছে, তাদের মুখের কথা কথাই থেকে গেছে। তার সুরাহা করতে বা সেই জংলী শাসনের অবসানকল্পে কোনরকম একটা প্রস্তাব ভারত সরকার বা পৃথিবীর অন্য কোন রাষ্ট করেনি। যারা আজকে পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট, যাদের কথায় পৃথিবীর পৃথিবীর প্রতিটি উঠে বসে আজ তারা কোথায়, আজকে তারা নিরব কেন? আমি তাদের প্রশ্ন করি বাঙ্গালী জাতির প্রতি তাদের কি কোন কর্তব্য নেই? আজকে পূর্ব বাংলার এই যুদ্ধ কি ইতিহাসের যুদ্ধের মতই থেকে যাবে? একটা দেশ আর একটা দেশকে জোর করে দখল করছে, তাদের ভূখন্ড হরণ করে নিয়েছে- এই সমস্ত মানুষগুলির বাঁচার অধিকারকে পশ্চিমবাহী জংলী শাসন বছরের পর বছর ধরে হরণ করে রেখেছে, সেই অধিকারকে অর্জন করার জন্য আজকের এই সংগ্রাম। আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ভারত সরকার তাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে না। আজকে আমি ইন্দিরা সরকারকে প্রশ্ন করব কেন তোমরা ওপারের বাঙ্গালীর বাঁচার অধিকারকে আজও স্বীকৃতি দিচ্ছ না। আজকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে কোন বাধা নেই, কারণ পূর্ব বাংলা তাদের নিজস্ব ভূখন্ড এবং সেখানে ৯৯.৬ দশমিক গণতান্ত্রিক ভোটে জনগণ তাদের রায় দিয়েছে, সেখানে জাতীয় সভার সভ্যদের নির্বাচিত করেছে অথচ কেন তাহলে আজকে ভারত সরকার তাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে না-এই প্রশ্ন আজকে প্রতিটি ভারতবাসীর, এই প্রশ্ন আজকে বাঙ্গালী জাতির, এই প্রশ্ন আজকে প্রতিটি শোষিত মানুষের। যখন আমরা দেখতে পাচ্ছি পশ্চিম বাংলার হাজার হাজার মানুষ দুবেলা খেতে পাচ্ছে না, যখন তারা তাদের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে তখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, পূর্ব বাংলা থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে ভারতের বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার এই সমস্যাকে আরও সমস্যাসঙ্কুল করে তুলছে। আজকে ইন্দিরা সরকার বোধ হয় মনে করছে যদি আমরা পূর্ব বাংলাকে স্বীকৃতি দেই তাহলে অন্য কোন রাষ্ট চীন, রাশিয়া বা আমেরিকা আমাদের আক্রমণ করবে বা
অন্যকোন কোন রাষ্ট্র আমাদের আক্রমণ করবে- এই ভয়ই ইন্দিরা সরকারের প্রধান বাধা। কিন্ত তারা দেখেছেন যে, ১৯৬২ সালে যখন চীনের দ্বারা আমাদের দেশ আক্রান্ত হয়, যখন ১৯৬৪সালে পাকিস্তান আমাদের দেশ আক্রমণ করে তখন এটা প্রমাণ হয়ে গেছে ভারতবর্ষের মানুষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, তারা দেখিয়েছে যে, ঐরকমভাবে নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো সংগ্রামের পেছনে তারা রয়েছে, তার জন্য নিজেদের শক্তি, নিজেদের রক্ত, নিজেদের সমস্ত অধিকারকে তারা বিলিয়ে দিয়েছে। যেকোনো আন্তর্জাতিক শক্তি, যেকোনো রাষ্ট্র যদি আমাদের রাষ্ট্র ভারতকে আক্রমণ করে- আমরা একতাবদ্ধ হয়ে সমস্ত জাতি যদি রুখে দাড়াই তাহলে কোন শত্রু আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবেনা এই বিষয়ে আমরা সুনিশ্চিত। তাই আমি বলতে চাই, পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য ভারত সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে হবে, শুধু ঐ প্রস্তাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আমাদের জনমত সংগ্রহ করতে হবে, আমাদের এখানে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, যে আন্দোলনের ফলে ভারত সরকার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রগুলি তাদের স্বীকৃতি দেবে এবং বাঙ্গালী জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে তারা মেনে নিবে এই বলেই আমি শেষ করছি। জয় হিন্দ।
শ্রী প্রয়াগ মণ্ডলঃ মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী যে প্রস্তাব বাংলাদেশ সম্পর্কে রেখেছেন সেই প্রস্তাব আমি সমর্থন করছি এবং সমর্থন করার সাথে সাথে বলছি যে, এই প্রস্তাব সম্বন্ধে কোন আন্তরিকতা আছে কিনা সেই প্রশ্ন বিভিন্ন দিক থেকে উঠেছে এবং এটা উঠাই স্বাভাবিক। কারণ আমরা জানি অনেক সময় অনেক প্রস্তাব নেওয়া হয়ে থাকে কিন্ত সেই প্রস্তাবগুলি ঠিকভাবে কার্যকরী করা হয় না। প্রস্তাব বা চুক্তিগুলি নেওয়া এক কথা এবং এগুলো কার্যে পরিণত করা আর এক কথা। সুতরাং আমি একমত যে এটার মধ্যে আন্তরিকতা আছে কিনা। নেহেরু-লিয়াকত যে চুক্তি ছিল তা মানা হয়নি। তাছাড়া জেনেভা এগ্রিমেন্ট যেটা আছে সেটাও হয়ত মানা হয় নি এবং আমাদের পূর্ববাংলা ইয়াহিয়ার জঙ্গীশাহী যে আক্রমণ সেটা আমাদের পশ্চিমবাংলার হয়ত ৪-৫ কিলোমিটারের মধ্যে হয়ত এসে পড়েছে এবং অনেক লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি আরও বলতে চাই যে, আমাদের এই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের পূর্ববাংলার ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের মত গণ্য করতে হবে। আমি বলতে চাই সরকার পক্ষকে যে, এই প্রস্তাব শুধু কাগজে না লিখে মুখ্যমন্ত্রী তো দিল্লী যাচ্ছেন, তিনি বলুন কেন্দ্রীয় সরকারকে এদের স্বীকৃতি দিতে হবে। আমি আনন্দিত যে এই প্রস্তাবের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র কথাটি আছে এবং সাথে আছে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। এখানে আমি একটু বলতে চাই, অস্ত্রশস্ত্র কথাটাকে গৌণ ধরে মুখ্য হিসাবে যদি চাল, মুড়ি, বিড়ি এগুলোকে ধরা হয় তাহলে খারাপ হবে এবং এই প্রস্তাবের কোন অর্থ থাকবেনা। তাই আমি বলছি, এক মাস বারো দিন পর কেন এই প্রস্তাব নিতে হবে, এটা আপনারা তো ইচ্ছা করলেই করতে পারেন। আপনারা দিল্লীতে গিয়ে বলুন বা সমস্ত জায়গা থেকে দিল্লীতে গিয়ে আবেদন করুন যে, এই সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক বা অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হোক। যাই হোক এছাড়া এই প্রস্তাবের মধ্যে অন্যান্য যে সমস্ত কথা রয়েছে যে, ইয়াহিয়া খান খারাপ লোক বা তার গণহত্যা অভিযানকে ধিক্কার জানানো হোক-এগুলি জানিয়ে লাভ নাই কারণ এক একটা শ্রেণীর এক একটা চরিত্র থাকে এবং সেই চরিত্রমত সে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের পায়ের তলা থেকে যখন মাটি সরে যায় তখন তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে এবং শেষ কামড় দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং সেটাই পূর্ববাংলায় হচ্ছে এবং তার ঢেউ এখানে এসেছে। ঠিক ইলেকশনের আগে প্রেসিডেন্ট রুলের সময় আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন জায়গাতে, গ্রামে সি আর পি মিলিটারি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্ত আমাদের সীমান্তে চীন আছে। যেকোনো সময় তারা আক্রমণ করতে পারে। এগুলি প্রতিক্রিয়াশীলদের পয়েন্ট, এক ঠেকা দেওয়ার জন্য তাঁরা অনেক কথা বলেন। এগুলি যারা করেন সেই সরকার কি করে পূর্ববাংলার আন্দোলনকে সমর্থন জানাবেন? যা হোক সরকার পক্ষ থেকে শুনলাম তাঁদের নাকি আন্তরিকতা আছে। ভাল কথা, আনন্দের কথা। আমাদের পশ্চিম বাংলার মানুষ যখন জাগবে, যারা অত্যাচারিত, নিষ্পেষিত তারা একদিন না একদিন জাগবে এটা খুব পরিষ্কার। তখন তাঁরা মন্ত্রীসভায় থাকুন আর নাই থাকুন, পশ্চিম বাংলার নাগরিক হিসাবে তাঁদের যে আন্দোলন হবে তাকে অন্ততঃ অন্তর থেকে সমর্থন জানাব এই বলে আমি শেষ করছি।
শ্রী অজিত কুমার গাঙ্গুলীঃ মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহোদয়, মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় যে প্রস্তাব এনেছেন, সেই প্রস্তাব আমি সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি। শুধু মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় এই প্রস্তাব এনেছেন বলেই নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন বাংলাদেশের মানুষকে সেখানের সমস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, আজকে এই হাউসে এই যে প্রস্তাব এসেছে সেটা চার কোটি পশ্চিমবঙ্গ বাসীর প্রতিভূ এই বিধানসভার সদস্যদের পক্ষ থেকে এসেছে। সেজন্য এর একটা মৌলিক গুরুত্ব আছে। সাধারণভাবে অনেকসময় অনেক প্রস্তাব এখানে সমর্থিত হয়, সেটা একটা দিক, আজকে উপাধ্যক্ষ মহাশয় যদি প্রস্তাবটা দেখেন এটা শুধু সমর্থনসূচক নয়, এই প্রস্তাবের একটা গভীর তাৎপর্য রয়েছে। প্রতি প্যারাতে দেখবেন একটি কার্যকরী সমন্বিত ধারা রয়েছে। আমি সেদিক সম্বন্ধে আপনার মাধ্যমে এই সভায় উপস্থিত করতে চাই। সেটা হচ্ছে, আপনি লক্ষ্য করেছেন, বাংলাদেশে যে লড়াইটা হচ্ছে সেই লড়াই অত্যাচারীর বিরুদ্ধে লড়াই নয়, এটা একটা উপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্তির লড়াই। লিবারেশন স্টাগল ফ্রম কলোনিয়াল অপ্রেশন। এটা আমাদের বুঝতে হবে। আমারও বাড়ি পূর্ববঙ্গে। আপনারা প্রায়ই বনগাঁর নাম শুনে থাকেন, সেই বনগাঁ থেকে ঝিকরগাছা ১৯ মাইল দূরে গেলেই দেখতে পাবেন, সেখানে নতুন বাড়ি ১১খানার বেশি হয়নি এই অত্যাচারী শাসনের অধীনে। ওখানে বেনাপোলের বাজার, নাভারণ বাজার, ঝিকরগাছা বাজার যতদূর যাবেন দেখতে পাবেন কত অন্যায় হয়েছে। একটা উপনিবেশিক দেশকে সেই অবস্থায় রেখে দিয়েছে। আমরা এটা বুঝি। কেননা আমরা এই উপনিবেশিক দাসত্বের মধ্যে ছিলাম, আমরা জানি ব্রিটিশদের অত্যাচার কি। সেই অত্যাচারের কাহিনী মনে রেখে আমরা এই জিনিস উপলব্ধি করতে পারি। কারণ, উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই পশ্চিমবঙ্গবাসী করেছিল। আজকে ওখানে যে লড়াই চলছে সেই লড়াইয়ের প্রতি সেদিক দিয়ে আমাদের সহানুভূতি আরও গভীর। এরা কি অত্যাচারই না করেছিল। আপনি উপাধ্যক্ষ মহাশয়, জানেন ইয়াহিয়া জন্ত- জানোয়ারকেও ছাড়িয়ে গেছে। যশোরে পোলের হাট বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে বাড়িতে চারজন মরা পড়ে আছে। একটা কুকুর পোষা কুকুরই হবে সেই মড়াগুলিকে শকুনের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্যই হয়ত পাহারা দিচ্ছে। একটা কুকুরের যে বোধ আছে ইয়াহিয়ার সেই বোধও নেই। শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মাননীয় সদস্যরা অনেকে জানেন, খবরের কাগজ দেখে থাকবেন, লোকমুখেও শুনে থাকবেন এই লড়াইয়ের কাহিনী। তাদের অনেকে দশ- বারদিন পর্যন্ত স্নান করতে পারেনি, তার মধ্য থেকেই লড়েছে, তাদের দেহ বন্ধ হয়ে আসছে কিন্ত এর মধ্যে থেকেই লড়াইয়ের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই অবস্থার মধ্যে তারা এতদিন রয়েছে। একমাসের বেশী হয়ে গেল আজ পর্যন্ত তাদের স্বীকৃতি দিতে পারলেন না। প্রথমদিকে কথা উঠেছিল কিভাবে সমর্থন দেব? গভর্নমেন্ট কোথায়? তারপর সেখানে প্রতিষ্ঠিত হল। এখন সে প্রশ্ন উঠতে পারেনা। প্রশ্ন হতে পারে, আমরা তো দিতে পারি কিন্ত পৃথিবীতে তো অনেক দেশ আছে কই কিছু তাঁরা তো করলেন না। কেন্দ্রীয় সরকার যদি এই ভেবে বসে থাকেন যে, আরও অন্যান্য দেশ সমর্থন করুন, তখন আমরাও করব। তাহলে বুঝতে হবে খানিকটা মজা দেখার মনোভাব নিয়ে তারা থাকছেন। এখানে ওই প্রস্তাব এককভাবে হয়েছে এবং জ্যোতি বাবু বলেছেন আমরা দিল্লী যেতে চাই। আমি বলি দিল্লী যাবেন তাতে আমাদের সমর্থন আছে, কিন্ত মনে রাখবেন দিল্লী সব নয়। আমরা যখন একসঙ্গে বসে প্রস্তাব রচনা করেছি তখন কেন তাকে কার্যকরী করার ব্যবস্থা করতে পারব না? কেন তার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারব না? কাজেই আমি মনে করি যখন এককভাবে সর্ববাদীসম্মতভাবে প্রস্তাব এসেছে তখন একে কার্যকরী করার জন্য একটা সুপরিকল্পনা আমাদের একসাথে বসে করতে হবে যাতে অদূর ভবিষ্যতে এর জন্য আমরা ব্যবস্থা করতে পারি। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যুদ্ধে যেমন সামনের ফ্রন্ট লড়াই করে ঠিক তেমনি বিয়ারেরও একটা কাজ থাকে। এখানে যারা এসেছে এই সরকার তাদের বাস্তুহারা মনে করেন। তাঁরা মনে করেন না যে লক্ষ লক্ষ লোক এসেছে ওই বিহারের। এদের শুধু খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাই নয়, মুখ্যমন্ত্রী মনে রাখবেন এই সমস্ত সৈনিক যারা এসেছে তাদের অস্ত্র দিয়ে, ট্রেনিং দিয়ে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা আবার ওখানে যেতে পারে। আমি সুবোধবাবুর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছি আমাদের দেশেও ভলান্টিয়ার রেইজ করতে হবে এবং তাদের হাতে অস্ত্র দিতে হবে। সেটা তারা আমার বুকে মারবে না কার বুকে মারবে সেই আতঙ্ক করে কোন লাভ নেই। দরকার হলে যারা উপনিবেশ করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে একথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
শ্রী মহম্মদ সামায়ুন বিশ্বাসঃমাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহাশয়, মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় বাংলাদেশের নির্যাতিত সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণের সমর্থন এবং তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করার যে প্রস্তাব এনেছেন মুসলিমলীগের তরফ থেকে আমি সেই প্রস্তাবকে আন্তরিকভাবে সমর্থন জানাচ্ছি। বলা বাহুল্য ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন অব মুসলিমলীগের সভাপতি জনাব কায়েদে মুল্লা ইসমাইল সাহেব এবং পশ্চিমবাংলা রাজ্য মুসলিমলীগের সভাপতি সেকেন্দার আলি মুল্লা বাংলাদেশের নিপীড়িত লোকের সমর্থনে এক যুক্ত বিবৃতি দিয়েছেন। খুবই পরিতাপের বিষয় সংবাদপত্রগুলি এই মুসলিমলীগের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করেন এবং সেজন্য বিরোধীপক্ষ অনেক কথা সোচ্চারে বলেছেন আর একটা কথা বলছি যখন আমরা এই গভর্নমেন্টের অংশীদার তখন মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় যে প্রস্তাব এনেছেন তাকে সমর্থন না করার প্রশ্ন কি উঠতে পারে? কাজেই আমরা এই প্রস্তাব সমর্থন করছি। এই প্রসঙ্গে আমি জ্যোতি বাবুকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই, তিনি যে কিছুদিন আগে কমিউনিস্ট দেশগুলি ঘুরে এলেন সেখানে তিনি এই বাংলাদেশের নিপীড়িত লোকদের জন্য কোন বক্তব্য রেখেছেন কি? অথবা বাংলাদেশের জনগণকে সমর্থন করবার জন্য কোন সক্রিয় ভূমিকা নিতে বলেছেন কিংবা সরাসরি তিনি কোন বক্তব্য রেখেছেন কি? এই পর্যন্ত সংবাদপত্র পড়ে যা দেখেছি তাতে তিনি সেইরকম কোন বক্তব্য রাখেননি। কাজেই এখানে একরকম কথা বলবেন এবং অন্যরকম শলাপরামর্শ করবেন এটা বিস্ময়কর। দ্বিতীয় কথা মুসলিমলীগ সম্বন্ধে একটি চার্জ এনেছেন। পরিতাপের বিষয় যে, আমরা বারবার বলেছি যে, মুসলিমলীগ সাম্প্রদায়িক দল নয়, আসলে মুসলিমলীগের জন্ম হয়েছে বিমাতৃসুলভ আচরণ দেখবার ফলে। যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টি থাকত তাহলে হয়ত এই মুসলিমলীগের জন্ম হত না। আমরা নবকংগ্রেসকে স্বাগত জানিয়েছি সত্য। যখন জাতীয় কংগ্রেস যুক্ত ছিল তাদের প্রতি আমাদের আস্থা ছিল না। তাঁদের মধ্যে বিমাতৃসুলভ আচরণ ছিল এটা বেদনাদায়ক কথা। তাই তাঁদের পাশে আমরা দাঁড়াতে পারিনি। আজকে আমরা নবকংগ্রেসকে সমর্থন জানিয়েছি। কারণ তাদের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, যখন যুক্তফ্রন্ট সরকার বারবার সরকার গঠন করেছেন তখন এসমস্ত মুসলিমদের প্রতি দৃষ্টি দেয়নি। তারা ছলে বলে কৌশলে অন্যকথা বলেছেন। আপনারা যেভাবে ব্যাঙ্গ করে বা কুৎসা করে চলেছেন তাতে জনকল্যাণ হওয়া শক্ত। আপনাদের এই কি প্রতিযোগিতার পরিচয়? কেরলে যখন মুসলিমলীগের সঙ্গে কমিউনিস্ট দল যখন জোট বেধেছিল তখন মুসলিমলীগ কি সাম্প্রদায়িক ছিল না? তখন যদি না হয়ে থাকে তাহলে নবকংগ্রেসের সঙ্গে মিলিত হল বলে তারা সাম্প্রদায়িক হল কি করে? আজকে বাংলাদেশের জনগণ হিন্দু মুসলিম এক মনে এক প্রাণে আমাদের কাছে সাহায্য চাচ্ছে এবং সেই সাহায্যের ভিত্তিতে আমরা সে প্রস্তাব কার্যকরী করার জন্য এক মন একপ্রাণ হয়েছি।
(গোলমাল)
আজ যদি চীন হুমকি দেয় তাহলে জ্যোতিবাবু কি এগিয়ে যাবেন না, না পিছিয়ে যাবেন? আর একটা প্রশ্ন রাখছি যে, প্রতিদিনের আমাদের সমস্যা আছে, আমাদের সকলেরই সমস্যা আছে এবং এই সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমি এই স্বীকৃতি জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি।
শ্রী মহম্মদ আমিনঃ মাননীয় ডেপুটি স্পীকার মহোদয়, বাংলাদেশ বিষয়ে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী তা আমি সমর্থন করছি এবং সমর্থন করতে গিয়ে একটি মন্তব্যের প্রতি লক্ষ্য রাখছি। একটু আগে শুনলাম কংগ্রেস বেঞ্চ থেকে কেউ বললেন যে কমিউনিস্ট লিডারের বাড়িতে নাকি সি আর পি পাহারা দেয়। তিনি কোথায় থেকে জানলেন জানিনা। তবে শুনে মনে হল কংগ্রেস হলেই কি মিথ্যা কথা না বললেই হয় না? এইরকম একটা কথা তাঁরা বললেন কি করে? আমি বলতে পার যে, কোন সিপিএম লিডারের বাড়িতে কোন সি আর পি নাই। একথা সম্পূর্ণ অসত্য। দ্বিতীয়তঃ এখানে অনেক মাননীয় সদস্যের কথা শুনলাম। একটু আগে মুসলিম লীগের একজন যুক্তি দিয়ে বললেন এখানে মুসলিমলীগ করা হয়েছে তার কারণ মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত। তিনি এইটুকুই কেন বললেন আমি জানিনা। তাঁর এটা বলা উচিত ছিল এবং আমাদের পার্টি এই কথাই বলেছে কংগ্রেসী রাজত্বে মুসলমানদের প্রতি শুধু বৈষম্যমূলক আচরণই নয় তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে রাখা হয়েছে। একথা বলার সৎ সাহস তাঁদের নেই কিন্ত আমাদের পার্টি বলেছে এবং আমরা সংগ্রামও করেছি। সংখ্যালঘুদের যে সমস্যা সেটা আমরা জানি। কিন্ত তাদের সমর্থনের জন্য মুসলিমলীগ গঠন করার দরকার হয়না। তাই যারা মুসলিমলীগ সদস্য আছেন তাদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করব যে, আজকে পাকিস্তানে যা হচ্ছে সেই পাকিস্তানই কি করে হল। অতীতের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা কি আমরা ভুলে যাব? আমি খুশি হলাম সাত্তার সাহেব যখন বললেন দ্বিজাতিতত্ত্ব ভুল এটা শুনে। এটা ভুল প্রমাণ হবেই, কিন্ত অনেক ক্ষয়ক্ষতির পরে। এত মূল্য দিতে হবে স্বাধীনতার একথা কেউ জানে না। আমার মনে পড়ে না যে এইভাবে কোনদেশ স্বাধীন হয়েছে। যাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়েছে, তাদের হত্যা করা হয়েছে। এত নির্যাতন পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আজকে যারা মুসলিমলীগ করছেন তাঁদের মনে সত্যিই জানিনা মুসলমানদের ভাল করার ইচ্ছা আছে কিনা, যদিও তা থেকে থাকে তাহলে এটা কি বুঝতে পারছেন না যে, মুসলিমলীগ করা মানেই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তারা কি বুঝতে পারছেন যে, মুসলিমলীগ বাড়লে জনসঙ্ঘও বাড়তে বাধ্য। তখন বাংলাদেশের আবহাওয়া বিষাক্ত হবে এবং তাতে বেশি ক্ষতি হবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, যাদের নিয়ে তাঁরা কথা বলছেন। তারপর ওঁরা বলেছেন ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন এলিয়াস, ১৪৪ হচ্ছে ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন। যেদিন স্যার এই গভর্নমেন্টের জন্ম হল সেই দিন থেকে ১৪৪ ধারা। আর স্যার, আমার বিশ্বাস যেদিন এর মৃত্যু ঘটবে সেদিন পর্যন্ত ১৪৪ধারাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। যা ইতিপূর্বে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের সে অভিজ্ঞতা আছে, ১৪৪ ধারা, মিলিটারি, সি আর পি এসব দেখা গিয়েছে। সংগ্রামের মাঠে তাঁর ফয়সালা হবে বলেছেন আমাদের কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার। তিনি বলেছেন, সংগঠনের জোর যদি আমাদের থাকে, মানুষকে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ করতে পারি তাহলে দেখে নেব। আর একটি কথা বলেই আমি শেষ করব। স্যার, বাংলাদেশে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা হঠাৎ হয়ে যায়নি। এখনে, অনেক মাননীয় সদস্য বলেছেন আমি সেই কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাইনা, শুধু এটুকুই বলব, পাকিস্তান হবার পর থেকেই এই আন্দোলন চলছে। কোনদিনই পাকিস্তানের জনগণ এই স্বেচ্ছাচার শাসককে মেনে নেয়নি। পাকিস্তান হবার পর থেকেই তারা দাবি করে আসছেন গণতন্ত্রের, যে দাবি এমন কিছুই ছিল না। ২৫ মার্চের আগে পর্যন্ত তাদের দাবি এইটুকুই ছিল। সেখানে এ ইয়াহিয়া খান এত অত্যাচার করলেন তিনি মিলিটারি দিয়ে এটাকে দাবিয়ে দিতে চেয়েছেন। পাকিস্তানের জনগণকে আমি একথাই বলতে চাই যে, আমাদের বাংলাদেশের আন্দোলন সম্পর্কে যে মনোভাব সেটা শুধু এই জন্য নয়, পাকিস্তান আমাদের প্রতিবেশী, তার থেকেও যেটা বেশী ২৩ বছর আগে আমরা একাই ছিলাম। আমাদের একই ভাষা, একই ঐতিহ্য, একই ইতিহাস, একই সমস্ত জিনিস আমাদের কোন জিনিসে পার্থক্য করা যায়না। আমাদের দেশে যখন জাতীয় মুক্তির আন্দোলন বেড়ে গেল, বিদেশী সম্রাজ্যবাদীরা যখন বুঝল যে, সরাসরি এই দেশ আর শাসন করা যায় না, তখন তারা এই ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা দেখলেন যে, ধর্মের নামে একটা বিভেদ আনা যায়, এবং একথা বললে সম্পূর্ণ হবেনা। তারপর মুসলিমলীগ পাকিস্তানের দাবি তুলল এবং তারপর দেশ বিভক্ত হল। শুধু এইটুকুই বললে সম্পূর্ণ হবেনা। কেননা, মুসলিমলীগ এতে কৃতকার্য হত না, যদি এই ষড়যন্ত্রের শেষদিকে কংগ্রেস নেতারা লিপ্ত হয়ে যেতেন। সেজন্য বলছি, এত বড় অন্যায় যা হল তার জন্য সেই কংগ্রেস এবং সেই মুসলিমলীগ দায়ী। যাদের কোনদিন ইতিহাস ক্ষমা করবেনা। আজকে দেখছি ইতিহাসের পরিহাস। সেই দুটি দল আবার মিলিতভাবে এখানে ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন করছে এবং আমাদের শিক্ষা দেবার চেষ্টা করছে যে, তারা নাকি দেশের ভাল করার চেষ্টা করছে। মাননীয় স্পিকার মহাশয়, আমি আপনার মাধ্যমে আমার শেষ কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি। আমাদের নেতা জ্যোতি বাবু যেকথা বলেছেন যে আমরা নিশ্চয়ই প্রস্তাবটি পাস করাব। কিন্ত এর মধ্যে ঐ ট্রেজারি বেঞ্চের লোকদের কতটা আন্তরিকতা আছে সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। সেভাবে এটাকে বিচার করতে হবে। আমরা আশা করি এই প্রস্তাবকে কার্যকরী করার জন্য আমরা সমস্ত শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাব। এই কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
শ্রী প্রফুল্ল কুমার সরকারঃ মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আজ মুখ্যমন্ত্রী যে প্রস্তাব বাংলাদেশ সম্পর্কে এই সভায় উপস্থাপনা করেছেন আমি ভারতীয় জনসঙ্ঘ দলের পক্ষ থেকে সেই প্রস্তাবকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি। সমর্থন প্রসঙ্গে আমি কিছু আলোচনা এই সভার সামনে উত্থাপন করতে চাই। মাননীয় স্পিকার মহাশয় নিশ্চয়ই জানেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল। তৎকালীন মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা জিন্নাহ সাহেব ভারতবর্ষের মুসলমান সমাজকে বুঝিয়েছিলেন একথা যে, ভারতবর্ষের মুসলমান তারা জাতি হিসেবে ভারতীয় নয়। ভারতবর্ষের মুসলমান জাতি হিসাবে মুসলমান এবং তার জন্য আলাদা রাষ্ট্র চাই। ব্রিটিশ সরকার মুসলিমলীগের এই দাবির ভিত্তিতে তৎকালীন ভারতবর্ষের কংগ্রেস দলের নেতৃবৃন্দ এই দাবিকে স্বীকার করে নিয়ে ভারতবর্ষকে দ্বিধা বিভক্ত করেছিল। একদিকে পাকিস্তান আর একদিকে ভারতবর্ষ তৈরি করা হয়েছিল। বাংলাদেশ বিভক্ত হয়েছিল এবং বাংলাদেশের একটা অংশ পূর্বপাকিস্তান নামে খ্যাত হয়েছিল। কিন্ত মুসলিমলীগের সাম্প্রদায়িক পরোচনার জন্য ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়েছিল এবং তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ মুসলিমলীগের এই দাবি স্বীকার করে নিয়ে যে ভুল করেছিল আজকে বহুরকমভাবে ভারতবর্ষের জনতাকে এবং পূর্ববঙ্গের জনতাকে তার খেসারত দিতে হচ্ছে। স্পিকার মহাশয় ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন করা যায়না। ধর্ম এক হলেও একটা জাতি হয়না। আজকে দিবালোকের মত এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, মুসলমান হিসাবে তারা যে জাতি গঠন করতে চেয়েছিল- পাকিস্তানের এক অংশের মুসলমান আর এক অংশের মুসলমানের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। পাঞ্জাবী, বেলুচি মুসলমানরা বাঙ্গালী মুসলমানের উপর আজকে অত্যাচার চালাচ্ছে। জাতি হিসাবে ধর্ম দিয়ে যে জাতি গড়া যায়না এটা তার পরিষ্কার নিদর্শন। এবং দ্বিজাতিতত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা আজকে প্রমাণিত হয়েছে। স্পীকার মহাশয়, মুজিবুর রহমানকে আজকে দেশদ্রোহী বলা হচ্ছে। মুজিবুর রহমান দেশদ্রোহী নয়। মুজিবুর রহমান দেশদ্রোহী নয় এবং আওয়ামীলীগ প্রকৃতপক্ষে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার। এই কথা আমি এইজন্য বলছি যে, পূর্ববঙ্গে আজকে যে ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে সেই ঘটনার পটভূমিকা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে ভারতবর্ষ বিভক্ত হবার পর থেকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্বপাকিস্তানের জনগণের উপর যে নির্মম শাসন এবং শোষণ চালিয়ে আসা হচ্ছিল, শুধু শাসন এবং শোষণ নয়, তাদের কালচারের উপর, তাদের কৃষ্টির উপর, বাঙ্গালী সভ্যতার উপর, বাংলা ভাষার উপর যেভাবে অত্যাচার চালানো হচ্ছিল, বাঙ্গালী জাতিকে যেভাবে শ্বাসরোধ করে মারার উপক্রম করা হয়েছিল আজকের ঘটনাবলী তার বিস্ফোরণ মাত্র। মুজিবর পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চাননি। মুজিবর চেয়েছিলেন, পাকিস্তানের সংবিধান এমনভাবে তৈরী করা হোক যে, সংবিধানের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্বপাকিস্তানকে শোষণ, শাসন, অত্যাচার করতে না পারে তার ব্যবস্থা থাকবে। কিন্ত কেন্দ্রে একটা সরকার থাকুক এটা মুজিবর রহমান বা আওয়ামীলীগ চেয়েছিলেন এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিও আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে রাখা হয়েছিল। কিন্ত ইয়াহিয়া আর ভুট্টো ষড়যন্ত্র করে। কিন্ত আওয়ামীলীগ বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করেছিলেন এবং পূর্ববঙ্গের মানুষদের একত্রিত করে এক জায়গায় এনেছিলেন। তার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা ভীত এবং সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন। তাই কিভাবে এই জাতিকে নস্যাৎ করা যায় তারা সেই চক্রান্ত তারা করেছিলেন এবং তারপর ১১দিন ধরে সেখানে আলাপআলোচনার নাম করে ভিতরে ভিতরে সামরিক সমস্ত প্রস্তুতি চালিয়ে তারা গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন এবং গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে হঠাৎ ২৫ তারিখে আলোচনা ভেঙ্গে দিয়ে আবার নতুন করে সামরিক শাসন প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। তখন সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গেল এবং মুজিবর স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। তাই আজকে বাঙ্গালী জাতি সেখানে মরণপণ করে স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন। আমরা বাঙ্গালী হিসাবে মনে করি ওরা আমাদের স্বজাতি, তারা বাঙ্গালী জাতি, পাকিস্তানী নয়, মুসলমান নয়, বাঙালী জাতি। সেখানে হিন্দুরাও স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন, মুসলমানরাও স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন। কাজেই সেখানকার স্বাধীনতা সংগ্রামকে বাঙ্গালী জাতি হিসাবে- এটা আমাদের দেশের একটা অংশ ছিল, ভারতবর্ষের একটা অংশ ছিল, সে অংশ ঐ সামরিক একনায়কতন্ত্রের কবল থেকে ছিনিয়ে আনবার জন্য আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্য দান করা প্রয়োজন। যদি অস্ত্র সাহায্যের প্রয়োজন হয় সে সাহায্য আমাদের করতে হবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই আজকে বিরোধীদলের মাননীয় নেতা বক্তব্যের সময় যে কটাক্ষ করেছেন এখন এই কটাক্ষের সময় নয়। আর একটি কথা আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, সীমান্তের ওপার থেকে দশ লক্ষের বেশী লোক এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে এবং তারা সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় এবং আরও বহুসংখ্যক লোক এখানে এসে উপস্থিত হবে। আমি মুর্শিদাবাদের সীমান্ত থেকে এসেছি। আমাদের এলাকা থেকে সংবাদ পেয়েছি যে, প্রতিদিন ১০হাজার করে লোক একমাত্র জলঙ্গী সীমান্ত অতিক্রম করে উপস্থিত হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তার উপর অবস্থান করছেন এবং হাজার হাজার মানুষের কোনরকম আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়নি। মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আপনি সরকারের কাছে অনুরোধ রাখবেন যেন এই সমস্ত লোকদের জন্য উপযুক্ত আশ্রয়ের ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। এই কথা বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।
শ্রী গোপাল বসুঃ মিঃ স্পীকার, স্যার লবির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা অধিকার আপনি খর্ব করতে চান? আপনি কে এস বির লোকদের এখানে থাকতে অনুমতি দিয়েছেন। তা না হলে তাঁরা এখানে কি করে আসে? সেদিনও এই নিয়ে গোলমাল হয়েছে, আজকে আবার তারা এখানে এসে ঘোরাফেরা করছে। আমি জানি, আপনি পারমিশন দেননি, অথচ তারা এখানে ঘোরাফেরা করছে। আমাদের মেম্বারদের অসুবিধা সৃষ্টি করছে। এটা যদি এভাবে চালান তাহলে আপনি আমাদের বলে দিন যে, পারমিশন দিয়েছি- তাহলে আমরা বুঝতে পারছি আপনার অনুমতি আছে, আর যদি না হয় সেটা খুলে বলুন। আর যদি না হয়- সেটা আপনি পারমিশন দেবেন না- আমাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করবার জন্য নয়, অধিকার রক্ষা করবার জন্য। কাজেই ওটা যাতে বন্ধ হয় তার জন্য স্ট্রিক্টলি আপনার অফিসে বলুন।
মিঃ স্পীকারঃ এর আগেও আমি আপনাদের অভিযোগ লক্ষ্য করেছিলাম। আজও আপনি অভিযোগ করলেন। আমি দেখব যাতে কোন মাননীয় সদস্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ না হয়।
শ্রী দিলীপ কুমার রায়ঃ মাননীয় স্পীকার মহাশয়, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় এখানে যে প্রস্তাব রেখেছেন তার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আমার বক্তব্য রাখতে চাই। তার সাথে সাথে ওপার বাংলার যারা শোষণ থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছে, তাদের জানাই আমার অভিনন্দন।
মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আপনি জানেন হিন্দু- মুসলিম এই দুই জাতি এই ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করা হয়েছিল। সেদিন আমরা ফরওয়ার্ড ব্লকের তরফ থেকে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম। আজকে অনেক মাননীয় সদস্য এখানে উপস্থিত আছেন, তাঁরা সেদিন তাঁদের দ্বিজাতিতত্ত্বকে মেনে নিয়ে এই দেশ বিভাগকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। আজ ওপার বাংলায় যা ঘটছে তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, দ্বিজাতিতত্ত্ব ভ্রান্ত এবং তাদের বক্তব্যও ভ্রান্ত।
মাননীয় স্পীকার স্যার, আমি এই প্রসঙ্গে বলতে চাই যে, ওপার বাংলায় ইয়াহিয়া সরকার যে বর্বর আক্রমণ চালাচ্ছে সেই ঘটনার বিবরণ দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা। তবু আমি বলতে চাই ওপারের যে আন্দোলন সে আন্দোলন জাতীয়তাবাদের আন্দোলন, দেশপ্রেমের সংগ্রাম, গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম। কিন্ত আমরা কি দেখছি! ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে, আজকে অনেক প্রগতিশীল রাষ্ট্র যারা সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার তারা নিরব হয়ে আছে। দক্ষিণআফ্রিকা, রোডেশিয়া, আরব এদের প্রশ্নে যারা সোচ্চার, ভিয়েতনামের নামে যারা মুখরিত, আজকে তাদের নীরবতার কি কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। আমি মনে করি এই হাউসের পক্ষ থেকে এই নীরবতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হোক।
আমি সীমান্ত কোচবিহার জেলার প্রতিনিধি। আমি সেখানে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি, মুক্তিফৌজের অনেকের সাথে কথাবার্তা বলেছি। আমি তাঁদের অটুট মনোবল লক্ষ্য করেছি। তাঁরা আমায় একথা বলেছেন, আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষ আসে নি, আমাদের দেশ বন্যাপীড়িত নয় আমাদের দেশে মহামারী দেখা দেয় নাই। কাজেই শুধু অন্নবস্ত্রের এই সাহায্য দিলে চলবে না, আমাদের অস্ত্র দিন যাতে ইয়াহিয়া সরকারের আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারি। এই দুঃখের দিনে আমরা আক্রান্ত হলেও ভারত সরকার নীরব। আজকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে অস্ত্রশস্ত্র জন্য তার উল্লেখ করে আমি বলতে চাই শুধু অস্ত্রশস্ত্র নয় আমাদের এমন গণআন্দোলন এবং জনমত সৃষ্টি করতেও হবে যাতে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র স্বাধীন বাংলা সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং সর্বতোভাবে সাহায্য করে তাদের সংগ্রামকে সাফল্যমণ্ডিত করতে সচেষ্ট হয়। এই প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই ওপার বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু এই বাংলায় এসেছে। আমি দেখেছি আমাদের হলদিবাড়ি থানায় প্রায় দু’ লক্ষ লোক এসেছে। মাননীয় মন্ত্রী সন্তোষ রায় মহাশয় সেখানে গিয়েছিলেন কিন্ত আজকে ১৫-১৬ দিন হল লক্ষ লক্ষ লোক যারা গাছতলায় পড়ে রয়েছে, কোন আশ্রয় পাচ্ছেনা, কোন খাদ্য পাচ্ছেনা, তাদের কোন ব্যবস্থা হচ্ছেনা, আমি মন্ত্রী মহাশয়কে সব জানিয়েছি। কিন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কাজেই সরকারী দানের কথা উল্লেখ করে বলতে চাই যে, যুদ্ধকালীন ব্যবস্থা যেমন নেওয়া হয়, সেইভাবে জেন অতিসত্বর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই দাবি রেখে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
শ্রী তিরিবরণ ভাদুড়িঃ মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আজকের এই সভায় আমাদের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় যে প্রস্তাব রেখেছেন সেই প্রস্তাবের বিশেষ সারমর্ম দেখেছি, দিল্লীর মসনদে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী কংগ্রেস সরকার সেই মসনদে সুপ্রতিষ্ঠিত। যে কংগ্রেস সরকার গণতন্ত্রের কথা না বলে, প্রগতিবাদের কথা না বলে সকালবেলা জল গ্রহণ করেন না, সেই সরকারের কাছে আজকে আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারের দাবি এবং ইয়াহিয়া সরকারের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশের জনগণের উপর যে ব্যবহার হচ্ছে তার বিরুদ্ধে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজনের দাবি জানানো হয়েছে। মনে হচ্ছে এই দাবি একটা কাগজে লেখা ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা, আজকে দীর্ঘদিন পর দেখছি, প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল নিছক একটা ভাওতা দিয়ে ইন্দিরা সরকার সামান্য একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ঘোষণা দেবই, অস্ত্রশস্ত্র দেবই। এই ঘোষণা দিলেই আমাদের অস্ত্রশস্ত্র দিতে বেশী দেরী লাগবে না। কিন্ত দেখছি, আজকে প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল এখনও সেই ঘোষণা এল না, অস্ত্রশস্ত্রের কথা আলাদা। সেই সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি পূর্ব বাংলার জনগণ ইয়াহিয়া সরকারের অত্যাচারে আমাদের মা বোনেরা যেভাবে আজকে পদ্মা পেরিয়ে এবং বিভিন্ন বর্ডার পেরিয়ে আমাদের এই অঞ্চলে বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছে তাঁর প্রতি কণামাত্র সাহায্য তো দূরের কথা সমবেদনা পর্যন্ত দেখাতে পারছেন না এটি দুঃখের বিষয়। যে কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের মুসলিমলীগের সঙ্গে কোয়ালিশন করেছেন, সেই মুসলিমলীগের কোন সদস্যকে আজ দেখতে পাচ্ছি না। বেলেডাঙ্গায় প্রায় একমাস আগে মস্ত বড় জনসভা করে মুসলিমলীগের মন্ত্রীগণ কথা বলেছেন এবং প্রচুর লোক তাদের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনারা পূর্ববাংলায় যে জনযুদ্ধ বা গনমুক্তির যুদ্ধ চলছে সেই যুদ্ধের ব্যাপারে আপনাদের ভূমিকা কি? বড় দুঃখ, লজ্জা, ক্ষোভের সঙ্গে আজকে আমাকে সভায় বলতে হচ্ছে যে, তাদের মুখ দিয়ে একটি কণা কথাও বেরোয়নি। তার কাছে অনেক মুসলমান ছেলে, আমার দলের অনেক মুসলমান লোক চিরকুট দিয়ে বলেছিলেন যে, মোল্লা সাহেব সাহেব বলুন পূর্বপাকিস্তানে যে লড়াই চলছে সেই লড়াই সম্পর্কে আপনাদের ভূমিকা কি? সেই ভূমিকা আমরা গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী কংগ্রেসীরা যে কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁদের কাছে কতখানি আশা করব। ওনারা আবার গণতন্ত্রের কথা বলেন। ভাঁওতা দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রেখেছেন। আমরা তাই দেখতে পাচ্ছি অবিলম্বে কথাটা তারা ব্যবহার করেছেন। আমরা পূর্বেই দেখেছি এই সমস্ত কথা ব্যবহার করা হয় সাধারণ মানুষকে ধোঁকা বা ভাঁওতা দেবার জন্য। আমরা তাই বলতে চাই অবিলম্বে কথাটা বাদ দিয়ে একটা সময় বেঁধে দেওয়া হোক দশ দিন কি সাতদিন কি পনের দিন সেই সময়ের ভেতর যদি ইন্ডিয়া সরকার যদি আমাদের দাবি মেনে না নেন তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমে তা আমাদের আদায় করে নিতে হবে এই কথা এই সভায় সমস্ত সদস্যের বিবেক বুদ্ধির প্রশ্ন নিয়ে বলা উচিত। জয়নাল আবেদিন মহাশয় অনেক বড় বড় সুন্দর সুন্দর কথা বললেন। কিন্ত তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন তাঁরা তো বলেছিলেন আকার ইঙ্গিতে যে আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিচ্ছি, অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছি। কিন্ত কোথায় দিচ্ছেন? কই তাঁদের ইন্দিরা সরকার তো এখনও দিচ্ছেন না। বড় গলা করে জোতদার জমিদারদের বিরুদ্ধে বলেছিলেন, কিন্ত বাংলাদেশের অবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সামান্য গরীব জমির মালিক সি আর পির অত্যাচারে জোতদারদের সহযোগিতায় জমি থেকে উৎখাত হচ্ছে। এই সমস্ত দেখে আমাদের লজ্জা ক্ষোভ লাগে। আমরা সরকারের চরিত্র দেখতে পাচ্ছি। এই সরকারের কাছে মৌলিক একটা প্রস্তাব দিলেই আমাদের সমস্ত দাবি আদায় হবে না। আমাদের দাবি আদায় করতে হবে আন্দোলনের বিরুদ্ধে। গণআন্দোলন ছাড়া প্রতিক্রিয়াশীল চক্রদের কাছ থেকে কোন দাবি আদায় করা যাবেনা। মিঃ স্পীকার স্যার, কবির সুরে একটি কবিতা আমার মনে জেগে উঠেছে—
সাবাস বাংলাদেশ-
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু
মাথা নোয়াবার নয়।
মিঃ স্পীকার স্যার, বাংলাদেশের যে সমস্ত অগণিত যুবক, ছাত্র, অগণিত ভাই, বোন, যে বিপ্লবী চেতনা, যে বিপ্লবী উন্মেষ তুলে ধরেছেন তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।
শ্রী সুধীর চন্দ্র বেরাঃ মাননীয় স্পীকার মহোদয়, আমি মুখ্যমন্ত্রী কর্তৃক যে প্রস্তাব এই সভায় আনা হয়েছে তা সর্বান্তকরণে এবং পূর্ণভাবে সমর্থন করি। আমি এখানে দেখলাম আলোচনার মাধ্যমে এই প্রস্তাব সমর্থন করতে গিয়ে কোন কোন রাজনৈতিক দল নিজেদের মূলধন বাড়াবার চেষ্টা করেছেন। এটা আমি তীব্রভাবে নিন্দা করছি। পূর্ববাংলার এই স্বাধীনতা সংগ্রাম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্বাধীনতার জন্য মানুষের সংগ্রাম জন্মগত। মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়, আপনি যদি ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখেন তাহলে দেখবেন মানুষ তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের জন্য অনেক রক্ত, অনেকে জীবন দিয়েছে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে আরম্ভ থেকে ফরাসী বিপ্লব প্রভৃতির মধ্য দিয়ে একথাই স্বীকৃত হয়ে এসেছে যে প্রতিটি জাতির তার স্বাধিকার রক্ষার অধিকার থাকবে, তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার থাকবে। পূর্ববাংলার লোক যখন তাদের স্বাধিকার প্রয়োগ করতে গেল তখন মদগর্বী ইয়াহিয়ার আঘাত লাগল; তিনি পাল্টা আঘাত লাগালেন। মাননীয় স্পীকার মহাশয়, আপনি জানেন পূর্ববাংলায় যে সংগ্রাম হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের মিলিত সংগ্রাম এর নজির ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুর্লভ এবং পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের তিনটি পর্যায়ে বিভক্তি দেখতে পাই। প্রথম হচ্ছে- অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, দ্বিতীয় হচ্ছে- সশস্ত্র সংগ্রাম এবং তৃতীয় হচ্ছে- স্বাধীনতা ঘোষণা। ভারতবর্ষের মধ্যে অনেকে অভিযোগ করেছেন- কংগ্রেস সরকার দেড় মাস পর্যন্ত ঘুমিয়েছিলেন। তাঁরা যদি একটু ভেবে দেখেন তাহলে দেখবেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার করার আগ পর্যন্ত এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ছিল এবং আন্তর্জাতিক আইনে আমরা সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারতাম না। কিন্ত যে মুহূর্তে তারা সরকার গঠন করেছেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন সেই মুহূর্তে থেকে সংগ্রামী রূপ বদলে গিয়েছে এবং আজকে তাদের স্বীকৃতি দিলে সার্বভৌম সরকার হবে এবং তার উপর হস্তক্ষেপ করলে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের আওতায় পড়ে। দুঃখের বিষয়, আজ বড় শক্তি, বিগ পাওয়ার্স, যাদের বিগ ব্রাদার্স হওয়া উচিত ছিল তারা স্বীকৃতি দেয়নি এবং আমরা স্বীকৃতি দাবি করছি কারণ আমরা মনে করি বাংলাদেশ সরকার- জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার – এবং জনগণের সরকার পৃথিবী থেকে মুছে যেতে পারেনা।
এই বলে বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
শ্রী এ এইচ বেসটারউইচঃ স্যার শেষ করার আগে আমি একটি পয়েন্ট অব অর্ডার আনতে চাই। গতকাল পরিবহন নিয়ে আমাদের কথা হয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সরকারিপক্ষ থেকে আমরা কোন তথ্য পাইনি। অথবা কোন নির্দেশনাও পাই নাই যে এটা করা হবে কিনা। আমি শুনেছি কিছু কিছু দল তাদের মত করে পরিবহনের ব্যাবস্থা করেছে কিন্তু সেটা সবার জন্য সম্ভব না। ১৬৯২ সাল থেকে পরিবহনের ব্যাপারটি প্রচলিত আছে কিন্তু আজ আয়োজনের এই অবস্থা দেখে আমি হতাশ। তাই আমি এটা উত্থাপন করছি এবং সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত আমি কোন ব্যাবস্থা দেখতে পাচ্ছিনা।
মি: স্পীকারঃ জনাব বেস্টউইচ, আমি এটার খোঁজ অন্যদের কাছ থেকে নিয়েছি। আপনি আমার কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন যে সদস্যদের বাসায় যাবার জন্য খরচ দেয়া উচিৎ। আমি বিরোধী দলের কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি। তারা আমাকে বলেছে তাদের নিজস্ব ব্যাবস্থা আছে। এই অবস্থায় সরকার বা বিরোধী দলের চিপ হুইপ কারো পক্ষ থেকেই আমার কাছে কোন অনুরোধ আসেনি। তাই আমি দেখতে পাচ্ছি শুধুমাত্র জনাব বেসটারউইচ আমাকে এটার জন্য চাপ দিচ্ছেন এবং অন্য কেউ এরকম করছেন না। যদি যথেষ্ট সংখ্যক সদস্য এটা দাবী করেন তাহলে তারা তাদের দলের চিপ হুইপ মার্ফত আমাকে জানালে আমি পরবর্তি ব্যাবস্থা নেবার চেষ্টা করব। কিন্তু এখন পর্যন্ত জনাব বেসটারউইচ ছাড়া এটা কেউ চাচ্ছেন না। তাই আমি মনে করি এই ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া ন্যায়সঙ্গত নয়। এর পরেও যদি আপনার খুব দরকার পরে তাহলে আপনি বিভিন্ন দলের চিপ হুইপের সাথে আলোচনা করে আমার চেম্বারে যোগাযোগ করতে পারেন। তখন আমি সরকারকে অনুরোধ করব প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিতে।
শ্রী জনাব বেস্টারউইচঃ স্যার, ১৯৬২ ও ১৯৬৭ সালে আমি এটা উত্থাপন করেছিলাম এবং এখনো আমিই সবার পক্ষে থেকে এটা উত্থাপন করলাম। কোন সদস্য যদি তাদের নিজেদের জন্য কোন ব্যাবস্থা করে থাকেন তাতে অন্যান্য সদস্যদের কোন লাভ নেই। আমরা গরিব মানুষ। আমাদের এরকম আয়োজন বা ব্যাবস্থা করার সামর্থ্য নেই। আমাদের বলতেই হবে- কারণ গভীর রাতে ট্যাক্সি বা বাস পাওয়া যায়না।
মি: স্পীকারঃ দুর্ভাগ্যজনক জনাব বেসটারউইচ, কেউ আপনার প্রস্তাবকে সমর্থন দিচ্ছেনা।
শ্রী সুধিন কুমারঃ আপনার এটা গৃহীত হলে খুব কম সংখ্যক সদস্যই এই সুবিধা গ্রহণ করবে।
মি: স্পীকারঃ আমি সন্মানিত সদস্যদের অনুরধ করব ১২ ও ১৩ তারিখে আমার চেম্বারে দেখা করতে।
শ্রী সুবোধ ব্যানার্জিঃ স্যার হাউজের সবার পক্ষে দেখা করা সম্ভব না। সরকার গত কয়েক বছর ধরে এসব করছেন। সরকারের উচিৎ এটা করে দেয়া। ক্ষতি কি?
মি: স্পীকারঃ আমাকে জনাব গোপাল বসু ও অন্যান্যরা বলেছেন যে তাদের নিজস্ব ব্যাবস্থা আছে।
শ্রী জ্যোতি বসুঃ ঐ ব্যবস্থাটা কংগ্রেস গভর্নমেন্টেরও ছিল। তিনটা রুটে তিনটা বাস ছিল। যে রুট দিয়ে যে যে বাস যেত মেম্বাররা সেই বাসে চলে যেতেন। এখন আমরা নিজেরাই ব্যবস্থা করছি। কারণ জীবন নিয়ে টানাটানি। বাস থেকে টেনে নিয়ে মারছে। ওপক্ষ একটা ব্যবস্থা করেছেন। কিন্ত অন্যেরা এসব বাস অ্যাভেল করতে পারছেন না। সেজন্য বলছি যে, সোমবার থেকে একটা কিছু ব্যবস্থা যদি করেন তাহলে ভালই হয়।
মি: স্পীকারঃ আমার কোন আপত্তি নেই।
শ্রী রাম চ্যাটার্জিঃ আমাদের যেটা আছে সেটা রাখতে হবে। কারোর পকেট থেকে দিতে বলছি না। গভর্নমেন্টের খরচে বাস আসে যায়। এতে একপক্ষ লাভ করবে, আর একপক্ষ লাভ করবে না, সেটা হবেনা। আমাদের মেম্বাররা হাঁটতে হাঁটতে ফিরছে, আর একপক্ষ বাসে করে চলেছে সেটা হবেনা।
শ্রী অজিত কুমার পাঞ্জাঃ সরকারের জানা মতে কোন সদস্য সরকারের কাছে পরিবহনের ব্যাপারে কোন মতামত বা অনুরোধ করেনি। তবেযদি কেউ করে আমরা ব্যাপারটা দেখব।
শ্রী গোপাল বসুঃ আপনি তো একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দিলেই পারেন।
মি: স্পীকারঃ আপনারা নিজেরাই বলেছেন যে, আপনাদের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। আমিও দেখলাম অলমোস্ট অল দ্যা মেম্বার্স তাঁরা নিজেদের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। হয়ত দু-চারজনের কিছু অসুবিধা হতে পারে সেজন্যই বোধহয় তাঁরা কিছু বলেননি।
শ্রী সুবোধ ব্যানার্জিঃ গভর্নমেন্ট শুনেছেন, অ্যারেঞ্জমেন্ট করবেন। এতে এত আলোচনার দরকার কি আছে? ওঁরা শুনেছেন। আগে যেরকমভাবে চলত সেইরকম একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট করবেন। আটটা বেজে গেছে। আমাদের শুধু জীবন নয়, প্রেস গ্যালারিও আছে। ওদেরও আমাদের দেখতে হবে। কাজেই আমরা একটু তাড়াতাড়ি ফিনিশ করি।
মি: স্পীকারঃ আমি এখন প্রধানমন্ত্রীকে তার জবাব দিতে অনুরোধ করছি।
শ্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়ঃ আমার আর কিছু যোগ করার নেই।
শ্রী সুবোধ ব্যানার্জিঃ এটা খুব ভালো জবাব।
মি: স্পীকারঃ আলোচনা এখানেই শেষ হল।
শ্রী অজয় কুমার মুখার্যি বললেন –
‘’ বিগত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামীলীগের অসামান্য ও ঐতিহাসিক সাফল্যের মধ্যে প্রকাশিত জনগণের সুস্পষ্ট রায়কে পদদলিত করিয়া বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক শাসক চক্রের যে নারকীয় গণহত্যাভিযান চালাইতেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা তাকে ধিক্কার জানাইতেছে এবং বাংলাদেশের জনগণ পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যে মরণপণ সশস্ত্র সংগ্রাম চালাইতেছেন তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও সেই সঙ্গে সংগ্রামী জনগণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছে।
পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র যাহাতে অবিলম্বে এই বর্বর গণহত্যা বন্ধ করিতে এবং বাংলাদেশ হইতে তাহার সমস্ত সামরিক বাহিনী তুলিয়া লইতে বাধ্য হয় তাহার জন্য উপযুক্ত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এই বিধানসভা ভারত সরকারসহ অন্যান্য দেশের সরকারের নিকট আবেদন করিতেছে।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা এই বিশ্বাস রাখে যে, তাহাদের সংগ্রাম বর্তমানে যতই কঠোরও প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হোক না কেন বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ শেষপর্যন্ত জয়লাভ করিবেনই। এই সভা আরও আশা রাখে যে, যেহেতু এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম সর্বপ্রকার আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র কর্তৃক বাংলাদেশের জনগণের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে এবং ইহা জাতীয় স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম সেই হেতু ইহা শুধু জাতীয় জনগণের নিকট নহে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের এমনকি পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজ্যের নিকট হইতেও ক্রমবর্ধমান সমর্থন লাভ করিবে।
বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় স্বাধীনতার মরণপণ সংগ্রামের প্রতি আশু ও জরুরী কর্তব্যের কথা বিবেচনা করিয়া এই বিধানসভা ভারত সরকারের কাছে দাবি জানাইতেছে যে, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রও তাঁহার সরকারকে স্বীকৃতি এবং অস্ত্রশস্ত্র সহ সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় কার্যকরী সাহায্য দিতে হইবে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নরনারী যখন রক্ত দিতেছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের জনগণ আহার কমে কিছুতেই রাজী হইতে পারেন না।
এই ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করিতে যতই দেরী হইতেছে ততই বাংলাদেশের জনগণের দুঃখ, দুর্গতি, লাঞ্চনা বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহাতে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ও জনগণ গভীর উদ্বেগ বোধ করিতেছে। এই অবস্থায় যাহাতে অবিলম্বে উক্ত দাবিগুলো স্বীকৃত তাহার জন্য ভারত সরকারের উপর প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিধানসভা, পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ও সরকারের নিকট আহবান জানাইতেছে।
ব্যাপক নরহত্যার মুখে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধা সীমান্ত পার হইয়া পশ্চিমবাংলায় চলিয়া আসিতে বাধ্য হইতেছেন। সৌভাতৃতের ও মানবতার অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে তাঁহাদের জন্য সর্বরকম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা একান্ত দরকার। এই পশ্চিমবঙ্গ ও উহার পার্শ্ববর্তী সীমান্তরাজ্যগুলির আর্থিক ক্ষমতার বাহিরে। এই কঠিন সত্য বিবেচনা করিয়া পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভারত সরকারের নিকট এই বিষয়ে যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের জন্য দাবি জানাইতেছি’’
মি: স্পীকারঃ আজকের অধিবেশন শেষ হল।