শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৭৮। যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস টেলিভিশনে দেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণ সিং এর সাক্ষাৎকার | ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় | ২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
|
যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস টেলিভিশনে দেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণ সিং এর সাক্ষাৎকার
২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
কলাম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেম
সংবাদদাতা জন হারটঃ
আধ ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলতে আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী। তাজা খবর এই যে, পাকিস্তান আজ থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তাদের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে পেতে যাচ্ছে, যিনি গত সপ্তাহে জাতিসংঘের প্রতিরক্ষা কাউন্সিল থেকে ওয়াক আউট করেন। সদ্য যুদ্ধে হেরে যাবার পর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ করেন এবং ভুট্টো তার স্থলাভিষিক্ত হন। এর আগে ভুট্টো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে নির্বাচন বাতিল বলে ঘোষনা করেছিলেন, তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের বা বর্তমান অক্ষত পাকিস্তানের বেশিরভাগ আসনে ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পার্টি জয়লাভ করে। গত সপ্তাহে ভুট্টো বলেছেন, তার আর কোন ইলেকশন দেওয়ার প্রয়োজন নেই, কেননা তিনি গতবারই জয়লাভ করেছেন। মুলত গত বছর শেখ মুজিবর রহমানের পার্টি সর্বচ্চো সঙ্খ্যক আসনে জয় লাভ করেছিল, কিন্ত তার পার্টি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করছিল, যা বর্তমানে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। শেখ মুজিব হয় মৃত্যুবরন করেছেন নয়ত তিনি এখনও ভুট্টোর হাতে বন্দী। এ মুহূর্তে ভারতের সাথে আপস করার দায়িত্বও ভুট্টোকেই নিতে হবে, এবং তিনি ভারতের দখল করা এলাকাসমুহ ফেরত চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
আজ সকালে আমাদের সাথে আছেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং, এবং জনাব, আমার প্রথম প্রশ্ন হলঃ আপনারা কখন আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছেন?
উঃ পাকিস্তানের নেতারা যখনি চান, আমরা তখনি আপস মীমাংসার জন্য সংলাপে বসতে প্রস্তুত আছি।
প্রশ্নঃ তা কবে নাগাদ হতে পারে, সে বিষয়ে কি আপনারা কোন ধারনা পেয়েছেন?
উঃ আমার জন্য সেটা বলা খুবি কঠিন, কিন্ত আমি আশা করছি শীঘ্রই।
প্রশ্নঃ মিঃ সিং, মুলত কোন বিষয়ে সংলাপ হবে, আপনারা কি স্থায়ী শান্তি স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করছেন?
উঃ মুলত সেটাই উদ্দেশ্য থাকবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন বাংলাদেশকেও আমরা নতুন রাষ্ট্র হিসাবে পেয়েছি, সেটিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ইস্যু ও আলোচিত হবে।
প্রশ্নঃ এটিই কি শান্তি স্থাপনের সংলাপকে সফল করার মুল শর্ত হিসেবে বিবেচিত হবে?
উঃ আপনি এটাকে একটা শর্ত বলতে পারেন, কিন্তু ৭.৫ কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে অবমাননা করে কোন সমাধান কিংবা শান্তি স্থাপন আসলে বাস্তবে সম্ভব হবেনা।
প্রশ্নঃ শেখ মুজিবর রহমানের কি হবে? তাকে এখনও কোথাও দেখা যায়নি। কেউ জানেনা তিনি জীবিত না মৃত। এ বিষয়টি কি সংলাপের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হবে, বা পরবর্তী শান্তিস্থাপন বিষয়ক আলোচনা সমুহে?
উঃ আমরা আশা করছি যে তিনি বেঁচে আছেন এবং অবশ্যই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মানুষের নির্বাচিত নেতা হিসেবে তিনি সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশটির ভবিষ্যৎ রূপরেখা দানে বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখবেন।
প্রশ্নঃ যদি তিনি বেঁচে না থাকেন, বা পাকিস্তান যদি তাকে মুক্তি না দেয়, সেক্ষেত্রে সংলাপ কোন দিকে মোড় নিবে?
উঃ আমি ধারনা করছি যে এবিষয়ে আওয়ামীলীগ দলের নেতারাই আলোচনা করবেন, কিন্তু আমার মনে হয়না পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী শেখ মুজিবর রহমানকে শেষ করে দেয়ার মত চরম পদক্ষেপ নিবে। পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্নঃ ভারত কি যুদ্ধের সময় কাস্মীর এবং পাঞ্জাবের সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের দখলকৃত ১৪০০ মাইল এলাকা বা অন্যান্য যে সকল এলাকায় তাদের সৈন্য আছে তা ফিরিয়ে দেবে?
উঃ আপনি যদি পূর্বাংশের কথা বলে থাকেন, আমরা বাংলাদেশকে একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি এবং আমাদের একটি দিনের জন্যও সেখানে অবস্থান করার অভিপ্রায় নেই। সকল দ্বন্দ্বের অবসান হয়ে পরিস্থিতি কিভাবে স্বাভাবিক হয় তার উপরি সবকিছু নির্ভর করছে। পশ্চিম অংশেও, আমরা আমাদের অবস্থান স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছি যে- পাকিস্তানের কোন অংশই আমরা আমাদের বলে দাবী করছিনা, সংলাপের ফলে অবশ্যই এই বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।
প্রশ্নঃ কিন্তু, কাস্মীরের কি হবে, মিঃ সিং- সেটি তো আসলে পাকিস্তানের অধীনে নয়?
উঃ এটি এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে আরো সংলাপ হতে পারে। একটি যুদ্ধ হয়েছে, অস্ত্র-সংবরন করা হয়েছে, প্রয়োজনে আবারো তা করা হবে।
প্রশ্নঃ কিন্ত আমাদের নিউদিল্লিতে আমাদের রাষ্ট্রীয় মুখপাত্রগন বলছেন যে গত কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধে ভারত কাশ্মীরের নতুন যেসব এলাকা দখল করে নিয়েছে, তা ফিরিয়ে দেবেনা।
উঃ আমি বলবো, তা সংলাপের মাধ্যমেই স্থির করা হবে, এবং প্রতি ক্ষেত্রেই একটি অস্ত্র সংবরন রেখা নিরধারিত হবে, যেমনটি প্রতিটি সশস্ত্র সঙ্ঘাতের পর করা হয়ে থাকে।
প্রশ্নঃ পূর্বাঞ্চল থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী কখন সরিয়ে নেয়া হবে?
উঃ আমি ইতিমধ্যেই বলেছি যে আমরা সেখানে একটি দিনও বেশি থাকতে চাইনা। অনেক কাজ বাকী রয়েছে। আত্মসমর্পণকারী পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করানোর বিষয়টি বাকি রয়ে গেছে। তাদের উপর মানুষ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আক্রমন করতে পারে। এক্ষেত্রে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। এ সকল বিষয়ই বিবেচনাধীন রয়েছে। ভারত এবং বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখবে।
প্রশ্নঃ মিঃ মিনিস্টার, ভারত এবং পাকিস্তানের এ যুদ্ধ, অবশ্যই এই দুই দেশের সীমা ছাড়িয়ে একটি বৈশ্বিক অস্থিরতা তৈরি করেছে, কেননা রাজনৈতিক এবং পরোক্ষভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চায়না এবং যুক্তরাষ্ট্রের মত পরাশক্তিও এ যুদ্ধে জড়িয়ে পরেছে। এখন কি নতুন করে ভারসাম্য ফিরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব? যদি, আমরা ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের কথাই ধরি, ভারতের জনগন বেশ প্রকটভাবেই যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী মনোভাব ব্যাক্ত করেছে। ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কে কি এ বিষয়গুলো প্রভাব ফেলবে?
উঃ আমরা সবসময়ি বিশ্বাস করি যে ভারসাম্য স্থাপনের কোন সীমা নেই, কোন নির্দিষ্ট ভিত্তিও নেই। ক্ষমতার কৃত্রিম ভারসাম্য রক্ষার্থে যখন অন্যান্য ক্ষমতাসীন ব্যাক্তিবর্গ ব্যাস্ত হয়ে পরেন, সেটাই বরং আরো সমস্যার সৃষ্টি করে। আপনি আমাকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কথা জিজ্ঞেস করছেন। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কোন নিরপেক্ষ ভুমিকা পালন করেনি। একি সাথে এটিও মনে রাখতে হবে যে, এদেশের সাংবাদিকগন, সংবাদমাধ্যম, জনপ্রতিনিধিগণ, সিনেটর এবং কংগ্রেসম্যান অনেকেই বাস্তব ঘটনাকেই সমর্থন করে গেছেন। আমি বলব না যে এর কোন প্রভাব দুই রাষ্ট্রের সম্পর্কে পরবেনা, কিন্তু এখন যেহেতু যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে প্রশাসন কিভাবে এ সমস্যা মোকাবেলা করে, তার উপরি সব কিছু নির্ভর করবে।
প্রশ্নঃ সেক্ষেত্রে, প্রশাসন কি করতে পারে বলে আপনি মনে করেন, মিঃ সিং?
উঃ ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে, আমাদের সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ ভুমিকা পালন করতে পারে।
প্রশ্নঃ ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে অবশ্যই তা প্রয়োজন। আপনি কি একি সাথে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার কথাও বোঝাচ্ছেন?
উঃ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে সময় লাগবে। কিন্তু সেটি ছাড়াও, অনেক বিষয়েই যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক অবস্থান ভারত এবং পাকিস্তানের বিষয়ে তাদের অনিরপেক্ষ মনোভাবকেই স্পষ্ট করে তোলে।
প্রশ্নঃ কোন কোন অবস্থান, মিঃ সিং? আপনি কি আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে পারবেন?
উঃ যেমনঃ তারা এখনও ভিত্তিহীন গল্প বানিয়ে বলছে যে এই যুদ্ধের জন্য ভারতই দায়ী। আমরা শুধুই নিজেদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করেছি, এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ ডিসেম্বর আমাদের বিভিন্ন এলাকায় বিমান হামলা করার নির্দেশ দেওয়ার পরই যুদ্ধ শুরু হয়। এরপরও এ যুদ্ধের জন্য ভারতকে দায়ী করা ভিত্তিহীন এবং কোনভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয়।
প্রশ্নঃ ভারত এবং চায়নার ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনার মন্তব্য কি?
উঃ আমরা সবসময়ই চাই যেন ভারত এবং চায়নার সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকে, এবং আমরা সবসময়ই এই নীতি অবলম্বন করবো। চায়না এক্ষেত্রে কিরকম সাড়া দেয়, তার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে, কিন্তু আমরা সবসময়ই এমন নিতী গ্রহনে আগ্রহী যা চায়নার সাথে আমাদের সম্পর্কের আরো উন্নতি সাধন করবে।
প্রশ্নঃ চায়নিজদেরকে বর্তমানে অসম্ভব সন্দিহান মনে হচ্ছে। জাতিসংঘে তারা বলছেন যে ভারতে তিব্বতি শরণার্থীদের উপস্থিতি তিব্বতে ভারতের অভিযানের একটি ন্যায়সঙ্গত অযুহাত হিসেবে দেখানো হতে পারে। তারা বলেন, ঠিক একি কারন দেখিয়ে পূর্ব বাংলাতেও সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে। এসকল অভিযোগ সম্পর্কে আপনি কি মনে করেন?
উঃ প্রথমত বাংলাদেশ এবং তিব্বতের পরিস্থিতি কোনভাবেই এক নয়। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এবং ইচ্ছাকে সেনাবাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতায় নির্দয়ভাবে দমন করা হচ্ছিল। অন্যদিকে, আমাদের কোন সন্দেহই নেই যে, তিব্বত চায়নারই অধীন একটি রাজ্য। আপনারা যদি তিব্বতের শরণার্থীদের কথা বলেন, তবে আমরা নিতান্তই মানবতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। আমরা তাদেরকে কখনও কোন রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার অনুমতিও দেইনি। যদি তারা সত্যি এমনটি সন্দেহ করে থাকে, তবে আমি বলবো এ সন্দেহের কোন ভিত্তি নেই এবং আমি এই দুই পরিস্থিতির মধ্যে কোন যোগসুত্র তৈরি করার সুযোগ দেখিনা।
প্রশ্নঃ মিঃ সিং, নৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে, পাকিস্তান বাংগালিদের সাথে যে আচরন করেছে তা সঙ্গত নয়, কিন্তু এধরনের জাতিগত সমস্যার সমাধানে অস্ত্রের ব্যবহার নতুন অস্থিরতারও জন্ম দিতে পারে বলে জাতিসংঘ উদ্যোগ প্রকাশ করেছে। বিশ্বের অনেকে দেশেই এধরনের সমস্যা বিদ্যমান, বাঙ্গালিরাও অনেক দেশে ছড়িয়ে আছেন। এ মুহূর্তে সেসকল দেশ, এবং তাদের প্রতিবেশিরা পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ কিংবা অস্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখলেও, এধরনের একটি উদাহরন কি তাদের ক্ষেত্রে আরেকটি সশস্ত্র যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি করতে উৎসাহ যোগাতে পারে?
উঃ আমি এধরনের আশঙ্কার কোন ভিত্তি খুজে পাইনা। প্রথমত, খুব বেশি সঙ্খ্যক বাংলাদেশি বিশ্বের অন্যান্য স্থানে অবস্থান করেন না। আমি কোনভাবেই ভাবতে পারিনা, ৭.৫ কোটি মানুষ সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্ভুলভাবে তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করার জন্য সামরিক বাহিনীর হাতে এভাবে নিগৃহীত হতে পারে। আমি এমন উদাহরন আর কোথাও কখনো দেখিনি। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে বা অন্যান্য রাষ্ট্রে হয়ত এমন ধরনের সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা আর কোথাও হয়নি। আমার মনে হয়না যে অন্য কোন দেশে এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বলে আশংকা করার কোন প্রয়োজন আছে।