You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.15 | যুক্তরাষ্ট্রের  প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে লেখা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি | ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭৭। যুক্তরাষ্ট্রের  প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে লেখা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১

৭.৫ কোটি মানুষের জীবন, মুক্তি এবং সুখের অধিকার
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মিঃ রিচারড নিক্সনকে লেখা ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি
১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

জনাব রাষ্ট্রপতি,

আমি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এমন একটি সময়ে আপনাকে লিখছি, যখন দুই দেশের অন্তর্বর্তী সম্পর্ক একটি দুঃখজনক মোড় নিয়েছে। আমি সবধরনের গর্ব, সংস্কার এবং আবেগকে সরিয়ে রেখে আপনাকে অনুরোধ করব, এখানে যে বিয়োগান্তক পরিস্থিতি ঘটে গেছে, তার কারণগুলো পুনরায় বিশ্লেষণ করে দেখতে। এমন অনেক সময় আসে যখন চরম শোক ও তার রেশ কেবলমাত্র অতীতের সোনালী সময়ের স্মৃতিচারণের মাধ্যমেই বিলীন করা সম্ভব। এমনি একটি ক্ষণজন্মা মুহূর্তেই সেই বিবৃতিটি দেওয়া হয়েছিল, যাতে বলা হয়েছে, যদি কোন সরকার গনমানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও সুখের অধিকার খর্ব করে, তবে ঐ জনগনেরও অধিকার আছে ঐ সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারন করা বা বিকল্প সরকার নির্বাচন করার।

যারা নিরপেক্ষভাবে ২৫শে মার্চ থেকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাগুলো জরিপ করেছেন, তারা অবশ্যই এই সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিদ্রোহকে স্বীকৃতি দিবেন, কেননা তাদেরকে এমন এক পরিনতির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল যেখানে তাদের জীবন, স্বাধীনতা কিংবা সুখের সকল অধিকার এর তো প্রশ্নই আসেনা, এ বিষয়ে কথা বলারও অধিকার দেয়া হয়নি। আমেরিকার বেশিরভাগ স্কলারগন যারা এ উপমহাদেশ সম্পর্কে জ্ঞাত, তারা প্রত্যেকেই পূর্ব বাংলার এসকল হতাশার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন।

যে দুঃখজনক যুদ্ধ চলছে, তা খুব সহজেই এড়ানো যেত যদি মহান বিশ্বনেতারা ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান আমাদের উপর হামলা চালানোর পূর্বে এখানে যে বিদ্রোহের সুচনা হয়েছিল সেদিকে নজর দিতেন, ঘটনার আসল কারণগুলোর দিকে মনোনিবেশ করে সমস্যা সমাধানের সঠিক উপায় অনুসন্ধান করতেন। আমি অসংখ্যবার এবিষয়ে চিঠি লিখেছি। এমন একটি সময়ে দেশ ত্যাগ করা কঠিন হলেও আমি শান্তির সন্ধানে বারবার বিদেশে ভ্রমন করেছি। বিশ্বনেতাগণকে ঘটনার ভয়াবহতা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে যে দরিদ্র শরণার্থীদের জন্য সকলেই ব্যাথিত হলেও এর পেছনের মুল সমস্যাটি সকলের কাছেই অবহেলিত ছিল।

যদি সকল রাষ্ট্র, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র তার ক্ষমতা, প্রভাব এবং কর্তৃত্ব খাটিয়ে শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারতেন, তাহলেও এ যুদ্ধ এড়ানো যেত। তার বদলে আমাদের বলা হয়েছিল যে একটি বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। সকলেই জানে যে বেসামরিক প্রশাসনের নামে আমাদের ধোকা দেয়া হয়েছে, এবং আজকে সেই ধোকা একটি বিয়োগান্তক পরিস্থিতিতে পরিনত হয়েছে।

এ সমস্যার সমাধানে প্রচুর মৌখিক প্রতিশ্রুতি দাওয়া হলেও, বাস্তবে কোন কিছুই করা হয়নি। বরং, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগন জোরপূর্বক তাদের সকল হেরে যাওয়া আসনগুলোকে শুন্য ঘোষনা করে ভুয়া নির্বাচন করেছে।

বহির্বিশ্বের কেউই মুজিবর রহমানের সাথে যোগাযোগ করার কথা উচ্চারনও করেননি। আমরা শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির জোর দাবী জানাই। এমনকি আটক অবস্থাতেও তার সাথে যোগাযোগ করা যেত, কিন্ত সে সম্ভাবনা কখনোই যাচাই করা হয়নি, কেননা যুক্তরাষ্ট্র এমন কোন কিছুই করবেনা, যাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান উৎখাত হতে পারেন। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র জানে যে মুজিবর রহমান একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানের স্বৈর শাসন স্থাপনের ক্ষেত্রে একটি হুমকিস্বরূপ, সুতরাং তাকে বারবার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য এবং দেশ শাসনে ইয়াহিয়া খানের অসুবিধা সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়েছে।

জনাব রাষ্ট্রপতি, আমি আন্তরিকভাবেই আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই, শেখ মুজিবর রহমানের সাথে গোপন আলোচনা কিংবা তার মুক্তি কি একটি যুদ্ধের সুচনার চেয়েও বেশি মারাত্নক?

আসল সত্য হল এইযে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগন জানেন যে, দুই অঙ্গরাজ্যের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ হলেও, জনগনের তীব্র বিরোধিতার মুখেও, পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে অলঙ্ঘনীয় রাখতে তারা যে কোন কিছুই করতে পারবে, মানবাধিকার, স্বাধীনতার অধিকার সকলই ভুলুন্ঠিত করতে পারবে। কেননা কেউ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র তাদের জনগনের পক্ষে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসবেনা।

জনাব রাষ্ট্রপতি, গত নয় মাস ধরে শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার কারনে আমরা ক্রমাগত পাকিস্তানী সরকারের চাপ এবং অবাধ্যতা সহ্য করে আসছি, কোন সহিংস প্রতিবাদ করিনি। গত ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ দিনেদুপুরে পাকিস্তানী বাহিনী অম্রিতসার, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তিতপুর, উত্তরালয়, যোধপুর, আম্বালা এবং আগ্রায় অবস্থিত বিমানঘাটিগুলোতে প্রচণ্ড বোমাহামলা চালানোর পরই যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এসময় আমি কোলকাতায় অবস্থান করছিলাম, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পাটনায় অবস্থান করছিলেন এবং তার সেখান থেকে তার দক্ষিনে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা ছিল। অর্থমন্ত্রী বোম্বেতে অবস্থান করছিলেন। কোন দুরভিসন্ধি নিয়েই তারা রাজধানীতে আমরা অনুপস্থিত থাকার সময়টিকে হামলার সময় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এমন অবস্থায় আমরা কি করে এ বিশ্বাস থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকব, যে পাকিস্তানী শাসকগন ও তাদের মন্ত্রনাদাতাগনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ, গঠনমূলক এবং যৌক্তিক?

আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় যে আমরা কি চাই। আমরা আমাদের জন্য কিছুই চাইনি। আমরা প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের কোন অংশ চাইনা। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানেরো কোন অংশ দাবী করিনি। আমরা পাকিস্তানের সাথে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। কিন্তু পাকিস্তান কি কাশ্মির দখল করার জন্য গত ২৪ বছর ধরে যে বিরামহীন এবং অর্থহীন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, তা থেকে বিরত হবে? তারা কি ভারতের প্রতি তাদের বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারনা এবং শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন ত্যাগ করবে? আমার পিতা অথবা আমি কতবার তাদের শান্তিচুক্তি করবার আহবান জানিয়েছি? ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, যতবার এধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, পাকিস্তান সাথে সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেছে।

আমরা অত্যন্ত ব্যাথিত হই যখন বর্তমান সংকটের জন্য পরোক্ষভাবে আমাদেরকেই দায়ী করা হয় বা আমাদের জন্যই সমাধান সম্ভব হচ্ছেনা বলে কটাক্ষ করা হয়। আমি জানিনা, কারা এধঅরনের অপবাদ দিয়ে যাচ্ছেন। আমি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, অষ্ট্রিয়া এবং বেলজিয়ামে সফরে থাকাকালীন জনসমক্ষে এবং ব্যাক্তিগত আলোচনায় বারবারই একটি রাজনৈতিক মধ্যস্ততার বিষয়ে জোর দিয়েছি। আমরা নয় মাস ধরে এর জন্য অপেক্ষা করেছি। অগাস্ট, ১৯৭১ এ যখন ডঃ কিসিঞ্জার আসলেন, আমি তাকে দ্রুত একটি রাজনৈতিক মধ্যস্ততা স্থাপনের গুরুত্বটি বুঝিয়ে বলেছিলাম। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত কোন ধরনের মধ্যস্ততার সামান্য কোন উদ্যোগ ও দেখতে পাইনি যার মাধ্যমে আমরা ধরে নিতাম যে আমরা যা ভেবেছি তা সঠিক নয়।

যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, আমি আন্তরিকভাবে আশা করব যে, আপনি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের জনগনের সকল আকাঙ্ক্ষা এবং আদর্শের প্রতিনিধি হিসাবে, সকল দিক গভীরভাবে বিবেচনা করে আমাকে জানাবেন যে, আমরা কি ভুল পদক্ষেপ নিয়েছি, যার কারনে আপনার মুখপাত্র ও প্রতিনিধিগন আমাদের সাথে এধরনের অসৌজন্যমূলক আচরন করছে।

শুভেচ্ছা ও শুভকামনায়,
বিনীতা
ইন্দিরা গান্ধী।