You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.03 | কোলকাতার জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা | “দি ইয়ারস অফ এন্ডীভার” - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৭২। কোলকাতার জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা “দি ইয়ারস অফ এন্ডীভার” ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১

আমরা সফল হবোই
আপনারা সবাই অবগত আছেন যে আজ আমরা এক নতুন ধরণের সংকটের মুখোমুখি। বাংলার এবং দেশটির অন্যান্য অংশের জনগন অতীতে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং গত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদেরকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছে। আমরা ভেবেছিলাম যে আমাদের উন্নতির পথে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব হয়েছে এবং আমরা এখন একটি শক্তিশালী দেশ গড়তে কঠোর পরিশ্রম করে যাবো। কিন্তু অচিরেই একটি বিষাদময় ঘটনা ঘটল যা আমাদের জনগণের উপর একটি বিশাল বোঝা চাপিয়ে দিল, যদিও আমরা একভাবে এতে জড়িতই ছিলাম। শুরুতে এটা ছিল কেবলই অর্থনৈতিক বোঝা। পূর্ব বাংলা থেকে শরণার্থীদের অবিরাম আগমন পশ্চিম পাকিস্তান, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার জনগণের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে পাল্টে দিয়েছে এবং তাদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলেছে। আমরা মনে করেছিলাম যে আমাদের এই বোঝাটা হয়ত অল্পকিছুদিনের জন্য বহন করতে হবে এবং অন্যান্য দেশের সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা তা সহজেই করতে পারবো। কিন্তু আমরা যে সহযোগিতা পেয়েছি, প্রয়োজনের তুলনায় তা অকিঞ্চিৎকর। যদিবা কেউ কেউ সাহায্য করেও থাকে, তারা এই সংকটের কারণ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র চিন্তিত ছিল না যে কেন একটি বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের ভিটেমাটি ত্যাগ করছে এবং বানভাসি জলের মত আমাদের দিকে ভেসে আসছে। সঠিকভাবে মূল নির্ণয় করা না গেলে কোনো রোগই সম্পূর্ণ আরোগ্য করা সম্ভব হয় না। এই বিশাল (জনগণের) অন্তঃপ্রবাহের কারণ সম্পর্কে মাথা না ঘামিয়ে আমরা যদি তা বন্ধ করতে চাই, তাহলে আমাদের কী করণীয়? আমরা সত্যিটা প্রকাশ করেছি এবং অন্যরা আমাদের সাথে একমত হয়েছে কিন্তু কেউই এ ব্যাপারে কিছু করেনি।

বর্তমান সংকট সম্পর্কে বুঝতে হলে আমাদেরকে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে হবে এবং জানতে হবে যে পাকিস্তান কীভাবে গঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ সমগ্র দেশেই সংঘটিত হয়েছিল, অবশ্যই বর্তমানে পাকিস্তান হিশেবে অভিহিত এলাকাতেও তা হয়েছিল। ‘সীমান্ত গান্ধী’ নামে সমধিক পরিচিত খান আব্দুল গাফফার খান এবং আব্দুল সামাদ খান, – যাকে ‘বেলুচ গান্ধী’ বলা হত, – এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান যখন গঠিত হল তখন এই নেতারা ক্ষমতায় অভিষিক্ত হননি। ভারতে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন এবং সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানে তাদের স্থান হয়েছিল কারাগারে এবং যারা অতীতে ব্রিটিশ সরকারকে সহায়তা করেছিল, তারাই পাকিস্তানে সরকার গঠন করেছিল। তারা সেনাবাহিনীতে বা অন্যান্য অফিসে পদ দখল করেছিল। তাদের এবং আমাদের মতাদর্শে একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল। আমরা তখনো উদ্বিগ্ন ছিলাম এবং এখনো সমান উদ্বিগ্ন যে আমাদের নতুন প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাথে সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত বিশেষত যখন পাকিস্তান আদর্শটি সত্যিতে বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাথে সবসময় বচসা করা কোনো রাষ্ট্রের জন্যই স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু আমরা যখনই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি, তখনই অন্যপাশে পেয়েছি একটি বদ্ধ মুষ্ঠি এবং অস্থিতিশীল, উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। আমাদের বিশ্বাস, এরূপ পরিস্থিতির কারণ এই যে অন্যান্য কিছু রাষ্ট্র পাকিস্তানকে এটা করতে উৎসাহ যোগাত। পাকিস্তানের সাথে বন্ধুসুলভ পরাশক্তিগুলো যদি শুরুতেই পাকিস্তানকে ভারতের সাথে যুদ্ধ না করতে পরামর্শ দিত, পাকিস্তান হয়ত যুদ্ধংদেহী ভূমিকা নিত না। ভারতের সাথে যুদ্ধে নামার শক্তিসামর্থ্য বা সাহস- কোনোটাই পাকিস্তানের ছিল না। কিন্তু তারা তা করেছিল; কারণ তারা বিদেশ থেকে সহযোগিতা ও যুদ্ধের সরঞ্জাম পাচ্ছিল। এমনকি তারা যখন আমাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল, তখনো তারা তাদের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে সমূহ উৎসাহ পেয়েছিল। তারা ইন্ধনদাতা রাষ্ট্রগুলো, যেহেতু তাদের পদ্ধতি বদলায়নি, যুদ্ধের ফলাফলের মাধ্যমে তারা আক্রমণকারী হিশেবেও চিহ্নিত হয়নি। এই সমস্তকিছুর ফলাফল হল এই যে, পরাশক্তিদের সাথে বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারেনি, বরং রাষ্ট্রটি আরো দুর্বল হয়েছে।

আমরা সবাই ভারতীয়, যদিও আমরা ভিন্ন ভাষাভাষী এবং ভিন্ন ভিন্ন ধর্মমত পোষণ করি। যে কোনো প্রদেশেই আমরা বসবাস করি না কেন, আমরা সকলেই এই রাষ্ট্রের নাগরিক, যারা এই দেশটিকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিন্ন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। একমাত্র উন্নত আদর্শই পারে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মমতের, অভ্যাসের, পোশাকের এবং ভাষার জনগোষ্ঠীকে এক সুতোয় বাঁধতে। কেবল ধর্ম ও ভাষা আজকের পৃথিবীর কোনো সম্প্রদায়কে এক জাতি হিশেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। আমাদের এই সংকীর্ণ চিন্তাচেতনার বাইরে যেতে হবে। ধর্ম একটি ভালো ব্যাপার এবং প্রত্যেকে অবশ্যই তার ধর্ম পরিপালন করবে। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে একটি জাতি গঠন করা যায় না এবং জনগণকে একতাবদ্ধ রাখা যায় না। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সময়ই আমরা একথা বলেছি কিন্তু না ব্রিটিশ সরকার না অন্য কেউ, – কেউই আমাদের কথা কানে তোলেনি এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে পাকিস্তানের সূচনালগ্ন থেকেই সেখানে এক ধর্মের মানুষেরা অন্য ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুদের উপর নৃশংসতা চালিয়েছে।

আরেকটা ব্যাপার পাকিস্তানে ঘটে আসছিল এবং বাকি পৃথিবী তা উপেক্ষা করে যাচ্ছিল; তা হলো এমনকি একই ধর্মের সংখ্যাগরিষ্ঠরাও অত্যাচারিত হচ্ছিল। আমরা এটা জানতাম কিন্তু এটা অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন ব্যাপার হওয়ার কারণে আমরা এতে হস্তক্ষেপ করতে পারিনি। কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘদিন বজায় থাকতে পারত না এবং শেষমেষ এটা পাকিস্তানকে আরো দুর্বল করে তুলেছিল। পাকিস্তান যদি আরো দুর্বল হয়ে থাকে, তা একারণে না যে আমরা এরকম চেয়েছি। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে কারণ অন্য রাষ্ট্রসমূহ একে (পাকিস্তানকে) ভুল নীতি অনুসরণ করতে সাহায্য করেছে যা সম্ভবত তাদের স্বার্থানুগামী ছিল এবং পাকিস্তানের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। আমাদের নেতারা জাতীয় স্বার্থ-অনুযায়ী নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং দৃঢ়ভাবেই তা অনুসরণ করেছেন।

আমাদের উন্নয়ন-পরিকল্পনা ইতোমধ্যে বাস্তবায়নাধীন কিন্তু ইতোমধ্যেই একটা বিরাট বোঝা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বোঝাটি মূলত অর্থনৈতিক কারণ শরণার্থীদের সংখ্যা অত্যন্ত ব্যাপক। এই অন্তঃপ্রবাহ একইসাথে কিছু সামাজিক, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাও সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের নিরাপত্তার প্রতি যে হুমকি এটি চাপিয়ে দিয়েছে। এটা আরো বড় বিপদের আকার নিতে পারে।

আপনারা জেনে থাকবেন যে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত যত শরণার্থী এসেছেন, আমরা সবাইকেই পুনর্বাসিত করেছি। একটি দরিদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও এবং বহির্বিশ্ব থেকে নামমাত্র সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও আমরা তা করেছি। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম যেহেতু আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা একটু একটু করে আরো হুমকির সম্মুখীন হচ্ছিল। পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গের মধ্যবর্তী সীমান্তে আমাদের পাশে মোতায়েন রয়েছে ‘বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স’ এবং অন্যপাশে ‘পূর্ববঙ্গ’ বা ‘পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস’ যদিও তারা তাদের নাম পাল্টে ফেলেছে এবং নিজেদেরকে ‘মুক্তিবাহিনী’ বলে অভিহিত করেছে।

এমতাবস্থায়, পাকিস্তান তার সেনাবাহিনীকে আমাদের সীমান্তের দিকে সরিয়ে আনলো; পশ্চিমে তারা কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজস্থান ও গুজরাটের দিকে আরো অগ্রসর হলো। যখন তাদের বাহিনী কাশ্মীর সীমান্তে উপনীত হলো, আমরা এর প্রতি জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। তারা আমাদেরকে বলল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সামরিক প্রশিক্ষণ কুচকাওয়াজের অংশ হিশেবে এটা করছে। কে এটা বিশ্বাস করতে পারে? বিশেষত এমন একটা দেশ, যে কিনা ইতঃপূর্বে তিন তিনবার পাকিস্তানী আগ্রাসনের শিকার হয়েছে? আমাদের নিরাপত্তার প্রতি বিপদ প্রতিমুহূর্তেই বাড়ছিল কিন্তু আমরা দশ দিন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করিনি। দশম দিনের পর আমরাও আমাদের সেনাবাহিনীকে এগিয়ে নিলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের সেনাবাহিনীকে সীমান্তের দিকে এগিয়ে নেইনি, আমাদের সীমান্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব পৃথিবীর কোনো দেশেরই, — ছোট কি বড়, — চোখে পড়েনি। আমাদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সম্পর্কে তারা চিন্তিত ছিল না বা এ ব্যাপারে যে তাদের কিছু করা উচিত, তা-ও তাদের মনে হয়নি। কেউই, কোনো রাষ্ট্রই, এ-ব্যাপারে কোনো মতামত প্রকাশ করেনি। কিন্তু যেইমাত্র আমাদের বাহিনী সামনে অগ্রসর হলো, অন্য কারো ভূমিতে না, আমাদেরই নিজস্ব সীমানায়, অমনি বিশ্বশক্তির অংশীদাররা হৈচৈ তুলে ফেললেন যে বিশ্বশান্তি সংকটাপন্ন এবং তারা বলতে শুরু করলেন যে উভয় দেশেরই তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। এখন, আমরা কি এটা মেনে নিতে পারি? ন্যূনতম দায়িত্ববোধসম্পন্ন কোনো সরকার, কোনো মন্ত্রী বা অন্য যে কোনো অফিস তার দেশ এবং সীমান্তের নিরাপত্তাকে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারে না। আমরা জানতে চেয়েছিলাম যে কেন পাকিস্তানী বাহিনীকে আমাদের সীমান্তের দিকে অগ্রসর করা হয়েছে এবং এটা আদৌ আমাদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি বহন করে না কিনা। আমরা যদি আমাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতাম, তাদেরকে সীমান্ত থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিতে হত, যেখানে আমাদের সেনানিবাসগুলো ও অন্যান্য বন্দোবস্ত রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের শহরগুলো এবং সেনানিবাসগুলো তাদের সীমান্তের কাছাকাছিই অবস্থিত। তারা যদি কিছুটা প্রত্যাহার করেও, তখনো তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। আমাদের আক্রমণ করতে চাইলে তারা দ্রুতই সীমান্তে পৌঁছাতে পারে। আমরা তা পারি না। কে আমাদের এই নিশ্চয়তা দেবে যে যদি আমরা আক্রান্ত হই, তারা আমাদের সাহায্য করবে এবং হানাদার বাহিনীর দখলকৃত ভূমি আমাদের ফিরিয়ে দেবে? কেউই এই বিষয়টি বিবেচনা করতে প্রস্তুত নয়। তারা সবাই বলছে যে সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। আমরা এই দাবিকে নাকচ করিনা। তবে আমাদের কিছু প্রস্তাব আছে। কিন্তু এটা কতটুকু যৌক্তিক যে শুধুমাত্র অন্যপক্ষের প্রস্তাবই মেনে নেওয়া হবে? আমাদের প্রস্তাব এই যে, পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীকে পূর্ব বাংলা থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। পূর্ব বাংলায় তাদের আগমন এবং অবস্থানের কারণেই সেখানে ত্রাসের রাজত্ব বিরাজ করছে এবং বিশাল জনস্রোতে শরণার্থীরা আমাদের দেশে প্রবেশ করছে। তারা যদি পূর্ব বাংলা ত্যাগ করে, যুদ্ধ অবিলম্বেই বন্ধ হবে। কিন্তু কেউই এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে রাজী নয়।

আমাদেরকে আমাদের পূর্ব সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দলকে স্বাগত জানানোর প্রস্তাবেও একমত হতে বলা হয়েছিল। আমার জানামতে, যতদূর সম্ভব, তাদের কেউ কেউ সেখানে ছিল। সম্ভবত তারা এখনো সেখানে অবস্থান করছে। কিন্তু প্রশ্নটা হল কেন তাদেরকে সেখানে নিযুক্ত করা হবে? তাদের সেখানে অবস্থান কি শরণার্থীদের নিজদেশে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করবে? শরণার্থীরা বলেছে যে বাংলাদেশে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ না করা পর্যন্ত তারা সেখানে ফিরে যাবে না। এমতাবস্থায় আমরা কি তাদের ফিরে যেতে বলতে পারি যখন আমরা দেখছি যে সেখানে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, গণহত্যা ও নারী নির্যাতন চলছে এবং একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে? কীভাবে আমরা তাদেরকে এরকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে ফিরে যেতে বলতে পারি? সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করাই বৈশ্বিক সম্প্রদায় এবং আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য হওয়া উচিত। আমরা অনেকদিন অপেক্ষা করেছি, অপেক্ষা করেছি দেখতে যে অন্য কোনো রাষ্ট্র এই ব্যাপারে সাহায্য করে কিনা এবং সেখানে বিরাজমান ত্রাসের রাজত্ব বন্ধ করে কিনা।

আমি ইউরোপে এবং যুক্তরাষ্ট্রে কিছু দেশে ভ্রমণ করেছিলাম। আমাকে সবজায়গাতেই আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে বাংলাদেশে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনের ব্যাপারে তারা আমার সাথে একমত। তারা বলেছিল যে তারা এই সমস্যাটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করছে। কিন্তু এ থেকে কোনো ফলাফলই আসে নি। আমরা কাউকে হুমকি দেই না, বা অযথা কোনো শোরগোল তুলতে চাই না। কিন্তু আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে ভালোমন্দ বুঝি এবং আমরা এই স্বার্থ পরিত্যাগ করতে যাচ্ছি না। পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাদের রক্ত ঝরাচ্ছে। অতীতে আমাদের দেশেও এরকম হয়েছে। অসংখ্য কৃষক, বুদ্ধিজীবী এবং আইনজীবী স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এখন কোনো রাষ্ট্র যদি ভাবে যে আমরা আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করবো না এবং তাদেরকে তাদের নিজস্ব অশুভ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দেবো; আমরা তাদের অশুভ পরিকল্পনার ভুক্তভোগী হতে পারি না।

এই দেশের প্রত্যেক নাগরিককেই এই বোঝা বা ভার বহন করতে ভূমিকা রাখতে হবে, হোক সে যুবক বা বৃদ্ধ, পুরুষ কিংবা নারী। কষ্ট ও দুর্ভোগ সওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সকলকে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং বিপদের মোকাবিলা করতে হবে। যদিও সমগ্র দেশকেই এই বোঝা বইতে হবে, আপনাদের পশ্চিবঙ্গবাসীদের এই ভারের একটু বেশিই অংশ নিতে হবে। যা-ই হোক না কেন, আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

আমি আপনাদেরকে আশ্বস্ত করছি যে আমি যুদ্ধ চাই না। আমি ঐকান্তিকভাবেই শান্তিকামী। আমি জানি যুদ্ধ কী এবং এটা কীভাবে জনগণকে, বিশেষ করে জনগণের দুর্বল অংশকে, ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমি যুদ্ধ ঘৃণা করি। আমার আন্তরিক কামনা এই যে আমি যুদ্ধ সংঘটনের পক্ষে প্রভাবক হিশেবে ভূমিকা রাখতে চাই না। নেহেরু শান্তির ব্যাপারে অনেক বলেছেন কিন্তু এমনকি তিনিও বলেছেন যে আমাদের যদি নিজেদের স্বাধীনতার প্রতি কোনো আক্রমণকে মোকাবেলা করতে হয়, আমাদের অবশ্যই তা সর্বোচ্চ শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমেই তা করতে হবে।

কিছু বিদেশি পত্রিকায় আমাকে জেদী হিশেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হ্যাঁ, আমাদের নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এমন বিষয় সম্পর্কে আমি অবশ্যই জেদী; এবং আমার মতে, বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত এবং শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণকে হত্যা করে নির্মূল করা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। সুতরাং, আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, বাংলাদেশে যে ভয়াবহ নৃশংসতা চলছে তা বন্ধ হবে। এটা জেদী হওয়া নয়। আমরা যদি আমাদের জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করি, তাহলে এর কোনো বিকল্প নেই। আপনারা অবগত আছেন যে কেবল স্থিরচিত্তে বিবেচনার পরেই আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা তাড়াহুড়ো করে কিছু করিনি। আমরা কেবল তা-ই করছি, যা যথাযথ এবং আমাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট। যখনই কোনো বৈদেশিক শক্তি আমাদের সাথে আলোচনা করেছে, আমরা সতর্কভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেই তবে তাদের কোনো প্রস্তাব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি এবং আমাদের সাধ্যমত প্রস্তাবগুলো মেনে নিয়েছি। আমরা একটি সংকটের মুখোমুখি এবং এমতাবস্থায় জনগণকে উদ্যমী হতে হবে। বদলে যাওয়া পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে কীভাবে এই জন-উদ্যমকে ব্যবহার করা যায়, – আমাদের তাও ভেবে দেখতে হবে। জয়ী হতে হলে যেকোনো সৈন্যবাহিনীকেই যুদ্ধ করতে হয়। আর আমাদের শিল্প-স্থাপনা, কলকারখানা এবং বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে গেলে এবং হাসপাতালে সেবাদান ক্ষতিগ্রস্ত হলে এটা সম্ভব হবে না। যদি আমরা সত্যিই জয়ী হতে চাই, কলকাতার নাগরিকদের নিশ্চিত করতে হবে যেন শহরে ও গ্রামে প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড আরো দক্ষভাবে ও বেশি উদ্যমের সাথে পরিচালিত হয়।

আমাদের দেশের জন্য এটি একটি অগ্নিপরীক্ষার সময় কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী যে আমরা সাফল্য লাভ করবো। সংগ্রামের প্রকৃতি যেমনই হোক না কেন, আমরা ঠাণ্ডা মাথায় এবং দৃঢ়ভাবে এর মোকাবেলা করব যাতে আমরা আমাদের জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা পূরণ করতে পারি এবং আমরা উন্নতির পথে যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারি। যত বড় বিপদই আসুক না কেন, যত ব্যাপক চাপই প্রয়োগ করা হোক না কেন, আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, এমনকি যদি আমরা নিঃসঙ্গও হই। আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসরত নাগরিকেরা জানেন যে পাকিস্তানীরা আগরতলা এবং অন্যান্য জায়গায় গুলিবর্ষণ করছে। আমাদের হাসপাতালগুলো আহতদের দ্বারা পরিপূর্ণ। আমাদের হৃদয়-নিংড়ানো শুভকামনা তাঁদের সাথী এবং আমি আমার পক্ষ থেকে, জাতির পক্ষ থেকে, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমরা তাঁদের সাহসিকতায় গর্বিত এবং আমরা আশা করি যে তাঁদের মনোবল উত্তুঙ্গু থাকবে। যদিও তাঁরা এখন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে পারছেন না, তবুও তাঁরা আমাদের সৈনিক, আমরা তাঁদের সাহসকিতা ও উদ্যমে গর্বিত।