You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬৮। বনস্থ বিথোভেন হলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষন ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ২১ নভেম্বর, ১৯৭১

নিম্ন লিখিত ভাষন থেকে উদ্ধৃতাংশঃ

ইলেকশনের পর আমরা ভেবেছিলাম যে, আমাদের পথ এখন পরিষ্কার, আপনার সবাই জানেন যে, আমরা তখন ব্যাস্ত ছিলাম একে অপরকে অভিবাদন জানাতে, একে অন্যের পিঠ চাপরাতে, হঠাৎ নতুন এক ঝামেলা শুরু হল, কোনপ্রকার সতর্ক বাণী ছাড়াই, আমাদের কোন দোষ ছাড়াই আমাদের উপরই অবতীর্ন হল এবং সেই সংকট আমাদের সীমানা জুড়ে চলছে। সাধারনত আমি অন্য দেশ সম্পর্কে মন্তব্য করতে পছন্দ করি না, কিন্তু এই মুহুর্তে যাতে আপনারা বুঝতে পারেন এখনকার অবস্থা, আমি কিছু বলতে চাই। ভারতীয় উপমহাদেশে যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছিলো, তখন সমগ্র উপমহাদেশ জুড়েই এই আন্দোলন বা সংগ্রাম ছিলো, এমনকি বর্তমান পাকিস্তান অংশতেও। কিন্তু যখন স্বাধীনতা অর্জিত হয়, দেশ বিভক্ত হয়, আমরাও সেই বিভক্তি মেনে নিয়েছিলাম, যদিও অখুশি মনেই। এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য আমাদের কাছে না বলার মতো কোন শব্দ বা কারন কিছুই ছিলো না। ভারতে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে যুদ্ধ করেছিলেন তারাই নির্বাচনে অংশ নেন এবং সরকার গঠন করেন। অন্যদিকে পাকিস্তানে যারা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন তারা জেলে রয়েছেন এবং যারা বিদেশি শাষক গোষ্ঠীদের সহযোগীতা করেছিলো তারাই সরকার গঠন করেছে। সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রেই। এটাই হল দুই দেশের পার্থক্য।

পাকিস্তান ২ বার ভারত আক্রমন করেছে এবং এখন আবারো যুদ্ধের আশংকা আছে। আমরা এমন কিছুই করব না বা করিনি যা একটা যুদ্ধকে প্ররোচিত করতে পারে। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি যুদ্ধের মতই, কেননা আমাদের সৈন্যরা সীমান্তে মুখোমুখি হচ্ছে। কিছুদিন আগে এই প্রশ্নটি আমাকে করা হয়েছিলো টিভিতে, “ভারত কেন সৈন্য প্রত্যাহার করছে না, যখন এই প্রস্তাবনা নেয়া হয়েছে? এই ভারতই জাতিসংঘের নিকট শরনাপন্ন হয়েছিলো, যখন এই সংকট অবস্থার ষড়যন্ত্র শুরু হয়।

আপনারা জানেন, ভারতে ঠিক যেমন আমাদের নির্বাচন হয়েছিলো, ঠিক তেমনই বেশ দীর্ঘ একটা সময় পর পাকিস্তানেও নির্বাচন হয়। কারন জনগন সামরিক শাষনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো এবং সেখানে নির্বাচনের একটি সাধারন চাহিদা ছিলো। পাকিস্তানে, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ভারতে আমার সংখ্যাগরিষ্ঠতার তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। পূর্ব বাংলার প্রায় প্রতিটি নারী পুরুষ এই মানুষটিকে ভোট দিয়েছিলেন। ভারত মনে করে আপনি নির্বাচনে জয়ী হলে, আপনিই সরকার গঠন করবেন – এটাই যৌক্তিক। কিন্তু সেখানে তা ঘটে নাই। এই ছয় দফা কর্মসূচি কোন নতুন কর্মসূচি না, শেখ মুজিবর রহমান নির্বাচনের আগেই জনগনের সামনে এই কর্মসূচি পেশ করেছিলেন। এটি ছিলো নির্বাচন কর্মসুচির নির্বাচনী প্রচারণা। কারো যদি এ ক্ষেত্রে কোন প্রকারে আপত্তি থাকে, নেতা বা অন্য কারো, নির্বাচনের আগেই আপত্তি জানানোর সময়। তাদের বলা উচিত ছিলো যে, এই ছয় দফার ভিত্তিতে তারা নির্বাচন করবে না। কিন্ত্ কেউ কোন কিছুই বলে নাই। বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচন জেতার পর এটা ঘটল। এর মানে হলো আরও বেশী শায়ত্বশাষন আমরা দিতে প্রস্তুত। আলোচনা শুরু হল। আমরা ভেবেছিলাম, পূর্ব বাংলার মানুষেরা ভেবেছিলো, আপোষে আসার এটাই ছিলো একমাত্র সঠিক উপায়; কিন্তু এই সময় গুলো ব্যাবহৃত হয়েছিলো আরো বেশি সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমুদ্র পথে নিয়ে আসার জন্য, এবং যখন তারা মনে করলো জনগণকে মোকাবিলা করার জন্য তাদের যথেষ্ট সৈন্য এসেছে, তখন ২৪শে মার্চে আমি পূর্ব পাকিস্তানের এক নেতা – যদিও তিনি মিটিং রুমে না থাকলেও ঐ স্থানেই ছিলেন – তিনি বললেন যে তিনি মনে করেছিলেন, সব কিছু ঠিক মতই চলছে এবং তারা একটি সমাধানের দিকে যাচ্ছেন।

এর পরের দিনই সন্ত্রাস এবং গনহত্যার রাজত্ব কায়েম হয় যার পরিমাণ ছিল মাত্রা ছাড়া। এর ফলাফল হচ্ছে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু যার পরিমাণ ৯০ লক্ষেরও অধিক, যা বেলজিয়াম বা অস্ট্রিয়ার মোট জনসংখ্যার সমান – যারা এখন ক্যাম্পে সর্বোচ্চ দুর্ভোগ আর দূর্দশা নিয়ে ভারতের মাটিতে অবস্থান করছে।

এখন, একটি সমৃদ্ধশালী দেশেও যদি হঠাৎ করে ৯০ লক্ষ মানুষ প্রবেশ করে তাহলে তারাও পুরো পরিস্থিতিকে সামাল দিতে পারবে না। ভারত হচ্ছে দরিদ্রতম দেশ গুলোর মধ্যে অন্যতম যার সম্পদ খুবই সীমিত এবং এই মুহুর্তে আমাদের দেশে আরও ৯০ লক্ষ মানুষ এসেছে। আপনারা কল্পনা করতে পারেন এটি প্রশাষন, সম্পদ ও অর্থের উপর প্রভাব ফেলবে। বেশির ভাগ শরনার্থী এসেছে ভারতের পূর্ব প্রদেশের ৪টি রাজ্য থেকে, এবং এর মধ্যে একটি হচ্ছে ত্রিপুরা যেখানে একজন অতিরিক্ত মানুষকে রাখার জন্যও জায়গা নেই। তারা থাকছে স্কুল কলেজ, পার্ক এবং সম্ভাব্য সব পাবলিক আবাসনগুলোতে। শুরুতে সবাই খুব সহমর্মী ছিলো। এখন, বাবা মায়েদের বক্তব্য, আমরাও সমব্যাথী কিন্তু আমাদের ছেলে মেয়েদের কি হবে? স্কুল গুলো কবে খুলবে? তারা কি পড়াশুনা এক বছর বাদ দিবে? তাই, এই সব রাজ্য গুলোতে সকল প্রকার প্রশাষনিক কাজ কর্ম স্থবির হয়ে আছে। প্রত্যেক কর্মচারী এখন ক্যাম্প দেখা শোনায় ব্যাস্ত।

অর্থনৈতিক চাপ ছিলো ভয়ঙ্কর, প্রশাষনিক সমস্যাও ছিলো, কিন্তু যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা তৈরী হয়েছে তা আরো বেশি। আমাদের সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আছে। তাদের একটি নির্দিষ্ট রেট আছে। এখন, আমরা শরনার্থীদের ক্যাম্পে রাখার চেষ্টা করেও পারছি না। কিন্তু কারন তাদের সংখ্যা এত বেশি এবং বেশির ভাগই ক্যাম্পে না এসে অত্যন্ত কম রেটে পরিসেবা দেয়। এখন সেখানেও ঝামেলা; কারন শ্রমিক ইউনিয়ন বলে, “এটা আমাদের রেট এবং আপনাকে চাকরী দেয়া সম্ভব না”। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সুযোগ নেবার মতো লোক ও আমাদের আছে এবং এর কারনে আমাদের বেশ সামাজিক দুঃশ্চিন্তা ও আছে। আমি শুধুমাত্র বোঝানোর জন্য একটা উদাহরন দিলাম যাতে বোঝাই যায় এটা ভারতের স্থিতীশীলতার উপর হুমকি। এই শরনার্থীদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা সত্যিকারের শরনার্থী নয়। আমাদের কোন উপায় নেই তাদের কে রাখার। আমরা অনেক অন্তর্ঘাতের স্বীকার হচ্ছি, ট্রেন উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ছিন্ন ভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গ পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় এবং ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে বিভিন্ন ধরণের গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি করা হচ্ছে।

শরনার্থীদের সংখ্যা নিয়ে পাকিস্তানীরা প্রশ্ন তুলেছিল, আমরা বলেছিলাম ৯০ লক্ষেরও বেশি। তারা যে সংখ্যাটা দিয়েছিল, যেটা ছিলো ২৫ থেকে ৩০ লক্ষের মত। এখন, তাদের এই তর্কের পেছনে কিছু যুক্তিও আছে, কেননা এই ২৫ থেকে ৩০ লক্ষের সংখ্যাটা ছিলো মুসলিম শরনার্থীদের। কিন্তু আমাদের কাছে শুধু মুসলমান শরনার্থীরাই ছিল না, ছিল হিন্ধু, খ্রীষ্টান এবং বৌদ্ধ শরনার্থীও। ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং আসাম এই তিন প্রদেশের প্রত্যকেরই একটি করে রেশন কার্ড আছে, এর ভিত্তিতে তাদের কে সম্পূর্ন গননা করা হয়। এটা সত্যি যে, পশ্চিম বাংলা খুব একটা সুসংগঠিত না, কারন সেখানে বহু লোকের বাস। কিন্তু যখন এ প্রশ্নটি উঠে এসেছে, আমরা সমস্ত ক্যাম্প গুলোর হিসাব পুনরায় গননা করছি, এবং এটি প্রায় শেষের দিকে। এটি শুরু হয় আমার দেশ ত্যাগের কিছুদিন পর থেকেই। কম বা বেশিও হতে পারে। আমার মনে হয় না আমার দেয়া হিসাবের সাথে সেখানে খুব বড় ধরনের পার্থক্য থাকবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, (১) জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের নিয়ে, এবং (২) সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে। যখন আমরা জাতিসংঘকে এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করতে বললাম, আমাদেরকে তখন বলা হলো এটি একটি আভ্যন্তরীন ব্যাপার, জাতিসংঘ এ ক্ষেত্রে কিছু করতে পারে না। সংকটের শুরুর দিকে একথা গুলো ঠিক ছিলো। আমরা তাদের শুরু থেকেই বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম যে, হতে পারে এটি আভ্যন্তরীন ব্যাপার, কিন্তু এর ফলাফল ভারতকে প্রভাবিত করে বিশাল সমস্যার সম্মুখীন করেছে, আর জাতিসংঘের এক্ষেত্রে নজর দেয়া উচিত। এখন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল আসতে চায়, কিন্তু তারা পূর্ব বাংলার সংকটের কারনগুলো সমাধান করতে নয়, উলটো দেখতে এসেছে কারা সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। তারা বলতে চায় যে শরনার্থীরা ফিরে যাক। আমরা শরনার্থীদের বলছি, ফিরে যান এবং যদি এই কথা বলতে আরও কেউ আসে সেটা তারা পারেন। আমরা তাদের স্বাগত জানাই। কিন্তু ভারতে একটি অবাধ মুক্ত সমাজব্যাবস্থা প্রচলিত। বেশির ভাগ সাংবাদিক যারা আপনাদের দেশ থেকে, কানাডা থেকে, আমেরিকা থেকে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে, এবং অন্যান্য দেশ থেকে পুর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান দুই অঞ্চলেই গেছে, তারা অবাধে রিপোর্ট করছে, কুটনৈতিক সৈন্যবাহিনী ইচ্ছে মতো যেখানে খুশী সেখানে যেঁতে পারে। যে কোন প্রতিনিধি দল আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, জাপান, নিউজল্যান্ড এবং ইউরোপী স্ক্যান্ডেনেভিয়ান বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছিলেন সেখানে। তারা স্বাধীনভাবে শরনার্থি ক্যাম্পে যাওয়া, রিপোর্ট করা ও তাদের সাথে শরনার্থীদের সাথে কথা বলতে পেরেছেন। তাই এটা কোন বড় ধরনের পার্থক্য তৈরী করবে না। এমনকি জাতিসংঘ হাই কমিশনে আরো ১০ জন প্রতনিধিও আমাদের এখানে আছে। তাই আরও প্রতিনিধি আসাটা কোন সমস্যা নয়। সেখানে আরো কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন, যেমন কারিতাস (CARITAS ), ইউনিসেফ UNICEF, কেয়ার (CARE), ওয়ার-অন –ওয়ান্ট (WAR-ON-WANT), ওক্সফ্যাম (OXFAM) এবং আরো অন্যান্য সংগঠন আছে। তাই তারা আসলে এমন কোন প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু আমাদের আপত্তি আছে। আমাদের আপত্তির কারন হলো এরা সামগ্রিক ভাবে সমস্যা মোকাবেলা করতে আসছে না। সমস্যার একটা অংশ দিয়ে মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে। যখন আমরা শরনার্থীদের বললাম, যা আমি অনবরত বলেই যাচ্ছি যে, ভারত স্থায়ী বোঝা হিসেবে এইসব শরনার্থীদের রাখতে পারবে না, তাদের কে অবশ্যই পূর্ব বাংলায় ফিরে যেতে হবে, তারা কয়েক মাসের জন্য থাকতে পারে, যদি তাদের মধ্যে কোন এতিম ছেলে মেয়ে এবং গৃহহীন নারী থেকে থাকে তো তারা থাকতে পারে। কিন্তু আমরা লক্ষ লক্ষ শরনার্থিদেরকে এভাবে আমাদের দেশের থাকতে দিতে পারি না। আমরা এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাদের উত্তর, আমরা ফিরে যেতে চাই, কিন্ত কীভাবে ফিরে যাবো যখন সেখানে গনহত্যা এখনো অব্যাহত। শুরুর দিকে শরনার্থির সংখ্যা ছিলো ৩০ থকে ৪০ হাজার, এর পর এর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাড়িয়েছে ৬২ হাজারেরও অধিক। এখন আমাকে বলা হচ্ছে এদের প্রবেশের হার নাকি এখন কিছুটা কমে এসেছে, কিন্তু এখনো তা ১৬ থেকে ২০ হাজারের মতো। কিন্তু এখনো অনেক মানুষই আসছে যাদের সেই একই বর্বরতা, ভয়, হত্যা, ধর্ষনের কাহিনী। আমরা কীভাবে তাদের কিভাবে বলতে পারি যে ফিরে যাও। এবং আমরা বললে কারাই বা শুনবে? প্রথমত, শর্ত হচ্ছে ওপারে যাবার জন্য শরনার্থীদের নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে তারা মর্যাদা নিয়ে যেতে পারবে। এটাই আমরা বলেছিলাম জাতিসংঘের কাছে।

এবার সেনা সংক্রান্ত বিষয়ে বলছি। পাকিস্তানিরাই প্রথমে সীমান্তে তাদের সেনা মোতায়েন করে, তারা প্রথমে পুর্ব সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে, কেননা তারা প্যারা ফোর্সেস। আমাদের তাদের সাথে চুক্তি আছে, তারা সামরিক সৈন্যবাহিনী হতে পারবে না, শুধু মাত্র আধা সামরিক – যাদের আমরা ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস – ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং আমাদের দিকে আমরা যাকে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বলি। তাদের এই রেজিমেন্ট এবং রাইফেলসের লোকেরা মার্চেই পাকিস্তানের চাকরী ছেড়ে দিয়েছে। যখনই এই সব ঘটনা শুরু হয়, তারা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করে। তাই তাদের সীমান্ত অরক্ষিত অবস্থায় থেকে যায়। হয় তারা ছেড়ে আসতো অথবা তারা সীমান্তের চেক পোষ্টের এই লোকগুলোকে বিশ্বাস করতে পারে নাই। তারা তাই সীমান্তে তাদের সৈন্য নিয়ে আসে। কিছু সময় পর আমরাও আমাদের সৈন্য সরাতে বাধ্য হই। পশ্চিম ভাগেও কোন সমস্যা ছিলো না, যেমন কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজস্থান, কিন্তু একদিন তারাও তাদের সৈন্য সেখান থেকে সরিয়ে নিয়েছে। এখন, আমাদের জাতিসংঘ বলছে, ‘ওহ এরা তো সামান্য ব্যায়াম প্রশিক্ষনের জন্য”। অবশ্যই, এটা এমন কথা না যা আমরা বিশ্বাস করতে পারি। অথচ, আমরা এক সপ্তাহের বেশি সময় কোন ব্যাবস্থা নেই নাই। কিন্তু একেবারে শেষ মুহুর্তে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে তাদের আসলে সৈন্য সরিয়ে নেবার কোন ইচ্ছাই ছিল না। আমরা সীমান্তে সৈন্য সরিয়ে আনতে বাধ্য হই।

এখন, প্রত্যাহারের মানে কি? লোকে বলে, যদিও এটা তাদের ভুল ছিলো, সেক্ষেত্রে সৈন্য প্রত্যাহারে কি ক্ষতিই বা ছিলো? ? ভালো, প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের সেনানিবাস ঠিক সীমান্তের কাছেই। কিন্তু আমাদের তো আর না, আমাদের টা ছিলো বেশ দূরে এবং আমরা যদি সৈন্য সরিয়েও নেই, আমাদের পক্ষে কোন ভাবেই দেশকে সঠিক ভাবে প্রতিরক্ষা করা সম্ভব হবে না, যদি তারা তাদের মন পরিবর্তন করে ফেলে। এবং আমাদের কাছে তাদের কে বিশ্বাস করার মতো কোন কারন ও নেই। তারা আমাদের কে দুইবার আক্রমন করেছে। এবং প্রতিবার তারা বলেছে আমরা কোন অনুপ্রবেশকারীকে পাঠাইনি। এবং পরে তারা পাব্লিক ফোরামে যেমন নিরাপত্তা পরিষদে বা অন্য কোথাও তারা এসব বলেছে। এটাই হচ্ছে ইতিহাস আর এটাই তার পটভুমি। ভারত গভীর ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শান্তির জন্য এবং ভারত সার্বিক নিরস্ত্রীকরনে বিশ্বাস করে। সরকারপ্রধান হিসাবে আমি মনে করি যুদ্ধ কখনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। কিন্তু এই বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের সীমান্ত অরক্ষিত অবস্থায় ফেলেও রাখতে পারি না। বিশেষ করে, পাকিস্তান থেকে যেসব খবর আসছে যে, পূর্ব বাংলা তারা প্রায় হারাতে বসেছে। তো তারা কেন পশ্চিমের কিছু অংশ দখল করবে না? এই হচ্ছে অবস্থা, যার সম্মুক্ষীন হচ্ছি আমরা। দূর থেকে দেখলে ভারতকে মনে হবে, “আচ্ছা, এখানে এমন কোন প্রভাব পরে নাই”। কিন্তু সেসকল মানুষেরা যারা সীমান্ত এলাকায় বসবাস করে, এবং এমন আছে যে থাকার ঘর আমাদের অংশে আর রান্নাঘর পূর্ব পাকিস্তানে অথবা তার উল্টোটা – এইসব মানুষের জন্য সীমান্ত পরিস্থিতি খুব খারাপ। আমাদের কোন প্রাকৃতিক সীমানা ছিল না, ছিলো না কোন নদী অথবা রাস্তা অথবা অন্য কিছু। যেসব লোকেরা সীমান্তে বসবাস করেন, তাদের জন্য এটা বেশ বড় সমস্যা। তারা রক্ষিত না অরক্ষিত? তাদের রক্ষার দায় সরকারের উপর নির্ভর করবে কিনা?

কিছুদিন আগে আমাকে কাশ্মীর নিয়ে আরেকটা প্রশ্ন করা হয়েছিলো। এখন কাশ্মীরের কি হবে? পাকিস্তান অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, কাশ্মীর হচ্ছে আদি পাকিস্তান, এবং আমি ভীত এই কারনে কিছু মানুষ তাদের এই অপপ্রচারে সহায়তা করছে। ১৯৬৫ সালে তারা অনেক প্রশিক্ষিত অনুপ্রবেশকারীদের পাঠায়। তারা ভেবেছিলো এদেরকে স্থানীয়রা স্বাগত জানাবে। কিন্তু তারা মোটেও স্বাগত জানায়নি। স্থানীয় লোকেরাই আমাদের সর্ব প্রথম খবর দিয়েছিলো, কারন, এটা যখন হয়, সে সময় ওইখাঁনে আমাদের তেমন বাহিনী ও ছিল না, এমনকি রাজধানী শ্রীনগরেও আমাদের পর্যাপ্ত পুলিশ বাহিনী ছিল। এটাই ছিলো সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। এটাই ছিলো তার কারন, ইতোমধ্যে ১৯৬২ সালেও, আমাদের অন্য আরেক সীমান্তে আক্রমন হয়েছিলো, এবং সেখানে আমাদের সেনাবাহিনী ছিলো। কিন্তু ১৯৬৫ সালে যে আক্রমনটি সংঘঠিত হয়, তখন স্থানীয় লোকদের ঐক্য ছিলো। তারা শুধু আমাদের খবরা-খবরই দিচ্ছিল না, সামনের দিকে প্রতিরক্ষা লাইন তৈরী করেছিলো যতক্ষন না পর্যন্ত সৈন্য বাহিনী এসে তাদের দেশকে রক্ষা করে। ঠিক এভাবেই, আমরা শুধু পাকিস্তানীদের কাশ্মীরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলাম। এ অঞ্চলের বিশাল একটা অংশ, যার বেশ কিছু সুবিধাজনক পয়েন্ট আছে, যা পূর্বে পাকিস্তানের দখলে ছিলো সেগুলো নিয়ে আমরা নেই। এখন, কাশ্মীর অনেক বছর ধরে শান্তিতেই আছে। সেখানে ভিন্নমত ও আছে, আমি বলছি না যে নেই, কার্যত সব দেশেই এমন আছে। এমন কোন দেশ খুজে পাওয়া দুষ্কর যেখানে ভিন্নমতের মানুষ নেই। পরিস্থিতি বিচারের জন্য সেখানে শান্তি আছে কি নেই সেখানে সরকার স্বাভাবিক ভাবেই যাতায়াত করছে, কাশ্মীরে শিক্ষার সম্প্রসারন ঘটছে, কৃষি ব্যাবস্থের উন্নতি, শিল্পের অগ্রগতি ঘটছে। প্রত্যেকেই স্বাধীন ভাবে সেখানে যেঁতে পারে। এটা সত্যি যে সম্প্রতি আমরা কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছি তাদের দু একজন নেতার উপর। তারা সব জায়গায় যেঁতে পারবে, কিন্তু কাশ্মীরে প্রবেশ করতে পারবে না, কারন সেখানে সব কিছু শান্তিপূর্ন আছে এবং আমরা চিন্তা করেছিলাম, এই মুহুর্তে কারো জন্য ঝামেলা সৃষ্টি করা মোটেও দেশের স্বার্থে নয়।

সুতরাং আমাদের লুকানোর কিছুই নেই এবং আমি আগেই বলেছি, এই ঝামেলা গুলোকে প্ররোচিত করবার মতো মানুষ আমরা না, আমরা করবো ও না, অবশ্যই না। কিন্তু যদি মনে করে থাকেন যে, এই বর্তমান অবস্থা স্থায়ী হবে, তবে তা অবাস্তব। যদি মনে করেন যে, পূর্ব বাঙ্গালীদের অন্তরে এই তিক্ততা ও ঘৃনা কোন প্রকার ইতিবাচক কার্যকলাপ ছাড়াই চলে যাবে, এটা সত্যি অবাস্তব। একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে, বর্তমান পরিস্থিতির বাস্তবতার সাথে মুখোমুখী হতেই হবে। প্রশ্ন এটা নয় যে, আমি কি মনে করি বা আমি কি চাই? এটি একটি অস্তিত্বের প্রশ্ন এবং পূর্ব বাংলার মানুষ তাদের নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারন করবে। তারা আমাদের কাছ থেকে উপদেশ চায় না, এবং আমি যদি দিয়েও থাকি তারা সেটা নিবে না। আজ তারা জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত। এটা ভালোও হতে পারে, আবার খারাপও হতে পারে, সেটা পরের ব্যাপার। কিন্ত এটা এমন এক অবস্থা যা কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। আর এ কারনেই আমরা চাই, বিশ্বের উচিত এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে চেষ্টা করে দেখা যাতে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে পৌছানো যায় যেটা স্থায়ী হবে, এবং কোন কিছুই স্থায়ী হবে না যদি পূর্ব বাংলার মানুষ এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা তা গ্রহনযোগ্য না হয়।

এখন, পাকিস্তান সরকার ঘোষনা করেছে যে, তারা পুনঃনির্বাচন করবে। আমরা সত্যিই বুঝতে পারছি না। যারা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তারা এখানে, তারা জীবিত। আপনি হঠাৎ করে এখন বলতে পারেন না, এই আসন গুলো খালি। তারা শুধু ‘এই আসন গুলো শুন্য’ এ কথা বলছে না, ৫৫ জন ব্যাক্তিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওই শুন্য আসনে নির্বাচিত করেছে। এটি একটি অস্বাভাবিক অবস্থা, এবং আমার মনে হয় না গনতন্ত্রে এবং স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে এমন কোন লোক এই পরিস্থিতিকে মেনে নিবে।

উপরন্তু ভারতের উপর চাপ, বিশেষ করে অর্থনৈতিক চাপ অস্বাভাবিক। কিছুক্ষন আগেই আমি আরেকজন শ্রোতাকে বলছিলাম, যখন আপনি অভাবী হবেন, আপনি জানেন যে আপনি আরো দরিদ্রতর হয়ে যেতে পারেন। যদি পর্যাপ্ত খাবার না থাকে, তবুও হয়ত সর্বদাই শেয়ার করতে চাইবে। এটাই আমরা আমাদের দেশে দেখতে পাই, এবং আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, যেখানে খরা হয়েছে, অথবা যেখানে যুদ্ধ হয়েছে, সেখানে এই গরীব লোকগুলোই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। আজকে, যদিও এই চাপ অস্বাভাবিক, এর জন্য আমাদের বিশাল মুল্য দিতে হবে, এটা শুধু অর্থেই নয়, উন্নয়নের জন্য, মানুষকে দেয়া প্রতিশ্রুতির মুল্য দিতে হবে, কর্মসংস্থান কর্মসূচি সহ, প্রত্যেক কর্মসূচীর মুল্য দিতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি এই কর্মসুচী গুলো বাদ না দিতে, কিন্তু আমি জানি না কীভাবে এটা অটুট থাকবে, সবকিছুকেই কাট ছাট করতে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের উপর বেশ বড় কর আরোপ করা হয়েছে, এবং ঠিক কিছু দিন আগেও আমাদের কে অতিরিক্ত কর আরোপ করতে হয়েছে সম্ভাব্য প্রত্যেকটি জিনিসের উপর যতটা আমদের মনে হয়েছে। এবং আমরা সবাই বসে ভেবেছি সম্ভাব্য করের আওতায় আর কি হতে পারে এবং তাদের কর আওতাভুক্ত করেছি। তো আমাদের উপর এই বিরাট বোঝা আছে, কিন্তু আমার জনগনের প্রতি আস্থা আছে। তারা দেখিয়েছে যে, তাদের যে কোন প্রকার চাপ সহ্য করবার, যে কোন প্রকার দুর্ভোগ সহ্য করার অথবা আত্নত্যাগের ক্ষমতা আছে। এবং আজকে যদি এটা আমাদের একতার জন্য করতে হয়, স্থিতিশীল অবস্থার জন্য করতে হয়, স্বাধীনতার জন্য করতে হয়, আমি জানি ভারতের জনগন, এবং এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো যারা পুরোপুরি আমার বিপক্ষে, আমি জানি এই প্রশ্নে, আমরা সবাই এক। এবং আমাদের সেই চাপ সহ্য করার মত সংকল্প আছে। এই অর্থনৈতিক চাপ অথবা আর যে চাপই যত বেশিই হোক না কেন আমরা তলিয়ে যাবো না।

কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা, স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য যা যা পদক্ষের নেয়া দরকার তা আমদের নিতে হতে পারে, এবং আমি মনে করি, এটা শুধু ভারতের স্বার্থেই নয়, এখানে পাকিস্তানেরও নিজ স্বার্থ আছে। ভারত অস্থির থাকলে পাকিস্তান টিকে থাকতে পারবে না। যদি পাকিস্তান কিছু মুহুর্তের জন্য অস্থিতিশীল হয়েও পড়ে এবং ভারত স্থির থাকে, তবে পাকিস্তান তার স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু উপমহাদেশের এই বিশাল অংশে একটা সমস্যা আছে যে কেউই পাকিস্তান বা অন্য কোন ছোট দেশ কে রক্ষা করতে পারবে না। এবং, আমার মনে হয়, যদি ভারতে অস্থিরতা বিরাজ করে, এটার একটা প্রভাব সমগ্র এশিয়াতে পড়বে এবং এমনকি বিশ্বের অন্যান্য অংশেও পড়বে।

আজকে মানুষ যতটা না বুঝতে পারছে, তার চাইতে অনেক বেশি ঝুকি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি; এবং আমি আজ সরকারে পক্ষ থেকে বা অন্য কোন দেশের হয়ে কিছু বলতে আসি নি। এবং বিদ্যমান এই অবস্থার কেবল মাত্র মুল্যায়ন করতে এসেছি। এবং এরপর এইসব দেশ, এই সরকার অথবা জনগনের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে, এই পরিস্থিতিতে তাদের ঠিক কি করা উচিত, তারা কি যাহায্য করবে কি করবে না সেটা দেখার বিষয়। সাধারনত, সবাই সহানুভুতিকে, বন্ধুত্বকে, সমর্থন কে স্বাগত জানায়, কিন্তু আমরা জানি যে, জীবনের চুড়ান্ত বিশ্লেষনে, সবাই- এমনকি একজন পিতা/মাতা, একজন সন্তান, অথবা একজন ভাই অথবা একজন বোন, প্রত্যেকেই একা, প্রত্যেকটি দেশই একা, এবং ভারতকে তার নিজের পায়ে দাঁড়ানো শিখতে হবে; সে তার নিজের পায়ে দাড়াবে এবং নিজস্ব সমস্যার সঙ্গে নিজেই মোকাবেলা করবে।

নিচে প্রদত্ত শ্রোতাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত কিছু প্রশ্ন এবং প্রধানমন্ত্রীর জবাব

প্রশ্নঃ আপনি পূর্ব পাকিস্তানের মানবতা নিয়ে বলেছেন। আপনি কীভাবে ফারাক্কা বাধ নির্মান সম্পর্কে ব্যাখ্যা করবেন, যা অবশ্যই সেখানে কৃষি ও অর্থনীতি ধ্বংস করতে যাচ্ছে?
প্রধানমন্ত্রীঃ আমি জানি না, মেয়েটি ঐ জায়াগাটার ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে জানেন কিনা? পুর্ব বাংলার দূর্ভোগ পানি স্বল্পতা নয়, বরং অতিরিক্ত পানি… ( করতালি)। এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। দূর্ভাগ্যবশতঃ পাকিস্তান এখন এটিকে রাজনৈতিক প্রশ্নে তৈরী করার চেষ্টা করছে, যদিও এটা তা না। এটা কোন ভাবেই পূর্ব পাকিস্তান বা পুর্ব বাংলাকে ক্ষতি করার কোন পন্থা নয়।

প্রশ্নঃ মিসেস গান্ধী, আমি আপনাকে বলতে চাই, আমি আন্তর্জাতিক মহিলা কাউন্সিলের মাইগ্রেশন কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। আপনার দেশের উদ্বাস্তুদের নিয়ে এই বিশাল সমস্যা নিয়ে আমস্টারডামে আমাদের মিটিং এ আমরা একটি সমাধানে এসেছি, যা ছিলো ৬০ সদস্যের কাউন্সিলকে আহবান করা যাতে তারা আরো বেশি সমস্যাটি নিয়ে আরো মনোযোগী হয় এবং জাতিসংঘকে বিশ্বের সংখালঘুদের প্রতি দেখাশোনার জন্য আহবান জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রীঃ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

প্রশ্নঃ ম্যাডাম, ইতিমধ্যে আপনার বক্তব্যে বলেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ জাতীয়তাবোধে অনুপ্রানিত। আপনার কি মনে হয় না, পশ্চিম বঙ্গের মানুষদের মধ্যে এই জাতীয়তা বোধের এই উদ্দীপনা অনুপস্থিত? কারণ বাঙ্গালীরা একটি জাতি, সেহেতু, তাদের একটি রাষ্ট্র থাকা উচিত? আপনি পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের কে একটি রাষ্ট্র গঠন থেকে কীভাবে প্রতিরোধ করবেন, তারাও তো ঠিক একই রকম বাঙালী?

প্রধানমন্ত্রীঃ এটা খুব ভাল একটা প্রশ্ন; এটা জিজ্ঞাসা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমার আসলে এটা আমার বক্তৃতায় উপস্থাপন করা উচিত ছিল। আচ্ছা, প্রথম উত্তর হল, পশ্চিমবঙ্গকে বাকি ভারত থেকে আলাদা করার কোন অভিপ্রায় নেই। দ্বিতীয়ত, প্রশ্ন শুধু এটা না যে পশ্চিম বঙ্গ কি করতে চায়, বরং পুর্ব বাংলায় বসবাসকারী লোকেরা পশ্চিম বঙ্গ তাদের সাথে যোগ দিক এটা চায় কিনা। অবশ্যই এই পৃথিবীতে কোন কিছুই অসম্ভব না এবং এটা একটা সুদুর সম্ভাবনা। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে এরকম কিছু ঘটবে, কারন শিল্পের দিক দিয়ে হোক, শিক্ষার দিক দিয়ে হোক অথবা অন্য যে কোন দিক দিয়ে হোক, পশ্চিমবঙ্গ পুর্ববাংলা থেকে অনেক উন্নত। আমরা আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে ভিয়েতনামে কি হয়েছিল, তারা তাদের চেয়ে একটি বড় সত্ত্বাকে সংযুক্ত করতে চাইবেনা যে তাদের উপর কর্তৃত্ব করবে।

প্রশ্নঃ আপনি শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফা কর্মসুচি সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয় আপনার শ্রোতাদের জানান উচিত যে, ৬ দফায় দেশ বিভাগের কথা উল্লেখ নেই। আর এটা স্ট্রাউসের চ্যান্সেলর নির্বাচনে জয়ী হবার এবং সে জার্মানি থেকে বাভারিয়াকে আলাদ করতে চাইবার মত বিষয় হবে। আমার মনে হয় না জার্মানীর জনগণ সেটা মানবে।
প্রধান মন্ত্রীঃ আমার মনে হয় আমি এইটা পরিষ্কারভাবে বলেছি যে, ৬-দফা নির্বাচনের আগে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেগুলো মানাও হয়েছিল, সম্ভবত, কারন তা না হলে কেনো নির্বাচন হলো? এটা ছিল পুর্ব বাংলার জনগনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রাথমিক কর্মসূচি এবং এবং এটা শুধু পুর্ব বাংলার জনগণের জন্য নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানে যেসকল লোক শেখ মুজিবুর রাহমানকে ভোট দিয়েছে তাদের জন্যও।

প্রশ্নঃ ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি ও ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতার অবসান সংক্রান্ত ব্যাপারে কিছু বলুন।
প্রধান মন্ত্রীঃ এই ব্যাপারটার সাথে আমাদের ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির কোন সম্পর্ক নেই। আমরা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতার অবসানকে স্বাগত জানাই এবং আমরা আশা করব যে, যেখানেই এরকম দ্বন্দ আছে সেই সব রাষ্ট্রের মধ্যে সকল বৈরিতার অবসান ঘটবে। যতদূর ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তির প্রশ্ন আসে, এটা তাই যা এতে বলা আছে, এর নামেই বলা আছে, “শান্তি, বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতার চুক্তি”।

বহু লোক যারা কখনই জোট নিরপেক্ষতাকে সমর্থন করেনি, তারা এখন বলার চেষ্টা করছে যে, এই চুক্তি জোট নিরপেক্ষতার বিপক্ষে যাচ্ছে, ভারত এখন আর জোট নিরপেক্ষ নয় এবং আরো অনেক কিছু। স্বাভাবিকভাবেই আমরা এইসব যুক্তিতে একেবারেই প্রভাবিত নই কারন আমরা জানি যে আমাদের নীতি কি এবং সেটা অপরিবর্তিত রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর।

প্রশ্নঃ মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, শ্রীমতী গান্ধী, আমার প্রশ্ন প্রায় আগের প্রশ্নের মতই, আমি শুধু একটি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই। এটা সত্য যে আমাদের সভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তির উদ্দেশ্য আমাদের জোট নিরপেক্ষতার নীতিকে প্রভাবিত করা নয়; কিন্তু আমার মনে হয় যে বিশ্বে আমাদের অংশে রাশিয়ার প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি যত দূর জানি, সোভিয়েত নৌবাহিনীর অন্তত কিছু অংশ, আমাদের কিছু বন্দরের দিকে অগ্রসর হয়েছে। এবং দীর্ঘ সময়ে রাশিয়ার ক্ষমতা এবং শক্তি এত বড় যে, আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের দীর্ঘকালের সম্পর্কের সময়কালে ভারত কি সত্যিই অক্ষুন্ন এবং জোট নিরপেক্ষ থাকতে পারবে?
প্রধানমন্ত্রীঃ এটা নিঃসন্দেহে একটি অসাধারন প্রশ্ন, যদি আমি তাই বলি। সম্ভবত তিনি বেশ কিছুদিন ভারতের বাইরে ছিলেন এবং তিনি জানেন না যে আমরা কি অনুভব করি। সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি ভারত মহাসাগরে থাকে তো তাতে কি হয়েছে, অন্যান্য নৌ বাহিনীরাও তো আছে। তিনি তো আর অন্য কোন নৌ বাহিনীর আমাদেরকে প্রভাবিত করার কথা বলেননি। তাহলে সোভিয়েত কেনো অন্যদের থেকে বেশি প্রভাব ফেলবে? পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশ, সেটা ছোট হোক আর বড় তা অন্য দেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা সেই চাপ প্রতিরোধ করতে পারব কিনা? আমরা সবসময়ই সেটা করেছি। আমরা আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়েছি। আমরা এটার জন্য ভিক্ষা চাইনি। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে এটার জন্য লড়াই করেছি (দীর্ঘ হাততালি)।
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!