শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৬৩। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির বক্তৃতা | ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় | ৬ নভেম্বর, ১৯৭১ |
“যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা”
ভাষণ থেকে নেওয়া উদ্ধৃতাংশ নিচে দেওয়া হলোঃ
আমি যদি মাত্র কয়েক মাস আগে আসতাম এবং আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করতেন, সমস্যাগুলো কি, আমি হয়তো বলতাম “এখন কোন সমস্যা নাই”। আমরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা আমাদের উদ্দেশ্যে দৃঢ়। এবং একটার পর একটা সমস্যা সমাধান করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি”। কিন্তু আমাদের নতুন সংসদ পূর্ন করে যখন আমাদের বিজয় উপলক্ষ্যে আমরা সব গণতান্ত্রিক সমাজকে পরস্পর অভিনন্দন জানাচ্ছি তার ঠিক একসপ্তাহ পরেই নতুন এক ভয়ঙ্কর বোঝা আমাদের উপর এসে পড়লো। আপনারা সবাই এসম্পর্কে অবগত। তাই আমি এটা নিয়ে কিছু বলতে চাইনা। কিন্তু আমি কিছু প্রশ্ন তুলে ধরতে চাই এবং যেগুলো আমরা খুব মৌলিক প্রশ্ন বলে মনে করি। আমাদের বাহিনী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বাহিনী সীমান্তে পরস্পরের মুখোমুখি হওয়ার কারণে আজ আমাদের বলা হয় যে সেখানে যুদ্ধের হুমকি আছে। এবং এটা সত্য। কিন্তু দুই বাহিনীর মুখোমুখি হওয়া প্রকৃত সমস্যা নয়। পূর্ববাংলায় যা ঘটেছে সেটাই হলো আসল সমস্যা। আজ যদি পূর্ববঙ্গে শান্তি থাকতো, তাহলে পশ্চিম বা পূর্বে আমাদের সৈন্যরা মুখোমুখি হলেও কোন ব্যাপার ছিল না। সেখানে কোন যুদ্ধ হবে না। কিন্তু এটা সেখানে খুব গুরুতর একটা সমস্যা। এবং এটা কিভাবে শুরু হলো? সেখানে ঘটা কোন বিদ্রোহ বা পাকিস্তানের এক অংশের পৃথক, বিচ্ছিন্ন বা স্বাধীন হতে চাওয়ার কারণে এই সমস্যার উত্থান ঘটেনি। সেখানে এমন কিছু বলা হয়নি। সেখানে পাকিস্তানের বর্তমান সামরিক নেতৃত্বে একটি উন্মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রকাশ্যে জনগনের সামনে নিরপেক্ষ নির্বাচন কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। যদি পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের এই কর্মসূচীর নিয়ে আপত্তি থাকতো, সেই মুহূর্তে বলতে পারতো, “আমরা এই নির্বাচন মানবো না, আমরা আপনার ছয়দফা মেনে নিতে পারবো না, আমরা তাদের অনুমোদন দেবো না”। কিন্তু এরকম কিছুই বলা হয়নি। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং পাকিস্তানের উভয় অংশের মানুষ একদলীয় আওয়ামী লীগের পক্ষে সিংহভাগ ভোট দিয়েছিল।
আমি আমার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠে অভিনন্দিত হয়েছি। কিন্তু এটা পাকিস্তানের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল তার তুলনায় কিছুই না। এটা তার জন্য একটি অসাধারণ বিজয় ছিল। এবং সে কোন চরমপন্থী নয়। তিনি একজন মধ্যমপন্থী ব্যক্তি। বস্তুত, আমি যদি শব্দটা বলতে পারতাম, কিছু মানুষ তাকে এক সময় আমেরিকার দালাল বলতো। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর, দৃশ্যত এটা পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের জন্য বিস্ময়কর হয়ে ওঠে। এবং তারা এই ফলাফল এড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন।
আলোচনা শুরু হয়েছে। আমরা শেখ মুজিব বা পূর্ব বাংলায় তার দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না। আমরা জানতাম না সেখানে কি ঘটছে। আমরা পত্রিকায় পড়েছি যে সেখানে আলোচনা হয়েছে। পরবর্তীতে অনেক পরে, আমার এখানে আসার মাত্র এক সপ্তাহ আগে এমন একজনের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় যিনি আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। এবং ২৪শে মার্চ তারা ভেবেছিল যে তারা (পশ্চিম পাকিস্তানিরা) হয়তো মীমাংসা করতে আসছে, তবে কোন সন্তোষজনক মীমাংসা নয় কিন্তু এখনো সেটা করা যায়। কিন্তু এবার পশ্চিম পাকিস্তান সৈন্য নিয়ে এসেছিল, এবং ২৫শে মার্চ রাতে সন্ত্রাসের রাজত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়। আপনারা সম্ভবত শুনেছেন যে, তাদের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সবচেয়ে বড় হামলা চালিয়েছিল, যেখানে সে রাতেই বিভিন্ন অনুষদের বহু ছাত্রদের হত্যা করা হয়। সমগ্র পূর্ব বাংলার বেসামরিক, আধা-সামরিক বাহিনী, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পূর্ব পাকিস্তানের রাইফেলস তাদের বশ্যতা পরিবর্তন করে, অর্থাৎ তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটাই আজকের পূর্ব বাংলার মানুষের লড়াইয়ের ভিত্তি। জনগণই সীমান্ত পার হয়ে আসা তরুণদের গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
এখন, আমাদের প্রশ্ন করা হয়েছে যে কেন ভারত জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে দ্বিধান্বিত! প্রকৃতপক্ষে, আমরা দ্বিধান্বিত নই, কারণ আমরা কিছু পর্যবেক্ষক ইতোমধ্যে ঢুকতে দিয়েছি। অনেক বছর ধরে পশ্চিম সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক আছে এবং আমরা পূর্ব সীমান্তে শরণার্থীদের ত্রাণ দেয়ার জন্য জাতিসংঘের হাই কমিশন থেকে প্রায় দশজন লোক আছে। আমাদের সমাজ অনেক উন্মুক্ত, যে কেউ আসতে চায়, আপনাদের যে কেউ – কূটনীতিকরা যারা সেখানে আছে, সাংবাদিক, ইউরোপের, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া, নিউজিল্যান্ড, আরব দেশ, স্ক্যানডিনেভীয়ার দেশগুলিতে থেকে যাওয়া সংসদীয় প্রতিনিধিদল – এনারা সবাই আমাদের সেনা-শিবিরে ছিলেন; সীমান্তেও ছিলেন এবং তাদের অনেকেই সীমান্ত পার হয়ে পুর্ব বাংলায় গেছিলেন। ব্যতিক্রম ছাড়াই, প্রত্যেকেই সেখানে ভয়ঙ্কর দুর্দশা এবং অতিমাত্রায় বিশৃঙ্খলা কথা বলেছেন। এখন এই মুহূর্তে আমাদের বলা হয়েছে কিছু আসন খালি দেখিয়ে একটা বেসামরিক সরকার গঠনের প্রচেষ্টা চলছে, যদিও আসনগুলো খালি নেই। যারা বৈধভাবে নির্বাচিত হয়েছে তারা সেখানে আছে তবুও তাদের আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে এবং আমাকে বলা হয় যে ৫৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এখন বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরো সংসদই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারে কারণ নিশ্চিতভাবেই এখন কারো পক্ষে ভোট দেওয়া সম্ভব নয়।
যদি জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক যায়, তাহলে তারা কি ইচ্ছা পোষণ করে? তারা যদি সত্যিই পূর্ব বাংলায় শান্তি আনার উদ্দেশ্যে যায়, আমাদের পক্ষ থেকে তাদের স্বাগতম; তারা যেদিকেই যেতে চান, আমরা তাদের সেখানে যেতে সাহায্য করবো। কিন্তু তারা এটা করতে চান না। তারা বলতে চায়, “পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে সেটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা – আমরা শুধু দেখতে চাই সীমান্তে কি ঘটছে”। সীমান্তে যা ঘটছে সেটাকে পূর্ব বাংলার ভিতরে যা ঘটছে তার থেকে আলাদা করা যাবেনা। আপনি বলতে পারেন না, “আমরা যাব এবং চেষ্টা করবো গেরিলা প্রতিরোধে, কিন্তু সেনাবাহিনীর কতৃক সাধারণ মানুষকে হত্যা প্রতিরোধ করতে পারবো না”। এমনকি সেখানে কিছু নারীর উপর যে অত্যাচার হচ্ছে তা আমি উল্লেখ করতে পারছি না। জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকরা ঐসব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে যাবেন না, কিন্তু তারা মুক্তিযোদ্ধারা কি করছে তার উপর হস্তক্ষেপ করতে চান।
আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন, “ভারত কি সমর্থন দিয়ে এব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে? ” আমি আপনাদের বলছি, আমরা যেটুকু করেছি তাতে পূর্ব বাংলার মানুষেরা ততটা খুশি নয়। তারা মনে করে, আমরা এপর্যন্ত খুব সামান্যই করেছি এবং আমি তাদের সাথে একমত। এবং আমরা এমন কিছু করছি যেটা আমরা তাদের করতে দিতে পারিনা। মানুষের সীমান্তের অন্যপাশ থেকে আমাদের পাশে আসা অথবা আমাদের এপাশ থেকে পূর্ব বাংলায় ফিরে যাওয়া আমরা বন্ধ করতে পারিনা। আমরা যদি এমনটা করতে সক্ষম হতাম, তাহলে আমরা অবশ্যই এই লক্ষ লক্ষ শরনার্থী আসা ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতাম। প্রথমদিকে প্রতিক্রিয়া ছিল, “তারা ব্যাপক কষ্টে আছে, আমরা তাদের প্রবেশের অনুমতি দেই”। কিন্তু খুব শীঘ্রই আমাদের জন্য এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো এবং এটি এখন অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতি তৈরি করছে।
আমেরিকার মানুষ উদারতা দেখিয়েছে। এখানে আসায় আমাকে একটি চেক দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দেশের দরিদ্র মানুষেরা শিশুদের দিয়ে আমাকে চেক দিয়েছে, সব ধরনের মানুষ, এবং আমরা তাদের সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞ। কিন্তু প্রধান সমস্যা আর্থিক নয়। আমরা গরীব, এই লক্ষ লক্ষ মানুষের ভরণপোষণের সামর্থ্য আমাদের নাই। কিন্তু দরিদ্র হওয়ার কারণে আমরা জানি কিভাবে খাদ্য ও প্রয়োজন ছাড়া বাঁচতে হয়, আমাদের যেকোনো অসুবিধা দেখা দিতে পারে। আমরা যেকোন সংখ্যক মানুষ দেখাশোনা করতে পারবো, অবশ্যই তাদের ও আমাদের অত্যন্ত অসুবিধা হবে, হয়তো কিছু লোক মারাও যাবে। যাইহোক, আমরা এই সমস্যা থেকে বাঁচতে পারবো। কঠিন ব্যাপার হলো রাজনৈতিক পরিণতি, সামাজিক টানাপোড়েন, প্রশাসনিক সমস্যা থেকে বেঁচে যাওয়া এবং সর্বশেষ কিন্তু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের পরাধীনতা, স্থিতিশীলতা ও ঐক্যতার প্রতি হুমকি। কারণ উদ্বাস্তুদের সঙ্গে যারা আসছে তারা প্রকৃত উদ্বাস্তু নয়। আমরা নাশকতার শিকার হচ্ছি। আমাদের ট্রেন উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, এবং অন্যান্য সব ধরণের অঘটন ঘটেছে।
সুতরাং, ভারত আজ বাস্তব হুমকির সম্মুখীন। আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার একটা জায়গাতে পৌঁছে গেছিলাম, এটা মোটেই সোজা ব্যাপার ছিলনা; অনেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে আমরা সেটা অর্জন করেছিলাম। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশের সাহায্য পেয়েছিলাম, কিন্তু এটা বৃহৎ সাফল্যের অনেক ক্ষুদ্র একটা অংশ। সবথেকে বড় ধকল হলো, এটা উদ্বাস্তুদের সমস্যা হোক বা আমাদের নিজেদের সমস্যা হোক, ভুগছে ভারতের জনগণ। এক্ষেত্রে অবস্থার যদি কোন উন্নতি হয়, সেটার কারণ অবশ্যই সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ভারতের মানুষের প্রচেষ্টা এবং আত্মত্যাগ।
সুতরাং, একটা পর্যায়ে এসে যখন আমরা ভাবছি যে এবার আমরা সহজেই অনেক দ্রুত সামনে এগিয়ে যেতে পারবো, তখনই আমরা হঠাত অন্য দেশের সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছি। তারা আমাদের সমস্যা না। এই অন্য দেশটি তাদের সেসব মানুষকে সীমান্ত পার হতে বাধ্য করছে যারা তাদের সরকারকে ভোট দেয়নি, বরঞ্চ তারা তাদের কাঙ্খিত শাসককে ভোট দিয়েছে। এই মানুষগুলোর অন্য কোন অপরাধ নেই, কারণ স্বাধীনতার ডাক উঠেছে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার পর, তার আগে নয়। তিনি নিজে, আমি যতদূর জানি, স্বাধীনতার জন্য ডাক দেননি, এমনকি এখনও না। কিন্তু তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর, সেখানে নারকীয় গণহত্যা হয়, এটা বোধগম্য যে এরপর বাকি মানুষরা বলবেঃ “এরপর কিভাবে আমরা একসঙ্গে বাস করবো? আমাদের পৃথক হতে হবে।
এই হলো অবস্থা। আমাদের পাকিস্তানের প্রতি কোন বিদ্বেষ নাই যদিও তারা নিয়মিত “ভারত ধ্বংস কর”, “ভারত জয় কর” প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা একদিন দেখেছে, একসপ্তাহ দেখেছে এরপর তারা তাদের গাড়িতে হামলা করেছে। আমরা কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি, এবং পড়বো না। আমরা এমনকি চীনাদের বিরুদ্ধেও ছিলাম না। চীন আমাদের আক্রমণ করেছিল, পাকিস্তান আমাদের আক্রমণ করেছিল। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সবসময়ই বন্ধুত্ব চেয়েছি। আমাদের দিক থেকে, আমরা সবসময় একতরফা পদক্ষেপ নিয়েছি যাতে আমরা সম্পর্কের একটি সহনীয় পর্যায়ে যেতে পারি। কিন্তু ওদিক থেকে কোন সাড়া পাচ্ছিনা।
কোন প্রতিক্রিয়া না পেলেও, আমরা কিছু মনে করবো না। কিন্তু তারা যখন তাদের সমস্যা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছে, আমরা মনে করি তখনই এটা আমাদের সহ্যের শেষ সীমায় পৌছে গেছে। তারা এখানে একটা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল, তাদের মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। তো আপনি কি করবেন? তাদের সীমান্ত দিয়ে বের করে দিবেন। এক খোঁচায়, আপনি আপনার শত্রুদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতেন, আপনি জনসংখ্যা থেকে পরিত্রাণ পেতেন, এবং আপনি ভারতকে দুর্বল করতে পারতেন, যা আপনি দুর্বল করতে চান। এসব ব্যাপার ভারত কখনোই সহ্য করতে পারে না। হতে পারে, আমি সহ্য করতে পারবো। কিন্তু আমি সংসদে আমার সব সংখ্যাগরিষ্ঠদের পক্ষে, এটা কোন একনায়কতন্ত্র নয়। আমাকে শুধু আমার দল নিয়ে থাকলে চলবেনা, গুরুতর পরিস্থিতিতে আমাকে ভারতের অন্য সব দলকেও সাথে নিতে হবে। এবং আমরা মনে করি যে, এটা শুধু ভারতের জন্য নয়, কারণ আমরা বিশ্বাস করি, যদি ভারতের শান্তি হুমকির সম্মুখীন হয়, যদি ভারতের স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন হয়, পাকিস্তানের আমার অংশে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা আসবে না। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য যেকোন দেশ হোক, সারা বিশ্বের সৈন্যবাহিনী তাদের সাথে আছে। কিন্তু উপমহাদেশের প্রধান অংশে অস্থিরতা পুষে রেখে তারা সেখানে শান্তি আনতে পারবে না।
আজ কিছু দেশ একজন ব্যক্তির সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে সমগ্র উপমহাদেশের শান্তিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করিনা, যে তারা এমন কোন ব্যক্তিকে সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানকে রক্ষা করা, অখণ্ড রাখা বা এটাকে শক্তিশালী করতে পারবেনা, যিনি নির্বাচিত ব্যক্তি নয় এমন একজন সামরিক স্বৈরশাসক। আজ আমরা যে সমস্যা নিয়ে ভাবছি এটা আসলে আজকের সমস্যা নয়, কিন্তু আমরা মৌলিক মূল্যবোধের জন্য লড়ছি, যার জন্য অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। আমাদের মূল্যবোধকেই আঘাত করা হয়েছে।
এবং তারা যদি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে আক্রমণ করতে পারে, তাহলে তারা (বাঙালিরা) যে আমাদের দেশে টিকে থাকতে পারবে বা এখানে এসে যে তাদের উপর আক্রমণ করা হবেনা তার নিশ্চয়তা কি! এটাই আমাদের বিব্রত করছে। কে দোষী এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যদিও আমি মনে করি এখানে পাকিস্তান দায়ী, কিন্তু আমি কোন তর্কে যেতে চাইনা। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কিভাবে আমরা শান্তিতে থাকতে পারি? শুধু সৈন্য সরানো উচিত এটা বললেই শান্তি আসবে না। শুধুমাত্র মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান করেই শান্তি স্থাপন করা সম্ভব। এবং মৌলিক সমস্যা পশ্চিমে নয় যেখানে সৈন্যরা পরম্পর মুখোমুখি হচ্ছে, বরং সমস্যা পূর্বে।
যেহেতু আমি সৈন্যদের কথা উল্লেখ করেছি, আমি আরো একটি কথা বলতে চাই, এবং সেটা হলো আমরা কিছু করার এক সপ্তাহ বা দশ দিন আগেই পাকিস্তান সৈন্য ওখানে সরিয়ে নেয়। আর ওখানে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক যারা ছিল, এই প্রশ্ন তারা তাদের কাছে করেছিল। তারা বলেছিল, “এটা তেমন গুরুত্বর কিছুই না, এটা শুধুমাত্র একটা সাধারণ প্রশিক্ষণ অনুশীলন”। প্রকৃতপক্ষে এটা খুব অদ্ভুত যে, আপনারা যখন অনুশীলন করছেন তখন আপনি একদিনের জন্য নয়, দুই দিনের জন্য নয়, বরং দশ দিনেরও বেশি আপনার সৈন্যদের দায়িত্ব বহাল রেখেছেন। এবং দশ দিন হয়ে গেলেও জাতিসংঘ বা অন্য কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এরপর আমরা বললাম, “এইসব লোক আমাদের আক্রমণ করতে পারে এবং নিজেদের রক্ষার জন্য আমাদেরও সৈন্য সরাতে হবে”। ইতোমধ্যে দুইবার এবং চীনাদের হিসাব আনলে তিনবার আমাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে, এবং কোনবারই আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। জনগন যদি ভাবে যে কোন সরকার দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করতে অক্ষম, তাহলে সেই সরকার কখনো স্থায়ী হয়না।
আমরা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেছি এই ভেবে যে কিছু একটা হবে, হয়তো ভালো কিছুই হবে। কিন্তু কারো কোন মাথাব্যথা নাই। আমাদের সিমান্তে এসব সৈন্যরা আমাদের মুখোমুখি হয়েছিল তখন কেউ একটা শব্দও করেনি। তখনই করেছিল যখন আমাদের সৈন্যরা এগিয়ে গেল, তখন সারা বিশ্বের হঠাত চিন্তার উদয় হলো, “ওহ, দুই সৈন্য গ্রুপ পরস্পর মুখোমুখি হচ্ছে”।
এটা সত্য যে, যুদ্ধ একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আমি গত যুদ্ধে বিমান আক্রমণের সবথেকে খারাপ সময়টাতে লন্ডনে বাস করেছি। এবং আমি জানি সেই যুদ্ধ এখন আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। আমি জানি বেসামরিক নাগরিকের উপর কি ঘটছে সেখানে। কেউ কখনো তার জনগণের জন্য যুদ্ধ চায়না। এবং ভারত কখনোই দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধকে উস্কে দেয়ার মত কিছু করবেনা। কিন্তু ভারত তার স্বার্থ রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। ভারত তার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ভারত এখন আগের থেকে অনেক ঐক্যবদ্ধ, এবং হোক স্বাধীনতা বা হোক গণতন্ত্র, ভারত এখন এইসব মৌলিক বিষয় সম্পর্কে অনেক আগ্রহী। এটা আমাদের সাথে টিকে থাকা জীবনের সংস্কৃতি। আমরা কোন একটি মতবাদ বা ‘ধর্ম’ অনুসরণ করিনা। এটা আমাদের জীবনের সংস্কৃতি যেটা আমাদের জাতিকে ত্রিশ শতাব্দী বাচিয়ে রেখেছে। কারোর মতের সাথে এটা যাক বা না যাক, এটাকে আমরা ধ্বংস হতে দিচ্ছিনা। আমরা সাহায্য চাই, আমরা সমর্থন চাই, আমরা সমবেদনাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু বস্তুত, বিশ্বের প্রতিটা ব্যক্তিই শেষ পর্যন্ত একা এবং প্রত্যেক জাতিই চরমভাবে একা। এবং যুদ্ধের প্রয়োজন মনে হলে ভারত একাই লড়াই করার জন্য প্রস্তুত…