শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৬২। ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তর | ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় | ৫ নভেম্বর ১৯৭১ |
ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা
৫ নভেম্বর, ১৯৭১
আমি এখানে আবার আসতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত। আপনাদের অনেকের সাথে আমার আগে পরিচয় হয়েছে ভারতে বা বাইরে। আপনারা আমার কিছু বর্ণনা দিচ্ছিলেন। কিন্তু সম্ভবত যারা রাজনীতি করেন তাদের জীবনের দুটি দিন কখনো একরকম হয়না। অনেক সময় অনেক দরকারি অথবা বাধ্যবাধকতাও মেনে চলতে হয়। অনেক কিছু ইচ্ছার বিরুদ্ধেও করে যেতে হয়।
যখন আমি মানুষের সাথে থাকি সেটাই আমার আনন্দ। বিশেষ করে যখন আমি বিশেষ কোন মানুষদের সাথে থাকি যেমন আজকের এই হলরুমের আপনারা।
আমাদের সময় সীমিত, তাই আমি দীর্ঘ বক্তৃতা করতে যাচ্ছি না। আমি শুধু কয়েকটি পয়েন্ট বলব যা আপনাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর পাইয়ে দিতে সহায়ক হবে। অবশ্যই, কোন বিশেষ বিষয়ে আগ্রহী হলে প্রশ্ন করবেন।
আমি এখানে পাঁচ বছর আগে এসেছিলাম এবং আমি আপনাদের বলেছিলাম ভারতে কি কি কাজ করার চেষ্টা করছি। সে সময় শুধু ভারতেই, বিশ্বের সব অংশে অনেক কিছু ঘটছিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই, এখন আমি আমার নিজের দেশে নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।
১৯৬৬ সালে আমার দেশ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। সেটা করেছিল বিশ্বের প্রেস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রেস – আমাদের ঐক্য, গণতন্ত্র এবং এমনকি আমাদের বেঁচে থাকার ক্ষমতা সম্পর্কে। সেসব পেরিয়ে এখানে আমি আবার এসেছি। তবে আমরা অনেক অন্ধকার এবং অসুবিধা পার করেছি যা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী মানুষের জন্যও কষ্টকর। আমরা এখন গম, ধান ও অন্যান্য শস্যতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, যা আমাদের জনগণের প্রধানতম খাদ্য। সেচ সুবিধা ও সারের প্রতুলতায় অন্যান্য পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির কিছু প্রভাব ছিল। গত মার্চ মাস পর্যন্ত আমাদের জনসংখ্যা চৌদ্দ মিলিয়ন।
আমাদের রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা পরিবর্তন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি আমাদের জাতীয় জীবনে বৃহত্তর সঙ্গতি ও দিকনির্দেশনা দিয়েছে। আমাদের জনগণের আত্মবিশ্বাস আমাদের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ষাট শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। শুধু শহরে নয়; প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও পাহাড়ি এলাকাতেও। জনগণ আমাকে এবং আমার দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের বিশেষ দিক ছিল মানুষের উদ্যম; বিশেষ করে তরুণদের ভেতরে – যার জন্য তারা নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে নির্বাচন প্রচারণা চালিয়েছিল।
নির্বাচন আমাদের মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছে এবং আমাদের নতুন শক্তিতে বলিয়ান করেছে এবং জীবন বোধ তৈরি করেছে। কিন্তু আজ আমাদের চিন্তাধারা বাংলাদেশ সঙ্কট নিয়ে বিষণ্ণ। সেখানেও নির্বাচন হয়েছিল। এমনকি সামরিক সরকারের অধীনে পূর্ববাংলার জনগণ মহা উচ্ছ্বাসে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য। ভোটে তারা তাদের রায় ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিল। সামরিক সরকার আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করছিল। মূলত সেই সময়ে তারা প্রচুর সৈন্য নিয়ে আসছিল। এর পর যখনি আওয়ামীলীগ একটি পরিণতির দিকে যাচ্ছিল তখনি নেমে আসল ন্যাকারজনক সন্ত্রাস – ইতিহাসে যার তুলনা বিরল।
আমি মাঝে মাঝে আত্মরক্ষার্থে প্রেসের সমালোচনা করতে দ্বিধা করিনি। কিন্তু আজ এই অনুষ্ঠানে আমি বিশ্বের অনেক দেশের প্রেস সংবাদদাতাদের ধন্যবাদ দেই বিশ্বের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করার জন্য। তারা পূর্ববাংলার ভয়ানক বিয়োগান্ত ঘটনাগুলো প্রকাশ করার মত সাহস ও অধ্যবসায় দেখিয়েছেন। তাদের রিপোর্ট ছিল সৎ এবং স্পষ্ট। কিন্তু ফোটোগ্রাফ দিয়ে তারা সেসব দুঃখ, দুর্দশা পৌঁছে দিতে পারেননি।
সেখানে যা হচ্ছে সেটি কোন গৃহযুদ্ধ নয়। এটা গণতান্ত্রিকভাবে ভোট দেবার অপরাধে বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যা। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার খুব ন্যাকারজনক পদ্ধতি এটি। এবং ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের অসহায় মানুষকে অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করে প্রতিবেশী দেশকে বিব্রত করার কৌশল। শরণার্থীদের সংখ্যা ইউরোপের কিছু দেশের জনসংখ্যার চেয়ে বেশী – যেমন অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম – যেখানে কিছুদিন আগে আমি গিয়েছিলেম।
আমরা মনে করি এটি একটি নতুন ধরণের আগ্রাসন। এটা অবশ্যই আমাদের উপর একটি বড় অর্থনৈতিক বোঝা। এর ফলে আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। এটা একটি দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সমস্যা হচ্ছে তাতে অন্য দেশও ভুক্তভোগী হবে – আর তা হল ভারত। এটি কোন আন্তর্জাতিক বিরোধ না। একটি ইন্দো-পাকিস্তান বিরোধও নয়।
আমাদের বলা হয়েছে যে সৈন্য মুকাবিলা শান্তির জন্য হুমকি। সমগ্র জনগণের হত্যা করা হলে সেটা কি শান্তির জন্য হুমকি নয়? বিশ্ব কখন উদ্বিগ্ন হবে? দুই দেশের সমস্ত মানুষ যদি যুদ্ধের কারণে মৃত্যুবরণ করে, হাজার হাজার শত শত জবাই করা হয় ও জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক শাসন যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদের দেশ থেকে বহিস্কৃত করে তখনো কি তারা উদ্বিগ্ন হবেনা?
আমরা আগ্রাসনের এই অবাক করা অবস্থা মোকাবেলা করতে পারছিনা। আমাদের নতুন ভাবে জবাব দিতে হবে। তাই আমরা বিশ্ব নেতাদের সংকটের প্রকৃতি এবং মীমাংসা সম্পর্কে ধারনা দিতে ও নিতে এসেছি। আমি বেশ কয়েক মাস আগে সরকার প্রধানদের কাছে চিঠি লিখেছি এবং তাদের সাথে দেখা করতে আমার সহকর্মীরা প্রস্তুত আছে। আমরা তাদের অবহিত করি যে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিবুর রহমান ও তার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা না করে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নানারকম তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব নেতারা এটা বুঝতে পারলে এই দুর্বিপাক এবং অনেক লক্ষ লক্ষ লোকের মাইগ্রেশন এড়ানো যেত। দিন চলে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও সময় আছে বিশ্বনেতার পরিস্থিতির বাস্তবতা উপলব্ধি করার।
আমি বিভিন্ন সফরে অনেক রাজধানী পরিদর্শন করেছি। আমি জানতে চেয়েছি সমাধান কি হওয়া উচিৎ। জানতে চেয়েছি কীভাবে পূর্ব বাংলার জনগণ একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধান পেতে পারে?
আমি বিশ্বের নেতাদের বলেছি পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থ বিরোধী কোন মতামত যেন তারা না দেন। একটি জাতির ভাগ্য তাদের অজান্তেই অন্যদের দ্বারা নির্ধারন করা ঠিক নয়। এশিয়ার জনগণের চাহিদা অনুযায়ী তাদের নিজস্ব পছন্দ অনুসারে টেকসই গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা উচিৎ। গণতন্ত্র যদি আপনাদের জন্য ভালো হয় তাহলে ভারতের জন্যও ভালো। এবং এটা পূর্ববাংলার জনগণের জন্যও ভালো হবে।
গণতন্ত্র অবদমনের চেষ্টাই পাকিস্তানে সব ঝামেলার মূল কারণ। বিশ্বের দেশগুলির চিন্তা করা করা উচিত তারা কি চান? এক ব্যক্তি ও তার মেশিন এর পক্ষে কাজ করা নাকি একটি পুরো জাতির স্বার্থ – কোনটি তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে ভারত কি উদ্যোগ নেবে। আমি মনে করি সবচেয়ে বড় কাজ হল ধইর্য ধরে থাকা। আমরা দেখতে চাই না যে এটি একটি ইন্দো- পাকিস্তান ইস্যু হয়ে যায়। দুই দেশের মধ্যে কোন সরাসরি আলোচনা এই পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করবে। সমাধান আরো কঠিন হবে। পাকিস্তান এমন একটি পরিস্থিতি বানানোর চেষ্টা করছে যাতে তারা বলতে পারে যে তাঁরা প্রতিবেশী দেশ দ্বারা আক্রান্ত। আমি বলেছি, হুমকি পাকিস্তান থেকে এসেছে- আমাদের দিক থেকে নয়। যখন তারা দেখছে তাদের প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হচ্ছেনা তখন তারা আমাদের পশ্চিম প্রান্তে সৈন্য জড়ো করতে থাকে।
পাকিস্তান জাতিসংঘ থেকে পর্যবেক্ষক ভারতে পাঠাবার প্রস্তাব করেছে। প্রাথমিক ভাবে তাকালে এটিকে ভালো একটি কাজ বলে মনে হয়। কিন্তু এটি আসলে মূল সমস্যা থেকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ অন্য দিকে ধাবিত করার কৌশল। আমরা আক্রান্ত হতে রাজি না। পূর্ববাংলার জনগণের জন্য কথা বলার কোন অধিকার আমাদের নেই – যার জন্য আমরা তাদের সাথে কোন আলোচনায় যেতে পারছিনা। শুধু শেখ মুজিব ও তার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এই অধিকার আছে।
আমি কিছু নির্দিষ্ট পয়েন্ট উল্লেখ করেছি যেগুলো ভেবেছিলাম আপনাদের আগ্রহ সৃষ্টি করবে। এখন আমাকে প্রশ্নের জন্য সময় দেয়া উচিৎ। তবে একটি কথা বলি আপনাদের – ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সাহেব বলেছেন আমি সাহায্যের জন্য এখানে এসেছি – কিন্তু আমি কোন সাহায্যের জন্য আসিনি। এমনকি যে কয়টি দেশ আমি ভিজিট করেছি তার কারো কাছে আমি সাহায্য চাইনা। আমি আর আমার প্রতিবেশী দেশের অবস্থা জানানো আমার দায়িত্ব – যাতে দেশগুলোর নেতারা পরিস্থিতি বুঝতে পারেন। তারা তাদের সিদ্ধান নেবেন। আমার কাছ থেকে শোনার পরে আমি জানতে চাই তারা এটা নিয়ে কি ভাবছেন বা কি মনে করেন বা তাদের কি করা উচিৎ।
এখানে আসার আমার প্রধান উদ্যেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমন্ত্রণ। এটি ১ বছর আগে দেয়া হয়েছিল। এইসব ঘটনা ঘটার অনেক আগে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সরকার প্রধানদের তাদের চিন্তাভাবনাকে একে অপরের সাথে শেয়ার করা উচিৎ।
প্রধানমন্ত্রীকে করা প্রেস এর কিছু প্রশ্নের জবাব নিচে উল্লেখিত হল –
প্রশ্ন: মাদাম গান্ধী, আপনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে কি আলোচনা করেছেন একটু বলবেন কি?
প্রধানমন্ত্রী: এই প্রশ্নটি আমাকে ১৫ নভেম্বর করা হয়েছিল আমাদের সংসদে। কোন আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না যদি আপনি না জানেন ঠিক আগের আলোচনায় কি কি আলোচিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীঃ আমি মনে করি আলোচনা সফল হয়েছে। ইউরোপ, এশিয়া; দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি, আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি মনে করি আমি যে মত দেব সেটাই তাদের অর্জন। আমি মনে করি প্রেসিডেন্ট এখন জানেন ভারত কি ভাবছে। এবং আমারও একটি ভালো ধারনা হয়েছে যে এই বিষয়ে আমেরিকা কি ভাবছে। এর চেয়ে বিস্তারিত মনে হয় এই অবস্থায় বলা দরকার নাই।
প্রশ্ন: আপনি হয়তো উত্তর দেবেন না, কিন্তু প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী আমরা জেনেছি পাকিস্তান ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে আপনার ফলপ্রসূ আলোচনা হয়নি। এই রিপোর্ট কি সঠিক? আপনি কি কিছু বলবেন?
প্রধানমন্ত্রী: না এই প্রতিবেদন সঠিক নয়। আমি আগেই বলেছি, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং প্রেসিডেন্ট দেখবেন যে তারা এই ব্যাপারে কি করতে পারেন। আমি অবশ্যই রাষ্ট্রপতির আন্তরিক ইচ্ছার প্রশংসা করি। আমার ধারনা এই রিপোর্ট মূলত আমাদের সাক্ষাৎ সম্পর্কে পূর্ব থেকে প্রত্যাশিত ধারনার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল। আমাদের আলোচনা অনেকক্ষণ ধরে চলেছে। এর কারণ হল আমরা অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ করেছি যার জন্য আজ সকাল পর্যন্ত আলোচনা গড়ায়।
তবে দুই দেশের যার যার দৃষ্টিভঙ্গি তার তার মত। কারণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা দ্বারা এটি প্রভাবিত। সুতরাং, যদিও আমি বলতে চাই যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একই রকম আলাপ করেছি তবে বিষয়টি অন্য কোন দেশের সাথে করা আলোচনার সাথে নাও মিলতে পারে।
তাই এই ক্ষেত্রে, আমরা প্রেসিডেন্ট ও তার সহকর্মীদের আমাদের সীমানার অবস্থা মূল্যায়ন করার ব্যাপারে বলেছি। আমরা মনে করি ভারতের স্থিতিশীলতা, শান্তি, আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। তবে এটি শুধুমাত্র, আমাদের না তথা এশিয়া বা এমনকি পুরো বিশ্বের জন্য গুরুত্তপূর্ন।
প্রশ্ন: আপনি কি আশা করেন যখন গণতন্ত্র পূর্ববাংলায় হুমকির সম্মুখীন তখন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উচ্চকণ্ঠে এর বিপক্ষে দাঁড়ানো উচিৎ? আলোচনার ফলস্বরূপ, আপনি কি আমেরিকান নীতিতে পরিবর্তন আশা করেন?
প্রধানমন্ত্রী: আমি মনে করি না প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কি করা উচিৎ সে সম্পর্কে মন্তব্য করা। এটা তার বিচার করার বিষয় – সব দিকে বিবেচনায় নিয়ে।
এখন, আপনারা দেখুন, আমেরিকা তার নীতিতে কোন পরিবর্তন করে কিনা। আমি মনে করি যে প্রেসিডেন্ট একটি উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। যদিও এর থেকে পথ বের করা অনেক কঠিন।
প্রশ্ন: ভারত কেন সীমান্ত থেকে ভারত ও পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবে রাজি হয়নি?
প্রধানমন্ত্রী: আমি আমার আগের মন্তব্যে এই পয়েন্ট স্পর্শ করেছি। যখন উদ্বাস্তু প্রথম ভারতে প্রবেশ শুরু করে তখন আমরা জাতিসংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আর সেই সময়ে বলা হয়েছিল যে এটি একটি আভ্যন্তরীন সমস্যা। পরে পাকিস্তান আমাদের পশ্চিম সীমান্তে সেনা এনেছিল। ভারত তখনো সরায়নি। সেখানে বিষয়টি জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করে এবং তারা এই প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ করে। পাকিস্তান বলেছিল এটা শুধুমাত্র সামরিক মহড়া।
একথাও ঠিক যে, তা খুব বিশ্বাসযোগ্য উত্তর ছিল না। কিন্তু, সম্ভবতঃ, এটা সত্য হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের নিরাপত্তা বিপদের মধ্যে ছিল। আপনারা জানেন আমাদের মাটিতে তিনটি বড় ধরনের আগ্রাসন আছে। একটি চীন থেকে এবং দুইটি পাকিস্তান থেকে। আমাদের সীমান্ত এলাকার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ তেমন ভালো না। তাই সরকারের প্রধান হিসেবে এটা দেখা আমার দায়িত্ব ছিল। আর সে জন্যই আমরা আমাদের সৈন্য সরিয়েছি।
সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে বলব, এটা ছিল মূল সমস্যা থেকে বিশ্বের ফোকাস অন্য দিকে সরানো। ১৯৬৫ সালের সংঘাতে, কাশ্মীরে হাজার হাজার অনুপ্রবেশকারীর চলাফেরায় দেশকে দুর্বল করার উদ্যেশ্যে একটি প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল যাতে সেই সুযোগে পাকিস্তানী আর্মি প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সেটা সফল হয়নি। কারণ যদিও অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের ভেতরে প্রবেশ করেছিল তবুও আমাদের মানুষ- কৃষক, যাযাবর গোত্র তাদের দেখাশোনা করেছে – এমনকি তাদের সাথে আশা ছাগল, গরু ইত্যাদিরও দেখাশোনা করেছে এবং আমাদেরকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করেছে।
সুতরাং, সেখানে কোন মুকাবিলা হয়নি। আর এই রকম পরিস্থিতি এখন পূর্ববাংলায় ঘটছে। এবং আমি মনে করি না এটাকে আলাদা কিছু হিসেবে দেখার সুযোগ আছে।
প্রশ্ন: প্রশ্ন U.N. মহাসচিব কি ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা কমানোর জন্য ভালো পদক্ষেপ নিচ্ছেন? যদিও ভারত কে দায়ী করা যায় না, তবুও কেন আপনি দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি রক্ষার জন্য আপনার এলাকায় U.N. পর্যবেক্ষকদের আসার অনুমতি দিচ্ছেন না?
প্রধানমন্ত্রী: দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আগে দিচ্ছি। আমি বলতে চাই আমাদের ইতোমধ্যে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা আছে। পশ্চিম ফ্রন্টেও কিছু আছে বহু বছর ধরে। পূবে আছে জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনের দশ জন প্রতিনিধি। সুতরাং, কোন পর্যবেক্ষক বা কোন বিদেশী নেই তা ঠিক নয়।
এছাড়াও, আমাদের সমাজ খুব উন্মুক্ত। সেখানে এম্ব্যাসেডর, কূটনৈতিক কোরের অন্য সদস্যরা, অনেক দেশ থেকে আসা প্রেস, রেডিও, টেলিভিশন এর প্রতিনিধি, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপের দেশগুলোর, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, ল্যাটিন আমেরিকান, জাপান, নিউজিল্যান্ড থেকে আসা সংসদীয় প্রতিনিধি দলের মানুষরা আছে।
সুতরাং, সেখানে আমাদের কিছু গোপন করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু প্রশ্ন হল তারা কি দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি আনতে সক্ষম হবে? পূর্ববাংলায় যা ঘটছে তাতে শান্তি কীভাবে আসবে? এখনও খুন করা হচ্ছে। হাজার হাজার শরণার্থী এখনো প্রতিটি দিন আসছে। এখন, আপনি যদি বলেন যারা এসেছে তাদের ফিরে যেতে হবে – প্রশ্ন হল – এটা কি নিরাপদ? আর যদি নিরাপদ হয় তাহলে আরো মানুষ আসছে কোথা থেকে? সুতরাং, এই একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হলেই আপনারা উত্তর পেয়ে যাবেন।
কিন্তু যদি মহাসচিব বা আগ্রহী কেউ যদি নিশ্চিত করেন যে এই অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে সক্ষম হবেন তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে, তিনি বলতে পারেন যে বাকিরা তাহলে ফিরে যেতে পারেন তেমন পরিবেশ সৃষ্টি করুন।
প্রশ্ন: বর্তমান সঙ্কটের দিনে কেন আপনি জাতিসংঘে একটি ভিজিট দিচ্ছেন না?
প্রধানমন্ত্রী: আমি মনে করি না এতে তেমন কাজ হবে।
প্রশ্নঃ কিছু পর্যবেক্ষক বলেছেন যে নতুন ভারত-সোভিয়েত চুক্তির কারণে স্পষ্টভাবে ভারত তার নিরপেক্ষ অবস্থা থেকে সরে গেল। এই ব্যাপারে আপনি কিছু বলবেন?
প্রধানমন্ত্রী: ভারত কখনো নিরপেক্ষ শিবিরে ছিলোনা। এই শব্দটা আমেরিকাতে ব্যাবহ্রিত হয়। ভারতে আমরা এই শব্দ ব্যাবহার করিনা। জোট- নিরপেক্ষতা মানে নিরপেক্ষ বা অসচেতনতা বা বিশ্বের অন্যন্য বিষয়ে অমনোযোগী বোঝায় না। এর অর্থ হতে পারে আমরা কোন মিলিটারি ব্লকের অধীনে না। আমরা নিজের যোগ্যতায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার রাখি। এর মানে এই না যে আমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা U.S.S.R. সমর্থন দেয় বলে। এগুলো আমরা আমাদের নিজস্ব দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে বিবেচনা করি। এবং অবশ্যই তা বিশ্ব শান্তির জন্য।
ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি সম্পর্কে যতটুকু বলতে পারি এর ফলে আমরা আমাদের জোট নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছিনা। আমরা কোনো দেশে সামরিক ঘাঁটির অনুমতি দেই নাই। আর, চুক্তি অনুযায়ী আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আমরা তাদের সাথে পরামর্শ করতে পারব কিন্তু সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে ভারতের নিজস্ব ব্যাপার। কি কি পদক্ষেপ নেব তাও আমাদের ব্যাপার।
প্রশ্ন: পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করার জন্য ভারত মহাসাগরের উপর সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি আউটলেট চেয়েছে বলে জানা যায়। এটির ব্যাপারে কিছু বলবেন?
প্রধানমন্ত্রী: আমি জানিনা কিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ববাংলায় যা ঘটছে তার জন্য ভারত মহাসাগরের একটি আউটলেট পাবে। আমার মনে হয় এতে তেমন কোন লাভ হবেনা।
প্রশ্নঃ হল ভারত কোন সহযোগিতা করছে কিনা। আমি মনে করি যে ভারত একটি বাস্তবসম্মত পরিস্থিতির ব্যাপারে ভাবছে। এর স্থায়ী সমাধান কি হতে পারে? কি সমাধান করলে পূর্ববাংলার জনগণের জন্য সেখানে থাকা সুবিধাজনক হবে? এটাই প্রশ্ন। আমার মনে হয় সেখানে যে পরিমাণ বিদ্বেষ গত কয়েক মাসে হয়েছে তাতে একটু আশু সমাধান কীভাবে আসতে পারে তাই চিন্তার বিষয়।
প্রধানমন্ত্রীঃ এটাই এখন বাস্তবতা। তাতে আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক।
প্রশ্ন: যেহেতু আপনি U.N. পরিদর্শনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না – তাহলে কি আপনি মনে করছেন যে এটির শক্তি ও যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ?
প্রধানমন্ত্রী: ইউনাইটেড নেশনস এর দুর্বলতা রয়েছে। কিন্তু আমরা সবসময় তাদের সমর্থন করেছি। কারণ আমরা মনে করি এই ধরনের একটি ফোরাম অপরিহার্য। যখন নেশনস লীগ ছিল, সবাই মনে করেছে এটা ঠিক মত কাজ করছে না যা করা উচিৎ। পরে জাতিসংঘ নামে এটি আসল। আমরা যদি জাতিসঙ্ঘ থেকে মুক্তি চাই তাহলে দেখা যাবে অন্য কোন নতুন নামে আবার সেটা শুরু হয়েছে।
সুতরাং, এটা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে এর নির্দিষ্ট কিছু দুর্বলতা আছে। এটা সবসময় নিজের মত কাজ করতে পারেনা।
প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যাক মোহন অন্য একদিন প্রেসক্লাবে বলেছিলেন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কোন যুদ্ধ হতে পারেনা। তিনি বলেছিলেন তিনি আপনাদের সাথে কথা বলবেন। তিনি কি বলেছিলেন?
প্রধানমন্ত্রী: আমি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছি কিন্তু আমার মনে পড়েনা তিনি এমন কিছু বলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি উদ্বিগ্ন, ঠিক যেমন প্রেসিডেন্ট নিক্সন উদ্বিগ্ন এবং রাশিয়ান নেতা এবং আমাদের নেতারাও উদ্বিগ্ন। তারা সবাই জানেন যুদ্ধ ভালো নয় – এটি আরও নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে। যেমনটি প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেন বর্তমান দুনিয়ায় সম্পূর্ণ বিজয় বলে আসলে কিছু নেই।
সুতরাং, আমরা এটাকে সম্পূর্ণরূপে প্রশংসা করি। আমি এর সাথে সম্পূর্ণরূপে একমত। কিন্তু, এটা আমাদের দেশের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার প্রশ্ন। যেকোন কিছুর বিনিময়ে তা রক্ষা করা হবে।
এই সমস্যা দূরীকরণে যুদ্ধ ছাড়া আমাদের যা কিছু করা সম্ভব তার সবটাই করছি। আমরা সমাধান বের করার চেষ্টা থামাব না। এই সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া আছে। আমি নিশ্চিত এটা মীমাংসা করা যাবে। কিন্তু এখন, আরও অনেক বিষয় এসে পড়েছে। প্রথমেই আমি বলছি ভারতের সাথে পাকিস্তানের বা পাকিস্তানের জনগণের কোন বিরোধ নেই। কিন্তু আমরা মনে করি যে, একজন ব্যক্তির ভুলের কারণে পাকিস্তান ভুগছে। কিন্তু যদি আমরা সেই ব্যক্তিকে সরাতে যাই তাহলে ভারতের কিছু হবেনা – তবে পাকিস্তানের অস্তিত্ব নিয়ে সমস্যা হবে।
প্রশ্ন: যদি পাকিস্তান তার বাকি হিন্দুদের বের করে দেয় তাহলে ভারতে অবস্থিত ষাট মিলিয়ন মুসলমানের পরিণতি কি হবে?
প্রধানমন্ত্রী: আমি বিশ্বাস করি যে তারা পুরোপুরি নিরাপদ থাকবেন। যদিও আমাদের কিছু জনগণের খুব খারাপ ধারনা আছে, আমাদের দাঙ্গা হয়েছে, যেটা আমি লজ্জার মনে করি – সরকার এই বিষয়ে খুব দৃঢ় আছে। এবং আমি মনে করি যে, আজকের সকল ভারতীয়, এমনকি ঐসব দল যারা সাধারণত আমাদের সমর্থন করে না, তারাও ভারতের শান্তি রক্ষায় আমাদের সংখ্যালঘুদের যথাযথ নিরাপত্তা দেবে যাতে তারা তাদের সাংবিধানিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে।
পাকিস্তানের বিপক্ষে না যাবার আমাদের কিছু কারণও আছে। পররাষ্ট্র সচিব খুব সুন্দরভাবে আমাকে দৃষ্টি আকর্ষন করিয়েছেন। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলের প্রতি ভারতের কোন দখল পরিকল্পনা নেই। এবং আমি যোগ করে বলি – এমনকি তা যদি পূর্ব বাংলার কোন ক্ষুদ্র অঞ্চলও হয়। আমরা অবশ্যই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চাই না।
প্রশ্ন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্যের বিলের ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
প্রধানমন্ত্রী: আমি মনে করি এটি একটি আভ্যন্তরীণ ব্যাপার যার উপর অনেক দেশ প্রভাবিত …. (হাসি)। আমি ভবিষ্যতবানি করতে পারছিনা। তাই আমি সত্যিই জানি না কি ঘটতে যাচ্ছে। আমরা সাহায্যকে স্বাগত জানিয়েছি। এবং যা আমরা নানা দেশ থেকে পেয়েছি তা দিয়ে আমরা অনেক কিছু করেছি যার সাহায্য না হলে পারতাম না। তবে অল্প অল্প করে আমরা স্বনির্ভরশীল হচ্ছি এবং আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছি।
তবে বোঝা দিন দিন ক্রমবর্ধমান এবং এর সিংহভাগ আমাদের সামলাতে হচ্ছে। আমরা সেগুলো আমাদের জনগণের উদ্যম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে সমাধান করছি। তবে আমরা আগে যা পেয়েছি সাহায্য এখন তার চেয়ে অনেক কম। সুতরাং, এতে আমাদের সত্যিই খুব বেশি সাহায্য করে না।
প্রশ্ন: চীন – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উন্নতি ভারতের উপর এবং অন্যান্য এশীয় দেশগুলোর উপর কি প্রবাভ ফেলবে?
প্রধানমন্ত্রী: ভালো প্রভাব থাকবে। কোন সম্পর্ক, যদি অন্য কারো বিরুদ্ধে না হয় তাহলে শান্তি থাকবে। আর সে জন্যই আমরা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। এবং আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে টানটান পরিস্থিতি অনেকটা কমে যাবে …..
প্রশ্ন: সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তি কি আপনার বাবা প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর জোটনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সুসংগত হয়?
প্রধানমন্ত্রী: আমরা তাই মনে করি। প্রেসিডেন্ট টিটো কিছুদিন ভারত সফর করার সময় বলেছেন এর ফলে জোটনিরপেক্ষ বিষয়ে কোন প্রভাব পরবেনা। এবং আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের বন্ধু চৌ এন লাইয়ের কিছু বিদেশী সংবাদদাতাদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এতে আমাদের নীতিগত অবস্থানে ব্যাত্যয় ঘটবেনা।
প্রশ্ন: পূর্ব পাকিস্তান কি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে প্রকাশ হওয়া উচিৎ?
প্রধানমন্ত্রী: আমি আগেই বলেছি, এই প্রশ্ন পূর্ববাংলার জনগণকে করা উচিত।
প্রশ্ন: ভারত মহাসাগরের ব্যাপারে একটি ফলো-আপ প্রশ্ন। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ে এই এলাকার মধ্যে নৌ বাহিনী পাঠাচ্ছে। এর সম্পর্কে আপনি কেমন অনুভব করেন?
প্রধানমন্ত্রী: আমরা শুধু আশা করতে পারি যে এর ফলে কোন উত্তেজনা সেখানে বৃদ্ধি পাবে না ……..
প্রশ্ন: যদি একটি সমাধান বড় ক্ষমতাধর দেশগুলো পূর্ববাংলার ব্যাপারে গ্রহণ না করতে পারে তাহলে মিশর ও ইসরাইলের সমাধান কীভাবে দিতে পারে?
প্রধানমন্ত্রী: এই মুহূর্তে আমি মনে করি যে, মিশর ও ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতি খুব আশাবাদী নয়। আমরা জানি কখনো কখনো অনেক শক্ত বাঁধন সহজেই কেটে ফেলা যায়। এই একটাই মাত্র আশা।
এর আগে, সোভিয়েত চুক্তি নিয়ে একটি প্রশ্ন ছিল। সম্ভবত আপনি জানেন যে এটার ৪র্থ অনুচ্ছেদে বিশেষভাবে বলা হয় যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি সম্মান প্রকাশ করেছে। উদ্বাস্তুদের সমস্যা পিছনে পরে যাচ্ছে। একটা তুলনা দিলে পুরো বিষয়টা আরও সুন্দরভাবে বোঝা যাবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা হিটলারের জার্মানিতে ইহুদীদের সমস্যা বলতে পারি। ধরুন আপনি বললেন, “আমাদের কিছু পর্যবেক্ষক সেখানে যাক”। কিভাবে তারা ইহুদীদের জন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সাহায্য করতেন? তারা কি বৈষম্য ও হত্যা থেকে রক্ষা করতে পারতেন? অনুরূপ অবস্থা আজ পূর্ববাংলায় বিরাজ করছে।
প্রশ্ন: পূর্ববাংলা সম্পর্কে আপনি যতটুকু জানেন, আপনি কি মনে করেন যদি পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দিয়ে দেয়াও হয় তারা জাতিগতভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত আছে?
প্রধানমন্ত্রীঃ আমরাও আমাদের স্বাধীনতার সময় এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমাদের প্রতিনিয়ত বলা হয়েছিল যে, ব্রিটিশরা খুব আনন্দের সাথে আমাদের স্বাধীনতা দিতে চায় কিন্তু ভারত এটার জন্য প্রস্তুত না। এবং আমি মনে করি আমরা অবশ্যই দেখিয়ে দিয়েছি। একইভাবে অন্যান্য অনেক দেশের কথা বলা যায় – হয়ত তারা ভুল করবে – কিন্তু সেগুলো থেকেই তারা শিখবে এবং তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।
প্রশ্ন: আপনি অনেক দেশের নেতাদের সাথে দেখা করে যাচ্ছেন। আপনি কি মনে করেন না যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করবার প্রয়োজন থাকতে পারে?
প্রধানমন্ত্রী: আমি বলেছি, যদি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আমাকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার জন্য দেখা করতে চান, আমি খুব খুশি হবে। কিন্তু সমস্যা যদি ভারতীয় সমস্যা সংশ্লিষ্ট না হয় তাহলে তা আলোচনা করার জন্য নয়। এই সমস্যা পূর্ববঙ্গ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে সম্পর্কিত।
কিন্তু সেখানে আরো এক একটি দিক আছে। আপনি শুধুমাত্র এমন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে পারেন যদি সেখানে তারা উভয়েই উভয়কে বিশ্বাস করে। কিন্তু যদি তা না হয় তাহলে করমর্দন করতেও আমার অসুবিধা আছে। পরিস্থিতি এখন এমনটাই। আপনি যদি দেখেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বা সাধারণ ভাবে যেসব মন্তব্য করে যাচ্ছেন তাতে এটি মনে হয় না যে এখানে কোন বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হতে পারে। আমি কারো সম্পর্কে অভদ্র শব্দ কখনই উচ্চারণ করিনি। (হাসি এবং সাধুবাদ) ….
—————-