You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.25 | বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার-আমার দেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার-আমার দেশ

দুর্জয়সেনা বাঙালী মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি অব্যাহত। যুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য অধ্যায়ের পর অনন্য অধ্যায় সৃষ্টি। পাঞ্জাবী পল্টনে ভীতির সঞ্চার । জয় বাংলা ধ্বনিতে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস মুখর। দেশবাসীরা মুক্তিবাহিনীর আগমন প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছেন। মুক্ত বাংলায় মুক্ত নিশ্বাস গ্রহণের জন্য বাংলার জনগণ মন উদগ্রীব। | কুখ্যাত ডিক্টেটর ইয়াহিয়া খানের সেনাপতি টিক্কা খান তার পাঞ্জাবী পল্টনের বর্বর শক্তিকে নিরীহ ও সুসভ্য বাঙালী জাতির প্রতি লেলিয়ে দিয়েছিলাে বাঙালী জাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিঃশেষে মুছে দেয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে। তাদের পুরনাে মনিবদের কাছে শুনেছিলাে বাঙালী একটি বেসামরিক জাতি। তারা অস্ত্র দেখলে ভয় পায়। তারা শুধু কেতাব-পুঁথি পড়তেই ওস্তাদ । মূর্খ টিক্কাখান ও তার পাঞ্জাবী পল্টন বাঙালী জাতির সত্যিকারের পরিচয়টা জানতাে না। তারা শুনেনি ঈসা খানের নাম। তারা জানেনা এই বাংলাদেশেই মুগলদের শক্তিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের বারভূঁইয়ারা। বাঙালী তিতুমীর বাঁশের কেল্লা তৈরী করে লড়াই করেছিলেন বৃটিশের বিরুদ্ধে। বাঙালী সূর্যসেন লুটে এনেছিলেন বৃটিশের অস্ত্রাগার চট্টগ্রাম থেকে। তারা দেখেছে বাংলার প্রান্তরে শৃগাল ঘুরে বেড়াতে। দেখেনি সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে। শুনেনি সিলেটের বীর সন্তান সৈয়দ হাদা মিয়া ও মাদা মিয়ার বীরত্ব কথা। টিক্কা এলাে। পাঞ্জাবী পল্টনকে ঢুকিয়ে দিলাে শহর-বাংলায়। গ্রামবাংলায়। চিৎকার উঠলাে শহরবাংলা থেকে। গ্রাম-বাংলার বুক থেকে নিহত হলাে অজস্র পিতাপুত্র। মা-বােন কন্যার সতীত্ব ধ্বংস। হলাে সংখ্যাতীত । বাংলার আকাশ বাতাস আর্তের ক্রন্দনে কেঁপেকেঁপে উঠছে। বাংলার যুবক বিস্মিত।  

কারণ সে একটা সুসভ্য জাতির প্রতিনিধি। পাঞ্জাবী পল্টনের মতাে মানুষ নামের পশুদের সংগে তার পরিচয় ঘটেনি ইতিপূর্বে। অমন উলংগ পরিচয়। সে দেখতে পেলাে তার মায়ের সংগে তার বােনের সংগে তার স্ত্রীর সংগে তার কন্যার সংগে কার্তিক মাসের কুকুরের মতাে আদিম কামনায় উন্মাদ হয়ে ওঠে আসঙ্গ লিলা চরিতার্থ করে ওদেরকে হত্যা করে চলেছে পাঞ্জাবী পল্টনের পশুরা। জেগে ওঠলাে ঈসাখান। জাগলাে তিতুমীর। গা ঝাড়া দিয়ে শ্মশান থেকে ওঠে এলেন মাষ্টারদা। সূর্যসেন। বাংলার আকাশ বাতাসে ধ্বনিত হলাে বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার, আমার দেশ মুক হয়ে যাওয়া বিদ্রোহী কবির বাণী মুখর হয়ে ওঠলাে ? বল বীরবল উন্নত মম শির,….. বাঙালী যুবক মাথা পেতে গ্রহণ করলাে কবি গুরুর আশীর্বাদ। তার বুক চিরে বেরিয়ে এলােঃ চিরদিন তােমার আকাশ তােমার বাতাস-ওমা, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি…..

বাংলার মাটির বুকে হাত রেখে সে শপথ নিলােঃ মহাবিদ্রোহী রণকান্ত আমি সেই দিন হব শান্তযবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রােল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রনিবেনা…….

এবং সেদিনই জন্মগ্রহণ করলাে আমাদের মুক্তি বাহিনী। পৃথিবীর গেরিলা যােদ্ধাদের ইতিহাসে। বাঙালী মুক্তিবাহিনী একটি গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়। এক অনন্য সংশপ্তক বাহিনীর জন্ম দিয়েছে বাঙালী। তরুণেরা।

দলেদলে ওঁরা প্রবেশ করছে গ্রামবাংলায়। নিজের দেশটিকে ওরা মুক্ত করবে পাঞ্জাবী কসাইদের। কবল থেকে। ওখানে অপেক্ষা করেছে অগণিত মা, বােন, ভাই। মা বলছেন, খােকন, কবে তুই আসৃবি? আমাদেরকে উদ্ধার করবে মরণপুরী থেকে আমরা যে দিন গুনছি বাবা তােমাদের অপেক্ষায়? আর। কতােদিন আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করিতে পারবাে ওই পাঞ্জাবী জানােয়ারদের। হাত থেকে? ওরা পুড়িয়ে দিয়েছে আমাদের ঘরবাড়ী। লুটে নিয়েছে যা কিছু টাকাপয়সা ও তৈজস পত্র ছিলাে সব। ভিখেরী শ্রেণীতে নামিয়ে দিয়েছে আমাদেরকে। আর যে সহ্য করতে পারিনে থােকন!

বােন বলছেঃ দাদা, তুমি কোথায় আছে এখন? আমাকে বলে গিয়েছিলে যুদ্ধ শিখে এসে বাংলা মাকে চিরদিনের জন্য উদ্ধার করবে ওই রুটী খেকো পাঞ্জাবী পশুদের হাত থেকে। তােমার যুদ্ধ শেখাটা কি এখনাে শেষ হলাে না? এদিকে যে শেষ হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। তুমি যাওয়ার কিছু দিন পরেই পাঞ্জাবী। জানােয়াররা এসেছিলাে। আমরা পালিয়ে গিয়েছিলাম গােরস্তানের জঙ্গলের ভেতরে। আমাদের বাড়ীঘর। ওরা পুড়ে দিয়েছে। তােমার বইপুস্তক সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুনেছি ওরা নাকি আমাকে খুঁজেছে খুব। চেয়ারম্যানের সেই বেজন্মা ছেলেটা ওদেরকে বলেছে আমার কথা।

পাশের বাড়ীর সাজুকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলাে। আহা, সাজুর সে কি কান্না । দাদা, তুমি যদি শুনতে। পেতে তাহলে পাগল হয়ে যেতে। আর যে পারিনে দাদামণি? বাংলার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করার জন্য ৮০ হাজার পাঞ্জাবী ডাকাত একটা কবর তৈরী করেছে। বাঙালীজাতির একটা ভুল ধারণা ছিলাে ওই হানাদার পশ্চিমা দস্যদের প্রতি। আমরা ভাবতাম ওরা সত্যিকারের যােদ্ধা। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ওদের সত্যিকারের রূপটা ধরা পড়েছে। দুর্বল ও নিরন্ত্রের প্রতি ওরা অত্যন্ত নির্মম। কিন্তু স্বল্প দিনের ট্রেনিংপ্রাপ্ত বাংলার দুজয়সেনা মুক্তি বাহিনীর সামনে আসতে ওরা ভয় পায়। এ পাকিস্তানী বীর পুঙ্গবরা রাতের বেলা শিবিরের বাইরে যেতে নারাজ। তাদের  কমাণ্ডারদের হুকুমে ও না। যেখানে যখনই মুক্তি সেনারা এগিয়ে যায় তখন পেছনে হটতে থাকে পাকিস্তানী হানাদারেরা এবং পরে কিন্তু সেই এলাকার লােকজনকে হত্যা করে ও ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দিয়ে বীরত্ব দেখিয়ে থাকে। তখন তারা যেনাে শেয়াল বনের রাজা’।  বাংলাদেশের বিভিন্ন রণক্ষেত্র বিশেষ করে সিলেট জেলার বিভিন্ন স্থানে খণ্ডযুদ্ধের যতােটুকু সংবাদ। আমাদের কাছে এসে পৌছেছে তাতে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, গত এপ্রিল মাসের মতাে এবার ও সমুদয় এলাকা ত্যাগ করে পিছনের দিকে হটে হট সিলেট শহরের সালুটিকর ঘাঁটিতে ওরা জমায়েত হয়ে ডিফে নিচ্ছে। তাদের প্রধান ভরসা বিমান বাহিনী ও দূরপল্লীর অস্ত্রশস্ত্র । অতি সম্প্রতি হাকালুকি ও ছাতকের যুদ্ধে তাদের বিপুল সংখ্যক সৈন্য হতাহত হওয়াতে ভীতির সঞ্চার হয়েছে পাঞ্জাবী পল্টনের। মধ্যে। কিন্তু আমাদের বীরযােদ্ধা মুক্তিবাহিনী তা মানবে কেননা? বর্বর পাঞ্জাবীরা যে দেনা করেছে। অনেক । আসিতেছে শুভদিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ’,

মুক্ত বাংলা।১; ৬ 

২৫ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯