You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪৩। সিমলায় অনুষ্ঠিত সর্বভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৮ অক্টোবর ১৯৭১

সিমলা সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এর ভাষণ, অক্টোবর ৮, ১৯৭১

আমি, এ.আই.সি.সি সদস্যদের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যারা সর্বসম্মতিক্রমে এবং সর্বান্তকরণে ইন্দো-ইউ.এস.এস.আর চুক্তি অনুমোদন করেছেন। এটি একটি রাজনৈতিক কাঠামো, তাই, পৃথক সাধারণ অনুমোদন এবং পূর্ণ এনডোর্সমেন্টের এর পাশাপাশি আমাদের জন্য পরিষ্কারভাবে এই নথির বিষয়বস্তু এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধারনা সম্পর্কে স্পট হওয়া জরুরী। আমি এই চুক্তিটিকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং উপাদানের সমন্বয়ে বিবেচনা করতে চাই। প্রথমত, এটা দুই দেশের মধ্যে চলমান চুক্তি উপনিবেশবাদ বর্জন এবং বর্ণবাদী শাসকদের অবদমনের জন্য কাজ করবে। এটি একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যৌথ ঘোষণাপত্র। একথা অনস্বীকার্য যে এখনো বিশ্বের বড় অংশ ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও বর্ণবাদী শাসকদের অধীনে আছে। পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসন এখনও ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও বর্ণবাদী শাসকদের অধীনে চলমান। বর্ণবাদী শাসকরা এখনও দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন অংশ গিনি, নামিবিয়া এবং রোডেশিয়ায় তাদের প্রভাব চালাচ্ছে এবং জাতিসংঘের গৃহীত রেজল্যুশনে তা অন্তর্ভুক্ত। এটা সবসময় আমাদের অর্গানাইজেশনের লক্ষ্য ছিল যে উপনিবেশবাদ বর্জন করতে হবে এবং বর্ণবাদী শাসকদের হটানোর জন্য কংগ্রেস কাজ করছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু আমরা ধারণ করিনা বরং স্বাধীনতার পর এটা আমাদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। কংগ্রেস সংগঠন সবসময় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে একটি খুব শক্তিশালী কন্ঠ উত্থাপন করেছে এবং বাস্তবিকই জাতির পিতা মহাত্মা জি, দক্ষিণ আফ্রিকাতেই নিজেই তার প্রথম রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করেছিলেন। এটা পরিতাপের বিষয় এবং দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে দক্ষিণ আফ্রিকা এখনও বর্ণবাদী শাসনামলে নিমজ্জমান ও জাতিবিদ্বেষ অনুশীলন চলছেই। চুক্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যকার চুক্তিতে যে উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের অবশিষ্টাংশ শেষ করার গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল যা মনে করিয়ে দেয়া হয়।

চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল জোটনিরপেক্ষ নীতি যা ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা অবাক ব্যাপার যে কিছু মানুষ, প্রাথমিক পর্যায়ে এটাকে সমালোচনা করেছেন এই বলে যে এই চুক্তি ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতির সাথে সাঙ্ঘর্ষিক। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই মন্তব্য কোন জোটনিরপেক্ষ দেশ থেকে আসেনি। বরং এমন কেউ মন্তব্য করেছে যারা নিজেরাই জোট নিরপেক্ষ নয় এবং যেখানে সামরিক শাসন ব্যাবস্থা পরিচালিত। ভারতের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের চুক্তি স্বাক্ষরে একে অপরের সাথে কো-অপারেশন ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। অথচ এতে এমন কিছু দেশ কষ্ট পেয়েছে যারা সামরিক চুক্তি এবং প্রতিরক্ষা চুক্তির সদস্য। প্রকৃত পক্ষে এই চুক্তি প্রমাণ করে যে ভারতের কর্মকান্ডে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রদ্ধা রয়েছে।

শুধু তাই নয়, আমি মনে করি, এটা প্রথমবারের মত একটি আনুষ্ঠানিক নথি যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন শান্তির জন্য একটি প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে জোটনিরপেক্ষতাকে সমর্থন দেয়। এটি মূলত সারা বিশ্বে উত্তেজনা কমানোর জন্য ছিল। সুতরাং, শুধুমাত্র ভারতের নীতি সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষণ করা হয়েছে তা নয় বরং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রেক্ষাপটে জোটনিরপেক্ষ ধারণার বৈধতা চতুর্থ ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আমিও সর্বশেষে মস্কোতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সফর শেষে যে চুক্তি করা হয় সেই ব্যাপারে হাউসের মনোযোগ আকর্ষন করছি। সেখানেও ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতির ধারণা বিশেষভাবে যৌথ ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছিল।

চুক্তির তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিধান হল বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা। দুটি দেশ, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এবং পারস্পরিক সুবিধার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্কযুক্ত থাকে। ফলে এই চুক্তি অনুযায়ী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যাবে। সর্বশেষ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি অগ্রিম ভিত্তিতে, ইলেকট্রনিক্স ক্ষেত্রে অগ্রগতি ও অন্যান্য অত্যাধুনিক ক্ষেত্র যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিঃসন্দেহে অসাধারণ উন্নতি করেছে, ভারত এই চুক্তি অনুযায়ী সম্পূর্ণরূপে কোনো বিশেষ পরিস্থিতির জরুরী প্রয়োজনে উপকৃত হবে বলে আশা করা যায়। ভারতের সুবিধা হল যে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে, শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারি। ইউএসএসআর এর প্রযুক্তি যা আমাদের কাছে আসবে তা দিয়ে আমরা আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও জ্ঞান বিস্তারের জন্য জন্য সম্পূর্ণ সুবিধা নিতে পারব।

চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ বিধান যা সম্পর্কে বেশ স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা হবে কারণ এটি খুব জনপ্রিয় একটি চুক্তি। বিস্তৃতভাবে এটি নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গি উপর বর্ণনা করা যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ এই চুক্তিতে ৩ টি ক্লজ আছে যাতে দু’দেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে যদি অন্য পক্ষ সামরিক সংঘাতে জড়িত হয় তাহলে সেও জড়িত হবে। এই চুক্তি প্রচলিত সামরিক চুক্তি বা পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তির থেকে আলাদা। সেখানে অন্যান্য দেশ জড়িত হলে দেশ এক সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে যেতে পারে। এই চুক্তিতে এ ধরনের কোন বিধান নেই। সেখানে অবশ্য অনাক্রমণ হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। এ সম্পর্কে স্পষ্ট বিধান আছে। অর্থাৎ দুই দেশের কেউ যদি অন্য দেশের সাথে কোনো সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয় তাহলে এদের কেউ ঐ দেশকে কোনো ধরনের কোনো সাহায্যের দেব না। তাহলে যদি আমরা কোন দেশের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হই তাহলে পূর্বচুক্তি থাকার কারণে সেই দেশকে আমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোন দেশ কোন প্রকার সহায়তা দিতে পারবেনা।

একথা অনসীকার্য যে আমরা ধারাবাহিকভাবে আমাদের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করব। আমি আশ্বস্ত করতে চাই যে এই চুক্তির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক সম্পূর্ণরূপে বিবেচনায় নিয়ে এই চুক্তি সুরক্ষিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন পাকিস্তানকে কোনো ধরনের সামরিক সরবরাহ করতে পারবেনা। আবার, চৌহান জিভারি স্বচ্ছভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, এই চুক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ যা আমাদের নিরাপত্তার জন্য অত্যাবশ্যক। কিন্তু চুক্তির কারণ যুদ্ধ এবং সংঘর্ষ নয়। কিন্তু যুদ্ধ এড়াতে এবং শান্তির বাহিনীকে অধিকতর শক্তিশালী করতে এটি দরকার। সংক্ষেপে, এই চুক্তির ফলে যখন দেশ যেকোন কারণে আক্রান্ত হয় বা একটি আক্রমণের হুমকির সম্মুখীন হয়, তখন দুই দেশ হুমকি এড়ানোর জন্য একে অপরের জন্য “কার্যকর পদক্ষেপ” গ্রহণ করবে। এর ফলে আক্রমণের হুমকির এড়ানো সহজ হবে। এটা খুবই মজার যে অনেকে আমাদের মনে করিয়ে দেন “কে এবং কোথায় তোমার বন্ধু? ’’ তারা আসলে আমাদের চুক্তির ছিদ্র খুঁজছেন। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই এই চুক্তি হবার পরে বিরোধী দলের অবস্থান সম্পর্কে – যারা ঐতিহ্যগতভাবে কংগ্রেস এর বিরোধিতা করে। এমনকি তারাও এই চুক্তির পরে প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসাবে, তেমন কিছু জোরালভাবে বলেননি। কারণ জানত যে, এই চুক্তি পক্ষে দেশের অনুভূতি এতটাই শক্তিশালী যে, তারা সম্পূর্ণভাবে এর পক্ষে ছিলেন। তারা চুক্তি সমর্থন করেছে তবে তাদের মূল অবস্থান পরিবর্তন করেনি এবং শুধু ফরম্যাট পরিবর্তন করেছে। তবে দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে – এতে কোন সন্দেহ নেই। যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে এর ফলে আমাদের স্বাধীনতা ও জোটনিরপেক্ষতা সুরক্ষিত থাকবে এবং একই সময়ে এটা আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতায় গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে। নিরাপত্তা কোণ থেকে এই চুক্তি বিবেচনা করলে দেখা যায় এটি আমাদের সার্বভৌমত্ব ও দুই দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য দরকারি একটি পদক্ষেপ।

সাম্প্রতিক বাংলাদেশ?

বস্তুত আমি এই বিষয়ে আসছি। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আমাকে আগে চুক্তি সম্পর্কে বলা উচিৎ ছিল। সেটা বলা শেষ করে আমি এখন রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিয়ে আমার সম্প্রতি বিভিন্ন রাজধানীতে এবং জাতিসংঘে সাম্প্রতিক সফর সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। আমি আন্তর্জাতিক বিশ্বকে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন দেব। আপনারা সন্দেহাতীতভাবে অবগত আছেন যে, প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রশ্নটি মূলত একটি অভ্যন্তরীণ প্রশ্ন এবং পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার ছিল। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষের গণহত্যা, নিপীড়ন এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক দলের বিরুদ্ধে শোষণ চলছিল। মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা অবদমনের ফলে এমন নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয় যে জোরপূর্বক প্রচুর দেশান্তর ঘটতে থাকে। পরিস্থিতি স্পষ্টত আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমার সহকর্মী ও অনেকে নিজে থেকে ভিজিট করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন – বিভিন্ন রাজধানীতে বিবৃতি, যৌথ বিবৃতি, কখনো কখনো সরকারি বিবৃতি দিয়েছেন। এই সমস্যা সমাধান এখন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অপরিহার্য। অতি সত্ত্বর উদ্বাস্তুদের ফিরে যাবার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করা অবশ্যম্ভাবী।

এখন যদি আমরা সাবধানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিতর্ক পরীক্ষা করি তাহলে দেখা যায় যে চারটি বড় ক্ষমতাধর দেশে- যারা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রাখে, তাদের মুখপাত্রদের, তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বক্তব্যে বোঝা যায় তারা পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন। এই পরিস্থিতির ফলে অসহায় মানুষ বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করছে ও ভারতীয় ভূখন্ডে জড়ো হচ্ছে যা ভারতের জন্য একটি বোঝা। এর ফলে এই এলাকায় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান পারে উদ্বাস্তুদের ফিরে যাবার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে। জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বাংলাদেশের মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে এবং সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের মানুষ তাদের উপর নির্ভর করে এবং শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের ওপর তাদের নির্ভরতা আছে যেটি তারা অভূতপূর্ব নির্বাচনী বিজয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যেখানে জাতীয় পরিষদে ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন পেয়ে দলটি জয়ী হয়েছে। এই ছিল পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তা পরিষদ-এর চার স্থায়ী সদস্য সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং সেইসাথে বৃটেন এগুলো বিস্তৃতভাবে গ্রহণ করে এবং নিরাপত্তা পরিষদে তাদের বিবৃতি তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রণীত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রকাশ্যে এই পরিস্থিতিতে ভারতের পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে।

সমগ্র বিশ্বে, আমরা শুধু ইতিবাচক বিষয়গুলো বলব, নেতিবাচক বিষয়গুলো নয়। এই সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে সার্বভৌম দেশ, যারা জাতিসংঘের সদস্য, তাদের একটি মোটামুটি বড় সংখ্যা আছে যাদের তাদের দেশে ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে সামরিক শাসক – যার মধ্যে পাকিস্তানও আছে। ঔপনিবেশিক যুগ-পরবর্তী সময়ের জন্য এটি একটি দু: খজনক অভিজ্ঞতা। বিপুল সংখ্যক দেশ স্বাধীন হয়েছে। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক দেশে গণতন্ত্র চর্চা, গণতান্ত্রিক কাঠামোর, গণতান্ত্রিক মতাদর্শ, গণতান্ত্রিক সংবিধান এগুলো সৃষ্টি হয়। কিন্তু এটি নিষ্ঠুর বাস্তবতা যে কোথাও কোথাও গণতন্ত্র শিকড় গাঁড়তে অক্ষম ছিল। প্রেসিডেন্সিয়াল বা পার্লামেন্টারি যে ধরণের হোক না কেন তা টেকেনি। শোনা যায় যে ইয়াহিয়া খান নির্বাচন দিতে ব্যার্থ হয়েছিলেন। এমনকি তারা নির্বাচন করার কথা বলে এখন পিছুটান দিচ্ছেন। এখন অবস্থা এমন যে তিনি চাইলেও এর থেকে এড়িয়ে চলতে পারবেন না। এতকিছুর কারণে আমাদের গণতান্ত্রিক আদর্শ, আমাদের আনুগত্য, আমাদের প্রেম যখন বাধাগ্রস্ত হবে তখন স্বাভাবিকভাবেই আমরা তা মেনে নেবনা। কারণ আমাদের দেশে আমরা গণতন্ত্রের শিকড় প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছি। অন্য কিছু দেশ যাদের অভিজ্ঞতা আমাদের মত না তারা অনেকে আমাদের মত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না- কারণ আমাদের মত তারা বিষয়গুলো অনুধাবন করলে এইসব ইস্যুতে স্বাভাবিক ভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াত।

জাতিসংঘে উপরোক্ত আলোচনার পরে আমি একটি ইতিবাচক এবং একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে চাই। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হল এইসকল ইস্যুতে ইতোমধ্যে যেসব দেশের প্রতিনিধিরা আমাদের সমর্থন দিয়েছেন তারা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের মনোভাব পরিবর্তন সম্পর্কে একই ধারনা পোষণ করেন এবং এর ফলে ভবিষ্যতে তাদের কাছ থেকে তাদের প্রভাবকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এবং আমি বলতে চাই যে, পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু যারা পাকিস্তানের সাহায্যকারী তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার সামরিক জেনারেলদের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পদ্ধতি জেনে ও এই সামরিক পদ্ধতির ব্যর্থতা সম্পর্কে আন্দাজ করতে পেরেছে এবং তারাও মনে করে সামরিক পদ্ধতি পরিত্যক্ত করা উচিৎ। এবং তারা মনে করে রাজনৈতিক ভাবেই এর সমাধান করতে হবে। আমরা জানতে পেরেছি যে যারা পাকিস্তানের বন্ধু তারাও এখন পাকিস্তানকে বোঝানো শুরু করেছে যে সামরিক কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক পথ অবলম্বন করতে।

আমাদের নিজেদের দেশে কিছু সমালোচক আমাদের নীতির ছিদ্রানুসন্ধান করার চেষ্টা করেছে। আমরা যখন বলি যে সেখানে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা হতে হবে, তখন তারা বলে কেন আমরা বাংলাদেশ সম্পর্কে আপোস করছি? আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। আমরা বলি যে বাংলাদেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে যা গ্রহণযোগ্য তা আমাদের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে। এটা স্বাধীনতার ভিত্তিতে হবে নাকি বৃহত্তর একটি উপনিবেশ হবে সেটা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নেবেন। একমাত্র এই পদক্ষেপের পরেই সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে পারে। যা শরণার্থীদের ফেরত যেতে সহজতর করবে।
আমি এই পর্যায়ে বলতে যে এটি সর্বজন গৃহীত হয়েছে এবং এটা সবাই উপলব্ধি করেছে যে ভারত শরণার্থীদের বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে এবং তাড়া তাদের রেখে দিতে চায়না। ঐতিহাসিক কারণে এবং বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মানবিক কারণে আমরা উদ্বাস্তুদের প্রতি সমবেদনা মনোভাব গ্রহণ করি। নিজেদেরকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের দেখাশোনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এখন স্বাধীনতার ২০ বছর পর একজন পাকিস্তানে অবস্থানরত মানুষ হয় একজন পাকিস্তানি নাগরিক, অথবা বাংলাদেশের নাগরিক অথবা একটি পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক এবং যখন কোন বিদেশি নাগরিক ভারতে আসে আমরা তাকে দেখাশোনা করব এটাই স্বাভাবিক। ভৌগলিক কারণে আমাদেরকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে। প্রাথমিক দায়িত্ব আমাদের উপর বর্তালেও আন্তর্জাতিক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব রয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাহায্য দিতে বলি তাতে আমাদের উপর সামান্য ভরও যদি কমে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোনো দেশ যারা আমাদের এই উদ্বাস্তুদের দেখাশোনা করার জন্য এইড দিতে পারে। মনে রাখতে হবে এটি পাকিস্তান বা বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাহায্য। ভারতের কোন সহায়তা নয়। আমরা বলেছি যেকোন পরিমাণ সাহায্য সাদরে গৃহীত হবে যা আমাদের বোঝা লাঘব করবে। ৯ মিলিয়ন লোক সেখানে যে আর্থ-সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে তা পরিমাপ যোগ্য নয়। এটাকে ডলার, পাউন্ড, ডাচমার্ক বা ইয়েন দিয়ে মাপা যায়না। এতে বস্তুত আমাদের পুরো দেশ ভুক্তভোগী।

আমি বলতে চাই আমাদের এই গভীর সমস্যায় সমগ্র প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় সরকার সাধ্যমত পদক্ষেপ নিয়েছে। উদ্বাস্তুদের দেখাশোনা যতটুকু সম্ভব চালিয়ে যাবার পাশাপাশি আমাদের উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ভারতের ৫৫ কোটি মানুষ যে ভোগান্তি আর ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে তা কোন পরিসংখ্যান, হিসাব, অর্থমূল্য দিয়ে বিচার করা যায়না। উদ্বাস্তুদের জন্য আমরা অসংখ্য স্কুল বন্ধ করে দিয়েছি। অসংখ্য হাসপাতালে চিকিৎসকরা শুধু তাদের চিকতসা দেবার জন্য নিয়জিত আছেন। এমনকি মেডিকেলের ছাত্ররা তাদের পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে সেখানে উদ্বাস্তুদের জন্য কাজ করছে। কত শত শিক্ষার্থি আর স্বেচ্ছাসেবক উদ্বাস্তুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে তার সীমা নেই। যদি এদের জন্য যত অর্থ দরকার তার সবটা পাওয়া যেত হয়ত ভারত নিশ্চিন্ত থাকতে পারত। এই একটি খুব বিপজ্জনক দিক যে সাধারণভাবে যদি আপনি অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন, তারা আপনাকে বলবে এটি বেশ বড় বোঝা, তারা অনেকটা সহানুভূতিশীল হবে, আমরা জানি। কিন্তু এটা করা আমাদের উদ্যেশ্য না। হয়তো আমরা আমাদের এই বোঝা শেয়ার করার আবেদন জানাব কিন্তু আমাদের মূল দাবী বাংলাদেশের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য পদক্ষেপ নেয়া যাতে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় এবং এর ফলে উদ্বাস্তুরা তাদের দেশে ফিরে যেতে সচেষ্ট হবে। এটি সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে বাংলাদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মেনে নেয়া। পুরো দেশের জন্য এটি সবচেয়ে জরুরী এই মুহুর্তে। আমি মনে করি এর গুরুত্ব ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সরকারগুলো অনুধাবন করেছেন। আমরা বোঝাতে পেরেছি যে আমাদের ধৈর্যের সীমা আছে। এবং আমাদের অধ্যবসায় ও সংযম এর সময় পেরিয়ে গেলে আমাদের জন্য তা আরও বিপদ জনক হবে। এই অবস্থার উন্নতিকল্পে বিশ্বকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মৌলিক ঐক্য ও আমাদের জাতি ও আমাদের মানুষের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মানসিকতাই এই মুহূর্তে আমাদের মূল শক্তি।

চীন গণপ্রজাতন্ত্রী সম্পর্কে, লক্ষ্য করে থাকবেন যে পিকিং থেকে কিসিঞ্জার তার দ্বিতীয় সফর শেষে দেখা গেল আমেরিকা তাদের নীতি পরিবর্তন করেছে। তাদের চেষ্টা ছিল চিনকে জাতিসংঘের বাইরে রাখা। যখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নীতি অবলম্বনকারী কিছু দেশেকে একীভূত করতে চাইছে ঠিক সেই মুহুর্তে তারা ওইসব দেশের ব্যাপারে তাদের কূটনীতি পরবর্তন করে ফেলেছে। তবে কূটনীতি হঠাত করে পাল্টে ফেলা যায়না। তাই তাদেরকে খুব রহস্যজনক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হচ্ছে। হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে যে আমেরিকা চিনকে জাতীয় পরিষদের সদস্য করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে ও পদক্ষেপ নিচ্ছে – শুধু তাই নয় নিরাপত্তা পরিষদেও চিনকে প্রবেশ করানোর জন্য কাজ করছে যেখানে ভেটো ক্ষমতা পর্যন্ত রয়েছে। অন্যদিকে তাইওয়ানকেও তারা প্রতিনিধিত্ব করছে। ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকা তার সমর্থকদের এতদিন বুঝিয়ে এসেছে যে তাইওয়ান সরকার শুধু ফরমোজা ও তাইওয়ানের নয় বরং এটি সমস্ত চিনের। কিন্তু হঠাত করে এখন তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। ভারত যতদূর জানে, চীনের সাথে আমাদের সম্পর্কে যত সমস্যা থাকুক না কেন, সেটি খুব স্পষ্ট এবং এই পরিবর্তিত অবস্থায় আমাদের মনোভাব একটি কমাও পরিবর্তন করার প্রয়োজন আমরা মনে করিনা। আমরা বিশ্বাস করি চিন এক এবং চীন একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র এবং একটি সরকার সেখানে বলবত আছে। এবং জাতিসংঘে তার ন্যায়সঙ্গত জায়গা তার পুনরুদ্ধার করা উচিত। তবে এই সেশনে তারা ফরমজাকে নিজেদের হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান। আমি মনে করি সে তার অবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রচুর সমর্থন পাবে। আমরা বিশ্বাস করি অস্থিতিশীল বিশ্বের লাঘব কমাতে চীন তার সাধ্যমত দায়িত্ব পালন করবে এবং জাতিসঙ্ঘে তাদের অবস্থান তুলে ধরবেন। এর জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্ব দীর্ঘদিন আগ্রহী – যার জন্য আমরাও অপেক্ষা করছি।

আমাদের ধারনা যে চীনকে এত সময় বাইরে রাখায় কিছু জটিলতা ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এটা স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে – যদিও চীন জাতিসঙ্ঘের সাথে যুক্ত হয়। আন্তর্জাতিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মুখোমুখি আমরা অবস্থান করছি।

আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, আমি কয়েক মিনিট ইউরোপের সর্বশেষ উন্নয়ন সম্পর্কে বলব। কোনো সন্দেহ নেই যে, ইউরোপে স্পষ্টভাবে উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। এই প্রাথমিকভাবে সম্ভব হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির চ্যান্সেলর জনাব উইলি ব্রান্ডিট এঁর সাহসের কারণে। তার ইচ্ছাতেই সোভিয়েত নীতির পরিবর্তন করা হয়েছে এবং অবশ্যই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে একটি খুব ভাল ফল পেয়েছে। এবং জার্মানি ও ইউএসএসআর এর মধ্যে মস্কো চুক্তি ইউরোপীয় উত্তেজনার শিথিলকরণে একটি নতুন দ্বার খুলেছে। উভয় পক্ষ মনে করেন এতে নতুন উন্নয়নশীল অবস্থা সৃষ্টি হবে। সর্বশেষ বার্লিনে চার ক্ষমতা চুক্তি, একটি আশা সৃষ্টি করেছে যে ইউরোপের উত্তেজনা শিথিলকরণ হচ্ছে। এতে করে শান্তি তরান্বিত হবে বলে আমরা মনে করছি। এর ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতার অবসান ও উত্তেজনার শিথিলকরণ হবে। একটি নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে বলেই আমরা মনে করছি। সশস্ত্র সংঘাত থেকে মুক্ত হয়ে কিছু উন্নয়নশীল দেশ উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে তাদের অর্থনীতি বিকশিত করার জন্য সুযোগ পাবে।

এই হল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। ভিয়েতনাম ও মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা সম্পর্কে আমার কাছে নতুন কোন তথ্য নেই। পশ্চিম এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ায় এখনও যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে – জানিনা এখান থেকে শান্তির পথে কবে আমাদের উত্তরণ হবে – যদিও আমরা তার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!