You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রতিবেদনঃ মেজর (অবঃ) রফিক-উল-ইসলাম
কুষ্টিয়ার যুদ্ধ
(লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

কুষ্টিয়াতে ২৮শে মার্চ সকালে কারফিউ উঠাতেই জনসাধারণ পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৩০শে মার্চ সকালে পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা অসামরিক লোকজনদের সহায়তায় কুষ্টিয়া শহরে অবস্থানরত ২৭তম বালুচ রেজিমেন্টের ওপর আক্রমণ চালিয়ে অবস্থানটি দখল করে নেয়।

চুয়াডাঙ্গাস্থ ৪র্থ ইপিআর উইংয়ের উইং কমান্ডার মেজর ওসমান সরকারী কাজে কুষ্টিয়া গিয়ে সার্কিট হাউসে উঠেছিলেন। পাকিস্তানীদের হামলার সময় তিনি কোন প্রকারে কুষ্টিয়া থেকে আত্মরক্ষা করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। ২৬শে মার্চ বেলা ১টার দিকে তিনি চুয়াডাঙ্গা পৌঁছে ইপিআর সেনাদের সংগঠিত করেন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। ৪র্থ উইংয়ের সদর দফতর থেকে ওয়ারলেসে ঐ এলাকার সীমান্তবর্তী সকল ফাঁড়ির ইপিআর সদস্যদের জনগণের সহযোগিতায় পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দেয়া হয়। ২৭শে মার্চ সকালে মেজর ওসমান ১ বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পাকিস্তানীরা কায়দা করে ২৪শে মার্চ এই রেজিমেন্টকে চৌগাছা পাঠিয়ে দিয়েছিলো। মেজর ওসমান সংক্ষেপে সর্বশেষ পরিস্থিতি বর্ণনা করে ইপিআর সুবেদার মজিদ মোল্লার মারফত লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠি তিনি লেঃ কর্নেল জলিলকে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এই অঞ্চলের সার্বিক কমাণ্ড গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু চিঠির কোন জবাব পাওয়া গেলনা। ২৮শে মার্চ মেজর ওসমান দানেশ নামে জনৈক মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে তার কাছে পুনরায় বার্তা পাঠান। শোনা যায় মুক্তিযোদ্ধা দানেশ পুনরায় অনুরোধপত্র নিয়ে লেঃ কর্নেল জলিলের সামনে উপস্থিত হলে তিনি প্রথমে চিঠিটি পড়েন এবং তার পক্ষে বিদ্রোহে যোগ দেওয়া সম্ভব নয় বলে দানেশকে জানিয়েদেন। এভাবে তাঁর সাথে দেখা না করার জন্যও তিনি দানেশকে সতর্ক করেদেন। এর পরিণতি হয়েছিল করুণ। এই দিন অর্থ্যাৎ ২৮শে মার্চেই লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে ব্যাটালিয়ন নিয়ে তাকে যশোর ফিরে যাওয়ার এবং অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ আসে।

যশোর ক্যান্টনমেন্টে ১ম ফিল্ড এম্বুলেন্স দলের বাঙালি সৈন্যরা আসন্ন বিপদ অনুভব করতে পেরেছিলো। ২৯শে মার্চ রাতে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা চৌগাছা থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এলে ফিল্ড এম্বুলেন্সের লোকেরা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের অস্ত্র জমা না দেয়ার আহবান জানায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এর আগেই অস্ত্র জমা দেওয়া শেষ করে সৈনিকরা ব্যারাকে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। ২৯শে মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানীরা হঠাৎ প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঘুমন্ত সৈন্যদের উপরে হামলা করে। বিশ্বাসঘাতকদের এই আক্রমণে অনেক বাঙালি সেনা প্রাণ হারায়। প্রাণ নিয়ে পালাতে পেরেছিলো এমন কয়েকজন পরে চুয়াডাঙ্গা গিয়ে মেজর ওসমানের সৈন্যদের সাথে যোগ দেয়।

১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর হামলার সময় পাকিস্তানীরা শুধু সেনাদেরই হত্যা করেনি, তাদের পরিবার-পরিজন, নারী-শিশুদেরও হত্যা করে। পাকিস্তানীদের হত্যা ও অত্যাচারের হাত থেকে দুগ্ধপোষ্য নবজাতকেরাও রেহাই পায়নি। ফিল্ড এম্বুলেন্সের বাঙালি কমান্ডিং অফিসার কর্নেল এস এ হাই এবং তার বাঙালি সহকর্মী ক্যাপ্টেন কালামকে ওরা দুঃসহ নির্যাতনের পর হত্যা করে। এই পরিস্থিতিতে চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান এবং তার সহযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আজম ইপিআর সৈন্যদের নিয়ে কুষ্টিয়া মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। কুষ্টিয়ার ২৭তম বালুচ রেজিমেন্টের দুইশত সৈন্য থানা, পুলিশ লাইন এবং জেলা স্কুলে অবস্থান গ্রহণ করছিলো। মেজর ওসমান তিনটি ঘাঁটিতেই পর্যায়ক্রমে আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেন। ২০শে মার্চ ভোর ৪টায় প্রথম আঘাত শুরু হয়। সারাদিন যুদ্ধের পর ৫টায় পুলিশ লাইন মুক্ত হয়।

এখানে অনেক পাকিস্তানী নিহত হয়, কয়েকজন আবার পালিয়ে গিয়ে জেলা স্কুলের প্রধান ঘাঁটিতে যোগ দেয়। ৩১শে মার্চ কুষ্টিয়া শহরের পাকিস্তানী অবস্থান গুলোর আবার নতুন আক্রমণ শুরু হয়। পাশ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক পুলিশ-ইপিআর এর সহায়তায় এগিয়ে আসে। তাদের হাতে ছিল বাঁশের লাঠি, বন্দুক এবং কয়েকটি ৩০৩ রাইফেল। জনতার ভীড় বেড়ে গেল। দুপুরের মধ্যে বিক্ষুদ্ধ জনসাধারণের বিরাট দল পাকিস্তানীদের দ্বিতীয় ঘাঁটি দখল করে নেয়।

শত্রুরা তখন পিছু হটে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। ২৭-বালুচ রেজিমেন্টের কোম্পানীর অন্তিম মূহুর্ত ঘনিয়ে আসে। ঘেরাওয়ের মধ্যে থেকে কোনভাবে প্রাণে রক্ষা পাওয়া কিছু পাকিস্তান সেনা দুটি জীপ এবং দুটি ডজ গাড়িতে করে রাতের অন্ধকারে ঝিনাইদহের দিকে পালাতে চেষ্টা করে। খবর পেয়ে জনসাধারণও পথের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। একদল মুক্তিযোদ্ধা শৈলকুপা সৈতুর (যশোর জেলার ঝিনাইদহে) নিকট অবস্থান গ্রহণ করে।

সেতুর নিকট পৌঁছাতেই পাকিস্তানীরা মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যামবুশের ফলে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। কয়েকজন পালাবার চেষ্টা করলে জনসাধারণ তাদের পিছু ধাওয়া করে। পথে তারাও জনতার হাতে প্রাণ হারায়। তবে এই সময়ের মধ্যে ২৭-বালুচ রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানীর হাতে দুই শতাধিক বেসামরিক বাঙালি প্রাণ হারিয়েছে, আহত আরো বেশী।

২রা এপ্রিল ভোরের দিকে বালুচ কোম্পানীর অবশিষ্ট সৈন্য কুষ্টিয়া থেকে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তার ব্যারিকেডের জন্য যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় তারা গ্রামের পথ ধরে পালাবার চেষ্টা করে। পথে কাউকে দেখতে পেলেই তারা গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্থু শিগগীরই তারা হতাশা ও ক্লান্তিতে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং গোলাগুলীও ফুরিয়ে যায়। জনসাধারণ সহজেই তাদের বন্দী করে। তারপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তালিকা থেকে ২৭-বালুচ রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানীর নাম চিরতরে মুছে যায়।

————————————————-

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!