You dont have javascript enabled! Please enable it!

যশোর- গোপালগঞ্জের প্রতিরোধ যুদ্ধ
সাক্ষাৎকারঃ মেজর আবদুল হালিম
২২-১১-১৯৭৩

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আমি আমার নিজ বাড়ি ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জে ছুটি ভোগ করছিলাম। ২৫শে মার্চের পাকবাহিনীর নির্মম হত্যাকান্ডের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নেই। প্রথমে গোপালগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগ অফিসের নেতৃবৃন্দের সাথে মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে পরিচালনা করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করি। সাথে সাথে ছুটি ভোগকারী সৈনিক ও ইপিআর দিগকে গ্রাম-গঞ্জ ও শহর থেকে একত্রিত করি। সেই সময় গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ ফরিদ আহমদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সর্ব প্রকার সাহায্য করেন।

২৮শে মার্চ গোপালগঞ্জ থানা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে তৎকালীন কালিয়া থানার এম-পি-এ সাহেবের সহযোগিতায় যশোর জেলার নড়াইল মহকুমা শহরে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পৌছি। সেই সময় নড়াইলে এস-ডি-ও কামাল সিদ্দীকি ও যশোর জেলার এ্যাসিস্টান্ট কমিশনার শাহাদৎ হোসেন সর্বপ্রকার সাহায্য করেন।

২৯শে মার্চ নড়াইল গিয়ে জানতে পারলাম, যশোরে পাকবাহিনীর সহিত মুক্তিবাহিনীর ভীষণ যুদ্ধ চলছে। তাই , নড়াইল থেকে যশোর অভিমুখে রওনা হই। পরে হামিদপুরে এক প্লাটুন পাকসেনা ডিফেন্স নিয়ে ছিল। আমার প্লাটুন সেই এলাকার ছাত্র, পুলিশ ও কিছু বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ান সহ ঐদিনই রাত্রি সাড়ে তিনটায় তাদের ডিফেন্সের চারদিক থেকে হামলা করি। আমাদের আক্রমণে ভয় পেয়ে তারা পেছনের দিকে পালিয়ে যায়।

৩০শে মার্চ সকালে আমার প্লাটুন ও হামিদপুর এলাকার অসংখ্য ছাত্র-যুবক সহ যশোর রওনা হই। সকাল ৯টার দিকে যশোর শহরে পৌছি। সেই সময় যশোর শহর আমাদের বাহিনীর আয়ত্বে ছিল। যশোর শহরে ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ক্যাপ্টেন হাসমত ও ক্যাপ্টেন আওলাদের সাথে দেখা করি এবং আমি ও আমার প্লাটুনের জোয়ানদেরকে কি করতে হবে তা অবগত করি।

সেই সময় ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে জানতে পারি যশোর –কলিকাতা রোডের শঙ্করপুর নামক স্থানে পাকবাহিনীর সহিত ইপিআর বাহিনীর ভীষন যুদ্ধ চলছে। রাত্রে অয়ারলেসে যুদ্ধের অগ্রগতি সম্বন্ধে যোগাযোগ করি।

৩১শে মার্চ সকালে শঙ্করপুর চলে যাই। সেখানে ইপিআর বাহিনী কে পুনরায় নতুনভাবে গুরুত্বপুর্ণ এলাকায় ডিফেন্স করে দেই। সেখানে ইপিআর বাহিনীর সুবেদার মালেক অসিম সাহসের সহিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে ক্যাপ্টেন আওলাদ ও ক্যাপ্টেন হাসমত কে আর খুঁজে পাওয়া গেল না, এবং স্বাধীনতা আন্দোলনেও তাদেরকে সক্রিয় অংশ নিতে দেখা গেল না।

৩১শে মার্চ থেকে ৩রা এপ্রিল পর্যন্ত যশোর সেনানিবাসের চতুর্দিক ঘিরে রাখা হয়। সকল গুরুত্বপুর্ণ পথে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয় ও ডিফেন্স তৈয়ার করা হয়। সেই সময় ভারতের সহিত যোগাযোগ করা হয় আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য, কিন্তু প্রথম দিকে সাহায্য পাওয়া যায় নাই। আমাদের হাতে তখন আধুনিক অস্ত্রের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য।

৩রা এপ্রিল বিকাল ৩ ঘটিকার সময় পাকবাহিনী যশোর সেনানিবাসের দুইদিক থেকে আক্রমণ করে। যশোর কলিকাতা রোডের উপরে শঙ্করপুর দিয়ে ও যশোর ঢাকা রোড দিয়েও তারা আক্রমণ করে। প্রথমে আর্টিলারী নিক্ষেপ করে ও মর্টার হতে গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। গোলা নিক্ষেপ করে পাকসেনারা সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে। আমাদের সম্বল ছিল দুইটি ৬ পাউন্ডার। দুইটিকে দুই রণাঙ্গনে বসানো হলো। ৬ পাউন্ডার থেকে পাকবাহিনীর উপরে গোলাবর্ষন করে বেশ কিছুক্ষন তাদের অগ্রগতিকে রোখা গেল। এইদিকে শঙ্করপুরের ৬ পাউন্ডারটি থেকে কয়েকটী গোলা নিক্ষেপের পরে জ্যাম লেগে যাওয়ায় আর গোলা নিক্ষেপ করা যাচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকা –যশোর রোডের ৬ পাউন্ডার টাকে নিয়ে আসার জন্য অয়ারলেসে বলা হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, নিয়ে আসবার পথে পাকবাহিনী চালক সহ ৬ পাউন্ডার টি আটকে ফেলে। এই সংবাদ পেয়ে আমাদের পক্ষে বাধা দেবার আর কোন উপায় রইল না। এদিকে পাকবাহিনীর আর্টিলারীর শেলে আহত হয়ে কিছু ছাত্র- যুবকেরা হাতিয়ার ফেলে পিছনে চলে আসতে বাধ্য হয়। সন্ধ্যার দিকে পাকবাহিনী আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপরে গুলি নিক্ষেপ করতে থাকে। এমতাবস্থায় আমরা আস্তে আস্তে পিছনের দিকে চলতে থাকি। ৩রা এপ্রিল সারারাত উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। আমাদের পক্ষে দুই কোম্পানীর মত ইপিআর ও আনসার-মুজাহিদ-ছাত্র যুদ্ধ করে। এই যুদ্ধে বিশেষ অসুবিধা ছিল। আমি ইপিআর বাহিনীর ক্যাপ্টেন নই, তাছাড়া সকল সৈনিকের ছিল সিভিল পোশাক। তাই সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনায় কিছু অসুবিধা হয়। এই যুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসালী লেঃ মতিউর রহমান এমপিএ বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষের ১৫ জন মুক্তিসেনা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শাহাদৎ বরণ করেন। এদিকে পাকবাহিনী যশোর দখল করে নেয়। ৪ঠা এপ্রিল আমরা সকলে নড়াইলে পুনরায় একত্রিত হই। সেখানে নতুনভাবে মনোবল নিয়ে নড়াইল-যশোর রোডে দাইতলা নামে বিকালে ডিফেন্স নিই। সেই সময় আমাদের জোয়ানদের মোট সংখযা ছিল এক কোম্পানী। অপরদিকে সকল আনসার ও মুজাহিদ নিজ নিজ এলাকায় চলে যায়। দাইতলা আমাদের ডিফেন্স খুব শক্ত করে গঠন করি।

৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী বিকালের দিকে পুনরায় আক্রমণ করে, কিন্তু আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকসেনারা টিকে থাকতে পারল না। তারা পিছনে ফিরে চলে যায়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর আনুমানিক ৩০ জনের মত নিহত হয়। তারা আপ্রাণ চেষতা করেও আমাদের ডিফেন্স নষ্ট করতে পারেনি। আমাদের পক্ষে কোন হতাহত হয়নি।

৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী পুনরায় আমাদের উপরে আক্রমণ করে। সেদিন তারা আর্টিলারী ও মর্টার ব্যাবহার করে। আমরাও তাদের আক্রমণ প্রতিহত করি। প্রায় ৫ ঘন্টা উভয়পক্ষে ভীষন যুদ্ধ হয়। পরে আমাদের গোলাবারুদের অভাবে আর টিকে থাকা গেল না। আমরা পিছনের দিকে চলে আসতে বাধ্য হলাম। নড়াইলে আমার কোম্পানী নিয়ে রাতে অবস্থান করি।

৯ই এপ্রিল পাকবাহিনী নড়াইলের মহকুমা শহরে বিমান হামলা চালায় ও সাথে সাথে দাইতলা থেকে পাকবাহিনী এসে নড়াইলে শহর দখল করে নেয়। আমার কোম্পানী ছত্রভংগ হয়ে যায়। কিছু ইপিআর জোয়ান ভারতে চলে যায়।

আমি পুনরায় গোপালগঞ্জে চলে আসি। সেই সময় গোপালগঞ্জ শত্রুমুক্ত ছিল। গোপালগঞ্জে পুনরায় ছাত্র, যুবক, ইপিআর ও সামরিক বাহিনীর জোয়ানদের নিয়ে দুটি কোম্পানী গঠন করি। তাদের রিতিমত প্রশিক্ষনের ব্যাবস্থা করি। প্রথমে আমার কোম্পানীর হেডকোয়ার্টার গোপালগঞ্জ শহরে গঠন করি। পরে আমার নিজ গ্রাম মানিকহার হাইস্কুলে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি। মে মাসের প্রথম দিকে পাক বাহিনীর নির্মম অতযাচারের সংবাদ জেনে স্থানীয় জনসাধারনের মধ্যে আমাদের নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলতে থাকে।

৮ই মে গোপালগঞ্জ থেকে ৫ মাইল দূরে তালা নামক স্থানে ৫ টি বার্জ বোঝাই পাট খুলনার দিকে যাচ্ছিল। আমরা তা আক্রমণ করি ও বার্জ গুলো কে ডুবিয়ে দেই। বার্জগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়া “বিরলা” নামের ছোট জাহাজটিকে আমাদের নদীতে পেট্রোলিং এর কাজে ব্যাবহার করি।

১১ই মে সকালে ঢাকা থেকে খুলনা অভিমুখে রকেট স্টীমার যাওয়ার পথে তালা ঝাজঘাটে জোরপুর্বক আটকিয়ে রাখি। প্রত্যেকটি যাত্রীকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেই, কারণ অধিকাংশ যাত্রী পাক সরকারের পক্ষে চাকুরীতে যোগদানের জন্য খুলনা যাচ্ছিল। জাহাজটিকে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয় এবং জাহাজের যাত্রীদের সরকার চাকুরীতে যেন যোগদান না করে এই শপথ করিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।

১১ই মে বিকালে পাকসেনারা স্থানীয় কিছু দালালের সহায়তায় প্রথমে গোপালগঞ্জে প্রবেশ করে। পরে আমাদের হেডকোয়ার্টার মানিকহার আক্রমন করে। প্রথমে আমরা তাদের তীব্র আক্রমণ প্রতিহত করি, কিন্তু পরে তাদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকে থাকা সম্ভব হয় না। আমাদের পক্ষে একটি মাত্র এল-এম-পি ছিল। তার চালক নায়েক রব গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ায় আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। পাকবাহিনী মানিকহার গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।

গোপালগঞ্জ পতনের পর ভারত অভিমুখে রওনা হই। পথে বহু বাধা বিপত্তির মধ্যে দিয়ে ২২শে মে পশ্চিমবঙ্গের বয়রা সিমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি।

———————————————————

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!