সিলেটের প্রতিরোধ যুদ্ধ
সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার চিত্তরঞ্জন দত্ত
২৪-৩-৭৩
(১৯৭১ সালে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন)
২৫শে মার্চ বড় বড় শহরে পাকিস্তানীরাযে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল সে খবর আমরা জানতে পারলাম ২৬শে মার্চ। সঙ্গে সঙ্গে হবিগঞ্জের আবালবৃদ্ধবনিতা প্রতিরোধ দুর্গ তৈরি করতে আরম্ভ করল। প্রতিটি হবিগঞ্জবাসী যেন এক-একটি বহিৃশিখা।
২৭শে মার্চ ১৯৭১ সন আমার বাড়িতে বসে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কয়েকজন মিলে নানা আলাপ আলোচনা চলছে। তখন কয়েকজন ছাত্র এসে আমাকে বলল, “দাদা, পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।” আমি বললাম, “আমিও তা চাই।” অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রদের মতানুযায়ী চলা ঠিক নয়। তাই আমি ওদেরকে বললাম কর্নেল রব (এমসিও)- এর কথা, যিনি বর্তমানে জেনারেল রব। কিছুদিন আগে তিনি ঢাকাতে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগদান করে এসেছেন। তাঁর কাছ থেকে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা জানা যাবে, এই ভেবে বললাম, কর্নেল রব যদি আমাকে বলেন তাহলে আমি এই মুহূর্তে প্রস্তুত।
২৭শে মার্চ শনিবার ১৯৭১ সন। বেলা প্রায় দু’টায় জেনারেল রব তার বাড়িতে আমাকে যাবার জন্য খবর পাঠালেন। গিয়ে দেখলাম কামরার ভিতরে বসে আছে আনসার মুজাহিদের কয়েকজন, সামরিক বাহিনীর কয়েকজন যারা ছুটি কাটাতে এসেছিলেন এবং কিছু সংখ্যক ছাত্র। বাড়ির বাইরে খোলা জায়গায় বিরাট ভীর। আমাকে দেখেই সকলে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বাংলা’ বলে আনন্দে চিৎকার করে উঠল। দেখলাম হাতিয়ার নিয়ে প্রায় ১৫০ জনের মত লোক যাবার জন্য তৈরি। কয়েকটি বাস ও ট্রাক একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। চারধারে শুধু ধ্বনিত হতে লাগল ‘জয় বাংলা’। আমি হাত উঠিয়ে সকলকে অভিবাদন করলাম।
ঘরের ভেতরে ঢুকতেই জেনারেল রব সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, আজই পাঁচটায় যে লোকবল আছে তাদের নিয়ে সিলেটকে মুক্ত করবার জন্য যাত্রা করব। যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমাকে দেয়া হল। আমি হাসি মুখে আমার সম্মতি জানিয়ে সকলকে অভিবাদন জানালাম এবং যাত্রাপথে গাড়ীতে আমাকে উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করলাম।
জেনারেল রবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র চারদিকে “জয় বাংলা” জয়ধ্বনি উঠতে লাগল। মনটা আনন্দে ভরে উঠল। হাতজোড় করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলাম, শক্তি দিও যেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পারি।
২৭শে মার্চ বেলা পাঁচটায় একটা জীপ ও পাঁচটায় একটা জীপ ও পাঁচটা বাস ও ট্রাক আমার বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। চারদিকে শুধু “জয় বাংলা” ধ্বনি। লোকে লোকারণ্য। আমি আমার স্ত্রী ও ছেলেমেদের বললাম, স্বাধীনতার ডাক এসেছে। আমাকে এখনি যেতে হবে। ‘জয় বাংলা’ বলে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
হবিগঞ্জ শহরটি যেন আনন্দে মেতে উঠেছে।
আমি, মানিক চৌধুরী ও জেনারেল রব একই গাড়ীতে বসেছিলাম। সবাই আমাদের হাত নেড়ে বিদায় সংবর্ধনা জানাল। গাড়ী ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে শায়েস্তাগঞ্জের দিকে। সেদিন আমাদের গন্তব্যস্থান ছিল রশীদপুর চা-বাগান। কারণ, খবর পেয়েছিলাম পাকিস্তানীরা শ্রীমঙ্গলের ওপারে আছে। ভেবেছিলাম ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে রশীদপুর পৌঁছে যাব এবং পরদিনের কর্মসূচি তৈরি করতে পারব, কিন্তু পথে চলতে গিয়ে আমাদের অনেক বাধা বিঘ্নের সম্মুখীন হতে হলো। কিছুক্ষণ পরপরই রাস্তার উপরে বড় বড় গাছ, পাথর ইত্যাদি রেখে ব্যারিকেড তৈরি করা ছিল। বলা বাহুল্য, জেনারেল রব ও মানিক চৌধুরীর আদেশক্রমেই এগুলি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে সম্পন্ন হবে তা কেউ ভাবেনি। স্বাধীনতাকামী প্রত্যেকটি বাঙালির মন আজ জেগে উঠেছে। যাহোক, আমি বললাম অন্য আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত রান্তাঘাট খোলা রাখতে। কারণ আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে হবে।
রশীদপুরে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় রাত ১১টা বেজেছিল। আমি জেনারেল রবকে বললাম, আজ রাত এখানেই থাকব এবং আগামী কাল ভোরে যারা আমাদের সঙ্গে এসছে তাদের কে এবং তারা এক সঙ্গে কি কি অস্ত্র ও হাতিয়ার এনেছে তা দেখে পরবর্তী কর্মপন্থা গ্রহণ করব। রশীদপুর চা-বাগানের ম্যানেজার মোস্তফা সাহেবকে বললাম, “ আজ রাতের জন্য ওদের শ্রমিকদের সাহায্য যেন চা-বাগানটি সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করানো হয়। এ খবরটি আমাকে কাল দুপুরের মধ্যেই দিতে হবে।”
আমাদের সবাইই আহারের ব্যবস্থা রশীদপুরেই হয়েছিল। এখানে একটা কথা বলতে চাই যে সিলেটের শমশেরনগরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা কোম্পানী ছিল। সেটার কমান্ডার ছিল মেজর খালেদ মোশারারফ (বর্তমানে কর্নেল)। হবিগঞ্জ থেকে রওনা হয়ে যখন আমরা পাইকপাড়া আসলাম তখন জানতে পারলাম মেজর খালেদ মোফাররফ শমশেরনগর থেকে রওনা হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে যাচ্ছে। সিলেট ছেড়ে এভাবে যাবার উদ্দেশ্যটা বোঝা যাচ্ছিল না। জেনারেল রবকে বললাম, আমাদের গিয়ে ওকে ধরতে হবে এবং সম্মিলিত চেষ্টায় সিলেট মুক্ত করতে হবে।
আমরা তাড়াতাড়ি যেতে অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু পথঘাটে বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে যখন মীরপুরের পুলে এসে পৌছলাম তখন আমি মনে মনে চিন্তা করেছিলাম যে খালেদ মোশাররফ ও তার সৈন্যসামন্ত এবং আমার সৈন্যসামন্ত নিয়ে সিলেটকে মুক্ত করব এবং সিলেটে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে সেখানে আমাদের প্রধান হেডকোয়ার্টার তৈরি করবো। সিলেট থেকে সারা বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে সুবিধা হতো। সেদিন যদি কর্নেল খালেদ মোশাররফ আমার কথা মেনে নিতেন, তাহলে আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হতো। বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হতো।
জানতে পারলাম গত রাতেই মেজর খালেদ মোশাররফ তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে মীরপুর অতিক্রম করে চলে গেছে। মেজর খালেদ মোশাররফ ও সৈন্যসামন্তদের পেলে সিলেটকে মুক্ত করে তারপর আমরা কুমিল্লার পথে গেলে সুবিধা হত। যাইহোক ওকে যখন পেলাম না তখন আমার নিজেকেই করতে হবে।
রাতে ঘুম হল না। চিন্তা করতে লাগলাম এ সামান্য অর্ধশিক্ষত সৈন্য নিয়ে কি করব। পরদিন ভোরে বেলা প্রায় সাড়ে সাতটার সময় আমি আমার স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী ছেলেদের দেখতে গেলাম। কারণ আমাকে জানতে হবে এদের কতখানি যুদ্ধ করবার ক্ষমতা আছে এবং ওদের সঙ্গে হাতিয়ার – গোলাবারুদ কি কি আছে। আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা যারা ছুটিতে ছিল সব মিলিয়ে মোট ১৫০জন মাত্র ছিল। তাদের কাছে আছে কেবল ৩০৩ রাইফেল এবং দশ রাউন্ড গুলি। এই সামান্য সৈন্য ও হাতিয়ার নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিতান্তই বোকামি।
যাইহোক, আমি সিলেটের মুক্ত করবার যে দায়িত্ব করবার যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি তা আমাকে যে ভাবেই হোক পালন করতেই হবে। মনে বিশ্বাস ও স্বস্তি পেলাম যখন সবাই বলল, স্যার আমরা তৈরি। যা আছে তাই নিয়ে নরপিশাচদের বধ করব এবং সিলেটকে মুক্ত করব। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম এই সামান্য হাতিয়ার ও সৈন্য নিয়ে কিভাবে কি করে পাকিস্তানিদের শায়েস্তা করব। ঠিক করে ফেললাম জনগণের শক্তিই হল বড় শক্তি এবং তার জন্য স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাহায্য আমাকে নিতে হবে। স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাছে যা যা আছে এবং আমার কাছে যা সৈন্য আছে তাই নিয়ে আমাকে সিরেট মুক্ত করতে হবে। তাই স্থানীয় গ্রামবাসীদের ডেকে বললাম, তোমরা আমার সৈন্যদের সঙ্গে সঙ্গে “জয় বাংলা” ধ্বনি উঠিয়ে চারদিকের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলবে। এই আওয়াজ শুনে শত্রুরা মনে করে যেন অনেক সৈন্য নিয়ে আমরা এদের বিরুদ্ধে লড়তে এসেছি। মানিক চৌধুরীকে বললাম যেভাবে হোক অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের ব্যবস্থা করতেই হবে।
২৮/২৯ শে মার্চ আমরা সৈন্যদের সংঘবদ্ধ করলাম। দুই প্লাটুন সাতগাঁ পাহাড়ের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। শ্রীমঙ্গল থেকে হবিগঞ্জ ও চুনারুঘাটে যদি শত্রুর আসতে হয় তাহলে সাতগাঁ পাহাড়ের মধ্য দিয়েই আসতে হবে। কারণ, রেললাইন ও বড় রাস্তা সাতগাঁ পাহাড়ের মধ্যে দিয়েই গেছে।
শত্রুরা কোথায় আছে সঠিক কবর পাচ্ছিলাম না। ভাসা খবর এসে পৌঁছাচ্ছিল। শ্রীমঙ্গল থেকে লোকজন আসা প্রায় বন্ধ ছিল। সঠিক খবর পাবার জন্য কয়েকজনকে শ্রীমঙ্গলের আশেপাশে পাঠালাম।
এদিকে রশীদপুরে আমাদের প্রথম কাম্প বানালাম। রশীদপুরের আশেপাশে চা-বাগান ছিল, সব বাঙালী ম্যানেজাররা খুব সাহায্য করেছেন। সৈন্যদের খাওয়া-দাওয়া, থাকার ব্যবস্থা এবং ট্রেনিংয়ের জায়গা সবই তাঁরা ব্যবস্থা করেছেন। চা-বাগানের ম্যানেজার মোস্তফা, আজিজ এদের নাম করতেই হয়। মানিক চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ বন্দোবস্ত করতে লাগল। বাস, ট্রাক যা পাচ্ছে আমাদের সাহায্যের জন্য এক জায়গায় করছে। আমরা আছি এ খবর জেনে নানা জায়গা থেকে যাদের একটু সামরিক প্রমিক্ষণ ছিল আমাদের সৈন্য দলে যোগ দিতে লাগলো।
এদিকে খবর পেলাম আমরুল চা-বাগানের দিকে পাকিস্তানীরা আসছে চুনারুঘাটে যাবার জন্য। ম্যাপে দেখলাম রাস্তাও একটা আছে এবং লোকজনের কাছ থেকে জানলাম এ রাস্তা দিয়ে শুধু মানুষই চলতে পারে, গাড়ী চলতে পারে না। যা কিছু সৈন্য ছিল, প্রায় দুই প্লাটুনের মত, পাঠিয়ে দিলাম আমরুল চা-বাগানের দিকে। ওরা পৌঁছার পর কবর পাঠাল যে পাকিস্তানীরা এসেছিল, আবার শ্রীমঙ্গলের দিকে চলে গেছে। আমি ওদের ফিরে আসাকে বললাম, কারণ আমার উদ্দেশ্য হল যত তারাতারি সিলেট অভিমুখে যাওয়া।
৩০ শে মার্চ খবর পেলাম পাকিস্তানীরা শ্রীমঙ্গলে এসে অত্যাচার আরম্ভ করেছে। ৩০/৩১ শে মার্চ রাতে শ্রীমঙ্গলের প্রায় দুই মাইল দূরে প্রতিরোধ গড়ে তুললাম এই উদ্দেশ্যে ৩১শে মার্চ সকালে আমি শ্রীমঙ্গল আক্রমন করব।
৩০শে মার্চ সকালে আমি আমার চার প্লাটুনকে নিয়ে চারদিকে শ্রীমঙ্গলে আক্রমণ করলাম। ভোর আটটায় শ্রীমঙ্গলে পৌঁছলাম। খবর পেলাম পাকিস্তনীরা শ্রীমঙ্গলে ছেড়ে মৌলভী বাজারের দিকে চরে গেছে। সময় নষ্ট না করে মৌলভীবাজার দখল করা শ্রেয় বলে মনে করলাম। চারধারে সৈন্য ছড়িয়ে পড়েছিল। ওদেরকে আবার একত্রিত করে মৌলভীবাজারের দিকে রওনা হলাম। রাস্তায় লোকজনের চলাচল এক রকম বন্ধ বললেই চলে। সৈন্যদের নিয়ে যখন মৌলভীবাজারের দিকে যাচ্ছিলাম জানতে পারলাম নয়নপুর চা-বাগানে পাকিস্তানীরা আছে। পেছনে দুটো প্লাটুনকে বললাম সোজা মৌলভীবাজার রাস্তায় না এসে নয়নপুর চা-বাগান শত্রুমুক্ত করে মৌলভী বাজার আসতে। নয়নপুর চা-বাগানটা শ্রীমঙ্গল থেকে ৭/৮ মাইল দূরে। নয়নপুরের কাছে আসতেই গোলাগুলির আওয়াজ শুনলাম। বেলা প্রায় আড়াইটা হবে। “জয় বাংলা” আওয়াজে পুরো নয়নপুর যেন মুখরিত হয়ে উঠল। বুঝলাম নয়নপুর আমাদের দখলে এসেছে। সংযোগের অভাবে কিছুই ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। বাকি সৈন্যদের বললাম মৌলভীবাজারের দিকে অগ্রসর হতে। বিকেল হয়ে গেছে। পৌঁছলাম মৌলভীবাজারে। মনে হচ্ছিল মৌলভীবাজার যেন শ্মশান হয়ে গেছে। লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। সার্কিট হাউসে এসে উঠলাম। আমার সৈন্যরাও আসতে লাগল। জয় বাংলা ধ্বনিতে সারা শহরটা মুখরিত হয়ে উঠল। লোকজন মনোবল না পেয়ে আমাদের কাছে আসতে লাগল।
রশীদপুর থেকে ক্যাম্প উঠিয়ে নয়নপুর মৌলভীবাজারে ক্যাম্প করলাম। কারণ ওখান খেকে আমার সিলেট আক্রমন করা সুবিধা হবে। জেনারেল রবকে একথা বলতে তিনি মেনে নিলেন। মৌলভীবাজারের অবস্থানটি এমনি জায়গায় যেখান থেকে দুটো প্রধান সড়ক, সিলেট থেকে একটা কুলাউড়া হয়ে, অন্যটি শেরপুর শাহীদপুর হয়ে মৌলভীবাজারে ওদের আসতে হবে। যদি শত্রুরা স্থলপথে কুমিল্লা অথবা ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া যেতে চায় তাহলে মৌলভীবাজারে ওদের আসতে হবে। একথা ভেবে মৌলভীবাজার কে প্রধান ঘাঁটি করে রাখলাম। খবর নিতে আরম্ভ করলাম শত্রুরা কোথায় এবং খবর পেলাম কুলাউড়ার দিকে শত্রুরা নেই। শত্রুরা এ রাস্তা বেছে নেবার আর একটা কারণ আমার সৈন্যদের সিলেটে যেতে হলে দুটো বড় বড় নদী পার হতে হবে। এই চিন্তা করে আমার কাছে যা সৈন্য ছিল তা নিয়ে শেরপুর-শাদীপুরের রাস্তায় সিলেট যাবার জন্য মনস্থ করলাম।
মৌলভীবাজারকে শক্ত ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য জেনারেল রব এবং মানিক চৌধুরীকে বললাম যে আমার আরো অস্ত্রশস্ত্র এবং সৈন্যের প্রয়োজন। শেরপুর-শাদীপুরের রাস্তায় সিলেট যেতে হলে দু’টো বড় বড় নদী আমাকে পার হতে হবে। যে সৈন্য আমার কাছে এখন আছে, তা দিয়ে দু’টো নদী পার হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে সিলেট পৌঁছানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। জেনারেল রব এবং মানিক চৌধুরীকে একথা বলতে তাঁরা আমাকে আশ্বাস দিলেন যে কিছু দিনের মধ্যে সৈন্য-গোলাবারুদ এসে যাবে।
পাকিস্তানীদের যুদ্ধের হাবভাব দেখে বুঝতে পারলাম ওরা বড় রকমের কোন যুদ্ধ করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না ওরা সিলেট একত্রিত হচ্ছে। তবে শেরপুর-শাদীপুরে দুটো নদীতে ওরা ভালভাবে বাধা দেবে সেটা বুঝতে পারলাম এবং সেজন্য তৈরি হতে লাগলাম।
আস্তে আস্তে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্য বাড়তে লাগল। জেনারেল রব সীমান্তে গিয়ে বিডিয়ার-এর বাঙালী ছেলেদের একত্রিত করে মৌলভীবাজারে পাঠাতে লাগলেন। মানিক চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে লাগলেন। আমার সৈন্য তখন প্রায় ৪৫০ জনের মত হয়ে গেল।
মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গলের জনগন আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। গিয়াসউদ্দিন সাহেব, তোয়াবুর রহীম, আজিজ, ডক্টর আলী, আলতাফ, ইলিয়াস এবং স্কুল কলেজের ছাত্রদের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। সৈনদের দেখাশুনা, খাওয়া-দাওয়ার সব রকমের ব্যবস্থা যদি মৌলভীবাজার ও সিলেটের জনগন না করতো তাহরে সিলেটকে শত্রুমুক্ত করা সম্ভব হত না।
ইতোমধ্যে খবর পেলাম প্রায় দুই প্লাটুন পাকিস্তানী সৈন্য শেরপুরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং এক প্লাটুন-এর বেশী সৈন্য শাদীপুর রক্ষা করেছে। সৈন্যদের সমাবেশ দেখে বুঝলাম এরা বড় রকমের যুদ্ধ করবে না। আরো খবর পেলাম, পাকিস্তানীদের কাছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান, তিন ইঞ্চি মর্টার, দুই ইঞ্চি মর্টার ইত্যাদি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আছে। লোকের আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। শেরপুর-শাহীদপুরের দুটো ফেরী ওদের কাছে আছে। কোন নৌকা এদিকে চলাচল করতে পারছে না। ওদের সঙ্গে একজন অফিসারও আছে জানতে পারলাম। যেভাবে হোক সিলেট আমাকে জয় করতে হবে।
৪ঠা এপ্রিল রাত আটটায় শেরপুরের কাছাকাছি প্রতিরক্ষারব্যূহ তৈরি করলাম। পরদিন আক্রমণ করব স্থির করলাম।
শেরপুরের প্রায় দেড় মাইল ডানে ও দেড় বাঁয়ে দুটো করে প্লাটুন পাঠান স্থির করলাম। গ্রাম বাসীদের বললাম যেন নৌকাগুলো ঠিক থাকে। রাতের অন্ধকারে সৈন্যরা চলল তাদের গন্তব্যস্থানে। বাকি সৈন্য নিয়ে মুখোমুখি আক্রমন চালাব এই স্থির করলাম। রাত প্রায় দশটায় আমরা কিভাবে শেরপুর-শাদীপুর আক্রমন চালাব তা সবাইকে বুঝিয়ে দিলাম- ডানে ও বাঁয়ের সৈন্যরা নদী পার হয়ে শত্রুদের ঘিরে ফেলবে এবং বাকি সৈন্যরা সম্মুখযুদ্ধে শত্রুদের ব্যস্ত রাখবে।
সকাল পাঁচটায় শেরপুরের সামনে আসতেই শত্রুরা গোলাগুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করল। পাল্টা জবাব আমরাও দিতে লাগলাম।
৫ই এপ্রিল। যতই বেলা বাড়তে লাগল গোলাগুলির আওয়াজ ততই বাড়তে লাগল। শত্রুরা তিন ইঞ্চি ও দুই ইঞ্চি মর্টার ও মেশিনগানের সাহায্যে আমাদের দিকে দু-একটা বাড়িতে আগুন ধরে গেল। গ্রামবাসীরা পালাতে আরম্ভ করল। সৈন্যদের বলেছিলাম, শত্রুরা যেন কিছুতেই নদী পার হয়ে এদিকে আসতে না পারে। বেলা প্রায় বারোটার সময় ওপারে দু’দিক থেকেই “জয় বাংলা” ধ্বনি শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম আমার সৈন্যরা শত্রুর কাছাকাছি চলে এসেছে। মাঝেমাঝে “ইয়া আলী” আওয়াজ ও শোনা যাচ্ছিল। তাতে বোঝা যাচ্ছিলো হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এই আওয়াজ আসার সঙ্গে সঙ্গে এপার থেকে গোলাগুলি ছোড়া বন্ধ করে দেয়া হল। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম আমার সৈন্যরা পৌঁছে গেছে এবং আমাদের হাতের ইশারায় ডাকছে। “জয় বাংলা” ধ্বনিতে পুরো শেরপুর গ্রাম মুখরিত হয়ে উঠলো।
ফেরীটা ভালই ছিল, তাড়াহুড়ার মধ্যে নৌকা এবং ফেরীগুলো নষ্ট করার সময় এবং সুযোগ শত্রুরা পায়নি। আমরা সবাই ওখানে গেলাম, সমস্ত সৈন্যকে আবার সংঘবদ্ধ করলাম এবং বললাম শেরপুর যেভাবে আমাদের দখলে এসেছে ঠিক সেভাবে শাদীপুরও দখল করতে হবে।
শত্রুদের গোলাগুলি আমাদের উপর আসতে শুরু হল। সময় নষ্ট না করে শাদীপুর দখলের জন্য হুকুম দিলাম। কাজ আরম্ভ হয়ে গেল। এদিকে পাকিস্তানীদের ১২টি মৃতদেহ এদিক-ওদিক থেকে পাওয়া গিয়েছিল এবং এদের সেখানই কবর দেয়া হয়েছিল। এই যুদ্ধে আমাদের তিনজন দেশের জন্য প্রাণ দিল। মৃতদেহগুলো মৌলভীবাজারে পাঠিয়ে দেয়া হল।
এদিকে খবর পেলাম তিন চারটা ট্রাক শাদীপুরে এসেছে। এর দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথম কারণ আরো পাকিস্তানী সৈন্য সিলেট থেকে এসেছে আর দ্বিতীয় কারণ সিলেটে পালাবার বন্দোবস্ত করেছে। যে টুকরো টুকরো খবর আসছিলো তাতে মনে হচ্ছিলো সিলেটে পালাবার বন্দোবস্তই করছিলো। যাই হোক, মানিক চৌধুরীকে তখনই খবর পাঠালাম মনুর দিক দিয়ে একটি কোম্পানীকে মৌলভীবাজার থেকে ট্রাকে করে শাদীপুরে পাঠিয়ে দিতে। যদি সিলেট থেকে শত্রুদের আরো সৈন্য এসে থাকে তাহলে আমার সৈন্যরা ঠিকমত যাতে মোকাবিলা করতে পারে এই ভেবে আমি মানিক চৌধুরীকে খবরটা পাঠালাম। এতে আমার দুটো লাভ হয়। প্রথমত- আমার সৈন্যসংখ্যা বাড়বে, দ্বিতীয়তঃ যদি শত্রুরা সিলেট থেকে সৈন্য পাঠায় তবে আমার সৈন্যসংখ্যাও এত বেশী হবে যে বরাবর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবো।
বেলা বাড়তে লাগলো। শত্রুদের গোলাগুলির আওয়াজও বাড়তে লাগলো। অন্ধকার হয়ে আসলো। দু’পক্ষে গোলাগুলি চলতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর শুনলাম “জয় বাংলা” ধ্বনি। এত জয়ধ্বনি হচ্ছিলো যে কিছুই বুঝা যাচ্ছিলো না কি হচ্ছে। গোলাগুলির আওয়াজ একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এবারও শত্রুরা ফেরী ও নৌকাগুলো নষ্ট করার সময় পায়নি।
নৌকা করে লোক যাওয়া আসা করতে লাগলো। শাদীপুর দখলে আসলো। আনন্দে মনটা ভরে উঠলো। খবরটা পাঠালাম মৌলভীবাজারে।
শত্রুদের পিছু ধাওয়া করা সমীচীন হবে না কারণ ওরা ট্রাকে করে পালিয়েছে। পায়ে হেঁটে তাদের ধরা সম্ভব না। তাই আমার সৈন্যদেরকে সংঘবদ্ধ করতে আরম্ভ করলাম। যে যেখানে আছে ওখানেই প্রতিরোধ গড়ে রাতের জন্য বিশ্রাম করতে হুকুম দিলাম। সুবেদার ফজলুল হককে ওর কোম্পানী নিয়ে শাদীপুরের প্রায় দুই মাইল আগে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বললাম। শত্রুরা কোথায় আছে খবর নিতে আরম্ভ করলাম।
এদিকে মৌলভীবাজারের মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে দেখা হয়। আমি তাকে বললাম যদি পারে একটা কোম্পানী পাঠিয়ে দিতে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা কোম্পানী নিয়ে আমার কাছে পৌঁছলো সিলেটের মেজর আজিজ। আমি তাকে পাঠিয়ে দিলাম কুলাউড়া-শেওলা-সাঁতারকান্দী-গোপালগঞ্জ হয়ে সিলেটের সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। এদিকে আমি শাদীপুর-সিলেটের রাস্তা শত্রুমুক্ত করে তার সঙ্গে সুরমা নদীর পাড়ে মিলিত হবো।
ক্যাপ্টেন আজিজের সৈন্য রাস্তায় বিনা বাঁধায় গোপালগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছলো। কিন্তু কদমতলীর (সিলেট থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে) কাছে যখন আসলো তখন শত্রুরা তার উপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করলো। যাই হোক, তার সমস্ত শক্তি দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করাতে শত্রুরা কদমতলী ছেড়ে সিলেটের দিকে পালিয়ে গেলো।
এদিকে খবর পেলাম বিশ্বনাথ এলাকায় রাস্তার দুপাশে শত্রুরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বিশ্বনাথ দখল করার প্রস্তুতি নিলাম। টুকরো টুকরো খবরে জানতে পারলাম বিশ্বনাথে শত্রুরা মাইন লাগিয়েছে এবং দু-একটা গরুও নাকি মারা গিয়েছে। এ খবরটা আমি আমার সৈন্যদের জানালাম না। যাই হোক সমস্ত শক্তি দিয়ে বিশ্বনাথের উপর আক্রমণ করলাম। এই যুদ্ধেও শত্রুরা সমস্ত শক্তি ব্যবহার করেছিল। তবে তাদের মনোবল ভেঙ্গে গিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে আমাদের আক্রমণে ওরা টিকতে পারল না এবং বিশ্বনাঠ ছেড়ে পালিয়ে একেবারে সিলেটে চলে গেল।
এদিকে ক্যাপ্টেন আজিজের সৈন্য শত্রুসৈন্যকে কদমতলী থেকে তাড়িয়ে সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করল।
৭ই এপ্রিল ১৯৭১ সন। সমস্ত সিলেট জেলা আমাদের দখলে আসল।
শত্রুরা এক জায়গায় একত্রিত হল। সিলেট বিমানবন্দর এবং চা-বাগানের আশেপাশে একত্রিত হয়। বুঝলাম এখন আমার কাছে যা সৈন্য আছে তা দিয়ে শত্রুদের উপর হামলা করা ঠিক হবে না, তাই জেনারেল রব ও মানিক চৌধুরীর কাছে আরো সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র চাইলাম।
৮ই এপ্রিল সকালে বসে আমি ও ক্যাপ্টেন আজিজ জল্পনা-কল্পনা করতে লাগলাম কি করে সিলেটকে মুক্ত করা যায়। এমন সময় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর লেঃ কর্নেল লিমাইয়া আসলেন এবং আমাকে বললেন শিলচরে যেতে। আমি বললাম, এক শর্তে আমি যাব যদি তিনি আমাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন। তিনি বলেন, তাই হবে। আমি তখনই তাঁর সঙ্গে শিলচর রওনা হয়ে গেলাম। রাত বারটা পর্যন্ত কি কর্মপন্থা আমরা অবলম্বন করব তা ঠিকঠাক করা হল, কিন্তু সেটা কার্যকরী হবার আগেই পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের উপর আক্রমণ করল। ভারতীয় সৈন্য আসার সৌভাগ্য হয়নি।
৯ই এপ্রিল পর্যন্ত পুরো সিলেট আমাদের দখলে রইল। আমার পরিকল্পনা ছিল বিমানবন্দর এবং লাক্কাতুরা চা-বাগান দখল করা। রাত প্রায় এগারটার সময় এক কোম্পানীকে পাঠিয়ে দিলাম খান চা-বাগানের দিকে। আর একটা কোম্পানীকে পাঠানো হল আখালিয়ার দিকে। আর দুই কোম্পানীকে নিয়ে লাক্কাতুরা চা-বাগান দিয়ে শালুটিকর বিমানবন্দর দখলের জন্য রওনা হলাম। ক্যাপ্টেন আজিজের উপর ভার দেয়া হল সুরমা নদীর দক্ষিণ পার অবরোধ করে রাখার।
১০ই এপ্রিল আমাদের উপর শত্রুরা প্রচণ্ড হামলা করল। শত্রুরা ইতিমধ্যে অনেক সৈন্য যোগাড় করেছিল। পুরোদিন যুদ্ধ চলল। আমাদের সৈন্যরা পাকিস্তানীদের আক্রমণের মুখে টিকতে পারল না। শত্রুরা সব রকম অস্ত্র ব্যবহার করল। আস্তে আস্তে আমার সৈন্যরা পিছু হটতে আরম্ভ করল এবং নদীর দক্ষিণ পাড়ে আসল। খাদিমনগরের কোম্পানী আসতে পারলে না। ওরা তামাবিলের (শিলং) দিকে চলে গেল। ওদেরকে আগেই বলা ছিল যদি আক্রমণ কৃতকার্য না হয় তাহলে ওরা যেন ক্যাপ্টেন মুতালিবের সঙ্গে (সে তামাবিলের দিকে যুদ্ধ করেছিল) মিলে যায়।
এসব যখন হচ্ছিল তখন আমি শিলচর থেকে অয়ারলেস যন্ত্রপাতি নিয়ে আসছিলাম। তখন এক দুর্ঘটনায় আমার গাড়ী উল্টে গিয়েছিল। সেদিন খুব সম্ভব ছিল ৮ই এপ্রিল। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি গাড়ী চালাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে একজন সিগন্যালমান ছিল। যখন কুলাউড়ার কাছে আসি তখন দুটো লোক আমার দিকে লক্ষ্য করে অস্ত্র ধরে এবং গুলি করার চেষ্টা করে। আমি তখন গাড়ীর স্পীড বাড়িয়ে দিলাম । কিন্তু রাস্তা খুব পিচ্ছিল ছিল এবং গাড়ীতে স্পীডও বেশী ছিল। আমার পায়ে-বুকে খুব আঘাত লেগেছিল। পরে জানা গিয়েছিল দুর্বৃত্তরা মুসলিম লীগের লোক ছিল।
যাই হোক, খোঁড়া পা নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতে আরম্ভ করলাম। তখনই একদিন জেনারেল ওসমানী এবং ব্রিগেডিয়ার পান্ডের সঙ্গে আমার মৌলভীবাজারে দেখা হয়। আমার এ অবস্থা দেখে লেঃ কর্নেল জামানকে সিলেট সেক্টরের ভার দেয়া হয় এবং আমাকে কিছু দিনের জন্য শেওলা-সুতারকান্দী-সিলেট এলাকার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হল। কর্নেল জামানকে উত্তর বঙ্গের একটা সেক্টরের পুরো দায়িত্ব আমাকে দেয়া হল। কর্নেল জামানকে উত্তর বঙ্গের একটা সেক্টরের কমান্ডার করে পাঠিয়ে দেয়া হল।
যাই হোক নদীর দক্ষিণ পাড়ে ভীষণ যুদ্ধ হলো। দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে আপ্রাণ যুদ্ধ করে যেতে লাগল। এদের উপর বিমান হামলা পর্যন্ত হয়েছিল। শত্রুদের এই আক্রমণের মুখে টিকতে পারল না। সৈন্যরা, ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন আজিজ পায়ে গুলি লেগে আহত হল। এবং আস্তে আস্তে ওরা মৌলভীবাজারের দিকে পিছু হটতে বাধ্য হল। বাকি সৈন্যরা গোলাপগঞ্জ-ঢাকা দক্ষিণের দিকে পিছু হটতে লাগল।
ইয়াকিনগঞ্জ-গোলাপগঞ্জে যা ছিল আমি প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করলাম। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি এখানে ভীষণ যুদ্ধ হয়। ইয়াকিনগঞ্জের যুদ্ধে সিলেটের বাঙালী এস-পি, যিনি পাকিস্তানীদের হয়ে কাজ করতেন, আমাদের হাতে ধরা পড়েন। পাকিস্তানীদের বাঙালীদের প্রতি দরদটা এই দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝা যাবে। পাকিস্তানীরা জানত না আমরা কত সৈন্য নিয়ে ইয়াকিনগঞ্জে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। আমাদের স্ট্যান্ডিং পেট্রল ইয়াকিনগঞ্জের প্রায় মাইল খানেক আগে ছিল। পাকিস্তানীরা সিলেটের বাঙালী এসপি সাহেবকে গোলাপগঞ্জে একটা অজুহাতে পাঠিয়েছিলেন। ইয়াকিনগঞ্জ-সিরেট সড়কে লোক চলাচল একবারে বন্ধ ছিল। শত্রুরা জানত যে সিলেট থেকে যদি কেউ গোলাপগঞ্জের দিকে যায় তাহলে তার রক্ষা নেই। ফায়ার খুললে একটি বাঙালী মরলে ওদের কিছু যায় আসে না। ওদের যা জানার দরকার তা জানতে পারলেই হলো। এসপি সাহেব স্ট্যান্ডিং পেট্রল পার হয়ে যখন মূল ডিফেন্সের মধ্যে আসল আমাদের ফায়ার খোলা হল চারদিক থেকে। তার জীপ দাঁড়িয়ে গেল। দেখালেন রুমাল। ফায়ার বন্ধ করে আমরা কয়েকজন গেলাম, ভাবলাম বড় শিকার পাব। কিন্তু আশ্চর্য! বাঙালী এসপি, কি করব, গুলি করে মারতে মনটা চাইল না। নিয়ে আসলাম ধরে। কত আকুতি-মিনতি করে বললাম, মশাই, পাকিস্তানীদের পা চাটছেন। ধরা পড়েছেন। তবে প্রাণে মাবর না, কারণে আপনি বাঙালী। হুকুম দিলঅম ওকে আমার হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেত। ওকে জেনারেল ওসমানী সাহেবের কাছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঠিয়ে দেই। ওর গাড়ীটা অবশ্য আমাদের লেগেছিল। আশ্চর্য, পরের দিনই রাতে শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমণ করল।
প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটকে বাধ্য হলাম। এমনকিভাবে গোলাপগঞ্জ-শেওলা-সুতারকান্দী যুদ্ধ করতে এপ্রিলের শেষের দিকে ভারতের করিমগঞ্জ এলাকায় এসে ট্রেনিং ক্যাম্প খুললাম। এদিকে দ্বিতীয় বেঙ্গল ও বাকি সৈন্যরা শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে আস্তে আস্তে মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল হয়ে ভারতের সীমান্তে জমা হতে লাগল।
—————————————————-