You dont have javascript enabled! Please enable it!

মধুপুর গড়ের যুদ্ধ
(‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

বিক্রমপুরের সুদূর গ্রামাঞ্চলে বসে ভারতীয় বেতারের প্রচারিত সংবাদ শুনছিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি সম্পর্কে আকাশবাণী ঘোষনা করছে, মংয়মনসিংহ জেলার মধুপুরগড়ে পাক সৈন্যদল আর মুক্তিবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে।

শতাধিক বছর আগে এই মধুপুর গড় আমাদের দেশের রাজনৈতিক আবর্তনের ইতিহাসের পাতায় একটু স্থান করে নিয়েছিল। আজকের দিনে আমাদের কাছে সেই ঐহিত্য হয়তো তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু সেদিন এই মধুপুর গড়ে একদল বিদ্রোহীর অভ্যূত্থান সারা বাংলার মানুষের মনে আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছিল। সেই বিদ্রোহ আকারে ছোট হলেও তখনকার দিনের বৃটিশ রাজপুরুষরা তাই নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল।

মংয়মনসিংহ শহর তথা মংয়মনসিংহ জেলা তখন মুক্ত অঞ্চল। কিন্তু তার উপর রাহু গ্রাসের ভয়াল ছায়া নেমে আসছে। দূর্দিন আসন্ন। হামলাকারী পাক-বাহিনী টাঙ্গাইল শহর হস্তগত করে মংয়মনসিংহ শহর দখল করবার জন দ্রুত বেগে ছুটে আসছে। তাদের এই অভিসন্ধিকে ব্যর্থ করতে হলে পথের মাঝখানেই তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। এই প্রতিরোধের ঘাটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মধুপুরই সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। মুক্তিবাহিনী স্থির করেছিল এইখানেই তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু প্রতিরোধ করবে কারা? প্রতিরোধের মূল শক্তি ইপিআর এর যোদ্ধারা এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে অন্য সেক্টরে চলে গেছে। তারা আসতে আসতে এই দুশমনরা মধুপুর ছাড়িয়ে চলে যাবে। অতএব অবিলম্বে তাদের বাধা দেওয়া দরকার। এই অল্প সময়ের মধ্যেই যেটুকু শক্তি আছে তাই নিয়ে তাদের প্রতিরোধ দিতে হবে।

মুক্তিবাহিনীর সংগঠকরা বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্রদের কাছে জরুরী ডাক পাঠালেন। সেই আহবানে সাড়া দিয়ে নানা জায়গা থেকে ২২ জন ছাত্র মধুপুর গড়ে এসে পৌঁছালো। এরা যুদ্ধ করার জন্য তৈরী হয়ে এলো বটে, কিন্ত এদের মধ্যে কেউ আগে থেকে অস্ত্র চালনায় অভ্যস্ত ছিল না। মাত্র দিন সাতেক আগে থেকে তারা ইপিআর-এর লোক বা প্রাক্তন সৈন্যদের কাছ থেকে রাইফেল চালনা শিখছিল। এইটুকু শিক্ষাই ছিল তাদের সম্বল। আর সম্বল ছিল অনিবার্ণ দেশপ্রেম ও দূর্জয় সাহস। একথা শুনলে কি কেউ বিশ্বাস করতে পারবে যে মাত্র ২২ জন অস্ত্র চালনায় অনভ্যস্ত ছাত্র সেদিন সেই দূর্ধর্ষ পাক-বাহিনীকে মোকাবেলা করতে দাঁড়িয়েছিল? একথা সত্য সত্যই বিশ্বাস করা কঠিন। তাহলেও এটাই ছিল বাস্তব ঘটনা।

১৩ই এপ্রিল তারিখে প্রথম সংঘর্ষ ঘটলো। দুপক্ষের মধ্যে গুলিবর্ষন চলল। ২২টি রাইফেল শত্রু পক্ষের মেশিনগানের জবাবে চলেছে। ছাত্ররা বনের আড়ালে আত্মগোপন করে যুদ্ধ করছিল। শত্রুপক্ষের প্রবল গুলিবর্ষণ সত্ত্বেও তাদের মধ্যে একজনও নিহত বা আহত হয়নি। পরে জানা গিয়েছিল এই দিনের যুদ্ধে প্রতিপক্ষের একজন ট্রাক-ডাইভার ও একজন জীপ ড্রাইভার মারা গিয়েছিল। বেশ কিছুটা দূর থেকে গুলি বিনিময় চলছিল। এইভাবে বাধা পেয়ে পাক-সৈন্যরা অবস্থা পরিবর্তনের জন্য থমকে দাড়িয়ে পড়লো। তাদের অগ্রগতি সেদিনের মতো স্থগিত হয়ে গেল। প্রতিরোধকারীদের পক্ষে এটি একটি বিরাট সাফল্য। মাত্র ২২ জন ছাত্রের এই বাহিনী শক্তিশালী শত্রুদের হাত থেকে এই সাফল্যকে ছিনিয়ে নিয়ে এলো। এসব ক্ষেত্রে প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘন্টা অত্যন্ত মূল্যবান। পরদিন ১৪ই এপ্রিল তারিখে এখান থেকে জরুরী ডাকে দুই ট্রাক বোঝাই ৫০/৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছে গেল। এদের মধ্যে অস্ত্র চালনায় শিক্ষিত ও অভ্যস্ত যোদ্ধারা ছিল। তাদের সঙ্গে রাইফেল ও হালকা মেশিনগানও ছিল। এদের পেয়ে এখানকার প্রতিরোধ বাহিনী এবার এক শক্তিশালী বাহিনী হয়ে দাঁড়ালো।

১৪ এপ্রিল সারাদিন ধরে দুপক্ষের প্রচণ্ড যুদ্ধ চলল। শেষ পর্যন্ত এদের প্রতি আক্রমন সহ্য করতে না পেরে সুশিক্ষিত ও আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত পাক-সৈন্যরা প্রাণ বাচাঁনোর জন্য উর্ধ্বশ্বাসে পেছন দিকে ছুটলো। ছুটতে ছুটতে তারা পিছনে ফেলে আসা কালিহাতী, ঘাটাইল অঞ্চলে গিয়ে থামলো। প্রতিরোধকারী মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হয়ে পাক সৈন্যদের পরিত্যক্ত ঘাটিতে গিয়ে দেখলো যে, সেখানে শত্রুপক্ষের সৈন্যদের মৃতদেহগুলি ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে আছে। শত্রুরা প্রাণভয়ে পালাবার সময় কতগুলি অস্ত্রশস্ত্র ফেলেই চলে গেছে। ফলে তাদের পরিত্যক্ত একটি ট্রাক, একটি জীপ, ৪০টি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ১৫০ বাক্স মেশিনগানের গুলি, কতগুলি মর্টার শেল এবং কয়েক গ্যালন তেল মুক্তিবাহিনীর হাতে এসে গেল।

মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে এভাবে তারা খেয়ে পালিয়ে এসে পাক-সৈন্যদলের পরিচালকরা নতুনভাবে চিন্তা করতে লাগলো। তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। প্রতিপক্ষ তাদের চোখের আড়ালে। আক্রমনের প্রবলতা দেখে তারা মনে করেছিল এক বিরাট সৈন্যদল তাদের পথরোধ করে দাড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু কার্যত মুক্তিযোদ্ধাদের মোট সংখ্যা ১০০ জনও হবে না।

বেতারে সংবাদ গিয়ে পৌছালো ঢাকায়। সঙ্গে সঙ্গে একটি বোমারু বিমান এসে বনের মধ্যে আত্মগোপনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বোমা ফেলতে লাগলো। বোমারু আক্রমনের গর্জনে আর বিস্ফোরনের শব্দে রণক্ষেত্র ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো। কিন্তু তাদেও ভয় পেলো না মুক্তিযোদ্ধারা। ভয় পেলো না সেই সমস্ত সহায়তাকারী সাধারণ মানুষেরা যারা পিছন থেকে মুক্তি যোদ্ধাদের রসদ যুগিয়ে চলেছিল। শত্রুপক্ষ অনেক চেষ্টা করেও প্রতিরোধ ব্যূহে ভাঙ্গন ধরাতে পারলো না। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন পণ করে সঙ্কল্প নিয়েছিল যে তারা কিছুতেই ওদের পথ ছেড়ে দেবে না। তাদের এই সঙ্কল্প শেষ পর্যন্ত অটুট ছিল। তারা পথ ছেড়ে দেয়নি। পাক সৈন্যরা বেগতিক দেখে এ পথ ছেড়ে দিয়ে অন্য পথ ধরতে বাধ্য হয়েছিল।

এই মধুপুরের যুদ্ধের শেষ পরিণতি ঘটল।

—————————————————–

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!