রণাঙ্গন থেকে
ঢাকা জেলার গ্রামে গ্রামে গেরিলা মুক্তি যােদ্ধারা প্রাণপণ লড়িতেছেন। গত মাসের শেষ সপ্তাহে নবাবগঞ্জ থানার রাজাকারদের খতম করিয়া গেরিলারা প্রথমে অস্ত্রশস্ত্র হাত করে। হানাদার ঐ থানায় ঘাটি করিয়া পাহারায় বসে। একদিন গভীর রাতে বীর গেরিলারা চারিদিক আক্রমণ করিয়া ১০ জন শত্রুসৈন্য খতম করে ও ৩৯ জন রাজাকারকে বন্দী করে। এবারও গেরিলারা প্রচুর অস্ত্রপাতি পায়। থানাটিও ভস্মীভূত করে। এই থানায় সতীর তীরে শত্রুসেনা বােঝাই একটি লঞ্চের উপর আক্রমণ করিয়া গেরিলারা ৩ জনকে খতম করে। কিছুদিন আগে পাকিস্তানী সৈন্যরা দোহার থানায় মেঘলা বাজার লুট করিতে যায়। গেরিলারা সামনে পিছে দুই দিক হইতে আক্রমণ করিয়া ১২ জনকে খতম করে এবং অস্ত্র ও রসদ বােঝাই দুইটি নৌকা দখল করে।
গেরিলারা আরও ৫ জন দালালকে খতম করিয়াছে। ইহারা হইল দোহার থানার রানাঘাট গ্রামের শান্তি কমিটির লােক আবদুল ব্যাপারী ও তাহার পুত্র সদাগর ডাকাত, কুদুস মােল্লা, হােসেন মােল্লা ও জয়পাড়ার রজব আলী। কুমিল্লা ১লা অক্টোবর কোম্পানিগঞ্জের কাছে শত্রুদের নৌকার উপর আক্রমণ করিয়া গেরিলারা ৮ জন হানাদারকে খতম করে। এই সংঘর্ষে আবদুস সামাদ নামে একজন তরুণ গেরিলা শহীদ হন। গত মাসে গেরিলারা ফরিদগঞ্জ থানায় চিতােলিতে শত্রুদের ঘাটি আক্রমণ করিয়া হানাদার সেনা ও রাজাকার লইয়া ৩৬ জন শত্রুকে খতম করে। বর্বর জল্লাদরা ইহার প্রতিশােধ লইবার জন্য চিরােলি বাজার ধ্বংস করে ও গ্রামবাসীদের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়। লালমণির হাট উত্তর বাংলার রেল ও বিমান যােগাযােগের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র লাল মণিরহাটে জোর লড়াই চলিতেছে। গত ১০ই অক্টোবর শহর হইতে ৬ কিলােমিটার দূরে তােলাবাড়ি হাটে এক সংঘর্ষে মুক্তি বাহিনী পাক সেনাদের ১৭ জনকে খতম করিয়া ১০টি রাইফেল, ৩টি চীনা অটোমেটিক রাইফেল, ২টি স্টেনগান ও ৩টি লাইট মেশিনগান দখল করে। . সম্প্রতি লালমণিরহাট থানায় পূর্বাঞ্চলের কুলাঘাট, বড়বাড়ি ও পঞ্চগ্রাম ইউনিয়ন হইতে হানাদারদের বিতাড়িত করিয়া গেরিলারা মুক্ত করিয়াছে। এই সব মুক্তাঞ্চলে গেরিলারা অনেক লুঠ করা। মাল উদ্ধার করিয়া স্ব স্ব মালিককে ফিরাইয়া দেয়। | গেরিলাদের সাথে জনগণও সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিতেছে। সম্প্রতি লালমণির হাট রইসবাগ ও আদিতমারি কাদিনগর মধ্যবর্তী ২ মাইল রেল পথে গেরিলা ও হাজার হাজার কৃষক জনতা। মিলিয়া সাবল কোদাল দিয়া লাইন, শ্লিপার পাথর তুলিয়া ফেলিয়াছে এমন কি মাটি কাটিয়া সমান করিয়া দিয়াছে। সেখানে রেলপথের চিহ্ন মাত্র নাই।
লালমণির হাটে পাক সেনাদের পা-চাটা আরও কয়েকটি ঘৃণ্য জীব খতম হইয়াছে। ইহারা হইল কুলাঘাট ইউনিয়নের দালাল চেয়ারম্যান হাজী করিম ও চৌকিদার উপাসু, রাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান ও অপর একজন টাউট ও মজুতদার। লালমণিরহাট ও শহরের কুখ্যাত গুণ্ডা সর্দার সম্প্রতি নিজের বাড়িতে ১০ জন চ্যালাচামুণ্ডা সহ খতম হইয়াছে। গত এপ্রিল মাস হইতে নরহত্যা হইতে নারী নির্যাতন পর্যন্ত সকল সৎকর্মেই ইহারা হানাদার পশুদের অনুগত সহচর ছিল।
রংপুরের মুক্ত থানা ফুলবাড়ি । রংপুর জেলার ফুলবাড়ি থানা জনগণের বীরত্বপূর্ণ ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ফলে শত্রু মুক্ত রহিয়াছে এবং গেরিলাদের একটি দুর্জয় ঘাটি রূপে গড়িয়া উঠিয়াছে। বাঙলাদেশে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রথম হইতেই এই থানাটি কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মুক্ত সংগ্রাম পরিষদ জনতাকে নেতৃত্ব দিয়া আসিতেছে ও কয়েক হাজার কৃষক ছাত্র যুবককে সংগঠিত করিয়া মুক্তি বাহিনীতে পাঠাইয়াছে। এই সংগ্রাম পরিষদ যুদ্ধ, পুনর্বাসন ও প্রশাসন চালাইতেছে। কিন্তু দুর্ভিক্ষ ক্রমেই এখানে কালাে ছায়া বিস্তার করিতেছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের থানা কমিটির সম্পাদক ইউনুস আলীকে সভাপতি ও ন্যাপের থানা কমিটির সম্পাদক বদরুজ্জামানকে সম্পাদক করিয়া একটি সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি’ গঠিত হইয়াছে। তাহারা সংবাদপত্রে এক বিবৃতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সােসাইটি, ভারতীয় রেডক্রস সােসাইটি ও মহান সমাজতান্ত্রিক দেশ সমূহের প্রতি মুক্তাঞ্চলে সাহায্যের জন্য আবেদন জানাইয়াছেন। গেরিলা কৌশল নওগাঁর উত্তরাংশে চকরামপুর গ্রামে একটি সড়ক সেতু এক দল রাজাকার পাহারা দিতেছিল। গেরিলারা উহাদের প্রতি গুলি ছুড়িলে উহারা অন্যত্র আশ্রয় নেয়। তখন গেরিলারা বিস্ফোরক দিয়া পুলটি উড়াইয়া দেয়। | নিকটস্থ শত্রুঘাটি হইতে ৩১ জন পাক সেনা ও একদল রাজাকার আগাইয়া আসে। গেরিলারা দুই দলে ভাগ হইয়া পড়ে। পাক সেনারা একটি দলের উপর আক্রমণ করিলে অন্য দলটি বাকী তিন দিক হইতে পাক সেনাদের উপর আক্রমণ করে। এই ভাবে পাক সেনারা গেরিলাদের চক্রব্যুহের মধ্যে পড়িয়া যায়। এখানে ১২ জন পাক সেনা ও কয়েক জন রাজাকার খতম হয়। মুক্তি যােদ্ধাদের পক্ষে কিছুই ক্ষতি হয় নাই। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে মালঞ্চা ও পাহাড়পুরে হানাদারদের সহিত গেরিলাদের এক দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে ৭৫ জন শত্রুসেনা ও ১২ জন রাজাকার খতম হয়।
মুক্তিযুদ্ধ। ১ :
১৬ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯