বিউটি অফ খুলনা মুক্তিবাহিনীর হস্তগত
কুষ্টিয়া-যশােহর ও খুলনা রণাঙ্গণ। ২৪শে অক্টোবর, দুঃসাহসিক মুক্তিযােদ্ধারা খুলনার “চাউলা-হাসানের “বিউটি অফ খুলনা” লঞ্চখানার কোন এক গ্রাম থেকে হাইজ্যাক করে মুক্তাঞ্চলের মুক্তি বাহিনীর ঘাটিতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া খুলনার দু’জন কুখ্যাত মুসলিম লীগ দালালকে বন্দী করে নিয়ে এসেছেন । উক্ত দালাল দু’জন। বন্দী হওয়ায় স্থানীয় গ্রামের জনগণ এদিনে নির্যাতন থেকে মুক্তি পেল। এজন্য জনগণ মুক্তি বাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। | ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, উক্ত দালাল দুজন লঞ্চযােগে খুলনা যাচ্ছিল রাজাকার এবং পাকসেনা। নিয়ে আসতে, এই সংবাদ পেয়ে একদল মুক্তিবাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে এই সাফল্য অর্জন ১৫ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর এক অতর্কিত প্রবল আক্রমণে রহেশকান্দি এলাকায়-পাকবাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনীর এক অতর্কিত আক্রমণে ১০জন পাক সেনা খতম হয় । ১৪ই অক্টোবর ভগজ্যোতি
ও সুকালিয়া অঞ্চলে পাক হানাদার বাহিনীর ঘাটিতে মুক্তিযােদ্ধারা একপ্রবল আক্রমণ পরিচালনা করেন। এবং এ আক্রমণ ২০ জন শত্রুসৈন্য নিহত হয়। সাদিপুর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা টহলদার পাক হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়েন এবং ৫জন হানাদার শত্রুকে খতম করতে সমর্থ হন। মুক্তিবাহিনী বকসা এলাকায় পাক টহলদার বাহিনীর উপর এক আক্রমণে ৪ জন পাকসেনা খতম এবং ৬ জনকে গুরুতররূপে আহত করেন। ১৩ই অক্টোবর মাদনা এলাকায় অসমসাহসী গেরিলা বাহিনীর প্রবল আক্রমণে ৪ জন পাক হানাদার খতম এবং ৭জন গুরুতররূপে আহত হয়। অপর বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় ৯ই অক্টোবর খুলনা জেলার অন্তর্গত বাগেরহাট মহকুমায় পাক। আক্রমণকারীরা মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হয় এবং এই বীরত্বপূর্ণ আক্রমণে একজন। অফিসার সহ ১০ জন পাক আক্রমণকারী শত্রুসৈন্য নিহত ও অনেকে গুরুতররূপে আহত হয়। মুক্তিবাহিনী এখন থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র দখল করেন।
অন্যান্য রণাঙ্গনের বার্তাঃ যশােহরের অন্তর্গত ফকিরহাট থানার কুলকাঠি হাইস্কুলস্থিত পাক সামরিক ঘাঁটির মুক্তি বাহিনীর বীর যােদ্ধাদের এক অতর্কিত আক্রমণে ১৫ জন পাক সেনা খতম হয়। মুক্তি বাহিনী এ অঞ্চল হতে ২০টি ৩০৩ রাইফেল এবং প্রচুর পরিমাণে গােলাগুলি দখল করেন। রামপাল সড়কে মুক্তি বাহিনী ও পাক টহলদার বাহিনীর মধ্যে ৬ ঘন্টা ব্যাপী এক প্রবল সংঘর্ষ হয় এবং শেষ পর্যন্ত এক প্লাটুন’ পাক সেনাকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে মুক্তি বাহিনী ১৫ জনকে খতম করেন এবং ১০টি ৩০৩ রাইফেল ছিনিয়ে নেন। ১৮ই অক্টোবর মুক্তি বাহিনীর অপর এক আক্রমণে ময়মনসিংহ জেলার রথরামারি অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর একজন জে-সি-ও সহ ২০ জন শত্রুসৈন্য নিহত হয়। নেত্রকোণা মহকুমার বড়হাটা এলাকায় মুক্তি বাহিনীর নৌ- যােদ্ধারা পাক আক্রমণকারিদের দুখানা স্পীড বোের্ড’ ডুবিয়ে দেন। পাক বাহিনীর অনেক সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র এখানে পানিতে নিমজ্জিত হয়। বিলম্ব প্রাপ্ত অপর এক খবরে জানা যায়- টাঙ্গাইল আকাশ্রী এলাকায় অসমসাহসী মুক্তি যােদ্ধাদের এক অতর্কিত আক্রমণে ২০ জন পাক সেনা খতম এবং ২৫ জন পাক সেনা খতম এবং ২৫ জন গুরুতর রূপে আহত হয়। এ অঞ্চলে থেকে ১৮ জন রাজাকার মুক্তি বাহিনীর কাছে তাদের অস্ত্রশস্ত্র সহ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন।
রাজাকার কম্যান্ডারের আত্মসমর্পণ রংপুর দিনাজপুর রাজশাহী রণাঙ্গন : ৯ই অক্টোবর পুখিলগাঁও অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ৩ জন পাকসেনা খতম হয়। আদিতমারির উত্তরাঞ্চলে ভূতেশ পূর পাক ঘাটি মুক্তিবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং এই আক্রমণে তিনজন পাকসেনা নিহত ও পাঁচজন গুরুতরভাবে আহত হয়। ৯ই অক্টোবর। গাইবাধা অঞ্চলে মুক্তি বাহিনীর কাছে বিপুল সংখ্যক রাজাকার আত্মসমপর্ণ করে। এ ছাড়া রংপুর জেলার হলিদাবাড়ি অঞ্চলের রাজাকার কমাণ্ডার হাবিবুর রহমান মুক্তিবাহিনীর কাছে অনেক অস্ত্রশস্ত্র সহ আত্মসমপর্ণ করতে বাধ্য হয়। ১৬ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর মর্টার আক্রমণে দিনাজপুর জেলার ভাওয়ালগঞ্জ অঞ্চলের পাক ঘাটির বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়- এই আক্রমণে ১৭ জন শত্রুসৈন্য নিহত হয়। এই দিন রাত্রে অপর এক আক্রমণে কালার অঞ্চলে পাক হানাদার বাহিনীর ১০ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী নিজেদের মুক্তাঞ্চলে প্রত্যাগমনের পথে মুরাদপুর অঞ্চলে পাক আক্রমণকারীদের সাথে এক মুখােমুখি সংগ্রামের সম্মুখীন হন; দীর্ঘসময় প্রবল গুলিবর্ষণের পর পাকবাহিনী ছিন্নবিছিন্ন হয়ে যায় এবং একজন ক্যাপ্টেন সহ ১৫ জন আক্রমণকারী পাক সেনা খতম হয়। পাঁচবিবি অঞ্চলে অপর এক আক্রমণে মুক্তিবাহিনী ১৬ জন পাক শত্রুসৈন্য এবং পাঁচজন রাজাকারকে খতম করেন। গত ১৩ই ও ১৭ই অক্টোবর মুক্তি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ১০ জন পাকসেনা ও তাদের সাহায্যকারী ৪ জন রাজাকার খতম হয়। দিনাজপুর অঞ্চলে ১৫ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ভীত সন্ত্রস্ত ২০ জন। রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র সহ আত্মসমর্পণ করে।
রেল যােগাযােগ বিছিন্ন ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্ট রণাঙ্গণ : ময়মসিংহ জেলার হাতিবাগান অঞ্চলে পাক সৈন্যের উপর মুক্তি বাহিনীর এক প্রবল আক্রমণে ২০ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। ৯ই অক্টোবর মােহনগঞ্জে মুক্তিযােদ্ধাদের এক অতর্কিত আক্রমণে চারজন শক্রসেনা খতম হয়। ১০ই অক্টোবর ফুলপুর ও হালুয়াঘাটের মধ্যকার সড়ক পথে চলন্ত এক পাক সৈন্যবাহিনীর শকট মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং এই আক্রমণে চারজন পাকসেনা খতম হয়। ৮ই অক্টোবর জামালপুর ও বাদুরাবাদঘাটের মধ্যকার যােগাযােগ ব্যবস্থা মুক্তিবাহিনী সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কেন্দুয়া ও কালী বাড়ীর মধ্যকার সেতুটি মুক্তিবাহিনী বিনষ্ট করেন এর ফলে জামালপুরও সরিষাবাড়ী অঞ্চলে র রেল যােগাযােগ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সিলেটের জামালপুর অঞ্চলে থেকে ৪০ জন রাজাকার প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১৪ই অক্টোবর দুর্গাপুর ও নাজিরপুর অঞ্চলে পাক টহলদার সৈন্য মুক্তিবাহিনীর বীর সেনাদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং দুজন পাক শত্রুসৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী এই অঞ্চলে কিশােরগঞ্জ ও ময়মনসিংহের মধ্যকার টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন করে দেন। মুক্তিবাহিনীর কৌশলী গেরিলা ১৩ অক্টোবর গৌরীপুর থানা আক্রমণ করে বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র দখল করেন। বিলম্বেপ্রাপ্ত অপর এক খবরে জানা যায় টাঙ্গাইল জিলার মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়।
গােপালপুর থানায় মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণে ২৫ জন হানাদার পাকসেনা নিহত হয়। ঢাকায় কালিয়াপুর অঞ্চলে রাজাকারদের ঘাটি মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ময়মনসিংহের সরিষাবাড়ী হতে ৬০ জন রাজাকার মুক্তি বাহিনীর কাছে তাদের অস্ত্র-শস্ত্র সহ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ঢাকা ও টাঙ্গাইল সড়ক পথের মধ্যকার অনেকগুলাে সেতু মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ধ্বংস করে দেন এবং এর ফলে উপরিউক্ত সড়কের যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। ময়মনসিংহ জেলার কুড়িগ্রাম ও কামারগাঁও অঞ্চলে ১৪ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর কাছে ১৬ জন রাজাকার তাদের রাইফেল সহ আত্মসমর্পণ করে। কেন্দুয়া ও ধর্মপাশা অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর অসমসাহসী গেরিলাদের আক্রমণে ৭ জন পাক শত্রুসৈন্য নিহত হয়। বিলম্বেপ্রাপ্ত অপর এক খবরে জানা যায় যে, ৪ঠা অক্টোবর কিশােরগঞ্জের নিকটস্থ একটি বাজারে পাক হানাদার বাহিনীকে মুক্তি যােদ্ধারা গ্রেনেড দ্বারা আক্রমণ করেন এবং ৫ জন হানাদারকে খতম করেন। মুক্তিবাহিনীর শহর প্রদক্ষিণ । চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বরিশাল শহরের প্রধান সড়কগুলি অসংখ্য সশস্ত্র মুক্তি বাহিনীর পথ পরিক্রমায় মুখরিত হয়ে ওঠে। বিস্তারিত খবরে প্রকাশ বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলে সমবেত মুক্তি বাহিনী শহরের সন্নিকটে কোন এক ময়দানে সমবেত হন এবং সন্ধ্যাবেলায় প্রায় এক সহস্ত্র মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র সেনানী পাক বিরােধী বিভিন্ন ধ্বনি সহকারে শহরের কয়েকটি প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। হানাদার বাহিনী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে এসময়ে ছাউনিতে আশ্রয় গ্রহণ করে। শহরের কোন এক সড়কে পাহারারত ৭ জন হানাদার শত্রুসৈন্য মুক্তি বাহিনীর হাতে খতম হয়। বিলম্বে প্রাপ্ত এক খবরে জানা গেছে যে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিবাহিনী বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ নামক স্থানে পাক সেনাদের দুখানা লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়। এ সংঘর্ষে ১৯ জন পাকসেনা খতম হয়। এখানে উল্লেখযােগ্য যে মেহেন্দীগঞ্জ থানার প্রায় সকল রাজাকার ও পাক দালাল বহু পূর্বেই খতম করা হয়েছে- মেহেন্দীগঞ্জ থানার সমুদয় অঞ্চল মুক্তি বাহিনীর দখলে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ১: ১০
২৪ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯