দিনাজপুর রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্যে প্রধান মন্ত্রী তাজুদ্দীনের ভাষণ
বাংলাদেশের চূড়ান্ত মুক্তির দিন সমাগত প্রায়।
(বিশেষ প্রতিনিধি) দিনাজপুর রণাঙ্গনঃ গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, বাংলার জাগৃতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রচারিত বাঙালী জাতীয়তাবাদ রক্ষা এবং হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য সাড়ে সাত কোটি বাঙলী আজ জল্লাদ পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে এক মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন। এবং তাদের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন সমাগত প্রায়। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বিগত ১৩ই অক্টোবর দিনাজপুর রণাঙ্গনের একটি যুব ক্যাম্পে তিন হাজার শিক্ষাপ্রাপ্ত মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছিলেন। | প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিদের মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে বিগত ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়ার হিংস্র হায়েনা বাহিনী নিরপরাধ নারী, পুরুষ ও শিশুর রক্ত আর লাশের নিচে চাপা দেওয়ার নৃশংসতম প্রচেষ্টা চালানাের পর বাংলার ছাত্র, যুবক, কৃষক এবং আপামর জনসাধারণ সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করতে বাধ্য হয়েছে।
তিনি বলেন, বাঙালিদের অস্তিত্ব, মৌলিক ও মানবিক অধিকার এবং পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের এই যুদ্ধ। এই জনযুদ্ধে আমরা অবশ্যই বিজয়ী হবাে। জনাব তাজউদ্দীন আবেগ জড়িত কণ্ঠে মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি ভূমিকে বর্বর কসাই বাহিনীর বধ্যভূমিতে পরিণত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর কমান্ডােদের মৃত্যুশীতল কাঠিন্য ও দুর্জয় মনােবল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহবান জানান। জনাব আহমদ রক্তাক্ত মুক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ স্বাধীনতার সূৰ্য্য সৈনিকদের সর্বপ্রকার বিভেদ বিস্মৃত হয়ে প্রত্যেককে মুক্তিযােদ্ধা’ এই গৌরবােজ্জ্বল পরিচয়ে চিহ্নিত হওয়ার জন্য আবেদন জানান।
তিনি বলেন, জাতীয় ইতিহাসের এই যুগ সন্ধিক্ষণে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের মরণজয়ী মুক্তি সংগ্রামের রক্ত পিচ্ছিল পথ রাজনৈতিক স্বাধীনতার কালিমায় কলঙ্কিত হওয়াও উচিত নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, হানাদার বাহিনী মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমই আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন আমরা জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি। অনুসরণ করে যাবাে। স্বাধীনতার অগ্নিশপথে বলীয়ান মুক্তিযােদ্ধারা তার বক্তৃতার মাঝে মাঝেই উদাত্ত কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে সমগ্র এলাকা প্রকম্পিত করেন। পরে তিনি আহত মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থা ব্যক্তিগতভাবে। অবলােকনের জন্য হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।
হাসপাতালে রংপুরের রণাঙ্গনে আহত সৈনিক হাসান তােরাবের সাথে তিনি কথা বলেন। মুক্তিযােদ্ধা তােরাব যুদ্ধে তার ডান হাত এবং বাম চোখ হারিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী একদিকে গর্ব এবং অন্যদিকে অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে যখন তােরাবকে জিজ্ঞাসা করেন যে, তিনি তার (প্রধানমন্ত্রী) কাছে কিছু চান কিনা তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর বাম হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আবেগ-বিহ্বল কন্ঠে বলন, প্লাস্টিক সার্জারি দ্বারা আমার হাতটি ঠিক করে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। হাত ঠিক হলেই আবার আমি যুদ্ধে যাবাে। এবং আমার বলিষ্ঠ কজি আবার শত্রু হত্যার কাজে ব্যাপৃত হবে। এ ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার। নেই।” পূর্বাহ্নে জনাব তাজউদ্দীন রংপুর জেলার তেঁতুলিয়া রণাঙ্গনের বেশ কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এখানকার অসম সাহসী মুক্তিবাহিনী ৭০টি গ্রাম মুক্ত করেছে। এই বিস্তার্ণ এলাকায় তিন লাখ লােক বসবাস করছে। তিনি দিনাজপুর ও রংপুরে বেশ কয়েকটি জনসভায়ও বক্তৃতা করেন।
জয়বাংলা (১) ১ : ২৪
২২ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯