You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | মুজিবের পতন : জিয়ার উত্থান | মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপন দলিল - জগলুল আলম - সংগ্রামের নোটবুক

মুজিবের পতন : জিয়ার উত্থান | মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপন দলিল – জগলুল আলম

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের শাসনভার হাতে নেয়ার পর দেশের অবস্থা ক্রমান্বয়ে স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। ১২ মার্চ থেকে ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ ত্যাগ করতে শুরু করে এবং ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশ-ভারত ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভারতপন্থী ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। জাতির সেই ক্রান্তিলগ্নে ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার পর জনগণের মধ্যে উন্নাসিকতার চাইতে আবেগপ্রবণতাই ছিল বেশি। কারণ ভারতের সাহায্যে স্বাধীনতা অর্জনের পর সকলের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবেই এ ধারণা বিরাজ করছিল যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবেই বিবেচিত হবে।

ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি সংস্থাপনের পর বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি বলতে গেলে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তিনদিকে ভারত পরিবেষ্টিত অবস্থায় বাংলাদেশের একমাত্র সীমান্তগত প্রতিপক্ষ ছিল ভারত এবং শক্তি ভারসাম্যের দিক দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করার প্রশ্নটি ছিল বাহুল্য মাত্র। নেপাল কিংবা বার্মার সঙ্গে বাংলাদেশের যে যৎসামান্য সীমানা ছিল তা নিয়ে বিরােধের অবকাশ ছিল খুবই কম। অন্যদিক দিয়ে চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের ওপর সরাসরি। কোনাে হুমকির সম্ভাবনা ছিল না। কারণ চীন-বাংলাদেশ দ্বন্দ্বে চীনকে বাংলাদেশে আসতে হতাে ভারত বা বার্মার ওপর দিয়ে বিশাল পথ অতিক্রম করে অথবা বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন করে। তা ছাড়া চীন তার পাকিস্তানপন্থী। মনােভাবের কারণে বাংলাদেশকে অনেকদিন পর্যন্ত স্বীকৃতি না দিলেও বাংলাদেশে চীনপন্থী রাজনীতির ক্রমবিকাশমান ধারার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিকভাবে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনাে বিরােধ ছিল না।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে অন্য যে কোনাে সাহায্যের চাইতে বাংলাদেশের খাদ্য সাহায্য, ত্রাণ, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের জন্য অর্থনৈতিক

পৃষ্ঠা: ২২১

সাহায্যেরই তাৎক্ষণিক প্রয়ােজনীয়তা ছিল। স্বাধীনতার দেড় বছর পরে ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সাহায্যের পাশাপাশি সামরিক সাহায্যের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে। আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের কোনাে সামরিক চুক্তি না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় সামরিক সম্ভারের। একটি তালিকা পাঠিয়ে বাজার অনুসন্ধানের লক্ষ্যে একটি চিঠি পাঠানাে হয়। আমেরিকা সেই তালিকা অত্যন্ত বিরক্তি এবং বিব্রতকর অবস্থায় গ্রহণ করে। কারণ, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচারে বাংলাদেশের সামরিক সম্ভারের কোনাে প্রয়ােজনীয়তা ছিল না। তালিকায় ফাইটার এয়ারক্রাফটের কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু আমেরিকা ধারণা করে নেয় যে সামরিক কোনাে উচ্চাভিলাষী মহল নিজেদের মানসিক সন্তুষ্টির জন্য তালিকাটি পাঠিয়েছে এবং এ মুহূর্তে বাংলাদেশের এমন কোনাে প্রয়ােজনীয়তা নেই যে সামরিক সম্ভারের জন্য তাদের বাজার অনুসন্ধান করতে হবে।

২৭ আগস্ট ১৯৭৩ বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ড্যানিয়েল নিউবাের স্টেট ডিপার্টমেন্টের পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের পরিচালক পিটার কনস্টেবলের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠানাে একটি চিঠিতে বলেন যে, সােভিয়েতরা ইতােমধ্যেই বাংলাদেশের কাছে মিগ বিমান পাঠিয়ে দিয়েছে যা শেখ মুজিবুর রহমানকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। বাংলাদেশকে একসময় এই মিগের দাম পরিশােধ করতে হবে এবং সে ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। যেহেতু বাংলাদেশের মিগ বিমানেরই প্রয়ােজন নেই সেহেতু তাদের পুরনাে এফ-৮৬ সরবরাহ করারও প্রয়ােজন নেই। যখন বাংলাদেশ খাদ্যের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে এবং আমেরিকা যখন তার প্রতিশ্রুত ভােজ্যতেলই সরবরাহ করতে পারেনি, তখন এফ-৮৬ বা স্পেয়ার পার্টসের জন্য লাইসেন্স ইস্যু করার কোনাে যৌক্তিকতা রয়েছে বলে মনে হয় না।

তিনি বলেন,

দু’জন মেজর এসে যে তালিকাটি দিয়ে গেছেন, তারা আবার ফিরে আসবেন বলে মনে হয় না। আর যদিও আসেন তা হলে তাদের বলে দেয়া হবে যে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে মন্ত্রীপর্যায়ের ব্যক্তির লিখিত অনুরােধ ছাড়া এ ধরনের আবেদন আর গ্রহণ করা হবে না।১

২৮ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তানের বন্দি বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যর্পণে ভারত সম্মত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা অফিসার ও বেসামরিক সদস্যের বিচারের ব্যাপারে চুক্তিতে কোনাে উল্লেখ ছিল না। চুক্তিতে বলা হয় যে, মানবতা লঙ্ঘনের অভিযােগে অভিযুক্ত ১৯৫ জনের ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের প্রথম ব্যাচ করাচি ফিরে যায়।

পৃষ্ঠা: ২২২

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারায় প্রথম পরিবর্তন আসে ১৯৭২ সালের অক্টোবরে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন তরুণ নেতার সমন্বয়ে গঠন করা হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। এর আগে বাংলাদেশ রণাঙ্গনের নবম সেক্টরের কমান্ডার খুলনায় ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাগমনকালে বিশাল পরিমাণ পাকিস্তানি অস্ত্রসম্ভার ভারতে পাচার করার সময় সশরীরে বাধা দেন। ফলে সেক্টর কমান্ডার এম এ জলিল সরকারের বিরাগভাজন হয়ে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হন ও পরে জাসদে যােগ দেন।

১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২২ তারিখে লাহােরে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবকে কনফারেন্সে যােগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ভারতের প্রতিবাদ সত্ত্বেও শেখ মুজিব ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে সম্মেলনে যান। পরে আমেরিকান দূতাবাসের গােপন নথি থেকে জানা যায় যে, সম্মেলনে যাওয়ার ব্যাপারে ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানাতে সম্মত হন। তবে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয় যে তিনি আর ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দির বিচারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করবেন না।’২ ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।

ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উচ্চকক্ষীয় কর্মকর্তাদের যােগাযােগের ভিত্তিতে ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে তিন দেশের প্রতিনিধিরা দিল্লিতে এক বৈঠকে মিলিত হন। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন, ভারতের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং ও পাকিস্তানের পক্ষে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ সেই বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দি প্রত্যর্পণ এবং বাংলাদেশে আটকেপড়া অবাঙালিদের পাকিস্তানে পুনর্বাসনের ব্যাপারে বিস্তারিত আলােচনা হয়। একইভাবে পাকিস্তানে আটকেপড়া বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও দেশগুলাের মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কামাল হােসেন বাংলাদেশের পক্ষে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি দাবি করেন। এবং বলেন যে জাতিসংঘ প্রস্তাব ও আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে বিচারের আওতায় আনার বিধান রয়েছে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন যে, ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে, এ বছর শেষের দিকে তিনি বাংলাদেশে যাবেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বাংলাদেশের জনগণের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইবেন। মুজিবও তখন বলেছিলেন যে বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমা করতে জানে এবং পাকিস্তানিদের সঙ্গে তারাও নতুনভাবে সম্পর্ক শুরু করতে চায়।

কিসিঞ্জার ও শেখ মুজিবের বৈঠক : সংলাপ

১৯৭৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান আমেরিকা যান ও নিউইয়র্কে তদানীন্তন সেক্রেটারি অব স্টেট কিসিঞ্জারের সঙ্গে এক আলােচনায় মিলিত হন।

পৃষ্ঠা: ২২৩

শেখ মুজিবের সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হােসেন আলী। আলােচনা ছিল নিম্নরূপ :৩

কিসিঞ্জার : আপনাকে এখানে পেয়ে আমি আনন্দিত। ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান জাতিসংঘে এসে আমাকে বলেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে ২০টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে নেমেছে কাজেই ওরা কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। কাজেই তিনি খুব ভালাে অবস্থানে আছেন অথচ আপনি ১৬৯টি আসনের মধ্যে পেয়েছেন ১৬৭টি। এর পর থেকে আমি আর রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস করি না।

শেখ মুজিব : আমি নির্বাচনের আগে এক প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলাম ৯০ ভাগ ভােট পাবাে। বলেছিলাম ৯৭ ভাগ আসনে জিতবাে। আমি অনেক নির্বাচন করেছি। কাজেই আমি ইয়াহিয়ার চাইতে ভালাে বুঝতাম।

কিসিঞ্জার : এ রকম ফলাফল হবে জানলে নির্বাচনই হতাে না। চীন যাবার সময় শেষবার সাক্ষাতে ইয়াহিয়া আমাকে ডিনারে ডাকেন। তিনি বলেছিলেন, লােকে আমাকে (ইয়াহিয়াকে) ডিক্টেটর মনে করে। সবাইকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি ডিক্টেটর?’ টেবিলে সবাই সমস্বরে বললেন, না। তারপর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, জানি না, তবে একজন ডিক্টেটর হলেও আপনি একটি গােলমেলে নির্বাচনে নেমেছেন।

আমরা বাংলাদেশের ভালাে চাই। আমাদের সাধ্যমতাে আপনাদের সাহায্য করবাে। আপনাদের অভ্যন্তরীণ কোনাে ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হবে না। আমরা বিশ্বাস করি আপনি দেশে স্থিতিশীলতা আনতে পারবেন। এবং আমরা আপনাকে সাহায্য করতে চাই।

শেখ মুজিব : ধন্যবাদ। আপনার অসীম দয়া। জেল থেকে বের হবার পর থেকে আমরা সমস্যায় আছি। আপনি আমাদের দুর্ভিক্ষ মােকাবিলায় যথেষ্ট সাহায্য করেছেন।

কিসিঞ্জার : আমরা সাধ্যমতাে সবকিছু করবাে। বছরের প্রথম চতুর্থাংশে আমরা দেড় লাখ টন খাদ্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আরাে ১ লাখ টনের অনুমােদন দেয়ার চেষ্টা চলছে। জানি এতে আপনার পুরাে প্রয়ােজন মিটবে না। কিন্তু আমাদেরও এ বছর ফসলের পরিস্থিতি খারাপ।

শেখ মুজিব : আমাদের চেষ্টা খাদ্য ঘাটতি কমিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া। আমাদের আগে ঘাটতি ছিল ৩ মিলিয়ন টন, যা এখন ২ মিলিয়ন টন। আমি যখন জেল থেকে বের হয়ে আসি তখন আমাদের সরকারই ছিল না। কিছু ছিল না।

কিসিঞ্জার ; সবকিছু ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে?

শেখ মুজিব : যুদ্ধের পর আমাদের হাতে কিছুই ছিল না। টাকা-পয়সা কিংবা সহায়-সম্পদ কিছুই ছিল না।

পৃষ্ঠা: ২২৪

কিসিঞ্জার ; আপনি তাে ফিরেছিলেন ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে, তাই না?

শেখ মুজিব : হঁ্যা। যখন আমি ফিরি সবার হাতে ছিল অস্ত্র। তা নিয়ে আমাদের সমস্যা ছিল। এখন আমাদের একটি সরকার আছে। আমি ‘মাফ করাে এবং ভুলে যাও’ এই নীতি মেনে চলছি।

কিসিঞ্জার : আপনার ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে আমরা অনেক সন্তুষ্ট। আপনি রাষ্ট্রনায়কোচিত কাজ করেছেন।

শেখ মুজিব : ওরা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করায় আমাকে কিছুটা জনপ্রিয়তা হারাতে হয়েছে। আমি কিছু বুদ্ধিজীবীর নাম দিতে পারি যাদের আপনি চিনতেন।

কিসিঞ্জার : বাঙালিরা বিদ্রোহী জাতি। আমি হার্ভার্ডে থাকতে আমার একজন ছাত্র আপনার এখনকার ফরেন মিনিস্টারের সঙ্গে আরাে কয়েকজন ছিলেন।

ড. কামাল : হঁ্যা, কয়েকজন বাঙালি ছিলেন। ওদের একজন ছিলেন মি. মাের্শেদ।

কিসিঞ্জার : উনি কি বহাল তবিয়তে আছেন?

ড. কামাল : জি, হ্যা।

শেখ মুজিব : পাকিস্তানি জেনারেল ফরমান আলী খান তার নােট বুকে অনেক কিছু লিখেছিলেন। তা আমাদের কাছে আছে। তিনি লিখেছিলেন, সবুজ বাংলার মাটি লাল করে দিতে হবে। ভুট্টো ঢাকায় আসার পর আমি তাদের বলেছিলাম। তাকে আমি কাগজটি দেখাই। তাকে বললাম, তােমার পক্ষ থেকে কিছু করাে। ৬৭ হাজার অবাঙালি পরিবার পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে বাংলাদেশে রয়ে গেছে। ওরা ওদের ফেরত নিতে চায় না। আমরাও তাদের চাই না। ক্যাম্পে বাস করছে ওরা। আমরা ওদের খাওয়াতে পারি না। আমাদের সেই সম্বল নেই। আমার কাজ আমি করেছি। আমি গণহত্যার শিকার। তা হলে পাকিস্তানিরা কেন একটু মহত্ত্ব দেখাতে পারছে না?

কিসিঞ্জার : আমরা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক দেখতে চাই। স্বাভাবিকীকরণের জন্য প্রভাব খাটানাে আমাদের নীতি। আমার মনে হয় বিষয়টি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আপনি কি আমাকে বিশেষভাবে সুনির্দিষ্ট কিছু করতে বলছেন?

শেখ মুজিব : আমি দায়-দায়িত্ব মাথায় নিয়েছি। সম্পদে আমাদের ভাগ থাকবে না কেন ? আমাদের সাড়ে ৭ কোটি লােক। অথচ আমরা স্বর্ণ পাইনি, প্লেন পাইনি, জাহাজ পাইনি। আমি পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ফেরত দিয়েছি। দরকষাকষির জন্য আমি ৪ হাজার সৈন্য রেখে দিতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করতে চাইনি। আমি দক্ষিণ এশিয়ায় সুসম্পর্ক চাই। বাংলাদেশ একটি ছােট দেশ।

পৃষ্ঠা: ২২৫

কিসিঞ্জার : সাড়ে ৭ কোটি লােক নিয়ে বাংলাদেশ একটি ছােট দেশ নয়।

শেখ মুজিব : সীমানাগতভাবে আমরা ছােট। স্বাধীনতার প্রথম দু’তিন মাসের মধ্যে আমরা রাস্তা ও ব্রিজ পুনর্নির্মাণ করেছি। সরকারি প্রতিষ্ঠান খুলেছি। একটি সংবিধান তৈরি করেছি। আমাদের সিভিল সার্ভেন্টরা দুই মাস যাবৎ পাকিস্তানে আটকা ছিলেন। বাংলাদেশে আমাদের সম্পদ আছে উর্বর জমি, জনশক্তি, গ্যাস, কয়লা, গবাদিপশু। আমাদের তেল পাবারও আশা রয়েছে।

কিসিঞ্জার : বাংলাদেশে কি কয়লা আছে? তেল পাওয়া গেছে?

শেখ মুজিব : তেল অনুসন্ধানের জন্য আমরা আমেরিকান একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছি। চুক্তি অনুযায়ী ওরা বােনাস পেমেন্টও দিয়েছে।

কিসিঞ্জার : আপনাদের তেল পাওয়া গেলে আমরাও সেখান থেকে ধার করবাে।

শেখ মুজিব : আপনাকে ধার করতে হবে না। আমরা আপনাদের সব দেনা শােধ করে দেব। আমরা বাংলাদেশে একটি মার্শাল প্ল্যান চাই। পেট্রোকেমিক্যাল সার কারখানার জন্য আগে বিদেশি বিনিয়ােগ চাই। আমাদের গ্যাস আছে, যা আমরা বিক্রি করতে পারি। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বড় একটি সমস্যা। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ সালে একটা মিশন সার্ভে করা হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলে নদীগুলাে ড্রেজিং করে কোলকাতার নদীপথে মালামাল পরিবহন করা হতাে। ব্রিটিশরা চলে যাবার পর আর কোনাে ড্রেজিং হয়নি। পাকিস্তান সরকার সার্ভে রিপাের্টের কবর দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে কিছু অববাহিকা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। বাংলাদেশের জন্য তারা কিছু করেনি, যার ফল আমরা এখন। ভােগ করছি। বন্যার হাত থেকে আমাদের ফসল, ঘরবাড়ি, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু, শাকসবজি কিছু বাঁচাবার উপায় নেই। আমরা এর সমাধান বের করতে পারি। আপনার জার্মানি পুনর্গঠনের জন্য যে মার্শাল প্ল্যান করেছেন, এখন বাংলাদেশের জন্য তেমন একটি কিসিঞ্জার প্ল্যান শুরু করুন।

 কিসিঞ্জার : একটা প্ল্যানে আমার নাম থাকলে আমি যত কিছু সম্ভব করতাম।

শেখ মুজিব : ভিয়েতনাম ও মধ্যপ্রাচ্যে আপনাদের বিশাল সাফল্য ছিল। বাংলাদেশেও আপনারা সফল হতে পারবেন। আমার দেশে এখন দুর্ভিক্ষাবস্থা চলছে।

কিসিঞ্জার : বাংলাদেশের পরিস্থিতি মার্শাল প্ল্যানের চাইতেও খারাপ। আমি অকপটে বলতে পারি, সে ধরনের পরিকল্পনা নেয়ার সম্ভাবনা নেই। তা ছাড়া আমরা বাংলাদেশ কনসাের্টিয়ামে যাচ্ছি। আমরা দেশে দ্রুত উন্নতি দেখতে চাই। ১৯৭১ সালে ভারতের সঙ্গে আমাদের বিরােধ ছিল চীনা নীতি নিয়ে। শান্তিপূর্ণভাবে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন দিয়েছি। আমাদের যা

পৃষ্ঠা: ২২৬

সাধ্য করবাে, কিন্তু আপনি অতিরিক্ত কিছু আশা করবেন না। কনসাের্টিয়ামে আমরা সক্রিয় ভূমিকা নেবাে। আপনার কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে। আমি শিগগিরই ঢাকা যাচ্ছি। যার মানে হলাে বাংলাদেশের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।

ড. কামাল : আমাদের সমস্যা, সময় খুব সংক্ষিপ্ত।

কিসিঞ্জার : ব্যুরােক্র্যাসির সমস্যা হলাে তারা সংকট এড়ানাের চেষ্টা করবে, কিন্তু মূল সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট করবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বড় পদক্ষেপ নেয়া পছন্দ করি। আমি মি. ম্যাকনামারার সঙ্গে দেখা করে দেখবাে কী করা যায়। আপনারা কি তার সঙ্গে দেখা করবেন?

শেখ মুজিব : হঁা, ওয়াশিংটনে।

ড. কামাল : দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য আমাদের তিন থেকে চার বছর সময় দরকার।

কিসিঞ্জার : আপনারা কি স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবেন?

ড. কামাল : হঁ্যা, তিন থেকে চার বছরের মধ্যে।

কিসিঞ্জার : বর্তমান আর্থিক চতুর্থাংশে আমরা আরাে ১ লাখ টন চাল দেয়ার আশা করছি।

এথারটন : এবং সারা বছর কী করা হবে তা বিবেচনায় না রেখেই দেখছি অতিরিক্ত কী পরিমাণ খাবার সরবরাহ করা যায়।

ড. কামাল : আমাদের দরকার ভােজ্যতেল, সার এবং রপ্তানি করার জন্য প্রকল্প সাহায্য। নৈতিক কোনাে সমস্যা আমাদের নেই। ৪০ ভাগ মুদ্রাস্ফীতি থাকার পরেও উপ-নির্বাচনগুলােতে আমরা জিতে চলেছি।

কিসিঞ্জার : কীভাবে সেটা সম্ভব হচ্ছে ১৫ মিনিট প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপ করে তা তাকে বােঝাবার চেষ্টা করুন।

শেখ মুজিব : বাংলাদেশে আমরা ৪ হাজার ৩০০ ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করেছি। প্রত্যেক ইউনিয়নে একটি করে লঙ্গরখানা খােলা রয়েছে।

কিসিঞ্জার : আপনি কি প্রচুর জায়গায় ঘুরছেন?

শেখ মুজিব : জনগণকে আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করছি।

কিসিঞ্জার : ভারতের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কী রকম?

শেখ মুজিব : খুব ভালাে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নিরপেক্ষ, জোটনিরপেক্ষ ও স্বাধীন। চীন, সােভিয়েত, আমেরিকা ও ভারতের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে।

কিসিঞ্জার : আমরাও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করছি।

শেখ মুজিব : আমরা তাকে স্বাগত জানাই। ভারতের সঙ্গে আমাদের মৈত্রী চুক্তি ও নদী কমিশন রয়েছে। আমি জেল থেকে বের হয়ে আসার পর

পৃষ্ঠা: ২২৭

বাংলাদেশে আমেরিকাবিরােধী সেন্টিমেন্ট ছিল। এখন জনগণ মার্কিন বন্ধুভাবাপন্ন।

কিসিঞ্জার : জেল থেকে বেরিয়ে আপনি চমৎকার দেখিয়েছেন। অনেক আবেগের মধ্যেও পাকিস্তানের সঙ্গে আপনার খারাপ ব্যবহার করার কথা ছিল। বাংলাদেশের প্রতি আমি সব সময় ছিলাম সহানুভূতিশীল। এ ছিল এক ধরনের স্বাভাবিক বন্ধুত্ব।

শেখ মুজিব ; আপনাদের দীর্ঘদিনের আগ্রহকে আমরা স্বাগত জানাই।

কিসিঞ্জার : আপনার জন্য আমেরিকানদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান রয়েছে। খাদ্যের ব্যাপারে আমরা বিশেষ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।

শেখ মুজিব : আমি তার জন্য কৃতজ্ঞ।

কিসিঞ্জার : আপনি প্রথমে ব্রিটেন গিয়ে তারপর বাংলাদেশে যান। তারপর কি তাৎক্ষণিকভাবে সরকারের দায়িত্ব নিলেন?

শেখ মুজিব : হঁ্যা। সেটা ছিল কঠিন এক দুঃসময়। সবার হাতে ছিল অস্ত্র। সবার কাছে অস্ত্রসমর্পণের আহ্বান জানালাম। দেড় লাখ অস্ত্র সারেন্ডার করা হলাে। পাকিস্তান সবার হাতে অস্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছিল। মিলিটারিরা সিভিলিয়ানদের অস্ত্রসজ্জিত করার অনুমতি পেয়েছিল। আমাদের কাছে এর দালিলিক প্রমাণ আছে।

কিসিঞ্জার : চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কতটুকু? ওরা কি বাংলাদেশে কোনাে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাচ্ছে? এখনাে কি ওদের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে?

শেখ মুজিব : এখনাে নয়। তবে আমরা পরস্পরকে চিনি। ১৯৫৭ সালে আমি পিকিং গিয়েছিলাম। ওরা ঢাকা এসেছে ১৯৬২ সালে। আমরা আত্মমর্যাদা বজায় রেখে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই। আমি চাইতে পারি, কিন্তু ওদের কাছ থেকেও প্রস্তাব আসা উচিত। জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে আমরা স্বাগত জানাই।

কিসিঞ্জার : আমার ধারণা চীন আগামী বছর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালাে ও স্বাভাবিক করতে চাইবে। ভারতকে নিয়ে ওদের দুশ্চিন্তা আছে, কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে ওদের বিরােধিতা করার কিছু নেই। তারা এ নিয়ে সতর্ক পদক্ষেপ নেবে। আপনাদের নীতি সঠিক। সবল বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং ঝগড়াবিবাদ এড়িয়ে যাওয়া। আপনাদের সঙ্গে সােভিয়েতের সুসম্পর্কে আমাদের কোনাে আপত্তি নেই।

শেখ মুজিব : ধন্যবাদ। গত দুই বছর আপনাদের কাজ ছিল প্রশংসার যােগ্য।

কিসিঞ্জার : সুপ্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রের জন্য সম্পর্ক স্থাপন করা সহজ। কিন্তু আপনাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নতুন একটি দেশের জন্য শূন্যাবস্থা থেকে কাজ শুরু

পৃষ্ঠা: ২২৮

করতে হয়েছে। সে ছিল অনেক কঠিন কাজ। আপনারা দু’জনে কি একসঙ্গে ছাড়া পেয়েছেন?

শেখ মুজিব : হঁ্যা। আমাকে রিলিজ করার পর আমি বললাম, আমার বন্ধুর কথা ভুলে যাবে না। তাকে ছেড়ে দিতে বললাম, কারণ সে ছিল আমার। পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা।

কিসিঞ্জার : আপনার সঙ্গে কি খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে?

শেখ মুজিব : ওরা আমাকে নিভৃত সেলে আটকে রেখেছিল। অবস্থা ছিল খারাপ ১১৭ দিন।

ড. কামাল : আমি অবশ্য ঠাণ্ডা জায়গায় ছিলাম। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে।

শেখ মুজিব : আমার বিরুদ্ধে ওরা মিথ্যা মামলা সাজিয়েছিল। কিসিঞ্জার : আমরা ওদের অনেক চাপের মুখে রেখেছিলাম।

শেখ মুজিব : আমি তা জানি। ১৬ ডিসেম্বর রাতে ওরা আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। অফিসার ইন চার্জ আমাকে পাঁচদিন চশমা ব্যারেজের কাছে। লুকিয়ে রেখেছিল। তারা বলার চেষ্টা করছিল এক কারাগার বিদ্রোহের ঘটনায়। আমি বন্দিদের হাতে নিহত হয়েছি। ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ আসার পর ওরা তিনবার আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে, ১৯৬৬ সালে গ্রেফতার করেছে এক ষড়যন্ত্রের মামলায় এবং ১৯৭১ সালে আমাকে আটক করে হত্যা করতে চেয়েছে। আমি এখন জীবনের এক্সটেনশনে আছি।

কিসিঞ্জার : আপনি আরাে ৬ বার বাঁচবেন। কথায় বলে, বিড়ালের ৯টি জীবন রয়েছে। তবে আপনি নতুন একটি দেশ গড়ে তুলেছেন। আপনি দেখবেন আমাদের প্রেসিডেন্ট আপনার প্রতি অনেক সহানুভূতিশীল। সাহায্যের ব্যাপারে কংগ্রেসের কাছে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, নিজেরাই আমরা। খাদ্যসংকটে। কিন্তু আমরা বিশেষ প্রচেষ্টা নেবাে।

শেখ মুজিব : অবাঙালিদের নিয়ে আমরা বিশেষ সমস্যায় আছি। বিশেষ করে যারা বাংলাদেশে থাকতে চায় না। এ ব্যাপারে কিছু করতেই হবে। তাদের কি আমি ইদি আমিনের মতাে দেশ থেকে বের করে দেবাে?

কিসিঞ্জার : পাকিস্তান ওদের নিচ্ছে না? আমরা প্রেসিডেন্টের কাছে এই প্রশ্নটি তুলবাে। তিনি তখন আরাে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করবেন।

শেখ মুজিব : আমার দরকষাকষির আর সুযােগ নেই। আমি ঝুঁকি নিয়েছি। ওরা আমাদের প্রফেসর, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের হত্যা করেছে। সারেন্ডারের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে। আমাকে দেশের জনগণের কাছে তার কৈফিয়ত দিতে হয়। আমি কখনাে কথার বরখেলাপ করি না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাকে করতে হয়েছে। আমি বলেছিলাম বাংলাদেশের মাটিতে ওদের বিচার হবে। কিন্তু সে বিচার হয়নি।

কিসিঞ্জার : বিচার না করে আপনি মানবিক ও রাষ্ট্রনায়কোচিত কাজ করেছেন। এতে আপনি দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে লাভবান হবেন। বিষয়টি আমি দেখবাে।৪

পরদিন ১ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে দেখা করেন এবং পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ফেরত দান, অবাঙালি প্রসঙ্গ এবং পাকিস্তানের সঙ্গে দায় সম্পদ ভাগাভাগির প্রশ্ন উত্থাপন করেন। ফোর্ডের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয় যে পাকিস্তানের সঙ্গে আলােচনার সময় এ নিয়ে ভুট্টোর ওপর চাপ প্রয়ােগ করা হবে। ৫ অক্টোবর ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের এক মূল্যায়নে বলা হয় যে,

মুজিবের সফর আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রচার ও জনসংযােগের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি বলে এই সফরের উদ্দেশ্যকে সার্বিকভাবে বাস্তবায়িত করতে পারেনি। মুজিব এবং তার সফরসঙ্গীরা বাংলাদেশের বিদ্যমান দুরবস্থা নিয়ে একটি নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারতেন যে ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। পত্রিকার সঙ্গে প্রচারণার ক্ষেত্রে তারা ছিলেন খুঁতখুঁতে। মুজিব কেবল ওয়াশিংটন পােস্টের জন্য একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ফোর্ডের সঙ্গে দেখা করার পর মুজিব প্রেস কর্পসের মুখােমুখি হননি ও সে দায়িত্ব ড. কামালের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। নিউজউইক, নিউইয়র্ক টাইমস ও টাইম ম্যাগাজিন মুজিবের জন্য সামাজিক আপ্যায়নের আয়ােজন করেছে কিন্তু ক্যাপশনসমেত ছবি ছাড়া তারা কোনাে নিউজ কভার করেনি। ওয়াশিংটন অভ্যর্থনায় শেখ মুজিব ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সাহেবজাদা ইয়াকুব আলীকে আলিঙ্গন করার সময়কার একটি নাটকীয় মুহূর্তের ছবি ছাপা হয়েছে। অথচ বাঙালিদের দেয়া সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানগুলােতে মুজিবকে তৎপর ও বক্তৃতা দিতে দেখা গেছে। সফরকালে তিনি ম্যাকনামারা, সিনেটর কেনেডি, রকফেলার ও ম্যাকগভের্নের সঙ্গে দেখা করেন।

দুর্ভাগ্যক্রমে, ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করলেও সে বিজয়ের ধারা শেখ মুজিব বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি। সে নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ৭৩ শতাংশ ভােট পেয়ে ২৯৩টি আসন দখল করে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল প্রধান বিরােধী দল হিসেবে ৭ শতাংশ ভােট পেয়ে আসন দখল করে ৫টি। মােজাফফরের মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ৮ শতাংশ ভােট পেলেও কোনাে আসন পায়নি। নির্বাচনে প্রতিটি আসনে গােলযােগ হয় এবং ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভােটকেন্দ্র দখল ও রাহাজানি ছিল অতি পরিচিত

পৃষ্ঠা: ২৩০

দৃশ্য। এমনকি রাতের বেলা বেতার ও টেলিভিশনযােগে ফলাফল প্রচারের সময় অনেক ভােটকেন্দ্রের প্রাপ্ত ভােটসংখ্যা পাল্টিয়ে দেয়া হয় বলেও অভিযােগ পাওয়া যায়। রাজনৈতিক দলগুলাের দাপটের সামনে নির্বাচন কমিশন ছিল অসহায়।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিপুল সাংগঠনিক শক্তির সামনে ন্যাপ, জাসদ কিংবা ভাসানী ন্যাপ বা কমিউনিস্ট পার্টির দাঁড়াবার মতাে সামর্থ্যই ছিল না। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কোনাে আশঙ্কাই ছিল না এবং এর পরেও তারা বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়ে জয়লাভ করে আসতে পারতাে। সে ক্ষেত্রে বিরােধী দলগুলাে প্রাপ্ত আসনের চাইতে কয়েকটি আসন বেশি পেলেও অবস্থার নামেমাত্র হেরফের হতাে না এবং সরকার গঠন নিয়ে আওয়ামী লীগকে কোনাে প্রতিবন্ধকতারই সম্মুখীন হতে হতাে না। উপরন্তু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে উপহার দিয়ে জাতির জন্য গণতান্ত্রিক আচরণের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখাতে পারতেন।

মূলত আওয়ামী লীগের দলীয় নেতৃত্বের আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের কারণেই নির্বাচন শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু ও সাবলীলভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছিলেন রাজনৈতিকভাবে অন্য ধরনের ইগাে বা মানসিকতা দিয়ে পরিচালিত এবং দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তাদের কেউই পরাজিত হতে চাননি। এ ব্যাপারে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রচ্ছন্ন কোনাে সমর্থন ছিল না এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। অন্যদিকে প্রশাসনের ভােট পরিচালনাকারী কর্মকর্তারা পরবর্তীকালে রাজনৈতিক প্রতিশােধ আসতে পারে ভেবে হয় নৈরাজ্যে সহায়তা করেছেন কিংবা পরিস্থিতি দেখেও না দেখার ভান করেছেন। ফলে ক্ষেত্রবিশেষে নির্বাচন ভণ্ডুল না হলেও ফলাফল প্রকাশে উল্টো ফল দেখা দিয়েছে।

দেশব্যাপী অসন্তোষ

যাই হােক, দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বহাল হলেও তা দুই বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি। একদিকে দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, রাজনৈতিক অসন্তোষ, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও নৈরাজ্য, সরকারের রাজনৈতিক যথেচ্ছাচার ইত্যাদি কারণে রাষ্ট্রের এমনিতেই দুর্বল কাঠামাে আরাে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের বিদ্রোহের আশঙ্কা দেখা দেয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতার ছাপ প্রকট হয়ে ওঠে। এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয় সংসদে জাতীয় সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী পাস করে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি দেশে একদলীয় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা কায়েম করা হয়।

বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশালের অধীনে জনগণের মৌলিক অধিকার সংকুচিত করা হয়, পার্লামেন্ট ও বিচার বিভাগকে করা হয়

পৃষ্ঠা: ২৩১

ক্ষমতাহীন। পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে প্রেসিডেন্টের হাতে সমস্ত নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে দেয়া হয়। পার্লামেন্টের কাছে দায়ী। একটি মন্ত্রিপরিষদের পরিবর্তে শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির কাছে দায়ী একটি কাউন্সিল অব মিনিস্টার গঠন করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল ও রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের প্রতি গণরােষের আরেকটি প্রধান কারণ ছিল জাতীয় সেনাবাহিনীর সমান্তরাল হিসেবে রক্ষীবাহিনী গঠন। ১৯৭২ সালের ৭ মার্চ জাতীয় রক্ষীবাহিনী আদেশবলে এই বাহিনী গঠন করা হয় এবং ১ ফেব্রুয়ারি থেকে তা কার্যকর দেখানাে হয়। ১২ থেকে ১৭ মার্চ ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে রক্ষীবাহিনী দায়িত্ব গ্রহণ করে।

রক্ষীবাহিনী সৃষ্টির ফলে একদিকে সরকারের সঙ্গে জনগণের এবং অন্যদিকে সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দূরত্ব বেড়ে যেতে থাকে। সেনাবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি আরেকটি সশস্ত্র বাহিনী গঠনের যৌক্তিকতা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। অন্যদিকে রক্ষীবাহিনীকে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করায় অবহেলিত সেনাবাহিনীর মধ্যেও ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে।

অনেকেই মনে করেন যে, মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে গঠিত মুজিববাহিনী’ নামের কিছু বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়। মুজিব বাহিনীর মূল নেতৃত্ব ও ট্রেনিং ছিল ভারতীয় বাহিনীর হাতে এবং মুজিব ও আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য ছিল এই বাহিনীর সদস্যপদ পাওয়ার একমাত্র যােগ্যতা। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে মুক্তিবাহিনীসহ সকলকে অস্ত্রসমর্পণের নির্দেশ দেন। এ সময় মুজিববাহিনীর সদস্যরা অস্ত্রসমর্পণে ইতস্তত করলে মুজিব এক ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা দেখতে পান। সে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়েই রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয় বলে অনেকে ধারণা করেন।

প্রথম থেকেই জাতীয় রক্ষীবাহিনী দেশজুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করে। বিশেষ করে নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের ক্যাডাররা ছিলেন রক্ষীবাহিনীর মূল প্রতিপক্ষ। দেশব্যাপী জাসদের কর্মীদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর অসংখ্য সংঘর্ষ ঘটে এবং এসব খণ্ডযুদ্ধে উভয়পক্ষে অনেক লােক হতাহত হয়। এর পাশাপাশি ১৯৭৪ সালে রক্ষীবাহিনীকে আইনগতভাবে রক্ষা করার জন্য রক্ষীবাহিনী আদেশ সংশােধন করে আইনগতভাবে রক্ষীবাহিনীর যে কোনাে কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া হলে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার হয়ে পড়ে একতরফা।

শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশাসনে অন্যতম দুর্বলতা ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিশাল জনশক্তিকে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে নিয়ােজিত করার ব্যর্থতা। দেশের লক্ষ লক্ষ তরুণ ও যুবক ভবিষ্যতের সােনালি আশায় ও দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ও স্বাধীনতার পর

পৃষ্ঠা: ২৩২

তারা স্বপ্নের অভীষ্ট সােনার বাংলা গড়ে তােলায় প্রত্যয়ী ছিলেন। সে সময় তারা যে পরিমাণে উদ্বুদ্ধ ছিলেন, তাতে করে জাতীয় পুনর্গঠনে যে কোনাে কাজে তাদের সঠিকভাবে লাগানাে যেতাে। তারাও চাইছিলেন তাদের প্রেরণা ও উদ্যম যেন সাধারণ কাজে ব্যয়িত না হয়, এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকের মতাে জাতীয় পুনর্গঠনের সৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেই ঔপনিবেশিক আদলে গড়ে তােলা হয় আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনীকে গুরুত্বহীন হিসেবে বসিয়ে রাখা হয় এবং সরকার জাতি গঠনের পরিবর্তে সিন্ডিক্যালভিত্তিক একটি ব্যবসায়ী শিল্পপতি শ্রেণী গড়ে তােলার প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে থাকেন। ফলে লক্ষ লক্ষ তরুণ যুবকের মনে যে হতাশাবােধের জন্ম নেয় তা থেকেই সমাজের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠে একটি বিদ্রোহী সত্তা।

রক্ষীবাহিনীর কারণে সেনাবাহিনীর অসন্তোষের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে অসন্তোষের আরেকটি কারণ ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাসদস্য ও আমলাতন্ত্রের পুনর্বাসন। ১৯৭৪ সালে পাক-বাংলাদেশ সমঝােতার পর পাকিস্তানে আটকেপড়া সেনাসদস্য ও আমলারা দেশে ফিরে আসেন। ইতােমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সেনা অফিসার ও আমলারা চাকরিতে সিনিয়রিটি পাওয়ায় উচ্চপদস্থ অনেক সেনা অফিসার ও আমলা কার্যত মুক্তিযােদ্ধাদের অধস্তন হয়ে পড়েন। তারা মনে করতে থাকেন যে, তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারার বিষয়টি ঘটনাক্রমিক এবং তা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ছিল না। ফলে সেনাসদস্য ও আমলাতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে গােটা জাতি মুক্তিযােদ্ধা ও অ-মুক্তিযােদ্ধা এই দু’ভাগে পারস্পরিক বিবদমান শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়।

শেখ মুজিবের সমাজতান্ত্রিক অনুশীলন প্রক্রিয়াও দেশের উঠতি ব্যবসায়ী ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়। দেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ এই চার স্তম্ভ গ্রোথিত করে একইসঙ্গে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে স্থান দেয়ায় নয়া পুঁজিপতি শ্রেণী ছিলেন অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত। এর মধ্যে আবার দেশের বৃহৎ সব শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে তারা আরাে শঙ্কা অনুভব করতে থাকেন। এর ফলে অনেকেই মনে করছিলেন যে, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন ও অর্থনীতির আগলমুক্ত হয়ে এবার তারা স্বশাসিত। একটি অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারবেন। অথচ শেখ মুজিবের ব্যাপকভিত্তিক জাতীয়করণের পর সরকারি খাতের শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলাে চালাবার মতাে দক্ষ লােকবল, অভিজ্ঞতা ও মেধা সরকারের ছিল না। উপরন্তু, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপােষকতায় জাতীয়করণকৃত শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার ভার রাজনৈতিক নেতা ও একশ্রেণীর মুক্তিযােদ্ধা নামধারী অ-মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হলে অচিরেই সেগুলােতে নির্বিচার লুটপাটের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।

পৃষ্ঠা: ২৩৩

অন্যদিকে সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা যােগ করার পর একে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যায়িত করা হতে থাকে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম জনঅধ্যুষিত বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ ও মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলাে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ইসলাম ধর্মবিরােধী মনে করে ব্যাপকভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকেন।

সব রকমের অসন্তোষের পাশাপাশি ১৯৭৪ সালে দেশ এক মহাদুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা রাজনৈতিক অবস্থাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে এবং তা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তােলে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ছিল জাতির ইতিহাসে রক্তাক্ত একটি দিন। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সেনা অফিসারের নেতৃত্বে বাহিনীর ছােট একটি দল রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে আক্রমণ করে ও শেখ মুজিবসহ তার পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্যকে হত্যা করে। পরবর্তীকালে হত্যার পেছনে যে কোনাে কারণ ও যুক্তিই দেখানাে হােক না কেন, আশ্চর্যের বিষয় হলাে গােটা জাতি এতে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেও জনমনে তাৎক্ষণিক কোনাে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। দিনরাত শেখ মুজিবের পদলেহনকারী রাজনৈতিক নেতাদের সকলেই ছিলেন নিশ্ৰুপ কিংবা আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। এদেরই আরেকটি উল্লেখযােগ্য অংশ রাতারাতি ভােল পাল্টে ঘাতকদের সঙ্গে হাত মেলান ও হত্যা-পরবর্তী সম্ভাব্য সরকারে যােগ দেয়ার ব্যাপারে তদবির করতে থাকেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড আকস্মিক হলেও একবারে অপ্রত্যাশিত ছিল না। চারদিকে ঘনায়মান দুর্যোগের মুখে অনেকেই বিশাল একটা কিছু ঘটার আশঙ্কা করছিলেন। কিন্তু যেভাবে মাত্র কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারের নেতৃত্বে প্রেসিডেন্টের মতাে জনপ্রিয় একজন নেতা নিহত হন তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন বলে মনে হয় না। এমন অনেকে আছেন যারা তার মৃত্যুর পরক্ষণে ভারতের হস্তক্ষেপেরও আশঙ্কা করছিলেন। তারা ভাবছিলেন, ভারত শেখ মুজিবের মৃত্যু পরবর্তী ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে এগিয়ে আসবে এবং শেখ মুজিব ও ভারতের বিরুদ্ধাচরণকারী কাউকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসতে দেবে না। কিন্তু ভারতে সেদিন চলছিল ২৪তম স্বাধীনতা দিবসের আমেজ এবং বিপন্ন বাংলাদেশের পক্ষে কেউ এগিয়ে আসেনি।

আমেরিকান স্টাফ মিটিংয়ের দৃশ্য৫

কিসিঞ্জার : এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক।

এফারটন : ওয়েল, এটি ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত একটি অভ্যুত্থান।

পৃষ্ঠা: ২৩৪

কিসিঞ্জার : তার মানে কি মুজিব জীবিত না মৃত?

এফারটন : মুজিবুর মৃত। তার নিকটস্থ পরিবারের সবাই।

কিসিঞ্জার : আমি ব্যুরাে অব ইন্টেলিজেন্স থেকে ভালাে পরামর্শ পেয়েছি।

মি. হাইল্যান্ড : আমি আপনার সঙ্গে কথা বলার সময়ও মুজিব জীবিত ছিলেন।

কিসিঞ্জার : সরি? তা হলে কি তারা ওকে কিছুক্ষণ পরে মেরেছে?

এথারটন : আমরা যতটুকু জানি। অবশ্য বিস্তারিত এখনাে জানি না। মনে হচ্ছে মুজিবকে মারাই ছিল ওদের উদ্দেশ্য। জাস্ট ওরা বাড়ি ঘেরাও করেছে, ভেতরে ঢুকেছে ও খুন করেছে।

কিসিঞ্জার : আমরা গত বছর তাকে সাবধান করিনি?

এথারটন : মার্চ মাসে অনেক নমুনা পাওয়া যাচ্ছিল।

কিসিঞ্জার : তাকে এ কথা বলা হয়নি? এথারটন : যথাসময়ে বলা হয়েছিল।

কিসিঞ্জার : আমরা কি বলেছিলাম কে তা করতে পারে? এথারটন : আমাকে দেখতে হবে কারাে নাম দিয়েছিলাম কি না?

মি. হাইল্যান্ড : তবে আমরা একটু ভাসা ভাসা বলেছিলাম বলে মনে হয়।

কিসিঞ্জার : সে ছিল একটা বিশ্ব-বােকা।

এথারটন : কিন্তু মুজিব তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তাকে নিয়ে কেউ এমন কাজ করতে পারে না। এখন কিন্তু মনে হচ্ছে হত্যাকারীরা পুরাে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছে।

কিসিঞ্জার : ওরা কারা?

এথারটন : মিলিটারি অফিসার। মাঝারি ও সিনিয়র ব্যাঙ্কের। বেশিরভাগই কম ভারতপন্থী, সােভিয়েতবিরােধী ও আমেরিকানপন্থী।

কিসিঞ্জার : এটা এক ধরনের অনিবার্য ছিল (এবসলুটলি ইনএভিটেবল)

এথারটন : এরা দেশের নাম বদলিয়ে রেখেছে ইসলামি রিপাবলিক…

কিসিঞ্জার : ওরা আমেরিকাপন্থী হবে তা অনিবার্য ছিল না। আমি মনে করেছিলাম হবে ভারতবিরােধী, চীনপন্থী। আমি সব সময় জানতাম ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়ে একদিন পস্তাবে। ‘৭১ সাল থেকে আমি এটা বলে আসছি।

পরদিন ১৬ আগস্ট বাংলাদেশ মার্কিন দূতাবাস থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে একটি টেলিগ্রাম পাঠানাে হয়।৬ এতে বলা হয়,

২৪ ঘণ্টার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বােঝা যাচ্ছে যে, অভ্যুত্থানকে চ্যালেঞ্জ করা হবে না। নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সশস্ত্র বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর প্রধানরা উপস্থিত থেকে নতুন সরকারের প্রতি

পৃষ্ঠা: ২৩৫

আনুগত্য জানিয়েছেন। জনগণের মধ্যে তেমন কোনাে প্রতিক্রিয়া হয়নি। মনে হয় সবাই নীরবে ঘটনা মেনে নিয়েছেন। একটা স্বস্তির ভাবও দেখা যাচ্ছে। যত নির্বিঘ্নে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে তাতে বােঝা যায় মুজিব ও জনগণ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। বাঙালিরা মুজিব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন, কারণ মুজিব তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেননি এবং ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য। অন্যদিকে মুজিব বাঙালিদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন, কারণ তিনি বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে না চেয়ে নিজেকে অসীম ক্ষমতাধর মনে করেছিলেন। নিজের ক্ষমতা বাড়ানাের অদম্য প্রচেষ্টা ও তার ভাগ্নে শেখ মনির ক্রমবর্ধমান প্রভাব বােধহয় অভ্যুত্থানকারীদের সতর্ক করে দিচ্ছিল যে আর বেশি সময় দেয়া ঠিক হবে না। এক্ষেত্রে ভারতের স্বাধীনতা দিবসকে বেছে নেয়ার ব্যাপারটি হতে পারে কাকতালীয়।

এ মুহূর্তে সুনির্দিষ্ট কোনাে দিক-নির্দেশনা দেয়া কঠিন। খন্দকার মােশতাকের অধীনে নতুন সরকার জনগণের মধ্যে কোনাে উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করবে না। মােশতাকের অধীনে সরকার টিকে থাকবে, তবে ব্যাপক পরিবর্তন হবে। এর মধ্যেই বােঝা যাচ্ছে যে, নয়া সরকার পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চাচ্ছে। আবার ভারতবিরােধী হিসেবে চিহ্নিত মােশতাক ভারতের সঙ্গে কোনাে বিরােধেও জড়াতে চাইবেন না। পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে মােশতাক বলেছেন তিনি বৃহৎ শক্তিবর্গ, আমেরিকা, সােভিয়েত ও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চান অর্থাৎ ভারসাম্যময়…সােভিয়েতের প্রভাব অবশ্য কিছুটা কমবে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মুজিবের সময়ের চাইতে ভালাে হবে। মােশতাক আমেরিকা ভাবাপন্ন এবং কেবিনেটের বামপন্থীদের বাদ দেয়া হবে। সম্ভবত মােশতাকের আমলে যুক্তরাষ্ট্র আরাে বেশি পরিমাণে সাহায্য দেবে।

মােশতাক সরকারের সঙ্গে মিলিটারির সম্পর্ক ঠিক বােঝা যাচ্ছে না। তবে তার প্রতিটি বিবৃতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা বলা হচ্ছে শােনা যাচ্ছে। মিলিটারিরা পাকিস্তানের আদলে সামরিক আইন প্রণয়নে ব্যস্ত। এতে মিলিটারির সঙ্গে অসামরিক লােকদের বিরােধ বাধবে কি না বলা যাচ্ছে না, তবে মােশতাক আরাে পরিচ্ছন্ন একটি সংবিধানের কথা বলছেন। এতে সন্দেহ নেই যে, অভ্যুত্থানের উদ্যোক্তারা নিজেদের প্রভাব খাটাতে চাইবেন। তবে তাদের মধ্য থেকে বাঙালি গাদ্দাফি সৃষ্টি হওয়ার কোনাে লক্ষণ নেই।

এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে, শেখ মুজিবের পতন সম্ভব করা হলেও মােশতাকের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনাে পরিকল্পনা এখনাে আসেনি। তবে বর্তমানে যারা বাংলাদেশে রাজনীতির পাদপীঠে আছেন তাদের কারােরই শেখ

পৃষ্ঠা: ২৩৬

মুজিবের মতাে জাদুকরী ব্যক্তিত্ব নেই যা অনেকদিন পর্যন্ত তিনি ধরে রেখেছিলেন। এবার যদি বেসামরিক সরকার ব্যর্থ হয় এরপর সামরিক একটি সরকারকে দেশরক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে দেখা যেতে পারে।

জিয়ার উত্থান

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভারতপন্থী বলে কথিত সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। খালেদ মােশাররফদের অনুসারীদের প্রথম কাজই ছিল শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। দীর্ঘ বাকবিতণ্ডা ও দেনদরবার শেষে শেখ মুজিবের সকল হত্যাকারী সামরিক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক নেতাদের ছেড়ে দেয়া হয় এবং তারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দেশের বাইরে চলে যান। খালেদ মােশাররফ নিজেকে স্বঘােষিতভাবে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করেন এবং জিয়াউর রহমানের স্থলে নিজেকে স্টাফ প্রধান হিসেবে নিয়ােগ দেন। জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।

কিন্তু সেদিন রাতেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে। সেনাবাহিনীর একটি অংশ ঢাকার জেলখানায় গিয়ে সেখানে আটক আওয়ামী লীগের ৪ জন সিনিয়র নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে হত্যা করে। ৬ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট মােশতাক পদত্যাগ করেন ও প্রধান বিচারপতি আবু মােহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপ্রধান নিয়ােগ করেন।

খালেদ মােশাররফ ছিলেন বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের একজন। যুদ্ধের সময় শত্রুর বুলেটের আঘাতে তিনি একবার মারাত্মকভাবে আহত হন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার সময়ও তিনি ঢাকায় ছিলেন।

বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সেনাবাহিনীর আরেকজন অফিসার কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে জাসদ সমর্থিত বামপন্থী একটি গ্রুপকে সংগঠিত করে আসছিলেন এবং গণবাহিনী নামে জাসদের নিজস্ব সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। গণবাহিনীর লক্ষ্য ছিল ঐতিহ্যগত সেনাবাহিনীর কাঠামাে ভেঙে দিয়ে সেখানে অফিসার ও সিপাহিদের এক সারিতে নামিয়ে এনে পিপলস আর্মি গঠন করা। এ উদ্দেশ্যে তারা ভারতবিরােধিতাকে তাদের মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এবং খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে পরিচালিত অভ্যুত্থানকে একটি ভারতপন্থী অভ্যুত্থান হিসেবে প্রচার করে সফল হয়। দেশের ঘনীভূত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ভারতবিরােধিতা সে সময় চরমে উঠেছিল এবং ভারতপন্থী কোনাে নেতার পক্ষে ক্ষমতায় থাকার কোনাে সম্ভাবনা আর ছিল না।

পৃষ্ঠা: ২৩৭

৭ নভেম্বর কর্নেল তাহের ও গণবাহিনীর নেতৃত্বে আরেকটি পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে। কর্নেল তাহেরের বিশেষ কোনাে গণ-পরিচিতি না থাকায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের জনপ্রিয় নেতা ও শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রদানকারী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অভ্যুত্থানের সামনে নিয়ে আসেন। গৃহবন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে আনা হয় এবং ঢাকার রাজপথে গণবাহিনীর পক্ষ থেকে তাকে অভূতপূর্ব সংবর্ধনা দেয়া হয়।

পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রথম পর্যায়ে জেনারেল খালেদ মােশাররফ ও তার সহকর্মী হায়দারসহ তাদের সহযােগী সামরিক নেতাদের হত্যা করা হয়।

তাহেরের পরামর্শে এবং প্রেসিডেন্ট আবু সায়েমের মাধ্যমে দেশব্যাপী সামরিক আইন জারি করা হয়। জিয়াউর রহমানকে সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়ােগ করে তার মাধ্যমেই সামরিক আইন ঘােষণার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও জিয়া তাতে রাজি হননি। ফলে বিচারপতি আবু সায়েম প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং জিয়াউর রহমানসহ সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। অন্য দু’জন উপপ্রধান। সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন নবনিযুক্ত বিমানবাহিনী প্রধান এম জি তওয়াব এবং নৌবাহিনী প্রধান এম এইচ খান।

আমেরিকার মতে, খালেদ মােশাররফ সত্যি সত্যি ভারতপন্থী ছিলেন কি না এ বিষয়টি স্পষ্ট ছিল না। ১০ নভেম্বর ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানাে এক টেলিগ্রামে খালেদ মােশাররফের পতন এবং জিয়ার উত্থান সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্রের তথ্যভিত্তিক একটি চিত্র পাঠানাে হয়।৭ টেলিগ্রামে বলা হয় যে,

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতাসীন মােশতাক সরকার খালেদ মােশাররফ ও তার কয়েকজন সহকর্মীর ওপর অবিচার করে তাদের প্রমােশন আটকে রাখেন। এমনকি মােশতাককে নিয়ন্ত্রণকারী মেজররা সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসারদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে তাদের বাদ দেয়ারও পরিকল্পনা করছিলেন। খালেদ মােশাররফ ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং তার পদাবনতিতে অসন্তুষ্ট। অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়ার ইচ্ছা থাকুক বা নাই থাকুক, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি মুজিবকে হত্যাকাণ্ডের পর মেজরদের হাত থেকে প্রশাসনকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন এতে কোনাে সন্দেহ নেই। এ-ও বলা হয় যে খালেদ মােশাররফ অভ্যুত্থানের সময় কোনাে রক্তপাতের পক্ষপাতী ছিলেন না। টেলিগ্রামে বলা হয়,

মােশাররফ ও তার সঙ্গীরা সেনা সদর দফতরের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়ার পরপরই শােডাউন হিসেবে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলাে দখল করেন এবং বিমান বাহিনীর একটি বিমান ও অস্ত্রসজ্জিত একটি হেলিকপ্টার আকাশে উড়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ

পৃষ্ঠা: ২৩৮

প্রমাণ করে। এদের আরাে লক্ষ্য ছিল ভূমিতে ট্যাংক বাহিনীর ওপর সতর্ক সংকেত পৌঁছানাে। এ অবস্থায় মােশাররফ মােশতাকের কাছে ৪ দফা বিশিষ্ট একটি দাবিনামা পাঠান।

(১) তিনি জিয়াউর রহমানের স্থলে সেনাবাহিনীর প্রধান হবেন, (২) মেজরদের সঙ্গে সেনা-শৃঙখলা অনুযায়ী আচরণ করা হবে, (৩) সরকারের অনুগত ট্যাংক বাহিনীকে নিরস্ত্র করতে হবে এবং (৪) মােশতাক তারপরও বহাল থাকবেন।৮

মােশাররফের সঙ্গে দু’দিনব্যাপী দেনদরবার শেষে তাকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়ােগ দিতে মােশতাক সম্মত হন এবং নিজে পদত্যাগ করে বিচারপতি আবু সায়েমকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। সায়েম ক্ষমতা নিয়েই জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। টেলিগ্রামে বলা হয়,

সেনাবাহিনীর ভেতরে ও বাইরে জিয়ার প্রচুর জনপ্রিয়তা থাকায় এবং খালেদ মােশাররফ সম্পর্কে ভারতপন্থী হিসেবে একটি ধারণা থাকায় জনগণ খালেদ মােশাররফকে খুব একটা উত্তাপের সঙ্গে গ্রহণ করেননি। মুজিবপন্থী একটি মিছিল ও জেলহত্যার প্রতিবাদে একটি হরতাল আহ্বান করা হলে এই ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে এই সুযােগে নিম্নতর স্তরের একটি গ্রুপ পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটিত করে মােশাররফ ও তার অনুসারীদের শেষ করে দেন। অভ্যুত্থানে বেশ কয়েকজন সেনা অফিসার নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

এতে বলা হয়,

মােশাররফের নিয়ন্ত্রণ শেষ হয়ে গেলে খন্দকার মােশতাক, জিয়া ও অন্যান্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মােশতাককে নতুনভাবে প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণের অনুরােধ জানানাে হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং অ-রাজনৈতিক ও অ-বিতর্কিত বিচারপতি সায়েমকেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত রাখার প্রস্তাব দেন।

টেলিগ্রামে বলা হয়,

এই ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব উভয়েরই পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে যা দেশে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসবে বলে আশা করা যায়।

অভ্যুত্থান বা পাল্টা অভ্যুত্থান কোনােটিকেই রাজনৈতিক হিসেবে পুরােপুরিভাবে চিহ্নিত করা যায় না। মােশাররফের আপাত উদ্দেশ্য ছিল মেজরদের বিতাড়িত করা এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল ভারতপন্থী বলে কথিত মােশাররফকে নিরস্ত করা। জিয়াকে সামনে আনার উদ্দেশ্য ছিল অন্তত মােশাররফের চাইতে ভালাে ও নিরপেক্ষ একজনকে নেতৃত্বে রাখা। বাস্তবে গত

পৃষ্ঠা: ২৩৯

কয়েকটি সরকারের কোনােটিই আমেরিকাবিরােধী, ভারতপন্থী অথবা সােভিয়েতপন্থী ছিল মনে হয় না। দ্বিতীয়ত এটা এখন স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে নেতৃত্বের উচ্চতম পর্যায় থেকে আরম্ভ করে নিম্নতম স্তর অবধি বিরাজ করছে একটি ভারতবিরােধী মনােভাব যার হাত থেকে মােশাররফ ও তার সঙ্গীরা রেহাই পাননি।

তথ্য নির্দেশিকা

১. ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৮৪। ঢাকা অ্যাম্বেসি ফাইলস, লট নং-৭৬ এফ-৬২, ডি আই এফ-১।

২. সেক্রেটারি অব স্টেট রিজিওনাল স্টাফ বৈঠকের ধারাবিবরণী, দলিল নং ৩৪।

৩. মেমােরেন্ডাম অব কনভারসেশন, ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, সেন্ট্রাল ফরেন পলিসি ফাইলস, গােপনীয়। কিসিঞ্জারের সঙ্গে ছিলেন নিকটপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অ্যাসিট্যান্ট সেক্রেটারি আলফ্রেড এথারটন, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের রবার্ট ওকলি ও নােট গ্রহণকারী পিটার ডি কনস্টেবল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যােগ দিতে কিসিঞ্জার নিউইয়র্কে ছিলেন।

৪. সাক্ষাৎকারের পর অপেক্ষমাণ সাংবাদিকরা আলােচনার বিষয়ে জানতে চাইলে কিসিঞ্জার ও শেখ মুজিব তাদের সামনে অভিন্ন বক্তব্য রাখেন। তারা উভয়েই বলেন, দুদেশের মধ্যে। চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। এক পর্যায়ে একজন সাংবাদিক কিউবার কাছে চটের বস্তা বিক্রির সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কী আলােচনা হয়েছে জানতে চাইলে শেখ মুজিব প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। কিসিঞ্জার বলেন যে কিউবা সংক্রান্ত বিষয়ে কোনাে আলােচনা হয়নি।

৫. বৈঠকে কিসিঞ্জারের সঙ্গে ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট আলফ্রেড এথারটন, ব্যুরাে অব ইন্টেলিজেন্সের মি. হাইল্যান্ড, আন্ডার সেক্রেটারি জোসেফ সিসকো ও অন্যান্য। ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি-৫৯, এন্ট্রি ৫১৭৭, বক্স-৩। স্টাফ মিটিংয়ের ট্রান্সক্রিপ্ট, গােপনীয়। সংক্ষেপিত। বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫।

৬. টেলিগ্রাম নং ৩৯৬৪, ন্যাশনাল আর্কাইভস, কোলকাতা ও ইসলামাবাদে এর অনুবাদ পাঠানাে হয়।

৭. টেলিগ্রাম নং ৫৪৭০। ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি-৫৯, সেন্ট্রাল ফরেন পলিসি ফাইলস, সিক্রেট ও ইমিডিয়েট।

৮. এ সময় মােশতাক কুমিল্লা সেনা ছাউনির কাছে সাহায্য চেয়ে তারবার্তা পাঠান। কিন্তু কুমিল্লা থেকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, তারা সেনাপ্রধানের নির্দেশ ছাড়া কাজ করবেন না।

Ref: মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম