রণাঙ্গন সমাচার
সমগ্র বাংলাদেশ আজ এক রনাঙ্গন। সর্বত্রই চলছে আজ প্রতিরােধের লড়াই মুক্তির সংগ্রাম। দেশ প্রেমে উদ্দীপ্ত মুক্তি সেনারা আজ মরণপণ লড়াই করে খতম করে চলছেন হানাদার পশুদের দল আর ছিনায়ে আনছেন একটার পর একটা গৌরবময় বিজয়। ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তি বাহিনীর তৎপর ও সাফল্য দিন দিন বেড়েই চলছে। দিনের পর দিন বয়ে আনছে এক একটা সাফল্য আর মুক্ত হচ্ছে এক একটা অঞ্চল। নীচে মুক্তি বাহিনীর সাফল্য ও তৎপরতার খবর দেওয়া হল। ২৮শে সেপ্টেম্বর ঃ ময়মনসিংহ-অধিনায়ক আফসার উদ্দিন আহমেদ তার একটা সুদক্ষ মুক্তি সেনার দল নিয়ে পাক বাহিনীর ভালুকা ও মল্লিক বাড়ীর ঘাটীর মাঝের গ্রাম ধর্মগুরে রাজাকার দেরে বাড়ীতে রাত তিনটায় এক অতর্কিত আক্রমণ চালায়ে ছয়জন রাজাকারকে ধরে এবং হত্যা করে। ২৯শে সেপ্টেম্বর মুক্তি বাহিনীর একটি দল ভালুকা বাজার ও নয়নপুরে অন্য আরও একটি দল। পাক দস্যুদের একটি দলের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন পাক সৈন্য ও ৬ জন রাজাকারকে খতম করেন। নয়নপুর আক্রমনে পাক সৈন্যরা অনেক লুটের মাল ফেলে পলায়ন করে। পরে মুক্তি সেনারা উক্ত মাল ও পত্র মালিকদের ফিরিয়ে দেয়। ৩০শে সেঃ মুক্তি বাহিনীর একটি দল রাত ৮ ঘটিকায় পাক সৈন্যদের প্রধান ঘাটী ভালুকা থানায় এক সাফল্যজনক আক্রমণ চালায়। পরে মুক্তি সেনারা তাদের পজিশন তুলে নিয়ে বাইদাগ্রাম আসে এবং সেখানে পাক সেনাদের সাথে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ সংঘঠিত হয়।
উক্ত যুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর যখন অধিকাংশ শত্রুসেনাকে খতম করে তখন পাক সেনাদের সাহায্য করার জন্য কাশীগ শত্রু ঘাটী হতে আরেকটি দল ভালুকার পথে আসতে থাকিলে মুক্তি বাহিনীর অপর একটি দল তাদের বাধা প্রদান করে এবং রাত থেকে আরম্ভ করে পরের দিন তিনটা পর্যন্ত অবিরাম যুদ্ধ চলে। উক্ত তিন স্থানে ১৯ ঘন্টা স্থায়ী যুদ্ধে মােট ৭০ জন পাক সেনা নিহত ও বহুসংখ্যক আহত হয়। শত্রুসেনারা বহু লুটের মাল ফেলে পলায়ন করে। ১লা অক্টোবর ঃ পাক দস্যুদের একটি দল সাগরদীঘি যাওয়ার সময় বাজুয়ার মােরার পেীছিলে মুক্তি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে চারজন পাকসেনা খতম হয়। ৩রা অক্টোঃ ভালুকা থানার তালার গ্রামে পাক সেনা ও রাজাকারেরা লুট পাট শুরু করলে মুক্তি যােদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ করে দুইজন পাক সেনা ও দুইজন রাজাকারকে খতম করে। দুইজন রাজাকার গুরুতর আহত হয়। ৫ই অক্টোঃ পাক বাহিনরি একটি দল মেছিলা ও বিরুনীয়া গ্রামে লুট পাট শুরু কলে মুক্তি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে দুইজন হানাদার পশু ও ৭ জন রাজাকার খতম হয় ‘ দস্যুরা লুটের মাল ফেলে পালিয়ে যায়। মুক্তি বাহিনীর অপর একটি দল ত্রিশাল থানার পেড়া বাড়ীর রাজাকার ঘাটীতে আক্রমণ করতে গেলে রাজাকারেরা একটি রেডিও, ঔষধপত্র ও বহু লুটের মাল ফেলে পলায়ন করে।
মুক্তি বাহিনীরা বানার নদীর পুল ধ্বংস করে। পাক বাহিনীর ত্রিশাল পােড়াবাড়ীর যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ঐ একই দিনে বনগাঁও ও চালায়দীর রক্ষীবাহিনীরা রাজাকার সাহেবালীকে ধরে মুক্তি বাহিনীর নিকট সােপর্দ করে। ৬ই অক্টোবর ৫ ভালুকা থানার বাঘের পাড়া ও ফুলবারীয়া থানার আছিম ক্যাম্পে মুক্তি যােদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণের ফলে এগারজন পাকসৈন্য ও তিন রাজাকার খতম হয়। পাঁচজন পাক সৈন্য গুরুতররূপে আহত হয়। ৮ই অক্টোবরঃ মুক্তি যােদ্ধারা সফর গায়ের কুখ্যাত ডাকাতের নিকট হতে ৪টি রাইফেল ও কালিয়াকৈর মুক্তি বাহিনী নামধারী একদল ডাকতের নিকট হতে ৪টি রাইফেল ও ৩টি সাধারণ ও ১টি S.M.G উদ্ধার করেন। | ৯ই অক্টোবর ও ঢাকা জেলার কালিয়াকৈর ও ময়মনসিংহের সারাধসার থানার পাক সেনার ও রাজাকার ঘাটিতে মুক্তিযােদ্ধারা এক অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ২৭ জন রাজাকার খতম করেন। মুক্তিযােদ্ধারা ১টি সর্টগান, ১টি রেডিও হস্তগত করেন ও গফরগাঁও রাজাকার ঘাটীটি পুড়িয়ে দেন।
একই দিনে গফর গায়ের দত্তের বাজারে পাক বাহিনীরা বল পূর্ব খাজনা আদায় শুরু করলে মুক্তিবাহিনীরা উক্ত অফিসটি পুড়িয়ে দেয় এবং অফিস থেকে একশত ও সাতটি মাইন উদ্ধার করেন। ১০ই অক্টোবর ৪ বেলা দশ ঘটিকায় প্রায় চল্লিশ জন পাক সেনী ও দেড় শতাধিক রাজাকার সমম্বয়ে একটি দল চানপুরে লুটতরাজ শুরু করলে মুক্তি যােদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তিন জন পাক সেনা ও ৫ জন রাজাকার খতম করেন। দস্যু সেনরা টিকতে না পেরে পালিয়ে যায়। ১১ই অক্টোবর রাত বারটার সময় পাঁচগায়ের কুখ্যাত রাজাকার আরমান আলী মণ্ডল ও তার ছেলেকে মুক্তিযােদ্ধারা হত্যা করে। ঐ একই দিনে কাচিনয় একজন সাধারণ মানুষ একজন রাজাকারকে ধরে মুক্তি বাহিনীর হাতে সােপর্দ করে এবং তাকে মুক্তি বাহিনীরা হত্যা করে। তাহার একটি রাইফেলসহ ২৭ রাউণ্ড গুলি পাওয়া যায়। ১৩ই অক্টোবর ঃ সােহাগপুর গহর নামক পুলে মুক্তি বাহিনী ও রাজাকারের মধ্যে এক সংঘর্ষ হয়। এবং ৩২ জন রাজাকার নিহত হয় এবং বহু সংখ্যক আহত হয়। রাজাকারদের অবস্থা গত ১১ই অক্টোবর দেওপাড়া পাক ঘাটী হইতে ৩০ জন রাজাকার পলায়ন করিলে জল্লাদের দলেরা বাকী ২৮ জন রাজাকারকে মেশিন গানের গুলিতে হত্যা করে।
জাগ্রত বাংলা ১: ৪।
১৪ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯