You dont have javascript enabled! Please enable it!

যুদ্ধোত্তর বৈদেশিক সাহায্য | মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম

একটি দেশের বৈদেশিক সাহায্য মৌলিকভাবে দাতা ও গ্রহীতার স্বার্থের ওপর নির্ভর করে এবং বাংলাদেশ ও আমেরিকার সাহায্যক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। প্রাকস্বাধীনতা আমলে আমেরিকার সাহায্য ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রমুখী, কারণ আমেরিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রসারিত করে দক্ষিণ এশিয়ার ওপর কৌশলগত প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং উপমহাদেশে সােভিয়েত ও ভারতীয় প্রভাবের মাত্রা হ্রাস করা। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার সামরিক সাহায্যের ওপর সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞা আরােপিত হলেও অর্থনৈতিক সাহায্য তখনও অব্যাহত ছিল। স্বাধীনতার পরেও পাকিস্তানে এই ধারা অব্যাহত ছিল, তবে উপমহাদেশে বাংলাদেশ নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় মার্কিন সাহায্যের ধারায়ও কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়। তবে স্বাধীনতার প্রথম দিকে বাংলাদেশে মার্কিন সাহায্যের মূলধারা ছিল ত্রাণসাহায্যভিত্তিক।

গ্রহীতা দেশগুলাে ধনী রাষ্ট্রের কাছ থেকে অর্থনৈতিক এবং অ-অর্থনৈতিক উভয় ধরনের ঋণ সাহায্য গ্রহণের প্রয়ােজনীয়তা দেখে এবং স্বাধীনতাত্তোর। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রয়ােজনীয়তাই ছিল মুখ্য। বিশেষ করে অঅর্থনৈতিক সাহায্যের মধ্যে সামরিক সাহায্য সংগ্রহে বাংলাদেশের প্রাথমিকভাবে কোনাে লক্ষ্যমাত্রাই ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে মূল প্রয়ােজন ছিল ত্রাণসাহায্য এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামাে গড়ে তােলা ও পুনর্নির্মাণের জন্য সরাসরি অর্থনৈতিক সাহায্য। দেশে একটি ন্যূনতম লক্ষ্যমাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে গেলেও অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও সম্পদ সমাবেশের যে আনুপাতিক ধারা বজায় রাখতে হয় সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে তা সম্ভবপর ছিল না। ফলে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় অনুপাত ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়ােগ অনুপাতের মধ্যে ছিল বিশাল এক ভারসাম্যহীনতা। এ

পৃষ্ঠা: ২০১

ভারসাম্য দূর করতে গিয়ে বিদেশি সাহায্য ও ঋণ সংগ্রহ করে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও বিনিয়ােগ প্রবাহ বাড়ানাে ছাড়া বাংলাদেশের কোনাে গত্যন্তর ছিল না।

অন্যদিকে পাকিস্তান আমল থেকেই বাংলাদেশ ছিল কারিগরি ও বৃহৎ শিল্পক্ষেত্রে প্রবেশাধিকারবঞ্চিত। পাকিস্তান আমলে বেশিরভাগ ভারী শিল্প পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে ওঠায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল আমদানিনির্ভর। পাট ও টেক্সটাইল শিল্প, কাগজ শিল্প ও ইস্পাত শিল্পের অংশ বিশেষ ছাড়া। এতদঞ্চলে ভারী কোনাে শিল্পব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়নি—যার অধিকাংশ আবার ৯ মাসের যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শেষত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল বাংলাদেশের নিত্যসঙ্গী, যার ফলে দেশের একমাত্র সম্পদভিত্তি কৃষি অর্থনীতিও ছিল নাজুক অবস্থায়।

১৯৬৯ সালের অক্টোবরে, অর্থাৎ পাকিস্তান আমলেই পূর্ব পাকিস্তানে একবার দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দেয়। বন্যা ও খরায় দেশে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় খাদ্যসামগ্রী বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় এবং একশ্রেণীর মজুতদার ও মুনাফাখাের রাতারাতি খাদ্যশস্যের দাম বাড়িয়ে বাজারে যা ছিল তা-ও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জরুরিভিত্তিতে ১৭ লাখ টন গম, সাড়ে তিন লাখ টন চাল ও আমেরিকান পিএল-৪৮০ বাবদ ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য এনে কোনােক্রমে সে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে সরকার কৃষি, বাজেট ও অর্থ বিভাগ তাৎক্ষণিকভাবে ৮ লাখ টন এবং পরিস্থিতির উন্নতিসাপেক্ষে ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিএল৪৮০-এর আওতায় আরাে দুই লাখ টন খাদ্যশস্য মঞ্জুর করে।১ ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি অফিস থেকে এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসিস্ট্যান্সের আওতায় পাকিস্তানকে ১০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণদানের একটি প্রস্তাব করা হয় এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাৎক্ষণিকভাবে ৫০ মিলিয়ন ডলার ও পরে সরবরাহ করার শর্তে আরাে ৫০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য অনুমােদন করেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল এক ঘূর্ণিঝড়ে কয়েক লক্ষ লােক নিহত হলে জরুরিভিত্তিতে ২৫ হাজার ডলারের গণসাহায্যসহ অঘােষিত পরিমাণে পিএল-৪৮০ ভিত্তিক অনুদানের ঘােষণা দেয়া হয়। সাহায্য সামগ্রীর মধ্যে ছিল ১০০০ তাঁবু, ১০ হাজার কম্বল, অতিরিক্ত ১ লাখ ডলারের সমপরিমাণ পাকিস্তানি রুপি এবং পরবর্তী পর্যায়ে আরাে ৪৭ লাখ ডলার পাকিস্তানি রুপির সাহায্য। উন্নয়ন কাজের জন্য সাড়ে তিন কোটি ডলার সমপরিমাণ পাকিস্তানি রুপি এবং ১ কোটি ডলারের খাদ্যবহির্ভূত ত্রাণ সাহায্য পাঠানাে হয়। পাকিস্তানের তাৎক্ষণিক প্রয়ােজন মেটানাের জন্য দেয়া হয় আরাে ৫০ হাজার টন। গমের পিএল-৪৮০ ভিত্তিক সাহায্য। এ আই থেকে অতিরিক্ত ১ কোটি ডলারের খাদ্য ও স্থানীয় মুদ্রার সাহায্য মঞ্জুর করা হয়।২

পৃষ্ঠা: ২০২

১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি হিসাব করা হয় যে অর্থবছরে পূর্ব পাকিস্তানে মােট মার্কিন সাহায্য মঞ্জুর করা হয়েছে ৯০ লাখ ডলার সমপরিমাণের এবং দুর্গত এলাকায় সরাসরি ১০ লাখ পাউন্ড ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে। ১৬ মিলিয়ন ডলার দামের আরাে ১ লাখ ৫০ হাজার টন খাদ্যশস্য সরবরাহের জন্য অনুমােদন চাওয়া হয়েছে। হিসাব করা হয় যে, দেশে মােট ত্রাণসামগ্রীর প্রয়ােজন হবে প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে আমেরিকা বাংলাদেশে সাহায্য পাঠাবার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ভূমিকা গ্রহণ করে। মানবিক কারণে আমেরিকা ছিল বাংলাদেশকে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ। কিন্তু একই সঙ্গে তারা সতর্ক ছিল যাতে করে সাহায্যের অতি আগ্রহ এমন কোনাে পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে যে, মনে হতে পারে আমেরিকা বাংলাদেশকে খুব জলদিই স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে।

আমেরিকা এ সময় সিদ্ধান্ত নেয় যে বাংলাদেশকে যে ত্রাণ এবং শরণার্থী সাহায্যই করা হােক না কেন তা হবে জাতিসংঘের মাধ্যমে এবং ডলারের মাধ্যমে সাহায্য না করে তা করা হবে ত্রাণসামগ্রীর ভিত্তিতে। এমনকি ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাবার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক যে ব্যয় ধরা হবে তাও জাতিসংঘের তহবিল থেকে সংকুলানের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

১৬ জানুয়ারি ১৯৭২ আমেরিকার সিনিয়র রিভিউ গ্রুপ এক বৈঠকে বাংলাদেশের জন্য মানবিক সাহায্য নীতিমালার সুপারিশসমূহ প্রণয়ন করে তা স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠায়। এতে জাতিসংঘ থেকে বাংলাদেশের জন্য নবায়নকৃত ত্রাণসামগ্রী নীতিমালা ও জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মসূচিতে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়ার সুপারিশ করা হয়। এতে সােভিয়েত অংশীদারিত্বসহ বিশ্বমাধ্যম থেকে বাংলাদেশের জন্য সহায়তা কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিক সহযােগিতার ক্ষেত্র চিহ্নিত করারও সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয় যে, এই ব্যাপক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় পিএল-৪৮০-র অধীনে খাদ্যশস্য ও ভােজ্যতেল পাঠানাে হবে এবং এতদুদ্দেশ্যে ৭৫ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ৭ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন পিএল-৪৮০-র আওতাভুক্ত অনুদান ব্যবহার করা হবে। ১৯৭১ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে এই অনুদান ঘােষণা করা হলেও তৎকালীন গােলযােগপূর্ণ পরিস্থিতির জন্য তা পাঠানাে সম্ভবপর হয়নি।৩ এরপর আন্তর্জাতিক কোনাে সাহায্য না আসা অবধি এবং সাহায্যের মান বিবেচনা না করে নতুন কোনাে অনুদান প্রদানের সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকারও সুপারিশ করা হয়।৪ এতে বলা হয় যে, জাতিসংঘসহ সকল দাতা দেশ ও সংস্থা থেকে যে সাহায্য পাওয়া যাবে। আমেরিকা তার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের অংশীদারিত্ব নিতে পারে। পূর্ব

পৃষ্ঠা: ২০৩

পাকিস্তানের জন্য জাতিসংঘের রিলিফ অপারেশনে এর আগে আমেরিকার অংশীদারিত্ব ছিল ৭০ ভাগ এবং ভারতের জন্য শরণার্থী রিলিফের বেলায় আমেরিকার অবদান ছিল ৪০ শতাংশেরও কম। অর্থাৎ সামগ্রিক সাহায্যচিত্র না দেখা পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য সাহায্যের ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রতিশ্রুত অবদান রাখা হবে ন্যূনতম পর্যায়ে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, শুধুমাত্র জাতিসংঘের ত্রাণ তৎপরতার মধ্যে আমেরিকার অবদান সীমিত না রেখে আগে ত্রাণকার্যে ভালাে রেকর্ড রয়েছে এমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থাকেও আমেরিকার প্রতিশ্রুত তহবিল থেকে নগদ অর্থ, পুনর্বাসন সামগ্রী, অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার ইত্যাদি জোগান দেয়া হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভবিষ্যৎ মার্কিন সম্পর্কের রূপরেখা প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দান থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে বলা হয়, পিএল-৪৮০ বাদে ভারত ও বাংলাদেশের জন্য যে কোনাে তহবিল থেকে সাহায্য মঞ্জুরির আগে কংগ্রেসের অনুমােদন নিতে হবে। প্রেসিডেন্ট ইতােমধ্যেই নিজের উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ২৫০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের একটি সাহায্য প্যাকেজের আবেদন জানিয়েছেন, যার মধ্যে হাউস থেকে ১৭৫ মিলিয়ন মঞ্জুর করা হয়েছে। সেখান থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার ইতােমধ্যেই উত্তোলন করা হয়েছে। তার মধ্যে ভারতীয় শরণার্থীদের জন্য। আগে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে ২০ মিলিয়ন ডলার ও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মসূচির আওতায় ৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে।

এতে বাংলাদেশে তখন পর্যন্ত সামগ্রিক ত্রাণসাহায্যে একটি বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে দেয়া মােট সাহায্যের পরিমাণ ছিল ১৮০ মিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে আমেরিকার অবদান ছিল ১৪০ মিলিয়ন ডলার। গােলযােগের কারণে ত্রাণসামগ্রী খালাসকরণে মাঝে মধ্যে বিপত্তি দেখা দিয়েছে, যে কারণে পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছানাে প্রকৃত ত্রাণসামগ্রীর আর্থিক মূল্য ছিল ৯০ মিলিয়ন ডলার। পিএল-৪৮০’র আওতাভুক্ত ৭৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৭ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য এখন পর্যন্ত জাহাজজাত করা হয়নি।

সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের মূল্যায়নে বলা হয়, বাংলাদেশে খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রীর পাশাপাশি রাস্তাঘাট, সেতু, রেল যােগাযােগ ও অন্যান্য পরিবহন ও যােগাযােগ মাধ্যম ইত্যাদি পুনর্নির্মাণে স্থানীয় ও বিদেশি মুদ্রায় প্রচুর অর্থ প্রয়ােজন হবে। বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানির জন্য প্রয়ােজন বৈদেশিক মুদ্রার। ভারত ৩৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সিমেন্ট ও ইস্পাত এবং

পৃষ্ঠা: ২০৪

অতিরিক্ত ১২ মিলিয়ন স্টার্লিং পাউন্ডের সমান অনুদান ঘােষণা করেছে। সােভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্থানীয় বস্ত্র মিলগুলাের জন্য তুলা ও বাংলাদেশের প্রধান আয়ের উৎস পাটকলগুলাের জন্য সাহায্য দিচ্ছে। ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রিলিফ ও অন্যান্য সাহায্য বাবদ ভারতের মােট সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৩২০ মিলিয়ন ডলার। ১৯৭২ সালে শরণার্থী ও খাদ্য সাহায্য বাবদ প্রথম তিন মাসে ৬৭ লাখ ডলার ও পুনর্বাসন প্রকল্পে অতিরিক্ত ৫৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। শুধু খাদ্য ও পুনর্বাসনে ভারতের মােট সাহায্যের পরিমাণ ছিল ১২২ মিলিয়ন ডলার। ১৯৭২ সালের ৭ মার্চ মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল সদস্য হ্যারল্ড সন্ডার্স হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পাঠানাে সামগ্রিক বৈদেশিক সাহায্যের ওপর একটি প্রতিবেদন পেশ করেন।৫ এতে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে আমেরিকা থেকে ২১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ১ লাখ ৭৫ টন খাদ্যশস্য এবং জাতিসংঘকে সাহায্য বাবদ আরাে ৩ লাখ ডলার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। রিভিউ গ্রুপের প্রস্তাব ছিল যে, আমেরিকার দেয়া সাহায্য যেন মােট প্রতিশ্রুত সাহায্যের এক-তৃতীয়াংশের বেশি না হয়। কেবলমাত্র মার্কিন সাহায্য এক-তৃতীয়াংশের নিচে নেমে এলেই নতুন সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে।

এ মুহূর্তে বিশ্ব সাহায্য পরিস্থিতি এমন যে আমেরিকায় নতুন করে কোনাে প্রতিশ্রুতি দেয়ার প্রয়ােজনীয়তা নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের সময়সীমা ঘনিয়ে আসায় গােটা পরিস্থিতি আরাে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়ােজন। বর্তমানে বিদেশি সূত্র থেকে সাহায্য আসা অব্যাহত রয়েছে। তবে ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার থেকে মুরে উইলিয়ামস আমেরিকার প্রাথমিক অনুদানের সঙ্গে ১০ থেকে ২০ মিলিয়ন ভােজ্যতেল যােগ করার সুপারিশ করেছেন। এটা সকলেরই জানা আছে বাড়তি ভােজ্যতেল উৎপাদন নিয়ে এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট সব সময়ই ব্ৰিত এবং তা সাহায্য তালিকায় রাখা হবে মার্কিন স্বার্থেরই অনুকূলে। অবশ্য এর পরেও আমেরিকার অংশীদারিত্ব সামগ্রিক সাহায্য প্রবাহের এক-তৃতীয়াংশ স্তর অতিক্রম করবে না।৬

তিনি বলেন, ইতােমধ্যে মােট বিদেশি প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে রয়েছে—

ব্রিটেন ২৫.৮ মিলিয়ন ডলার

কানাডা ৫.৫ মি. ডলার

সুইডেন ৬.০ মি. ডলার

অস্ট্রেলিয়া ১.০ মি. ডলার

সােভিয়েত ৫.৫ মি. ডলার

পাকিস্তান ১০.০ মি. ডলার

সুইজারল্যান্ড ২.৫ মি. ডলার

নিউজিল্যান্ড ১.০ মি. ডলার

শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসনে অন্যান্য বিদেশি সাহায্যের মােট পরিমাণ ২৪ মি. ডলার।

ভারত (খাদ্য, ত্রাণ, পরিবহন ও বিদেশি মুদ্রায় ঋণসহ) ১৬৮ মি. ডলার আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ২০.০ মি. ডলার

(রেডক্রস ৩ মিলিয়ন, ক্যাথলিক এজেন্সিসমূহ ১০ মিলিয়ন, ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেস ৫ মিলিয়ন, কেয়ার ১ মিলিয়ন ডলার)

আমেরিকা ২১.০ মি. ডলার

মোট ২৭৯.৩ মিলিয়ন ডলার৭

ভারতের অবদান বাদ দিলেও আমেরিকার প্রাথমিক অবদানসহ মােট সাহায্যের পরিমাণ ১২০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আমেরিকা এক-তৃতীয়াংশ হিসেবে মােট সাহায্য দিতে পারে ৪০ মিলিয়ন ডলার।

২০ মার্চ ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দি প্রেসিডেন্ট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স জেনারেল আলেক্সান্ডার হেগ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানাে এক মেমােতে প্রতিশ্রুত মােট সাহায্যের এক-তৃতীয়াংশের স্তর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় স্তরের সাহায্য মঞ্জুরির প্রস্তাব করেন। ইতােমধ্যে বাংলাদেশে খাদ্যাভাবের কারণে দুর্ভিক্ষাবস্থার আশঙ্কা দেখা দিলে সাহায্য আরাে বেগবান করে দুর্ভিক্ষাবস্থা সামাল দেয়ার প্রস্তাব করা হয়।৮ এতে আরাে বলা হয় যে, কংগ্রেস ইতােমধ্যেই বাংলাদেশে রিলিফ কার্যক্রমের জন্য অর্থ মঞ্জুর করেছে এবং সেখান থেকে ৩৫ মিলিয়ন ডলার ক্যাশ ও খাদ্য সাহায্য হিসেবে পাঠানাে যেতে পারে।

২৪ মার্চ জেনারেল হেগ আরেকটি মেমােরেন্ডামে এ যাবৎ আমেরিকার দেয়া সাহায্যের পরিপূর্ণ ফিরিস্তি দেন। এতে বলা হয়,

এ যাবৎ দেয়া ও প্রতিশ্রুত মার্কিন সাহায্যের মধ্যে রয়েছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টন চাল ও গম, ৫০ হাজার টন ভােজ্যতেল (২২ মিলিয়ন ডলার), ৩ মিলিয়ন ডলার ক্যাথলিক রিলিফ সার্ভিসেসের দেয়া আবাসন প্রকল্পের সাহায্য, লাে-কস্ট হাউজিং বাবদ কেয়ারের সাড়ে ৬ লাখ ডলার, পােতাশ্রয় পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়নের জন্য ৩৫ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের জাতিসংঘ ঋণ, ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির ছাত্র পুনর্বাসন ও কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির জন্য ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার এবং ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রসের ১৫ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য।

পৃষ্ঠা: ২০৬

ভারতের মােট প্রতিশ্রুত ও দেয় সাহায্য ধরা হয় সর্বোচ্চ ১৬১ মিলিয়ন ডলার এবং ভারত ও আমেরিকার পরে তৃতীয় সর্বোচ্চ অবদান ছিল সােভিয়েত ইউনিয়নের—পুনর্বাসন প্রকল্প ও পণ্য সাহায্য বাবদ মােট ৫১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। অন্যান্য উল্লেখযােগ্য ঋণদাতার মধ্যে রয়েছে গ্রেট ব্রিটেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্স।৯

 ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর বাংলাদেশে মার্কিন সাহায্য প্রবাহও বেড়ে যায়। ১৫ মে সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের বৈঠকের বিবরণী থেকে দেখা যায় যে এ যাবৎ বাংলাদেশে মােট প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৭৭০ মিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে আমেরিকার অবদান ছিল ১১৬ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া জাতিসংঘ, আইবিআরডি, আইএমএফের দেয়া ঋণসহ পুনর্বাসন কাজে বাংলাদেশের জন্য প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৬৪৮ মিলিয়ন ডলার এবং এর চেয়ে বেশি একটি তহবিল বরাদ্দ ছিল ১৯৭২ সালের জন্য। অন্যদিকে ১৫ জুলাই নিক্সনের কাছে কিসিঞ্জারের পাঠানাে ত্রাণ হিসেবে পাওয়া যায়, সেদিন পর্যন্ত ইইসি এবং বেসরকারি উৎসের দেয়া মােট সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৫৩৩ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ডলার এবং আমেরিকার অবদান ছিল ২৬৩ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার যা যােগ করলে মােট সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৯৬ দশমিক ৯১ মিলিয়ন ডলার। আমেরিকার দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলাের মধ্যে ছিল স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলাের দেয়া ১৪ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন ডলার, জাতিসংঘের রিলিফ অপারেশন ৩৫ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশ সরকারকে সরাসরি দেয় ১১৫ মিলিয়ন ডলার, পরিবহন খাতে ৭ দশমিক ২৮ মিলিয়ন ডলার এবং পিএল-৪৮০ খাতে ৯০ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার।

৩ আগস্ট নাগাদ জাতিসংঘ বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের জন্য ১ মিলিয়ন টন খাদ্য সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশকে আশু দুর্ভিক্ষাবস্থা থেকে বাঁচানাের আবেদন জানায়। সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারা পৃথিবী থেকে বাংলাদেশের জন্য খাদ্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায় ৭ লাখ ৩ হাজার টন। এর মধ্যে আমেরিকার অংশ ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার টন। অন্যান্য দেশের প্রতিশ্রুত খাদ্য সাহায্য ছিল নিম্নরূপ :

আমেরিকা

৩৫০ হাজার টন

ইইসি ১২৮ হাজার টন

জাপান ৬১.১ হাজার টন

ভারত ৫০ হাজার টন

কানাডা ৫০ হাজার টন

অস্ট্রেলিয়া ৪০ হাজার টন

পাকিস্তান ২২ হাজার টন

ইউকে ২০ হাজার টন

মোট ৭৩৭ দশমিক ১০ হাজার টন।১০

১৯৭২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে আবার খাদ্য সংকটের আশঙ্কা দেখা দেয়। ১ নভেম্বর মার্কিন দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত মিশন চিফ ড্যানিয়েল নিউবেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করলে শেখ মুজিব জরুরিভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত খাদ্য সাহায্য প্রার্থনা করেন। মুজিব বলেন, খাদ্য সাহায্যের যেসব প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ও যাচ্ছে সেগুলাে প্রসেস করতে প্রচুর সময় লেগে যাচ্ছে এবং তিনি দীর্ঘ অথবা স্বল্পমেয়াদি ঋণে, এমনকি প্রয়ােজনবােধে নগদ মূল্যে হলেও খাদ্যশস্য সংগ্রহে আগ্রহী। তিনি জানান যে, বাংলাদেশ ইতােমধ্যেই বার্মা, থাইল্যান্ড, জাপান ও সিঙ্গাপুর থেকে খাদ্যশস্য ক্রয় করেছে।১১ মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মুজিবকে পরামর্শ দেন যে, বিদ্যমান অবস্থায় দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ নগদ মূল্যে খাদ্য কিনলেই তা উত্তম হবে। একই সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৮৭ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং।

মুজিব এবং তার প্রতিনিধিরা এ সময় অন্যান্য দেশের সঙ্গেও খাদ্য সাহায্য নিয়ে দেনদরবার করেন। কানাডার হাইকমিশনার মুজিবের সঙ্গে দেখা করে জানান যে, সেপ্টেম্বর মাসে কানাডা খাদ্য সাহায্যের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জাহাজ না পাওয়ার কারণে তা পাঠানাে যায়নি। খুব সম্ভবত মার্চের আগে তা বাংলাদেশে আসবে না। তিনি মুজিবকে বলেন, আমাদের ফলন কম হলেও ফেব্রুয়ারি আগে তা অনুভব করা যাবে না এবং ইতােমধ্যে কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির ভাইস প্রেসিডেন্ট ঢাকা এসে দীর্ঘমেয়াদি সাহায্যের ব্যাপারে আলােচনা করে যাবেন।

অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার বলেন যে, তিনি মুজিবের দেখা পাননি। তবে মধ্য সেপ্টেম্বরে খাদ্যমন্ত্রী একবার খাদ্য সাহায্যের জন্য তদবির করেছিলেন। তাকে জানানাে হয়েছিল যে, অস্ট্রেলিয়ার হাতে নগদ মূল্যে বিক্রির ১ লাখ টনের মজুদ নেই।

১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা দেয়া হলে আওয়ামী লীগসহ দেশের তখনকার সব ক’টি রাজনৈতিক দল একযােগে নির্বাচনে নেমে পড়ে। নির্বাচনী প্রচারের সময় বাংলাদেশে আমেরিকান সাহায্যের স্বরূপ একটি বিশেষ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমেরিকার পাকিস্তানপন্থী মনােভাবের কারণে অনেকেই ঋণ ও সাহায্য নিয়ে আমেরিকার আন্তরিকতার প্রশ্ন তােলেন, এমনকি আমেরিকার সাহায্য দানের পেছনে অশুভ কোনাে উদ্দেশ্য কাজ করছে বলে প্রচার করা হয়। একপর্যায়ে

পৃষ্ঠা: ২০৮

তাজউদ্দীন আহমদ ও তােফায়েল আহমেদের মতাে নেতারাও এই আমেরিকান বিরােধী শিবিরে শরীক হন এবং অন্যদের সঙ্গে মিলে আমেরিকার বিরুদ্ধে বিষােদগার করতে থাকেন। এদের মধ্যে কয়েকজন আবার বাংলাদেশ আমেরিকার কাছ থেকে কোনাে সাহায্য চায় না বলেও মন্তব্য করে বসেন। তারা এ-ও বলেন যে, আমেরিকা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের এড়িয়ে সিভিল সার্ভেন্টদের হাত করে তাদের মাধ্যমে সমস্ত ঋণ ও সাহায্য কার্যক্রম পরিচালিত করতে চাইছে।

এ সময় আমেরিকা ১৯৭৩ সালের জন্য বাংলাদেশে ইউএস এইড কর্মসূচি প্রণয়নের পদক্ষেপ নিচ্ছিল। বাংলাদেশি নেতাদের রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরতা এই কর্মসূচি প্রণয়নের পথে সমূহ বাধার সৃষ্টি করে। ফলে ইউএস এইড কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় বিঘ্নন সৃষ্টি হয়। মুজিব সরকার ইউএস এইড প্রত্যাহারের ইস্যুটি তার নির্বাচনী প্রচারণা থেকে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ কারণে বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কেই ফাটল ধরার প্রবণতা দেখা দেয়। ঘটনাক্রম বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও সিভিল সার্ভিসের মধ্যেও একটি তিক্ততা সৃষ্টি করে।

এমতাবস্থায় আমেরিকা সিদ্ধান্ত নেয় যে, ১৯৭৩ সালের ইউএস এইড চুক্তি স্বাক্ষরের আগে বাংলাদেশকে অবশ্যই চাপের মধ্যে রাখতে হবে। বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাস থেকে পরামর্শ দেয়া হয় যে, অত্যন্ত বিনম্রভাবে এবং ভদ্রজনিত ভাষায় বাংলাদেশ সরকারকে জানাতে হবে যে প্রকাশ্যে অত্যন্ত জাঁকজমক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই চুক্তি স্বাক্ষরের আয়ােজন করতে হবে, যাতে করে তা বিপুলভাবে প্রচারণা পায়। সম্ভবপর হলে অর্থমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতাে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে সেই অনুষ্ঠানে নিয়ে আসা হবে। অন্যথায় মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিদের অনুষ্ঠানের সঙ্গে এমনভাবে সম্পৃক্ত করা হবে যাতে করে জনমনে ধারণা জন্মে যে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক কারণে আমেরিকাবিরােধী বক্তব্য ছাড়লেও আসলে তারা আমেরিকার প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন নন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এ কৌশল কার্যকর না হলে প্রয়ােজনবােধে ৭ মার্চের নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত ইউএসএইডের ঋণদান কর্মসূচির নবায়ন স্থগিত রাখা হবে।১২

১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মার্কিন দূতাবাস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানাে এক নথিতে বলা হয় যে,

বাংলাদেশ সরকার যদি মনে করেন দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের মার্কিনপন্থী আঁকজমক অনুষ্ঠান করা বিপদজ্জনক হয়ে পড়বে, তা হলে আপাতত কোনাে কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা উচিত ও অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে বাংলাদেশের মনােভাব পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

২৬ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের আরাে অবনতি ঘটে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতার একটি অংশ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে ইউসিস সেন্টারগুলােতে

পৃষ্ঠা: ২০৯

হামলা চালায় ও অফিসের ক্ষতিসাধন করে। এর আগে ১১ ডিসেম্বর ঢাকায় ইউসিস কার্যালয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ভিয়েতনামে মার্কিন হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলেও শেষবারের হামলার সুনির্দিষ্ট কোনাে কারণ ছিল না। চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স নিউবেরি এ নিয়ে অভিযােগ তুলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং বাংলাদেশে আমেরিকান ফ্যাসিলিটিগুলাের নিরাপত্তা জোরদার করার দাবি জানান।

বাংলাদেশে ভারতীয় সাহায্য

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত শুধু বাংলাদেশকে আশ্রয় এবং সামরিক সাহায্যই দেয়নি, যুদ্ধকালে এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবেও অভূতপূর্ব সহযােগিতা করেছে। অনেকে ভারতের এই সাহায্যকে পাকিস্তান ভাঙার উদ্দেশ্যে যথার্থ বিনিয়ােগ বলে মনে করলেও এ কথা অবিসংবাদিতভাবে সত্য যে ভারতের সামরিক, মানবিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য ছাড়া এত অল্প সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাে না। ভারতবিরােধীরা অবশ্য প্রকাশ্যেই দাবি করেন যে, ভারতের সামরিক সাহায্য ছাড়াই এবং একমাত্র গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমেই পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব ছিল। কিন্তু তার জন্য যুদ্ধ হতাে প্রলম্বিত এবং উভয়পক্ষে জান ও মালের যে ক্ষতি হতাে তা হতাে বাস্তব ক্ষতির চাইতে বহুগুণে বেশি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে নয়াদিল্লি যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি ও প্রশাসন পুনর্গঠন ও বিনির্মাণে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পলিসি প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকা আসেন। তিনি বলেন যে, ভারত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছে১৩ এবং জাতীয় পুনর্গঠনে সব ধরনের সাহায্য প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ। ১৯৭২ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঢাকা সফর করার কর্মসূচি স্থির করার পর জানুয়ারির ২২ তারিখে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে ডি পি ধর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসেন এবং বৈঠকের পর ৩ ফেব্রুয়ারি দুজন একটি যুক্ত স্মারকে স্বাক্ষর করেন। পরে ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরকালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির ৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, দু’দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে এবং বাণিজ্য, পরিবহন। ও যােগাযােগ বিষয়ে সাম্য ও পারস্পরিক সুবিধাভিত্তিক সহযােগিতার ক্ষেত্র অনুসন্ধান ও তা কার্যকর করবে।১৪ নয়াদিল্লি আশ্বাস দেয় যে, তারা তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশে ২ লাখ টন নাইট্রোজেন সার, দুই লাখ টন আকরিক

পৃষ্ঠা: ২১০

তেল, ২৫ হাজার বেল তুলা, ১ হাজার বেল সুতা এবং দেড় লাখ টন খাদ্য সাহায্য পাঠাবে।১৫ চুক্তির ধারাবাহিকতা অনুসারে ২৮ মার্চ দু’দেশের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে উভয়পক্ষে ২৫ কোটি টাকা লেনদেনে বাণিজ্য ভিত্তি সম্প্রসারণের ব্যবস্থা রাখা হয় ও বাংলাদেশকে ভারত সুদমুক্ত ৫ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করে। চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ থেকে ৯ কোটি টাকার তাজা মাছ, সাড়ে ৭ কোটি টাকার কাঁচা পাট ও ৩ কোটি টাকার কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট এবং ভারত থেকে ১০ কোটি টাকার কাঁচা তামাক, সাড়ে ৪ কোটি টাকার সিমেন্ট এবং ৪ কোটি টাকার কয়লা সরবরাহের কর্মসূচি নেয়া হয়।

অবশ্য তদানীন্তন বাংলাদেশের অর্থনীতির ভঙ্গুরতা এবং যােগাযােগ ও উৎপাদন কাঠামাের অনিশ্চয়তার জন্য এ চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসের এক হিসাবে দেখা যায় যে, দু’দেশের মধ্যে ৪ কোটি টাকার বাণিজ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে এবং তা হয়েছে ভারতের অনুকূলে।১৬

ত্রাণসামগ্রী হিসেবে ১৯৭২-৭৩ সালে ভারত বাংলাদেশকে ৫০ কোটি রুপির খাদ্যশস্য এবং ৩০ কোটি রুপির সাধারণ সামগ্রী পাঠায়। এ ছাড়া পরিবহন ব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য ১০ কোটি রুপির আর্থিক সাহায্য মঞ্জুর করা হয়। পাশাপাশি সাড়ে ৯ কোটি রুপির বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ ও সাড়ে ১৮ কোটি রুপি শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ করা হয়। এ ছাড়া ভারত কাঁচামাল, ইস্পাত, সার, পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য পণ্য আমদানির জন্য ৫ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২৫ কোটি রুপি অতিরিক্ত অনুদান মঞ্জুর করে। ১৯৭৩ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ভারতীয় সাহায্যের মােট পরিমাণ ছিল ২১০ কোটি রুপি ও ২৫ কোটি রুপির বিশেষ ব্যাংক ঋণ।

একই সময়ে ভারত ৭৮ দশমিক ৪৬ কোটি রুপি মূল্যের সাড়ে ৭ লাখ টন খাদ্যশস্য সরবরাহ করে, যার মধ্যে সাড়ে ৬ লাখ টন ছিল গম এবং ১ লাখ টন চাল। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের খাদ্য ঘাটতির সহায়ক হিসেবে ১৯৭২ সালের শেষের দিকে অতিরিক্ত দেড় লাখ টন খাদ্যশস্যও পাঠানাে হয়। অন্যান্য ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে ছিল ৮৬ লাখ রুপি মূল্যের ডাল, ম্যাচবক্স ও হ্যান্ডপাম্প। কয়লার ঘাটতি পূরণের উদ্দেশ্যে বার্জ, রেলওয়ে ও স্টিমারযােগে ২ লাখ ৭৬ হাজার টন কয়লা বাংলাদেশে পাঠানাে হয়। এ ছাড়া বছরে আড়াই শতাংশ হার সুদে ১৫ কিস্তিতে পরিশােধযােগ্য ৫ মিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রার ঋণ মঞ্জুর করা হয়। সামগ্রিকভাবে ১৯৭১-৭৫ সালে ভারত বাংলাদেশকে ২১৫ দশমিক ২৫ কোটি রুপির অনুদান ও ৯৩ কোটি রুপির ঋণ সাহায্যসহ প্রায় ৩০০ কোটি রুপির সাহায্য মঞ্জুর করে। অবশ্য মধ্যে কেবলমাত্র স্বাধীনতার প্রথম বছরে অর্থাৎ ১৯৭২৭৩ সালে মঞ্জুরকৃত সাহায্যের পরিমাণই ছিল ২০০ কোটি রুপির বেশি।

পৃষ্ঠা: ২১১

১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ভারত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পরে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সাহায্যদাতা দেশ। আমেরিকার স্টাডি গ্রুপের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের মােট প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের মধ্যে সে সময় ভারতের অবদান ছিল ১৮ শতাংশ। ১৯৭২ সালের মে মাস থেকে ১৯৭৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৮টি সাহায্য ও ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ১৯৭৪

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে বাংলাদেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সাহায্য প্রবাহ অব্যাহত থাকলেও সামগ্রিক প্রয়ােজনের তুলনায় তা পর্যাপ্ত ছিল না। আমেরিকার রিসার্চ গ্রুপের হিসাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে খাদ্য সাহায্য, অবকাঠামাে পুনর্নির্মাণ এবং ত্রাণ সাহায্যসহ আর্থিক হিসেবে প্রয়ােজন ছিল ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ মােট প্রাপ্ত সাহায্যের পরিমাণ ছিল ১ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে। এরপর আবার ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে সর্বগ্রাসী বন্যার ফলে আমন ও আউশ ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়, যার ফলে অভ্যন্তরীণভাবে খাদ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হয়। ফলে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তাকে আজো বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহতম সামাজিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কারণকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তবে সবাই মােটামুটিভাবে একমত যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শস্যোৎপাদন কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থার আচরণ, প্রতিকূল মাইক্রো-ইকোনােমিক পরিস্থিতি এবং দুর্যোগের সময়টাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যশস্য সংগ্রহ বা সরবরাহে ব্যর্থতা ছিল দুর্ভিক্ষের মূল কারণ। অর্থনীতিবিদদের মতে, সবগুলাে উপলক্ষ একত্রিত হয়ে সমাজের সবচাইতে দুস্থ অংশটাকে সবেগে আঘাত করেছে এবং বিশেষ করে দিনমজুর শ্রেণীর পরিবারগুলাে এতে চরমতম দুর্দশার শিকার হয়েছে।১৭

দেশের ভূমিহীন জনসংখ্যার হার সে সময় যেখানে ছিল শতকরা ৪০ ভাগ সেখানে আর্থিক খাতে সম্প্রসারণ প্রবণতা বাড়লেও উৎপাদন ও বিনিয়ােগ ভারসাম্য আসতে বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর সময় লেগে যায়। আর্থিক সম্প্রসারণের সীমা ১৯৭২ সালের ৭০ ভাগ থেকে ১৯৭৪ সালে কিছুটা নেমে এলেও রাজস্ব আদায়ে মন্দা ও নবগঠিত সরকারের জন্য সরকারি ব্যয়ের উচ্চহার প্রতিবছর বাজেট ঘাটতিকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলছিল। ভােগ্যপণ্যের মূল্যসূচক ১৯৭২ সালে ৫২ শতাংশ, ১৯৭৩ সালে ৩৩ শতাংশ এবং ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি-জুন মাসে দাঁড়ায়। ২১ শতাংশে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতি প্রান্তিক চাষী, কৃষি শ্রমিক ও শহুরে দিনমজুরদের আয় নিশ্চিত করলেও তাদের প্রকৃত আয় ছিল ন্যূনতম জীবনযাত্রা নির্বাহের প্রয়ােজনের তুলনায় অনেক কম।

পৃষ্ঠা: ২১২

১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে বাজারে খাদ্যমূল্য পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। আগের বছর ১৯৭৩-এর তুলনায় খাদ্যসামগ্রীর দাম ছিল দ্বিগুণেরও বেশি। অথচ ১৯৭৩ সালের আমন ফসল মিলিয়ে ১৯৭৪ সালের খাদ্যোৎপাদন ছিল আগের বছরের চাইতে বেশি। কিন্তু জুলাই-আগস্ট মাসে ভয়াবহ এক বন্যায় প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের নিদারুণ ক্ষতি হয় এবং গ্রামের লােকজন তাদের প্রধান কর্মসংস্থান ও নগদ অর্থের উৎস থেকে বঞ্চিত হয়। উপরন্তু বাড়তি বিনিয়ােগের জোগান না থাকায় পরের বছর আমন উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় এবং চাষীরা আগাম দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় ভীত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে আবার খবরের কাগজগুলােতে আউশ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার কাল্পনিক চিত্র তুলে ধরায় ভীতিবােধ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে তখনাে শক্তিশালী কোনাে ফসল ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি এবং নবগঠিত ফসল ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে খাদ্যশস্যের আসল মজুদ ও উৎপাদন। এবং ফসলের নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা ছিল না। ফলে আমন উৎপাদন কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং মৌসুমের শেষ দিকে বিলম্বে চারা রােপণের মধ্য দিয়ে ক্ষতি কতটুকু পুষিয়ে নেয়া যাবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার মতাে কেউ ছিল না। এমতাবস্থায় বাজার ব্যবস্থা ক্রমাগত গুজবের শিকার হতে থাকে। ব্যবসায়ী ও সরকারি এজেন্সিগুলাে খাদ্যশস্যের অভাবের আশঙ্কায় অস্বাভাবিক এক মজুদ পরিস্থিতি গড়ে তােলে। ১৯৭২-৭৩ সালে দেশে খাদ্য পরিস্থিতি সন্তোষজনক না থাকায় প্রায় ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে নগদমূল্যে সংগ্রহ করতে হয়েছিল, যা ১৯৭৪ সালে এসে আরাে অধিক হারে আমদানির পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেয়।

১৯৭৪ সালের মার্চ মাস থেকেই খাদ্যশস্যের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এর প্রধান কারণ ছিল সরকারি গুদামে খাদ্য মজুদের অপ্রতুলতা। ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় সরকারি খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি ১৯৭৪ সালে প্রায় অর্ধেকে এসে দাঁড়ায়, যখন সরকারি মজুদের মােট পরিমাণ ছিল মাত্র দেড় লাখ টন। এ অবস্থায় সরকারকে বাধ্য হয়ে শহরভিত্তিক রেশনিং ব্যবস্থায় সংকোচন নিয়ে আসতে হয়। জানুয়ারি থেকে রেশন ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণে ভাটা পড়ায় সরকারের ওপর জনগণের আস্থা শেষ হয়ে যায় এবং সবাই ধরে নেন যে দেশ ক্রমাগত দুর্ভিক্ষের দিকে এগিয়ে চলছে। এতে খাদ্যশস্যের দাম আরেক দফা বেড়ে যায় এবং চাল ব্যবসায়ী ও নব্য মজুদদার গােষ্ঠী খাদ্যাভাব ও আগামীতে মুনাফা লােটার আশায় মজুদ পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করে তােলে।

১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি থেকেই বাংলাদেশ বিদেশ থেকে বিশেষ করে আমেরিকা থেকে খাদ্য সাহায্যে তেমন একটা সাড়া পাচ্ছিল না। সে বছর বাংলাদেশে ২৫ লাখ টন খাদ্য আমদানির প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিলেও বিশ্ববাজার থেকে বাংলাদেশকে ক্রয় করতে হয় ১১ লাখ টন। আমেরিকা বাদে অন্যান্য দেশ

পৃষ্ঠা: ২১৩

থেকে প্রতিশ্রুত খাদ্য সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ টন এবং বাকি ৭ লাখ টনের প্রতিশ্রুতি ছিল আমেরিকার, যার মধ্যে বছরের প্রথম দিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল ২ লাখ টন। বাকি ৫ লাখ টনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ঋণচুক্তির আওতায় ২ লাখ টন এবং পিএল-৪৮০’র আওতায় ৩ লাখ টন খাবার পাঠানাের ব্যাপারটি তখনাে স্থির করা হয়নি। ১৯৭৩ সালের ২০ জুন ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের নির্বাহী সেক্রেটারি টি এল এলিয়ট কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানাে এক মেমােতে নভেম্বরের আগেই সেই ৫ লাখ টন খাদ্য পাঠানাের সুপারিশ করে বলেন যে, অন্যথায় বাংলাদেশ খাদ্য পরিস্থিতির দিক দিয়ে ব্যাপক দুর্যোগের সম্মুখীন হবে।১৮ ১৯৭৪ সালের প্রথম চতুর্থাংশের মধ্যে সেগুলাের জাহাজজাতকরণের সুপারিশ করা হয়।

এতে বলা হয়, আমেরিকার খাদ্যশস্য পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় ১৯৭৪ সালের জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য বণ্টনে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনাে কার্যক্রম নেয়া হয়নি—এমনকি ১৯৭৪ সালের প্রথম চতুর্থাংশের জন্যও নয়। ৬ জুলাইয়ের আগে কোনাে সিদ্ধান্তও নেয়া সম্ভব হবে না। একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত দেখিয়ে জুলাই মাসের মধ্যে খাদ্যপণ্য আমেরিকার বন্দর ত্যাগ এবং অতিরিক্ত ১ লাখ টন গম পরের বছরের বরাদ্দ থেকে আগাম হিসেবে সত্বর সরবরাহের জন্য মেমােতে অনুরােধ জানানাে হয়।

১৯৭৪ সালের আমেরিকায় ক্ষমতার পালাবদলের পর প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের আমন্ত্রণে শেখ মুজিবুর রহমান আমেরিকা যান। তিনি বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষাবস্থা ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির একটি চিত্র ফোর্ডের সামনে তুলে ধরেন। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড শেখ মুজিবকে অতি সত্বর দেড় লাখ টন খাদ্য পাঠানাের আশ্বাস দেন ও আরাে এক লাখ টন আমেরিকার উৎপাদন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিবেচনাধীন রয়েছে বলে জানান।১৯

কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাইরে থেকে খাদ্য আনার সবগুলাে সরকারি প্রচেষ্টা সফল হয়নি। একদিকে সরকারের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল না এবং অন্যদিকে আমেরিকা থেকে প্রতিশ্রুত খাদ্য সাহায্য পাওয়ার পথে একের পর এক বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছিল। ১৯৭৪ সালের প্রথম চতুর্থাংশে বাংলাদেশে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৯৭৩ সালের একই সময়ের প্রায় অর্ধেক। বছরের তিন-চতুর্থাংশে গিয়ে রিজার্ভ দাঁড়ায় আগের বছরের একই সময়ের রিজার্ভের ২৫ ভাগে। আইএমএফের কম্পােজিটরি ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি থেকে ঋণ সংগ্রহের পরিমাণ ছিল নগণ্য। ১৯৭৪ সালের দ্বিতীয় চতুর্থাংশে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৫ মিলিয়ন ডলার।২০ পরবর্তী তৃতীয় ও চতুর্থাংশেও তা ছিল মাত্র ১৮ মিলিয়ন ডলার ও ৩৮ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের ক্রেডিট পাওয়ার যােগ্যতা এমন কম ছিল যে স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণ পাওয়া লেনদেনগুলােও শেষ পর্যন্ত দাতা সংস্থাগুলাে বাতিল করে দেয়। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস নাগাদ মােট খাদ্যশস্য আমদানি করা

পৃষ্ঠা: ২১৪

হয় ২৯ হাজার ও ৭০ হাজার টন, অথচ তখন প্রতি মাসের জন্য খাদ্য চাহিদা ছিল। আড়াই থেকে তিন লাখ টন। ( সে সময় অনেকেই ব্যাপক চোরাচালানকে খাদ্য ঘাটতি ও দুর্ভিক্ষের অন্যতম একটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু সমীক্ষায় দেখা গেছে, সীমান্ত উন্মুক্ত থাকায় এবং চোরাচালান একটি বিশেষ শ্রেণীর স্থায়ী পেশা হলেও দেশের সামগ্রিক খাদ্য ঘাটতির প্রেক্ষাপটে চোরাচালানের অবদান ছিল নগণ্য। সাধারণত আমন ও বােরাে ফসল উৎপাদনের পরপর সীমান্তের অপর পারে খাদ্যমূল্য বেশি থাকলে খাদ্যের চোরাচালান হয় এবং ব্যক্তিগতভাবে মাথায় অথবা গরুর গাড়িতে করে চোরাচালানিরা অপর পারে মাল পাচার করে। একটি দেশের খাদ্য ঘাটতি হওয়ার জন্য যে বিশাল পরিমাণে চোরাচালান হওয়া দরকার, ব্যক্তিগতভাবে মাথায় বােঝা নিয়ে সেই পরিমাণ পণ্য ওপারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বড় চালানের জন্য প্রয়ােজন ট্রাকের বহর অথবা নদীপথে বার্জ। মানুষের চোখের সামনে দিয়ে সীমান্ত ফাঁড়ি অতিক্রম করে বার্জ বা ট্রাকের মাধ্যমে বিশাল চালান দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে পাচার হয়ে যাবে তা বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়নি।

যাই হােক, সীমান্তরক্ষীরা অনেক সময়ই অভিযােগ করেছেন যে, খাদ্য পাচারকারীদের বেশিরভাগই ছিল সরকারদলীয় সদস্য অথবা তাদের তল্পিবাহক। কাজেই তাদের প্রভাবের জোরে অনেক সময়ই চোরাচালানিদের ছেড়ে দিতে হয়েছে। স্থানীয় এক ধরনের প্রশাসনিক অফিসাররাও এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযােগ রয়েছে। কিন্তু এর পরেও যখন চারিদিকে খাদ্য ঘাটতির গুজব ও দুর্ভিক্ষের হাতছানি তখন জনগণ ও প্রচারমাধ্যমের চোখের ওপর দিয়ে এমন কোনাে বড় ধরনের খাদ্যের পাচার হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি।

খাদ্য ঘাটতি মােকাবিলার জন্য তখন বাংলাদেশ সরকারের করণীয় ছিল মূলত তিনটি।২১ প্রথমত সরকারিভাবে খাদ্য বিতরণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশাল এক খাদ্য মজুদ ভাণ্ডার সরকারি উদ্যোগে গড়ে তােলা। এর জন্য প্রধান করণীয় ছিল অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ কর্মসূচি জোরদার করা, কারণ কেবলমাত্র আমদানিকৃত খাদ্য দিয়ে বিশাল মজুদ ভাণ্ডার গড়ে তােলা প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ ও বাংলাদেশের জন্য ছিল অসম্ভব। কিন্তু ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্যোৎপাদন কম হওয়ায় ১৯৭৪ সালে বিশাল মজুদ ভাণ্ডার গড়ে তােলাও সম্ভব ছিল না। ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে খাদ্য সংগ্রহ অভিযান জোরদার করা হয়, কিন্তু তখন বাজারে চালের মূল্য ছিল সংগ্রহ মূল্যের চাইতে অনেক বেশি। অন্যদিকে সরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অযােগ্যতা ও দুর্নীতির কারণে সাধারণ কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্য সংগ্রহ এবং সরকারি গুদামে খাদ্য বিক্রয় বাধ্যতামূলক ও তা নিয়ন্ত্রণের জন্য মহল্লায় মহল্লায় কমিটি করে দেয়া হয়। কিন্তু কমিটিগুলােতে স্থানীয় টাউট ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অন্তর্ভুক্তি থাকায় মানুষ ভীত হয়ে পড়ে

পৃষ্ঠা: ২১৫

এবং খাদ্য সংগ্রহ কর্মসূচিতে অংশ না নিয়ে পক্ষান্তরে চালের মজুদ গড়ে তােলে। অন্যদিকে সরকার খাদ্য সংগ্রহ বাধ্যতামূলক করে দেয়ায় জনমনে আগাম দুর্ভিক্ষাবস্থা অনুমান করে ত্রাসের সঞ্চার হয়—যার ফলে মজুদ প্রবণতা আরাে এক দফা বেড়ে যায়। ১৯৭৪ সালে ৪ লাখ টন খাদ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বাস্তবে সংগ্রহ ছিল মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার টন।

এই উদ্যোগ একটি কার্যকর উদ্যোগ হলেও ১৯৭৪ সালে তা সফল না হওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং সংগ্রহ অভিযানের রাজনীতিকরণ। সরকারি কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপােষকতায় এ সময় চাল সরবরাহকারী ও সংগ্রহকারীদের মধ্যে মধ্যস্বত্বভােগী একটি দালাল চক্র গড়ে ওঠে এবং তাদের মুনাফা সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মধ্যেও আংশিকভাবে বণ্টিত হয় বলে অভিযােগ ওঠে। অনেক সময় মধ্যস্বত্বভােগীরা নিজেরাই সরকারি অর্থে চাল কিনে তা খােলাবাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দেয়। এতে করে সরবরাহ ব্যবস্থায় খােলাবাজারে অনুকূল অবস্থা এলেও সরকারি সংগ্রহ অভিযান আর সফল হয়নি।

অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থা স্থিতিশীল করার জন্য দ্বিতীয় যে ব্যবস্থা অবলম্বন করা যেতাে তা হলাে প্রবল জনমত সংগ্রহ করে সেই জনমতকে মজুদদার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। মজুদদার ও ব্যবসায়ীদের এমনভাবে অনুপ্রাণিত করা যেতাে যার ফলে মজুদ করা চাল খােলাবাজারে চলে আসে ও বাজার ব্যবস্থা স্থিতিশীল হয়। এর জন্য প্রয়ােজন ছিল সরকারের ওপর জনগণের প্রবল আস্থা। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও প্রয়ােজনবােধে দলের নেতাকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেও এ ব্যবস্থা কাজে লাগানাে যেতাে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন উত্তপ্ত এবং তখন সরকারের প্রতি জনগণের আর আস্থা নেই। সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা নিজেরাই তখন দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে সাধারণ মানুষদের ওপর থেকে বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন নীতি ও পরমত সহনশীলতার অভাব সমাজকে ততদিনে পুরােপুরিভাবে গ্রাস করে ফেলেছে। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অত্যন্ত উদ্বুদ্ধ ও সচেতন একটি রাজনৈতিক কর্মীবাহিনী গড়ে তােলার যে সম্ভাবনা ছিল ১৯৭৪ সালে এসে তা বিপরীতমুখী স্রোতধারা সৃষ্টি করে সরকারকে নিয়ে গেছে রক্ষণশীল ভূমিকায়।

তৃতীয় একটি উপায় ছিল সহসা সরকারের সমস্ত খাদ্যভাণ্ডার উজাড় করে ঢেলে দিয়ে শহরে রেশনিং ও গ্রামাঞ্চলে সরবরাহ নিশ্চিত করে সাময়িকভাবে হলেও বাজার ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করে তােলা ও খাদ্য সরবরাহের ব্যাপারে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। একবার বাজার ব্যবস্থা স্থিতিশীল হয়ে পড়লে মজুদদারদের পক্ষে আর অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদের মজুদ ধরে রাখা সম্ভব ছিল না। গুদামজাতকারী ও মজুদদাররা যদি সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতার নমুনা

পৃষ্ঠা: ২১৬

দেখতে পেতেন তা হলে বাজারে খাদ্যের সরবরাহ অবশ্যই সাবলীল পর্যায়ে নেমে আসতে পারতাে। এর জন্য প্রয়ােজন ছিল খাদ্য সংগ্রহের জন্য সবগুলাে উৎসকে সমানভাবে ব্যবহার করা এবং একই সঙ্গে দেশের বাইরে থেকে যে কোনাে উপায়ে খাদ্য সংগ্রহের জন্য সর্বতাে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।

খাদ্য সরবরাহে আমেরিকার ভিন্নমূর্তি

১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সরকার আমেরিকা সরকারের কাছে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের জন্য মঞ্জুরকৃত খাদ্য সাহায্য ছাড় করার একটি আবেদন জানায়। এক বছর আগে থেকেই এই আবেদন জানানাের অর্থ ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া, যাতে করে সরবরাহ প্রক্রিয়ায় কোনাে বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়।

সে বছর অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানাের জন্য ২২ লাখ টন খাদ্য আমদানির একটি লক্ষ্যমাত্রাও স্থির করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেক্রেটারি কিসিঞ্জারের কাছে প্রতিশ্রুত খাদ্য সরবরাহের আবেদন জানান। আমেরিকা থেকে খাদ্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ছিল ৩ লাখ টন এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তা নমনীয় করে তাৎক্ষণিকভাবে ২ লাখ ২০ হাজার টন খাদ্য সরবরাহের প্রস্তাব করা হয়। ঘটনাক্রমে সারা পৃথিবীতে তখন খাদ্য ঘাটতি এবং আন্তর্জাতিকভাবে চালের বাজারেও ঊর্ধ্বগতি। সেক্রেটারি অব স্টেট অনুদান হিসেবে খাদ্য না নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ক্রয়সূত্রে চাল সংগ্রহের পাল্টা প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশের ক্ষুধাপীড়িত মানুষের জন্য আশু প্রয়ােজনীয় এই সরবরাহ অনুদানভিত্তিতে ছাড় দিতে ওয়াশিংটনকে তখন রাজি করানাে সম্ভব হয়নি।

দুই দেশের সরকারের মধ্যে এ নিয়ে কয়েক দফা যােগাযােগের পর ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে এসে বাংলাদেশের ওয়াশিংটনস্থ রাষ্ট্রদূত বিষয়টি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেটের কাছে উত্থাপন করেন। তখন এ ব্যাপারে কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে সরবরাহের ব্যাপারে আশ্বস্তও করা হয়।

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মধ্যে বিষয়টি চূড়ান্ত করার ব্যাপারে ঘন ঘন যােগাযােগ চলাকালীন ১৯৭৪ সালের ২৭ মে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত জানান যে, মার্কিন সরকার জানতে পেরেছেন যে বাংলাদেশ সরকার কিউবার কাছে পাটের বস্তা বিক্রি করছে এবং পিএল-৪৮০’র একটি শর্ত অনুযায়ী কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করছে এমন কোনাে দেশকে খাদ্য সাহায্য করা যাবে না। বাংলাদেশ সরকার জবাব দেন যে, এককালীন চালান হিসেবে বাংলাদেশ জুট কর্পোরেশন ৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ৪ মিলিয়ন চটের বস্তা বিক্রি করেছে এবং কিউবার সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি ও দীর্ঘমেয়াদি কোনাে বাণিজ্যভিত্তি নেই। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ তখন বেপরােয়াভাবে বিদেশি মুদ্রার পেছনে ছুটোছুটি করছে এবং পাট তখন বিশ্ববাজারে

পৃষ্ঠা: ২১৭

প্রবল প্রতিযােগিতার সম্মুখীন। তৃতীয়ত, জুট কর্পোরেশন পিএল-৪৮০’র এমন কোনাে বিধান সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল না। চতুর্থত, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ আমেরিকার সঙ্গে পিএল-৪৮০ ভিত্তিক খাদ্য আমদানি নিয়ে বেশ কয়েকবার লেনদেন করেছে এবং প্রতিবারই আইনের প্রয়ােজনে বাংলাদেশকে শর্তের একটি বিরাট তালিকা পূর্ণ করতে হয়েছে, যাতে কখনােই পিএল-৪৮০’র এই শর্ত সম্পর্কে বাংলাদেশকে অবহিত করা হয়নি। পঞ্চমত, পিএল-৪৮০’র আওতায় এই খাদ্য সরবরাহের জন্য বিগত ৯ মাস থেকে কাগজপত্র চালাচালি ও দেনদরবার করা হচ্ছে। এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে উক্ত বিষয়টি কারাে কাছে উত্থাপন না করা ছিল রহস্যজনক। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে আগে অবহিত করা হলে বাংলাদেশ কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য স্থগিত রাখতে পারতাে।

আমেরিকার সরকার কী উদ্দেশ্যে হঠাৎ করে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাে সে বিষয়টি কারাে কাছে পরিষ্কার হলাে না। দুই দেশেরই জানা রয়েছে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে কিউবার রয়েছে গভীর বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক এবং কিউবা ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম কয়েকটি দেশের একটি। আর বিষয়টির অবতারণা ঘটে ঠিক সেই সময়ে যে সময় বাংলাদেশে চলছে প্রবল খাদ্যাভাব।

যাই হােক, ঢাকায় আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এবং ওয়াশিংটনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জানান যে, স্ট্র্যাটেজিক নয় এমন কোনাে পণ্য নিয়ে বাণিজ্য করলে হয়তাে বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে ছাড় দেয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাট সেই ক্যাটাগরিতে পড়ে না। অন্যথায় প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে খাদ্য সরবরাহের বিষয়টি মার্কিন স্বার্থের অনুকূলে এমন বিবেচনা করে তাতে ছাড়পত্র দেয়ার জন্য কংগ্রেসে পাঠালে এবং কংগ্রেস তাতে অনুমােদন দিলে বিষয়টি নমনীয় করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু ইউএস এইড থেকে একই সঙ্গে বলে দেয়া হয় যে, বাংলাদেশে চাল সরবরাহ করার জন্য আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের কাছে এমন কোনাে প্রস্তাব পাঠাবেন বলে আশা করা যায় না। তবে বাংলাদেশকে জানানাে হলাে যে কিউবার সঙ্গে এই মুহূর্তে ব্যবসা বন্ধ করলে বাংলাদেশের জন্য খাদ্য সাহায্য পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।

অত্যন্ত লজ্জিতভাবে বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি কিউবার কাছে উত্থাপন করে। কিউবা সরকার বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলাের সঙ্গে বড় শক্তিগুলাের স্বাভাবিক আচরণের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারকে বলে যে কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করা হবে এবং তাতে করে বাংলাদেশের সঙ্গে কিউবার সম্পর্ক নষ্ট হবে না।

বাংলাদেশ থেকে সেই মর্মে আমেরিকার কাছে অঙ্গীকারনামা দিয়ে অনতিবিলম্বে খাদ্য সরবরাহ শুরু করার আবেদন জানানাে হয়। তখন আমেরিকা থেকে জানানাে হয় যে, চটের বস্তার বর্তমান চালান সম্পূর্ণভাবে জাহাজজাত না হওয়া পর্যন্ত বােঝা যাবে যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কিউবার বাণিজ্যিক সম্পর্ক

পৃষ্ঠা: ২১৮

রয়েছে। কাজেই শেষ বস্তাটি পর্যন্ত জাহাজজাত না করা অবধি খাদ্য সাহায্যের ব্যাপারে কিছুই করা যাবে না।

সে সময় বাংলাদেশের নিজস্ব কোনাে শিপিং লাইন ছিল না এবং কনফারেন্স লাইনের কোনাে জাহাজ নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের বন্দর স্পর্শ করে যেতাে না। ফলে এই হাস্যকর শর্ত পূরণ করতে করতে বাংলাদেশের অক্টোবর মাস এসে পড়ে। ইতােমধ্যে দুর্ভিক্ষ তার করাল থাবা বিস্তার করে ফেলেছে বাংলাদেশের। গ্রামে-গঞ্জে এবং লাখ লাখ লােক দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে অনাহারে-অর্ধাহারে।

পৃষ্ঠা: ২১৯

তথ্য নির্দেশিকা

১. স্টেট ডিপার্টমেন্ট, দলিল নং ৮৬, নিক্সনের কাছে কিসিঞ্জারের মেমােরেন্ডাম, অক্টোবর ১৯৭০।

২. নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, বক্স-৩৩৪।

৩. মূলত পাকিস্তানের সঙ্গে এর ব্যবস্থা করা হলেও তা বাতিল করে পুনরায় বাংলাদেশের জন্য পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

৪. ডকুমেন্ট নং-৩৮৯। হেনরি কিসিঞ্জারের জন্য সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের মেমােরেন্ডাম।

৫. ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, বক্স-৫৯১। স্টেট ডিপার্টমেন্ট ডকুমেন্ট নং ৪০৯।

৬. প্রাগুক্ত।

৭. প্রাগুক্ত, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস।

৮. জেনারেল আলেক্সান্ডার হেগের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানাে মেমােরেন্ডাম, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ডকুমেন্ট নং ৪১০, তারিখবিহীন এই মেমােটি প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছানাে হয় ২০ মার্চ, ১৯৭২।

৯. ডকুমেন্ট নং-৪১২, প্রাগুক্ত।

১০. ইনফরমেশন মেমােরেণ্ডাম, ডকুমেন্ট নং ৪২৮, ন্যাশনাল আর্কাইভস, লট-৭৭ ডি-১৬, এ আইডি-১।

১১. বাংলাদেশ মার্কিন দূতাবাস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানাে টেলিগ্রাম, টেলিগ্রাম নং ৪৫৯১।

১২. ডকুমেন্ট নং ৪৩২, চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ড্যানিয়েল নিউবেরির পাঠানাে টেলিগ্রাম, টেলিগ্রাম নং ৫৪৫১।

১৩. দ্য হিন্দু, ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১।

১৪. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, দ্বিতীয় খণ্ড, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নয়াদিল্লি, ১৯৭১, পৃ. ৬৪৭।

১৫. ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, বােম্বে, ৬ জানুয়ারি, ১৯৭২।

১৬. বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, প্রাগুক্ত। মর্নিং নিউজ, ঢাকা, ১০ অক্টোবর, ১৯৭৩।

১৭. হােয়াট ইজ অ্যাবাউট দ্য ১৯৭৪ ফেমাইন? প্রফেসর নুরুল ইসলাম, স্কলার’স জার্নাল, আপডেটেড অক্টোবর ১৫, ২০০৫।

১৮. ফরেন রিলেশনস অব ইউনাইটেড স্টেট, ৮ খণ্ড, ডকুমেন্ট নং ৩২, এআইডি ফাইলস, ১৫-৮, বাংলাদেশ।

১৯. শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের কথােপকথন, অক্টোবর ১, ১৯৭৪। ফোর্ড লাইব্রেরি, এনএসসি ফাইলস, বক্স ৫৯১।

২০. নুরুল ইসলাম, প্রাগুক্ত।

২১. প্রাগুক্ত।

পৃষ্ঠা: ২২০

Ref: মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!