পাকিস্তান ও ভারত | বাংলাদেশের স্বাধীনতা | একাত্তরের সংকট | মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম
পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর গােটা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পেয়ে উভয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করে। দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ছিল জুলফিকার আলীর পাকিস্তান পিপলস পার্টি। তারা জাতীয় পরিষদে ৮৮টি এবং প্রাদেশিক পরিষদে ১৪টি আসনে জয়লাভ করে।
১৯৭০ সালের পাকিস্তানের আইন কাঠামাে আদেশের ওপর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ চূড়ান্ত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিভিত্তিক ৬ দফা কর্মসূচি পেশ করে। অন্যদিকে দেশের পশ্চিম অংশে জুলফিকার আলী ভুট্টো তার ভাত-কাপড়-বাসস্থানের১ দাবিতে নির্বাচনী প্রচার চালান। ২৪টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়। ডানপন্থী দলগুলাে ইসলামভিত্তিক এবং বামপন্থী দলগুলাে নিজ নিজ দলের আদর্শ অনুযায়ী আঞ্চলিক ও জাতীয় কমিউনিজমের শ্লোগান তােলে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পেছনে কাজ করছিল ৬ দফাভিত্তিক প্রবল গণজোয়ার। পাকিস্তানের পশ্চিম ও পূর্ব অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনের আগলমুক্ত হয়ে স্বয়ম্ভর অর্থনীতিসমৃদ্ধ একটি সােনার বাংলা গড়ে তােলার স্বপ্ন দেখছিল।২
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তখন অনুভব করতে পারছিলেন যে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গােলযােগ ও দেশের অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে তার পক্ষে আর দেশের শাসনভার চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সেজন্য যথাশীঘ্র দেশ শাসনের ভার রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দিয়ে মানে মানে সরে পড়াই ছিল তার
পৃষ্ঠা: ১২১
মুখ্য উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্যে ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসেই তিনি দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘােষণা করেছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূলে এক মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়ে লক্ষ লক্ষ লােক প্রাণ হারান। ফলে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি অবধি।
ইয়াহিয়া খানের নির্বাচন দেয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭০ সালের আইন। কাঠামাে আদেশের অধীনে একটি জাতীয় পরিষদ গঠন করা, যে জাতীয় পরিষদে দেশের রাজনীতিকগণ দেশের পরবর্তী ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। সেই জাতীয় পরিষদ দেশের দুই অংশের মানুষের আশাআকাক্ষার প্রতিফলক হিসেবে একটি সংবিধান প্রণয়ন করবে এবং এর পর থেকে সেই সংবিধানের অধীনে দেশ পরিচালিত হবে।
নির্বাচনী এজেন্ডায় আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির মধ্যে কোনাে মিল ছিল না। ডান ও বামপন্থীদের সমবায়ে গঠিত আওয়ামী লীগের ভাবধারা ছিল পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং স্বায়ত্তশাসনের আওতায় কেন্দ্রের কাছ থেকে যতখানি সম্ভব ক্ষমতা প্রদেশে স্থানান্তরিত করা। অন্যদিকে সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা সঞ্চিত রাখা এবং চরম ভারত বিরােধিতা। ফলে দেশের দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দুটির মধ্যে সমঝােতার কোনাে ক্ষেত্র। উন্মুক্ত ছিল না।
নির্বাচনে এ ধরনের ফলাফলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একেবারে ক্ষমতাশূন্য হয়ে পড়েন এবং তার পক্ষে আর সরকারসুলভ মধ্যস্থতা করার মতাে শক্তি ছিল না। অনন্যোপায় হয়ে তিনি মার্চের ৩ তারিখে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি ১ মার্চ জাতীয় পরিষদ স্থগিত রেখে দেনদরবারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলােকে আবারাে কিছুটা সময় ও সুযােগ সৃষ্টি করে দেন। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান দাবি করছিলেন যে, তিনি তার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে দলের ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করে সংবিধান প্রণয়ন করতে চান। অন্যদিকে ভুট্টো বলেন যে, শেখ মুজিব তার ৬ দফা ও প্রাদেশিক পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে সরে না এলে তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবেন না।৩ পশ্চিম পাকিস্তানের আরাে কয়েকটি ছােট ছােট রাজনৈতিক দল ভুট্টোর সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পােষণ করেন।
নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক পা সরে যাওয়ার ইচ্ছাও মুজিবের ছিল না। অথচ তিনি ও তার দলের লােকজন তখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসনসহ পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতরে একটি ফেডারেল সরকার গঠনেরই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং বিচ্ছিন্নতার কোনাে চিন্তা তার মাথায় ছিল না।৪
পৃষ্ঠা: ১২২
অন্যদিকে ভুট্টো ও সমর্থকরা হয়তাে মনে করছিলেন পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও অসুবিধা নেই, এবং তখন তারা পাকিস্তানের অবশিষ্ট অংশকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে শাসন করতে পারবেন। এটা তাদের মতে ছিল শেখ মুজিবের অধীনে একটি দুর্বল কেন্দ্রভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার চাইতে ভালাে।
এ সময় মার্কিন এক পর্যালােচনায় বলা হয় যে, ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদ স্থগিত করে দেয়ায় সংকট একটি জটিল স্তরে এসে উপনীত হয়েছে। অনতিবিলম্বে সমঝােতাভিত্তিক একটি সিদ্ধান্তে না আসতে পারলে বাঙালিদের বিচ্ছিন্নতা ও দু’পক্ষের সমঝােতায় পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
পাক-ভারত সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মপন্থা
পাকিস্তানে এই অনিবার্য ভাঙনের টানাপােড়েনের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল এই যে দুটি পৃথক স্বাধীন দেশের চাইতে একটি একক শক্তিশালী পাকিস্তানই ছিল আমেরিকার কাম্য।৫ ছয় কোটি লােক অধ্যুষিত পশ্চিম পাকিস্তান এবং সাড়ে সাত কোটি লােক অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তান ছিল আমেরিকার জন্য একটি বিশাল বাজার ও দক্ষিণ এশিয়া সামরিকভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় একটি ঘাটি। স্বাধীন একটি পূর্ব পাকিস্তান হবে সামরিক ও নিরাপত্তার দিক দিয়ে দুর্বল, অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত এবং বহিঃশত্রুর আগ্রাসন রক্ষায় অক্ষম। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত থাকলে ভারতের প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণ না দেখাবার ক্ষেত্রেও পশ্চিম পাকিস্তানকে খানিকটা প্রভাবিত করতে পারবে। সর্বশেষ, উপমহাদেশে শান্তি বজায় রাখতে গিয়ে ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন করা ছাড়া আমেরিকার গত্যন্তর ছিল না।
অবশ্য যে গতিতে পাকিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে গেছে, তাকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করার সাধ্য যুক্তরাষ্ট্রের ছিল না। ১৯৬০ সাল নাগাদ আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের যে ধরনের সম্পর্ক ছিল সে ধরনের সম্পর্ক আর না থাকাতে আমেরিকার পক্ষে বড় জোর পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর অভ্যন্তরীণভাবে কিছুটা প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা ছিল। নতুন পরিস্থিতিতে আমেরিকার জন্য বেশি প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়েছিল। মুজিব ও তার অনুসারীদের সঙ্গে যােগাযােগ করে ঘটনাপ্রবাহের ওপর কঠোর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা। পূর্ব পাকিস্তানিরা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্নতার পথে এগিয়ে গেলে তাতে বাধা দেয়ার ইচ্ছা আমেরিকার ছিল না।
আমেরিকা লক্ষ্য রাখছিল যে দেশের একীভূত অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য ইয়াহিয়া খান প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু তার এই প্রচেষ্টায় আমেরিকার কিছু করণীয় নেই। একমাত্র করণীয় ছিল ইয়াহিয়াকে উৎসাহ জুগিয়ে পাকিস্তানের প্রতি সহযােগিতা বজায় রাখা, যাতে করে ইয়াহিয়া সাফল্যের একটি পর্যায়ে উপনীত হতে পারেন।
পৃষ্ঠা: ১২৩
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর পাশাপাশি অবশ্য এ-ও বুঝতে পারছিল যে, একক পাকিস্তানের অস্তিত্বের ওপর মার্কিন স্বার্থ অধিকতর কার্যকরভাবে রক্ষা করা যাবে। একথা সত্য, তবে দুটি পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি হলেও আমেরিকা তার পররাষ্ট্র নীতিমালাকে দুই দেশের প্রেক্ষাপটে নতুন করে পুনর্বিন্যাস করে নিতে পারবে। আমেরিকা দেখছিল যে ভেঙে দু’টুকরা হয়ে গেলেও অদূরভবিষ্যতে কোনাে অংশ মারাত্মক রকমের বিপরীতধর্মী কোনাে পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করবে না। তাদের দু’অংশই আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইবে, একই সঙ্গে ভারত-সােভিয়েত রাশিয়া চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক কামনা করবে, উভয়েই আমেরিকার অর্থনৈতিক সহযােগিতার মুখাপেক্ষী হবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে আমেরিকার সমর্থন চাইবে। খুব সম্ভবত উভয় অংশই আমেরিকার কাছে সামরিক ও গণনিরাপত্তামূলক সাহায্য চাইবে, তাদের প্রয়ােজন হবে যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ। যাই হােক, সর্বোপরি দেশের উভয় অংশ এমন কোনাে আচরণ করবে না, যাতে করে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার স্বার্থ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।
আমেরিকার ধারণা ছিল, স্বাধীন একটি বাংলাদেশ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্যোগের সম্মুখীন হবে এবং কালক্রমে তা ছড়িয়ে পড়বে রাজনৈতিক পরিধিতেও। অবশ্য কোনাে কারণে পাকিস্তান যদি ভেঙে না যায় তা হলে অখণ্ড পাকিস্তানেও পূর্ব পাকিস্তান এ ধরনের দুর্যোগের হাত থেকে রেহাই পাবে না। রাজনৈতিকভাবে মুজিবুর রহমানের অধীনে আওয়ামী লীগ নয়া রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক একটি সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে এবং শুরু থেকে জনগণের কাছ থেকে বিপুল সহযােগিতা ও সমর্থন পাবেন, যা সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশটি তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য উভয় স্বার্থে পার্শ্ববর্তী ভারতের সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে এবং একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মিত্রতাবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একই সাহায্যদাতার ওপর নির্ভর না করে যত বেশি সম্ভব সাহায্যদাতার কাছ থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালাবে।
আওয়ামী লীগ যেভাবে ক্ষমতার শীর্ষ স্তরে উঠে এসেছে তা পর্যালােচনা করলে মনে হয় শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের চাইতে তার ক্ষমতার মূল উৎস ছিল আবেগতাড়িত জাতীয়তাবাদী জনগণ এবং সময় যতই পার হবে নিপীড়িত এই জনতার মুখে হাসি ফোটানাের কাজটি ততই কঠিন হয়ে উঠবে। এমনকি নিজ দলের অভ্যন্তর থেকেই দলটিতে বিরােধের সূত্রপাত ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে দলের বাইরে থেকে সংস্কারবাদী বামশক্তির বিরােধিতাও হবে প্রবল। দীর্ঘমেয়াদি বিচারে পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান সংস্কার প্রবণতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বহাল থাকলে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না।
পৃষ্ঠা: ১২৪
আমেরিকা মনে করছিল, অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান হয়তাে তার নিম্নস্তরের প্রবৃদ্ধি স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক বছর পরও ধরে রাখতে পারবে, কারণ সে সময়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশে পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বয়ম্ভর অর্থনীতির ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবে। একদিকে প্রধান অর্থকরী ফসল পাট পাকিস্তানের সঙ্গে আর ভাগাভাগি করতে হবে না এবং বর্তমান আন্তঃশাখার বহির্বাণিজ্য ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বারা পরিপূরক হবে। অবশ্য দীর্ঘমেয়াদিভাবে অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক সংকট বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হবে বামপ্রবণতাভিত্তিক ও সামরিক বিভাগ সমর্থিত ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন সরকার এবং রাজনৈতিক সমীকরণে সেখানে সামরিক বাহিনীর প্রচ্ছন্ন ভূমিকা থাকবে। সশস্ত্রবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট এ হবে একটি স্বৈরাচার ধরনের সরকার। তবে সামরিক সমর্থন এবং অধিকতর জোরালাে অর্থনৈতিক ভিত্তির কারণে সেখানে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পূর্বাংশের চাইতে বেশি হবে। প্রথমদিকে সামরিক বাহিনী পুরাে সমর্থন দিলেও সময়ান্তরে সেখানে রাজনৈতিক বিরােধিতা ও গণচ্যালেঞ্জের আশঙ্কা রয়েছে। বহিক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে বৈরীভাব বহাল রাখায় পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থের এক বিশাল অংশ ব্যয় করতে হবে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে, যার ফলে অর্থনৈতিক প্রগতি অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি হবে চীনের সঙ্গে মিত্রতা, আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকার প্রচেষ্টা, সােভিয়েতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিসাধন। এবং ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে সুসম্পর্ক বহাল রাখা।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের ভাঙন যদি অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং পূর্ব পাকিস্তানে নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয় তা হলে আমেরিকার করণীয় সম্পর্কে পর্যালােচনায় বিশেষভাবে আলােকপাত করা হয়। এতে সুস্পষ্টভাবে বিকল্প ব্যবস্থার বিধান থাকে :
১. আমেরিকার নীতি হবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার পক্ষে থাকা। তবে বিদ্যমান অস্থিতিশীলতা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং এ ব্যাপারে পাকিস্তানকেই নিজের করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
২. আমেরিকা পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর পরিপূর্ণ সমর্থন বজায় রাখলেও পূর্বাংশে উদীয়মান জাতীয়তাবাদী ধারণাকে একেবারে উপেক্ষা করতে পারে না। সরকার পরিচালনার ব্যাপারে পাকিস্তান যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবে সে সিদ্ধান্তের আলােকে প্রয়ােজনে আমেরিকান নীতিমালা পুনর্বিন্যস্ত করার সুযােগ রয়েছে।
৩. প্রকাশ্যে আমেরিকা নিজের নীতিমালা বজায় রাখলেও ব্যক্তিগতভাবে ইয়াহিয়াকে আহ্বান জানানাে যেতে পারে যাতে করে যে কোনাে মূল্যে
পৃষ্ঠা: ১২৫
পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখা যায়। এমনকি ভুট্টোর দল সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় সহযােগিতা দিতে অস্বীকার করলে এবং পাকিস্তানে দুর্বল কেন্দ্রভিত্তিক প্রশাসন চালু রাখতে হলেও ইয়াহিয়ার উচিত হবে মুজিবের সঙ্গে কোনাে না কোনাে ভাবে সমঝােতায় আসা।
প্রস্তাবিত মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি
ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের পর্যালােচনায় বলা হয়,
বিচ্ছিন্নতা একেবারে অপরিহার্য হয়ে না উঠলেও আমেরিকার উচিত হবে পাকিস্তানের অখণ্ডতার ওপর পরিপূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রাখা। এর মধ্যে যে কোনাে ধরনের নমনীয়তা দেখালে তাতে পূর্বোল্লিখিত দ্বিতীয় স্তরের মনােভাব প্রকাশ পাবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ধারণা হবে যে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে ফেলার জন্য কাজ করছে। এতে করে পাকিস্তানের সঙ্গে এবং ভবিষ্যতে একক পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের অবনতি ঘটবে।
কাজেই এ মুহূর্তে করণীয় হবে ১নং থিওরির আলােকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর একটি ভারসাম্যমূলক মনােভাব বজায় রাখা। এতে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন অব্যাহত থাকবে এবং পূর্ব পাকিস্তানকেও বােঝানাে সম্ভব হবে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নীতিতে অনমনীয় নয় যদিও আমেরিকা এখনাে মুজিবের কাছ থেকে পরস্পরসম্মত সাংবিধানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি অখণ্ড পাকিস্তানের প্রত্যাশী।
যদি দেখা যায় যে দু’অংশের মধ্যে ভাঙন অনিবার্য হয়ে উঠেছে অথচ পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘােষণা করেনি, তা হলে (১) উপরে বর্ণিত ১নং দৃষ্টিভঙ্গি বহাল রাখতে হবে, অথবা (২) পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের জানিয়ে দিতে বাধ্য হবে যে আমেরিকা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানকে সমর্থন করতে প্রস্তুত এবং একই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানকে জানিয়ে দিতে হবে যে আমেরিকা সার্বিক পরিস্থিতির ওপর সার্বিকভাবে নজর রাখছে, অথবা (৩) পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে আমেরিকা পূর্ব পাকিস্তানের নয়া সরকারকে সমর্থন দিয়ে
সেখানে অর্থনৈতিক সহযােগিতার প্রতিশ্রুতি দেবে। পর্যালােচনায় বলা হয়,
যদি ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে কিন্তু তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষণা করা না হয়। তা হলে উপরােক্ত ২নং দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের জানিয়ে দেয়া হবে যে আমেরিকা নয়া রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে এবং সরকারের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে। এতে করে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানিদের কাছাকাছি থাকা যাবে আবার দুই পাকিস্তানের ভাঙন অনিবার্য হলে পশ্চিম পাকিস্তানও তাতে অরাজি হবে না।
পৃষ্ঠা: ১২৬
এতে বলা হয়,
পূর্ব পাকিস্তানি নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘােষণার আগে সম্ভাব্য পাকিস্তানি হামলা প্রতিরােধের জন্য আমেরিকার হস্তক্ষেপ চাইলে আমেরিকা তা এই যুক্তিতে প্রত্যাখ্যান করবে যে, আমেরিকা পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক হামলার কোনাে সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে না এবং আমেরিকা সেখানে কোনাে সশস্ত্র বিরােধে জড়াতে চায় না। অবশ্য এর পরেও আমেরিকা পাকিস্তানের তরফ থেকে সামরিকভাবে ব্যবস্থা নেয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়নি। বাইরে বাইরে নিরপেক্ষতার আবরণে নিজেদের ঢেকে রেখে সামরিক হামলার ব্যাপারে অজ্ঞতা প্রকাশ করলেও মার্কিন প্রশাসনের একটি অংশ পাকিস্তান পরিস্থিতিতে সামরিক সংঘর্ষের আশঙ্কাও অনুমান করছিলেন। সে কারণেই মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের পর্যালােচনায় পাকিস্তান সামরিক ব্যবস্থা নিলে মার্কিন করণীয় সম্পর্কেও আগাম দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে রাখা হয় :
১. আমেরিকান নাগরিক ও সম্পত্তির রক্ষাব্যবস্থা ছাড়া আমেরিকা এই যুক্তিতে কোনাে সরাসরি পদক্ষেপ নেবে না যে আমেরিকার কোনাে স্বার্থ নেই। আমেরিকা পরিস্থিতির উন্নতিতে কোনাে অবদান রাখতে পারবে না এবং যে কোনাে মার্কিন হস্তক্ষেপ পশ্চিম পাকিস্তানকে বরং বিক্ষুব্ধই করবে।
২. পশ্চিম পাকিস্তানে নেতাদের মিলিটারি অ্যাকশন প্রত্যাহারের অনুরােধ জানিয়ে বলা হবে যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অনমনীয়তার মুখে যে কোনাে সামরিক পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে, বরং পাকিস্তানের মিলিটারি হস্তক্ষেপে ভারতকে সামরিক হস্তক্ষেপে জড়িয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে যাতে করে অযথা পাক-ভারত বিবাদ এবং রক্তক্ষয়ের সূত্রপাত ঘটবে।
৩. পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ নিয়ে আলােচনা করা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হবে যে, আমেরিকা যে কোনাে রাজনৈতিক সমস্যায় অস্ত্রধারণের বিরােধী। এর পরেও যদি ভারত পূর্ব পাকিস্তানিদের সাহায্যে সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয় তা হলে ভারত সরকারকে এ ধরনের ঘটনায় জড়িয়ে না পড়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হবে যে, এতে করে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটবে এবং চীন এই দ্বন্দ্বের সুযােগ নিতে পারে।
৪. পশ্চিম পাকিস্তানি ও সম্ভাব্যভাবে ভারতের সামরিক বিরােধ অনিবার্য হয়ে উঠলে আমেরিকা সেখানে সামরিকভাবে জড়িত হবে না। তবে ব্রিটিশ এবং অন্যান্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিদেশি শক্তির সঙ্গে যােগাযােগ করে সহযােগিতা নিষিদ্ধকরণ, অর্থনৈতিক ও সামরিক সরবরাহ বন্ধ ইত্যাদির ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
পৃষ্ঠা: ১২৭
৫. আমেরিকা মনে করে যে, পাকিস্তান সাহায্য কামনা করলেও পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতিতে চীনের জড়িত হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই। চীন জানে যে এ ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে চাইলে তাকে বিরাট ভারতীয় এলাকা অতিক্রম করতে হবে যার ফলে বিরাটাকায় চীন-ভারত সংঘর্ষের সূত্রপাত হবে। বার্মার ৪০০ মাইলব্যাপী সমুদ্রসীমার ভেতর দিয়ে এসে ভারতীয় এলাকায় অনুপ্রবেশ হয়তাে এড়ানাে যায় তবে এত বিরাট দক্ষতা এ মুহূর্তে চীনের আছে বলে মনে হয় না। যাই হােক, আমেরিকা এই যুক্তিতে সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে দূরে থাকবে যে এলাকাটি মারাত্মকভাবে মার্কিন স্বার্থের পরিপূরক নয়।
৬. বহির্দেশীয় যে কোনাে সামরিক সংঘর্ষের সূচনা ঘটলে আমেরিকা সব ধরনের আন্তর্জাতিক পদক্ষেপকে সমর্থন করবে। যেমন সম্মিলিত জাতিসংঘ এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি।
প্রস্তাবে বলা হয় যে,
পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক হস্তক্ষেপ অত্যাসন্ন হয়ে উঠলে হবে অযথা রক্তপাত বন্ধের জন্য সবরকম পদক্ষেপ গ্রহণ, শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকলে তা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সীমিত রাখার পদক্ষেপ নেয়া। এজন্য প্রয়ােজনবােধে আমেরিকাকে পশ্চিম পাকিস্তানের অসন্তুষ্টি ঘাড়ে নিয়ে সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিতে হবে।৬ ৬ মার্চ ১৯৭১ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিলে। দেশব্যাপী বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সারাদেশ প্রতিবাদ, মিছিল, মিটিং আর বিক্ষোভে সরগরম হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্য হরতাল আহ্বান করা হয়। ৩ মার্চ ঢাকায় এক বিশাল জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ হিসেবে ঘােষণা করা হয় এবং ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের তৎকালীন বিশালতম জনসভা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অসহযােগ আন্দোলনের ঘােষণা দেন।
এ সময় ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো একত্রিত হয়ে বাঙালিদের সঙ্গে আপােষরফা ও আলােচনার নামে পূর্ব পাকিস্তানে অবাঙালি পাকিস্তানি সৈন্য ও রসদের সমাবেশ ঘটাতে থাকেন। এর আগেই ইয়াহিয়া খান ঘােষণা দিয়েছিলেন যে ২৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে।
এ পর্যায়ে বাঙালিদের কয়েকজন প্রতিনিধি ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন এবং পাকিস্তানের অভিপ্রায়ের প্রতি ইঙ্গিত করে আমেরিকার হস্তক্ষেপ ও সহযােগিতা কামনা করেন। ১ মার্চ আওয়ামী লীগ
পৃষ্ঠা: ১২৮
নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে একটি চিঠি পাঠান।৭ মুজিব চিঠিতে ইয়াহিয়া খানকে ঢাকায় আনার জন্য মার্কিন প্রতিনিধিকে অনুরােধ জানিয়ে। বলেন যে, তিনি রক্তপাত থামানাের লক্ষ্যে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলােচনা করতে চান। তিনি বলেন যে, ছয় দফা নিয়ে আলােচনায় এমনিতেই যথেষ্ট বিলম্ব হয়ে গেছে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে একটি কনফেডারেশনের ভিত্তিতে, দু’অংশের জন্য পৃথক সংবিধান, একই সেনাবাহিনী এবং একই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বহাল রাখার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলােচনা করা যেতে পারে।
চিঠিতে মুজিবের প্রশ্ন ছিল আমেরিকা কি বাংলাদেশে ভবিষ্যতে চীনা কমিউনিজমের প্রভাবসহ পাকিস্তানিদের সঙ্গে সশস্ত্র সামরিক সংঘর্ষ দেখতে চায়, নাকি ঘটনার কোনাে রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাশা করে? মুজিবকে জানানাে হয় যে, আমেরিকা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় এবং ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসতে সম্মত হওয়ায় শান্তিপূর্ণ সমাধানের সুযােগও রয়েছে। আমেরিকা প্রত্যাশা করে যে, আলােচনার সময় উভয়পক্ষ পারস্পরিক সমঝােতার মনােভাব প্রকাশ করবেন।
এর আগে ৭ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মসূচি ঘােষণা করা হলেও একই জনসভা থেকে শেখ মুজিব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেয়ার জন্য ৪টি শর্ত দিয়েছিলেন। সেগুলাে ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং বাংলাদেশে বেসামরিক জনগণের ওপর হত্যা-নির্যাতনের বিচার বিভাগীয় তদন্ত।
১৫ মার্চ একই দিনে মুজিবের পক্ষ থেকে সম্মিলিত জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে একটি টেলিগ্রাম পাঠানাে হয়। টেলিগ্রামে বলা হয় যে, বাংলাদেশে পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে এবং বেসামরিক বাঙালিদের হত্যা করার জন্য পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও গােলাবারুদ নিয়ে আসা হচ্ছে। অবিলম্বে পাকিস্তানের এই তৎপরতা থামানাের জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানানাে হয়।৮
১২ মার্চ ইসলামাবাদ থেকে ব্যাংককে অবস্থানরত পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের কাছে জরুরি একটি টেলিগ্রাম পাঠানাে হয়। এতে বলা হয় যে,
পাকিস্তান সরকার মুজিবের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে এখন পর্যন্ত সামরিক আইন প্রত্যাহার বা ক্ষমতা হস্তান্তরের পদক্ষেপ না নেয়ায় মুজিবের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তবে এখনাে আলােচনার মাধ্যমে সমাধান বেয়নেটের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চাইতে কার্যকর হবে বলে মনে করা হচ্ছে।৯
পৃষ্ঠা: ১২৯
এতে বলা হয়,
ভুট্টো হয়তাে শেষ পর্যন্ত কনফেডারেশনের প্রস্তাবে নমনীয় হতে পারেন কিন্তু কেন্দ্রে কোনাে শক্তি না থাকায় সেনাবাহিনী তা মেনে না নেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। টেলিগ্রামে বলা হয়,
কেন্দ্র অথবা প্রদেশে বা উভয়স্থলে অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি প্রস্তাব মুজিবের কাছে বেশি গ্রহণযােগ্য হতে পারে। এতে অন্তত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। পরবর্তী সংবিধান প্রণয়ন না হওয়া অবধি ইয়াহিয়াকে স্বস্থানে বহাল রাখলে সেনাবাহিনীর কাছেও তা গ্রহণযােগ্য হতে পারে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা দিলে ভুট্টোরও তা গ্রহণ না করার কোনাে কারণ নেই। এর ফলে বর্তমান দুর্যোগজনক পরিস্থিতির চাইতে অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উভয় অংশে পরিস্থিতি শান্ত করা সম্ভব।
১৩ মার্চ ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের সচিব ও প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারি হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে একটি মেমােরেন্ডাম পাঠান।১০ এতে বলা হয়,
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায়। বদ্ধপরিকর। প্রয়ােজনে তারা শক্তি প্রয়ােগ করবে। পূর্ব পাকিস্তানে নয়া গভর্নর নিয়ােগ এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাম্প্রতিক সতর্কবাণী থেকে এ আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। আরাে দেখা যাচ্ছে যে পাকিস্তান সিংহলের মাধ্যমে বিমানে করে পাকিস্তান থেকে প্রচুর সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় ইয়াহিয়া ব্যক্তিগতভাবে সমঝােতা চাইলেও সেনাবাহিনীর কাছে জবাবদিহিতার ভয়ে। তিনি সে পথ থেকে বিরত থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
শেখ মুজিব এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা না করলেও মনে হচ্ছে কৌশলগত কারণেই তিনি তা করেননি। তিনি যা ঘােষণা দিয়েছেন তা স্বাধীনতা ঘােষণার খুবই কাছাকাছি এবং বলেছেন তা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থামবে না। হয়তাে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে যেতে হতে পারে ভেবেই তিনি এককভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা এখন পর্যন্ত দেননি।
১৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে অসহযােগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘােষণা দেন এবং বলেন যে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে তিনি নিজেই একটি সমান্তরাল সরকার হিসেবে ৩৪টি নির্দেশনা জারি করেন। এতে
পৃষ্ঠা: ১৩০
সরকারি ও আধাসরকারি সব অফিস-আদালত অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সামরিক আইনের সামনে আর মাথা নত না করার জন্য বাঙালিদের আহ্বান জানানাে হয়।১১
অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টির নেতা ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৬ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থকে উপেক্ষা করে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা যাবে না। তিনি সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে বলেন, এখনাে সময় আছে যাতে করে এই চলমান সমস্যার সমাধান হতে পারে। তবে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ না করে কেন্দ্রীয়ভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান।
১৭ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান অন্যান্য দলের নেতাদের নিয়ে আলােচনার জন্য ঢাকা আসেন। ইতােমধ্যে সামরিক বাহিনী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে নিরীহ জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। সামরিক সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এসব অভিযােগের তদন্তে সম্মত হলে মুজিব সামরিক সরকারের অধীনে তদন্তের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নেতা হিসেবে মনােনয়ন দিয়ে তিনি ৪ সদস্যবিশিষ্ট নিজস্ব তদন্ত টিম গঠন করেন। ইয়াহিয়ার সঙ্গে সংলাপ চলাকালেই সামরিক বাহিনী আবার ঢাকার পার্শ্ববর্তী কয়েকটি এলাকায় গুলি চালালে মুজিব সংলাপ বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।১২
২০ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া এবং ২১ মার্চ মুজিব-ভুট্টোর মধ্যে সংকট নিরসনের সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে আলােচনা চলে। ২৪ মার্চ মুজিব ও ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারা একত্রে বসে সমস্যা সমাধানের উপায় উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চালান। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো তাদের অসফল প্রচেষ্টা শেষে পশ্চিম পাকিস্তান ফিরে যান এবং সেদিন রাতে পাকিস্তানিদের হাতে বাংলাদেশে শতাব্দীর ঘৃণ্যতম নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। অপারেশন সার্চলাইট নামে খ্যাত সেই হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজধানী ঢাকা শহরে প্রায় ৭ হাজার লােককে হত্যা করে। পরবর্তী এক সপ্তাহে কেবলমাত্র রাজধানীতে প্রায় ৩০ হাজার লােককে হত্যা করা হয়।১৩
সিআইএ’র পর্যালােচনা ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করলে বাংলাদেশের জন্য আর সরাসরি অস্ত্রধারণ ছাড়া কোনাে উপায় ছিল না। ২৫ মার্চের দু’দিনের মাথায় শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। আওয়ামী লীগের উপর ও মাঝারি সারির নেতারা আত্মগােপনে যান এবং তাদের
পৃষ্ঠা: ১৩১
মধ্যে অনেকে সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। পাকিস্তানিদের হামলা রাজধানী ছাড়িয়ে জেলা শহরগুলােতে বিস্তৃত হলে হাজার হাজার বাংলাদেশি প্রতিদিন সীমান্ত পার হয়ে ভারতে ঢুকতে থাকেন। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ইপিআর ও বাংলাদেশ পুলিশের বাংলাদেশি সদস্যরা নানা স্থানে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের সঙ্গে মিলে দেশব্যাপী পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করতে থাকেন।
এমতাবস্থায় ১২ এপ্রিল আমেরিকার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ থেকে পাকিস্তান-বাংলাদেশ-ভারতের সমকালীন পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে একটি সমীক্ষা বের করা হয়। সমীক্ষায় বিশেষ করে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ, ভারতের ভূমিকা এবং পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিস্তৃত আলােচনা করা হয়।১৪ সমীক্ষায় বলা হয়,
২৫ মার্চ রাতে আকস্মিক হামলা চালানাের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বােধ হয় মনে করেছিল যে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে নিয়ে আসা যাবে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রতিপন্ন হয়েছে। ১৩ হাজার ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা নামেমাত্র রসদ হাতে নিয়েই সারাদেশে প্রতিরােধ গড়ে তুলেছেন। জনগণ তাদের সর্বাত্মক সহযােগিতা দিচ্ছে।
ইসলামাবাদের বাহিনী কেবল দুটি শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখেছে। সেখানেও ঘন ঘন কারফিউ দিয়ে সীমিত জায়গায় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় অচল। বন্দরগুলাে বন্ধ, রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন, সেতু ও ফেরিঘাটগুলাে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। ত্রিশ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য সাড়ে সাত কোটি বিদ্রোহী লােককে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশের জনগণের এখন আর পাকিস্তানের প্রতি কোনাে আগ্রহ নেই। তারা স্বাধীন আবাসভূমিতে দিন কাটানাের স্বপ্ন দেখছেন।
ভারত বাংলাদেশিদের কতটুকু সাহায্য করবে তার ওপর পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণ কতদিন বহাল থাকবে ও জনগণ কতদিন তাদের বিরুদ্ধে থাকবেন তা নির্ভর করছে। দেশের তিনদিকে ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত থাকায় অস্ত্র ও গেরিলা ভারত থেকে পাঠাতে কোনাে অসুবিধা নেই। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশিদের ওপর সমর্থন প্রবল এবং সরকারের ওপরও এ নিয়ে প্রচণ্ড চাপ দেয়া হচ্ছে। তারা মনে করছেন বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জিত হলে পাকিস্তানিদের সামরিক ক্ষমতা কমে যাবে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাশ্মীর বা এ ধরনের অন্য সমস্যাগুলাে নিয়ে তেমন মাথাব্যাথা নেই এবং তারা মনে করেন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে দিল্লির কোনাে ক্ষতিই হবে না। শেখ মুজিবুর
পৃষ্ঠা: ১৩২
রহমান আগেই ভারতের সঙ্গে সদ্ভাবের কথা বলে গেছেন। এমতাবস্থায় মনে করা হচ্ছে যে বাঙালিদের প্রতি ভারতের অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্যের পরিমাণ দিন দিন বাড়বে। এর মাধ্যমে অবশ্য ভারত তার কিছু অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানিদের হাতে গিয়ে পড়তে পারে এমন ঝুঁকিও নিচ্ছে।
বাঙালিদের সাহায্য করার পেছনে ভারতের অবশ্য আরাে একটি কারণ রয়েছে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে লড়াই দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে বিপ্লবের নেতৃত্ব বামপন্থীদের হাতে চলে যেতে পারে। এ ধরনের ঘটনায় ভারত বিশেষ করে পশ্চিম বাংলা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় পশ্চিমবঙ্গে অনুরূপ বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রেরণা দিলে চরম বামপন্থীদের মধ্যে থেকেই তা আসার আশঙ্কা রয়েছে।
ভারত অবশ্য বাংলাদেশে অপ্রকাশ্যে বেশি সাহায্য দিতে চাইবে। নন। অফিসিয়াল এডভাইজার, লুকানাে অস্ত্র সরবরাহ, গােপন আশ্রয় ইত্যাদি হবে সাহায্যের মাধ্যম। তবে ভারত যদি দেখতে পায় যে, বামপন্থীদের হাতে নেতৃত্ব চলে যাচ্ছে তা হলে সাহায্য প্রকাশ্যে চলে আসবে। ফলে পাকিস্তানের সৈন্যদের সঙ্গে ভারতীয়দের খণ্ডযুদ্ধের সংখ্যাও বাড়বে। এতে সরাসরি পাক-ভারত যুদ্ধের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। ভারত অবশ্য অন্য ফ্রন্টিয়ার থেকে সৈন্য না এনেই পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের পরাভূত করতে সক্ষম। এতে অবশ্য খানিকটা ঝুঁকিও রয়েছে। কারণ পাকিস্তান একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম ফ্রন্টে হামলা চালাতে পারে।
গােপন সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি ভারত একই সঙ্গে কূটনৈতিক চাপ প্রয়ােগ করছে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশে তারা মানবিক উদ্বেগ প্রকাশের জন্য চাপ দিচ্ছে ও সিংহলের ওপর চাপ দিচ্ছে যাতে করে পাকিস্তানকে বিমান অবতরণের সুযােগ না দেয়া হয়। খুব সম্ভবত ভারত অচিরেই বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে দেবে।
ভারত বাংলাদেশে যে পরিমাণেই সমর্থন দিক না কেন, পাকিস্তানকে চরম কঠিন অবস্থার মুখােমুখি হতে হবে। বর্ষা আসার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানিদের নিজেদের মধ্যকার যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সিংহল বিমানের অবতরণ প্রত্যাখ্যান করলে তাদের অবস্থা আরাে সঙ্গিন হয়ে পড়বে। তখন বাধ্য হয়ে তারা সমুদ্রপথে অস্ত্র ও লােকবল নিয়ে আসতে বাধ্য হবে যাতে করে তাদের। আক্রমণ ক্ষমতা আরাে হ্রাস পাবে। কিন্তু বাঙালিরা যদি নয়া জাতীয় নেতৃত্ব নিয়ে আরাে শক্তি সঞ্চয় করতে পারে তবে গুটিকয়েক অবস্থানও ধরে রাখা পাক বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হবে না।
পাকিস্তানে প্রথমদিকে সেনা হামলার প্রতি সমর্থন থাকলেও অবস্থার প্রেক্ষাপটে এবং পরাজয় অবধারিত হয়ে পড়লে তা আর থাকবে না।
পৃষ্ঠা: ১৩৩
এখন পর্যন্ত চীন ছাড়া কোনাে দেশ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে বাংলাদেশ বিষয়ে সমর্থন দেয়নি। ভারতের চাপে সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের বর্বরতার নিন্দা জানাচ্ছে। তারা ইতােমধ্যেই রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে কমিউনিস্ট চীন সম্প্রতি ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে এই অভিযােগ তুলে ভারত সরকারের কাছে একটি নােট দিয়েছে। চীন এখন পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে পারে, এমনকি ভারতের সীমান্তে চীনা সৈন্যের সমাবেশও ঘটাতে পারে। অবশ্য ভারত জানে যে চীন কোনাে পদক্ষেপ নিলে তারা সােভিয়েতের সমর্থন পাবে। চীনও মনে হয় শেষ পর্যন্ত আর এতদূর অগ্রসর হবে না। বরং কোনাে চরম বামপন্থী বাংলাদেশি নেতৃত্বের পুরােভাগ চলে এসে চীনের সাহায্য কামনা করলে তারা বিব্রতই হবে।
পাকিস্তানিরা শেষ পর্যন্ত তাদের প্রচেষ্টায় সফল হবে এমন আশা করা কঠিন। সফল হলেও তাদের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না, কারণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দাবি পেশ করেছে। বাঙালিরা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চায় এবং এ দাবি এখন আরাে জোরদার হয়েছে। পাকিস্তানিরা পরিস্থিতি কোনাে রকমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বড় জোর তারা আইউবের অনুকরণে একটি কেন্দ্রশাসিত ব্যবস্থা রাখতে পারে, যেখানে বাঙালিদের আগের চাইতে অনেক বেশি সুযােগ-সুবিধা দিতে হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তার রাজনৈতিক অবয়ব ও দৃষ্টিভঙ্গি কী রকম হবে তা এ মুহূর্তে নিরূপণ করা কঠিন। মুজিব ও তার সহকর্মীরা বেঁচে থাকলে এবং তাদের ফিরে আসতে দিলে তারাই এসে সরকার গঠন করবেন। মুজিবের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি মডারেট। তিনি ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক, ভারসাম্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি, নমনীয় ধরনের সােশ্যালিজম ও জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন চান। তবে সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে রেডিক্যাল বামপন্থীদের হাতে নেতৃত্ব স্থানান্তরিত হয়ে যেতে পারে।
পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পাকিস্তানিদের জন্য তা হবে মারাত্মক এক মনস্তাত্ত্বিক আঘাত। ইয়াহিয়া হয় পদত্যাগ করবেন না হয় তাকে বের করে দেয়া হবে। বিচ্ছিন্নতার ফলে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্যোগ বাড়বে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার অভাব, শিল্পের জন্য সংরক্ষিত একটি বাজার হারানাে, সশস্ত্র বাহিনীর জন্য উচ্চতর মাথাপিছু ব্যয় ইত্যাদি সমস্যায় দেশটি জর্জরিত হবে। পশ্চিম পাকিস্তান চারটি পৃথক জাতিতে বিভক্তও হয়ে যেতে পারে। তবে দেশটির বিশাল সামরিক বাহিনী খুব সম্ভবত পশ্চিমাংশের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে পারবে। পূর্ব পাকিস্তানের চাইতে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর—তারা খাদ্য রপ্তানিকারী,
পৃষ্ঠা: ১৩৪
শিল্পভিত্তিসম্পন্ন একটি দেশ এবং দেশটিতে ভূমির ওপর জনসংখ্যার চাপ তেমন প্রবল নয়।
সেনাবাহিনী সব সময়ই পাকিস্তানে ক্ষমতার একটি প্রধান উৎস হয়ে থাকবে। ক্রমান্বয়ে সেনাবাহিনী বেসামরিক রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও সরকার হিসেবে তারা এমন দলকে বেছে নেবে যার সঙ্গে তাদের মানসিক সখ্য রয়েছে। তবে ক্ষমতায় যেই আসুক না কেন, প্রথম দিকে তাকে এ গ্লানির বােঝা অবশ্যই বহন করতে হবে যে, ১৩ কোটি জনসংখ্যার একটি জাতির বদলে তারা এখন সাড়ে ৫ কোটি লােকের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে ক্রমান্বয়ে এই প্রবণতা ফিকে হয়ে আসবে। পূর্ব পাকিস্তানকে হারানাের ফলে প্রথমদিকে তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সংকটে পড়লেও দীর্ঘমেয়াদিভাবে তা তাদের কাছে আশীর্বাদ বলেই মনে হতে পারে।
ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের মূল্যায়ন ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের বিদ্রোহী নেতারা কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে বাংলাদেশ অধিকৃত এক মুক্তাঞ্চলের আম্রকাননে মিলিত হন ও প্রবাসী একটি সরকার গঠন করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেই প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন। আহমদ প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পাকিস্তানে কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুপস্থিত দেখিয়ে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি নিয়ােগ করা হয়।
মে মাস নাগাদ পাকিস্তানি বাহিনী গােটা পূর্বাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে এবং দেশের অধিকাংশ জেলা শহর ও থানা দখল করে নেয়। অন্যদিকে বাঙালি সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ও ভারতের সহযােগিতায় অসংখ্য যুবক ছাত্র কৃষক জনতা আধা সামরিক মুক্তিবাহিনী গঠন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর ওপর চোরাগােপ্তা হামলা শুরু করে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের প্রয়ােজনীয় ট্রেনিং ও রসদ সরবরাহ করে।
পাকিস্তান বাহিনী দ্রুত পরিস্থিতির আপাতত নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হলেও দীর্ঘমেয়াদিভাবে তাদের সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনাে সম্ভাবনা দেখা যায়নি। অন্যদিকে ভারতীয়দের সহায়তায় মুক্তিবাহিনী দিনে দিনে শক্তি সঞ্চয় করায় পাকিস্তানিদের অবস্থান ক্রমশ আরাে অনিশ্চিত হয়ে ওঠে।
২৫মে মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের নির্বাহী সেক্রেটারি থিওডাের এল এলিয়ট জুনিয়র প্রেসিডেন্টের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে তদানীন্তন পাক-ভারত সম্পর্কের মূল্যায়ন তৈরি করে পাঠান।১৫ এতে বলা হয়,
পাকবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে প্রভাব বিস্তার করলেও রাজনৈতিক ও সামরিক স্থিতিশীলতা এখনাে বিপন্ন এবং পরিস্থিতি ক্রমেই আন্তর্জাতিক একটি সংঘর্ষের
পৃষ্ঠা: ১৩৫
দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার দ্বিতীয় স্তরের স্বার্থ থাকলেও এখন দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতিমালার ওপর সরাসরি আঘাত আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এতে বলা হয়,
বিগত ১০ দিনে বেশ কয়েকটি গােপন রিপাের্টে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আনাগােনার খবর পাওয়া গেছে এবং ভারতের সর্বাত্মক হামলার পরিকল্পনার নমুনা দেখা যাচ্ছে। সীমান্তে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) শক্তি বাড়াতে এবং সৈন্যবাহিনীকে সীমান্তের তিন মাইলের মধ্যে মােতায়েন করে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন প্রায় এক লক্ষ হিন্দু শরণার্থী ভারতে ঢুকছে এবং এই শরণার্থীর উদ্বেগই রণসজ্জার কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এ যাবৎ প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। বাঙালিদের সাহায্য এবং শরণার্থীদের আগমন বন্ধ করার জন্য ভারত সরকারের ওপর অনবরত পার্লামেন্টারি ও জনগণের চাপ আসছে। ভারত সরকার আশঙ্কা করছেন যে শরণার্থী আসা ঠেকানাে না গেলে অচিরেই তাদের সংখ্যা ৮০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। ফলে এলাকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামাের ওপর অপরিমেয় চাপ আসবে।
শরণার্থীদের সাহায্য করার পাশাপাশি ভারত সরকার বাঙালি মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করছে। বিএসএফ-এর সদস্যরা প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযােদ্ধাকে ট্রেনিং দিচ্ছেন এবং অনেক এলাকায় বিএসএফ সদস্যরা বাংলাদেশ এলাকায় ঢুকেও মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং রসদ সরবরাহ করছেন। এর মধ্যে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী অন্তত একবার ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
ভারত এখনাে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনাে যুদ্ধে যেতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে না, তবে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তারা আগে থাকতে আঘাত হানতেও পারে। পাকিস্তানিরা অবশ্য ধরে নিয়েছে যে ভারত বাঙালিদের শুধু সামরিক ও রাজনৈতিক সহযােগিতাই করে যাবে। সেজন্যই মাঝে মধ্যে তারা ভারতের অভ্যন্তরে ট্রেনিং ক্যাম্পগুলােতে হামলার চেষ্টা করছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তাে তারা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বড় ধরনের হামলাও চালাতে পারে এবং পূর্বাংশের লােকদের ধারণা দিতে পারে যে ভারতের হস্তক্ষেপের কারণে দেশের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বেশ কতকগুলাে কারণে দুদেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হতে পারে। সেগুলাে হলাে :
(১) পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনগােষ্ঠীর ওপর পাকিস্তানিরা নরহত্যা চালাচ্ছে এবং অসংখ্য হিন্দু শরণার্থী ভারতে আসা অব্যাহত রেখেছে। এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ
পৃষ্ঠা: ১৩৬
করার লক্ষ্যে ঢাকা একটি মডারেট আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত করতে পারে।
(২) পাকিস্তানিরা ভারতে অবস্থিত বাঙালিদের গেরিলা ক্যাম্পগুলাে ধ্বংস করার জন্য ভারতীয় এলাকায় নির্বিচারে বােমাবর্ষণ করতে পারে।
(৩) অন্যান্য ধরনের সীমান্তজনিত ঘটনা যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন বিমান বাহিনী ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করলে বিমান ভূপাতিত করে দিতে পারে।
(৪) ভারতীয়দের বিভ্রান্ত করার জন্য পাকিস্তানিরা কাশ্মীরে হামলা চালিয়ে বিশ্বের দৃষ্টি বাংলাদেশ পরিস্থিতি থেকে সেদিকে আকর্ষণ করতে পারে।
(৫) ২৪ মে থেকে ভারতীয় পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হলে সেখানে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ভারত সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ আসতে পারে। ফলে ইসলামাবাদের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কচ্যুতি ঘটতে পারে। স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশকে আরাে বেশি পরিমাণে সাহায্য করার দায়দায়িত্ব ভারতের ঘাড়ে এসে পড়বে যার ফলে গােপন দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিতে পারে।
এ ধরনের যুদ্ধাবস্থা যে কেবল ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। গােয়েন্দা সূত্রগুলাে থেকে জানা গেছে যে, চীন হয়তাে ইতােমধ্যেই পাকিস্তানকে শর্তসাপেক্ষে আশ্বাস দিয়েছে যে ভারতের সঙ্গে বিবাদ শুরু হলে চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করবে। তারা হয়তাে এই আশ্বাস দিয়েছে যে, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধাবস্থা শুরু হলে চীন তিব্বত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করবে। চীন সরাসরি জড়িত হয়ে পড়লে সােভিয়েত ইউনিয়ন প্রকাশ্যে ভারতের সমর্থন করে সামরিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে।
যুদ্ধাবস্থা নিরসনে আমেরিকার করণীয়
বর্তমান অবস্থায় ভারত ও পাকিস্তানের ওপর আমেরিকার প্রভাব সীমিত হলেও যুদ্ধাবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে উপমহাদেশে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার জন্য বেশ কতকগুলি পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার কোনাে রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধাবস্থার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আকাক্ষার ওপর ভিত্তি করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যদি পরস্পরসম্মত শান্তিপূর্ণ কোনাে পথ উদ্ভাবন করা না যায় তা হলে এমন কোনাে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না যে শরণার্থী সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাছাড়া শান্তিপূর্ণ কোনাে সমাধান হলেই ভারত পশ্চাদপসরণ করবে এবং বাঙালিদের সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবে অবস্থাদৃষ্টে তা মনে হচ্ছে না। সেজন্য মার্কিন
পৃষ্ঠা: ১৩৭
সরকারের উচিত হবে :
(ক) পাকিস্তান সরকারের ওপর রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ অব্যাহত রাখা এবং তাদের বলে দেয়া যে এ ধরনের সমঝােতার ওপর মার্কিন সরকারের সাহায্য করার ক্ষমতা নির্ভর করছে।
(খ) পশ্চিম পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বাড়াবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাকিস্তান সরকারকে সমঝােতায় প্রলুব্ধ করা।
(গ) নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ উভয় স্থানে যুদ্ধের ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করে সীমান্ত সংঘর্ষে না যাওয়ার জন্য তাদের অনুপ্রাণিত করা। ভারতকে চীনা কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন রাখা এবং তাদের অবহিত করা যে অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আমেরিকা কোনাে সাহায্য করতে পারবে না।
(ঘ) ভারত সরকারকে শরণার্থীদের জন্য মার্কিন সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি দেয়া এবং পাকিস্তানিদের এমন পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানানাে যাতে করে শরণার্থীদের যাওয়া বন্ধ হয় এবং তারা ফিরে যাওয়ার কারণ খুঁজে পায়।
(ঙ) পরিস্থিতি শান্ত করার উপায় উদ্ভাবনের জন্য গােপনে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আলােচনা করা।
(চ) পৃথিবীর অন্যান্য দেশকে শান্তি স্থাপনে মধ্যবর্তী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানাে। সুইসরা ইতােমধ্যেই কোলকাতা ও ঢাকায় যােগাযােগ করে উভয় দেশের কূটনীতিকদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা নিচ্ছে। আরাে কোনাে কোনাে দেশকে অনুরূপ ভূমিকার জন্য অনুরােধ জানানাে যেতে পারে। যেমন ইসলামাবাদ, দিল্লি ও পিকিংয়ের সঙ্গে কানাডার ভালাে সম্পর্ক রয়েছে।
(ছ) জাতিসংঘের মহাসচিবকে আরাে রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক ত্রাণ প্রচেষ্টা এবং শান্তি স্থাপনের জন্য প্রকাশ্য আবেদন এবং প্রয়ােজনবােধে দক্ষিণ এশিয়া সফর করে সেখানকার নেতাদের সঙ্গে আলােচনার আহ্বান জানানাে।
নিক্সন ও কিসিঞ্জারের মধ্যে বাক্যালাপ
কিসিঞ্জার : ইন্দিরা গান্ধী আপনাকে চিঠি দিয়েছে।
নিক্সন : জানি।
কিসিঞ্জার : তা নয়। তাড়াতাড়ি এর জবাব দেয়া দরকার। মিলিটারি অ্যাকশনে না যাবার জন্য তাকে অনুরােধ করা যেতে পারে। আমি পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেছি। সে বলছে ইয়াহিয়াও একটি চিঠি পেলে খুশি হবে। এতে সে অনেক কিছু বলার সুযােগ পাবে। এখন তার এখানে পাবলিসিটি পাওয়ার কোনাে সুযােগ নেই।
নিক্সন : তাই।
পৃষ্ঠা: ১৩৮
কিসিঞ্জার : এবং ইন্দিরা গান্ধী। আমি ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা এখন ভীষণ ঘােরপ্যাচ লাগাচ্ছে।
নিক্সন : ইন্দিরা চায়…।
কিসিঞ্জার: সে হয়তাে বলতে চাইবে তার চিঠি পাঠানাের ফলেই…।
নিক্সন : হঁ্যা।
কিসিঞ্জার : আপনি ইয়াহিয়াকেও লিখেছেন। কাজেই সবার এখন খুশি থাকার কথা। পাকিস্তানিরা…।
নিক্সন : কিন্তু ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলা হয়নি তাে?
কিসিঞ্জার : না, না। শুধু লেখা হয়েছে, শরণার্থীরা খুব জলদিই পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি আপনাকে এখন জবাব দেবেন যে তিনিও ঠিক তা-ই চান। আমি… সঙ্গে যা ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছি।
নিক্সন : গুড।
কিসিঞ্জার : অ্যামবেসির সঙ্গে। তখন আপনি এর ক্রেডিট নিতে পারবেন। আপনি তখন ইন্ডিয়াকে বলতে পারবেন গতি কমাতে।
নিক্সন : হঁ্যা।
কিসিঞ্জার : আমরা ইয়াহিয়াকে সন্তুষ্ট রাখবাে।
নিক্সন : ভারতের আসলে দরকার… তাদের জন্য আসলে দরকার…।
কিসিঞ্জার : দে আর সাচ বাস্টার্ডস।
নিক্সন : দরকার একটা মহাদুর্ভিক্ষ। কিন্তু তা হচ্ছে না। কারণ আমরা তাদের খাওয়াচ্ছি। নতুন ধরনের গম খাওয়াচ্ছি। কিন্তু দুর্ভিক্ষ না হলে শেষ পর্যন্ত তাদের দরকার বড় ধরনের একটা যুদ্ধ। লেট দ্য গডড্যাম ইন্ডিয়ানস ফাইট এ ওয়ার।
কিসিঞ্জার : ইন্ডিয়ানরাই হলাে এখানে সবচাইতে বেশি আক্রমণমুখী (অ্যাগ্রেসিভ)।
নিক্সন : ইন্ডিয়ানস?
কিসিঞ্জার : ইয়াহ।
নিক্সন : শিওর।১৬
ভারতের ব্যাপারে নিক্সনের অনীহা ছিল প্রবল। কিসিঞ্জারও দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতির বিষয়ে পাকিস্তানের পক্ষপাতিত্ব করছিলেন। বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর ভারত পুরােপুরিভাবে সােভিয়েত শিবিরে ঢুকে পড়লে সঙ্গত কারণেই আমেরিকাকে তার দক্ষিণ এশীয় পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজাতে হয়। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের মাখামাখির কারণে পাকিস্তানের প্রতি আমেরিকার আস্থাবােধ কম থাকলেও একদিকে সামরিক ও অন্যদিকে অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে আমেরিকা পাকিস্তানকে এমন কাবু করে রেখেছিল যে পাকিস্তানের পক্ষে আর অন্য কোনাে শিবিরে ঢােকা সম্ভব ছিল না।
পৃষ্ঠা: ১৩৯
তবে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে আমেরিকা ছিল সত্যি সত্যিই উদ্বিগ্ন। কারণ পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে গেলে ইয়াহিয়ার পক্ষে আর ক্ষমতায় থাকা সম্ভব ছিল না। ইয়াহিয়া যদি বেসামরিক নেতৃত্বের হাতে দেশ ছেড়ে দিয়ে পদত্যাগও করেন তা হলে ক্ষমতা চলে যায় ভুট্টোর হাতে—যার হাতে আমেরিকার ভারতের সঙ্গে সহনশীলতার ভিত্তিতে স্থাপিত পররাষ্ট্রনীতি ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিপূর্ণ আস্থা কোনােটাই নিশ্চিত ছিল না। তাই আমেরিকার উদ্দেশ্য ছিল যতদিন সম্ভব ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতায় ধরে রেখে বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে ভারতের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা।
নিক্সন-কিসিঞ্জারের আরেকটি সংলাপ ১৯৭১ সালের ৪ জুলাই নিক্সন ও কিসিঞ্জার টেলিফোনে আবার আলাপ করেন। আলাপের বিষয়বস্তু ছিল পাক-ভারত-বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এবং ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিংয়ের তৎপরতা। ভারতের ব্যাপারে নিক্সন ছিলেন আগের মতােই উন্নাসিক এবং একই সঙ্গে কিটিংয়ের অতি ভারতপ্রীতিতে বিরক্ত।
নিক্সন : আমি কিটিংকে বলেছিলাম, আমাদের নিশ্চিত থাকতে হবে আমরা যেন কারাে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে না পড়ি। অথচ কেউ যেন আমাদের নিয়ে টানাটানিও না করে।
কিসিঞ্জার : সে (কিটিং) এ ব্যাপারে একেবারে নাছােড়বান্দা। নিক্সন : সে আমাদের দিয়ে কী করাতে চাইছে?
কিসিঞ্জার : সে মনে করে আমাদের উচিত পাকিস্তানের মিলিটারি সাহায্য কেটে নিয়ে ভারতকে দিয়ে দেয়া যাতে করে তারা পাকিস্তানকে…
নিক্সন : এ ধরনের আজেবাজে কথা আমি শুনতে চাই না।
কিসিঞ্জার : মি. প্রেসিডেন্ট, ইয়াহিয়াকে যে করেই হােক টিকিয়ে রাখতে হবে।
নিক্সন : এমনকি চীনের কথা বাদ দিলেও… আমি ভারতীয়দের সাহায্য করতে চাই না। ওদের জাতই খারাপ। এখন কিটিং… অন্য যে কোনাে। রাষ্ট্রদূতের মতােই… যারাই যেখানে যায় একদম ভেড়া বনে যায়।
কিসিঞ্জার : ‘দোজ সানস-অব-বিচেস’ আমাদের জন্য তারা কোনােদিন একটা আঙ্গুলও ওঠায়নি। কিসের জন্য আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে তাদের হেল্প করতে যাবাে? পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হলে তাে তা ভারতের নর্দমায় পরিণত হবে। ১০ কোটি লােক এশিয়ার দরিদ্রতম…।
নিক্সন : ইয়াহ।
কিসিঞ্জার : কোনাে রিসাের্স নেই। কমিউনিস্টদের জন্য উর্বরক্ষেত্রে পরিণত হবে। এর পর তারা পশ্চিমবঙ্গের জন্য ভারতের ওপর চাপ দেবে।
পৃষ্ঠা: ১৪০
ভারতীয়রা বােকার মতাে যা করছে তাতে মজাটা টের পাবে… অবশ্য তাদের মাথায় যদি পূর্ব পাকিস্তানকে একটা কলােনিতে পরিণত করে কোলকাতা থেকে চালাতে না চায়।
নিক্সন : তাদের মাথায় অবশ্য অন্য চিন্তা আছে। তা হলাে পাকিস্তানকে ধ্বংস করা।১৭
প্রেসিডেন্ট নিক্সন, কিসিঞ্জার ও ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সংলাপ
নিক্সন : আমাদের অন্যান্য অ্যাম্বেসেডরের মতাে ভারতীয়রা কিটিংকেও ব্রেনওয়াশ করে ছেড়ে দিয়েছে। এন্টি-পাকিস্তান।
কিটিং : অলরাইট আমাকে বলতে দিন…।
নিক্সন : তােমার চপ্পল কোথায় দেখি…।
কিটিং : আমাকে ৫ মিনিট সময় বলতে দেন।
নিক্সন : আশা করি তুমি আমাদের অ্যাম্বেসিকে তােমার আগের লােকজনের মতাে ও সব হিপ্পিদের হাতে ছেড়ে দাওনি…।
কিটিং : আমি শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড বলতে চাই। তারপর আপনি ওদের ফরেন মিনিস্টারের সম্পর্কে কিছু বলতে চাইবেন।
নিক্সন : ভারতীয়রা মনে করে তুমি একজন ভালাে অ্যাম্বেসেডর।
কিটিং : কিন্তু তারা খুব কড়া।
নিক্সন : একথা বহুবার শুনেছি।
কিটিং : আমি ব্যক্তিগতভাবে বলছি, আপনি যেভাবে শুরু করেছেন তা চমৎকার। কারণ…।
নিক্সন : এটা ঠিক না।
কিটিং : ডােন্ট লেট এনি অব দিজ বাস্টার্ডর্স লেট ইউ ডাউন। এবং আপনিও দারুণ সামলাচ্ছেন। গ্রেট।
নিক্সন : ইয়াহ।
কিটিং : ইন্ডিয়ানরা কড়া।… আমি নিশ্চিত যে উপমহাদেশে একটি পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এবং সেখানে ভারত ও পাকিস্তানকে সমান ভাবলে চলবে না। ইন্ডিয়া একটি স্ট্রং, স্টেবল দেশ। পাকিস্তানে তাে নানারকম ঝামেলা চলছে। (আমি যে দুটি সুপারিশ পাঠিয়েছি)১৮ সেগুলাের মধ্যে আরেকটি ছিল সাহায্য সংক্রান্ত। আমি বলেছিলাম…
কিসিঞ্জার : আমি তা দেখিনি।
নিক্সন : সেগুলােতে কি এখনই কিছু করার সুপারিশ আছে? ফরেন মিনিস্টার আমার সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলতে চায়? পাকিস্তান? কিটিং : জি। তারা চায়…।
পৃষ্ঠা: ১৪১
নিক্সন : পাকিস্তান ভেঙে দিতে তাই না?
কিটিং : না, না। প্রথমদিকে ওরাও আমাদের মতােই ভাবছিল পাকিস্তান অটুট থাকবে। শেখ মুজিবুর রহমান ভারতপন্থী এবং মার্কিনপন্থী। সে নিজেও ভাবছিল পাকিস্তান তার বন্ধু থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর্মি নেমে সবকিছু ভণ্ডুল করে দিল। সে কারণে তারা ছিল আপসেট। তবে আমি যখন অ্যাম্বাসেডরের কাছে যাই তখন আমাদের এইডের কথা বলেছিলাম। আমার মনে হয় ওরা এজন্য আমাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
নিক্সন : এখন এর পরিমাণ কত?
কিটিং : সাড়ে ১৭ মিলিয়ন।
নিক্সন : হঁ্যা। আমি যখন গিয়েছিলাম তখন তা ছিল আড়াই মিলিয়ন।
কিটিং : রাষ্ট্রদূত প্রথমেই যে কথা বলবে তা হলাে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের কথা। শরণার্থীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানােই সবচেয়ে জরুরি। আমরা ইন্ডিয়ায় আর টাকা ঢালতে চাইব না। যদি এক বছর এমন অবস্থা চলে তা হলে তার খরচ দাঁড়াবে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার।
নিক্সন : শরণার্থীদের সংখ্যা কত? তিন লাখ…।
কিসিঞ্জার : না, তা প্রায় ৫০ লাখ। এবং তারা ভারতের সবচাইতে ঘনবসতি এলাকায়।
নিক্সন : স্যরি, তিন লাখকে আমরা খাওয়াচ্ছি।
কিটিং : দ্যাটস রাইট। প্রায় পঞ্চাশ লাখ। তার মধ্যে প্রায় ত্রিশ লাখ…।
নিক্সন : গুলি করে ওদের মেরে ফেলে না কেন?
কিটিং : এর মধ্যে ৩০ লাখ কেবল কোলকাতায়। চিন্তা করেন, নিউইয়র্কের সাইজের একটা শহরে বাড়তি ৩০ লাখ লােক এলে কী অবস্থা হবে। এখনাে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ করে লােক আসছে। সবশেষে আমি শুনেছি প্রতিদিন দেড় লাখ। ওরা এখন হিন্দুদের মারছে। প্রথমদিকে ছিল ওদের জনসংখ্যার অনুপাতেই ৮৫ ভাগ মুসলমান। এখন ওরা ধরে ধরে হিন্দু মারছে।
নিক্সন : কেনেথ, সে মনে করছে আমাদের কী করা উচিত? আমরা কী সুপারিশ করতে পারি?
কিটিং : সে মনে করে আমার মনে হয়, সে মনে করে…।
নিক্সন : আমাদের কি ইয়াহিয়াকে চাপ দেয়া উচিত?
কিটিং : হঁা। আমার মনে হয় সে তাই চায়। তার মতে একমাত্র রাশিয়া এবং আমেরিকা ইয়াহিয়াকে চাপ দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে পারে। এর মধ্যে আমেরিকার সুবিধা সােভিয়েতের চাইতে বেশি এবং একমাত্র উপায় হলাে অর্থনৈতিক চাপ। ইয়াহিয়া দাবি করছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। কিন্তু
পৃষ্ঠা: ১৪২
আসলে তা স্বাভাবিক নয়। আগামী এক বছরের জন্য স্বাভাবিক হবে না। আমিন১৯ কিংবা কয়েকজন দলছুট আওয়ামী লীগারদের দিয়ে লােকদেখানাে সমঝােতা করে কোনাে লাভ হবে না। তিক্ততা এখন যে পর্যায়ে গেছে তাতে, ফারল্যান্ডও তা বুঝতে পারছে, পাকিস্তান টিকবে না। জোসেফ (ফারল্যান্ড) ইতােমধ্যেই তার টেলিগ্রামে এটা জানিয়েছে। আমিও তা প্রচণ্ডভাবে বিশ্বাস করি।
নিক্সন : তা… সিং এর সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে কখন?
কিসিঞ্জার : বৃহস্পতিবার, মি. প্রেসিডেন্ট।২০।
কিটিং : এ ব্যাপারে আমার কিছু সাজেশন আছে।
নিক্সন : ইয়াহ।
কিটিং : পাকিস্তানকে যে সাহায্য দেয়া হচ্ছে তা থেকে কিছুটা কেটে ভারতকে শরণার্থী সমস্যা সামলাতে দেয়া যায়। আপনি সেটা তাকে বলতে পারেন।
কিসিঞ্জার : তােমার আগের স্কিমে বলা হয়েছিল ২৫ মিলিয়ন ডলার…।
নিক্সন : পাকিস্তানি এইড।
কিসিঞ্জার : হ্যা পাকিস্তানি এইড ইন্ডিয়াকে দেয়ার জন্য…।
নিক্সন : না। আমার মনে হয় ভারতকে দেয়ার জন্য আলাদা তহবিলের ব্যবস্থা করতে হবে।
কিটিং : আমার মনে হয় না এমন কোনাে তহবিল আছে। পাকিস্তানের জন্য ধরা আছে ৮ মিলিয়ন ডলার।২১
চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
এর আগের অধ্যায়ে চীনে কিসিঞ্জারের যে গােপন সফরের বিবরণ দেয়া হয়েছে সে সফরে কিসিঞ্জার ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান ও ভারতসহ কয়েকটি দেশ সফর করেন। ভারত সফরকালে ৭ জুলাই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের সঙ্গে কিসিঞ্জার ও তার সফরসঙ্গীদের এক সুদীর্ঘ বৈঠক হয়। ২ জুলাই কিসিঞ্জার ওয়াশিংটন ত্যাগ করেন ও পাকিস্তান সফরকালে চীনে গােপন মিশনে যান এবং পাকিস্তান থেকে ফেরার পথে জগজীবন রামের সঙ্গে তার অফিসে দেখা করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জগজীবন রাম, প্রতিরক্ষা সচিব কে বি লাল, পররাষ্ট্র দফতরের আমেরিকা ডিভিশন প্রধান মিসেস রুক্মিনী মেভিলন এবং কিসিঞ্জারের সঙ্গে ছিলেন রাষ্ট্রদূত কিটিং ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের স্টাফ হ্যারল্ড সন্ডার্স। ১১ জুলাই কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে ফিরে যান এবং ১২ জুলাই তাদের আলাপচারিতার বিবরণী তৈরি করা হয়। বৈঠকে ভারত, চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা হয়। তবে চীন সফরের অভিজ্ঞতায় কিসিঞ্জার
পৃষ্ঠা: ১৪৩
ছিলেন ভারতের কাছ থেকে অন্যান্য বিষয়ের চাইতে চীন সম্পর্কে ভারতের মনােভাব জানতে বেশি আগ্রহী।
বৈঠকে জগজীবন রাম প্রথমেই পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রের প্রসঙ্গ ওঠালে কিসিঞ্জার বলেন যে কয়েকদিন আগে তিনি সে প্রসঙ্গ নিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন ও এ মুহূর্তে তিনি আরাে সাধারণ বিষয় নিয়ে আলােচনা করতে চান। সে পর্যায়ে তিনি সম্ভাব্য ভারতের ওপর মিলিটারি চীনের কমিউনিস্ট হুমকির বিষয়ে ভারতের মনােভাব সম্পর্কে জানতে চান।
জগজীবন রাম বলেন যে, ভারত ও চীনের সামরিক ভারসাম্যের মধ্যে তেমন কোনাে পরিবর্তন ঘটেনি। চীন সীমান্তের কিছু জায়গায় সৈন্য সমাবেশ করেছে এবং সামরিক অনুশীলন চালাচ্ছে। ভারতের প্রস্তুতি আগের মতােই বহাল রয়েছে। তিনি বলেন, চীনা কমিউনিস্টরা পূর্ব বাংলায় উত্তর-পূর্ব সীমান্তে গােলমাল বাধাবার জন্য মিজোদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং তার সংখ্যা হবে ১ হাজার থেকে ১২০০। সাধারণভাবে চাইনিজরা আগের মতােই হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। তবে পূর্ব পাকিস্তানে গােলযােগ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে ওরা সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা বাড়ায়নি।
মি. লাল বলেন, চীনারা দ্রুত তাদের যােগাযােগ, বাংকার ও এয়ারপাের্ট সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। ভারতের উত্তর সীমান্তে চীনের প্রায় ১ লাখ সৈন্য রয়েছে।
চাইনিজরা তাদের সৈন্য সমাবেশ না বাড়িয়ে বর্তমান অবস্থান থেকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে কি না বা কোনাে রকম হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে কি না জিজ্ঞেস করলে লাল বলেন, ভারত সেটা আগে থাকতে জানতে পারবে, কারণ চীনকে তখন সাপ্লাই ত্বরান্বিত করতে হবে। তিনি বলেন যে ১৯৬২ সালে ভারত তৈরি ছিল না। এবং তথ্য প্রবাহও খুব একটা সন্তোষজনক ছিল না। তার মতে, যুদ্ধ করার জন্য সাপ্লাই মজুদ করতে চীনের দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে।
কিসিঞ্জার বলেন যে, কমিউনিস্টরা হামলা চালাবার আগে কী ধরনের সামরিক প্রস্তুতি নিতে পারে তার ওপর ইউরােপে মার্কিন স্টাডি করা হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানান যে ভারতেও এ ধরনের সমীক্ষা চালানাে হয়েছে।
ভারতীয়রা চীনা কোনাে আকস্মিক হামলাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে জিজ্ঞেস করলে রাম বলেন, এটা তেমন সহজ হবে না। এমনকি তিব্বতের ওপর দিয়ে হামলা চালালেও। এ ব্যাপারে আমেরিকার কাছে কোনাে তথ্য আছে কি না জানতে চাইলে কিসিঞ্জার বলেন এমন সম্ভাবনা খুবই কম। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ বাধলে এ ধরনের সম্ভাবনা আছে।
মি. লাল বলেন, ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে না। কাজেই এ ধরনের হামলা যথার্থ হবে না। এ পর্যায়ে অ্যাম্বেসেডর কিটিং বলেন যে, চাইনিজরা বলেছে যুদ্ধ হলে তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করবে। কিসিঞ্জার বলেন, ভারতের। বিরুদ্ধে চীন কোনাে ব্যবস্থা নিলে আমেরিকা তার ওপর কড়া নজর রাখবে।
পৃষ্ঠা: ১৪৪
ভারতের সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জগজীবন রাম বলেন যে, ভারতের পূর্ব-পশ্চিম উভয় সীমান্তের পরিস্থিতি উত্তেজনাকর। যে কোনাে পরিস্থিতিতে সামরিক সম্ভার সংযােজনা হলে তা উত্তেজনা বাড়ায়। বাংলাদেশকে বিচার করতে হবে সুপরিসর শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপট থেকে। আমেরিকাকে বিচার করে দেখতে হবে পাকিস্তান বাংলাদেশকে ধরে রাখতে পারবে কি না। কিংবা পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ থাকলে বর্তমান অবস্থায় তা কি মার্কিন স্বার্থের পরিপূরক হবে?
কিসিঞ্জার বলেন যে, আমেরিকার সরকার বিষয়টি বিবেচনা করছে। তিনি এ মুহূর্তে আমেরিকার কী করণীয় আছে জিজ্ঞেস করলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানান যে আমেরিকার অনেক কিছু করার রয়েছে। পাকিস্তানের যা অর্জন তা কেবল আমেরিকার জন্যই হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক শক্তির পুরােটা যােগান দিয়েছে আমেরিকা। রিফুজিরা সৃষ্টি করেছে তাৎক্ষণিক সমস্যা। যদি লােকগুলাে এদেশেই থেকে যায় তা হলে সামাজিকভাবেও তা ভারতের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়। সবকিছুর বাইরে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধান করার বিষয়টি জরুরি হয়ে এসেছে।
কিসিঞ্জার বলেন, আমেরিকা বিচ্ছিন্নতার পক্ষে না। সবাই রাজনৈতিক সমাধান কামনা করছে। আমেরিকা ভারতকে বিভ্রান্ত করতে চায় না। এমন একটা পরিবেশ দরকার যাতে শরণার্থীরা দেশে ফেরত যেতে পারে।
ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন যে, মুজিবুর রহমান কোনােদিনও বিচ্ছিন্নতা চাননি। তিনি ছিলেন একজন মডারেট। ভারতের এখনকার মূল সমস্যা হলাে ৭০ লাখ শরণার্থী নিয়ে। তিনি বলেন, আমেরিকা ইয়াহিয়ার ওপর চাপ দিতে পারে। তাকে বলতে পারে, যাতে করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছানুযায়ী রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা হয়।
কিসিঞ্জার বলেন, আমেরিকা ভারতকে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল অবস্থানে দেখতে চায়। আবার পাকিস্তানের ওপরও প্রভাব বহাল রাখতে চায়। আমেরিকার ইচ্ছা হলাে সেই প্রভাব কাজে লাগিয়ে এমন একটা সমঝােতার ব্যবস্থা করা, যাতে শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরতে পারে। সে কৌশল কাজে না লাগলে সে বিষয়ে পুনঃনিরীক্ষা চালানাে হবে।
ভারত সরকার প্রচণ্ড চাপের মুখে রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, এখানে রয়েছে জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলগুলাে ও প্রচারমাধ্যম সরকারকে কোনাে একটা কিছু করার জন্য অনবরত চাপ দিচ্ছে। পাকিস্তান অভিযােগ করছে যে, ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করছে, যা সত্য নয়। পাকিস্তান সীমানা থেকে বরং আগরতলায় বােমাবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। পাকিস্তানের সেখানে রয়েছে প্রায় ৭০ হাজার সৈন্য। চারটার চাইতে বেশি ডিভিশন সমুদ্রপথে ওদের সাপ্লাই আসছে। তবে বেশি দিন তারা অবস্থান ধরে
পৃষ্ঠা: ১৪৫
রাখতে পারবে না। কারণ তাদের সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ওরা টিকবে না।
জগজীবন রাম বলেন, ভারত চায় আমেরিকা পাকিস্তানের ওপর তাদের প্রভাব প্রয়ােগ করুক, অথচ আমেরিকা তা করছে কি না সন্দেহ রয়েছে। সম্প্রতি সামরিক সাহায্যের মাত্রা তেমন বেশি না হলেও ভাবাবেগতাড়িত হয়েই ভারত প্রতিক্রিয়া। দেখিয়েছে। তবে পাকিস্তানের সামরিক সামর্থ্য ভারতের বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য হলাে আমেরিকার মনােভাব।
কিসিঞ্জার স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক ভারসাম্য নিয়ে আসা আমেরিকার লক্ষ্য নয়। এ মুহূর্তে একমাত্র লক্ষ্য হলাে শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা।২২
ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডির মন্তব্য ও মেমােরেন্ডামের প্রেক্ষিতে ১০ জুলাই ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ব্যুরাে অব নিয়ার ইস্টার্ন এন্ড সাউথ এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সের সদস্য অ্যান্থনি কোয়াইন্টাল ৪০ পৃষ্ঠাব্যাপী বিশাল এক সমীক্ষা প্রণয়ন করেন। এতে পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা। করে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হওয়া বা না হওয়ার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ করা হয়।২৩
যুদ্ধের সম্ভাবনা
এতে বলা হয়,
ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের আশঙ্কার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি নমুনা দেখতে পাওয়া গেলেও যুদ্ধের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে ভারতীয় সিদ্ধান্ত প্রণেতারা জানেন যে যুদ্ধ বাধলেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অতখানি সহজ হবে না, যুদ্ধ হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরু হলে চীনের সরাসরি হস্তক্ষেপ চলে আসতে পারে। অবশ্য এতসব নেতিবাচক প্রেক্ষাপটের পরও আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধে যেতে পারে।
ভারতীয় এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ ও শরণার্থীদের অবস্থানের ওপর। বিশেষ করে ভারত যদি মনে করে যে, দীর্ঘদিন শরণার্থীদের অবস্থানের ফলে বেঙ্গল ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রগতিশীল রাজনীতি জোরদার হবে এবং পর্যায়ক্রমে তা ভারতের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও সংহতিকে বিনষ্ট করবে এবং বাংলা, আসাম ও ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজনৈতিক কাঠামােকে বদলে ফেলবে, তা হলে যুদ্ধের প্রক্রিয়া আরাে জোরদার হবে। তারা তখন মনে করতে পারে, যুদ্ধের ভয়াবহতার চাইতে ভারতের রাজনৈতিক
পৃষ্ঠা: ১৪৬
সংকট হবে আরাে ভয়াবহ এবং প্রয়ােজনে যুদ্ধ করে হলেও সেসব প্রেক্ষিত থেকে ভারতকে রক্ষা করতে হবে।
অবশ্য যুদ্ধ ঘােষণার মাঝখানের সময়টাতে একটা ফাঁক রয়ে গেছে যে সময়টাতে ভারত পর্যবেক্ষণ করবে আন্তর্জাতিক চাপ, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতার প্রেক্ষাপট, পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি পুনঃস্থাপন এবং শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে পাকিস্তান কোনাে রাজনৈতিক সমাধানের দিকে এগিয়ে যায় কি না। সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসের মধ্যে এ ক্ষেত্রে অবস্থার কোনাে পরিবর্তন সূচিত না হলে দু’পক্ষের সংঘর্ষের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কীভাবে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটছে, তার ওপর আমেরিকার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ভর করা উচিত বলে মন্তব্য করে সমীক্ষায় বলা হয়,
খুব সম্ভবত এ যুদ্ধ শুরু হবে ভারতের আক্রমণের মধ্য দিয়ে কিংবা দু’পক্ষের সীমান্তে ঘন ঘন সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। শেষােক্ত ক্ষেত্রে অবশ্য। বিশেষভাবে এক পক্ষের ওপর দোষ চাপানাে যাবে না।
প্রাথমিকভাবে সংঘর্ষ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা বেশি। আমেরিকার স্বার্থ হবে লক্ষ্য রাখা যুদ্ধে কোনাে তৃতীয় শক্তি বিশেষ করে চীন জড়িয়ে না পড়ে। আরাে দেখতে হবে যুদ্ধ যাতে প্রলম্বিত না। হয়… কারণ তা হলে পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর আঘাত আসতে পারে। কাজেই ভারত যদি পাকিস্তান আক্রমণ করে তা হলে আমেরিকার প্রাথমিক লক্ষ্য থাকবে সমঝােতা ও দেনদরবারের মধ্য দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধ ও বিবাদ মিটিয়ে ফেলা,
ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার ও সার্বিক রাজনৈতিক সমঝােতা। সমীক্ষায় বলা হয়,
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে গেলে আমেরিকা তিনটির মধ্যে একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। সেগুলাে হলাে : (১) চুপ থেকে পর্যবেক্ষণ করা। (২) যে আক্রান্ত হবে তাকে সামরিক সাহায্য দেয়া এবং (৩) রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করে যুদ্ধাবস্থা স্থানীয় পর্যায়ে সীমিত রাখা।
১. প্রথমত নির্বিকার ভূমিকা পালন করে ঘটনায় নাক না গলানাে যেতে পারে। যে ক্ষেত্রে যুদ্ধের জন্য কে দায়ী নিরূপণ করা কঠিন সেসব ক্ষেত্রে এই কৌশল খুবই কার্যকর হয় এবং আমেরিকার কাছে স্পষ্ট হবে যে চীনের জড়িত হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। এর ফলে ভারত কিংবা পাকিস্তান কারাে সঙ্গেই আমেরিকার সম্পর্কের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। দুই পক্ষই মনে করতে পারে যে, তাদের প্রতি নৈব্যক্তিক
পৃষ্ঠা: ১৪৭
সমর্থন দিতে গিয়েই আমেরিকা নীরব ভূমিকা পালন করছে। এর ফলে হয়তাে দুই পক্ষের রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য আমেরিকার পক্ষে মধ্যবর্তী একটি ভূমিকাও পালন করা সম্ভব। অবশ্য সংঘর্ষ যদি কেবলমাত্র স্বল্প মেয়াদের হয় তবেই এই কৌশল কার্যকর হতে পারে। কারণ দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের অভ্যন্তরীণ সংহতিকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করবে, যা হবে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতার পরিপন্থী।
অবশ্য এর একটি ভালাে এবং একটি খারাপ দিক রয়েছে। ভালাে দিক হলাে এই যে এর ফলে দুই পক্ষের আনুগত্য অর্জন করে মধ্যবর্তী ভূমিকা পালন করা যাবে। খারাপ দিক হলাে এর ফলে রাশিয়ার প্রতি ভারতের এবং চীনের প্রতি পাকিস্তানের আনুগত্য বেড়ে যেতে পারে, যার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন স্বার্থ মারাত্মক সংকটে পড়বে।
২. দুই নম্বর কৌশল হবে, যে কোনাে এক পক্ষকে সামরিক সাহায্য দেয়া। দু’দেশের প্রতিই আমেরিকার সীমিত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।২৪ কোনাে দেশের সঙ্গেই আমেরিকার এমন কোনাে বাধ্যবাধকতা নেই যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমেরিকাকে কারাে পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে হবে। পাকিস্তান ও ভারত উভয়েই অবশ্য আমেরিকাকে যুদ্ধে জড়িত করে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করবে। এমন যদি হয় যে কোনাে পক্ষ আগে আক্রান্ত হয়েছে, সেই পক্ষে সাহায্য করলে আমেরিকার ভাবমূর্তি বাড়তে পারে।
পাকিস্তান যদি আগে আক্রান্ত হয়, তা হলে ১৯৬৫ সালের অবস্থার মতাে পাকিস্তান আমাদের দিকে ঝুঁকতে পারে। তখন যদি আমেরিকা বিবেচনা করে যে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি বজায় রাখার জন্য মার্কিন সাহায্যের প্রয়ােজন এবং সামরিক সাহায্য দিলে পাকিস্তানের বিপর্যয় রােধ করা যেতে পারে, তা হলে শুধু অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করা যায় কিন্তু কোনাে জনবল পাঠিয়ে নয়। এর ফলে পাকিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী একটি রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনও সম্ভব হবে। তবে এর ফলে ভারত এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের প্রচণ্ড ক্ষতি হবে। ফলে ভারতের সঙ্গে স্থায়ী সম্প্রীতি গড়ে তােলার সব সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে।
সীমিত আকারে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অবশ্য ভারতকে অস্ত্র সাহায্য করার কৌশল অবলম্বন না করার সম্ভাবনাই বেশি। অবশ্য চীন যদি পাকিস্তানের পক্ষে ব্যাপকভাবে অংশ নেয় এবং ভারতের ওপর সরাসরি হুমকি সৃষ্টি করে২৫ তা হলে ভারত নিজে পাক-ভারত সংঘর্ষের উদ্যোক্তা না হলে এ ধরনের সাহায্য বিস্তার
পৃষ্ঠা: ১৪৮
করা যেতে পারে। চীনাদের জড়িত হওয়ার সুবাদে ভারতকে সাহায্য করতে পারলে ভারতের কাছে যে স্বীকৃতি পাওয়া যাবে তা হবে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার যে কোনাে প্রাপ্তির চাইতে উত্তম। এ ক্ষেত্রে ভারতকে দেয়া অস্ত্র। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হলেও পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে এবং সংঘর্ষ থামানাের জন্য আমেরিকার মধ্যস্থতা করার যে সম্ভাবনা ছিল তা আর থাকবে না।
৩. তৃতীয় কৌশল হবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। পাকিস্তান ও ভারত উভয়ের সঙ্গে ভালাে সম্পর্ক বহাল রাখতে গিয়ে এবং উপমহাদেশে চীনা প্রভাব প্রতিহত করার জন্য আমেরিকা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কৌশল অবলম্বন করলে মার্কিন ভূমিকায় অশেষ নমনীয়তা থাকবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রধান উদ্দেশ্য থাকবে পাক-ভারত সম্পর্ককে স্থানীয় পর্যায়ে সীমিত রাখা এবং চূড়ান্তভাবে শেষ করা। এ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অবশ্যই সে অঞ্চলে অশান্তির মূল কারণগুলাে অপসারণ করা সম্ভব।
যুদ্ধের আশু সম্ভাবনা দেখা দিলে আমেরিকার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে করণীয় কতগুলাে বিষয়ও চিহ্নিত করা হয়। সেগুলাে হলাে :
১. আমেরিকার যে কোনাে পণ্যবাহী জাহাজ ভারত বা পাকিস্তানগামী হলে দু’দেশের জন্যই পণ্য বহনকারী জাহাজগুলােকে যুধ্যমান কোনাে দেশের বন্দরে না ভেড়ার নির্দেশ দিতে হবে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় এমন দেখা গিয়েছিল যে ভারত বা পাকিস্তানের বন্দরে প্রতিপক্ষ দেশের মালামাল নিয়ে কোনাে জাহাজ ভিড়লে সে সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছিল।
২. যুদ্ধের ফলে উভয় দেশের বিমানবন্দরগুলােতে বােমাবর্ষণ করা হতে পারে। মিলিটারি অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ড এবং কমার্শিয়াল এয়ার ক্যারিয়ারগুলাের জন্য এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে ভারত বা পাকিস্তানে অবতরণ না করে দেশগুলাে অতিক্রম করা যায়।
৩. ভারত ও পাকিস্তানের সকল পােস্টে উদ্ধার ব্যবস্থা তৈরি রাখতে হবে, যাতে করে স্বল্প সময়ের নােটিশে উদ্ধারকার্য সম্পন্ন করা যায়।
৪. চীনা গতিবিধি সূক্ষ্মভাবে নিরূপণ করার লক্ষ্যে গােয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করতে হবে, যাতে করে চীনা পক্ষ কোনাে পদক্ষেপ নিলে ত্বরিত গতিতে যথাযথ মার্কিন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা যায়।
সমীক্ষায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিষয়ে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখার প্রস্তাব দিয়ে বলা হয়,
ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করলে তার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানাে। দিল্লির
পৃষ্ঠা: ১৪৯
ওপর আমেরিকার চাইতে সােভিয়েত প্রভাব রয়েছে অনেক বেশি এবং সেজন্যই ভারত-পাকিস্তান বিবাদ নিরসনে সােভিয়েত সাহায্য কামনা করা যায়। ১৯৬৬ সালের তাসখন্দ কনফারেন্সের পর থেকে সােভিয়েত ইউনিয়ন অব্যাহতভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তিরক্ষকের ভূমিকা পালন করে আসছে, যদিও তাদের মূল স্বার্থ হলাে ভারতকে সহযােগিতা করা। সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত ডব্রিনিন ২৬ মার্চ পাকিস্তানি ঘটনা সম্পর্কে সেক্রেটারিকে অবহিত করেছিলেন এবং আমেরিকার পরিকল্পনা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিলেন। কাজেই এখন অনায়াসে যুদ্ধাবস্থায় আমেরিকা সােভিয়েত পরিকল্পনা সম্পর্কে তত্ত্বতালাশ করতে পারে। ইত্যবসরে পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশ বিভেদ নিরসনে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানেও শান্তিরক্ষকের ভূমিকায় সােভিয়েত ইউনিয়নকে প্রবৃত্ত হতে অনুরােধ জানানাে যায়। সােভিয়েত যে শুধু জাতিসংঘের শান্তি ও ত্রাণকার্যেই ভূমিকা পালন করতে পারে তা নয়, ভারতে আশ্রয় নেয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নেও তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
নিক্সন, কিসিঞ্জার ও ফারল্যান্ডের সংলাপ
নিক্সন ; বাইরে প্রচুর নেতিবাচক ক্যাম্পেইন চলছে। আমি বুঝি না তােমরা সবাই একসঙ্গে কেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। দেখেছাে, কিটিং লবি করছে। ইন্ডিয়ানদের জন্য। তার কি পাকিস্তানের পক্ষে কিছু ভালাে বলা উচিত ছিল না?
ফারল্যান্ড : আমি পারি…।
নিক্সন ; এতে কি কাজ হবে?
কিসিঞ্জার : আমার মনে হয়, হবে।
ফারল্যান্ডঃ আমি বুঝি। আমি একটু লাে প্রােফাইল মেন্টেইন করছিলাম। কারণ আমি চাইনি চীন সফরের ওপর আমার কাছে কোনাে প্রশ্ন আসুক।
নিক্সন : ওহ্। তা তুমি বললেই পারাে এ ব্যাপারে তুমি কিছু বলবে না।
ফারল্যান্ড : সকালে আমার সঙ্গে চাক পারসি ও ফ্র্যাংক কিলােগের দেখা হয়েছিল। সবাই জিজ্ঞেস করছিল আমি কোথায়। আমি কেন কমিটির সামনে গিয়ে বক্তব্য রাখছি না। আমি বলেছি, আমি জানি না… (অস্পষ্ট)। আশা করছিল আমি তার কমিটির সামনে হাজির হবাে। আমি স্টেট ডিপার্টমেন্টের চার্লস ব্রে-কে বলেছি শুক্রবার বিকেলে আমি প্রেসের সামনে একটা ব্যাকগ্রাউন্ডার দেবাে।
নিক্সন : গুড।
কিসিঞ্জার : শুনানির চাইতে ব্যাকগ্রাউন্ডার ভালাে।
নিক্সন : গুড। প্রেস ব্যাকগ্রাউন্ডার বেশি পছন্দ করে।
ফারল্যান্ড : আরেকটা ব্যাপার। আমরা যদি ইয়াহিয়া খানকে বেশি জবরদস্তি করি, তা হলে গােটা উপমহাদেশের সমস্যা হবে। অর্থাৎ, সে ফাইট
পৃষ্ঠা: ১৫০
করবে। সে যদি সত্যি সত্যি ফাইট করে তা হলে আমরা জমানার সবচাইতে খারাপ অবস্থাটা দেখতে পাবাে। চীন আসামের ওপর দিয়ে চলে আসবে। অন্যদিকে মিন্টকা পাসের ভেতর দিয়ে তারা কাশ্মীরে এসে গেরিলা উৎপাত শুরু করবে। চারদিক ঘিরে ফেলবে ওরা। ইন্ডিয়াও হট্টগােল কম বাধাবে না। অত্যন্ত খারাপ সময় এসে যাবে।
নিক্সন : আমাদের অবস্থান কী হবে বলে মনে করাে?
ফারল্যান্ড : আমরা এখন যেটা করছি সেটাই ভালাে। মি. প্রেসিডেন্ট, আমরা সেই ৭১২ সালে ফিরে যাচ্ছি, মুসলিমরা যখন সিন্ধু আক্রমণ করে। এর পর থেকে উপমহাদেশে কোনােদিন শান্তি আসেনি। কারণ হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কমন কিছু নেই। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ইমােশােনাল, বিশ্বাস, সব দিক দিয়ে তারা আলাদা। একজন শত মূর্তির পূজা করে, আরেকজন এক এক আল্লায় বিশ্বাস করে। একজন গরুর পূজা করে, আরেকজন গরু খায়। গত বছর ইন্ডিয়ায় ৫২১টা সাম্প্রদায়িক রায়ট হয়েছে।
নিক্সন : মিজারেবল ড্যাম প্লেস।
কিসিঞ্জার : আমার ট্রিপের সময় আমি বুঝেছি ইন্ডিয়ানরা আসলে কী চায়। তাদের চিন্তা হলাে একমাত্র বাংলাদেশ… (অস্পষ্ট)। তারা জানে তারা পূর্ব পাকিস্তানে ওদের নিচু করতে পারে, তা হলে পশ্চিম পাকিস্তানে ওরা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে, গােটা পাকিস্তানই ভেঙে যাবে। ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান পরস্পরকে ঘৃণা করে।
নিক্সন : ও শিওর। এটাই ওদের (পাকিস্তানের) ভয়… (অস্পষ্ট)। খারাপ দিক হলাে যে তােমরাও এটাই মনে করাে। তােমাদের কি মনে হয় ইয়াহিয়া ফাইট করবে?
ফারল্যান্ড : অবশ্যই।
নিক্সন : সে সুইসাইড করতে যাচ্ছে।
কিসিঞ্জার : আমি সম্পূর্ণ একমত। সে লড়াই করবে। ঠিক যেভাবে লিংকনকে লড়াই করতে হয়েছিল। তার কাছে পূর্ব পাকিস্তান হলাে পাকিস্তানের অংশ… (অস্পষ্ট)।
নিক্সন : হরিবল স্লটারস?
ফারল্যান্ড : স্বীকৃত সংখ্যা হলাে ৫ লাখের ওপরে। বেশিরভাগ লােক বিশ্বাস করে ১০ লাখের বেশি। দেড় কোটি রিফুজি।
নিক্সন : আসলে সবকিছুরই দুটি দিক আছে… (অস্পষ্ট)।
ফারল্যান্ড : তারা (ইন্ডিয়ানরা) প্রপাগান্ডার ওস্তাদ। পাকিস্তানিরা না। পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়ার প্রসঙ্গে…।
পৃষ্ঠা: ১৫১
নিক্সন : উহ হু।
ফারল্যান্ড : ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানে ২২০০ রাউন্ড পয়েন্ট ২২ গুলি সারভাইভাল রাইফেলের জন্য পাঠানাে হয়েছে। ব্যস এই পর্যন্তই।
নিক্সন : ভালাে, বেশ ভালাে।
ফারল্যান্ড : সাহায্যের (প্রতিশ্রুত) ৪০ ভাগ হলাে ট্রাক ও অন্যান্য যােগাযােগযন্ত্রের খুচরা অংশ যেগুলাে ছাড়া ভুখা রিফুজিদের খাওয়ানােও যাচ্ছে
নিক্সন : ভালাে, খুব ভালাে। আমাদের আর সিচুয়েশন খারাপ না করাই উচিত। দেখা যাক সমস্যা সমাধানের জন্য কী করা যায়। তবে এ নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া না করাই ভালাে। অন্যথায় রক্তগঙ্গা বইবার আশঙ্কা আছে।
ফারল্যান্ড : ইয়াহিয়া আমাকে বলেছে তারা ইন্ডিয়ার ভেতরে ২৯টা ক্যাম্প চিহ্নিত করেছে যেখানে গেরিলাদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। আমি বলতে চাই না, তবু বলছি, গেরিলাদের হামলা জোরদার হচ্ছে। প্রত্যেক দিন গড়ে ১৮ জন করে পাকিস্তানি সৈন্য মারা যাচ্ছে। দিনে ২টা করে ব্রিজ ভেঙে পড়ছে। রিফুজিরা ফেরত যেতে চাইলেও তাদের বাধা দেয়া হচ্ছে। ইন্দিরার নিজের বিবৃতিতে আছে, তিনি তাদের ফিরে যেতে মানা করছেন। তার মতে, রাজনৈতিক সমস্যার একমাত্র সমাধান হলাে বাংলাদেশ, ব্যস।
নিক্সন : আমার পরামর্শ, নিজেদের লাইনে আমাদের ঠিক থাকতে হবে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্যুরােক্রেসিকে সামলাতেই আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারা সবাই বেসিক্যালি প্রাে-ইন্ডিয়ান। তারা বলতে বেশিরভাগ। আমেরিকান প্রেস যা বলে তারা তাই বিশ্বাস করে। আবার তারা যা বলে আমেরিকান ও ইন্ডিয়ান প্রেস তা-ই লেখে।
পৃষ্ঠা: ১৫২
সপ্তম অধ্যায়
বাংলাদেশের স্বাধীনতা
১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এ আই ডি (এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট) সেক্রেটারি রজার্সের কাছে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। রিপাের্টে সমসাময়িক রিলিফ তৎপরতা ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এ আই ডি-র পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়।১
এতে বলা হয়,
ত্রাণ ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করতে গিয়ে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক প্রশাসন শিথিল করে বেসামরিক প্রাধান্য বাড়াবার পদক্ষেপ নিয়েছেন। সে ভিত্তিতে এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘােষিত বেসামরিক ধারণার সুবাদে সামগ্রিক প্রশাসন ব্যবস্থা দুই ভাগে ভাগ করে সামরিক প্রশাসন প্রধান সামরিক প্রশাসকের হাতে রেখে ড. এ এম মালিককে একজন বিশ্বাসী ও অনুগত বাঙালি হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের পদে মনােনীত করেছেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অবশ্য প্রকাশ্যে দাবি করছেন যে, শরণার্থীরা আর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যাচ্ছে না। তিনি বলেছেন, সীমান্তে প্রহরা বসানাে হয়েছে এবং তারা শরণার্থীদের গমনে ও মুক্তিযােদ্ধাদের অনুপ্রবেশে বাধা দিচ্ছে। টিক্কা খান অবশ্য স্বীকার করেছেন যে সীমান্তের অনেক জায়গায় সেনাবাহিনীর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বহাল করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীন ভেরিফিকেশন ছাড়া দুই পক্ষের পরস্পরবিরােধী বক্তব্যের সঠিকতা নির্ণয় করা কঠিন। ভারত বলছে শরণার্থীর সংখ্যা ৮০ লাখের বেশি, পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের হিসেবে তা ২৫ লাখের বেশি হবে না।
রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এখন পর্যন্ত কোনাে কর্মপন্থা স্থির করেননি। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ইয়াহিয়ার মনােভাব এখন পর্যন্ত বিচার বিভাগ সংক্রান্ত বিষয়। তিনি বলছেন, যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কোনাে অভিযােগ নেই তারা ফিরে আসতে পারেন এবং নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে যে তাদের বিচার করা হবে না। এখন পর্যন্ত সাধারণ পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত
পৃষ্ঠা: ১৫৩
৮৮ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৯৪ জন সদস্যকে ফৌজদারি অভিযােগ নেই বলে ছাড় দেয়া হয়েছে। তবে অন্য সকল আওয়ামী লীগার ও রিফুজিদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ও দায়মুক্তির বিষয়টি এখনাে অস্পষ্ট।
সাধারণ পরিষদের ৮৮ জন সদস্যের মধ্যে, ইয়াহিয়া খান বলেছেন, কেবলমাত্র ১৬ জন ঢাকায় সামরিক রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছেন। এদের মধ্যে একজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের ওপর আরােপিত অবৈধ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ৮৮ জনের মধ্যে বাকীদের ফিরে আসায় অনুপ্রাণিত করার জন্য পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানালে ইয়াহিয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগারদের কনসেশন দেয়ার ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা যতটুকু নমনীয় হবার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি ততটাই করেছেন।
শেখ মুজিবের ওপর সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি হলাে, গােটা ব্যাপারটি বিচার বিভাগের হাতে সমর্পন করা হয়েছে এবং বিচার বিভাগই মুজিবের জন্য নিরপেক্ষ বিচারের ব্যবস্থা করবে। ইয়াহিয়া বলেছেন, বিচারের জন্য শেখ মুজিবের পক্ষে। একজন দক্ষ, যােগ্য ও স্বাধীন কৌসুলি দেয়া হবে। ইয়াহিয়া এ ব্যাপারে স্থির নিশ্চিত যে মুজিব একজন অপরাধী। তিনি বলেছেন, দুটি অ্যাসেম্বলি থাকতে পারে। দুটি এখানে এবং দুটি ওখানেও থাকতে পারে। কিন্তু তারা পাকিস্তানের পতাকাও ছিড়ে দুটি পতাকা করে ফেলবে, সেটি হতে দেয়া হবে না।
বাঙালি বন্ধু ও সহকর্মীরা জানাচ্ছেন, মুজিবকে হত্যা করলে আরেক দফা পূর্ব পাকিস্তান থেকে গণভিত্তিতে শরণার্থী যাওয়া শুরু হবে। ইয়াহিয়ার কাছে অবশ্যই এ তথ্য পৌঁছানাে হয়েছে। এর ফলে ধারণা করা হচ্ছে যে জীবিত মুজিবের চাইতে মৃত মুজিব পাকিস্তানের ঐক্যের জন্য অনেক বেশি বিপজ্জনক।
পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুবিরােধী মনােভাব আরাে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের আক্রমণ তীব্রতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার বাড়বে। জেনারেল রহিম খান বলেছেন এ যাবৎ ২০০ স্থানীয় নেতা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। এর ফলে গ্রামীণ এলাকায় প্রশাসনকার্যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সরকার এখন গ্রামের অশিক্ষিত কিন্তু হিন্দুবিরােধী যুবকদের ধরে ভয়ভীতি দেখিয়ে ও ইসলামে প্রলুব্ধ করে অনিয়মিত সৈন্য হিসেবে ট্রেনিং দিতে চাচ্ছে… যাতে করে তারা নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করতে পারে। তবে এই তৎপরতা কেবল সীমান্তের পূর্ব পাকিস্তান অংশেই সীমিত।
নিক্সন, কিসিঞ্জার, ক্রোমার ও ডগলাস-হােমের সংলাপ
১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, কিসিঞ্জার, ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি ডগলাস-হােম এবং লন্ডনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্রোমারের মধ্যে এক
পৃষ্ঠা: ১৫৪
আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে তখন মুক্তিবাহিনী মহাদাপটে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে এবং গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযােগিতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিগুলাের ওপর ঝটিকা আক্রমণ চালাচ্ছে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান তখনাে নির্বিকার, বরং দাবি করছেন যে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সীমান্তে শরণার্থীদের স্রোত তখন কিছুটা মন্দীভূত হয়ে এলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে শরণার্থীরা ইয়াহিয়ার প্ররােচনায় প্রলুব্ধ ও আশ্বস্ত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে গেলেও আবার হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
ডগলাস-হােম : ভারতের বিষয়টি অত্যন্ত সিরিয়াসলি নিয়েছি। গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। রিফুজির সংখ্যা এখনাে প্রতি সপ্তাহে ৪ হাজার করে বাড়ছে। গত তিন সপ্তাহে ১১ বার পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণসামগ্রীর চালান গিয়েছে। তবে আমাদের একটি শিপিং লাইন এখন পূর্ব পাকিস্তান ও চট্টগ্রামে যেতে চাচ্ছে না। জাতিসংঘ কীভাবে কাজ করবে বুঝতে পারছি না। গেরিলাদের কার্যক্রম চলতে থাকলে কোন কিছু সম্ভব নয়।
নিক্সন : হুম।
ডগলাস-হােম : আমরা যা করার করছি। আপনিও চেষ্টা করুন যাতে ইয়াহিয়া খান তাড়াতাড়ি গর্ত থেকে বের হয়ে আসেন। অবশ্য তিনি বাংলাদেশের লােকজনের সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। তা হলে ভারতে থাকা কিছু তােরও সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। এখন তিনি যাদের সঙ্গে কথা বলছেন তাদের কোনাে দাম নেই। এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে।
কিসিঞ্জার : (অস্পষ্ট)।
ডগলাস-হােম : ইয়েস।
কিসিঞ্জার : কোলকাতায় বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ আছে। আমরা বাংলাদেশের লােকজন ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে ভারতের বাইরে একটা মিটিংয়ের চেষ্টা করেছি। ইয়াহিয়া তাতে রাজি আছেন। ভারতীয়রা তা চাইছে না। তারা অনেক জটিল আচরণ করছে। তারা চাচ্ছে প্রতিটি জিনিস আমরা তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করে স্থির করি। তারা এমন সব দাবি তুলছে তা মানা কঠিন।
ডগলাস-হােম : খুবই খারাপ খবর।
কিসিঞ্জার : তারা খাদ্য ঘাটতি এলাকায় সরবরাহ লাইন ছিন্ন করে দিচ্ছে। আমরা বারবার বলছি যে খাদ্যবাহী জাহাজগুলােতে সৈন্য বহন করা হবে না— আমাদের চেষ্টা যাতে রিফুজিদের সংখ্যা কমে আসে। কিন্তু ওরা সহযােগিতা করছে না।
পৃষ্ঠা: ১৫৫
ডগলাস-হােম : (অস্পষ্ট)।
নিক্সন : আসলে ইন্ডিয়ানরা হলাে হিপােক্রিট এবং বকধার্মিক। এতে সন্দেহ নেই যে ইয়াহিয়া খুব স্টুপিডের মতাে সবকিছু হ্যান্ডেল করছে। সে লােক হিসেবে ভালাে, কিন্তু এবার স কিছু সামলাতে পারেনি। এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশ হয়ে যাবে—পাকিস্তান ছিড়ে-ফুঁড়ে বের হয়ে আসবে। কিন্তু ইন্ডিয়ানরা এমন খেলা খেলছে যা ভালাে হচ্ছে না। মনে হয় তারা সমঝােতাহওয়ার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছে। সমঝােতা না হলে কী অবস্থা দাঁড়াবে তারা যা করছে এখন তা হজমও করতে পারছে না। কীভাবে ওরা দেশটিকে নিয়ন্ত্রণ করবে? সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলাে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সুইসাইডাল মনােবৃত্তি নিয়ে চূড়ান্তভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
ডগলাস-হােম : কাশ্মীরে?
নিক্সন : অবশ্যই।
কিসিঞ্জার: আজ একটা গােয়েন্দা রিপাের্ট পেয়েছি। তারা কাশ্মীরে যাওয়ার চিন্তা করছে, ফরেন সেক্রেটারি বলেছে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
নিক্সন : আমরা কী করতে পারি?
কিসিঞ্জার : আমরা ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে একদম ব্যর্থ হইনি। কারণ বাংলাদেশের লােকেরা কথা বলতে সত্যিই আগ্রহী।
নিক্সন : সত্যি?
কিসিঞ্জার : হ্যা। তবে তারা প্রথমে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টা ফয়সালা করতে চায়। স্বায়ত্তশাসন মানে স্বাধীনতা। অন্য কোনাে রাস্তায় তারা যাবে না। ইন্ডিয়ানরাও এখনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবি করছে। হঁ্যা, ইয়াহিয়া কখনােই তাতে রাজি হবে না। দরকার হলাে একটা ফেস সেভিং ফরমুলা ও অন্তর্বর্তীকালীন সময়।
ডগলাস-হােম : মিসেস গান্ধী খুব জলদিই আসছেন।
নিক্সন : তােমার সঙ্গে দেখা করতে?
ডগলাস-হােম : লন্ডনে যাত্রাবিরতি করেছিলেন। আবার আসবেন।
নিক্সন : এবং এর পর এখানে আসবেন। তাই না? কিসিঞ্জার : নভেম্বরে আসার কথা।
নিক্সন : আমি ব্যাপারটা গ্রোমিকোর সঙ্গে তুলেছিলাম। এবং আমি ছিলাম তার সঙ্গে খুবই কড়া। আমি বলেছি, যদি যুদ্ধ বাথেধ… আমরা কোনাে যুদ্ধ চাই না। আমরা ইন্ডিয়ানদের উৎসাহিত করলে পাকিস্তান ভাববে… এবং গ্রোমিকোও বলেছে (ইন্দিরার কাছে) মস্কোতে এ ব্যাপারটি জানানাে হয়েছে।
নিক্সন : অবশ্য সে সত্য কথা বলেছে কি না বুঝতে পারিনি।
পৃষ্ঠা: ১৫৬
কিসিঞ্জার : ইন্ডিয়ানরা এখন গেরিলাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছে এবং চাচ্ছে… (অস্পষ্ট… তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে)।…ইন্ডিয়ানরা যদি আসলেই পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার সমাধান করতে চায় সেটা সমাধানের যােগ্য। কিন্তু তারা চায় পূর্ব পাকিস্তানকে ব্যবহার করে পাকিস্তানকে ভাঙতে…। আর ইয়াহিয়ার দরকার রাজনৈতিক বাস্তবতা। আমার সঙ্গে (চীন যাওয়ার পথে) ওর লম্বা কথা হয়েছিল। সে খুব ব্রাইট না, কিন্তু চেষ্টা করেছে।
নিক্সন : সে একজন ভালাে লােক।
কিসিঞ্জার : অটোনমির জন্য ওর একটা ফেস সেভিং ফরমূলা দরকার।
ডগলাস-হােম : রাইট। কিসিঞ্জার কালচারের ডিফারেন্স ও লােকজনের মনােভাব বিবেচনা করলে—অটোনমিই হলাে একমাত্র জবাব। অন্য কোনাে রাস্তা নেই।
ডগলাস-হােম : ঠিক।২
সংকটাপন্ন অবস্থায় পাক সরকার
৪ অক্টোবর ১৯৭১ পাকিস্তানে মার্কিন দূতাবাস থেকে ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়। ঢাকা, করাচি ও লাহােরের দূতাবাস এবং পেশােয়ারের কনসাল জেনারেলের পাঠানাে রিপাের্টের ভিত্তিতে তৈরি এই প্রতিবেদনের কপি পাঠানাে হয় ওয়াশিংটন ডিসি, আমেরিকার কনসাল বােম্বে, কোলকাতা ও ঢাকা, কাবুলে মার্কিন দূতাবাস, করাচিস্থ দূতাবাস, কাঠমাণ্ডু দূতাবাস, কন্সাল লাহাের, মাদ্রাজ ও অ্যাসেম্বলি লন্ডন, দিল্লি, তেহরান, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অফিস ও জেনেভা মিশনে।৩
রিপাের্টে বলা হয়,
পাকিস্তান সরকারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনের প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাব দেশের ভেতরে বিশৃঙ্খলা থামানাে, মুক্তিবাহিনীকে দমানাে এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি মার্চের পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তান সরকারের বেসামরিক প্রশাসন নিয়ােগ ও নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি কোনাে কাজ দেয়নি। জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর পাক-বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন অব্যাহত রেখেছেন। সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার মতাে লােক দেখানাে কর্মসূচিতে কোনাে কাজ হয়নি। মুক্তিবাহিনী ক্রমশ তাদের হামলা জোরদার করছে এবং আগামী মাসগুলােতে তা আরাে অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে নিরাপত্তা নেই বললেই চলে, তবে ঢাকা শহরের পরিস্থিতি আগের মতােই শান্ত।
ইয়াহিয়া খান ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে নির্বাচন দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করতে চাইছেন। মনে হচ্ছে নির্বাচনের পরপরই সংসদের অধিবেশন আহ্বান
পৃষ্ঠা: ১৫৭
করা হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করে পিপলস পার্টির বিকল্প শক্তি দাঁড় করানাের প্রচেষ্টা নেয়া হবে। তবে মুসলিম লীগগুলােকে একত্রিত করে এ ব্যবস্থা নেয়ার প্রাথমিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই মুসলিম লীগ একত্রীকরণের প্রচেষ্টা পূর্ব পাকিস্তানে এখনাে সম্ভাবনাপূর্ণ। ঢাকায় নির্বাচনপূর্ব তােড়জোর লক্ষ করা যাচ্ছে, যদিও পাকিস্তান সরকার কতটুকু অবাধ নির্বাচন দেবে সে ব্যাপারে এখনাে সন্দেহ রয়েছে। মুক্তিবাহিনীর আঘাত নির্বাচনকে কোনদিকে টেনে নিয়ে যাবে সেটাও একটা বিবেচনার বিষয়।
পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক দ্বন্দ্ব একটা মােটামুটি প্যাটার্ন নিয়েছে। তবে তার ঠিক লক্ষ্য-নিশানা এখনাে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের সামরিক যানবাহনগুলাে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছে, সমুদ্রগামী জাহাজের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রের হামলা চালাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের দু’টি সমুদ্রবন্দরেই। পূর্ব পাকিস্তানের একজন মন্ত্রী এবং পূর্ব পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের একজন নেতার ছেলের ওপর মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাণঘাতী হামলা সফল হয়নি।
ঢাকার কন্সাল জেনারেল রিপাের্ট করছেন যে মুক্তিবাহিনী বিশেষ করে ঢাকা, নােয়াখালী, কুমিল্লা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ এবং সিলেটে অসংখ্যবার হামলা চালিয়েছে এবং ঢাকার গ্রামাঞ্চলে হামলা জোরদার করেছে। কন্সাল জেনারেল আরাে জানাচ্ছেন যে, যশাের ও দিনাজপুরে লড়াই চলছে এবং খুলনা। ও রংপুরের অনেক এলাকা এখন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। চট্টগ্রাম, বরিশাল, পটুয়াখালীতেও নিম্নস্তরের মুক্তিবাহিনীর অ্যাকশন চলছে।
সামরিক আইন প্রশাসক নিয়াজীর নির্দেশ সত্ত্বেও গ্রাম ও বাজারে পাকবাহিনীর অগ্নিসংযােগ এবং মুক্তিবাহিনীর নির্বিচার প্রতিশােধ প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। ঢাকা থেকে বলা হচ্ছে যে কন্সাল জেনারেল বিক্ষিপ্ত রিপাের্ট পাচ্ছেন, বিশেষ করে ময়মনসিংহ থেকে, যে সেনাবাহিনী হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। পাকিস্তান সরকার দাবি করছে যে তারা সীমান্তের কাছে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি হামলা প্রতিহত করেছে। সীমান্ত এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে বােমাবর্ষণের ঘটনা ঘটছে।
গুজব শােনা যাচ্ছে যে অক্টোবর মাসে মুক্তিবাহিনী বড় ধরনের হামলা চালাবে। এর মধ্যে ভারতীয় ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং শেষ হয়ে গেলে এবং বর্ষার বেগ কমে এলে উভয়পক্ষের যােগাযােগের প্রবণতা বাড়লে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে লড়াই আরাে জোরদার হবে। পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক আইন। প্রশাসন পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিবাহিনীর হামলার ব্যাপারে সম্পূর্ণ অবহিত। কিন্তু তা প্রতিহত করতে সক্ষম এমন কোনাে জোরদার সামরিক প্রস্তুতি পূর্ব
পৃষ্ঠা: ১৫৮
পাকিস্তানে লক্ষ করা যাচ্ছে না। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বর্তমান পাক-ভারত উত্তেজনার মুখে সতর্কাবস্থায় রয়েছে।
ঢাকার কন্সাল জেনারেল বলেছেন, মুক্তিবাহিনীর হামলার ফলে দুটি বিষয় বিবেচ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকটাপন্ন অবস্থা এবং উভয়পক্ষের প্রতিশােধপ্রবণতা সত্ত্বেও জনগণ কতদিন মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন দেবে এবং মুক্তিবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিক কোনাে অবকাঠামাে গড়ে তুলতে পারবে কি না। এমন একটা ধারণা দেয়া হচ্ছে যে, ঢাকায় শহুরে বুর্জোয়া শ্রেণী (যেখান থেকে মূলত আওয়ামী লীগের জন্ম) ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনের পথ খুঁজছেন। তবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি তাদের ঘৃণাবােধ এখনাে অব্যাহত। গ্রামাঞ্চলের জনগণ তাদের ক্ষুধা-দারিদ্র মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে দ্বিধাবােধ করছেন না। মুক্তিবাহিনী এখনাে জনগণের পুরােপুরি সমর্থন ও সহযােগিতা পাচ্ছে বলে ঢাকার ধারণা।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ফরিদপুর জেলায় মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি বাঙালিদের সমান্তরাল বেসামরিক প্রশাসনিক গড়ে উঠেছে। নােয়াখালীর স্থানবিশেষে মাওবাদী কমিউনিস্ট গ্রুপের বেসামরিক আধিপত্যেরও খবর পাওয়া গেছে। মাওবাদী তােয়াহা গ্রুপ সেখানে সক্রিয়। পাকিস্তান বাহিনী সীমিত শক্তি নিয়ে অবস্থান করছে বা পুরােপুরি অনুপস্থিত এমন কয়েকটি জায়গায় একই ধরনের বেসামরিক কাঠামাে প্রস্তুত হয়েছে। কন্সাল জেনারেল রিপাের্ট করছেন। যে, বেসামরিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক গভর্নর নিয়ােগ, বহুদলীয় মন্ত্রিপরিষদ, সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা, উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা কিংবা ইয়াহিয়া খানের সংবিধান সংশােধনীসংক্রান্ত প্রস্তুতি কোনােটাই এখনাে পূর্ব পাকিস্তানি সরকারি অফিসারদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সামান্য ব্যতিক্রম বাদ দিলে পূর্ব পাকিস্তান সরকার এখন পর্যন্ত মার্চ-পূর্ব পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারেনি। গ্রেফতার অব্যাহত থাকায় দেশের জনগণ সাধারণ ক্ষমা ও পরিচিত কিছু লােককে ছেড়ে দেয়ার পরেও স্বস্তি অনুভব করছে না। গভর্নর মালেক এবং তার কেবিনেট পাকিস্তানিদের পা চাটা বলেই মানুষের ধারণা। তবে উপনির্বাচনের প্রস্তুতি ১৯৭০ সালে যারা পরাজিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে।
করাচি ও লাহােরের কন্সাল জেনারেলদের মতে, পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রয়েছে। শহুরে পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বালুচিস্তানের গ্রামীণ এলাকায় কিছুটা উত্তেজনা থাকলেও তা মারাত্মক কিছু নয়। লাহােরে জনগণের মধ্যে ভারতের সম্ভাব্য হামলার ব্যাপারে কিছুটা অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
পূর্ব পাকিস্তানে দুই মুসলিম লীগ একীকরণের ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে। পাকিস্তান মুসলিম লীগের লিডার কাইউম অচিরেই একীকরণের জন্য ঢাকা
পৃষ্ঠা: ১৫৯
যাচ্ছেন, যা তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে করতে পারেননি। পাকিস্তান সরকার চাপ দিলে পি ডি পি সহ অন্যান্য দলগুলাের সমন্বয়ে ইউনাইটেড ফ্রন্ট গঠনের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। পশ্চিম পাকিস্তানের মতাে পূর্ব পাকিস্তানেও নেতাদের পরস্পরের মধ্যে ব্যক্তিগত বৈরিতা অনেক বেশি, যার ফলে সবগুলাে ডানপন্থী দল মিলিয়ে একটি কোয়ালিশন গঠনের সম্ভাবনা ক্ষীণ, বলতে গেলে এক রকম অসম্ভব। পি ডি পি এবং জামায়াত হয়তাে মনে করছে যে নির্বাচন অবাধ হলে তারা ভালাে ফল করতে পারবে। কাজেই হেরে যাওয়া মুসলিম লীগের সঙ্গে সখ্যতা বন্ধনে তাদের তেমন কোনাে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। যে কোনাে অবস্থাতেই হােক, পি ডি পি ও জামাত বলেছে যে তারা ভুট্টোর পিপলস পার্টির সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেবে।
কিসিঞ্জার ও রজার্স টেলিফোন সংলাপ
মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট উইলিয়াম রজার্স ২০ নভেম্বর হেনরি কিসিঞ্জারকে টেলিফোন করে পাক-ভারত-বাংলাদেশ পরিস্থিতির সার্বিক দিক নিয়ে আলােচনা করেন।৪
(সকাল ১০টা ৫৫)
কিসিঞ্জার : জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের সঙ্গে সকালে আমার কথা হয়েছে। খুব সম্ভবত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কথা বলতে। চান না, কারণ তিনি ঘােষণা দিয়ে মিটিংয়ে বসতে চান না। ব্যাপারটি ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানকে নিয়ে। ব্রান্ট জানতে চেয়েছিলেন আমাদের মনােভাব কী। আমি বলেছি আমরা যুদ্ধ থামাতে চাই। তিনি ইউ এন’র কথা বলাতে আমি বলেছি। ঘটনাটি জাতিসংঘে গেলে আমরা সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেব এবং রিফুজিদের সরাবার সুযােগ দেব।
রজার্স : খুব ভালাে। প্রেসিডেন্ট কী চান?
কিসিঞ্জার : উনি বললেন ঠিক আছে। আমি বলেছি ভারতের মিত্ররা এটা ভালােভাবে নেবে না। ওরা পাকিস্তানকে থামাতে চাইবে।
রজার্স : অবস্থা এমন চলতে থাকলে জাতিসংঘই হবে একমাত্র ভরসা।
কিসিঞ্জার : তার মানে পাকিস্তানকে ছিড়ে ফুড়ে খেয়ে ফেলবে।
রজার্স : যুদ্ধ না থামালে তাই হবে।
কিসিঞ্জার : ইন্ডিয়ানরা এখন বেপরােয়া।
রজার্স : আমার মনে হয় জাতিসংঘে পাকিস্তান ইণ্ডিয়ার চাইতে ভালাে করবে। অবশ্য এ ছাড়া পাকিস্তানের কোনাে গতিও নেই।
কিসিঞ্জার : আর একদিনও যুদ্ধ চললে আমি জাতিসংঘে যাবার পক্ষপাতি।
রজার্স : কিন্তু আমরা কোনাে উদ্যোগ নেব না।
পৃষ্ঠা: ১৬০
কিসিঞ্জার : না, অন্য কেউ।
রজার্স : আমার মনে হয় আমাদের অবস্থান ভালাে। আমরা দু’পক্ষকেই অস্ত্র সংবরণ করতে বলেছি। মানবিক সাহায্য দিচ্ছি। ইয়াহিয়ার পজিশন মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর চাইতে ভালাে। ইন্দিরা কোনাে ইউ এন রিপ্রেজেন্টিটিভ গ্রুপ চান না। ইয়াহিয়া চান। কাজেই তিনি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। অবশ্য এটাই হলাে তার একমাত্র করণীয়।
কিসিঞ্জার : ইউ এন ও চিনাকে যারা সাহায্য করেছে তাদের অপদস্থ করা সােভিয়েতের একটা কৌশল।
রজার্স : আর মনে হচ্ছে এতে ওরা সফলও হয়েছে।
কিসিঞ্জার : আমার মনে হয় আমাদের মিলিটারি পাইপলাইন বন্ধ করে দিতে হবে।
রজার্স : শুধু তাই যথেষ্ট হবে না। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক চলছে ইন্টেলিজেন্স সুবিধার কারণে। আমরা এক সময় যদি মনে করি সেটা এত গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা হলে ইন্ডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেব। এতে সামরিক কোনাে হেরফের অবস্থা হবে না, তবে আমাদের ওপর নজর পড়বে। গােলাবারুদ সাপ্লাই বন্ধ হবে, তবে রাডার ইকুইপমেন্টের ব্যাপারে আরাে তলিয়ে দেখতে হবে।
কিসিঞ্জার : আমরা যদি ইন্ডিয়াকে বলি হিউমেনিটারিয়ান ও সামরিক সব। রকম সাহায্য দেব তা হলে কী হবে?
রজার্স : আমাদের সামরিক সরবরাহের ওপর ইন্ডিয়া ভরসা করে না।
কিসিঞ্জার : ইন্ডিয়া আসলে চায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি।
রজার্স : কে বলেছে?
কিসিঞ্জার : গতকাল এক বক্তৃতায় এ কথা বলা হয়েছে।
পরদিন ২৪ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন, সেক্রেটারি রজার্স এবং হেনরি কিসিঞ্জার আবার ইন্দো-পাক পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। আলােচনার বিষয়বস্তু মূলত সীমিত ছিল ইন্দো-পাক সমস্যাকে জাতিসংঘের দিকে ঠেলে দেয়া যাতে কোনাে পক্ষের সঙ্গে বিবাদে না জড়িয়ে আমেরিকা দায়মুক্তি পেতে পারে, আবার একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার একটি রক্তপাতহীন রাজনৈতিক সমাধান হয় ও পূর্ব। পাকিস্তানি শরণার্থীরা নিরাপদে নিজ দেশে ফিরতে পারেন।
আমেরিকা এ সময় অনুভব করতে পারছিল যে পূর্ব পাকিস্তানে পাক-বাহিনীর যে ৬০ থেকে ৭০ হাজার সশস্ত্র সদস্য রয়েছে ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মিলিত শক্তির মুখে ছিল তা নগণ্য এবং লড়াই শুরু হলে পাক-বাহিনী এক ফুঙ্কারে উড়ে যাবে। সীমিত সামরিক সরঞ্জাম এবং আড়াই হাজার মাইলের সীমানা পাকিস্তান বাহিনীকে ইতােমধ্যেই কোণঠাসা করে ফেলেছিল।
পৃষ্ঠা: ১৬১
প্রেসিডেন্ট নিক্সন মনে করেছিলেন যে পাক-ভারত দ্বন্দ্বে ঠিক সেই মুহূর্তে তার করণীয় কিছু ছিল না। পরিস্থিতির মােড় ঘােরাতে মার্কিন প্রভাব কতটুকু কাজ করবে সে নিয়ে তার নিজেরই সন্দেহ ছিল। সামরিক সাহায্য দিয়েও সে মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বাহিনীর সামরিক অবস্থান শক্তিশালী করা সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে ভারত সে মুহূর্তে আর আমেরিকার সাহায্যের মুখাপেক্ষী ছিল না। কাজেই প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশে পাকিস্তান ও ভারত মার্কিন যে কোনাে অস্ত্র সরবরাহের জন্য সরবরাহকারীদের লাইসেন্স বাতিল করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আলােচনার সময় উঠে আসে যে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সম্মিলিত জাতিসংঘের সাহায্য চাওয়া হলে গােটা অবস্থা পাকিস্তানের অনুকূলে যাবে। কারণ, জাতিসংঘ বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে ওঠাবে, সেখানে আলােচনা হবে। সঙ্গত কারণেই জাতিসংঘ পূর্ব পাকিস্তানে একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে এবং পর্যবেক্ষক দলের পর্যবেক্ষণ শেষে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। জাতিসংঘের প্রস্তাব আসতে পারে সাময়িক যুদ্ধবিরতি এবং রাজনৈতিক সমাধানের জন্য জাতিসংঘ বা কারাে মধ্যস্থতায় সমঝােতাধর্মী আলােচনা। ইত্যবসরে পাকিস্তান সরকার তার পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচন, উপনির্বাচন বা সংবিধান সংশােধন সংক্রান্ত বেসামরিক সিদ্ধান্তগুলাে বাস্তবায়িত করার সময় ও সুযােগ পেয়ে যাবে। আলােচনাকালে বলা হয় যে,
ভারত কোনাে অবস্থাতেই এ হেন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘে যেতে চাইছে না। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে ইন্দিরা গান্ধীর কড়া ভাষায় লিখিত এক সাম্প্রতিক চিঠির রেফারেন্স দিয়ে বলা হয় যে, ভারত বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের দিকে ঠেলে দিতে বিশেষভাবে নিষেধ করেছে। চিঠিতে বলে দেয়া হয়েছে যে ভারত উপমহাদেশ এলাকায় জাতিসংঘের কোনাে উপস্থিতি দেখতে চায় না। কোনাে পর্যবেক্ষক দলও দেখতে চায় না।
এতে বলা হয়,
জাতিসংঘে ইয়াহিয়ার শক্তিশালী প্রতিনিধি রয়েছে, যেখানে সে জাতিসংঘের উচ্চ মহলে তদবির করছে। এমনকি ভারত সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে রাজি হলে জাতিসংঘ থেকে সে পাকিস্তানের সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাবও পাশ করিয়ে আনতে পারবে। মােট কথা, নিরাপত্তা পরিষদের যে কোনাে সিদ্ধান্তই আসবে পাকিস্তানের অনুকূলে।
আমেরিকা মনে করে যে, চীন, পাকিস্তান ও ইউরােপের দেশগুলাে সম্মিলিতভাবে জাতিসংঘ সনিরাপত্তা পরিষদের যে কোনাে সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে সক্ষম। পরিষদে উভয়পক্ষকে অস্ত্র সংবরণ করার প্রস্তাব ওঠাতে পারলে ভারত বিক্ষুব্ধ হলেও তাতে ইতিবাচক ফল আসতে পারে। আমেরিকা ধরে নেয় যে, পাক-ভারত বিষয় নিরাপত্তা পরিষদে না ওঠানাের জন্য ইন্দিরা গান্ধীর হুমকিযুক্ত চিঠি আসার অর্থই হলাে অচিরেই ভারত পাকিস্তানে হামলা চালাতে যাচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ১৬২
তারা বলেন,
ইন্দিরা অনবরতভাবে দাবি করে আসছেন যে, ভারতীয় কোনাে সৈন্য পাকিস্তান সীমানায় আগ্রাসন চালাচ্ছে না বা মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দিচ্ছে না। এমতাবস্থায় জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল সেখানে গেলে সবকিছু ফাঁস হয়ে পড়বে। তবে আমেরিকার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ না নেয়ার জন্য সতর্ক থাকার
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আলােচনাকালে বলা হয়,
ভারত যে এ মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে রাজনৈতিক সমাধান চাচ্ছে না তা ঠিক নয়। তারা রাজনৈতিক সমাধান চাচ্ছে, কিন্তু তা হতে হবে বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে। কারণ প্রথমত, ভারত বাংলাদেশকে ভুটানের মতাে একটি দেশ হিসেবে দেখতে চায় এবং পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে সেখানে আফগানিস্তানের মতাে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান আগে থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল সেহেতু তাদের দাবিয়ে রাখা কোনাে কঠিন কাজই হবে না।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা করে ও একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভারত সীমান্তে ব্যাপক হামলা চালায়। পাকিস্তানি যুদ্ধ বিমান উভয় সীমান্তে ভারতীয় আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বােমাবর্ষণ করে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগরতলার ওপরেও ব্যাপক বােমাবর্ষণ করা হয়। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনী প্রবল বিক্রমে প্রথমে প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলে ও পরে বিশেষ করে পূর্ব সীমান্তে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়।
পশ্চিম সীমান্তে ভারতের যুদ্ধ ছিল কমবেশি প্রতিরক্ষামূলক। ভারতের উদ্দেশ্য ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূর্ব পাকিস্তান দখল করে বাংলাদেশের অবস্থান নিশ্চিত করা ও অতঃপর যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করে পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে যার যার অবস্থান বহাল রাখা।
৪ নভেম্বর ওয়াশিংটনে কেবিনেট রুমে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, ইন্দিরা গান্ধীসহ উভয় দেশের নেতাদের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক আহ্বান করা হয়। বৈঠকে দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তৃত আলােচনা চলে। আমেরিকার পক্ষে জোসেফ ও সিসকো এবং ভারতের পক্ষে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ত্রিলােকনাথ কাউল যার যার দেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।৫
সিসকো বলেন যে, ইয়াহিয়া একটি আলােচনা শুরু করতে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন এবং তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে শেখ মুজিবের প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমঝােতা নিয়ে আলােচনা
পৃষ্ঠা: ১৬৩
করতে চান। রাজনৈতিক একটি প্রক্রিয়া শুরু করার স্বার্থে তিনি ভারতকে এই প্রস্তাবে সম্মত হবার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে এ নিয়ে দেনদরবার করা যাচ্ছে না। কাউল বলেন যে বাংলাদেশিরা এ মুহূর্তে স্বাধীনতা ছাড়া দ্বিতীয় কোনাে চিন্তা করতে নারাজ এবং এধরনের আলােচনার প্রয়াস হবে অর্থহীন।
তিনি বলেন, একমাত্র মুজিবের পক্ষেই স্বাধীনতার চাইতে কম কিছু বিষয় নিয়ে আলােচনা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু অবস্থা এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে এখন আর স্বয়ং মুজিবের পক্ষেও পিছু হটা সম্ভব হবে না।
এক পর্যায়ে ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং বলেন যে ইয়াহিয়া রাজি হলে কেউ যদি জেলখানায় গিয়ে এ ব্যাপারে মুজিবের সঙ্গে কথা বলতে চান তা হলে এর শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য শেষ চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু অন্য সকলে এর সম্ভাব্যতা নিয়ে কোনাে উৎসাহ দেখালেন না। তাদের মতে শেখ মুজিব রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং তিনি যদি তাদের সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শই করতে না পারেন তা হলে তাকে কোনাে দেনদরবারে বিযুক্ত করার মানেই হয় না।
সিসকো বলেন, ইয়াহিয়া খানকে একতরফা যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়ে সৈন্য প্রত্যাহারেও রাজি করানাে যেতে পারে। কিন্তু কাউল বলেন যে, বাংলাদেশের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা না হলে ভারত কোনাে নিরাপত্তা ঝুঁকি নেবে না। তিনি বলেন, ভারত এখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সমঝােতার মধ্যস্থতা করতে আগ্রহী নয়, তবে পাকিস্তান চূড়ান্ত যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় ভারতও চূড়ান্ত ফলাফল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।
৮ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল নবাবজাদা আগা মােহাম্মদ রাজা বারবার ব্যতিব্যস্ত হয়ে কিসিঞ্জারকে ফোনে ধরার চেষ্টা করেন। কিসিঞ্জারের সঙ্গে রাজার বেলা পৌনে তিনটায় দেখা করার কথা থাকলেও সে বৈঠকের কথা কোনাে কারণে রাজার কাছে পৌঁছানাে হয়নি। এদিকে সেদিন রাজার সঙ্গে নিক্সনের সিনিয়র মিলিটারি এডভাইজার আলেকজান্ডার হেইগের সঙ্গে রাজার বৈঠকের কথা থাকলেও কোনাে কারণে কিসিঞ্জারকে সে কথা জানানাে হয়নি।
রাজা টেলিফোনে কিসিঞ্জারকে বলেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ফারল্যান্ডের মাধ্যমে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে রাজাকে কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন।
কিসিঞ্জার বলেন, রাজা যেন বারবার পাকিস্তানের লােকজনকে গােলাবারুদ চেয়ে টেলিগ্রাম পাঠাতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, আমেরিকা যা করতে পারে তা করছে এবং এ ব্যাপারে সাংকেতিক মেসেজ পাঠানাে হবে। তিনি বলেন, এভাবে অনবরত খােলা মেসেজ আসায় বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন রাজা হেগ এর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি যেন সেখানে পারস্পরিক সামরিক চুক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়ে সরাসরি আনুষ্ঠানিকভাবে সাহায্য চেয়ে পাঠান।
পৃষ্ঠা: ১৬৪
রাজা বােধহয় জানতেনই না যে আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের তেমন দ্বিপাক্ষিক সামিরক চুক্তি রয়েছে এবং তিনি তাতে বিস্ময়ই প্রকাশ করেন।৬
কিসিঞ্জার তাকে পরামর্শ দেন আমেরিকান পক্ষকে যেন বলা হয় যে তারা যেন পরের বছরগুলােতে নেয়া চুক্তির ব্যাখ্যাগুলাে ব্যবহার করেন।
পাকিস্তানকে মার্কিন সামরিক সাহায্য দেয়ার ব্যাপারে ভারত কতটা সংবেদনশীল এবং সচেতন ছিল একটি ঘটনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। ৮ ডিসেম্বর আমেরিকার একটি সামরিক বিমান করাচিতে অবতরণ করে। পরদিন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ ভারতে মার্কিন সামরিক এটাশের কাছে নােট পাঠান। নােটে অভিযােগ করা হয় যে আমেরিকার একটি বিমান সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে করাচি বিমানবন্দরে পাকিস্তানি সামরিক যানে বেশ কিছু সংখ্যক মালামাল আপলােড করেছে। মানেকশ বলেন, পাকিস্তানের জরুরি প্রয়ােজনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামরিক সরঞ্জাম আমেরিকা থেকে পাকিস্তানে পাঠানাে হয়েছে বলে গােয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ ব্যাপারে সামরিক এটাশের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করা হয়।
আমেরিকা মিলিটারি এয়ারলিফট কমান্ড থেকে প্রাথমিকভাবে কনফার্ম করা হয়। যে, আমেরিকার বিমান বাহিনীর একটি সি-১৪১ এয়ারক্রাফট সকাল সাড়ে নয়টায়। করাচি বিমানবন্দরে সত্যি অবতরণ করেছে। অ্যাম্বেসি ফ্লাইট হিসেবে বিমানটি সেখানে ৮ জন যাত্রী ও ৫৩৯ পাউন্ড ব্যক্তিগত ও অ্যাম্বেসি মালামাল খালাস করে। কোনাে মালামাল বা যাত্রী সেখান থেকে ওঠানাে হয়নি। অতঃপর বিমানটি নিয়াদিল্লিতে যায় এবং ৪ জন যাত্রী ও ১৮০০ পাউন্ড মালামাল ও অ্যাম্বেসি সামগ্রী নামিয়ে দেয়। অতঃপর সেখান থেকে বিমানটি যায় থাইল্যান্ডের ব্যাংককে।৭
ভারত ও বাংলাদেশের যৌথবাহিনী সারা দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রক্ষণব্যুহ ভেদ করে যতই রাজধানী ঢাকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, উপমহাদেশের মানচিত্রে পরিবর্তন ততই অত্যাসন্ন হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি বাহিনী তখন মনােবল ও উদ্যম হারিয়ে ফেলে সম্মানজনক পশ্চাদপসরণের পথ খুঁজছে। আমেরিকাও তখন উপলব্ধি করতে পেরেছে যে এ মুহূর্তে পাকিস্তানে শান্তি প্রচেষ্টা বা সমঝােতার প্রচেষ্টা চালিয়ে কোনাে লাভ নেই।
এমতাবস্থায় আমেরিকার সামনে তিনটি করণীয় এসে উপস্থিত হয়। (১) যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান এখন অতীতের বিষয়ের মতাে স্থির হয়ে গেছে, সেহেতু অন্ততপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানকে অক্ষত রেখে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকান নীতিমালা অব্যাহত রাখা, (২) পাকিস্তান ও ভারত উভয়কে যুদ্ধবিরতিতে সাহায্য করে উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বহাল রাখা এবং (৩) যে মুহূর্তে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে সে মুহূর্ত থেকে উপমহাদেশে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির। ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পূর্বাহ্নেই সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
পৃষ্ঠা: ১৬৫
১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড জরুরিভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। তার বর্ণনায় প্রেসিডেন্টকে তখন ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত বলে মনে হচ্ছিল। তবে আপাতভাবে তিনি প্রত্যাশার চাইতে বেশি মানসিক শক্তি দেখানাের চেষ্টা করেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ফারল্যান্ডকে জানান যে, পূর্ব পাকিস্তানে পাক-বাহিনী পিছু হটতে হটতে এখন রাজধানী ঢাকায় এসে জড়াে হয়েছে। এ মুহূর্তে অস্ত্র বিরতির কোনাে ব্যবস্থা করতে না পারলে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক প্রতিরক্ষায় যেতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সার্বিক অবস্থা আগের মতােই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিমান বাহিনী সেখানে চমৎকার নৈপুণ্য দেখাচ্ছে।
ওয়াশিংটন থেকে পাওয়া টেলিগ্রামের বরাত দিয়ে ফারল্যান্ড প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করেন, পূর্ব পাকিস্তানে জেনারেল রাও ফরমান আলী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলেও তার চাইতে কম গূরুত্বপূর্ণ গভর্নর মালিক কীভাবে অন্য ধরনের প্রস্তাব নিয়ে এগুতে চাইছেন? পাক পররাষ্ট্র সচিব সুলতানের দিকে কঠোরভাবে তাকিয়ে ইয়াহিয়া খান বলেন যে, সেখানে কিছুটা ভুল বােঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে।
যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ইয়াহিয়া খান ফারল্যান্ডকে জানান যে, তিনি পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যে কোনাে যুক্তি-তর্ক মেনে নেবেন। পাকিস্তান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে এবং সে প্রস্তাবকে পাকিস্তান যৌক্তিক বলে মনে করে।
১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় আমেরিকার কন্সাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাক ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটে পাঠানাে এক টেলিগ্রামে জানান, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মালিকের অনুরােধে তিনি গভর্নর ও রাও ফরমান আলীর সঙ্গে দেখা করেন। তারা রাজধানী ঢাকায় রক্তপাত এড়ানাের জন্য ঢাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কোনাে একটা ব্যবস্থা করে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে বলেছেন।
ফরমান আলী জানান, পূর্বাঞ্চলে পাক-বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়েছে এবং মাত্র তিন চার দিনের জন্য কোনাে রকমে অবস্থান ধরে রাখতে পারবে। তিনি আর বাইরে থেকে কোনাে সাহায্য আসার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না এবং তার বিবেচনায় এখন সব চাইতে জরুরি হলাে নির্বিচারে রক্তারক্তি বন্ধ করা। ফরমান স্পিভাকের সঙ্গে একমত হন যে, যে কোনাে মূল্যে হাতাহাতি লড়াই বন্ধ করতে হবে।
ফরমান আলী জানতে চান এ মুহূর্তে ওয়াশিংটন, ইসলামাবাদ এবং কোলকাতার সঙ্গে যােগাযােগ করা সম্ভব কি না। ফারল্যান্ড সে ব্যাপারে নিশ্চিত করলে রাও এবং গভর্নর জানান যে তারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধবিরতির সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তার কাছে পাঠাবেন এবং তিনি যাতে আমেরিকান সরকারের মাধ্যমে তা ভারতের কাছে পাঠিয়ে দেন। অবশ্য সে দিন-ই ইসলামাবাদ থেকে তারবার্তায় তাকে জানানাে হয় যে, ফারল্যান্ড ইসলামাবাদ থেকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়
পৃষ্ঠা: ১৬৬
সরকারের মাধ্যমে যােগাযােগ করছেন এবং ঢাকা থেকে এ ব্যাপারে কোনাে উদ্যোগ নেয়ার প্রয়ােজনীয়তা নেই।
সেদিন বেলা ১টায় লে. জেনারেল নিয়াজী ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকায় আমেরিকার কনস্যুলেট অফিসে যান। ফরমান আলীর হাতে ছিল যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের একটি খসড়া কপি। নিয়াজী তাকে জানান যে, ভারতীয় বিমানবহরের হামলা থেকে মনে হচ্ছে যে পাকিস্তানের আর যুদ্ধ না থামিয়ে উপায় নেই। নিয়াজী ও ফরমান আলী চুক্তিটিতে স্বাক্ষর দেন ও কনস্যাল জেনারেলের। কাছে তা জমা দেয়া হয়। যুদ্ধবিরতি চুক্তি প্রস্তাবে ছিল :
(ক) পাকিস্তানের সব সেনাসদস্যকে এক জায়গায় একত্রিত করা হবে। (খ) মিলিটারি ও প্যারামিলিটারি ফোর্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। (গ) ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। (ঘ) মার্চ ১৯৭১ সাল থেকে যারা পাক বাহিনীকে সহযােগিতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনাে প্রতিশােধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না।
আরাে বলা হয় যে, বিরােধ নিষ্পত্তি করতে গিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব তারা মেনে নেবেন। তারা চুক্তিপত্রে আত্মসমর্পণ শব্দটি ব্যবহারে ছিলেন অনিচ্ছুক। এ ব্যাপারে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছ থেকে কোনাে অনুমােদন নেয়ার প্রয়ােজন আছে কি না জিজ্ঞেস করলে নিয়াজী জবাব দেন ডেফিনিটলি, নাে।
কন্সাল জেনারেল তাদের জানান যে, গভর্নর মালিক গভর্নর হাউজ ছেড়ে চলে গেছেন এবং আত্মরক্ষার জন্য ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রসে গিয়েছেন। ফলে এখন তিনি আর কোনাে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নেই। জেনারেল ফরমান আলী জানান যে, গভর্নর মালিক তার পদত্যাগপত্র দাখিল করে গেছেন।
নিয়াজী ও রাও ফরমান আলী যখন আত্মসমর্পন দলিল চূড়ান্ত করছিলেন। তখন পাকিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেষ বারের মতাে চেষ্টা করে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে একটি চিঠি পাঠান। তিনি বলেন,
ডিসেম্বর মাসে রাশিয়া থেকে এক বিরাট সামরিক বহর জাহাজ ও বিমানে করে ভারতে এসে পৌঁছেছে। এমতাবস্থায় রাশিয়ার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব, সেনা প্রত্যাহার এবং দেনদরবার একটি তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গিয়েও তারা সময়ক্ষেপণ করছে। এ ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ নেই যে, তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে পূর্ব পাকিস্তান দখলে সাহায্য করা। আমরা নিশ্চিত যে পূর্ব পাকিস্তান দখল করা শেষ হলে তারা ভারতকে
পৃষ্ঠা: ১৬৭
চালিত করবে পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে এবং এ জন্যই তারা ভারতকে রণসাজে সজ্জিত করেছে।৮
পাকিস্তান নিজেকে রক্ষা করতে চায় এবং এবং এর জন্য প্রয়ােজন প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র ও গােলাবারুদের সরবরাহ। ভারতের হামলা প্রতিরােধ করার এখনাে সময় আছে।
আমেরিকা ইতােমধ্যেই তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পাকিস্তানকে কিছু অস্ত্র সরবরাহ করেছে। কিন্তু ভারত ও রাশিয়ার সামরিক সম্ভারের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। এমতাবস্থায় আমেরিকার হস্তক্ষেপ একমাত্র অর্থবহ সমাধান। এ মুহূর্তে সপ্তম নৌবহরের কেবলমাত্র পাকিস্তানের এলাকায় আগমনই নয়, বরং এমন একটি চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে করে পাকিস্তানের ওপর আসা চাপ কিছুটা লাঘব হয়। এ ব্যাপারে সপ্তম নৌবহর কী করতে পারে তার একটি পূর্ণ বিবরণ ইতােমধ্যেই রাজার মাধ্যমে পাঠানাে হয়েছে।৯
নিয়াজীর খসড়া আত্মসমর্পণপত্রের অনুলিপি ভারতে ডেপুটি চিফ অব মিশনের কাছে পাঠানাে হলে ডেপুটি চিফ অব মিশন তা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সেক্রেটারি পিএন হাকসারের কাছে পাঠিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে তার একটি অনুলিপি পাঠিয়ে দেয়া হয় ভারতের সেনাধ্যক্ষ মানেকশর কাছে। ডেপুটি চিফ অব মিশন জানান যে চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমেরিকার কোনাে দায়দায়িত্ব নেই এবং তিনি শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের নির্দেশে চিঠিটি হস্তান্তর করেছেন।১০
ভারত সরকারের কাছে আত্মসমর্পণের দলিলটি পাঠালে দিল্লি থেকে কিছু সংশােধন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়। তাতে যােগ করা হয় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ ও যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
১৫ ডিসেম্বর নিক্সনের কাছে পাঠানাে এক নােটে কিসিঞ্জার জানান যে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারিয়ার টাস্কফোর্স এন্টারপ্রাইজ মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরের কেন্দ্রে ঘাঁটি এলাকার কাছাকাছি অবস্থান করছে। গুজব আসছে যে এন্টারপ্রাইজ পাকিস্তানকে সাহায্য করতে যাচ্ছে। ব্রিটিশরাও এলাকায় কিছু নৌজাহাজ পাঠিয়েছে। তাদের একটি কমান্ডাে ক্যারিয়ার এবং একটি ফ্রিগেট সিংহলের দক্ষিণ উপকূলে। একটি গাইডেড মিশাইল সার, একটি অয়েলার এবং একটি ডিজেল পাওয়ার সাবমেরিনসহ সােভিয়েত একটি নৌবহর দক্ষিণ চীন সমুদ্র অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরের দিকে যাত্রা করেছে যা তিনদিনের মধ্যে উপকূলে উঠবে বলে ধরে নেয়া যায়। ভারত মহাসাগরে সােভিয়েতের আরাে ১২টি যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। তবে তারা কেউ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধসীমানার কাছাকাছি নয়।১১
পৃষ্ঠা: ১৬৮
এদিকে হাকসার মানেকশর কাছে সংবাদ পাঠালে জেনারেল মানেকশ নিয়াজির কাছে এক বার্তায় চুক্তিপত্র অনুসারে সকল পাকিস্তানি সৈন্যের নিরাপত্তা ও জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দিদের নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা দেন। তিনি জানান যে, নিয়াজীর কাছ থেকে কনফার্মেশন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল জগজিত সিং অরােরার কাছে যুদ্ধ থামানাে ও আত্মসমর্পণ আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশ পাঠানাে হবে।১২
এদিকে একই দিনে (১৫ ডিসেম্বর) প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে একটি সুদীর্ঘ চিঠি পাঠান। ওয়াশিংটনে এম্বেসেডর ঝা চিঠিটি নিক্সনের হাতে তুলে দেন।১৩
চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধী বলেন,
২৫ মার্চ থেকে শুরু করে বিগত নয় মাসে বাংলাদেশের বুকে রক্তের যে হােলি খেলা চলেছে বিশ্বের মহান নেতারা বাস্তবতা নিরীক্ষণ করে গভীর দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করলেই সে রক্তক্ষয় থামাতে পারতেন। আমি গত নয় মাসে যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরে শান্তির বার্তা নিয়ে সারা বিশ্ব ভ্রমণ করেছি। অনেকে শরণার্থীদের ব্যাপারে সমবেদনা দেখালেও আসল সমস্যার সমাধানে কেউ এগিয়ে আসেননি।
সারা পৃথিবীর, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা, প্রভাব ও কর্তৃত্ব কাজে লাগালে এই যুদ্ধ রােধ করা সম্ভব হতাে। যুদ্ধ বন্ধ করা সম্ভব হতাে যদি তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে দেয়ার নির্দেশ দিতেন। অথচ তার বদলে তার জায়গায় হাস্যকরভাবে একজন বেসামরিক লােককে বসানাে হয়েছে। সকলেই জানেন যে সে সরকার একটি প্রহসন মাত্র। আর আজ? সেই প্রহসন আজ এক ট্রাজেডিতে পরিণত হয়েছে।
রাজনৈতিক সমাধানের অনেক আপ্তবাক্য উচ্চারণ করা হয়েছে, কিন্তু যােগ্য একটি পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি। বরং পাকিস্তানের শাসকেরা প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠান করে সুষ্ঠু নির্বাচনের অবমাননা করেছেন ও হাস্যকরভাবে শূন্য আসনে উপ-নির্বাচন করেছেন।
একবার কারাে মুখে এ কথাটি উচ্চারিতই হয়নি যে সমস্যা সমাধানের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রয়ােজন। তার সঙ্গে যােগাযােগের কোনাে চেষ্টাই চালানাে হয়নি। আমাদের সনির্বন্ধ আবেদন, শেখ মুজিবকে মুক্তির ব্যবস্থা করুন। এমনকি বন্দি থাকা অবস্থায়ও তার সঙ্গে যােগাযােগের ব্যবস্থা করে দেয়া যেতাে। কিন্তু তা করা হয়নি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে… কারণ শেখ মুজিব মুক্ত হলে ইয়াহিয়া সরকারের তাৎক্ষণিক পতন হতাে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে যে শেখ মুজিব হলাে আসল উপলক্ষ এবং এক সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন একটি অমােঘ বাস্তব বিষয়… অথচ সেখানে শুধু পরিস্থিতির
পৃষ্ঠা: ১৬৯
ভঙ্গুরতা এবং ইয়াহিয়া খানের বিপর্যয়ের বিষয়টিই বিবেচনা করা হয়েছে।
মি. প্রেসিডেন্ট, সবরকমের আন্তরিকতা দিয়ে প্রশ্ন করতে চাই, শেখ মুজিবের মুক্তি কিংবা নিদেনপক্ষে তার সঙ্গে গােপন একটি যােগাযােগ ব্যবস্থাও কি ভয়াবহ একটি যুদ্ধের চাইতে বিপজ্জনক কিছু ছিল?
আমরা আমাদের জন্য কিছুই চাই না। আমরা পূর্ব পাকিস্তান দখল করতে চাই না। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে ভূমিও দখল করতে চাই না। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব চাই। গত ২৪ বছরে আমার বাবা এবং আমি বহুবার পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতবিহীন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য হাত বাড়িয়েছি। ইতিহাসে রেকর্ড করা আছে যে যতবার আমরা বন্ধুত্বের জন্য হাত বাড়িয়েছি পাকিস্তান তাৎক্ষণিকভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
নিক্সন ও কিসিঞ্জারের টেলিফোন সংলাপ১৪
কিসিঞ্জার : ভারতীয়রা এখন আনবিলিভেবল। তারা চাচ্ছে জাতিসংঘ যাতে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়। এতে জাতিসংঘ সামনাসামনি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আমার মনে হয় না আমরা এতে রাজি হবাে।
নিক্সন : কিছুতেই না।
কিসিঞ্জার : সােভিয়েতরা ব্রিটিশদের বলে দিয়েছে যে, তারা ব্রিটিশদের প্রস্তাবে ভেটো দেবে। এ রকম হলে আমাদেরই উচিত সােভিয়েতকে জিজ্ঞেস করা তারা কী চায়।
নিক্সন : তা বলা যেতে পারে। হয়তাে তারা এ জন্য তৈরিও আছে।
কিসিঞ্জার : তা হতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে বদলাচ্ছে।। তারা অলরেডি চীনকে নাস্তানুবাদ করেছে। এবার তারা আমাদের নাস্তানুবাদ করবে। কিন্তু আমাদের তার মুখােমুখি হওয়া ঠিক হবে না।
নিক্সন : হ্যা।
কিসিঞ্জার : জার্মানদের কাছ থেকে একটা মেসেজ পেয়েছি। তারা জরুরিভাবে পশ্চিমে কী ঘটছে তার খবর নিতে বলেছে ও অবিলম্বে যুদ্ধ থামাবার ব্যবস্থা করতে বলেছে।
নিক্সন : আর এখন আমরা ব্রিটিশ প্রস্তাবের ওপর ভেটো দেখতে পাচ্ছি।
কিসিঞ্জার : তা এখনাে হয়নি।
নিক্সন : এতে ব্রিটিশরা আমাদের সারিতে চলে আসছে।
কিসিঞ্জার : ক্রোমার আমাকে একটা মেসেজ দেখিয়েছে। পাঠানাে হয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। অত্যন্ত কড়া ভাষায়। ভুট্টো মনে হয় আজ জাতিসংঘে খুব আবেগপূর্ণ বক্তৃতা দিয়েছে।
পৃষ্ঠা: ১৭০
নিক্সন : আমিও শুনেছি।
কিসিঞ্জার : ভারত বলছে ওরা পশ্চিম পাকিস্তানে হামলা চালাবে না। কিন্তু কাশ্মীরের কথা কিছু বলে নি।
নিক্সন : ওয়েল, লেটস জাস্ট ওয়েট নাউ। আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কোনাে চয়েস নেই। এখন সব কিছু সােভিয়েতের হাতে। আমরা কিছুই করতে পারবাে না।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক-বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্র বাহিনীর কাছে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। ভারতের পক্ষে ইস্টার্ন ক্যান্ডের প্রধান লে. জেনারেল জগজিত সিং অরােরা এবং পাকিস্তানের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণপত্রে স্বাক্ষর দেন। প্রায় ৯০ হাজার সেনা সদস্য ও বেসামরিক লােককে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ঘােষণা করা হয়। সেনা সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ৫৫,৬৯২ জন আর্মি, ১৬,৩৫৪ জন প্যারা মিলিটারি, ৫,২৯৬ জন পুলিশ, ১,০০০ নেভি ও ৮০০ জন এয়ার ফোর্স সদস্য। বাদবাকি সদস্যরা ছিলেন পাক বাহিনীর সহযােগী বেসামরিক সদস্য। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর প্রায় ৪ হাজার এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ৯,০০০ সদস্য নিহত হন। আহত হন ভারতের পক্ষে ১০ হাজার ও পাকিস্তানি পক্ষে সাড়ে ৪ হাজার। পাকিস্তানিরা দাবি করে যে যুদ্ধে ভারতের ১৩০টি বিমান ভূপাতিত করা হয়, যেখানে ভারতের হিসেবে সে সংখ্যা ৪৫টি। অন্যদিকে, ভারত পাকিস্তানের ৯৪টি বিমান ভূপাতিত করার দাবিদার, যেখানে পাকিস্তানের হিসেবে ভূপাতিত বিমানের সংখ্যা ৪২টি। মিত্র বাহিনীর মধ্যে ৫ লক্ষ ভারতীয় সৈন্য ও ১ লাখ ৭৫ হাজার মুক্তিবাহিনী অংশ নেয়। অন্যদিকে, দুই ফ্রন্টে মিলিয়ে পাকিস্তানের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৬৫ হাজার।১৫
১৬ ডিসেম্বর বেলা আড়াইটায় নয়াদিল্লিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লােকসভার এক অধিবেশনে ঘােষণা করেন যে, জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছে। একই সঙ্গে ভারত সরকার ভারত ও পশ্চিম ফ্রন্টে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করেছে যা পর দিন সকাল থেকে কার্যকর হবে। তিনি বলেন, ভারতের সীমান্তগত কোনাে উচ্চাভিলাষ নেই এবং ভারত সরকার এ ব্যাপারে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক বিবৃতি প্রত্যাশা করছে।১৬ পর দিন ১৭ ডিসেম্বর কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানাে এক তারবার্তায় জানান যে, জাতিসংঘের এবং ইন্দিরা গান্ধীর প্রস্তাবে সম্মত হয়ে ইয়াহিয়া খান সকাল সাড়ে নয়টা থেকে তার সৈন্যদের যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দিয়েছেন।
পৃষ্ঠা: ১৭১
তথ্য নির্দেশিকা
১. এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (এ আই ডি) ডেপুটি এডমিনিস্ট্রেটর উইলিয়াম মরিসের প্রতিবেদন। সেক্রেটারি রজার্সের কাছে তা পেশ করা হয় ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। ন্যাশনাল আর্কাইভস, গােপনীয়। আলােচনার সুবিধার জন্য রিলিফ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু রাজনৈতিক বিষয়গুলাে তুলে ধরা হয়েছে।
২. ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, হােয়াইট হাউস টেপস। রেকর্ডিং অব কনভারসেশন, ওভাল অফিস, কনভারসেশন নং- ৫৮২-৯।
৩, ন্যাশনাল আর্কাইভস, আরজি ৫৯, সেন্ট্রাল ফাইলস, ১৯৭০-৭৩, গােপনীয়।
৪. লাইব্রেরি অব কংগ্রেস ম্যানাস্ক্রিপ্ট ডিভিশন, কিসিঞ্জার পেপারস, বক্স-৩৭০। টেলিফোন সংলাপ বর্ণানুক্রমিক ফাইলস ১৫-২৩ নভেম্বর, ১৯৭১। গােপনীয়তা নির্দেশ করা নেই।
৫. ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, এন এস সি ফাইলস, বক্স নং ৯১৯। ডি আই ডিজিটস, ইন্ডিয়া, নভেম্বর, ১৯৭১, গােপনীয়।
৬. পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার কোনাে পারস্পরিক চুক্তিই কখনাে বলবৎ করা হয়নি। নিক্সন ও কিসিঞ্জার আসলে আগের আমলের চুক্তিগুলাে নিয়ে খুব বেশি জানতেন না। পাকিস্তান ভারত দ্বারা আক্রান্ত হলে সাহায্য করার জন্য আমেরিকার চুক্তিগত বাধ্যবাধকতা ছিল। ১৯৫৯ সালের ৫ মার্চ পাকিস্তানের বাগদাদ চুক্তিতে স্বাক্ষরের সময় এমন বিধান ছিল। ১৯৫৭ সালের ৯ মার্চ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত যৌথ বিবৃতির ভিত্তিতে চুক্তিটি সংস্থাপিত হয়। ১৯৬২ সালে চুক্তিতে পাকিস্তানকে এ আশ্বাস দেয়া হয় যে, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্টদের সাহায্যপ্রাপ্ত কোনাে দেশ দ্বারা পাকিস্তান আক্রান্ত হলে আমেরিকা পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেবে। ১৯৬২ সালে আইউব খানের সঙ্গে সম্পাদিত একটি সাহায্য স্মারকে পাকিস্তানকে এই আশ্বাস দেয়া হয়।
৭. মেমােরেন্ডাম ফর রেকর্ড, ন্যাশনাল মিলিটারি কমান্ড সেন্টার, ওয়াশিংটন। ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি-৫৯, এন ই এ ফাইলস, লট নং ডি-৭৯।
৮. নিয়াজীর চিঠিটি ওয়াশিংটনে পাঠানাে হলে ওয়াশিংটনে জাতিসংঘে ব্যস্ত ভুট্টোর কাছে তা দেয়া হয়। কিন্তু ভুট্টো চিঠিটি নিউইয়র্কে ভারতীয় অফিসে পাঠাতে অস্বীকার করেন। পরে আমেরিকার ইউ এন মিশন থেকে তা ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের কাছে পাঠালে শরণ সিং তা ইন্দিরা গান্ধীর সেক্রেটারি হাকসারের কাছে পৌছানাের জন্য ভারতে কিটিংয়ের কাছে পাঠান। ভুট্টো নিজে
আত্মসমর্পণের দলিল জাতিসংঘের কাছে পেশ করতে চাননি।
৯. এর আগে ১৩ ডিসেম্বর এম্বেসেডর রাজা চিঠিটি হেগের কাছে পৌছান এবং হেগ সেটি তাৎক্ষণিকভাবে হােয়াইট হাউসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। চিঠিতে বলা হয়েছিল, করাচি উপকূলে ভারতের হামলা প্রতিরােধ করার লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি প্রয়ােজন।
১০. শুধুমাত্র নিক্সনের জন্য মার্ক করা ইয়াহিয়ার চিঠি। বক্স-৬৪৩।
১১, ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস। বক্স-৩৭।
১২. প্রাগুক্ত, রাজনৈতিক, ২৭-১৪-ভারত-পাকিস্তান।
১৩. ফরেন রিলেশনস অব দ্য ইউনাইটেডে স্টেটস, ১৯৬৯-৭৬। সংক্ষেপিত।
১৪. ডকুমেন্ট ৩১৫, নিক্সন ও কিসিঞ্জারের টেলিফোন সংলাপ। লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, ম্যানাস্ক্রিপ্ট ডিভিশন, বক্স-৩৭০।
১৫. দুই পাশের বিভিন্ন দাবির প্রেক্ষিতে প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। উপরােক্ত তথ্য ইন্দো পাকিস্তানি অয়ার অব ১৯৭১, ওয়াইকিপেডিয়া থেকে নেয়া হয়েছে।
১৬. টেলিগ্রাম নং ১৯৩৩৭ ও ১৯৩৪০। ন্যাশনাল আর্কাইভস।
পৃষ্ঠা: ১৭২
Ref: মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম