You dont have javascript enabled! Please enable it! চীন-মার্কিন সম্পর্ক ও ইয়াহিয়ার দূতিয়ালি | মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপন দলিল - জগলুল আলম - সংগ্রামের নোটবুক

চীন-মার্কিন সম্পর্ক ও ইয়াহিয়ার দূতিয়ালি | মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম

চীন-মার্কিন সম্পর্ক
১৯৫৫ সালের ১ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন জেনেভায় রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে থাকা মার্কিন ও চীনা নাগরিকদের পুনর্বাসনসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরাে কয়েকটি ইস্যু নিয়ে আলােচনার উদ্যোগ নেয়। এ সময় দু’দেশের মধ্যে কোনাে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না এবং আগের ১৬ বছরে উল্লেখযােগ্য ধরনের পারস্পরিক কোনাে যােগাযােগও ছিল না। চীন-মার্কিন সম্পর্ক একরকম বারুদের স্কুপের ওপর অবস্থান করায় দু’পক্ষই তখন তাতে প্রশমনের প্রক্রিয়া উদ্ভাবনে দিকনির্দেশনা খুঁজছিল।
১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট বিজয়ের পরে এবং ১৯৫০ সালে কোরিয়ার যুদ্ধের পূর্বক্ষণে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের একাংশ তাদের প্রতিপক্ষ দেশে আটকে পড়ে। এটা যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। না, তখন চীনা কর্তৃপক্ষ বিপুলসংখ্যক আমেরিকান মিশনারি, ব্যবসায়ী ও শিক্ষাবিদকে চীনের বাইরে যেতে এক্সিট পারমিট দিতে অস্বীকার করে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার একটি জরুরি অবস্থা ঘােষণা করে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত চীনা ছাত্র ও কারিগরদের চীনে ফেরত যেতে না দিয়ে আটকে ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রে তখন চীনা ছাত্র ছিল প্রায় ৫ হাজার, যার মধ্যে ১০৫ জনকে বেশ কয়েক বছর যাবৎ আটকে রাখা হয়। প্রায় ছয় সপ্তাহ আলােচনার পরে ১৯৫৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর দুই দেশ একটি সমঝােতায় আসে। ঘােষণা অনুসারে আটকেপড়া চীনা ও মার্কিন নাগরিকরা তৃতীয় একটি দেশের মধ্যস্থতায় যার যার দেশে ফিরে যাবার সুযােগ পায়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গ্রেট ব্রিটেন এবং চীনের পক্ষে ভারত তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা পালন করে।
কিন্তু দু’পক্ষে সমঝােতার পরেও সমস্যার সমাধান হলাে না। বাস্তবায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে চীন কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের সময় থেকে চীনের ওপর আরােপিত
পৃষ্ঠা: ১০৯

মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রত্যাহার এবং চীন ও আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে আলােচনার দাবি জানায়। কিন্তু মার্কিন পক্ষ থেকে বলা হয় যে, প্রতিটি আমেরিকান নাগরিক পুনর্বাসনের আগে কোনাে আলােচনা সম্ভব নয়। এক পর্যায়ে। চীনা কর্তৃপক্ষও সব চীনা নাগরিকের প্রত্যাবাসন দাবি করলে আমেরিকা থেকে জানানাে হয় যে কোনাে চীনা নাগরিককে আটকে রাখা হয়নি এবং অনেকে স্বেচ্ছায় আমেরিকায় থেকে গেছে।
চীন ও আমেরিকার মধ্যে নাগরিক প্রত্যাবাসনের বিষয়টি নিয়ে আরাে কতিপয় ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। এ সময় তাইওয়ানকে মেইনল্যান্ড চায়নার সঙ্গে একীভূত করার জন্য চীন তার বিরুদ্ধে বলপ্রয়ােগ করে। আমেরিকা চীনের এই বলপ্রয়ােগ বন্ধ না করা পর্যন্ত বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে অস্বীকার করে। এভাবে ১৯৫৫ সালে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাথমিক আলােচনা শুরু হওয়ার পর ১৩৬টি বৈঠক অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও চীন-মার্কিন সম্পর্ক স্বাভাবিক করা যায়নি।
১৯৫৫ সালের ১৪ মে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর১ পাল্টা সংগঠন হিসেবে সােভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে গঠন করা হয় ওয়ারশ ট্রিটি অর্গানাইজেশন। রাজনৈতিক ও সামরিক জোট হিসেবে পূর্ব ইউরােপের দেশগুলাে এতে যােগ দেয় ও পরবর্তীকালে এটি ওয়ারশ প্যাক্ট নামে পরিচিতি অর্জন করে।২
১৯৫৮ সালের গােড়ার দিকে চীন প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাইশেক ছিলেন আমেরিকার জারি করা নিষেধাজ্ঞায় অসহিষ্ণু। ১৯৫৪ সালের পারস্পরিক সমঝােতামূলক প্রতিরক্ষা চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এই সমঝােতা বােধটুকু কাজ করছিল যে চীনা মেইনল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে কোনাে তৎপরতা পরিচালনা করার আগে তাদের সঙ্গে আলােচনা করা হবে। মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট ডাল্লেস ১৯৫৮ সালের মার্চে তাইওয়ান সফরের সময় চিয়াং কাইশেক চীনা মেইনল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযােগ নেয়ার জন্য সেক্রেটারিকে প্রস্তাব দেন। তার ধারণা ছিল যে, স্পেশাল গেরিলা বাহিনী ব্যবহার করে কম্যান্ডাে হামলার মাধ্যমে তাইওয়ানের স্বপ্ন পূরণ করা যাবে। কিন্তু ডাল্লেস চিয়াং কাইশেককে আরাে মােক্ষম সুযােগ আসা অবধি অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন।
১৯৫৮ সালে চীন-মার্কিন সম্পর্ক এমন এক পর্যায়ে দাঁড়ায় যে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্ব একটি অবশ্যম্ভাবী চীন-মার্কিন যুদ্ধের আশঙ্কা করতে থাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার ও সেক্রেটারি অব স্টেট জন ফস্টার ডাল্লেস এই দুর্যোগ শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে থাকেন। বিশেষ করে তাদের বিরােধ যেন পারমাণবিক সংঘর্ষের দিকে না যায় সেদিকে তারা বিশেষভাবে নজর রাখছিলেন, কারণ চীন ও আমেরিকা উভয়েই ছিল পারমাণবিক শক্তির অধিকারী।
আগস্ট মাসে চীন ব্যাপকভাবে গােলাবর্ষণ করে জাতীয়তাবাদীদের এলাকাভুক্ত কুয়ােময় প্রদেশকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার উপক্রম করলে আইসেনহাওয়ার ও ডাল্লেস
পৃষ্ঠা: ১১০

প্রমাদ গুনলেন। তারা চীনের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে চাননি—আবার তাইওয়ানের প্রতিরক্ষায় ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ সময় চিয়াং কাইশেক উপকূলবর্তী এলাকায় অস্ত্র সমাবেশ করে চীনা মেইনল্যান্ডে আক্রমণ চালাবার জন্য আইসেনহাওয়ারকে অনুরােধ করলে তিনি তাতে সাড়া দেননি—বরং সপ্তম নৌবহর, মিলিটারি সাহায্য ও নৌ-প্রতিরক্ষা দিয়ে উপকূলের তিন মাইল দূর থেকে সামরিক সহায়তা দান অনুমােদন করেন। সেপ্টেম্বর মাসে ১৯৫৭ সালের আদলে দুই দেশের মধ্যে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে কথাবার্তা চালানাের প্রস্তাব এলে অক্টোবর মাসে চীন কুয়ােময়তে বােমাবর্ষণ বন্ধ করে ও আমেরিকা তার নৌবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে এক ধরনের যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে যুদ্ধাবস্থার আপাত অবসান ঘটে। ১৯৫৯ সালে আমেরিকা তাইওয়ানে দ্রুত অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রস্তাব দিলে তাইওয়ান সরকার বেসরকারি খাতের দ্রুত প্রসারের মাধ্যমে এক বিশালাকায় অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে আসেন।
১৯৬০ সালে আইসেনহাওয়ার চীন প্রজাতন্ত্র সফর করার সময় চিয়াং কাইশেক চীনা মেইনল্যান্ড ও মার্কিন সহায়তায় একটি গেরিলা বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু আইসেনহাওয়ার সে প্রস্তাবে সাড়া দেননি।
১৯৪৯ সালে ব্যাপক সংস্কারের মধ্য দিয়ে মাও সে তুং ক্ষমতায় এসে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের গােড়াপত্তন ঘটাবার পর থেকেই আমেরিকা ছিল চীনের ব্যাপারে সন্দিগ্ধ এবং উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বে কমিউনিজম বিস্তৃতির ভয়ে আশঙ্কাগ্রস্ত। ১৯৫৮ সালে মাও সে তুং সােভিয়েতের আদলে সমাজতান্ত্রিক ফর্মুলায় না গিয়ে এক নয়া অর্থনৈতিক কর্মসূচি ঘােষণা করেন। এতে শিল্প ও কৃষির দ্রুত প্রবৃদ্ধি, বিশালাকায় সমবায় বা কমিউন ও মুদ্রণশিল্পের বিকাশের কর্মসূচি নেয়া হয়। এ সময় সােভিয়েতরা চীনে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সাহায্য প্রেরণ বন্ধ করে দেয়। ১৯৬০ সালে সােভিয়েতরা চীন থেকে তাদের সামগ্রিক লােকবল প্রত্যাহার করে নেয়। এ সময় আন্তর্জাতিক ফোরামে চীন ও সােভিয়েত ইউনিয়ন দুটি আলাদা ব্লকে বিভক্ত হয়ে গেলে উন্নত বিশ্বের শক্তিপরিধি চীন, সােভিয়েত ও পশ্চিম ইউরােপসহ আমেরিকা এই বলয়ে ত্রিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
১৯৬০ সালের দশকের পুরােটা সময় মার্কিন-চীন সম্পর্ক ছিল একরকম অস্তিত্ববিহীন। এ সময়টাতে চীনের ইতিহাসে রাশিয়া-চীন সম্পর্কই বেশি প্রাধান্য পেতে দেখা যায়। ১৯৬৯ সালে চীন ও রাশিয়া আমুর ও উসুরি নদী অঞ্চলে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছে।৩ দুই কমিউনিস্ট শক্তির দ্বন্দ্ব এ সময়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে বিশ্বে আরেক দফা পারমাণবিক সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দেয়।
ষাটের দশকে আমেরিকার মূল প্রচেষ্টা ছিল চীনকে সম্মিলিত জাতিসংঘে ঢুকতে না দেয়া। এ সময় আমেরিকা তার মিত্রদেরও চীনের সঙ্গে ওঠাবসা না করার। জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছে।৪ ১৯৬৪ সালে চীন পারমাণবিক বােমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটালে আমেরিকা আরাে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে
পৃষ্ঠা: ১১১

যায় যে, প্রেসিডেন্ট জনসন চীনের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার জন্য হামলা চালানােরও সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পরে আণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতার আশঙ্কায় সে সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়।
আমেরিকার সঙ্গে চীনের আরেকটি তিক্ততার কারণ ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ। ভিয়েতনামে চীন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ১৯৪৯ সাল থেকেই। চীনে তখন সবেমাত্র কমিউনিজম সংস্কারের ছোঁয়া লেগেছে। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের যুদ্ধাস্ত্র ও কারিগরি সাহায্য দেয়। ১৯৬২ সালের এপ্রিলে মাও সে তুং হ্যানয়ে ৯০ হাজার রাইফেল ও অন্যান্য বন্দুক বিনামূল্যে সরবরাহ করেন।৫ আমেরিকা তার রােলিং থান্ডার কর্মসূচির মাধ্যমে ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে চীন আমেরিকার বােমাবর্ষণের ক্ষতিপূরণ পুষিয়ে দেয়ার জন্য উত্তর ভিয়েতনামে কারিগরি ও প্রকৌশলী সাহায্য দেয়। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সাল অবধি উত্তর ভিয়েতনামী গেরিলাদের পাশাপাশি প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার চীনা সৈন্য ভিয়েতনামে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এ যুদ্ধ ১৯৬৭ সালে এক চরম আকার ধারণ করে। প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার চীনা সৈন্য এ সময় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে চীন ১ হাজার ৪৪৬ জন সৈন্য হারায়। উত্তর ভিয়েতনাম, ভিয়েতকং ও তার মিত্রশক্তি এবং চীনা সৈন্যের হাতে আমেরিকার প্রায় ৫৮ হাজার সৈন্য নিহত হয়।
১৯৬৭ সালে আমেরিকা ফরেন ক্লেইমস সেটেলমেন্ট কমিশন গঠন করে ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট আগ্রাসনের সময় ক্ষতিগ্রস্ত আমেরিকানদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করে। ফলে চীনে অবস্থানরত আমেরিকান কোম্পানিগুলাে চীনা জাতীয়করণের ফলে দখলে নেয়া সম্পত্তিগুলাের বিপরীতে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে সক্ষম হয়। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি সংগঠনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পালিয়ে চলে এলেও আমেরিকান এক্সপ্রেসের একজন কর্মকর্তাকে চীনা কর্তৃপক্ষ প্রতিশােধ হিসেবে ৫ বছর পর্যন্ত আটকে রাখে।৬
ষাটের দশকের শেষের দিকে গিয়ে অবস্থায় কিছুটা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায়। ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট জনসন ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে চীন ধরে নেয় যে, দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ক্ষমতা সম্প্রসারণের কোনাে অভিলাষ আমেরিকার নেই। বরং এ সময় রাশিয়া কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাতের জন্য চেকোশ্লোভাকিয়ায় হামলা চালালে চীন ধরে নেয় যে, এর পর রাশিয়া চীনের ওপর আঘাত হানতে পারে। ১৯৬৯ সালে চীন-রাশিয়া সীমান্ত সংঘর্ষের পর চীনের মধ্যে এই আশঙ্কা তীব্রতর হয়। কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন চীনা। নেতারা মনে করতে থাকেন যে, এমতাবস্থায় আমেরিকার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে পারলে তারা কৌশলগতভাবে লাভবান হতে পারবেন এবং সােভিয়েতের হুমকি এতে প্রতিহত করা সম্ভব হবে। চীনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চৌ এন লাই ছিলেন।
পৃষ্ঠা: ১১২

এই ধারণার প্রবক্তা এবং চিন্তাধারণায় তিনি চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর সমর্থন লাভেও সক্ষম হন।
আমেরিকাতেও এ সময় চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দাবি জোরদার হয়ে উঠছিল। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সভা-সমিতি ও সেমিনারের আয়ােজন করে চীনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের গুরুত্বের ওপর চালানাে হচ্ছিল আলােচনা। অনেকে ভিয়েতনাম, কম্বােডিয়া ও লাওসের মতাে বিভিন্ন স্থানে কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্য চীনকে দায়ী করলেও সবাই ধরে নেন যে, চীনের সঙ্গে মার্কিন সহাবস্থানে সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে একটি শক্তিবলয় গড়ে ওঠায় বিশ্বক্ষমতাস্তরে নতুন একটি ধারার ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে মার্কিন ব্যবসায়ীরা ১০০ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত চীনে পৃথিবীর বৃহত্তম বাজারের স্বপ্ন দেখছিলেন। এভাবে বিভিন্ন মহল থেকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য আমেরিকার প্রশাসনের ওপর অনুপ্রেরণা ও চাপ অব্যাহত রাখা হয়।
আমেরিকা প্রথম থেকেই অনুভব করতে পারছিল যে পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী দেশ আমেরিকা এবং সবচাইতে জনবহুল দেশ চীনের মধ্যে সাংঘর্ষিক কোনাে সম্পর্ক বজায় রাখার অর্থ হলাে গােটা বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক একটি পরিস্থিতি। বিশ্ব শান্তির বৃহত্তর স্বার্থেই এই দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যেকার সুদীর্ঘ দুই দশকের বিচ্ছিন্নতা মিটিয়ে ফেলার প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী ন্যাশনাল সিকিউরিটির স্টাডির এক মেমােরেন্ডামে বলা হয়—
দুই দশক ধরে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বকারী চীন আন্তর্জাতিক বিশ্বের মূলধারার বাইরে অবস্থান করছে। এই বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ হলাে চীনের নিজস্ব আচরণের কারণে এক ধরনের স্বেচ্ছানির্বাসন এবং আংশিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেরণায় পশ্চিমা বিশ্বের প্রচেষ্টা যাতে বিশ্বে কমিউনিজম মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। জাতিসংঘে চীনের অন্তর্ভুক্তির বিরােধিতা করে এবং তাইপের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি জোরদার করে আমেরিকা গােটা বিশ্বে যেসব সমস্যা সৃষ্টি করেছে সেগুলাে হলাে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, সমুদ্রসীমা বিষয়ক জটিলতা, সমুদ্রস্থিত তেলের অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব, বিমান হাইজ্যাকিং, মাদকদ্রব্যের ব্যাপক চোরাচালান ও অন্যান্য। অন্যদিকে অনেক বড়াে বড়াে আন্তর্জাতিক চুক্তিতে।
বিশ্বের বিশালতম জনগােষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এতে বলা হয়,
চীন ও আমেরিকার মধ্যে বিচ্ছেদের কারণেই পশ্চিমা বিশ্বে আমেরিকার প্রতি আনুগত্য দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে, গণচীনের প্রতি সমর্থন বাড়ছে এবং তাইওয়ান প্রশ্নে আমেরিকার সমর্থকের সংখ্যা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার পলিসি হয়ে
পৃষ্ঠা: ১১৩

পড়েছে অবাস্তব ও ব্যাকডেটেড এবং আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণভাবে এর জন্য আমেরিকাকে দুর্নাম কুড়ােতে হচ্ছে।

মেমােরেন্ডামে প্রশ্ন তােলা হয়,
(১) চীন-আমেরিকা সম্পর্কের মধ্যে কি এ ধরনের শীতলতা চলতেই থাকবে? (২) এ ব্যাপারে কি কোনাে পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব? (৩) এ ব্যাপারে ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়? (৪) আমেরিকার নীতিমালায় কোনাে পরিবর্তন নিয়ে আসা হলে তা কি চীনা নীতিতে প্রভাব ফেলবে না? (৫) চীন-মার্কিন সম্পর্কে নতুন মেরুকরণের উদ্যোগ নেয়া হলে তাইওয়ানের কাছে আমেরিকার বাধ্যবাধকতার ভবিষ্যৎ কী রকম দাঁড়াবে? এবং (৬) এর ফলে আমেরিকার কী লাভ বা কী ক্ষতি হতে পারে?
এ সময় আমেরিকার একটি টেবিল টেনিস দল চীনে আন্তর্জাতিক একটি টুর্নামেন্টে অংশ নিতে যায় ও সেখানে এক মজাদার ঘটনা ঘটে। আমেরিকার একজন টেনিস খেলােয়াড় ঠিক সময়ে বাস ধরতে পারেননি। তিনি বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখতে পান যে তাকে রেখেই বাস চলে গেছে। এমতাবস্থায় চীনা খেলােয়াড়দের বহনকারী বাস থেকে একজন খেলােয়াড় হাতের ইশারা করে আমেরিকান খেলােয়াড়টিকে আমন্ত্রণ জানান ও নিজেদের বাসে তুলে নেন। বাসে তারা ভাঙা ভাঙা ভাষায় কথা বলেন ও শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে উপহার বিনিময় করেন।
ঘটনাক্রমে এই বিষয়টি চীন ও আমেরিকা উভয় দেশের সংবাদপত্রে খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপানাে হয়।
চীনে চৌ এন লাইয়ের সরকার এর মধ্যে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের একটা সম্ভাবনা দেখতে পান। তিনি মনে করেন যে, খেলােয়াড়দের মধ্যে পারস্পরিক সমঝােতার ভাব থাকলে বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় পরিধিতেও তা বিস্তার করা সম্ভব। এর পর থেকেই চীন আমেরিকার সঙ্গে যােগাযােগের যথাযথ মাধ্যম অনুসন্ধান করতে থাকে।

ইয়াহিয়ার দূতিয়ালি
ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন বেশ কয়েকবার পাকিস্তান সফর করেন। ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করতে আসেন লাহােরে। এর আগের সফরগুলােতে আসাকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আইউব খান এবং ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে নিক্সনের তেমন পরিচয়ও ছিল না। সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের প্রধান। সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং আইউব খানের সঙ্গে অসম্পাদিত কয়েকটি ব্যাপারে আপডেট হওয়া।
পৃষ্ঠা: ১১৪

বিদায়ের আগে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইয়াহিয়া খানকে কথা প্রসঙ্গে জানান যে, তিনি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের কথা ভাবছেন।৮ তিনি বলেন যে, প্রায় দুই দশক আগে চীনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে এবং এর মধ্যে সরকারিভাবে চীনের সঙ্গে কোনাে যােগাযােগই রাখা হয়নি। তিনি বলেন, যখন সময় যথার্থ বলে মনে হবে তখন তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যােগাযােগ করতে চান যাতে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ইয়াহিয়া মধ্যবর্তী হিসেবে কাজ করতে পারেন। ইয়াহিয়া তাকে জানান যে, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এ ব্যাপারে সহযােগিতা করতে সানন্দে রাজি আছেন।
অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই নিক্সন ছিলেন চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পক্ষপাতী। ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী থাকাকালে ফরেন অ্যাফেয়ার্স পত্রিকায় নিক্সন এক নিবন্ধে লিখেছিলেন যে আমরা জাতিগত পরিবার থেকে চীনকে কেবল দূরে সরিয়ে রাখতে পারি না। এই ক্ষুদ্র পৃথিবীতে এমন কোনাে স্থান থাকতে পারে না যেখানে কয়েকশ’ কোটি সক্ষম মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতাে এক কোনায় অবস্থান করবে।৯
প্রেসিডেন্ট হবার প্রথম দুই দিনে প্রেসিডেন্ট নিক্সন হােয়াইট হাউসে বসে তার নােটে লিখেছিলেন, ‘চীনা কমিউনিস্ট—স্বল্পমেয়াদি কোনাে পরিবর্তন নয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদিভাবে ৮০ লক্ষ লােককে বিচ্ছিন্নভাবে রাখা ঠিক হবে না। আমাদের উচিত হবে চীনের সঙ্গে যােগাযােগের সূত্র বের করা। চীন হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমবায়ভুক্ত এবং প্যাসিফিক সম্প্রদায়ের সদস্য।১০
অবশ্য প্রজাতন্ত্রী চীন সব সময়ই সন্দেহ করছিল যে আমেরিকা গােপনে বা প্রকাশ্যে গণচীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে এবং এ ব্যাপারে তারা ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল। পাকিস্তান ছাড়াও রুমানিয়ার সহযােগিতায় এ ধরনের যােগাযােগের একটি গুজব ইতােমধ্যেই বর্তমান ছিল। এমনকি গণচীনের ওয়াশিংটনস্থ রাষ্ট্রদূত চৌ সু কাই এ নিয়ে ১৯৬৯ সালের আগস্টে কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখাও করেন। অতি সাম্প্রতিককালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড সফর নিয়েও রাষ্ট্রদূত প্রশ্ন তােলেন।১১ রাষ্ট্রদূতের জিজ্ঞাসা ছিল রুমানিয়া সফরের সময় রুমানিয়ান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে চীনা কমিউনিস্টদের ও আমেরিকার মধ্যে কথাবার্তা শুরুর কোনাে প্রসঙ্গ এসেছিল কি না।১২ কিসিঞ্জার তাকে জানান যে এ ধরনের কোনাে আলােচনাই হয়নি এবং পিকিং সম্পর্কে মার্কিন নীতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি।
যাই হােক, প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইয়াহিয়াকে দূতিয়ালির ব্যাপারে প্রস্তাব দেয়ার পরবর্তী দুই বছর এ নিয়ে আর কোনাে কথাবার্তা হয়নি। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতিসংঘের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে নিউইয়র্কে এলে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইয়াহিয়াসহ কয়েকজন বিদেশি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানকে ডিনারের দাওয়াত
পৃষ্ঠা: ১১৫

দেন। কিন্তু ডিনারে প্রচুর লােকজন থাকায় নিক্সনের সঙ্গে ইয়াহিয়ার কোনাে কথাবার্তা হয়নি।
পরদিন ইয়াহিয়ার সঙ্গে নিক্সনের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।১৩ বৈঠকের পর নিক্সন ইয়াহিয়াকে তার নিজস্ব কক্ষে নিয়ে যান এবং গােপনে আলাপচারিতা করেন। অনেকক্ষণ একান্তে বৈঠকের পর নিক্সন ইয়াহিয়াকে বিদায় সম্ভাষণ জানান। এই গােপন আলােচনার সারবস্তু কোনােদিনই বাইরে প্রকাশিত হয়নি।
পরবর্তীকালে নিক্সনের অলিখিত বাণী সঙ্গে নিয়ে ইয়াহিয়া খান নভেম্বরে বেইজিং সফর করেন। প্রেসিডেন্ট চৌ এন লাই স্বয়ং ইয়াহিয়াকে সাদর সম্ভাষণ জানান।
সফরের দ্বিতীয় দিনে ইয়াহিয়া খান অবস্থান করছিলেন পুরনাে ফরাসি দূতাবাস ভবনে, যা তখন অত্যন্ত বিলাসবহুল একটি গেস্ট হাউস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। একই দিনে ভবনের নিভৃত একটি কক্ষে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে চৌ এন লাইয়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইয়াহিয়া চৌ এন লাইকে জানান যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন চৌ এন লাই বা অন্য কোনাে চীনা নেতার সঙ্গে দু’দেশের বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে আলােচনার জন্য দূত পাঠাতে চান। চৌ এন লাই সঙ্গে সঙ্গে তার কোনাে জবাব দেননি এবং বলেন যে চেয়ারম্যান মাও-এর সঙ্গে আলােচনা করে তিনি সিদ্ধান্ত জানাবেন।
পরদিন চৌ ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেন এবং অত্যন্ত পরিহাসচ্ছলে বলেন যে, এতদিন আমি বিভিন্ন মহল থেকে এ ধরনের প্রস্তাব পেয়েছি। তবে এবারই প্রথমবার আমি একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে আরেক রাষ্ট্রপ্রধানের ইচ্ছা তৃতীয় একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে জানাতে দেখলাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে চীনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে মনে করে এবং সে কারণেই আমরা বেইজিংয়ে দূত পাঠাবার ব্যাপারে নিক্সনের প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি। এর পর তাদের মধ্যে আলােচনার শর্ত ও স্থান ইত্যাদি নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলােচনা হয়।
দূতিয়ালির সুবাদে অবশ্য ইয়াহিয়া খান চীনের কাছ থেকে অনেকটা বাড়তি সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হন। চীন পাকিস্তানের কাছে সে যাবৎ পাওনা সকল ঋণ মাফ করে দেয়। অতিরিক্ত সামরিক সরবরাহের জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের একটি চুক্তিও সম্পাদিত হয়।
নভেম্বরের ২০ তারিখে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পররাষ্ট্র বিষয়ক কিছু তথ্য নিয়ে আলাপ করতে গেলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাকে বলেন, অত্যন্ত গােপন এবং সংবেদনশীল একটি বিষয় নিয়ে তিনি আলাপ করতে চান। পাকিস্তানে ইয়াহিয়া এবং তিনি ছাড়া বিষয়টি কাউকে জানানাে চলবে না। কিসিঞ্জারের সঙ্গে যােগাযােগের মাধ্যম হবেন ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে যােগাযােগের মাধ্যম হবেন ইসলামাবাদে চীনা
পৃষ্ঠা: ১১৬

রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, গােপনীয়তা বজায় রাখার জন্য সকল মেসেজ হবে হাতে লেখা যাতে সচিবদের মাধ্যমেও তা বাইরে চলে যেতে না পারে। যােগাযােগের কোনাে কপি রাখা হবে না এবং পড়ার পর মেসেজগুলাে নষ্ট করে ফেলতে হবে। কেবলমাত্র ইয়াহিয়া খানের কাছে মেসেজের কপি সংরক্ষিত থাকবে।
এরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নিক্সনের সঙ্গে ওয়াশিংটনে এবং চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে বেইজিংয়ে তার আলােচনার কথা জানান। ২৩ নভেম্বর ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের কাছে কিসিঞ্জারের জন্য একটি বার্তা পাঠানাে হয়। কিন্তু মেসেজ আসার আগাম কোনাে খবর না দেয়ায় ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত মেসেজটি না পড়েই নির্ধারিত সফরে মেক্সিকো চলে যান, যার জন্য কিসিঞ্জারের কাছে বার্তা পাঠাতে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। রাষ্ট্রদূত ফিরে আসার পর সেদিনই তা কিসিঞ্জারের কাছে পৌঁছানাে হয়।
এদিকে চীন ও আমেরিকা তাইওয়ান ও ভিয়েতনামে এবং পাকিস্তান, ভারত ও পূর্ব পাকিস্তান ঘটনায় ব্যস্ত থাকায় ছয় মাস পর্যন্ত এ নিয়ে আর কেউ তেমন অগ্রসর হতে পারেননি। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে গণচীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই চেয়ারম্যান মাও-এর পক্ষ থেকে নিক্সনের কাছে একটি অত্যন্ত গােপনীয় বার্তা পাঠান।১৪’ আমেরিকার সঙ্গে চীনের কোনাে যােগাযােগ না থাকায় বার্তাটি প্রথমে পাঠানাে হয় পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের কাছে। ইয়াহিয়া সেটি তাৎক্ষণিকভাবে ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূত হিলালীর কাছে পাঠিয়ে দেন। ২৭ এপ্রিল বিকাল পৌনে চারটায় হিলালী কিসিঞ্জারের অফিসে যােগাযােগ করে বলেন যে, গণচীন সংক্রান্ত একটি জরুরি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনার জন্য পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও তিনি কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখা করতে চান।
বিকাল ৬টা ১২ মিনিটে ১৮ মিনিটের এক সাক্ষাতে হিলালী চৌ এন লাইয়ের চিঠিটি কিসিঞ্জারের হাতে পৌঁছে দেন। সেদিনই সন্ধ্যায় কিসিঞ্জার চৌ এন লাইয়ের চিঠিটি নিয়ে দেখা করেন নিক্সনের সঙ্গে। চিঠিতে চৌ এন লাই বলেন,
আমেরিকা ও চীনের মধ্যেকার সম্পর্ক নবায়নের সময় এসেছে এবং দু’দেশের মধ্যে অনেক বিষয়ে আলােচনার প্রয়ােজন বলে দু’দেশের অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ে সরাসরি বৈঠকের মাধ্যমেই কেবল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলাের সমাধান হতে পারে। সেজন্যই চীন সরকার প্রকাশ্যে আমেরিকার অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের একজন বিশেষ দূতকে চীন সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। আমরা আশা করি এ ব্যাপারে কিসিঞ্জারের মতাে একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি প্রেসিডেন্টের দূত হিসেবে চীনে সরকারি সফরে আসবেন, এমনকি স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট চীনে এলেও তাকে অত্যন্ত সাদরে বরণ করে নেয়া হবে।১৫
পৃষ্ঠা: ১১৭

অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি মনে করেন যে, এর জন্য উপযুক্ত সময় এখনাে আসেনি তা হলে তিনি তার নিজের চীন সফরের বিষয়টি পরবর্তী যে কোনাে সময় স্থির করতে পারেন। দু’দেশের মধ্যে সরাসরি কোনাে যােগাযােগ নেই বলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মাধ্যমে উচ্চ পর্যায়ের এই বৈঠকের কার্যপ্রণালী, দিন-তারিখ ও আলােচনার বিষয়সূচি স্থির করা যেতে পারে।
১০ মে প্রেসিডেন্ট নিক্সন চৌ এন লাইয়ের চিঠির আনুষ্ঠানিক জবাব দেন। আগের নিয়ম অনুযায়ী চিঠিটি কিসিঞ্জারের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এবং সেদিনই তা পাকিস্তানে চীনা রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে চীনে পৌছে দেয়া হয়। চিঠিতে কিসিঞ্জার বলেন,
চীন-মার্কিন সম্পর্কের বিদ্যমান অচলাবস্থা নিরসনের জন্য সরাসরি অতি উচ্চ পর্যায়ের যােগাযােগ জরুরি হয়ে পড়েছে বলে আমেরিকা মনে করে। কাজেই আমেরিকা এবার সরাসরিভাবে চীনের সঙ্গে যােগাযােগ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এতে উভয় পক্ষ নিজেদের মধ্যেকার প্রশ্নগুলাে উত্থাপন করতে পারবে।১৬
আমেরিকা মনে করে যে, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফরের আগে দু’দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক হওয়া প্রয়ােজন। সেজন্যই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স ড. কিসিঞ্জারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই কিংবা অন্য কোনাে একজন উচ্চপদস্থ চীনা নেতার বৈঠকের প্রস্তাব করছেন। ড. কিসিঞ্জার চীন গিয়ে সেই বৈঠকে অংশ নেবেন এবং তা হবে এমন একটি স্থানে যা পাকিস্তানের সীমানা থেকে বেশি দূরে নয়। বৈঠকে কিসিঞ্জার মার্কিন প্রেসিডেন্টের সময়সূচি নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করবেন। তবে এ মুহূর্তে বৈঠকটি অত্যন্ত গােপনে হওয়াই বাঞ্ছনীয় হবে বলে আমেরিকা মনে করছে।
সে হিসেবে কিসিঞ্জার চীনে তার গােপন সফরে যাবেন ১৫ জুন বা তার পরবর্তী যে কোনাে এক সময়ে এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার যাবার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। চিঠিতে আশা প্রকাশ করা হয় যে ইয়াহিয়া খান ছাড়া যােগাযােগের জন্য অন্য কোনাে মাধ্যম ব্যবহার করা হবে না এবং চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে কিসিঞ্জারের বৈঠকের গােপনীয়তা কঠোরভাবে পালন করা হবে।
২৯ মে বেইজিং থেকে অনুরূপভাবে চৌ এন লাইয়ের আরেকটি মেসেজ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠানাে হয়। মেসেজে বলা হয়,
প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মেসেজগুলাে অত্যন্ত মনােযােগের সঙ্গে দেখেছেন এবং চেয়ারম্যান মাও সে তুং ও চৌ এন লাই নিক্সনের কাছ থেকে সাড়া পেয়ে অত্যন্ত পুলকিত হয়েছেন। নিক্সন পিকিং সফর করার ফলে
পৃষ্ঠা: ১১৮

পিকিং ও ওয়াশিংটনের নেতাদের সরাসরি আলােচনার মাধ্যমে অনেক প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যাবে।
এটা বলার কোনাে অপেক্ষা রাখে না যে, চীন ও আমেরিকার মধ্যে বিদ্যমান বিবাদের মূল উপলক্ষ হলাে তাইওয়ান, এবং তাইওয়ান প্রণালী থেকে মার্কিন সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহারের উপায় উদ্ভাবনের বিষয়টি আলােচনায় প্রাধান্য পাবার দাবি রাখে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই সফরের অগ্রবর্তী প্রতিনিধি হিসেবে কিসিঞ্জারকে সাদরে গ্রহণ করবেন।
প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই মনে করেন যে ড. কিসিঞ্জার জুন মাসের ২০ তারিখের মধ্যে চীন সফরের ব্যবস্থা নিলে ভালাে হয়। সেই দেখাসাক্ষাৎ হবে পিকিং-এ এবং ইসলামাবাদ থেকে সরাসরি বিশেষ এক ফ্লাইটে তাকে জনবিহীন একটি এয়ারপাের্টে নামানাে হবে। তিনি ইচ্ছা করলে পাকিস্তানি বােয়িং ব্যবহার করতে পারেন অথবা চীন থেকে কিসিঞ্জারকে আনা নেয়ার জন্য বিশেষ চীনা বিমান পাঠানাের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আলােচনা ও কিসিঞ্জারের আসা যাওয়ার জন্য তিন থেকে চার দিন সময়ের প্রয়ােজন হতে পারে। কিসিঞ্জার ইচ্ছা করলে বাইরে যােগাযােগের জন্য নিজের কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারবেন।
কিসিঞ্জারের সফরের বিষয়টি গােপন রাখার কাজটি হবে যথেষ্ট কঠিন। তাই ইচ্ছে করলে কিসিঞ্জার প্রকাশ্যেও চীনে আসতে পারেন। এর পরেও গােপনীয়তার সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে গণচীন সরকার গােপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষার সব রকম নিশ্চয়তা দিচ্ছে। কথাবার্তায় সুফল পাওয়া গেলে অবশ্য
দু’পক্ষ মিলে একটা বিবৃতি প্রকাশ করা যাবে। ১ জুলাই কিসিঞ্জার এক সরকারি সফরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলােতে তার যাত্রা শুরু করেন। কিসিঞ্জার এবং তার সফরসঙ্গীরা সফরের এক পর্যায়ে পাকিস্তান এসে পৌঁছলে ইয়াহিয়া খান একটি গােপন পরিকল্পনা নেন।১৭ ডিনারের সময় কিসিঞ্জার হঠাৎ করে অসুস্থতার ভান করে সেখান থেকে বের হয়ে যান। গেস্ট হাউসে প্রহরাধীন অবস্থায় বিশ্রাম নেয়ার ছলে মধ্যরাতে কিসিঞ্জারকে ছােট একটি এয়ারফিল্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। সারা বিশ্বের প্রচার মাধ্যম, মার্কিন দূতাবাসের কর্মচারীরা কিংবা নিক্সনের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এ ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পেলেন না।
প্লেনে উঠে কিসিঞ্জারের দেহরক্ষী চেয়ারম্যান মাওয়ের ছবি লাগানাে জ্যাকেট পরা চাইনিজ আরােহী দেখে ঘাবড়ে যান। তিনি আশঙ্কা করেন যে কিসিঞ্জার বােধ হয় চাইনিজদের হাতে কিডন্যাপ হতে যাচ্ছেন। কিন্তু কিসিঞ্জার নিজেই তাকে শান্ত করেন।
ভাের ৪টায় প্লেন ছাড়ার সময় কিসিঞ্জার দেখতে পান যে পরনের একটি শার্ট ছাড়া বাড়তি কোনাে কাপড় তিনি সঙ্গে আনেননি। তিনি তখন এমন একটি দেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে দেনদরবার করতে যাচ্ছিলেন যার সঙ্গে ২০ বছরেরও বেশি
পৃষ্ঠা: ১১৯

সময় যাবৎ আমেরিকার কোনাে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই—আর তার পরনে ছিল অপরের কাছ থেকে ধার করা বেখাপ্পা সাইজের একটা ঢলঢলে শার্ট।
১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীন সফর করেন। অথচ তিনি যখন চীন সফর করেন তখন তার সফরের প্রেক্ষাপট সাজানাের নায়ক ইয়াহিয়া খান গভীর সমস্যায় নিমজ্জিত, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ আক্রমণের মুখে পরাজিত ও বিধ্বস্ত।

তথ্য নির্দেশিকা
১. নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন। ১৯৪৯ সালে স্থাপিত এই সংগঠনের সদস্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলাে।
২. এর সদস্যদের মধ্যে ছিল সােভিয়েত ইউনিয়ন, আলবেনিয়া, পােল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া ও পূর্ব জার্মানি।
৩. টমাস ওয়াইগেন্ড, দ্য ফিউচার অব দ্য ইউ এস চীন রিলেশন, ওয়ার্ল্ড সিকিউরিটি নেটওয়ার্ক, ২০ অক্টোবর, ২০০৫।
৪. সিনাে-আমেরিকান রিলেশন্স, ওয়াইকিপিডিয়া, রিলেশন্স ফ্রোজেন।
৫. প্রাগুক্ত।
৬. প্রাগুক্ত।
৭. যে, পি, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স সিন্স ১৯৪০, লন্ডন। লংমান, পৃ ২৫৫।
৮. তদানীন্তন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মােহাম্মদ খানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ধারা বিবরণী। সূত্র : আমেরিকা এক্সপেরিয়েন্স : নিক্সন’স চায়না গেইম, পি বি এস ডট অর্গ।
৯. ফরেন অ্যাফেয়ার্স, অক্টোবর ১৯৬৭, রিচার্ড নিক্সন, এশিয়া আফটার ভিয়েতনাম।
১০. নিক্সনের হাতে লেখা নােট, জানুয়ারি ২০-২১, অফিস অব হিস্টোরিয়ান, ভলিউম ৭, চীনা ১৯৬৯-৭২।
১১. রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড সফরে প্রেসিডেন্ট নিক্সন দক্ষিণ ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনস, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও রুমানিয়া সফর করেন এবং ব্রিটেনেও স্বল্পকালীন যাত্রাবিরতি করেন।
১২. প্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কিসিঞ্জারের বৈঠকের মেমােরেন্ডাম, আগস্ট ৬, ১৯৬৯।
১৩. সুলতান মােহাম্মদ খান, প্রাগুক্ত।
১৪. নিক্সন ট্রাভেলস চায়না, ইউনাইটেড স্টেটস হিস্টরি ইউ-এস হিস্টরি ডট কম।
১৫. ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, এন এস সি ফাইলস, চীনা মেটেরিয়ালস, বক্স নং ১০৩১
১৬. ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, এন এস সি ফাইলস, চীনা মেটেরিয়ালস, বক্স নং ১০৩১, ওয়াশিংটন, মে ১০, ১৯৭১।
১৭. এই পরিকল্পনার নাম দেয়া হয়েছিল মার্কো পােলাে, প্রাগুক্ত।
পৃষ্ঠা: ১২০

Ref: মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম