You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারত-মার্কিন সম্পর্কের সূত্রপাত | মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম

সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার পারমাণবিক স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই উপমহাদেশে সম্ভাব্য কমিউনিস্ট আগ্রাসন ঠেকানাের জন্য আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়ায় মিত্রের অনুসন্ধান শুরু করে। এ সময় গােটা অঞ্চলেই কৌশলগত প্রভাব বিস্তার ছিল আমেরিকার কাছে মুখ্য প্রশ্ন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দক্ষিণ এশিয়া জাপানের স্থল ও নৌবাহিনীর আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়। আমেরিকার কাছে। প্রশ্ন ছিল, এর পর কমিউনিস্ট চীন ও সােভিয়েতের কাছ থেকে দক্ষিণ এশিয়া কতটুকু আগ্রাসনের শিকার হতে পারে? এ সময় আমেরিকার উদ্দেশ্য ছিল ভারত ও পাকিস্তানকে বহিঃশত্রুর হামলা থেকে রক্ষা করা, এই দুই দেশে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা, যার মাধ্যমে আমেরিকা প্রয়ােজনবােধে সােভিয়েত রাশিয়ার ওপর হামলা চালাতে পারে এবং দুই দেশকেই অভ্যন্তরীণ কমিউনিস্টদের উৎপাত থেকে রক্ষা করা। প্রথমদিকে আমেরিকার লক্ষ্য ছিল ভারতে প্রভাব বিস্তার করা ও পাকিস্তানে ঘাঁটি স্থাপন করে সেখান থেকে দূরপাল্লার বােমারু বিমানের সহায়তা দিয়ে পারস্য উপসাগর এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখা।১

ভারতকে অত সহজে কাবু করা সহজ না হলেও আমেরিকা পাকিস্তানকে সহজেই রাজি করাতে সক্ষম হয়। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে প্রচুর পরিমাণ সামরিক সাহায্য দিয়ে আমেরিকা পাকিস্তানকে বাগদাদ চুক্তি২ ও সিয়াটোতে যােগ করে নেয়। ইতােমধ্যে ভারত তার জোটনিরপেক্ষ নীতির কারণে কোনাে সামরিক জোটে যােগ দিতে অস্বীকার করে। ফলে আমেরিকার একমাত্র লক্ষ্য থাকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যের ভিত্তিতে ভারতকে আমেরিকার প্রতি নির্ভরশীল করে রাখা। ১৯৬০ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে চার বছরের জন্য ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের একটি পিএল-৪৮০ খাদ্যচুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এ সময় ভারত আমেরিকার কাছ থেকে ৫৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করে। ১৯৬২ সালে চীন ভারত যুদ্ধের পর আমেরিকার কাছ থেকে। ভারত ৮০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্যের অনুদান লাভেও সক্ষম হয়।৩

পৃষ্ঠা: ৭৯

আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তান ও ভারতকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দেয়া ছাড়াও আমেরিকা এ সময় অভ্যন্তরীণভাবে উপমহাদেশের অঞ্চলবিশেষে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তােলায় সাহায্য করে। বিশেষ করে ১৯৪৯ সালে কমিনটানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিপ্লবী আন্দোলনের ডাক দেয়া হলে আমেরিকা পাকিস্তান ও ভারত উভয়কে কমিউনিজমের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে নানা ধরনের উন্নয়ন, গােয়েন্দা ও তথ্য-যােগাযােগ পরিকল্পনা হাতে নেয়। আমেরিকা ধরে নেয় যে, ভারতের কমিউনিস্টরা মূলত সােভিয়েতের দিকে এবং পাকিস্তানের কমিউনিস্টরা চীনের দিকে ঝুঁকছে যার দুটোই ছিল আমেরিকার জন্য বিপজ্জনক। ফলে আমেরিকা বিশাল পরিমাণে উদ্বৃত্ত খাদ্য, অর্থনৈতিক সাহায্য ও কারিগরি এবং কৃষি মিশন নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানে এসে তাদের কমিউনিস্ট প্রভাব থেকে সরানাের চেষ্টা করে। আমেরিকার ধারণা ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযােগিতা করে এ সমস্ত দেশকে কমিউনিজমে নিরুৎসাহিত করা যাবে এবং অঞ্চলের জনগণকে গণতন্ত্রমুখী করা যাবে।৪

প্রথম থেকেই আমেরিকা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্বের কোনাে কারণ ও সম্ভাবনা খুঁজে পায়নি। আমেরিকার ধারণা ছিল, ভারতের ওপর প্রথম আঘাত আসবে কমিউনিস্ট চীন থেকে এবং পাকিস্তানের ওপর আঘাত হানবে সােভিয়েতরা। দক্ষিণ ভিয়েতনামের ওপর চীনের আঘাতের পর বিষয়টি আরাে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমেরিকা বুঝতে পারে যে, ভিয়েতনামে চীনের প্রভাব বিস্তার সফল হলে ভারতেও কমিউনিজম চলে আসবে। ফলে ভিয়েতনাম নিয়ে আমেরিকার যতটা না ভয় ছিল, জনসংখ্যা এবং সম্পদের বিচারে ভারতের ব্যাপারে তাদের ভয় ছিল তার চাইতে বেশি। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই উইলিয়াম রস্ট্রো দক্ষিণ এশিয়ায় সাহায্য বাড়ানাের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়াকে কমিউনিস্ট আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার কমিউনিস্টবিরােধী হামলা পরিচালনায় সমর্থন জানিয়েছিলেন।৫

তবে ভারতের কড়া জোটনিরপেক্ষ নীতির কারণে আমেরিকা সব সময় ভারতকে সমর্থন করে চলেছে। আমেরিকা এমন ধারণা পােষণ করেছে যে, যেহেতু ভারত আমেরিকার শত্রু নয়, সেহেতু আমেরিকার অত ঘনিষ্ঠ জোটবদ্ধ বন্ধু হবারও প্রয়ােজনীয়তা নেই। তাদের কাছে নেহেরুর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ছিল অনেকটা নির্বিষ সাপের মতাে, যে প্রচণ্ড ফনা তুলে ভয় দেখালেও দংশনে ক্ষতির আশঙ্কা ছিল না বললেই চলে।৬

জন ফস্টার ডাল্লেস৭ এ সময়ে স্নায়ুযুদ্ধে ভারতের নীরবতার সমালােচনা করেছেন। তার মতে, পারমাণবিক স্নায়ুযুদ্ধে কোনাে পক্ষ অবলম্বন না করে ভারত অনৈতিক কাজ করেছে। কিন্তু তিনি কিংবা কোনাে আমেরিকান কর্মকর্তা নেহেরুর নিরপেক্ষতাকে ক্ষতিকর বলতে পারেন নি। এর প্রধান কারণ হলাে, স্নায়ুযুদ্ধকে

পৃষ্ঠা: ৮০

ভারতের পক্ষ থেকে সব সময় ভিন্নতরভাবে ব্যাখ্যায়িত করা হয়েছে। নেহেরুর আসল উদ্দেশ্য ছিল স্নায়ুযুদ্ধে পক্ষ অবলম্বন না করে দুই পক্ষের কাছ থেকে সহযােগিতা সংগ্রহ। পরবর্তীকালে ভারত নিজে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হলেও এ নীতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।

ভারত স্নায়ুযুদ্ধকে ব্যাখ্যা করেছে সামরিকায়ন হিসেবে। নেহেরুর মতে স্নায়ুযুদ্ধ ছিল একটা অস্ত্রের প্রতিযােগিতা যা অচিরেই পারমাণবিক অস্ত্র যুদ্ধে পরিণত হবে এবং সারা পৃথিবীকে গ্রাস করবে।৮ হিরােশিমায় পারমাণবিক বােমা বিস্ফোরণে তিনি কঠোর আঘাত পেয়েছিলেন এবং হােমি ভাবাকে৯ পারমাণবিক রি-অ্যাক্টর বানাতে নির্দেশ দেয়ার সময় বলেছিলেন, এখানে কোনাে পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে কিংবা পরীক্ষা করার অনুমতি দিয়ে সারা পৃথিবীকে ধ্বংসযজ্ঞ বানাবার প্রচেষ্টা নেয়া যাবে না, যা আমেরিকান ও রাশিয়ানরা তাদের বিশাল পারমাণবিক বােমার যুদ্ধ দিয়ে ইতােমধ্যেই বিপদাপন্ন করে ফেলেছে।

অন্যদিকে, দারুণভাবে অস্ত্রভারে সুসজ্জিত একটি বিভক্তিতে পৃথিবী ভাগ হয়ে যাওয়ার অর্থ হলাে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কোটি কোটি দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য কম অর্থনৈতিক সাহায্য, কারণ, পারমাণবিক অস্ত্রযুদ্ধে ব্যাপৃত হওয়ায় পরাশক্তিগুলাে সঙ্গত কারণেই অর্থনৈতিক সহযােগিতা কমিয়ে দেবে। আমেরিকানদের ভারতীয়রা জন্মলগ্ন থেকেই দেখে এসেছে অতি উন্নত বাস্তববাদী একটি বহুধার্মিক রাষ্ট্র হিসেবে। ভারতীয়দের সব সময়ই ভয় ছিল যে, আমেরিকা এক সময়ে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ভারতের আঞ্চলিক প্রভাবের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অথচ সেই ১৯২৭ সালেই নেহেরু লিখেছিলেন যে সােভিয়েত ইউনিয়ন কখনাে ভারতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না।১০ ভারতীয়দের বিশ্বাস ছিল যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন কোনাে উপনিবেশবাদী শক্তি নয় এবং উপনিবেশবাদী সম্প্রসারণবাদের অনুসারী নয়। কাজেই সােভিয়েত রাশিয়ার আপাত অক্ষতিকর চরিত্রের প্রতি ভারতীয়দের আস্থা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি।

ভারতীয়দের মতে, সােভিয়েত ইউনিয়ন একটি একনায়ক রাষ্ট্র, কিন্তু ভারত সব সময়েই সােভিয়েতকে না ঘটাতে আমেরিকাকে পরামর্শ দিয়েছে। মােরারজি দেশাই একবার প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে বলেছিলেন, যদি ওদের সঙ্গে ভালাে ব্যবহার কর তা হলে এক সময় তাদের মানসিকতার পরিবর্তনও ঘটতে পারে।১১

অন্যদিকে পাকিস্তানকে সহযােগিতা করে আমেরিকা ভারতকে বিশাল অস্ত্র প্রতিযােগিতার দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।১২ ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে আমেরিকার সামরিক সাহায্য পাকিস্তানকে একটি শক্তিশালী, যােদ্ধা রাষ্ট্রে পরিণত করে। এ সময় আমেরিকা পাকিস্তানকে প্রথম শ্ৰেণীর ফ্যান্টম, এম-৪৮ ট্যাংক, এফ-৮৫ আধুনিক জেট এয়ারক্রাফট এবং নৌবাহিনীর জন্য সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে। পাক-বাহিনীকে সর্বোচ্চ মানের

পৃষ্ঠা: ৮১

সামরিক প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। ১৯৫৯ নাগাদ এই ধরনের সহযােগিতা অব্যাহত থাকলে এক সময় সবার মনে ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে সামরিকভাবে ভারত আর পাকিস্তানের সঙ্গে পেরে উঠবে না। কিন্তু ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে এসে সেই ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। পাকিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন মহল থেকে ১৯৬৫ সালের জয় পরাজয় নিয়ে নানা কল্পকাহিনী রচনা করা হলেও এ ব্যাপারে অধিকাংশই একমত প্রকাশ করেন যে যুদ্ধে ভারতের তুলনায় পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি।

পাক মার্কিন গভীর সম্পর্কের কারণে ভারত-মার্কিন শীতলতার আরাে একটা স্পষ্ট কারণ ছিল। আমেরিকার বিপুল পরিমাণে অস্ত্র সাহায্য পাকিস্তানকে এমন একটা ধারণা দিয়েছিল যে, যুদ্ধক্ষেত্রে তারা দিল্লির সমকক্ষ। ভারতের সাবেক এয়ারফোর্স প্রধান এয়ার মার্শাল কে ডি চাধা এ ব্যাপারে ভারতীয়দের মনােভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতার সুবাদে পাকিস্তানের অফিসার ও জনগণ ছিল বেপরােয়াভাবে উজ্জীবিত। মিলিটারি অফিসারেরা আমেরিকার প্রশিক্ষণ পেয়ে মনে করতেন যে, তারা সুপার হিউম্যানে। পরিণত হয়েছেন। তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে ভারতকে একটা ঠেলা দিলেই পড়ে যাবে। তারা অনেকেই এমন মনে করতেন এবং এমন কথা প্রচার করতেন যে১৩ একজন পাকিস্তানি সৈন্য ৮ জন বা ১০ জন ভারতীয় সৈন্যের সমকক্ষ। একপর্যায়ে পাকিস্তান এমন সংবেদনশীল হয়ে যায় যে, কাশ্মীর প্রশ্নে তারা কোনাে সমঝােতায় আসতে অস্বীকার করে। তারা ধরে নেয় সেখানে আর রাজনৈতিক সমঝােতার কোনাে প্রয়ােজনীয়তা নেই এবং সামরিকভাবেই এই সমস্যার সমাধান ঘটানাে সম্ভব অথবা চাপ দিয়ে ভারতের কাছ থেকে সুবিধাজনক কনসেশন আদায় করা সম্ভব হবে।১৪

এভাবে দিল্লির দৃষ্টিতে পাক-আমেরিকান সম্পর্ক ছিল কমিউনিস্টবিরােধী নয়, বরং ভারতবিরােধী এবং ভবিষ্যৎ ভারত-মার্কিন সম্পর্ক সে ধারণাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ভারত মনে করতাে যে, আমেরিকা আসলে ভারতের শত্রুকে লালন পালন করছে এবং উপমহাদেশে কমিউনিস্ট প্রভাব রুখতে যাওয়াটা একটা বাহ্যিক উপলক্ষ্য মাত্র।

এর পাশাপাশি, চীন-ভারত উত্তেজনাও ছিল মার্কিন-ভারত সম্পর্কোন্নয়নের পেছনে একটি শক্তিশালী নিয়ামক শক্তি। চীনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের দোদুল্যমানতা দিয়েও ভারত-মার্কিন সম্পর্ক বারবার দোলায়িত হয়েছে। ১৯৪৯ চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসার পরপরই আমেরিকা ভারতকে চীনা বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল। এর পরেও নেহেরু কোরিয়ার ব্যাপারে নিরপেক্ষ থেকেছেন এবং ভারত-চীন সীমান্তে তিব্বতের বিরােধযুক্ত এলাকায় চীনকে ছাড় দিয়েছেন। কিন্তু এশিয়ার এ দুই শক্তি যখন ১৯৬২ সালে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তখন।

পৃষ্ঠা: ৮২

আমেরিকার সেই সতর্কবাণীই সত্য বলে প্রমাণিত হয়। এ সময়েই দিল্লি ও ওয়াশিংটন একটি ঘনিষ্ঠ গােয়েন্দা ও কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন করে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আমেরিকা এর পর ভিয়েতনামের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেললে সেখানেও কমিউনিস্টদের দমনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। এভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় স্থানান্তরিত হয় এবং আমেরিকা-ভারত সম্পর্কের নতুন ভিত্তি গড়ে উঠতে থাকে।

ভারত, আমেরিকা ও কাশ্মীর

স্নায়ুযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তীকালে ভারত-আমেরিকার সম্পর্কে যেমন পরস্পরের মধ্যে সন্দেহের বীজ উপ্ত হয়েছে, তেমনি ভারতের পক্ষে আমেরিকান মনােভাব ইতিবাচকভাবেও সাড়া দিয়েছে। এর সার্বিক প্রতিফলন দেখা দেয় কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে আমেরিকার আগ্রহের ভেতর দিয়ে।

কাশ্মীরের ভূমির ওপর পাকিস্তান এবং ভারতের অধিকারের দাবি এবং কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্ৰাধিকার এই তিন মিলে কাশ্মীর সমস্যা একটি ত্রিমুখী জটিল সমস্যা। ১৯৪৭ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যেমন সীমানাগত দ্বন্দ্ব রয়েছে, তেমনি রয়েছে কাশ্মীরে অনুপ্রবেশকারী সমস্যা। অনুপ্রবেশকারীদের একাংশ পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হতে আগ্রহী, আবার অন্য এক অংশ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিদার।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরের শাসনকর্তা ছিলেন পশতু দুররানী সাম্রাজ্য। ১৮১৯ সালে শিখ শাসক রঞ্জিত সিং কাশ্মীর জয় করেন। ১৮৪৫ ও ১৮৪৬ সালে এ্যাংলাে-শিখ যুদ্ধের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাশ্মীরের কর্তৃত্বভার গ্রহণ করে ও পরে তা এক চুক্তির মাধ্যমে গুলাব সিংয়ের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি পর্যন্ত কাশ্মীর ছিল হিন্দু মহারাজাদের শাসনে, অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল মুসলমান।

ভারত বিভক্তির সময় পাকিস্তানের প্রত্যাশা ছিল কাশ্মীর তার সীমানার সঙ্গে যুক্ত হবে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ভারত শাসন আইনে কাশ্মীরকে ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে যােগ দিতে অথবা স্বাধীন থাকার অনুমতি দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পশ্চিম কাশ্মীরের মুসলিম বিপ্লবীরা দির-এর পাকিস্তানি উপজাতীয়দের সহযােগিতায় কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করে ও ডােগরা বাহিনীর হাত। থেকে কাশ্মীরকে দখল করার চেষ্টা করে। মহারাজা হরি সিং ভারতে আশ্রয় নেন।

মহারাজা কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চাইছেন, এই আশঙ্কায় জঙ্গি মুসলিম বিপ্লবী ও পাকিস্তানি উপজাতীয়রা বারামুল্লা সেক্টরে অভিযান চালায়। হরি সিং ভারতের সাহায্য কামনা করেন, কিন্তু পাকিস্তান ও ভারত পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত না হতে চুক্তিবদ্ধ থাকায় ভারত সেখানে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকে।

পৃষ্ঠা: ৮৩

পাক উপজাতীয়রা শ্রীনগরের কাছাকাছি এসে পৌঁছলে মহারাজা ভারতীয় সাহায্যের জন্য বেপরােয়া হয়ে ওঠেন। ভারত শর্ত দেয় যে, ভারতের সাহায্য পেতে হলে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের হাতে তুলে দিতে হবে। চুক্তি স্থাপনের পর ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানিদের সেখান থেকে হটিয়ে দেয়।

১৯৪৮ সালে ভারত কাশ্মীর প্রশ্নে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। কিন্তু কাশ্মীর শাসক শেখ আব্দুল্লাহ এই ভেবে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চাননি যে ভারত গােটা কাশ্মীর থেকে অনুপ্রবেশকারীদের সরিয়ে দিতে পারে। ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল নিরাপত্তা পরিষদ এক প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও উপজাতীয়দের সরে যেতে বলে। একই সঙ্গে এলাকায় একটি গণভােট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে অঞ্চলে সৈন্যসংখ্যা সীমিত করার জন্য ভারতকে নির্দেশ দেয়া হয়। বলা হয় যে, গণভােটে নির্ধারিত হবে কাশ্মীরবাসী ভারত না পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হতে চায়।

১৯৪৮ সালের নভেম্বরে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ে গণভােটে রাজি হলেও পাকিস্তান কাশ্মীর থেকে সৈন্য অপসারণে আপত্তি জানায়। ফলে গণভােট আর অনুষ্ঠিত হয়নি। পাকিস্তানিরা দাবি করছিল যে, সৈন্য উঠিয়ে নিলে কাশ্মীরবাসীরা অবাধে ভােট দিতে পারবে না। অন্যদিকে ভারত পাকিস্তানের সকল সৈন্য অপসারণের চাপ অব্যাহত রাখে। পাকিস্তান যুগপৎভাবে সৈন্য অপসারণ ও গণভােট অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিলে ভারত তাতে রাজি হয়নি। এরপর কয়েক বৎসরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে পরপর চারটি প্রস্তাব পাস করলেও সেগুলাের কার্যকর কোনাে ভূমিকা ছিল না। পাকিস্তান চারটি প্রস্তাবেই রাজি থাকলেও ভারত কোনাে না কোনাে কারণে সেগুলাে উপেক্ষা করে। অন্যদিকে জাতিসংঘের প্রস্তাবের পক্ষে বাধ্যবাধকতার সঙ্গে কার্যকর করার কোনাে শর্ত না থাকায় শেষ পর্যন্ত সেগুলাে অমীমাংসিতই থেকে যায়।১৫

১৯৪৮ থেকেই আমেরিকা কাশ্মীর সমস্যা সমাধান করার জন্য অবদান রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। আমেরিকা তার আঞ্চলিক কৌশলগত কারণে না হলেও প্রতিবারেই অস্থায়ী ভিত্তিতে কাশ্মীর সমস্যার কোনাে না কোনাে সমাধান ঘটানাের চেষ্টা করেছে। অবশ্য ভূ-রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমেরিকার এই সহযােগিতার মনােভাবকে ভারত ও আমেরিকার পক্ষ থেকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যায়িত করার অবকাশ রয়েছে।

টুম্যান, আইসেনহাওয়ার ও কেনেডি প্রশাসন সকলের তরফ থেকেই কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমেরিকা সম্মিলিত জাতিসংঘের কাঠামাের আওতায় ব্রিটেনের সঙ্গে মিলেও কাজ করেছে, জাতিসংঘকে শান্তিসৈন্য পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং বিরােধপূর্ণ কাশ্মীর এলাকায় যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘে পরিদর্শক পাঠানাের উদ্যোগ নিয়েছে আইসেনহাওয়ার প্রশাসন।

পৃষ্ঠা: ৮৪

আরেকটি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের আশঙ্কা করে দু’দেশের মধ্যে সমঝােতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে, যদিও সে প্রচেষ্টায় কোনাে কাজ হয়নি। তবে আইসেনহাওয়ারের দ্বিতীয় দফায় প্রশাসনের সময় সিন্ধুনদের পানিবণ্টনের একটি সমস্যার সমঝােতামূলক সমাধান সম্ভব হয়। বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে এই পানিবণ্টনের দেনদরবার অনুষ্ঠিত হলেও আমেরিকা প্রকল্প স্থাপনের জন্য ১ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য প্রদান করে। ওয়াশিংটন সেখানে লাে-প্রােফাইল মেইনটেইন করলেও অর্থনৈতিক সাহায্য ও কূটনৈতিক উৎসাহ সমঝােতায় বিশেষ ভূমিকা রাখে।

১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর আমেরিকা কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের পক্ষে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়। এ সময় কেনেডি প্রশাসন এক ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়। প্রেসিডেন্ট পর্যায়ের উৎসাহ এবং কঠোর চাপ ও প্রলােভন দেয়া সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পাকিস্তান কখনাে চীন-ভারত সংঘর্ষকে গুরুত্ব দেয়নি এবং বারবার প্রচার করার চেষ্টা করেছে। যে, আমেরিকার কাছ থেকে বাড়তি সামরিক সাহায্য সংগ্রহের জন্যই ভারত বারবার চীন-ভারত দ্বন্দ্ব নিয়ে অতিশয়ােক্তি করছে।১৬

আমেরিকা সব সময়ই এ ধরনের সমস্যা সমাধানের যেসব প্রচেষ্টা চালিয়েছে তার মূল লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় কমিউনিস্ট আগ্রাসন বন্ধ করা। আমেরিকার ধারণা ছিল যে, দক্ষিণ এশিয়ায় বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব থাকলে তা হবে কমিউনিস্ট চাষের জন্য উর্বর ক্ষেত্র। কাজেই ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর প্রশ্নে কোনাে সমঝােতায় আসুক তা ছিল আমেরিকার একান্তভাবে কাম্য।

লিন্ডন বি জনসন, যিনি ছিলেন কেনেডির তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে নিস্পৃহ, অবশ্য সেই প্রবণতা আর অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি নিজে সেখানে জড়িত হতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন এবং পরিবর্তে জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবকে সমর্থন দেন। পরবর্তীকালে তিনি তাসখন্দে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদনের জন্য সােভিয়েত উদ্যোগকেও সমর্থন জানান।১৭

ভারতে আমেরিকান সাহায্যের প্রথম তিনটি দৃষ্টান্ত ছিল মূলত অর্থনৈতিক সাহায্য। অবশ্য ভারত ভিয়েতনাম সরকারকে সমর্থন দেয়ায় এই সম্পর্কে কিছুটা তিক্ততাও ছিল। ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে ভারতে কৃষি সংস্কার চালানাের জন্য আমেরিকা চাপ প্রয়ােগ করে। এ সময় লিন্ডন বি জনসনের প্রশাসন ভারতে পিএল৪৮০ ভিত্তিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়, যদিও ভারতের কোনাে কোনাে স্থানে বিরাজ করছিল দুর্ভিক্ষাবস্থা। এসময় স্বল্প পরিমাণে খাদ্য সাহায্য অব্যাহত থাকলেও সাহায্যের নিষেধাজ্ঞা ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। এর ফলে একদিকে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে নিদারুণ তিক্ততার সৃষ্টি হলেও পক্ষান্তরে দীর্ঘমেয়াদে ভারত লাভবানই হয়। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার সুবাদে ভারতে ব্যাপক

পৃষ্ঠা: ৮৫

কৃষি সংস্কার সাধিত হয়। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এ সময় ধরে নিয়েছিলেন যে, আমেরিকা আসলে একই সঙ্গে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দিয়ে পক্ষান্তরে ভারতের সার্বভৌমত্বের ওপরই আঘাত করছে।১৮

১৯৬৯ সালে পাকিস্তান ভারতে আমেরিকার অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে দক্ষিণ এশীয় সামরিক সরবরাহ নীতির প্রভাবে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও ইতােমধ্যে খাদ্য ও অর্থনৈতিক সাহায্য একরকম স্বাভাবিকভাবেই শুরু করে দেয়া হয়। একই বছর ২০ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স। হেনরি কিসিঞ্জার হােয়াইট হাউসে পাঠানাে এক গােপন প্রতিবেদনে ভারতে আমেরিকার অর্থনেতিক সাহায্যের প্রাথমিক প্রস্তাব দেন।১৯ এতে বলা হয় যে,

ভারতে অর্থনৈতিক সাহায্য এপ্রিলে চূড়ান্ত করার কথা থাকলেও এর আগেই ভারতে খাদ্য সাহায্য পাঠানাের সুপারিশ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ৩০ মিলিয়ন ডলারের চাউল ও ভেষজ তৈল এবং ২৫ মিলিয়ন ডলারের জোয়ার বা ভুট্টা। আগেভাগেই খাদ্য সরবরাহ করার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তাদের গুদাম খালি করতে চাইছে। গতবছর খাদ্যের উৎপাদন হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত বেশি। ভিয়েতনামের চাহিদা মেটানাের জন্য বেশি পরিমাণে উৎপাদন করা হয়েছিল অথচ তাদের চাহিদা ছিল নামে মাত্র।

এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টও খাদ্য গুদামজাতকরণ ও ক্রয়ের বাড়তি ব্যয় এড়াতে চাইছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তিনি বলেন,

ভারত ভুট্টার ব্যাপারে নিদারুণ উৎসাহী, কারণ এবছর দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা না থাকলেও ন্যায্যমূল্যের ভিত্তিতে ভুট্টা২০ বিক্রি করলে শহর এলাকায় খাদ্যমূল্যের ওপর চাপ কমে আসবে। খাদ্যের এই চালান হবে ১৯৬৯ সালের জন্য প্রতিশ্রুত খাদ্য কর্মসূচির অংশ (১৭০ মিলিয়ন ডলার)। এই কর্মসূচি সামনের মাসে পর্যালােচনা করে আরাে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের নয়া গম ও তুলা সরবরাহের সঙ্গে যােগ করা হবে।

১৯৬৯ সালের মাঝামাঝিতে গিয়ে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা হঠাৎ করে টালমাটাল হয়ে ওঠে। ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস পার্টি সহসা সংকটের সম্মুখীন হয়। অনেকে মনে করেতে থাকেন যে, এ অবস্থায় হয়তাে ইন্দিরা গান্ধীকে পদত্যাগ করতে হতে পারে। কংগ্রেসের ভেতরে ওল্ডগার্ড দলীয় রাজনীতিবিদ ও ইন্দিরা গান্ধীর অনুসারী নব্য রাজনীতিবিদদের মধ্যে সংঘাত ছিল এই সংকটের কারণ। ওল্ডগার্ড অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হােম মিনিস্টার চ্যাবন এবং ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার দেশাই।২১ এর ফলে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আসন্ন দিল্লি সফর অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। মেমােরেন্ডামে বলা হয়,

পৃষ্ঠা: ৮৬

আগের সপ্তাহে ব্যাঙ্গালােরে অনুষ্ঠিত এক পার্টি বৈঠকে মূলত দুটি বিষয়ে আলােচনা হয়। সেগুলাে ছিল ১৪টি বৃহদাকার ব্যাংক জাতীয়করণ ও ১৬ আগস্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনােনয়ন। মিসেস গান্ধী ব্যাংকের প্রশ্নটি অনুমােদন করিয়ে নেন, কিন্তু তা করতে গিয়ে দলের বিরােধীদের সমর্থন হারান। চ্যাবন এবং দেশাই আপাতভাবে নিম্নকক্ষের স্পিকার সঞ্জীব রেড্ডিকে সমর্থন দেন। এবং সমর্থনের পাল্লা ভারী থাকায় দলীয়ভাবে তাকেই প্রার্থী মনােনীত করতে হয়। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নেন। গিরি বলেন যে, তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্টের নির্বাচন করবেন। ইন্দিরা গান্ধী তখন পর্যন্ত এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য দলের অন্যান্য নেতার সঙ্গে দেনদরবার করছিলেন।

ভারতের প্রেসিডেন্টের পদটি একটি আনুষ্ঠানিক পদ হলেও ২০ বছর যাবৎ সংসদে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় সেখানে একধরনের স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। কয়েকটি রাজ্য সরকারের অস্থিতিশীলতা এবং সেসব জায়গায় বিরােধী দলের কাছে পরাজয়ের কারণে২২ পদটির গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছিল, কারণ সাংবিধানিকভাবে রাজ্যে হস্তক্ষেপ করেন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী নন। অন্যদিকে ১৯৭২ সালের আসন্ন নির্বাচনে কোয়ালিশন সরকার গঠনের জোর সম্ভাবনা থাকায় ইন্দিরা গান্ধী অবশ্যই বন্ধুভাবাপন্ন একজনকে রাষ্ট্রপতি পদে দেখতে চাইছিলেন।

১৬ জুন দেশাই কেবিনেট থেকে পদত্যাগ করেন। মনে করা হয় যে ব্যাংক জাতীয়করণের বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধীর কর্মসূচির বিরােধিতা করায়ই তাকে সরে যেতে হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়ায় তিনি এখন আর অলংকারিক পদ উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকতে চাইছেন না। চ্যাবন অবশ্য কেবিনেটে থেকে যান। কিসিঞ্জারের মেমােরেন্ডামে বলা হয়,

দিল্লি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রবর্তী টিমের সদস্যরা জানাচ্ছেন, গিরির পদত্যাগ এবং ইন্দিরা গান্ধীর পতনের সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আসন্ন ভারত সফর অনেকটাই অর্থহীন হয়ে পড়েছে। অগ্রবর্তী টিমের সদস্যরা বহু যােগাযােগ করেও প্রেসিডেন্টের সফরের ওপর সঠিক কোনাে তথ্য পাচ্ছেন না, কারণ উচ্চপদের নেতারা সবাই ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট সামাল দিতে ব্যস্ত।

এমতাবস্থায় প্রেসিডেন্টের সফর বাতিলের বিষয়টি ভারতের পক্ষ থেকেই আসা উচিত। কাজেই ভারত তা বাতিল না করা পর্যন্ত অগ্রবর্তী টিমের সদস্য।

ওয়াকারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এদিকে কিসিঞ্জারের পাঠানাে অপর এক বার্তায় ভারতে আমেরিকান অর্থনৈতিক সাহায্যের সমকালীন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়। এতে বলা হয় যে, ১৯৭০ সালের

পৃষ্ঠা: ৮৭

পিএল-৪৮০ কর্মসূচির আওতায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এক্ষণে তা ঘােষণা না করে প্রেসিডেন্টের ভারত সফর চূড়ান্ত হলে প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে তা ঘােষণা করা হলে সফরের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতীয় ও মার্কিন সমবায় সমিতি, মার্কিন প্রাইভেট ফার্ম ও ব্যাংকের সমন্বয়ে একটি সার কারখানা নির্মাণের জন্য এআইডি’র আওতায় ৩৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রস্তাব করা হয়।২৩

যাই হােক, ভারত আপাতভাবে তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠলে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ভারত সফরের কর্মসূচি বহাল থাকে। ৩১ জুলাই থেকে ১ আগস্ট ১৯৬৯ নিক্সন ভারত সফর করেন এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও উচ্চপদস্থ ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে দু’ দফা বৈঠকে মিলিত হন। কিসিঞ্জার এবং ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব টি এন কাউল নিজ নিজ সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানের সঙ্গে ছিলেন।২৪

বৈঠকে কিসিঞ্জার স্পষ্ট বক্তব্য দেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা হলাে সীমান্তজনিত সংঘর্ষ এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত নিরসন করা। অভ্যন্তরীণ সংঘাত একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও এর সঙ্গে উন্নয়নের প্রশ্ন জড়িত এবং সে কারণেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে সাহায্য করতে চায়।

পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের প্রেক্ষাপটে ভারত পাকিস্তানের সম্পর্ক মূল্যায়ন করতে গিয়ে কাউল বলেন যে, পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নয়া অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত ভারতের উদ্বেগের কারণ। ভারত ইতােমধ্যেই পাকিস্তানের কাছে ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তিসহ বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে যেগুলােকে আশানুরূপ কোনাে সাড়া পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, নব্য কংগ্রেসের পর চীন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের কথা বলতে শুরু করেছে। ফলে অনেক দেশের মধ্যে পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্কে পরিবর্তন অত্যাসন্ন হয়ে উঠছে। চীন পাকিস্তানের নামে বিক্ষুব্ধ অংশটিকে অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে। ভারতের সীমান্তে বিপুল সৈন্য সমাবেশ করেছে। অদূর ভবিষ্যতে তেমন কোনাে বড় ধরনের সংঘাত প্রত্যাশিত না হলেও সাম্রাজ্যবাদী, সংশােধনবাদী এবং প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রগুলাে এখন একীভূত আকার ধারণ করতে শুরু করেছে।

অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে কিসিঞ্জার বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র উপমহাদেশে অস্ত্র প্রতিযােগিতা বন্ধ করতে চায় এবং মূল্যবান সম্পদ সামরিক কাজে ব্যয় করতে নিরুৎসাহিত করে। ভারত নিজে নিজে অস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানায়।

ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব এইচ সি সারিন বলেন, সেন্ট লুইয়ের অস্ত্র নির্মাণ কারখানায় উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ২০ শতাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ পাকিস্তানের সৈন্য সংখ্যা ৬ ডিভিশন থেকে বেড়ে ১১ ডিভিশন হয়েছে, ১১টি লাইট

পৃষ্ঠা: ৮৮

রেজিমেন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯টিতে। ১৯৬৫ এর তুলনায় পাকিস্তানের সামরিক সামর্থ্য এখন প্রায় দ্বিগুণ বলে তিনি মন্তব্য করেন।

কাউল বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের উভয়েরই সামরিক সম্ভারের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। তবে ভারতের সামনে রয়েছে প্রবল প্রতিপক্ষ চীন। পাকিস্তানের প্রতি চীন কোনাে হুমকি নয়। পাকিস্তান যেখানে মনে করছে একটা হুমকি, ভারত সেখানে মনে করছে দুইটা হুমকি। কাজেই পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করার কোনাে মানেই হয় না।

কিসিঞ্জার বলেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চায় না। এ দুইয়ের মধ্যে পছন্দ বাছাই করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি হলাে কোনাে বাছাই না করা। যুক্তরাষ্ট্র আশা করে দুই দেশ তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারবে। তিনি বলেন, পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনাে সিদ্ধান্ত হয়নি। এই সফরে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে মনােভাব জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এটি অনস্বীকার্য যে ভারতের স্থিতিশীলতার ওপর দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা পুরােপুরি নির্ভর করে। কোনাে অস্ত্র প্রতিযােগিতায় সাহায্য দেয়ার ইচ্ছা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ভারতের সঙ্গে আলােচনা করা হবে বলে তিনি জানান।

২০ আগস্ট ১৯৬৯ ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট থেকে হােয়াইট হাউসে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ভারতের নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়।২৫ এতে বলা হয় যে, ব্যাংক জাতীয়করণের কারণে বাম দলগুলাের সমর্থন পাওয়াতেই ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ভি ভি গিরিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা সম্ভব হয়েছে।

ভিয়েতনাম প্রশ্নে তিক্ততা

আমেরিকা যখন দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধরত ঠিক সে সময়ে উত্তর ভিয়েতনামের প্রতি ভারতের সমর্থন ছিল আমেরিকার বিশেষ গাত্রদাহের কারণ। বিশেষ করে উত্তর ভিয়েতনামের প্রতি চীনের সমর্থনের পরেও ভারতের হ্যানয়মুখী প্রবণতাকে আমেরিকা দেখছিল সন্দেহের চোখে—কারণ উপমহাদেশে ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পরে চীন ও ভারত একসঙ্গে কোনাে বিরােধে একই পক্ষে অবস্থান করবে সেটা স্বাভাবিক কোনাে অবস্থা ছিল না।

১৯৬৯ সালের ৬ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ত্রিলােকিনাথ কাউল২৬ ওয়াশিংটনে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে দেখা করেন।২৭ কাউল রজার্সকে বলেন যে, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী তদানিন্তন সময়ে মার্কিন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নীতিমালা বিশেষভাবে জানতে আগ্রহী। সেক্রেটারি রজার্স তাকে বলেন যে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অত্যন্ত ভালাের দিকে যাচ্ছে এবং উভয় দেশের প্রেসিডেন্ট অনুভব করছেন যে, দিল্লিতে সফল সফরের পর এই সম্পর্ক উত্তরােত্তর

পৃষ্ঠা: ৮৯

উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, পাকিস্তানকে অস্ত্র দেয়ার বিষয়টি এখন পর্যন্ত পর্যালােচনাধীন হলেও আজ পর্যন্ত কোনাে অস্ত্র পাকিস্তানকে দেয়া হয়নি।

সেক্রেটারি রজার্স এশিয়ান পলিসি, বিশেষ করে এশিয়ায় আমেরিকান সামরিক ও বেসামরিক লােকবলের সংখ্যা কমিয়ে আনা, গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সহযােগিতা ব্যবস্থা ইত্যাদি ব্যাখ্যা করে বলেন যে আমেরিকা এ মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাতে নীতিমালা বিষয়ক কোনাে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে না, তবে বিদ্যমান প্রতিশ্রুতিগুলাে বহাল রাখতে আগ্রহী। তিনি বলেন, আমেরিকা কারাে সঙ্গে নতুনভাবে জোটবদ্ধ হতে চায় না, কিন্তু কেউ আমেরিকার বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হােক সেটাও চায় না।

রজার্স বলেন যে, সম্প্রতি খবর পাওয়া গেছে, যে ভারত খুব জলদি হ্যানয়-এ তার দূতাবাসের অফিস খুলতে যাচ্ছে। এই ভারত-ভিয়েতনাম সম্পর্কটি হলাে এখন ভারতের প্রতি মাথাব্যথার একমাত্র কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, ভারত দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ দেখিয়ে উত্তর ভিয়েতনামকে স্বীকৃতি দেয়ায় আমেরিকার এক্সিকিউটিভ ব্রাঞ্চ, কংগ্রেস এবং আমেরিকান জনগণ সকলের কাছে ভারতের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। আমেরিকা দেশের ও দেশের বাইরে যে কোনাে বড় কর্মসূচিতে হাত দিলে তার ওপর কংগ্রেসের অনুমােদন প্রয়ােজন হয়। অথচ হ্যানয়ের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি আমেরিকান কংগ্রেস একটি মার্কিন বিরােধী পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচনা করছে।

সেক্রেটারি রজার্স বলেন, ভারত ইতােমধ্যেই হ্যানয়ে রাষ্ট্রদূতের সমমর্যাদার প্রতিনিধি নিয়ােগ করেছে যার সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের মতােই যে কোনাে বিষয়ে যােগাযােগ করা যায়। ভারতের এই ভূমিকা ইন্টারন্যাশনাল কন্ট্রোল কমিশনের২৮ নিরপেক্ষ ভূমিকার পরিপন্থী বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে।

তিনি বলেন, ভারত তার পলিসি অনুসারে বিভক্ত দেশগুলাের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক এড়িয়ে চলে। আমেরিকা যখন সেখানে একপক্ষের সমর্থনে যুদ্ধ করছে, তখন হ্যানয়কে স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ হলাে একটিই এবং তা হলাে আমেরিকা যুদ্ধরত থাকা অবস্থায় ভারত মার্কিনবিরােধী শিবিরে যােগ দিয়েছে। তিনি বলেন, এর ফলে আমেরিকার জনগণের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে তা সাময়িক হবে না। এর প্রতিক্রিয়া হবে সুদূরপ্রসারী এবং সিরিয়াস ধরনের। প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে তিনি বলেন, এ হলাে ভারতের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সূচনা মাত্র এবং ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করেন।

আমেরিকার দক্ষিণ এশীয় সামরিক সরবরাহ পলিসি তখন পর্যন্ত কার্যকর না। হওয়াতে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, এক্ষেত্রে আমেরিকার নিচুপ থাকার অর্থ হবে ভারতের স্বার্থ, আঞ্চলিক স্বার্থ এবং সারা বিশ্বের জন্য শান্তি পরিস্থাপনের স্বার্থ। তিনি বলেন, ভারত এই ভেবে উত্তর

পৃষ্ঠা: ৯০

ভিয়েতনামের পক্ষ নিয়েছে যে, উত্তর ভিয়েতনাম ভারতের সমর্থন কামনা করেছে যাতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়। এক্ষেত্রে ভারতের মূল উদ্দেশ্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় চীন ও সােভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব হ্রাস করা বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, ভারত সরকার হ্যানয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন যাতে তিনি ভারতের অবস্থান এবং একই সঙ্গে আমেরিকার অবস্থান হ্যানয়ের উচ্চতম পর্যায়ে ব্যাখ্যা করতে পারেন। দক্ষিণ ভিয়েতনামে প্রতিনিধি পাঠিয়ে সেখানে মার্কিন মনােভাব পৌঁছাবার কোনাে প্রয়ােজন রয়েছে বলে ভারতীয় সরকার মনে করছে না বলে তিনি মার্কিন সেক্রেটারিকে জানান।

তিনি আরাে আশা প্রকাশ করেন যে, মার্কিন কংগ্রেস ভারতের হ্যানয়কে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবে এবং সিদ্ধান্তে আসবে যে আমেরিকাকে আহত করার জন্য নয়, বরং বিশ্বশান্তির বৃহত্তর স্বার্থেই তা করা হয়েছে।

সেক্রেটারি রজার্স বলেন, ভারত হ্যানয়ের সঙ্গে যােগাযােগের জন্য সেখানে দূতাবাস পর্যন্ত স্থাপন করেছে, যাতে বােঝা যাচ্ছে যে, প্রকাশ্যে ভারত একটি পক্ষ অবলম্বন করেছে। ভারত যেন তার নিজের স্বার্থের দিকে নজর রাখে। আমেরিকার কংগ্রেস এবং জনগণের কাছে এ নিয়ে একসময় ভারতকে নিদারুণ ব্রিতকর অবস্থায় পড়তে হতে পারে। এর ফলে মার্কিন ভারত সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ। মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

ভারতের সমকালীন ক্ষমতার ওপর মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের এক সমীক্ষায় ১২ নভেম্বর ১৯৬৯ তারিখে বলা হয় যে,

ভারত পাকিস্তানের চাইতে আকারে চারগুণ বড় এবং আধুনিক একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যােগ্যতা পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি। জনসংখ্যা এবং সম্পদের বিচারে ভারত একসময় এশিয়ার নেতৃস্থানীয় দেশ, দক্ষিণ গােলার্ধে এমনকি গােটা বিশ্বকেও নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখে।২৯ ইতােমধ্যেই ভারতে প্রচুর সংখ্যায় ভারী শিল্প গড়ে উঠেছে এবং খাদ্যে তারা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে… যা গত কয়েক বছর আগেও চিন্তা করা যায়নি। পারমাণবিক ক্ষমতা অর্জনের দক্ষতাও ভারতের রয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে সে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেও তাতে অবাক হবার কিছু থাকবে না।

আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের প্রভাব নেহেরুর সময়কার চাইতে তুলনামূলকভাবে কম হলেও ভিয়েতনাম পরবর্তী এশিয়ায় তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম।

পৃষ্ঠা: ৯১

সামরিক দিক দিয়ে ভারত এতদূর এগিয়ে গেছে যে, এখন তারা যুগপভাবে পাকিস্তান ও চীনকে রুখতে সক্ষম। হিমালয় পর্বতমালা অতিক্রম করে অথবা বার্মার ভেতর দিয়ে অচিরেই তারা চীনকে আটকাতে পারবে। ভারতের প্রায় ১১ লক্ষ সদস্যের সেনাবাহিনী দিয়ে তারা এক তৃতীয়াংশ চীন ও এক তৃতীয়াংশ পাকিস্তানে মােতায়েন করেও যে কোনাে ফ্রন্টের জন্য বাকি এক তৃতীয়াংশ রিজার্ভ রাখতে পারে। মুক্ত পৃথিবীতে ভারতের সেনাদল দ্বিতীয় বৃহত্তম।

সমীক্ষায় বলা হয়, পাকিস্তানের যে সামরিক ক্ষমতা রয়েছে তাতে ভারতে পশ্চিম ফ্রন্টে তারা হয়তাে ভারতকে কয়েক সপ্তাহ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে—কিন্তু তা অনির্দিষ্টকালের জন্য সম্ভব হবে না। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান ভারত দ্বারা আক্রান্ত হলে পাকিস্তান কিছুই করতে পারবে না। এই শক্তি সামথ্যের বিচারে ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যে কোনাে দেশের বিচারে ভারতের প্রভাবের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখার জন্য সমীক্ষায় সুপারিশ করা হয়।

ভারতে মারণাস্ত্র সরবরাহের মার্কিন নীতিমালা

আগেই বলা হয়েছে যে, ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই আমেরিকার তৈরি ও সরবরাহকৃত অস্ত্রশস্ত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলে বিশ্বব্যাপী আমেরিকার বিরুদ্ধে সমালােচনার ঝড় ওঠে। এক পর্যায়ে যুদ্ধের সময়ই আমেরিকা তার দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিক সরবরাহ নীতিতে পরিবর্তন এনে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই সামরিক সাহায্য প্রেরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

পাকিস্তান ও ভারতে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের ওপর সব সময়েই কয়েকটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় কাজ করেছে। মার্কিন উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে একটি শক্তিবলয় গড়ে তােলা, যাতে করে আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আবার, অন্যদিকে পাকিস্তানকে সােভিয়েত বা কমিউনিস্ট চীনের দ্বারস্থ হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে। যখনই নিষেধাজ্ঞা নীতি নমনীয় করে আমেরিকা সাময়িকভাবে পাকিস্তানে সামরিক সরবরাহ শুরু করতে চেয়েছে, তখনই একই সঙ্গে তারা উপমহাদেশে ভারসাম্য বিধানের জন্য ভারতের কাছেও সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে অস্ত্র ও অর্থনৈতিক সাহায্য পাঠাবার চেষ্টা করেছে।

আমেরিকার কয়েক জেনারেশনের নীতি নির্ধারকেরা স্পষ্টত অনুভব করতে পেরেছেন যে, ভারত ও পাকিস্তানের বিদ্যমান পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতা দূর করে কৌশলগতভাবে একক ও শক্তিশালী একটি দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তােলা সম্ভব নয়।৩০ উপমহাদেশে বিভক্তির পর ভারত ও পাকিস্তানের নেতারা অযৌক্তিকভাবেই দ্বন্দ্বে

পৃষ্ঠা: ৯২

জড়িয়েছেন এবং আমেরিকা ও অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তির শত চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও তা জোড়া লাগানাে সম্ভব হয়নি। ফলে আমেরিকা অনন্যোপায় হয়ে দুটি পক্ষকেই সাহায্য করে গেছে। এভাবেই ১৯৬১-৬২ সালে যখন পাকিস্তানে আমেরিকান সামরিক সাহায্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তখন ভারতে অর্থনৈতিক সাহায্যও ছিল সর্বোচ্চ। আবার আমেরিকান মারণাস্ত্র ভারতে চালান শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানেও ক্ষতিপূরণমূলক সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য পাঠানাের মাত্রা বেড়ে গেছে।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনুভব করতে পারে। যে, অর্থহীনভাবেই দু’দেশে সামরিক ও অর্থসাহায্য পাঠানাে হয়েছে এবং বিনিময়ে আমেরিকাকে উপমহাদেশের অস্ত্রবিক্রির ব্যবসায়ী হিসেবে বদনাম ঘাড়ে তুলে নিতে হয়েছে। তারা বুঝতে পারেন যে, তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য, শিল্পসমৃদ্ধ ইউরােপ বা উদীয়মান শিল্পসমৃদ্ধ উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতাে তারা অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাজেই সে সময় থেকে আমেরিকা বিশেষ করে ভারতকে অন্য দুটি প্রেক্ষাপট থেকে মার্কিন স্বার্থের পরিপূরক বলে ধরে নিতে থাকে। সেগুলাে হলাে, ভারতের গণতন্ত্রের প্রতি সহমর্মিতা এবং ধরে নেয়া যে আমেরিকার এবং ভারতের বিশাল গণতন্ত্রের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রয়েছে। অন্যটি হলাে এই যে, ভারত নিঃসন্দেহে আমেরিকার কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থনৈতিক সাহায্য পাওয়ার দাবি রাখে, যেহেতু তারা পৃথিবীর দরিদ্রতম জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশকে লালন করে।

অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য পেলেও ভারত মার্কিন-ভারত সম্পর্ক নিয়ে সব সময়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকেছে। কারণ, তারা স্পষ্টতই দেখেছে যে, ভারতে সাহায্য বিস্তার করে ভারতের চারদিকে একটি ভারতবিরােধী বলয় গড়ে তুলতে আমেরিকা সাহায্য করে গেছে।

যাই হােক, ভারত মার্কিন সম্পর্কের এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে ১৯৬৯ সালে আমেরিকা তার দক্ষিণ এশীয় সামরিক সরবরাহ নীতিতে আংশিক পরিবর্তন এনে পাকিস্তানে সাময়িকভাবে হলেও অস্ত্র পাঠানাের কথা বিবেচনা করলে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের রিভিউ গ্রুপ এককালীন ভারত-মার্কিন সম্পর্ক ও পাকিস্তানে অস্ত্রসাহায্যের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া চুলচেরাভাবে বিশ্লেষণ করে।৩১ বৈঠকে ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট ফর নিয়ার ইস্টার্ন অ্যাণ্ড সাউথ এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন ধারণা প্রকাশ করেন যে, প্রাথমিকভাবে এর ফলে ভারতে অর্থনৈতিকভাবে ও জনমনে প্রবল প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাবে। তিনি মনে করেন, প্রথম দিকে এ নিয়ে হইচই শুরু হলেও আস্তে আস্তে তা থেমে যাবে, কারণ ভারত আমেরিকা থেকে অস্ত্র কিনতে চায়। বৈঠকে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেন যে, ইন্দিরা গান্ধীর সরকার হয়তাে এই ঘটনাকে মার্কিনবিরােধী প্রচারণার একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। জবাবে ভ্যান হলেন বলেন যে সে উত্তাপ বেশিদিন স্থায়ী হবার আশঙ্কা নেই।

পৃষ্ঠা: ৯৩

পর্যালােচনাকালে আরাে বলা হয় যে, ভারত এতে খুব বেশি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবে না, কারণ ভারত এই দফায় মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্যের খােলা নীতি থেকে বঞ্চিত হতে চাইবে না। বড়জোর পাকিস্তানে অস্ত্র সাহায্য পাঠানাের পরিপূরক হিসেবে ভারত সােভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আরেক দফা অস্ত্রের চালান নিয়ে আসতে পারে।

ইউ এস কালচারাল সেন্টার ইস্যু

দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকান অস্ত্র সরবরাহ নীতিমালা নিয়ে টানাপােড়েনের এই সন্ধিক্ষণে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কে আরেকটি অশনি সংকেতের সূত্রপাত ঘটে ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে। এ সময় সন্দেহজনক কার্যকলাপের অভিযােগে ভারতের পাঁচটি শহরে আমেরিকান তথ্য কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৬৯ সালের ৩ ডিসেম্বর সােভিয়েত ইউনিয়ন ত্রিবান্দ্রামে একটি রাশিয়ান তথ্য কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব করলে ভারতে অবস্থিত সকল বিদেশি তথ্য কেন্দ্রের কার্যকলাপের ওপর একটি পর্যালােচনা চালানাে হয়। পর্যালােচনায় ভারতের মতে বেশ কয়েকটি তথ্যকেন্দ্রে অনিয়মিত কার্যকলাপের অভিযােগ আসে ও ফলে ১৯৭০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আহমেদাবাদ, নাগপুর, চণ্ডিগড়, রাচী ও বারানসীর আমেরিকান তথ্যকেন্দ্রগুলাে ভারতীয় সরকারের নির্দেশে বন্ধ করে দেয়া হয়।৩২

২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ ওয়াশিংটনে ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট থেকে দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীনেশ সেনের কাছে হাতে হাতে পৌঁছাবার জন্য জরুরি একটি টেলিগ্রাম পাঠানাে হয়।৩৩ এতে বলা হয় যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোনাে কোনাে আমেরিকান তথ্যকেন্দ্র রাজনৈতিক ও অন্যান্য অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপ পরিচালনা করছে বলে অভিযােগ তুলেছে ও কয়েকটি তথ্যকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে যথার্থ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ চেয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। পাঠানাে চিঠিতে বলা হয় যে, তথ্যকেন্দ্রগুলাে বন্ধ করে দেয়া ঠিক হয়নি এবং ভারতীয় সরকারের যথার্থ অনুমােদন নিয়েই এবং সরকারের জ্ঞাতসারেই তথ্যকেন্দ্রগুলাে পরিচালনা করা হচ্ছিল। ভারতের পাঠানাে যে কোনাে তথ্য আমেরিকাতে বিশেষভাবে পর্যালােচনা করা হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয় যে, বিষয়টি ইতােমধ্যেই জনমনে প্রশ্ন তুলেছে এবং তা আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে দুর্যোগ সৃষ্টি করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বলাবাহুল্য, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে বিশদ কোনাে ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি এবং অতিরিক্ত তথ্য চাওয়া হয়নি। ৩ মার্চ রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর এক বৈঠকেও বিষয়টি উত্থাপন করা হয় এবং এর ফলে ভারত ও আমেরিকার জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিশেষভাবে জানানাে

পৃষ্ঠা: ৯৪

হয়। তা ছাড়া ২৬ ফেব্রুয়ারি লােকসভার স্বতন্ত্র সদস্য এম কে ত্রিপুরা বিষয়টি লােকসভায় একটি বিবৃতির মাধ্যমে উত্থাপন করে বিষয়টি আরাে জটিল করে তুলেছেন বলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানানাে হয়।

ইন্দিরা গান্ধী আলােচনাকালে বলেন যে, তিনি কালচারাল সেন্টার বিষয়ে তেমন অবহিত নন এবং এ ব্যাপারে নিশ্চয় কোনাে সমাধান উদ্ভাবন করা যাবে।

৫ মার্চ ভারতীয় চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মহারাজা কৃষ্ণ রাসগােত্রা আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট রজার্সের কাছে পাঠানাে এক টেলিগ্রামে আমেরিকান তথ্য কেন্দ্রের ব্যাপারে ভারতীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। পররাষ্ট্র দীনেশ সেনের পক্ষ থেকে পাঠানাে সেই টেলিগ্রামে বলা হয় যে, ভারত কোনাে দেশের সঙ্গে তার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না বরং তা আরাে শক্তিশালী করতে চায়। তিনি বলেন, ভারতে কর্মরত প্রত্যেকটি দেশের প্রত্যেকটি তথ্যকেন্দ্র ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মধ্যে একটি কর্মসমান্তরালতা আনার জন্য ভারত সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। এবং তা যে কোনাে দেশের যে কোনাে তথ্যকেন্দ্রের ব্যাপারে প্রযােজ্য হবে। তা আমেরিকা বা বিশেষ কোনাে দেশের তথ্যকেন্দ্রের বিষয় নয়। বন্ধুপ্রতিম দেশগুলাের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক যােগাযােগ সমান্তরাল করার জন্য এবং অর্থাৎ একটি ভারসাম্যময় সাংস্কৃতিক সম্পর্ক সকলের সঙ্গে গড়ে তােলার জন্যই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে টেলিগ্রামে উল্লেখ করা হয়।৩৪ তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এর মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝির অবসান ঘটবে।

অবশ্য মার্কিন প্রশাসনের উচ্চস্তরে এই ঘটনা নিদারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ৭ মার্চ ১৯৭০ সিনিয়র মিলিটারি অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল আলেক্সান্ডার হেগ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের স্টাফ হ্যারল্ড সন্ডার্স কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানাে এক মেমােতে ঘটনার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের অত্যন্ত কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।৩৫ সন্ডার্স মেমােতে যেসব সম্ভাব্য পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয় সেগুলাে হলাে :

১. এরপর ভারত থেকে যে কোনাে অনুরােধ অত্যন্ত শীতলভাবে গ্রহণ করা হবে এবং জবাবের জন্য অপেক্ষমান অনুরােধগুলাের বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা হবে। যেমন, ভারত বর্তমানে নারকোটিকস কন্ট্রোল কমিশনে একজন প্রার্থীর জন্য আমেরিকার সমর্থন চেয়েছে। পরবর্তী রাউন্ড দ্বিপাক্ষিক আলােচনার জন্য ভারত সময় চেয়েছে। ভারতের এ ধরনের সকল কূটনৈতিক পদক্ষেপ ও অনুরােধ সরাসরি প্রত্যাখ্যান বা বিলম্বিত করা হবে। ২. পিএল-৪৮০’র ব্যাপারে ছােটখাটো কিছু আবদার রয়েছে ভারতের। সেগুলাে সবই প্রত্যাখ্যান করা হবে। যেমন ভারত আরাে ১ লাখ বেল তুলা এবং অতিরিক্ত কিছু ভােজ্য তেল চেয়েছে যাতে তারা নিজেদের বাজারে মূল্যস্থিতি করতে পারে। ভারতীয় রুপিতে তারা বড় রকমের অনুদানও আশা

পৃষ্ঠা: ৯৫

করছে। এর যে কোনােটা বা সবগুলাে অস্বীকার করা যেতে পারে। ৩. আমেরিকায় ভারতের কিছুসংখ্যক ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে। সেগুলাে কোন আইনে চলছে তা বােধগম্য নয়। তাদের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ না হলে সেগুলাে সরাসরি বন্ধ করে দেয়া যায় কি না ভেবে দেখা যেতে পারে। এ ছাড়া বৈজ্ঞানিক সহায়তার ক্ষেত্রেও অনুরূপ কার্যকলাপের খোঁজ করা হচ্ছে।

৯ মার্চ সেক্রেটারি রজার্স ভারতে মার্কিন দূতাবাসে আরেকটি টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রামে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীনেশ সেনের কাছে রজার্সের কড়া প্রতিবাদলিপি পাঠানাের জন্য রাষ্ট্রদূত কিটিংকে নির্দেশ দেয়া হয়। এতে বলা হয় যে, ভারতীয় পক্ষ মার্কিন তথ্যকেন্দ্রগুলাে বন্ধ করে দেয়ার ঘটনাকে নেহায়েতই ভুল বােঝাবুঝি বলে ধামাচাপা দিতে চাইলেও ভারতীয় ও মার্কিন প্রচার মাধ্যমে এ নিয়ে তুমুল হইচই চলছে। এক্ষেত্রে ভারতের যুক্তি কিছুতেই গ্রহণযােগ্য নয়। ভারত সরকারের প্রতি তিনি অবিলম্বে সকল ভুল বােঝাবুঝির ত্বরিত অবসান ঘটানাের জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান।

২৭ মার্চ হেনরি কিসিঞ্জারের পক্ষ থেকে হােয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে আবার একটি মেমাে পাঠানাে হয়। এতে ভারতকে চাপের মুখে রাখতে হলে অনতিবিলম্বে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে তার একটি তালিকা দেয়া হয়। এতে কতিপয় আন্তর্জাতিক সংস্থায় ভারতের প্রতিনিধিদের মার্কিন সমর্থন প্রত্যাহার, লস এঞ্জেলসে ভারতের একটি ট্যুরিস্ট কেন্দ্র অনুমােদনে বিলম্ব এবং পিএল-৪৮০’র অধীনে কিছু ভারতীয় দাবি নাকচ করে পরবর্তী দফায় ভারত মার্কিন দ্বিপাক্ষিক আলােচনার ব্যাপারে নিশ্চপ থাকার প্রস্তাব করা হয়। এর চাইতে সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপের মধ্যে সাহায্যের পরিমাণ হ্রাস, আমেরিকার ধরে রাখা ইন্ডিয়ান রুপির একতরফা ব্যবহার এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচিতে কাটছাট আনার প্রস্তাব করা হয়।৩৬

ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের নির্বাহী সচিব থিওডাের এলিয়ট ১৫ মে কিসিঞ্জারের কাছে লেখা এক মেমােতে ভারতে আমেরিকান তথ্যকেন্দ্র বন্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানান। তিনি বলেন,

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ থেকে তথ্যকেন্দ্রগুলাে চালানাের কতকগুলাে গাইডলাইন দেয়া হয়েছে যা আমেরিকার প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন তারা বলছে যে, কেন্দ্রগুলােতে কোনাে আবাসিক পরিচালক থাকতে পারবে না এবং ভবিষ্যতে কেবলমাত্র ভারতীয়দের সমন্বয়ে গঠিত একটি পরিচালক বাের্ড

প্রতিষ্ঠানগুলাে চালাবে। মেমােতে বলা হয়,

রাষ্ট্রদূত কিটিংকে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব টি এন কাউলকে জানাবার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে আমেরিকা পাঁচটি উল্লিখিত তথ্যকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার

পৃষ্ঠা: ৯৬

সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শনিবার ১৬ মে থেকে এই বন্ধ কার্যকর হবে। ভারতীয়রা আমেরিকাকে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ১৮ মে পর্যন্ত সময় দিয়েছে। কিটিংকে এই মর্মে ভারতের কাছে একটি নােট পাঠাতে বলা হয়েছে যে, কেন্দ্রগুলাে বন্ধ করে দেয়ার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সর্বতােভাবে দায়ী এবং আমেরিকা ভারতের যে। কোনাে প্রশ্নে যথাযথ সাড়া দিয়ে তার কর্তব্য পালন করেছে।৩৭

অর্থনৈতিক সাহায্যের অব্যাহত ধারা

ভিয়েতনামের প্রতি ভারতের সমর্থন এবং ভারতে পাঁচটি আমেরিকান তথ্যকেন্দ্র নিয়ে যখন ভারত-মার্কিন সম্পর্ক টালমাটাল অবস্থা সে সময়েও ভারতে মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রবাহ ছিল অব্যাহত। মার্কিন প্রশাসনের একটি অংশ মনে করছিলেন যে, ভারতীয় প্রশাসনের বড় একটি অংশ ছিলেন মুক্ত অর্থনীতির প্রবক্তা। এবং তারা কিছুতেই সেই অংশটিকে বিগড়ে দিতে চাইছিলেন না। আরেকটি অংশ মূলত পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীনেশ সেনকে ব্রিতকর অবস্থায় ফেলে সুবিধা আদায় করতে চাইলেও তারা ছিলেন ভারতীয় জনগণের অর্থনৈতিক দুরবস্থার ওপর সহানুভূতিশীল। তারা দেখছিলেন যে ভারতকে দেয়া অর্থনৈতিক সাহায্যগুলাে সরাসরিভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীলকরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং রাজনৈতিক বা কৌশলগত বিষয়গুলাের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়।

মে মাসে হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে ১৯৬৯/৭০ সালের জন্য ভারতে মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্যের একটি প্রস্তাব পাঠান।৩৮ প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার তহবিল থেকে ভারতকে ১৯৩ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য প্রস্তাব সুপারিশ করা হয়। এই পরিমাণ ছিল আগের বছর দেয়া সাহায্যের প্রায় সমান এবং গােটা বছরে ভারতের মার্কিন সাহায্যপ্রাপ্তি এতে ৪০৮ মিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। তবে ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে প্রাপ্ত মঞ্জুরির তুলনায় তা ছিল ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। ২৬ মে অনুষ্ঠেয় ভারতীয় সাহায্য কনসাের্টিয়ামের বৈঠকে এই মার্কিন সাহায্য আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষণা করার জন্য প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।

এ সময় বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ভারতের ২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের নতুন সাহায্য প্যাকেজ প্রয়ােজন ছিল। সাহায্যের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন, বর্ধিত শিল্পপণ্য ও সার আমদানির জন্য ব্যয়ভার পূরণ এবং ভারতের বৈদেশিক ঋণের দায়-দেনা পরিশােধে সহায়তাকরণ। অন্যান্য দাতাদের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং আমেরিকার দেয়া ঋণের পরিমাণ কমে যাওয়ায় মার্কিন সাহায্যের পরিমাণ ছিল কনসাের্টিয়ামে পাওয়া মােট ঋণ প্রতিশ্রুতির ২৯ শতাংশ, যা আগের বছরে ছিল। ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। ভারতের জন্য দেয়া ঋণ প্রস্তাবের মধ্যে ছিল : ৭

পৃষ্ঠা: ৯৭

১৯৩ মিলিয়ন ডলারের নয়া সাহায্য তহবিল আগের অনুমােদন দেয়া ৩৫ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য প্যাকেজ আগের অনুমােদিত পিএল-৪৮০’র ১৮০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য মিলিয়ে মােট ৪০৮ মিলিয়ন ডলার মার্কিন সাহায্য এর সঙ্গে ছিল

অন্যান্য কনসাের্টিয়াম সদস্যের প্রতিশ্রুতি ৩৫০ মিলিয়ন ডলার আই ডি এ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ ৩০০ মিলিয়ন ডলার সামগ্রিক বিশ্বঋণের পরিমাণ এতে দাঁড়ায় ১০৫৮ মিলিয়ন ডলার।৩৯ আমেরিকার প্রতিশ্রুত ১৯৩ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের মধ্যে ছিল :

* দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানাের লক্ষ্যে ভারতের নেয়া বৃহদাকার এক কর্মসূচিতে সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ আমদানির জন্য ৫০ থেকে ৯০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ।

* ভারতের মােট শিল্পোৎপাদনের প্রায় ৯০ শতাংশ অবদান রাখা বেসরকারি খাতের জন্য কাঁচামাল ও শিল্প উপকরণ আমদানিতে ৭০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ একটি অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও ভারতের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ পলিসির কারণে অবশ্যই এই কর্মসূচি প্রায়ই ব্যাহত হতে দেখা যায়।

* প্রাথমিকভাবে কৃষি ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির জন্য ৮ মিলিয়ন ডলারের কারিগরি সাহায্য কর্মসূচি।

* ভারতের নিজস্ব জনসংখ্যা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ২৫ মিলিয়ন ডলারের অনুদান।৪০

প্রস্তাবে বলা হয় যে, বিদেশি মুদ্রার জন্য বহিঃসাহায্যের ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল হলেও ভারত ইতােমধ্যে রপ্তানি ব্যয় বাড়ানাে, ঋণ পরিশােধ, পুনঃতফসিলীকরণ এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশে যথাযথ সাফল্য অর্জন করেছে। কয়েক বছর আগেও বিদেশি ঋণ ভারতের প্রয়ােজনীয় বিদেশি মুদ্রার ৫৩ শতাংশ অবদান রাখলেও তা কমে এসেছে ৪০ শতাংশে।

শরণ সিংয়ের উদ্বেগ ১৬ জুলাই ১৯৭০ ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং সদ্যনিযুক্ত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমেরিকার কাছে পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক সাহায্য পাঠানাের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।৪২

শরণ সিং কিটিংয়ের কাছে পাকিস্তানে মার্কিন সামরিকসম্ভার সরবরাহের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলে কিটিং সেক্রেটারি রজার্সের উদ্ধৃতির বরাত দিয়ে

পৃষ্ঠা: ৯৮

বলেন যে, মার্কিন দক্ষিণ এশীয় সামরিক সরবরাহ নীতি সংশ্লিষ্ট মহলের পর্যালােচনাধীন রয়েছে। তিনি জানান যে, বিষয়টি এখন আমেরিকার উচ্চতম। পর্যায়ের বিবেচনাধীন এবং সে সম্পর্কে তাকে এখনাে কিছু জানানাে হয়নি।

শরণ সিং বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং স্পর্শকাতর এবং ভারতের জন্য অত্যন্ত দুঃশ্চিন্তার বিষয়। তিনি বলেন, পাকিস্তানকে যে কোনাে ধরনের অস্ত্র সাহায্যের ব্যাপারে চিরন্তন একটি উদ্বেগ রয়েছে। তা ছাড়া এ ধরনের সাহায্যদানের

সরবরাহের পরিমাণ বাড়লে ভারতের ওপর হুমকি বেড়ে যায় এবং তখন ভারতকেও প্রতিরক্ষার জন্য বাড়তি অস্ত্রের জোগান দিতে অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হতে হবে। কারণ ভারতকে তখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে হয় সামরিক কাজে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিককালে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছেন যে ব্যাপারটি অত্যন্ত সিরিয়াস।

এরপর সর্দার শরণ সিং সােভিয়েত রাশিয়া ও চীন থেকে পাকিস্তানের অস্ত্র সংগ্রহের ওপর লম্বা একটা ফিরিস্তি দেন। তিনি অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সামরিক জোটবদ্ধতা রয়েছে। কিটিং এ ব্যাপারে তার অজ্ঞতার কথা জানালে শরণ সিং আবার বলেন যে, প্রশ্নাতীতভাবে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক সখ্যতা রয়েছে এবং এ সখ্যতা করা হয়েছে কেবলমাত্র ভারতের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে চীনের কোনাে বিরােধ দেখা দিলে পাকিস্তান নিঃসন্দেহে চীনের সঙ্গে থাকবে এবং তা হবে ভারতের বিরুদ্ধে।

তিনি বলেন, ভারত দু’ ফ্রন্টে পাকিস্তানের মােকাবিলা করছে। এ মুহূর্তে ভারত পাকিস্তান থেকে প্রত্যক্ষ হামলার হুমকির সম্মুখীন নয়… কিন্তু যে কোনাে বিরােধের সময় চীনা এবং পাকিস্তানি বাহিনী পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তিনি বলেন যে, এ কারণেই পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারটি ভারতের কাছে একইসঙ্গে ভাবাবেগজনিত, অর্থনৈতিক ও সামরিক উদ্বেগের কারণ।

জবাবে কিটিং বলেন যে, আমেরিকা যখন সামরিক বিষয়াদি বিবেচনা করে তখন সঙ্গত কারণেই অন্যের সঙ্গে তার মতদ্বৈততা থাকতে পারে। বিষয়টি সামগ্রিকভাবে আমেরিকার সরকারের বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল এবং প্রেসিডেন্ট স্বয়ং সেখানে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি স্বীকার করেন যে, পাকিস্তানে আমেরিকার যে কোনাে অস্ত্র সরবরাহ অথবা মার্কিন অনুমােদনে তৃতীয় কোনাে পক্ষ থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করা হলে তা সঙ্গত কারণেই ভারতের উদ্বেগের কারণ হবে। তিনি বলেন যে, ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান ও ভারতে আমেরিকার সামরিক সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হবার পর একবার মাত্র তাতে ব্যতিক্রমধর্মী

পৃষ্ঠা: ৯৯

সরবরাহ করা হয়েছে এবং সেটি করা হয়েছে ভারতে, পাকিস্তানে নয়। বর্তমানেও ভারতে অনুরূপ একটি সরবরাহের প্রশ্ন বিবেচনাধীন রয়েছে।

কিটিং বলেন, পাকিস্তানে আমেরিকার অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানাের আগে ভারতকে আরাে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা উচিত। দেখতে হবে এর মাধ্যমে কি মার্কিন নীতিমালা পরিবর্তিত হচ্ছে, নাকি ভারতে সাহায্য পাঠানাের মতাে একটি ব্যতিক্রমধর্মী সিদ্ধান্ত মাত্র। দেখতে হবে এতে কি নতুন অস্ত্রের চালান দেয়া হচ্ছে, নাকি আগের ক্ষয়ে যাওয়া অস্ত্রগুলাে বদলে দেয়া হচ্ছে। আরাে দেখতে হবে সরবরাহকৃত অস্ত্রগুলাে কি আক্রমণাত্মক নাকি রক্ষণাত্মক কাজে ব্যবহারের উপযােগী।

সর্দার শরণ সিং বলেন, রক্ষণাত্মক বা আক্রমণাত্মক যাই হােক না কেন, পাকিস্তানের এখন অস্ত্রের কী প্রয়ােজন সেটাই তার বােধগম্য নয়। তিনি বলেন, পাকিস্তান নিজেই দম্ভ করে বলে বেড়াচ্ছে যে ভারত হলাে পাকিস্তানের একমাত্র শত্রু, চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের মিত্রতা রয়েছে, ভারত কখনােই জোর করে কাশ্মীর কিংবা পাক-ভারত সীমান্তে যুদ্ধবিরতি সীমা অতিক্রম করবে না এবং প্রয়ােজনে। প্রতিহত করবে কিন্তু হামলা চালাবে না। ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক মনােভাব কেউই সমর্থন করবে না। তিনি আরাে বলেন, পাকিস্তান আমেরিকার কাছ থেকে যেসব অস্ত্র পাচ্ছে তার। বেশিরভাগই আক্রমণাত্মক কাজে ব্যবহারের উপযােগী। তিনি বলেন , যে অন্যতম প্রধান কারণে ভারত পাকিস্তানে হামলা চালাবে না সেটা হলাে সাম্প্রদায়িক সমস্যা উদ্ভবের আশঙ্কা এবং ভারত কখনােই সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে আমন্ত্রণ জানাবে না।

কিটিং শরণ সিংকে নিশ্চয়তা দেন যে আমেরিকা দক্ষিণ এশীয় সামরিক সরবরাহ নীতির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানকে কোনাে অস্ত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তা রাষ্ট্রদূত হিসেবে আগে তাকে জানানাে হবে এবং যথাসময়ে তিনি সে ব্যাপারে ভারত সরকারকে অবহিত করতে পারবেন। তিনি বলেন যে, খবরের কাগজে সংবাদ পাঠ করে ভারতকে এ কথা জানতে হবে না… কারণ ভারতের সঙ্গে পূর্বালােচনার ভিত্তিতেই সবকিছু করা হবে।

১৯৭০ সালের মে মাসে লক্ষ্মীকান্ত ঝা ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত হয়ে আসেন। এর আগে তিনি ছিলেন রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর। ২২ জুলাই ঝা কিসিঞ্জারের অফিসে এক সৌজন্য সাক্ষাৎকারে যান। বক্তব্যের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন অনেকটা রক্ষণশীল। শুরুতেই তিনি বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী এবং তিনি সে ব্যাপারে পূর্ণ সহযােগিতা করতে চান।

ঝা বলেন, দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয়কেই সমানভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দু’দেশের মধ্যে বহুক্ষেত্রে মতৈক্য থাকলেও কেবল গুটিকয়েক বিষয় প্রচার।

পৃষ্ঠা: ১০০

মাধ্যম এবং পার্লামেন্টে বিতর্কের কারণে উভয়পক্ষের জন্য বেদনাদায়ক হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দিল্লী ত্যাগের আগে ইন্দিরা গান্ধী তাকে বলেছেন যে অনতিবিলম্বে এই বিদ্যমান অচলাবস্থা দূর করতে হবে এবং সেজন্য আমেরিকার সহযােগিতা ভারতের প্রয়ােজন।৪৩

ভারতের সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে এল কে ঝা বলেন প্রথমবারের মতাে ভারতে একটি সংখ্যালঘু সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বামপন্থীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে হয়েছে। বাধ্য হয়েই সরকারকে মাঝে মধ্যেই এমন বিবৃতি দিতে হচ্ছে যা দেখে মনে হতে পারে আমেরিকা ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন নয়। অনেক সময় পার্লামেন্টে বিতর্কের আলােকেই সরকারকে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে হচ্ছে।

ভারত ও চীনের পরিস্থিতির উদাহরণ টেনে রাষ্ট্রদূত বলেন, তিনি মনে করেছিলেন মৌলিক বিষয়গুলােতে ভারত ও আমেরিকার চিন্তাধারার মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন মৌলিক আন্তর্জাতিক উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে দু’ পক্ষই অভিন্ন, দুজনেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বিভক্ত দেশগুলাের উভয়পক্ষের স্বাধীনতা চায় এবং উভয়েই সেখানে চীনা আধিপত্য ন্যূনতম পর্যায়ে সীমিত রাখতে চায়। তিনি বলেন, ভারতীয় বিবৃতি দেখে মাঝে মধ্যে মনে হতে পারে যে ভারত এ কারণে আমেরিকার সমালােচনা করছে যে ভারত একটি চীনপন্থী বা সােভিয়েতপন্থী দেশ। বাস্তবে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি হলাে এই যে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার সামরিক জবরদস্তি এলাকায় চীনা প্রভাব আরাে জোরদার করে তােলারই আশঙ্কা রয়েছে। জবরদস্তির কারণে সেখানকার অনেক দেশই চীনের সাহায্য নিতে পারে। ভারত আসলে আন্তর্জাতিক কন্ট্রোল কমিশনের মাধ্যমে নন-কমিউনিস্ট দেশগুলাের সঙ্গে যােগাযােগ অব্যাহত রাখারই চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের কারণে ঐতিহাসিকভাবে ভারতে একটি মার্কিনবিরােধী মনােভাব গড়ে উঠেছে। ১৯৫০ সাল থেকে এই প্রবণতা চলে আসছে। আমেরিকা সুস্পষ্টভাবে প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সে অস্ত্র ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে চরম ডানপন্থী কয়েকটি বিরােধী রাজনৈতিক দল তাদের সাম্প্রদায়িক মনােভাব প্রকাশ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের সহানুভূতি অর্জন করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী এই প্রবণতার ঘাের বিরােধী। তিনি ভারতকে ফ্যাসিস্ট বা নন-সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান না। ডানপন্থীরা যুক্তি দেখান যে, ভারতের মূল শত্রু রয়েছে দুটি… চীন ও পাকিস্তান এবং এ মূহূর্তে তারা পরস্পরের সঙ্গে সখ্যতাবন্ধনে আবদ্ধ। মুসলমানদের প্রতি কঠোর ব্যবহার না করার কারণে ভারতীয় সরকারের তারা সমালােচনাও করেন। ভারত জোরদার সামরিক শক্তি গঠন না করায় এবং চীনের পারমাণবিক অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও ভারতে

পৃষ্ঠা: ১০১

পারমাণবিক অস্ত্র না থাকায় তারা ক্ষুব্ধ। কাজেই এ অবস্থায় পাকিস্তানে সামরিক সহযােগিতা দেয়া হলে ডানপন্থীরা বামপন্থীর সঙ্গে মিলে ভারতের অভ্যন্তরে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করে তুলতে পারে।

কিসিঞ্জার বলেন, তিনি অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের ওপর মন্তব্য করতে চান।

১. ভারত পৃথিবীর মহান রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে একটি এবং সম্ভাব্য উদীয়মান শক্তি। ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী। ২. আমেরিকা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বাসী। ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময় সাহায্য করে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র তা অব্যাহতভাবে করেও যাবে। ৩. মার্কিন প্রশাসন এ বিষয়ে অবহিত যে ভারতের কিছু বিশেষ সমস্যা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোনাে অবস্থাতেই ভারতকে অভ্যন্তরীণ সংহতি বিনষ্ট হওয়া দক্ষিণ এশীয় দেশের মতাে দেখতে চায় না। এ ব্যাপারে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক উদ্দেশ্য পরস্পরের সমান্তরাল। ৪. বর্তমানে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার গভীরতর সুসম্পর্ক স্থাপনের একটি পর্যায় চলছে। ৫. তবে এক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যাও রয়েছে। যেমন :

(ক) যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের সমস্যা অনুধাবন করতে হবে এ কথা সত্য তবে কিছু কিছু ভারতীয় বেপরােয়া ও চাঁছাছােলাভাবে আমেরিকার সমালােচনা করছে। আমেরিকার তথ্যকেন্দ্রগুলাে বন্ধ করে দেয়া এর একটি বাস্তব উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে তথ্যকেন্দ্রগুলাে ছিল সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যম, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের যন্ত্র নয়।

(খ) অতীত ইতিহাস থেকে কতিপয় সমস্যার উদ্ভব ঘটেছে। রাষ্ট্রদূত ১৯৫০ সালে অস্ত্র সরবরাহের প্রসঙ্গ তুলেছেন। সে সময়ে একজন প্রফেসর হিসেবে কিসিঞ্জার স্বয়ং অস্ত্র পাঠনাের সমালােচনা করেছেন। কিন্তু সেটা ছিল তার ব্যক্তিগত মতামত, সরকারি নয়।

(গ) যুক্তরাষ্ট্র স্থায়ীভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে অস্ত্র সরবরাহ সম্পর্ক নবায়ন করতে চাইছে না। দক্ষিণ এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযগিতা সৃষ্টি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা যুক্তরাষ্ট্রের নেই।

(ঘ) অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে চূড়ান্ত যে কোনাে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ভারতের সঙ্গে আলােচনা করা হবে।

(ঙ) আমেরিকা অস্ত্র সরবরাহ নবায়ন না করে একবারের মত রিপ্লেসমেন্ট কিছু অস্ত্র দিয়ে তার আগে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে চাইছে মাত্র।

পৃষ্ঠা: ১০২

এল কে ঝার সঙ্গে কিসিঞ্জারের বৈঠকের পর শরন সিংয়ের উদ্বেগ কিছুটা কমে আসে। পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে তার উম্মা অব্যাহত থাকলেও ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের একটি সম্ভাবনার দ্বার তিনি উক্ত দেখতে পান। ২৯ জুলাই সরদার শরন সিং মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট রজার্সের কাছে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে একটি পত্র পাঠান। চিঠিতে তিনি বলেন যে তিনি আশা করেন আমেরিকার সঙ্গে পারস্পরিক সহযােগিতার ভিত্তিতে কাজ করা সম্ভব এবং আগামী দিনগুলােতে দু’দেশের মধ্যেকার সম্পর্কে উত্তরােত্তর উন্নতি ঘটবে।

 তিনি বলেন, ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিংয়ের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক বৈঠকের সময় দু’দেশ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পথগুলাে খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে।

তিনি বলেন, বিশ্বে শান্তি সংরক্ষণের ব্যাপারে আমেরিকা ও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোনাে পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না, বিশেষ করে ভারতীয় অঞ্চলে দু’দেশের মধ্যেকার কার্যপদ্ধতিতে ফারাক থাকতে পারে এবং বিশেষ কতকগুলাে ইস্যুতে দৃষ্টিভঙ্গিগত মতভেদ থাকতে পারে; তবে আগে দু’দেশের সম্পর্কে ক্ষেত্রবিশেষে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে দু’দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগের মাধ্যমে নিঃসন্দেহে সে সমস্ত ব্যতিক্রম দূরীভূত করা সম্ভব।

শরন সিং তার চিঠিতে বলেন, প্রস্তাবিত পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি এখন পর্যন্ত দু’দেশের মধ্যে বিব্রতকর একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে। এ ব্যাপারে ভারতের বিরােধিতার কারণগুলাে বিভিন্ন পর্যায়ে আলােচনা করাও হয়েছে। এ ধরনের মার্কিন সিদ্ধান্ত ভারতে নিদারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে এবং উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে। তিনি রাষ্ট্রদূতকে বলেছেন যে, এ ব্যাপারে যে কোনাে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলােচনা করা হবে।

পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের অগ্রগতি আমেরিকার ব্যাখ্যা : ২৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে সাময়িকভাবে সমরাস্ত্র পাঠানাের ব্যাপারে এক রকম স্থির সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতের সঙ্গে আগের আলােচনার ভিত্তিতে ঠিক করা হয় যে, সরবরাহ চূড়ান্ত করার আগে এ বিষয়ে ভারত সরকারকে যথারীতি অবহিত করা হবে এবং প্রস্তাবিত সমরাস্ত্রের একটি বিবরণী ভারতের কাছে পাঠানাে হবে। এ বিষয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা আগেই অনুমান করে রাষ্ট্রদূত কিটিংকে বিষয়টিতে সজাগ থাকতে বলা হয়। ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট থেকে কিটিংয়ের কাছে পাঠানাে এক জরুার টেলিগ্রামে ভারতের সঙ্গে বিষয়টি কীভাবে বােঝাপড়া করতে হবে সে বিষয়ে দিক-নির্দেশনাও দেয়া হয়। টেলিগ্রামের একটি

পৃষ্ঠা: ১০৩

অনুলিপি অবগতির জন্য পাঠানাে হয় রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে।৪৪ রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং দিল্লিতে সেই টেলিগ্রাম পেয়ে ভারতের কাছে। মার্কিন অভিপ্রায় বিশদভাবে জানান।

২৮ জুন প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানের কাছে নগদ মূল্যে একদফা অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়ায় সেই সিদ্ধান্তের আলােকে টেলিগ্রামে তখনকার দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন সরবরাহ নীতিমালা বিস্তৃতভাবে পর্যালােচনা করা হয়। এতে বলা হয় যে, আমেরিকার মৌলিক নীতিমালা অপরিবর্তিত থাকলেও ভবিষ্যত নীতিমালা সংযােজন ও বিয়ােজনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। টেলিগ্রামে বলা হয়,

পাকিস্তানি নেতারা উপর্যুপরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন এবং সােভিয়েত রাশিয়া ও চীন থেকে অস্ত্র সংগ্রহে নিজেদের অনীহার কথা তুলে ধরেছেন। গত বছর প্রেসিডেন্ট নিক্সনের লাহাের সফরের সময় এ বিষয়টি তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানের অনুরােধ বিবেচনা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বারবার পাকিস্তানের ত্রিমুখী সমস্যার কথা বিচার করেছে। সেগুলাে হলাে, একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালাে সম্পর্ক রাখা, চীন ও সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক অব্যাহত রাখা এবং ভারতের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক অব্যাহত রাখা। পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করতে গিয়ে এমন সব অস্ত্র বাছাই করা হয়েছে যেগুলাে পাকিস্তানের জন্য প্রয়ােজন। ট্যাংকের মতাে পুরােপুরিভাবে সামরিক আইটেম তালিকাভুক্ত করা হয়নি এবং ভারতের রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিক ভারসাম্যের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। আমেরিকা মনে করে না যে, প্যাকেজে এমন কোনাে আইটেম যুক্ত করা হয়েছে যা উপমহাদেশে শক্তির ভারসাম্য বা দক্ষিণ এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযােগিতার সূচনা ঘটাবে।

আমেরিকা মনে করে বিষয়টির আশু নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়ােজন। ইয়াহিয়া খানকে অনেক আগেই অফার দেয়া হয়েছে এবং এখন সেটি বাস্তবায়নের সময় এসেছে। বিলম্ব হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং আমেরিকা এতে আরাে দেরি করে অস্ত্র বিক্রির পেছনের রাজনৈতিক সুবিধা হারাতে চায় না। ভারতকে এ ব্যাপারে যথাসময়ে জানানাে না হলে ভারতের সঙ্গে উদীয়মান সু-সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়াও ব্যাহত হবে।

ভারতের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলােচনার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলাে ভারতকে নিশ্চয়তা দেয়া যে, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ ভারতের বিপক্ষে নয় এবং তা উপমহাদেশে সামরিক দুর্যোগ সৃষ্টি করবে না।

বলাবাহুল্য, আমেরিকা থেকে পাকিস্তানে যে সামরিক সম্ভার পাঠানাের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রতি সােভিয়েত ও ফরাসি প্রতিশ্রুতি তার

পৃষ্ঠা: ১০৪

চাইতে বহুগুণে বেশি। গােয়েন্দা সূত্রের মতে, সােভিয়েত ২০০টি টি-৫৪ এবং টি-৫৫ ট্যাংক সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং মাত্র ৬০টি এখন পর্যন্ত ডেলিভারী দেয়া হয়েছে। ১৯৬৮ সালে তারা এর পাশাপাশি পাকিস্তানকে ১১২টি ১৩০ মিমি কামান সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে যার মধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ৬০টি। সম্প্রতি ফরাসিরা পাকিস্তানের কাছে ৩০টি সুপারসনিক মিরেজ-৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি করেছে। এসব লেনদেনের সময় ভারত খুব একটা উচ্চবাচ্যও করেনি। পর্যালােচনায় বলা হয়,

ভারতকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার যে, ১৯৬৫ সাল থেকে পাকিস্তান ও ভারতে আমেরিকার অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। সে সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্র কোনাে দেশেই কোনাে মারণাস্ত্র বিক্রি করেনি। অবশ্য ১৯৬৭ সালে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে আমেরিকা ভারতে যুক্তরাজ্য থেকে ১২টি আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত হান্টার বিমান এবং সম্প্রতি ব্রিটেন থেকে আরাে ১২টি মার্কিন নিয়ন্ত্রিত ক্যানবেরা বিমান বিক্রি করেছে পাকিস্তান ও ভারতের কাছে।

আমেরিকার এটাই ছিল তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে একমাত্র লেনদেন। যাই হােক, শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের তহবিলের অভাবে আমেরিকার পাকিস্তানকে সাহায্যদানের প্রক্রিয়া ক্রমশ বিলম্বিত হয়ে যাওয়ায় এই ইস্যুটি একসময় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ভারত থেকে আমেরিকা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে বলেও অভিযােগ তােলা হয়। এমনকি এ অভিযােগও তােলা হয় যে, আমেরিকা এবং আমেরিকার বন্ধুপ্রতিম ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ভারতের সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চাইছে। শেষপর্যন্ত কূটনৈতিক যােগাযােগের মাধ্যমে এসব অভিযােগও নিরপেক্ষকরণ সম্ভব হয়।

পৃষ্ঠা: ১০৫

তথ্য নির্দেশিকা

১. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য : রবার্ট ম্যাকমােহন, কোল্ড ওয়ার অন দ্য পেরিফেরি, দ্য ইউনাইটেড স্টেটস, ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান; কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৪।

২. পরবর্তীকালে বাগদাদ চুক্তি সেন্টো-তে পরিণত হয়।

৩. সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৬৩০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সম্ভার, ৬১১ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য ও ৫৫ মিলিয়ন ডলারের নগদ অর্থে অস্ত্র সরবরাহ। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ৪০০ মিলিয়ন ডলারের স্থলে ১৯৬০ সালে তা ৮২২ মিলিয়নে পৌছে।

৪. ড. স্টিফেন সি কোহেন, ইন্ডিয়া অ্যান্ড আমেরিকা : অ্যান ইমার্জিং রিলেশনশীপ, ন্যাশন স্টে সিস্টেম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ফোর্সেস ইন সাউথ এশিয়া কনফারন্সে পাঠকৃত প্রবন্ধ। ডিসেম্বর ৮-১০, ২০০০, কিয়ােটো, জাপান।

৫. ডব্লিউ ডব্লিউ রস্ট্রো, দ্য ডিফিউশন অব পাওয়ার : অ্যান এসে ইন রিসেন্ট হিস্টরি, নিউইয়র্ক, ম্যাকমিলান পাবলিকেশন, ১৯৭২

৬. ড. স্টিফেন কোহেন, প্রাগুক্ত।

৭. ১৯৫৩-৫৯ সালে জেনারেল আইসেনহাওয়ারের সময় আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট।

৮. টুওয়ার্ড ফ্রিডম, অ্যান অটোবায়ােগ্রাফি অব জওহরলাল নেহেরু, বিকন প্রেস, বােস্টন, পুনঃমুদ্রণ ১৯৫৮।

৯. ভারতীয় পারমাণবিক পদার্থবিদ, টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসাের্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, যাকে ভারতীয় পারমাণবিক কর্মসূচির জনক বলা হয়।

১০. নেহেরু, প্রাগুক্ত। ১৯২৭ সালে নেহরু রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন।

১১. মােরারজি দেশাই, দ্য হিস্টরি অব মাই লাইফ, দ্বিতীয় খণ্ড, নয়াদিল্লি, ১৯৭৪। পৃ. ১৭১-১৭২।

১২. অবশ্য সব ইতিহাসবিদ এ কথা স্বীকার করেন না। তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আফগানিস্তানে সােভিয়েত আগ্রাসন শুরু হবার অনেক আগে থেকেই ভারত উল্লেখযােগ্য পরিমাণে সামরিক সম্ভার ক্রয় করেছিল এবং রিগান প্রশাসন পাকিস্তানকে একগুচ্ছ অস্ত্র সরবরাহের আগেই ভারত সােভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে বিরাট পরিমাণে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য দেনদরবার করছিল।

১৩. এয়ার মার্শাল কে ডি চাধা, ইন্দো-পাক এন্টাগনিজম, হােয়াই দা ইম্পাসে, ইন্ডিয়ান ডিফেন্স রিভিউ, জানুয়ারি, ১৯৯০।

১৪. চাধা, প্রাগুক্ত।

১৫. সূত্র : ওয়াইকিপেডিয়া, কাশ্মির কনফ্লিক্ট, ফ্রি এনসাইকোপ্লেডিয়া।

১৬. কোহেন, প্রাগুক্ত।

১৭. ডেনিস কুক্স, ইউ এস ফরেন পলিসি ইন সাউথ এশিয়া, সাম লেসন্স ফ্রম হিস্ট্রি, বুকিং ইন্সিটিউট আরকাইভস।

পৃষ্ঠা: ১০৬

১৮. গ্যারি হবেয়ার, জেফরি শর্ট অ্যান্ড কিম্বারল এলিয়ট, ইকনমিক স্যাংশন রিকন্সিডার্ড, সাপ্লিমেন্টাল কেস হিস্টরিস, ওয়াশিংটন ডি সি ইন্সিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিকস,

১৯৯৩।

১৯. ভারতে অর্থনৈতিক সাহায্যের ওপর মেমােরেন্ডাম, ওয়াশিংটন, মার্চ ১৯৬৯

২০. সরবরাহকালে ইংরেজিতে ‘সরগম’ বলা হয়েছে, যাকে ভুট্টাজাতীয় জোয়ার বা ভুট্টা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

২১. কিসিঞ্জারের কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পাঠানাে গােপন মেমােরেন্ডাম, জুলাই ১৬, ১৯৬৯, ন্যাশনাল আরকাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, এন এস সি ফাইলস, বক্স নং ৫৯৫, গােপনীয়।

২২. ১৯৬৭ সালের চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনেক কমে যায় ও সে সময় কংগ্রেস মাত্র ৫৪ শতাংশ সংসদীয় আসনে জয়ী হয়। বিহার, কেরালা, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ,পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে অকংগ্রেসীয় সরকার গঠন করা হয়। উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটে এবং রাজস্থানকে প্রেসিডেন্টের প্রত্যক্ষ কেন্দ্রীয় সরকার শাসন আইনে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে নিয়ে আসা হয়। সূত্র : জেমস হেইজম্যান ও রবার্ট ওরডেন, ইন্ডিয়া : এ কান্ট্রি স্টাডি, ওয়াশিংটন, লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, ১৯৯৫।

২৩. প্রেসিডেন্টের জন্য কিসিঞ্জারের গােপন মেমােরেন্ডাম, জুলাই ১৮, ১৯৬৯।

২৪. নিক্সন তখন জুলাই ৭ তারিখে এক রাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড সফরে বের হন। গুয়ামে তিনি রাত্রিকালীন যাত্রাবিরতি করেন। অতঃপর সেখান থেকে তিনি ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তানে যান। এ ছাড়া তিনি অনির্ধারিত সফরে ভিয়েতনাম, সরকারি সফরে রুমানিয়া ও লন্ডনের মিল্ডেনহল এয়ার ফোর্স বেইসে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেন ও

প্রাইম মিনিস্টার হ্যারল্ড উইলসনের সঙ্গে দেখা করেন।

২৫. কংগ্রেস পার্লামেন্টারি বাের্ড ১১ জুলাই ১৯৬৯ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনােনয়নের জন্য বৈঠকে বসে। দল থেকে আগেই সঞ্জিব রেড্ডিকে প্রেসিডেন্ট পদে মনােনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বৈঠকে ইন্দিরা বয়ােঃবদ্ধ নেতা জগজীবন রামকে প্রেসিডেন্ট পদে মনােনয়ন দেবার জন্য প্রস্তাব দেন। তার এ দাবি প্রত্যাখ্যাত হলে ইন্দিরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে না আসা অবধি বৈঠক মুলতবি করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু নিজলিঙ্গাপ্পা বিষয়টি ভােটে উঠালে ইন্দিরা ৪-২ ভােটে হেরে যান। পরদিন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াবার ঘােষণা দেন। মিসেস গান্ধী জানতেন যে ভি ভি গিরিকে সমর্থন দিতে হলে আগে তাকে পার্টির অন্যান্যদের সমর্থন অর্জন করতে হবে। মােরারজি দেশাইকে কেবিনেট থেকে বহিষ্কার করে এবং ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করে সেই আস্থা তিনি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। এর পর ইন্দিরা নিজেই সঞ্জিব রেড্ডির পক্ষে মনােনয়ন দাখিল করেন। কংগ্রেস নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন যে ইন্দিরা শেষ মুহূর্তে গিরিকে-ই সমর্থন দেবেন। তাই তারা চরমভাবে ভুল করে প্রধান বিরােধী দলের সঙ্গে আঁতাতের চেষ্টা করেন। এ সুযােগে ইন্দিরা গান্ধী বাম দলগুলাের সঙ্গে যােগাযােগ করে নির্বাচনের আগের রাতে গিরিকে সমর্থন দেন ও নির্বাচনে গিরিকে জিতিয়ে আনেন। নির্বাচনে গিরি পান ৪২০,০৭৭ ভােট আর সঞ্জিব রেডিড পান ৪০৫,৪২৭ ভােট। বিরােধী দলের প্রার্থী দেশমুখ ছিলেন তৃতীয় স্থানে। তিনি পান ১১২,৭৬৯ ভােট।

পৃষ্ঠা: ১০৭

২৬. ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব কাউল সে সময়ে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক আলােচনার জন্য এক বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিতে ওয়াশিংটনে ছিলেন। পরবর্তীকালে সেক্রেটারি রজার্স ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিংয়ের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন ও একই মনােভাব ব্যক্ত করেন।

২৭. ন্যাশনাল আরকাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, এন এস সি ফাইলস, বক্স নং ৫০৬, গােপনীয়। টেলিগ্রাম নং ১৭৫৪৩৪।

২৮. ইন্টারন্যাশনাল কন্ট্রোল কমিশন বা আই সি সি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যার দায়িত্ব হলাে ইন্দোচীন যুদ্ধ তথা ভিয়েতনামের বিভক্তির পর জেনেভা কনভেনশনের পরিপন্থী কোনাে কার্যকলাপ হচ্ছে কি না এই সংস্থা তা পর্যবেক্ষণ করে। কমিউনিস্ট, নন কমিউনিস্ট এবং জোট নিরপেক্ষ ব্লকের পক্ষ থেকে পােল্যান্ড, কানাডা ও ভারত থেকে প্রতিনিধি সমন্বয়ে এই সংস্থা গঠিত।

২৯. ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল রিভিউ গ্রুপের অ্যানালিটিক্যাল সামারি, নভেম্বর ২২, ১৯৬৯। ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস।

৩০. কোহেন, প্রাগুক্ত।

৩১. রিভিউ কমিটির বৈঠকের বিশ্লেষণ, নভেম্বর ২৫, ১৯৬৯।

৩২. আমেরিকা দাবি করে যে উক্ত কেন্দ্রগুলােতে কূটনৈতিক বা কনস্যুলার পর্যায়ের কোনাে প্রতিনিধি পর্যন্ত ছিল না। এবং প্রাইম মিনিস্টার নেহেরুর সঙ্গে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত চেষ্টার রাউলের এক সমঝােতার ভিত্তিতে কেন্দ্রগুলাে খােলা হয়েছিল। একই ধরনের সমঝােতার ভিত্তিতে সােভিয়েত ইউনিয়ন ত্রিবান্দ্রামে সােভিয়েত তথ্য কেন্দ্র খােলার প্রস্তাব দিয়েছিল।

৩৩. টেলিগ্রাম নং ২৯৫৬৯। সূত্র : এন এস সি ফাইলস, বক্স নং ৫৯৬।

৩৪. ভারতের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের পাঠানাে চিঠি : প্রাপক সেক্রেটারি রজার্স, মার্চ ৫, ১৯৭০, ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, এন ই এ/ আই এন এস ফাইলস, লট ৭৩, ডি ৩৭৭।

৩৫. ন্যাশনাল আর্কাইভস, বক্স ৫৯৬, অতি গােপনীয়।

৩৬. ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, এন এস সি ফাইলস, বক্স ৫০৬।

৩৭. প্রাগুক্ত, বক্স ৫৯৬, কান্ট্রি ফাইলস, মিডল ইস্ট, ভারত, ২য় খণ্ড, ১০/৬৯-৮/৭০।

৩৮. নিক্সনের পাঠানাে প্রস্তাবটি ছিল তারিখবিহীন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাতে অনুমােদন দান করেন ১৯ মে। এতে বােঝা যায় যে এর অন্তত দু’তিন দিন আগে মেমােটি পাঠানাে হয়েছিল।

৩৯. প্রাগুক্ত।

৪০. ১৯৬৩/৬৪ সালের ২ মিলিয়ন ডলার থেকে এ খাতে ভারতের ব্যয় ১৯৬৯/সালে দাঁড়িয়েছিল ৪৬ মিলিয়ন ডলারে।

৪১. দীনেশ সিংয়ের পরে সর্দার শরণ সিং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হন। ২৭ জুন দীনেশ সিং এর পরিবর্তে তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়। এর আগে তিনি ছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

৪২. দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানাে টেলিগ্রাম। টেলিগ্রাম নং ৮৪২৪।

৪৩. আলােচনার সারসংক্ষেপের ওপর মেমােরেন্ডাম, ওয়াশিংটন, জুলাই ২২, ১৯৭০। ন্যাশনাল আর্কাইভস, বক্স ৫৯৬, গােপনীয়।

Ref: মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!