You dont have javascript enabled! Please enable it! ইয়াহিয়ার উত্থান : সতর্ক যুক্তরাষ্ট্র | মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপন দলিল - জগলুল আলম - সংগ্রামের নোটবুক

ইয়াহিয়ার উত্থান : সতর্ক যুক্তরাষ্ট্র | মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম

১৯৬৯ সালের ২৭ মার্চ ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিলালী ওয়াশিংটনে সেক্রেটারি অব স্টেট রজার্সের কাছে একটি চিঠি হস্তান্তর করেন। চিঠিতে বলা হয় যে, পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল এ এম ইয়াহিয়া খান নিম্নোক্ত ব্যক্তিগত মেসেজটি প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এস নিক্সনের কাছে হস্তান্তরের অনুরােধ জানিয়েছেন।১
এক্সেলেন্সি,
২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইউব খান এক চিঠিতে দেশের বেসামরিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমাকে জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানে বেসামরিক শাসনব্যবস্থা ও সংবিধান অচল হয়ে পড়ায় তার আর সরে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই এবং এমতাবস্থায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দেশের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নিতে হবে। ২৫ মার্চ রাতে তিনি পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্ত ঘােষণা করেন এবং সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে আমাকে ডেকে শুধুমাত্র বহিঃশত্রুর মােকাবিলাই নয়, অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙখলাও রক্ষা করার জন্য আমার ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনেরও আহ্বান জানান।
২. ফলে আমি দেশে সামরিক আইন জারি করেছি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে সর্বময় ক্ষমতা হাতে নিয়েছি।
৩. আমার সর্বতাে প্রচেষ্টা হবে দেশে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, স্বল্পতম সময়ে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনর্বহাল এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা।
৪. এই দুঃসময়ে পাকিস্তান তার সর্বস্তরের বন্ধুদের কাছ থেকে সহমর্মিতা, সমঝােতা ও সমর্থন আশা করে। আমি বিশ্বাস করি পাকিস্তান এবং আপনার মহান। দেশের মধ্যকার সম্পর্ক কেবল বহালই থাকবে না বরং দিন দিন গাঢ়তর হবে।
পৃষ্ঠা: ২৯

আমি আমার পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, পাকিস্তান সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় এবং এ নীতির কোনাে ব্যত্যয় ঘটবে না।
রাষ্ট্রদূত হিলালী ইয়াহিয়া খানের চিঠিটি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের হাতে পৌঁছানাের ব্যবস্থা করার অনুরােধ জানান।
১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে আইউব খানের ক্ষমতা দখলের সঙ্গে ১৯৬৯ সালের ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা দখলের কোনাে মিল ছিল না। মনেপ্রাণে কেউ সামরিক শাসন কামনা না করলেও আইউব খানের ১১ বছরের দুঃশাসনামলে পাকিস্তানের জনগণ ছিল অতিষ্ঠ। ইয়াহিয়া খানের প্রধান লক্ষ্য ছিল ভেঙে যাওয়া ঘর মেরামত করা। দেশের দু’অংশের মধ্যকার চরম বৈষম্য, বৈষম্যমূলক চাকুরি কাঠামাে, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির নিদারুণ দৈন্যদশা ইত্যাদি পূর্ব পাকিস্তানকে সামগ্রিকভাবে পশ্চিমাংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল।
ইয়াহিয়া খানকে আইউব খান পরামর্শ দিয়েছিলেন তার নীতিমালাই অনুসরণ করার। কিন্তু ইয়াহিয়া পা বাড়ালেন তার বিপরীত দিকে। ক্ষমতায় আসার পরপরই তিনি প্রথমে লাহােরে এবং পরে ঢাকায় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা করলেন। এদের মধ্যে ছিলেন মুমতাজ দৌলতানা, মাওলানা মওদুদী, সরদার শওকত হায়াত খান, নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী এবং শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু প্রতিটি বৈঠকে নেতারা আইউব খানের কাছে প্রস্তাবিত বিষয়গুলােই উত্থাপিত করায় আলােচনায় বিশেষ কোনাে ফল পাওয়া গেল না। ফলে ইয়াহিয়া খান যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান আবার পররাষ্ট্রনীতির বেলায় আইউব খানের রেখে যাওয়া কর্মপদ্ধতিই অনুসরণ করলেন। ১৯৬৯ সালের ১ এপ্রিল তিনি উপপ্রধান। সামরিক আইন প্রশাসক ও নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এ কে এম আহসানকে ওয়াশিংটনে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করতে পাঠান।
পরের দিন ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে মার্কিন দূতাবাসে পাঠানাে এক টেলিগ্রামে সেই বৈঠকের বিশদ বিবরণী পাওয়া যায়।২ প্রসঙ্গত, আহসান ওয়াশিংটন গিয়েছিলেন সদ্যপ্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইসেনহাওয়ারের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যােগ দেয়ার অজুহাতে। টেলিগ্রামে বলা হয়,
আন্ডার সেক্রেটারি প্রথমেই জানতে চান ঠিক কী পরিস্থিতিতে সামরিক আইন জারি করা হয়েছিল। আহসান বলেন, শ্রমিকরা আইন তুলে নিচ্ছিল নিজেদের হাতে, অনবরত ধর্মঘটে চারিদিকে ছিল বিশৃঙ্খলা এবং পুলিশ বাহিনী আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। তিনি বলেন, সামরিক আইন জারি করার
পৃষ্ঠা: ৩০

পরও কোনাে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়নি বা কোনাে রাজনৈতিক নেতাকে আটক করা হয়নি। আন্ডার সেক্রেটারি জানতে চান এক্ষণে দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহাল করতে গেলে কী প্রয়ােজন হবে। জবাবে আহসান বলেন, রাজনৈতিক নেতারা সংবিধান মেনে নিয়ে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের পক্ষে মত দিলেই তা হবে পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণের জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেন, এ যাবৎ সামরিক নেতারা রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করেননি এবং নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট দিন তারিখও এর আগে স্থির করা হয়নি।
এ অবস্থায় কী আশা করা যেতে পারে এ প্রশ্নের জবাবে আহসান বলেন, ৩১ মার্চ এক বিবৃতিতে তিনি নিজেই বলেছেন যে, আগামী জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। তিনি বলেন, এমতাবস্থায় সামরিক বাহিনী ব্যারাকে ফিরে গিয়ে শূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে না। বরং তারাই নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। আহসান বলেন, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। অতীতে সরকার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সেখানে অবিচার করেছে এবং এক্ষণে তাদের জন্য কিছু করার দায়িত্ব সরকারকেই হাতে নিতে হবে।
আন্ডার সেক্রেটারি বলেন, মূলত রিঅ্যাকশন এবং ওভার রিঅ্যাকশনের কারণেই সমস্যা দেখা দেয়। হিটলার ও মুসােলিনী সে কারণেই একনায়কতন্ত্রকে অ-জনপ্রিয় করে গেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে কোনাে কোনাে সময় সামরিক শাসন অপরিহার্য এবং গঠনমূলক হতে পারে, কিন্তু সেই অপরিহার্যতা ও গঠনমূলক প্রবৃত্তির যথার্থ সংজ্ঞা নিরূপণ করা কঠিন।
অ্যাম্বেসেডর হিলালী আলােচনাক্রমে জানান যে, অ্যাডমিরাল আহসান যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রনীতি সম্পর্কে এবং দক্ষিণ এশিয়ার অস্ত্র সরবরাহ নীতির সর্বশেষ পর্যালােচনা সম্পর্কে জানতে চান। আন্ডার সেক্রেটারি বলেন যে সবকিছু আগের মতােই চলছে এবং দু’এক মাসের মধ্যেই সর্বশেষ অবস্থান জানা যাবে।
আন্ডার সেক্রেটারি বলেন, আমাদের অস্ত্রনীতি নিয়ে নানা ধরনের কথা হয়। আমেরিকানরা বলেন, আমাদের অস্ত্র ব্যবসাই করা উচিত না। কেউ কেউ বলেন, অন্য দেশের অভ্যন্তীরণ বিষয়ে আমাদের হস্তক্ষেপ করা উচিত না। আবার কেউ কেউ বলেন, আমাদের এমন দেশে সাহায্য পাঠানাে উচিত না যারা সাহায্যের টাকা দিয়ে অস্ত্র কিনে অপচয় করবে।
অ্যাডমিরাল বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই তা হবে দারুণভাবে ক্ষতিকর। কারণ এখন অন্যান্য দেশ আমেরিকার স্বার্থবহির্ভূত দেশগুলাে থেকে অস্ত্র সরবরাহ করা শুরু করবে কিংবা পশ্চিম ইউরােপের বিভিন্ন দেশ থেকে চড়া দামে অস্ত্র কিনতে বাধ্য হয়ে বিপুলভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বহাল রাখার জন্যও প্রচুর
পৃষ্ঠা: ৩১

অস্ত্রের প্রয়ােজন বলে তিনি মন্তব্য করেন। অ্যাডমিরাল বলেন, এ মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাকিস্তানের সাহায্য পাওয়ার বিষয়টি মানসিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ এবং মার্কিন সদিচ্ছা ভবিষ্যতে উভয়ের জন্য মুনাফাজনক হবে।
পাক-রাশিয়া সম্পর্ক ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পরও ১৯৪৯ সাল নাগাদ পাকিস্তান মস্কোতে কোনাে রাষ্ট্রদূত নিয়ােগ করেনি। ১৯৪৯ সালের ২ জুন মস্কো থেকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে আমন্ত্রণ জানানাে হলে পাকিস্তান তা সাদরে গ্রহণ করে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কূটনৈতিক ও পররাষ্ট্রবিষয়ক জটিলতার কারণে সেই সফর বাস্তবায়িত হয়নি। পরিবর্তে ১৯৫০ সালের মে মাসে লিয়াকত আলী খান। আমেরিকা যান এবং পাকিস্তানিদের ভাষায় ‘সঠিক মিত্র বেছে নেন।৩
১৯৫০ সালের নভেম্বরে রাশিয়া পাকিস্তানের কাছে আমেরিকার সঙ্গে গাঢ় ঘনিষ্ঠতার ব্যাখ্যা দাবি করে। পাকিস্তান মস্কোকে আশ্বস্ত করে বলে যে পাকিস্তান কখনােই নিজ ভূখণ্ডকে সােভিয়েতবিরােধী তৎপরতার জন্য ব্যবহার করতে দেবে না। ১৯৬০ সালে একটি আমেরিকান ইউ-২ গুপ্তচর বিমান পেশােয়ার থেকে উড্ডয়ন করে সােভিয়েত সীমানায় ঢুকে পড়লে গুলি করে সেটিকে ভূপাতিত করা হয়। একে রাশিয়া পাকিস্তানের ওয়াদার বরখেলাপ বলে ধরে নেয়। এর পরপরই পাকিস্তান একে একে আমেরিকার তাঁবেদারিতে সিয়াটো, সেন্টো, বাগদাদ চুক্তি ও অন্যান্য জোটে ঢুকে পড়লে রাশিয়া এবার কাশ্মীর প্রশ্নে নিজের নিরপেক্ষ অবস্থান পরিবর্তন করে সরাসরি কাশ্মীরবাসীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে সমর্থন দিতে থাকে।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান ও রাশিয়ার মধ্যে প্রথম বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও চুক্তির ফলাফল তেমন আশানুরূপ হয়নি। দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক তখন এতােই তিক্ত ছিল যে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে দেশব্যাপী কলেরার প্রকোপ দেখা দিলে পাকিস্তান তার সাহায্যার্থে রাশিয়ান মেডিকেল টিমকে স্বাগত জানাতেও অনীহা। প্রকাশ করে।
তবে ইউ-২ গুপ্তচর বিমান ভূপাতিত হবার ঘটনার পর থেকে পাকিস্তান তার পররাষ্ট্রনীতিতে কিছুটা অদলবদল ঘটানাের কথা চিন্তাভাবনা শুরু করে। এ সময় আমেরিকাও ভারতে খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য বাড়িয়ে দেয় এবং পাকিস্তান তা নিজের নিরাপত্তার ওপর হুমকি বলে মনে করতে থাকে। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানে সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত মিখাইল কাপিটসা একবার পরিহাস করে বলেছিলেন, আমরা ভারত ও আফগানিস্তানকে সমর্থন করি কারণ তারা আমাদের বন্ধু। এমনকি তারা ভুল করলেও আমাদের বন্ধু। কিন্তু তােমরা ভুল করনি এটা জানার পরও তােমাদের বন্ধু তােমাদের সমর্থন করে না।৪
পৃষ্ঠা: ৩২

১৯৬১ সালের ৪ মার্চ পাকিস্তান রাশিয়ার সঙ্গে একটি তেল অনুসন্ধান চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং প্রথমবারের মতাে রাশিয়ার কারিগরি সাহায্য স্বীকার করে নেয়। ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ক্রুশ্চেভকে নেপাল ও সিংহল সফরের সময় পাকিস্তানেও সফরের আমন্ত্রণ জানায়। শেষ পর্যন্ত ক্রুশ্চেভ তার দক্ষিণ এশিয়া সফর বাতিল করেন। ফলে তিনি আর পাকিস্তান যেতে পারেননি। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে তিনি প্রেসিডেন্ট আইউব খানকে মস্কো যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে আইউব খান মস্কো সফরে যান।
তবে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রাশিয়ার এ দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন ঘটে। এ সময় রাশিয়া আপাতভাবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করায় শেষ পর্যন্ত পাক-ভারত উভয়পক্ষকে তাসখন্দে আমন্ত্রণ জানানাের সুযােগ পায়। তাসখন্দের ব্যাপারে আমেরিকারও কোনাে অসম্মতি ছিল না, কারণ মার্কিন-সােভিয়েত উভয় পরাশক্তিরই তখন লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাবকে দমিয়ে রাখা। তাসখন্দ চুক্তি পাক-ভারতের মধ্যকার উত্তেজনা পুরােপুরি প্রশমনে ব্যর্থ হলেও তা পাকিস্তানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কোন্নয়নে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।
১৯৬৮ সাল নাগাদ রাশিয়া পাকিস্তানের সঙ্গে ছােটখাটো একটা অস্ত্র সরবরাহ চুক্তি সম্পাদন করলে ভারত তাতে অখুশি হয়। এমনকি একপর্যায়ে ভারত ফারাক্কা ইস্যুতে কোসিগিনের মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবও নাকচ করে দেয়। একপর্যায়ে ১৯৬৮ সালের আগস্টে রাশিয়া চেকোশ্লোভাকিয়ায় আগ্রাসন চালালে ভারত তাতেও মৃদু প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তান অবশ্য সে সময় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।
১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সােভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্শাল আন্দ্রেই গ্রেকো পাকিস্তান সফর করেন এবং মুখের ওপর পাকিস্তানকে বলেন যে, পাকিস্তান একই সঙ্গে চীন ও সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে পারবে না। সে পর্যায়ে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সােভিয়েতের বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করলে গ্রেচকো জবাব দেন যে সুপার পাওয়ারের সঙ্গে যা সম্ভব পাকিস্তানের সঙ্গে তা সম্ভব হতে পারে না। ১৯৬৯ সালের মে মাসে কোসিগিন দ্বিতীয়বারের মতাে পাকিস্তান সফর করেন এবং পাকিস্তান, ভারত, ইরান, আফগানিস্তান ও সােভিয়েত ইউনিয়নের সমন্বয়ে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযােগিতার প্রস্তাব দেন। একই বছর ৭ জুন ব্রেজনেভ মস্কোতে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিস্ট কনফারেন্সে একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি তােলেন, যার মূল থিম ছিল এশিয়ার জন্য একটি সমন্বিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। পাকিস্তান অবশ্য দুটির কোনােটিতেই খুব একটা সাড়া দেয়নি। ১৯৭০ সালের জুন মাসে ইয়াহিয়া খান মস্কো সফরে গিয়ে সােভিয়েত অস্ত্র সরবরাহের ইঙ্গিত দিলে কোসিগিন তাকে বলেন যে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সম্মত না হলে পাকিস্তান সােভিয়েতের কাছ থেকে অস্ত্র সরবরাহ আশা করতে পারে না।
পৃষ্ঠা: ৩৩

মার্কিন-দক্ষিণ এশিয়া সামরিক নীতি
১৯৬৯ সালের ১৬ এপ্রিল রাওয়ালপিন্ডিস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে হােয়াইট হাউসে পাঠানাে এক টেলিগ্রামে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন সামরিক নীতির পূর্বাপর অবস্থা এবং তদানীন্তন অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়। অতি গােপনীয় সেই টেলিগ্রামের কপি পাঠানাে হয় ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, প্রতিরক্ষা বিভাগ, বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রধানদের কাছে।৫
টেলিগ্রামে বলা হয়,
পাকিস্তানে সােভিয়েত যুদ্ধাস্ত্র পাঠানাে এবং সেখানে সামরিক আইন জারির প্রেক্ষাপটে সমস্যার দুটি ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এর আগে অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন সামরিক নীতির ওপর কিছুটা আলােকপাত করা প্রয়ােজন।
এতে বলা হয় যে,
আইসেনহাওয়ার ও নিক্সন প্রশাসনের সময় পাকিস্তান ছিল আমাদের ঘনিষ্ঠতম মিত্রদের একজন। সে সময় বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ছিল সিয়াটো, সেন্টো ও ইউ-২ উড্ডয়নের জন্য বেস পেশােয়ার, অথচ আজকাল সিয়াটো নিষ্ক্রিয়, অর্থনৈতিক বিষয়াদি বাদ দিলে সেন্টো অস্তিত্ববিহীন, ইউ-২-এর প্রয়ােজনীয়তা অনেক আগেই ফুরিয়েছে এবং পাকিস্তান, চীন ও রাশিয়া উভয়ের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ব্যস্ত রয়েছে।
অন্যদিকে আইউব সরকারের পতনের পর সামরিক শাসন জারি হওয়ার প্রেক্ষাপট হিসেবে দেশে দেখা দিয়েছে গােলযােগ, কেন্দ্রীয় সরকার হুমকির মুখে এবং চরম বামপন্থীসজ্জিত দেশের পূর্বাংশে সংস্কারবাদীরা ক্ষমতার দিকে এগুচ্ছে।
এর জন্য আমরা পাকিস্তান সরকারকে ভুলের জন্য কিছুটা দায়ী করতে পারি। কিন্তু এর আগে পাকিস্তানিদের ধারণায় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সাহায্য অব্যাহত রাখার পরও আমরা যেসব ভুল করেছি সেগুলাে বিবেচনায় নেয়া উচিত।
১. ১৯৬২ সালে আমরা প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করেছি। এবং তার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে কোনাে আলােচনা করিনি।
২. ১৯৬৫ সালের বসন্তকালে আমরা অত্যন্ত রূঢ়ভাবে প্রেসিডেন্ট আইউবের যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করেছি।
৩. ১৯৬২ সালের ৫ নভেম্বর অ্যাম্বেসেডর ম্যাককনি একটি গােপন স্মারকলিপি পাঠিয়ে বলেছিলেন যে পাকিস্তান ভারত দ্বারা আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসবে। কিন্তু ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান ভারত কর্তৃক আক্রান্ত হলে আমরা পাকিস্তানকে সাহায্য করিনি।
৪. ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে আগে হামলা চালিয়েছে ভারত। তখন ভারতের অভিযােগ ছিল যে, পাকিস্তান কাশ্মীরে অস্ত্র ও সৈন্য পাচার করছে যা
পৃষ্ঠা: ৩৪

সর্বাংশে সত্য। কিন্তু অতীতে কী হয়েছে তা জেনেও আমরা নিশ্রুপ থেকে ঠিক কাজ করিনি।
৫. আমরা যে কেবল পাকিস্তানের জন্য এগিয়ে আসিনি তাই নয়, আমরা অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছি, মিলিটারি সাপ্লাই মাঝপথে বাতিল করেছি এবং খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ বন্ধ করেছি। ভারতের ক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে। তবে এতে পাকিস্তানের ক্ষতি হয়েছে অনেক বেশি। কারণ পাকিস্তানের সব অস্ত্রই আমেরিকান, যেখানে ভারতে মাত্র কিছু পরিমাণ অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানাে।
৬. সে সময় চীন নিজ দেশে ভারতীয় সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে, ভারতকে হুমকি দিয়েছে। পরবর্তীকালে পাকিস্তানে প্রচুর পরিমাণ ট্যাংক, গােলাবারুদ, যুদ্ধবিমান ইত্যাদি পাঠিয়ে সাহায্য করেছে ও পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য পাঠানাের ব্যবস্থা করেছে।
এর ফল হয়েছে এই যে : (ক) পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনগণ মনে করেন যে আমেরিকা তাদের পৃষ্ঠদেশে ছুরিকাঘাত করেছে। (খ) সকল পর্যায়ে পাকিস্তানিরা মনে করে যে, চীন তাদের অকৃত্রিম বন্ধু এবং পৃথিবীতে একমাত্র নির্ভরযােগ্য মিত্র। (গ) চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযােগিতার পাশাপাশি চাইনিজ এক্সপার্ট, টেকনিশিয়ান, মিলিটারি ও শ্রমিকরা পাকিস্তানে আসতে পেরেছে। (ঘ) সে সব চাইনিজ তাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছে লাল বই, সঙ্গে মাও-এর ব্যাজ, শ্লোগান ও চীনের অন্যান্য সব রকমের প্রচার সরঞ্জামাদি।
৭. ১৯৬৭ সালের এপ্রিল মাসে আমরা পাকিস্তানকে জানিয়েছিলাম যে, আমরা অস্ত্রশস্ত্রের জন্য স্পেয়ার পার্টসের সরবরাহ আবার শুরু করতে যাচ্ছি। এবং এর পর থেকে আমরা তা কেস বাই কেস ভিত্তিতে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পাঠাবাে। সার্বিক তদারকিতে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।
(ক) এক বছর আগে আইউবের কাছে আমাদের প্রেসিডেন্টের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও জার্মানি, ইটালি ও বেলজিয়াম থেকে ট্যাংক পাঠানাের কার্যক্রম প্রত্যাহার করা হয়েছে। আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল এখন ১০০ এবং পরে আরাে ১০০ ট্যাংক পাঠানাে হবে। (খ) তুরস্ক থেকে ট্যাংক পাঠানাের একটি প্রস্তাব মাসের পর মাস ধরে ঝুলে আছে। এখন সেটা বাস্তবায়িত হলেও ডেলিভারিতে ১৫ মাস লেগে যাবে। (গ) ইতােমধ্যে ইরান ট্যাংক দিতে চাচ্ছে, কিন্তু আমরা তা বারবার অস্বীকার করছি কারণ আমরা যে কোনাে দেশ থেকে তা নেবাে
পৃষ্ঠা: ৩৫

কিন্তু ইরান থেকে নেয়া যাবে না বলে আমাদের পলিসি দিকনির্দেশনা রয়েছে।
৮. এ সমস্ত ব্যর্থ প্রচেষ্টার ফলে আমরা যেসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছি সেগুলাে হলাে—
(ক) জার্মানি, ইটালি, বেলজিয়াম ও তুরস্ককে অস্বস্তিতে ফেলেছি; (খ) বারবার ভারতকে বিরক্ত করেছি; (গ) ইরানকে বিব্রত করেছি এবং (ঘ) পাকিস্তানকে বারবার এই ধারণা দিয়েছি যে আমাদের প্রতিশ্রুতি এবং তা বাস্তবায়নের মধ্যে কোনাে মিল নেই।
৯. ইতােমধ্যে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে বিরাট আকারের সাহায্য পেয়েছে এবং ট্যাংক, জেট এয়ারক্র্যাফট ও অন্যান্য সরঞ্জাম নির্মাণের দক্ষতা অর্জন করেছে।
১০. পাকিস্তান লজিস্টিক, ট্রেনিং, আর্থিক এবং আদর্শগত কারণে আমেরিকান অস্ত্রশস্ত্র পেতে চায়। তারা কমিউনিস্ট দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে চায় না। কিন্তু তাদের জন্য আর কী পথ খােলা আছে?
১১. দেখা যাচ্ছে যে, প্রয়ােজনের কারণেই তারা এখন আবার মূল সাপ্লাইয়ের জন্য কমিউনিস্ট দেশগুলাের দিকে ঝুঁকছে। তাদের থামাবার সকল সম্ভাবনা এখনাে শেষ হয়ে যায়নি।
১২. পাকিস্তানের বর্তমান গােলযােগের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরাে জরুরি হয়ে পড়েছে।
কারণ : (ক) চীনপন্থী ভাসানী এবং সংস্কারবাদী ও সুবিধাবাদী ভুট্টো কথাবার্তা বলা শুরু করেছেন। তারা একসঙ্গে কাজ শুরু করতে পারেন। (খ) মিলিটারি থেকে সাড়ে বারাে কোটি লােক অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানে সংস্কারমুখিতার প্রবণতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ দেশটি পৃথিবীর পঞ্চম জনসংখ্যাবহুল দেশ।
১৩. এ সমস্ত অসুবিধা সত্ত্বেও অস্ত্রশস্ত্রের জন্য কমিউনিস্টদের ওপর নির্ভরশীল একটি সামরিক বাহিনীকে কীভাবে কমিউনিস্টবিরােধী কাজে লাগানাে যেতে পারে? আমাদের চুক্তি থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে আমরা নিজেদের ভিয়েতনামের মতাে আরেকটি পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারি না। এর সবচেয়ে সহজ সমাধান হলাে সীমিত পরিমাণে পাকিস্তানকে প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা এবং তাদেরকে প্রতিরক্ষায় সক্ষম করে তােলা।
১৪. (ক) আংশিকভাবে আমাদের এখনকার পলিসি হলাে যে, আমরা বিপজ্জনক অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণে বাধা দেব এবং খেয়াল রাখবাে যাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অর্থ সামরিক কাজে ব্যবহার করা না হয়। পাকিস্তান ও ভারত উভয়ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটছে ও পলিসি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
পৃষ্ঠা: ৩৬

(খ) আমাদের আরেকটি পলিসি বলছে যে, আমরা পাকিস্তান বা ভারত কাউকে মারণাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবাে না; কারণ ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে তারা আমাদেরই অস্ত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এখনাে আমরা জর্ডান ও ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠাচ্ছি। তারা ১৯৬৭ সালে একইভাবে আমাদের অস্ত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। এটা অবশ্য সত্য যে, আমরা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ প্রতিহত না করলেও আমাদের মিলিটারি সাপ্লাই পলিসির কারণে যুদ্ধ তাড়াতাড়ি থামানাে সম্ভব হয়েছে।
১৫. এ মুহূর্তে সীমিতভাবে হলেও আমাদের প্রত্যক্ষ অস্ত্র সাহায্যের উদ্দেশ্য হবে—
(ক) কমিউনিস্টদের হাতে ছেড়ে না দিয়ে পলিসি নমনীয় রাখা। (খ) সামরিক ব্যয় যুক্তিযুক্তভাবে সীমিত করা। কারণ—
১. নমনীয়তায় ভারসাম্য রাখা ও
২. আমাদের অস্ত্র দামে সস্তা অথচ ভ্যালুর ক্ষেত্রে মূল্যবান।
(গ) আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ভারসাম্য রাখা। তুরস্কের ১০০টি ট্যাংকের দাম পড়বে ৪০ লাখ ডলার। অথচ সরাসরি বিক্রি করলে আমাদের মুনাফা বেশি হবে।
(ঘ) আমাদের বর্তমান সরবরাহ নীতিমালার অকার্যকর, ঠগবাজি ও অস্বস্তিকর থার্ড পার্টির মাধ্যমে বিক্রি বন্ধ করা।
(ঙ) ভারত ও পাকিস্তানকে একসঙ্গে অস্ত্র সরবরাহ করলে ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যস্থতা করার ক্ষমতা বাড়বে।
(চ) এতে ভবিষ্যতে আমাদের উপমহাদেশে মার্কিন-সােভিয়েত
সহযােগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে। ১৬. এটা মনে করা হয় যে, আমাদের নীতি পরিবর্তন ভারতকে বিব্রত করবে। কারণ— (ক) ভারত এমনিতেই আমাদের বর্তমান পলিসির ব্যাপারে বিরক্ত। (খ) সম্প্রতি ভারত ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারাও আমেরিকা থেকে মারণাস্ত্র সংগ্রহ করতে চায়। (গ) ভারত ব্ৰিত হলে কি ক্ষতি হতে পারে? প্রায় সকল আন্তর্জাতিক ইস্যুতে এমনিতেই ভারত আমেরিকার বিরােধিতা করছে। তারা। রাশিয়ার সঙ্গে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। বেশ কয়েকটি রাজ্যে কমিউনিস্টরাই সরকার গঠন করেছে। (ঘ) উপমহাদেশে অস্ত্র সরবরাহ করার নীতি নমনীয় করার অর্থ এই নয় যে পাকিস্তানকেই বেশি সুবিধা দিতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৩৭

পাকিস্তানে রাশিয়ার সামরিক সাহায্য
টেলিগ্রামে পাকিস্তানে রাশিয়ার সামরিক সাহায্য সম্পর্কে ব্যাখ্যায়িত বিশ্লেষণে বলা হয়,
আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে রাশিয়া পাকিস্তানে সীমিত সংখ্যক ট্যাংক ও আর্টিলারি সরবরাহের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং সােভিয়েতরা পাকিস্তানে এস-ইউ-৭ এবং মিগ-২১ এয়ারক্রাফট পাঠাতে আগ্রহী। সােভিয়েত মিলিটারি একাডেমিতে বিনিময় চুক্তিতে পাকিস্তানি সেনাসদস্য প্রেরণ, পাকিস্তানে সােভিয়েত জাহাজের আগমন, সেনাবাহিনীর মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং যৌথ সামরিক মহড়া ইত্যাদিও বিবেচনার অপেক্ষায় রয়েছে।
যেহেতু রাশিয়ার মিলিটারি সাপ্লাই শুরু হয়ে গেছে এবং দুই বছর আগেই আমরা এই আশঙ্কা করেছিলাম, সেহেতু এক্ষণে আর আমাদের অস্ত্র সরবরাহ নীতি নমনীয় না করার কোনাে কারণ নেই, বরং এই নমনীয়তার গতি আরাে ত্বরান্বিত করা দরকার।
এখন পর্যন্ত পাকিস্তান যেসব প্রতিশ্রুতি পেয়েছে তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। গুটিকয়েক রাশিয়ান ট্যাংক ও এখন থেকে ১৫ মাস পরে তুরস্ক থেকে ১০০ ট্যাংক (সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে) পেলেও পাকিস্তান ১০০+১০০=২০০ ট্যাংকের মূল প্রাপ্তি থেকে অনেক পিছিয়ে থাকবে।
যেহেতু রাশিয়া তার দুয়ার খুলে দিয়েছে এবং ট্রেনিং, অন্যান্য ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে এই লেনদেন আরাে বাড়বে, সেহেতু আমাদের এগিয়ে যাওয়া প্রয়ােজন।
ভূমধ্যসাগরে শক্তিশালী রাশিয়ান নৌবহর ও ভারত মহাসাগরে সােভিয়েত রণতরীর উপস্থিতি ইরান, সৌদি আরব ও অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতিম আরব দেশ এবং তুরস্কের ওপর নিরাপত্তা হুমকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাশিয়া বা চীনপন্থী পাকিস্তানে এতে কেবল নতুন মাত্রাই যােগ করবে।
সামরিক শাসন পাকিস্তানের সামরিক শাসন সম্পর্কে টেলিগ্রামে বলা হয় :
এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে, পাকিস্তানে সামরিক শাসন বহাল থাকায় কংগ্রেসে এ নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হবে; বিশেষ করে রিউজ অ্যামেন্ডমেন্ট নিয়ে সেখানে অনেক বাদানুবাদ হবে। কিন্তু তাই বলে আমাদের বৃহত্তর উদ্দেশ্য থেকে সরে যাওয়া উচিত হবে না। কেবল এর বিরুদ্ধে কংগ্রেস সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের কাছাকাছি হলেই আমাদের দক্ষিণ এশীয় সামরিক নীতি বেকায়দায় পড়তে পারে।
এটা মনে রাখতে হবে যে রিউজ অ্যামেন্ডমেন্টে এ কথা বলা হয়নি যে, কোনাে সামরিক সরকারকে সাহায্য করা যাবে না। এখানে কেবল নিজেদের
পৃষ্ঠা: ৩৮

জনগণের ওপর নির্যাতনকারী স্বৈরাচারী সামরিক একনায়কতন্ত্রের কথাই বলা হয়েছে।
(ক) আজ পর্যন্ত এমন কোনাে প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে ইয়াহিয়া খান একজন সামরিক স্বৈরাচারী ও একনায়ক। (খ) এমন কোনাে প্রমাণ নেই যে, পাকিস্তানে সামরিক শাসন জনগণকে সব রকমের সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। (গ) পক্ষান্তরে তিন সপ্তাহের সামরিক শাসন পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, সরকার প্রেস সেন্সরশিপ করেনি, পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সরবরাহ বাড়ানাের ব্যবস্থা করেছে, নিম্ন বেতনভুক্ত সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়িয়েছে, শ্রম-সম্পর্কে নমনীয়তা এনেছে, স্কুলকলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়েছে, পড়াশােনার বেতন কমিয়ে ও কিস্তির ব্যবস্থা করে ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়েছে, সরকারি দুর্নীতি রােধের ব্যবস্থা নিয়েছে এবং পাকিস্তানিরা ভারত যেতে চাইলে তাদের জন্য একজিট ভিসা প্রয়ােজনের প্রথা বাতিল করেছে। সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সদিচ্ছা ঘােষণা করেছে এবং যথাশীঘ্র সাংবিধানিক বেসামরিক সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্যদিকে সামরিক এই সরকার বেসামরিক প্রশাসনে তেমন হস্তক্ষেপ করছে না এবং ক্ষেত্রবিশেষে ছােটখাটো গ্রেফতার ছাড়া জোরজবরদস্তিও করা হচ্ছে না। কোনাে মুখ্য রাজনৈতিক নেতাকে এ পর্যন্ত আটকও করা হয়নি। সরকার এখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের মতাে সংবেদনশীল বিষয়, পূর্ব পাকিস্তানে সম্পদ প্রবাহ বৃদ্ধি এবং জাতীয় পরিষদে প্রাদেশিক প্রতিনিধিত্ব এবং কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের মতাে বিষয়গুলােতে হাত দেয়নি। তবে খুব জলদিই এগুলাের ব্যাপারে কাজ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। (ঘ) উপরােক্ত কারণগুলাে বিবেচনা করলে রিউজ অ্যামেন্ডমেন্ট পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কিছুতেই প্রয়ােগ করা যাবে না। (ঙ) এরপরও কেউ রিউজের প্রসঙ্গ তুললে তা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের রয়েছে।

টেলিগ্রামে বলা হয়,
এখন পর্যন্ত আমার কংগ্রেসে যাওয়ার সুযােগ না হলেও ১৯৬৮ সালের জুন এবং ১৯৬৯ সালের মার্চে আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের বেশিরভাগই নীতি নমনীয়তার পক্ষে কথা বলেছেন। আসলে কেউই এর বিরুদ্ধাচরণ করেননি। বরং ইন্ডিয়ানার সিনেটর সিসিংটন ১৯৬৯ সালের ১৪ মার্চ আমাকে এক চিঠিতে লিখেছেন যে, সেক্রেটারি অব স্টেট যদি লিখে দেন যে তার পাকিস্তানের কাছে
পৃষ্ঠা: ৩৯

অস্ত্র বিক্রিতে কোনাে আপত্তি নেই এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে এই অস্ত্র বিক্রি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থেই করা হচ্ছে তা হলে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনাে আপত্তি ওঠাবাে না।
৩. পাকিস্তান বাদে অন্যান্য দেশে সামরিক সরকারের সঙ্গে আমরা অস্ত্রশস্ত্রের লেনদেন করছি।
৪. সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে বােঝা যাচ্ছে যে, কোনাে এক সময়ে পাকিস্তানের মিলিটারিই দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারক হবে। বর্তমানে তারা অভ্যন্তরীণ গােলযােগ ও ভেতরে-বাইরে কমিউনিস্ট আগ্রাসন রুখতে ব্যস্ত। তারা মার্কিনপন্থী’ এবং আমাদের উচিত তাদের সে অবস্থানে ধরে রাখা। গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রশস্ত্রের জন্য কমিউনিস্টদের ওপর নির্ভরশীল হলে আমরা তাদের ধরে রাখতে পারবাে না। তাদের চাহিদাও পরিমাণগত এবং গুণগতভাবে খুব বেশি নয়। তারা যা চাচ্ছে তার বেশিরভাগই পুরনাে অস্ত্রশস্ত্রের বদলে নতুন আধুনিক সরঞ্জাম।
৫. পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকার মনে করে যে, দেশীয় শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপন এবং বৈদেশিক আগ্রাসন প্রতিহত করা—উভয় কাজের জন্যই পাকিস্তানের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়ােজন। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলাে সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য থাকা। কিন্তু বিভিন্ন গােয়েন্দা সূত্র থেকে দেখা যাচ্ছে যে, চীনপন্থী বিপ্লবী মনােভাবাপন্ন শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং সামরিক বাহিনীকে একদিন তাদের মুখােমুখি হতে হবে। আমাদের কাছে অসমর্থিত এমন খবরও রয়েছে যে অনেক চীনপন্থী গেরিলাকে উত্তর ভিয়েতনামে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে চীনপন্থীরা ক্ষমতায় এলে তা হবে ভারতের জন্য বিপর্যয়ের কারণ এবং আমাদেরও স্বার্থের পরিপন্থী।
৬. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে দক্ষিণ এশীয় অস্ত্র সরবরাহ নীতি নমনীয় করলে তার মাধ্যমে আমাদের পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে এমন চাপ দেয়ার সুযােগ আসবে যাতে করে তারা যথাসম্ভব শীঘ্ন সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে সাংবিধানিক বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে আরাে ভালাে সুযােগ-সুবিধা দেয়। আমেরিকান অস্ত্র সাহায্যের পরিমাণ যত বেশি হবে আমরা তত বেশি খুচরা যন্ত্রাংশ ও ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারবাে। কমিউনিস্টরা তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারলে তাদের মূল উদ্দেশ্য হবে একনায়ক একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং তা হবে বেসরকারি খাতের অর্থনীতির বিরুদ্ধে। আমাদের কিছুতেই উচিত হবে না
পাকিস্তান এবং তাদের কমিউনিস্ট মিত্রদের জন্য সেই সুযােগ সৃষ্টি করে দেয়া। টেলিগ্রামে সুপারিশ করা হয় যে—
১. ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের কাছে আমাদের অস্ত্র সরবরাহ নীতি হতে হবে নমনীয় এবং কেস বাই কেস ভিত্তিতে দেশ দুটোতে মারণাস্ত্রের চালান অব্যাহত
পৃষ্ঠা: ৪০

রাখতে হবে। এ নীতিকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
২. যথাসম্ভব শীঘ্র এই নীতি-নমনীয়তা বাস্তবায়িত করতে হবে।
৩. সুযােগমতাে ইয়াহিয়াকে পরামর্শ দিতে হবে যাতে তার নীতিমালা আমাদের চিন্তার সম্পূরক হয় এবং আমাদের এমন শর্ত আরােপ করতে হবে যে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যদানের উদ্দেশ্য হলাে রাজনৈতিক জীবনযাত্রা স্বাভাবিকীকরণ ও পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্কের উন্নয়ন।
৪. এ কথা মনে রাখতে হবে, নীতি পরিবর্তনের অর্থ সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রের চালান শুরু করে দেয়া নয়। চুক্তি স্থাপন এবং তা কার্যকরণের সময়ের মধ্যে একটা ব্যবধান রাখতে হবে, যাতে করে প্রয়ােজনবােধে আমরা তাদের প্রতিশ্রুতির ব্যত্যয় ঘটলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারি।
৫. আমরা ভারত ও পাকিস্তানে যে অস্ত্র ও সাহায্য বিনিয়ােগ করেছি তার তুলনায় রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র সাহায্য করে অনেক বেশি গ্রহণযােগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে। এর পরে রয়েছে চীনা সাহায্য। এখন রাশিয়া পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করে একই অবস্থা সৃষ্টি করতে পেরেছে।

পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক নীতি
১৯৬৯ সালের ২৫ এপ্রিল রাওয়ালপিন্ডির আমেরিকান দূতাবাস থেকে মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটে একটি টেলিগ্রাম পাঠানাে হয়। টেলিগ্রামের সারবস্তু ছিল ইউ এস পলিসি অপশন ইন পাকিস্তান।৭ এর সারসংক্ষেপে বলা হয়,
পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির মূল লক্ষ্য ছিল শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন বহাল রাখা, পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা কাঠামােতে পূর্ব পাকিস্তানের অধিগ্রহণ প্রতিহত করা এবং জাতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্বকে অস্বীকার করা। ইয়াহিয়া সরকার আগের সরকারের ব্যর্থতার দোহাই দিয়ে এর কিছু কিছু কারণ নির্মূল করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বটে, কিন্তু তাতে তার সাফল্যের মাত্রা ছিল নেহায়েতই অল্প। আমেরিকার জন্য দুর্ভাগ্যজনক দিক হলাে এই যে, তাকে এমন একটি সরকারকে সমর্থন করতে হচ্ছে যার জনপ্রিয়তা ক্রমহ্রাসমান এবং ক্রমশ হয়ে পড়ছে জনবিচ্ছিন্ন। তবে এর মধ্যে থেকেই আমেরিকাকে তার সামরিক ও সহযােগিতার নীতিমালা স্থির করতে হবে।
টেলিগ্রামে বলা হয়,
যে সমস্ত কারণে সামরিক শাসন জারি করা হয় সেগুলাে বাস্তবায়ন করা ছিল পাকিস্তানের জন্য অপরিহার্য এবং মূলত সবগুলাে ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের পরিস্থিতি ছিল প্রতিকূলে। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা এবং ক্ষমতা কাঠামাে ছিল পূর্ব
পৃষ্ঠা: ৪১

পাকিস্তানি অধিগ্রহণের প্রবল হুমকির মুখে। আইউবের আমলের শেষ দিকে অবস্থা এ রকম চরমে ওঠে যে তা নিয়ন্ত্রণ করা আইউবের পক্ষে সম্ভব হয়নি। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসতে দিলে সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান এমন সব বিল নিয়ে আসতে পারতেন যা উপরােক্ত তিনটি ক্ষেত্রেই মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করতে পারতাে। শেষ পর্যন্ত আইউব খানকেই হয়তাে সামরিক বাহিনী তলব করতে হতাে বা সামরিক আইন জারি করতে হতাে।
এর অর্থ অবশ্য এমন দাঁড়ায় না যে ইয়াহিয়া খান আইউব খানের আমলের অবিচার ও নৈরাজ্যের অবসান ঘটাবার চেষ্টা করবেন না এবং দেশের সম্পদ ও ক্ষমতা দুই অংশে সুষম বণ্টনের ভিত্তিতে পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থান বহাল রাখার প্রচেষ্টা নেবেন না। বর্তমান সামরিক আইন প্রশাসক অবশ্য অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সংকটাপন্ন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন। কোন পদ্ধতিতে তিনি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলাের হাতে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করতে পারবেন। সে পদ্ধতিও এখন পর্যন্ত অজানা রয়ে গেছে। ইতােমধ্যেই ইয়াহিয়া খান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গণসংযােগ শুরু করেছেন। তাই এর ফলাফল ইতিবাচক কি না তা জানার জন্য আরাে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
সামরিক আইন প্রশাসন এবং বিশেষ করে ইয়াহিয়া খান হয়তাে নিজেই জানেন না কীভাবে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য এবং জনগণের সন্তুষ্টি অর্জন করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এটা স্পষ্টতই বােঝা যাচ্ছে যে, দেশের দুই অংশেই রাজনৈতিক দলগুলাে যার যার কর্মসূচি বাস্তবায়নের ব্যাপারে অত্যন্ত অনমনীয় এবং সময়ান্তরে তাদেরও নিজ নিজ দাবিনামায় নমনীয়তা নিয়ে আসতে হবে। সামরিক আইন প্রশাসন মূলত চেষ্টা করছে সেই নমনীয়তার জন্য অনুকূল একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি করা, যাতে করে পরবর্তীকালে বেসামরিক রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে মূল সমস্যাগুলাে সমাধান করা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, সামরিক আইন প্রশাসন এই লক্ষ্যার্জনকে কতটুকু অগ্রাধিকার দিচ্ছে? বাঙালিরা কি ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিতে সম্মত হবেন নাকি ভিন্ন পথ ধরবেন? দুর্বলতম কেন্দ্র এবং আরাে স্বশাসিত প্রদেশ হলে পরিস্থিতি কী হবে? অর্থনৈতিক বিভাজনতা পরিস্থিতিকে কোন দিকে টেনে নিয়ে যাবে?
বিদ্যমান অবস্থা আমেরিকার জন্য সংকট এবং সুযােগ দুই-ই সৃষ্টি করেছে। সামরিক আইন প্রশাসন যদি স্বৈরাচারী ভূমিকা নিয়ে বিদ্যমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বহাল রাখতে চায় কিংবা তার উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়। তা হলে আমেরিকার প্রধান কর্তব্য হবে দেশের দু’অংশেরই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। অন্যদিকে সামরিক প্রশাসন যদি প্রাথমিকভাবে কিছু দাবি মেনে নিয়ে দু’অংশের মধ্যেকার বৈষম্য কিছুটা কমিয়ে আনতে পারে তা হলে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থেই সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে এবং অর্থনৈতিক ও
পৃষ্ঠা: ৪২

সামরিক সাহায্য অব্যাহত রাখবে। সামরিক আইন প্রশমনের পক্ষে অবশ্য এ হবে একটি কঠিন কাজ এবং এতে সর্বতাে সাফল্য প্রত্যাশা করা যায় না।
এটা বলার কোনাে অপেক্ষা রাখে না যে, পাকিস্তানকে অবিচ্ছিন্ন রাখাই হলাে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান স্বার্থ। বিচ্ছিন্ন হলে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি হবে দুর্বল, পূর্বাঞ্চলে সৃষ্টি হবে গােলযােগপূর্ণ বামবলয়, অতি সহজেই তার ওপর প্রভাব পড়বে পশ্চিম বাংলা ও চীনের, দুর্বল কেন্দ্র থাকার ফলে তা পরিণত হতে পারে সােভিয়েত ও চীনের রণক্ষেত্রে। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল কেন্দ্রশাসিত পূর্ব পাকিস্তান টিকে থাকলেও তা হবে পরিপূর্ণ বিচ্ছিন্নতার তুলনায় কিছুটা ভালাে এবং সামান্য হলেও মার্কিন স্বার্থের পরিপূরক।
এ যাবৎ সামরিক আইন প্রশাসন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা কমবেশি সন্তোষজনক। গমের নিম্নমুখী মূল্য নির্ধারণ, সাম্প্রতিক নিম্ন আয়ের সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি, কৃষি আয় বাড়ানাের জন্য স্টাডি গ্রুপ গঠন, স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুলগুলােতে ফি কমানাে এগুলাের সবকিছুতেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মনােভাব পরিলক্ষিত হয়। উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছাত্র ও শ্রমিক সমস্যা দূর করার ব্যাপারে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। দুর্নীতি দমন ও সরকারি কর্মচারীদের সম্পত্তি নিরীক্ষণের ঘােষণাও আশাব্যঞ্জক। তবে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে পাকিস্তানের এসব সমস্যা রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয়।
অবশ্য আজ পর্যন্ত পূর্বাংশের স্বায়ত্তশাসন, পূর্বাংশে সম্পদ প্রবাহ বৃদ্ধি, কেন্দ্র ও প্রদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য কিংবা জাতীয় পরিষদে প্রদেশে প্রতিনিধিত্বের মতাে সংবেদনশীল বিষয়গুলােতে হাত দেয়া হয়নি। সামরিক প্রশাসনের কোনাে কর্তৃপক্ষই এসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করছেন না। সামরিক আইন জারির অব্যবহিত পরে দেয়া বিবৃতি থেকে অবশ্য মনে হচ্ছে যে, সরকার শক্তিশালী কেন্দ্র বহাল রাখার পক্ষপাতী। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে কেন্দ্রের ক্ষমতা বহাল রাখতে চান এবং শহুরে শ্রমিক ও গ্রামীণ নিম্ন আয়ভুক্ত লােকদের অতিরিক্ত সুবিধা দিতে চান। শেষত তারা দেশের পূর্বাঞ্চলে অতিরিক্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা স্থাপিত করতে চান না।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উচিত হবে এটা ধরে নেয়া যে, পাকিস্তানে। সমস্যার সমাধানের গতি হবে মন্থর। সে বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা হওয়া উচিত বর্তমান পলিসি অপশন অপরিবর্তিত রাখা, অর্থাৎ আইউবকে দেয়া। সমর্থন ইয়াহিয়ার ওপর স্থানান্তর করা, অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য প্রত্যাহার অথবা সীমিত করা এবং নয়া সরকার কীভাবে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যায় তা নিরীক্ষণ করে নতুন সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া। যুক্তরাষ্ট্রের আরাে উচিত হবে কী পরিমাণ সহযােগিতা দিলে তাদের কাছ থেকে কী ধরনের সুবিধা পাওয়া যায় তা বিবেচনা করে সাহায্য ও সহযােগিতার মাত্রা নির্ধারণ করা।
পৃষ্ঠা: ৪৩

২৯ এপ্রিল রাওয়ালপিন্ডি থেকে রাষ্ট্রদূত ওহলার ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটে একটি টেলিগ্রাম পাঠান।৮ টেলিগ্রামে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সচিবের বৈঠকের একটি সারমর্ম তুলে ধরা হয়। পররাষ্ট্র সচিব তাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ১৯৬৮ সালের জুন মাসে তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আইউব প্রেসিডেন্ট জনসনের কাছে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যাতে বলা হয়েছিল যে, ছােট আকারের এবং অল্প দৃশ্যমান একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি অন্যত্র স্থাপন করাতে আইউবের কোনাে আপত্তি নেই। তিনি আরাে স্মরণ করিয়ে দেন, সে সময় প্রেসিডেন্ট জনসনের বিষয়টিতে আগ্রহ ছিল বলে সচিবকে জানানাে হয়েছিল।
অথচ আসল ব্যাপার হলাে, প্রেসিডেন্ট জনসনের সম্মতির কথা আইউব খানকে জানানাের পর তদানীন্তন নয়া পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরশাদ হােসেন। জানিয়েছিলেন যে, বাস্তবে আইউব খান এমন কোনাে প্রস্তাব জনসনকে দেননি। আইউব স্বয়ং তার বিরােধিতা করে বলেছিলেন যে, অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে এবং রাশিয়ানরা সব জেনে গেছে। কাজেই আইউব খান এর পর আর এ নিয়ে সামনে এগােতে চাননি।
এখন ইয়াহিয়া খান যদি একই প্রস্তাব দেন তা হলে তার পরিবর্তে আমেরিকা কী প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে সে ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা দেয়ার জন্য টেলিগ্রামে অনুরােধ জানানাে হয়।
এ থেকে বােঝা যায়, আইউব সরকারের পতনের পর পরবর্তী ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইন সরকার পররাষ্ট্রনীতিতে আইউব খানেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন এবং সর্বোপরি আইউব খানের রেখে যাওয়া সামনে এগােনাের’ নীতিমালা গ্রহণ করেছেন। সে কারণেই ইয়াহিয়া আপাতভাবে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য সংবেদনশীল বিষয়গুলােতে হাত না দিয়ে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে শান্ত করতে চেয়েছেন। অন্যদিকে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনি তার মার্কিনপন্থী নীতি অব্যাহত রেখেছেন।
ইয়াহিয়া খান স্পষ্টত অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, মূলত দুটি কারণে তার মার্কিন অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দরকার। প্রথমত, পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক দরকষাকষিতে তাকে অনেক ছাড় দিতে হবে, যে কারণে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বে। পাকিস্তানের সম্পদের পূর্ব ও পশ্চিমাংশে সুষম বণ্টনের প্রশ্নে সঞ্চয় পরিধিতে যে ঘাটতি দেখা দেবে, অভ্যন্তরীণ উৎস হতে তা মেটানাে সম্ভব নয়।
অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান যদি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের দিকে যায় তা হলে তা প্রতিহত করার জন্য কাজে লাগাতে হবে সামরিক বাহিনীকে। সেক্ষেত্রে একদিকে সামরিক সজ্জায় বিনিয়ােগ বাড়বে এবং অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ উৎস হতে বাজেট কাটছাঁট করে হলেও সামরিক ক্ষুধা মেটাবার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর মার্কিন সামরিক সরবরাহ নীতির কঠোরতার
পৃষ্ঠা: ৪৪

কারণে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ক্ষেত্রেই মার্কিন সামরিক সহযােগিতা হয় বন্ধ, কিংবা সীমিত করে দেয়া হয়। ফলে ভারত একদিকে সােভিয়েত সহযােগিতায় এবং অন্যদিকে নিজস্ব অস্ত্র নির্মাণ কারখানা গড়ে তুলে সাময়িকভাবে এই ইচ্ছা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলেও চীন ও রাশিয়ার যৎসামান্য সহযােগিতার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের পক্ষে সে ধাক্কা সামলানাে সম্ভব হয়নি। ফলে আপাতভাবে উপেক্ষিত হলেও পাকিস্তানকে মার্কিন সাহায্যের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয়।
১৯৬৯ সালের ১৬ মে পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এম এম আহমেদ এবং ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জারের অফিসে তার সঙ্গে দেখা করেন।৯ জনাব আহমেদ কিসিঞ্জারকে জানান যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্দেশে তিনি ওয়াশিংটনে এসে এ আই ডি, কিসিঞ্জার এবং হােয়াইট হাউসের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে এসেছেন।
জনাব আহমেদ সরাসরি বলেন যে, পাকিস্তানের বিদ্যমান গােলযােগের প্রেক্ষাপটে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সেগুলাে হলাে : (১) বহির্সাহায্য অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে ভালাে কাজ দেয় এবং পাকিস্তানকে বিদেশি অর্থনৈতিক সহযােগিতা দেয়ার সিদ্ধান্ত বিবেচনাপ্রসূত চিন্তাধারারই ফলাফল। (২) পাকিস্তান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভালাে কাজ করছে কিন্তু কেবলমাত্র প্রবৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হলেও পাকিস্তান এখন আর সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রয়ােজনীয় বিপুল অর্থের চাহিদা মেটাতে পারছে না—বিশেষ করে সাম্প্রতিক গােলযােগের পরে। (৩) সাম্প্রতিক গােলযােগ প্রমাণ করেছে যে, প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপট আসলে ছিল ক্ষেত্রবিশেষে প্রাতিষ্ঠানিক। কিন্তু এরপরে সামাজিক উন্নয়নের কর্মসূচিগুলাে অব্যাহত রাখা হয়েছে। তিনি বলেন যে, সামরিক সরকার। সব সমস্যার সমাধান করতে না পারলেও গােলযােগ সত্ত্বেও উল্লেখযােগ্য পরিমাণে সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
তিনি বলেন, সামাজিক সংস্কার এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পদের ভারসাম্য বিধান করতে গেলে এখন পাকিস্তান সরকারকে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কিছুটা। কম্প্রোমাইজ করতে হবে। সরাসরিভাবে দাবি না করলেও জনাব আহমেদ ইঙ্গিত দেন যে বিগত কয়েক বছরে অর্থনৈতিক সহযােগিতা কমে যাওয়ায় অর্থ বরাদ্দে কিছুটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে, যার সঙ্গে বর্তমান সংকট সৃষ্টির একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
উত্তরে কিসিঞ্জার বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ছিলেন আইউবের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। তবে সেই আন্তরিকতাকে কীভাবে ডলারে পরিণত করা যায় তার জন্য অনেক ইস্যু বিবেচনার প্রশ্ন চলে আসে। সেগুলাে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক উভয় ধরনের ইস্যু। তবে পাকিস্তানের পরিস্থিতি এবং প্রয়ােজন সম্পর্কে মার্কিন সরকার অত্যন্ত সচেতন।
পৃষ্ঠা: ৪৫

রাষ্ট্রদূত হিলালী সামরিক সহযােগিতার প্রসঙ্গ ওঠাতে চাইলে কিসিঞ্জার তা এড়িয়ে যান। জনাব আহমেদ বলেন যে মিলিটারি সাহায্যের সঙ্গে বাজেটের সম্পর্ক রয়েছে কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনুদান হিসেবে অস্ত্র না দিয়ে ক্রয়ের ভিত্তিতে তা দেয়ায় উন্নয়ন বাজেটের টাকা সামরিক খাতে ব্যবহার করতে হচ্ছে। কিন্তু কিসিঞ্জার এ প্রশ্নেও নিরুত্তর থাকেন।
যাই হােক মে ১৯-২০ তারিখে অনুষ্ঠিত প্যারিস কনসাের্টিয়ামের বৈঠকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতির বিপরীতে সদস্যরা ২৫০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য মঞ্জুর করেন।১০ উপরন্তু বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও ইতালির প্রতিনিধিরা বলেন যে, তারা সরকারের সঙ্গে আলােচনাক্রমে সাহায্যের পরিমাণ স্থির করবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জানান, ১৪০ মিলিয়ন সাহায্যের প্রস্তাব অনুমােদনের জন্য কংগ্রেসে পাঠানাে হবে। জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস তাদের ঋণের শর্ত শিথিল করা হবে বলে জানিয়ে দেয়।
আসলে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর থেকেই পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যদান কর্মসূচিতে ভাটা পড়ে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ অবধি পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্যের পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। এ সময়ের মধ্যে সর্বমােট সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। অথচ দশকের শেষের দিকে তার মধ্যেও আবার কাটছাট করে বাস্তবে সাহায্য মঞ্জুর করা হয় মাত্র ২ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার।১১ অবশ্য এর আগে ৬০ দশকের প্রথম অর্ধেকে পাকিস্তানে প্রদত্ত আমেরিকার সাহায্যের পরিমাণ ছিল পাকিস্তানের প্রাপ্ত সামগ্রিক বিদেশি সাহায্যের অর্ধেকের চেয়েও বেশি।১২ সে সময় মার্কিন অর্থনৈতিক সহযােগিতার মাধ্যমে পাকিস্তানের মােট উন্নয়ন বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ মেটানাে যেত এবং মােট আমদানি ব্যয়ের ৫০ শতাংশ তা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব ছিল। লক্ষণীয় যে, শুধু ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে মােট বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৫৪১ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন ডলার যার মধ্যে আমেরিকার সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৫০৪ দশমিক ৩১ মিলিয়ন ডলার এবং সামরিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল মাত্র অর্ধ মিলিয়ন ডলার।১৩
লক্ষণীয় যে, এর চারদিন পর অনুষ্ঠিত ভারতের জন্য কনসাের্টিয়ামের বৈঠকে অংশ নেয়া বেশিরভাগ দেশ কোনাে সাহায্য প্রস্তাব দিতে অনীহা দেখালেও প্রাপ্ত সাহায্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।১৪ উপস্থিত বেশিরভাগ দেশ ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতার ওপর সন্তোষ প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ছিল পাকিস্তানকে দেয়া প্রতিশ্রুতির প্রায় আড়াই গুণ বেশি, ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার। জাপান ও ইতালি কোনাে প্রতিশ্রুতি দান থেকে বিরত থাকে। ইতালি বলে যে, সাহায্যের পরিবর্তে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট গ্রহণে ভারত রাজি থাকলে তা বিবেচনা করা যেতে পারে। জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস পাকিস্তানের মতােই ঋণের শর্ত নমনীয় করার প্রস্তাব দেয়।
পৃষ্ঠা: ৪৬

১৯৬৯ সালের ১৯-২৩ মে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট রজার্স তার দক্ষিণ এশিয়া সফরে সিয়াটো বৈঠকে যােগ দেয়ার জন্য ব্যাংককে যান। ২৬-২৭ মে তেহরানে সেন্টো বৈঠকে যােগদানের আগে তিনি ২৩-২৪ মে নয়াদিল্লিতে, ২৪-২৫ মে লাহােরে এবং ২৫ মে কাবুলে যাত্রাবিরতি করেন।১৫ ২৪ মে সেক্রেটারি রজার্স লাহােরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৯০ মিনিটের এক দীর্ঘ বৈঠকে মিলিত হয়ে পাকিস্তান ও উপমহাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন।
২৬ মে ওয়াশিংটনে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানাে সেক্রেটারি রজার্সের এক গােপন তারবার্তায় জানানাে হয় যে, বৈঠকে তারা পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সাহায্য, সামরিক সাহায্য ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে বিশদ আলােচনা করেছেন।১৬ বৈঠকে সেক্রেটারি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সহযােগিতা দানে আগ্রহী। তবে তিনি সামরিক সাহায্যের ব্যাপারে কোনাে প্রতিশ্রুতি দান থেকে বিরত থাকেন।
বৈঠকে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে, দেশের গােটা প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার পথে। তার মূল কারণ হলাে : (ক) বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণে দীক্ষার অভাব (খ) সামাজিক খাত ও উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব (গ) পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি নিদারুণ অবহেলা (ঘ) দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি।
তিনি বলেন, সামরিক সরকার যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বেসামরিক উত্তরণ চাইছেন। তিনি জানান, মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকার ব্যবস্থা ও সর্বোচ্চ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জোর দাবি রয়েছে। তবে তিনি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিলেও বিশেষ কোনাে সাংবিধানিক পরিবর্তন আনবেন না। তিনি বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনী কোনাে জোরজবরদস্তি করছে না এবং জনগণ বরং স্বস্তি অনুভব করছেন। তবে তিনি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তার সামরিক জীবনে ফিরে যাবার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন।
পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মি. আহমেদের সাহায্য নিয়ে ইয়াহিয়া জানান, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সহযােগিতায় পাকিস্তানের অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে তবে তা আগের পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য আরাে সাহায্য প্রয়ােজন। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য তার পিএল-৪৮০ ভিত্তিক খাদ্য সাহায্য ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রকল্প সাহায্য দরকার। সেক্রেটারি জানান যে, পাকিস্তানের বিদ্যমান সামরিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কিছুটা অস্বস্তিজনক। তবে কংগ্রেসের কাছে ১৪০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য ঋণ চাওয়া হয়েছে ও উত্থাপিত বাকি বিষয়গুলাে বিবেচনা করা হবে।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খুব সংক্ষিপ্ত আলােচনা করেন, তবে কাশ্মীর ও ফারাক্কা প্রশ্নে অত্যন্ত অনমনীয় মনােভাব দেখান। তিনি
পৃষ্ঠা: ৪৭

বলেন, যারা সমস্যাকে সমস্যা বলে মনে করেন না তাদের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়া অর্থহীন। তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানে পাকিস্তান আগ্রহী কিন্তু অদূরভবিষ্যতে কিছু ঘটার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি সেক্রেটারি রজার্সকে জিজ্ঞেস করেন সেক্রেটারি দু’পক্ষের আলােচনায় মধ্যস্থতা করতে পারবেন কি না। সেক্রেটারি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সমস্যা সমাধানের কোনাে দায়দায়িত্ব নেবে না। তবে দুই পক্ষ রাজি থাকলে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য সব রকমের প্রচেষ্টা চালাবে।

তথ্য নির্দেশিকা
১. ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, সেন্ট্রাল ফাইলস ১৯৬৭-৬৯, ১৫-১ পাক। ২৯ মার্চ চিঠিটি হােয়াইট হাউসে পাঠানাে হয়। নিক্সন ইয়াহিয়ার কাছে এর জবাব পাঠান ২২ এপ্রিল। (নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, এন এস সি ফাইলস , বক্স নং ৬২৩, কান্ট্রি ফাইলস, মিডল ইস্ট, পাকিস্তান, ১ম খণ্ড, ১ জানুয়ারি ৬৯-৩০ নভেম্বর ৬৯)।
২. টেলিগ্রাম নং-৫০৩৫৪, ওয়াশিংটন থেকে রাওয়ালপিন্ডি, ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, সেন্ট্রাল ফাইলস ১৯৬৭-৬৯, ডি ই এফ ৭ পাক-ইউ এস এ-গােপনীয়।
৩. পাকিস্তান-রাশিয়ান রিলেশনস, ড. নুরুল হক, ৩০ জুন ২০০৭।
৪. প্রাগুক্ত।
৫. টেলিগ্রাম নং ৩৮৪২, ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, এন এস সি ফাইলস, বক্স ৬২৩, ভলিউম ১, ১ জানুয়ারি ৬৯-৩০ নভেম্বর ৬৯।
৬. এই বিলে স্বৈরাচারী কোনাে সরকারকে মার্কিন সাহায্যদানের বিরােধিতা করে আইন পাস হয়। আমেরিকার দেয়া অস্ত্র যেন একনায়ক সরকাররা জনগণ ও আমেরিকার মিত্রদের ওপর ব্যবহার না করতে পারে সে প্রচেষ্টা রহিত করাই ছিল বিলের উদ্দেশ্য।
৭. ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, সেন্ট্রাল ফাইলস ১৯৬৭-৬৯ রাজনৈতিক-১-পাক ইউএস, গােপনীয়।
৮. ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯ সেন্ট্রাল ফাইলস ১৯৬৭-৬৯, ডি ই এফ ১৫, পাক ইউএস, গােপনীয়।
৯. ন্যাশনাল আর্কাইভস, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়ালস, এন এস সি ফাইলস, বক্স ৬২৩, কান্ট্রি ফাইলস, মিডল ইস্ট, পাকিস্তান, ভলিউম-১, ১ জুন ১৯৬৯-৩০ নভেম্বর ‘৬৯।
১০. ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, সেন্ট্রাল ফাইলস ১৯৬৯-৭০ এ আই ডি ৯, পাক।
১১. অ্যাবাউট দোস বিলিয়নস, নিউজউইক, অক্টোবর ২০, ২০০৯। উৎস : দ্য ডেইলি বিস্ট, ওয়াশিংটন ব্যুরাে।
১২. আনিস ইব্রাহীম, বেলফোর সেন্টার ডিসকাশন পেপার, ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রােগ্রাম, হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল, জুলাই ২০০৯।
১৩. দ্য গার্ডিয়ান, ডাটাব্লগ, সিক্সটি ইয়ার্স অব ইউএস এইড টু পাকিস্তান, গেট দ্য ডাটা।
১৪. প্যারিসের অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট মিশন থেকে সেক্রেটারি অব স্টেট রজার্সের কাছে পাঠানাে টেলিগ্রাম, টেলিগ্রাম নং ৭৬৯৯, ন্যাশনাল আর্কাইভস, আর জি ৫৯, এ আই ডি ৯।
১৫. সেন্ট্রাল ফাইলস, ১৯৬৭-৬৯-এর ফুটনােট, ও আর জি ৭-এস, গােপনীয়।
১৬. প্রাগুক্ত, রেফারেন্স নং ০৯৫০ জেড।
পৃষ্ঠা: ৪৮

Ref: মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেনেটর গোপন দলিল – জগলুল আলম