You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর পাকিস্তানে আর একবার নির্বাচন হলাে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে ইয়াহিয়া খান চমকে গেলেন। যতদূর মনে পড়ছে, পূর্ব-পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু মুজিবের আওয়ামী লীগ ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন দখল করেছিলেন। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল, পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেয়েছিল মাত্র ৮৩টি আসন। ফলে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলাে। এখানেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদল প্রমাদ গুণলাে। তারা কিছুতেই পূর্ব-পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেনে নিতে পারছিল না। কারণ পূর্ব-পাকিস্তানের হাতেই দেশ শাসনের ক্ষমতা চলে যাবে। অথচ উপায় তাে নেই। নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিতে হলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের আধিপত্য মেনে নিতেই হবে।
যাই হােক, জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা করে সাংবাদিকদের কাছে ঘােষণা করলেন ‘মুজিবই পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরাে ঘােষণা করলেন-“১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের

পৃষ্ঠা: ১৬
অধিবেশন শুরু হবে।” সারা পূর্ব-পাকিস্তান সেদিন উল্লাসে ফেটে পড়লাে। কিন্তু আসলে এই ঘােষণা ছিল ইয়াহিয়া খানের আর একটি ধাপ্পা। করাচীতে ফিরে গিয়েই ইয়াহিয়া খান স্বমূর্তি ধরে ঘােষণা করলেন “৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন হবে না।”
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ক্ষোভে গর্জে উঠলেন, আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠলাে সারাদেশ। এরপর একের পর এক ঘটনায় আলােড়িত হতে লাগলাে পূর্ব-পাকিস্তান। দ্রুত পটপরিবর্তন হতে লাগলাে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের। আমরাও সময়ের সঙ্গে তাল রেখে যথাসম্ভব পূর্ব-পাকিস্তানের ঘটনাবলী এবং এপার বাংলায় তার প্রতিক্রিয়া শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরছি। কারণ পূর্ব-পাকিস্তানের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানবার জন্য এপারের মানুষ অধীর আগ্রহে রেডিও খুলে বসে থাকতেন।
১৯৭১ সালের ৩রা মার্চেই ঢাকার পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে বাংলাদেশের নাম, সীমা, জাতীয় পতাকা এবং অন্যান্য জরুরী বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে। আসলে এই সভাই হলাে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্মলগ্ন।
অবশেষে এল সেই স্মরণীয় দিন ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু ঐদিন রমনা ময়দানের জনসভায় সবাইকে যােগদানের জন্য আহবান জানালেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ সেদিন জমায়েত হলেন রমনা ময়দানে। বিশাল ঐ জনসভায় বজ্রকণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর সেই উদাত্ত ঘােষণা “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
এখন আর ৬ দফা নয়, ১১ দফা নয় এক দফা দাবি নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লাে বাংলাদেশের মানুষ। তাদের এখন একটাই দাবি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা। শুরু হলাে পাকিস্তানের সশস্ত্র সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের অঘোষিত যুদ্ধ।
বাংলাদেশের এইসব নানা নাটকীয় ঘটনায় বারে বারে আলােড়িত হয়েছে এপার বাংলাও। অন্যায় অবিচার আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখর হয়েছে কলকাতা মহানগরী। কখনও মিছিলে, কখনও প্রতিবাদী সভায় উপস্থিত থেকে, আবার কখনও বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং সাধারণ মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে, বেতারে তুলে ধরতে হয়েছে আমাকে। সংবাদ বিচিত্রার মাধ্যমে সেদিনের সেই স্মরণীয় সংগ্রামের অনেক ঘটনা, অনেক মুহূর্ত, আজও আমায় আবেগে উত্তেজনায় রােমাঞ্চিত করে তােলে।
মনে পড়ে, সেই অবিস্মরণীয় গানটির কথা।
শােন, একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে উঠে রণি ॥

পৃষ্ঠা: ১৭
গানটি যিনি গেয়েছিলেন, আমাদের শিল্পী বন্ধু অংশুমান রায় আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঐ গানটি চিরদিনই ইতিহাস হয়ে থাকবে। এই গানটির ইতিহাস হবার পেছনে আর একটি ইতিহাস আছে।
আমাদের সহকর্মী বন্ধু সংবাদ পাঠক দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে সেদিন বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী কামরুল হাসান সাহেব এসেছেন। বাংলাদেশ থেকে তখন যে কোন শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ অথবা অপর যে কোন ব্যক্তিত্ব আমাদের এখানে এলেই ছুটতাম টেপ রেকর্ডার নিয়ে তাঁর কাছে। উদ্দেশ্য, যাতে বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থাটা পৌঁছে দেয়া যায় শ্রোতাদের কাছে। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে তখন যােগাযােগ বলতে কিছুই ছিল না। আর পাক বেতারে তাে চলছে মিথ্যার বেসাতি আর অপপ্রচার।
দেব দুলালের কাছ থেকে টেলিফোনে কামরুল হাসান সাহেবের আসার খবরটি পেয়েই টেপ রেকর্ডার নিয়ে ছুটলাম ওর পূর্ণ দাস রােডের বাড়িতে। পোঁছে দেখি হাসান সাহেব ছাড়াও সেখানে উপস্থিত আছেন গৌরীদা অর্থাৎ গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, লােকসঙ্গীত শিল্পী দীনেন্দ্র চৌধুরী আর অংশুমান রায়। কিছুক্ষণ আলাপআলােচনার পর হাসান সাহেবের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করলাম। কাজ শেষ, তাই টেপ রেকর্ডার বন্ধ করে ফিরে আসব বলে উঠেছি। তখন অংশুমান হাসান সাহেবকে একটি গান শােনাতে চাইলাে। গানটি বাংলাদেশ নিয়ে, গৌরীদার লেখা। আবার বসে, টেপ রেকর্ডার খুললাম। কারণ বাংলাদেশ নিয়ে আমি যা পাই তাই তখন সংগ্রহ করি। আর এখানে তাে সাক্ষাৎকারের সঙ্গে গান কিছুটা দিলে অনুষ্ঠানে কিছুটা বৈচিত্র্য আসবে! গান তাে হবে, কিন্তু হারমােনিয়াম-তবলা কোথায়? তবলা বাজাবেই বা কে? আসলে, সেদিন কেউ আমরা গানের জন্য প্রস্তুত হয়ে আসিনি। দেব দুলালের বাড়িতে নিচের তলাতেই থাকতেন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী অশােকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখান থেকেই, একটি হারমােনিয়াম আনা হলাে। কিন্তু তবলা? কুছ পরােয়া নেই! দীপেন পাশ থেকে একটি বাঁধানাে খাতা নিয়ে তার ওপর আঙ্গুল ঠুকে দিব্যি তবলার কাজ চালিয়ে দিল। আমরা সবাই নির্বাক! আমার বেশ মনে আছে গানটি সেদিন আমাদের এমনভাবে নাড়া দিয়েছিল যে আমরা সবাই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসেছিলাম, কারাে মুখে কোন কথা ছিল না। গানের কথায় আর সুরে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম অথবা আবেগতাড়িত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম! কি জানি, হয়তাে বা দুটোই। যাই হােক, হাসান সাহেবের কাছে বিদায় নিয়ে স্টুডিওতে ফিরে এলাম।
৭ই মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা পাকিস্তানী বেতার গতকাল প্রচার করেনি। কিন্তু স্টুডিওতে ফিরে এসে শুনলাম,

পৃষ্ঠা: ১৮
আজ সেই ভাষণটি কেন জানি না, ঢাকা বেতার থেকে প্রচারিত করা হয়েছে আর আমাদের এখানে তা রেকর্ড করে রাখা হয়েছে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে যে ভাষণটির কিছু অংশ আজকের সংবাদ বিচিত্রায় নেয়া হবে। আমি কিন্তু ভাষণটি তখনও শুনিনি। মনটা দমে গেল। কারণ এতক্ষণ ছক কষছিলাম কামরুল হাসানের সাক্ষাৎকার আর অংশুমানের গান কিভাবে সাজানাে যায়। যাই হােক, বঙ্গবন্ধুর রেকর্ড করা ভাষণের টেপ নিয়ে স্টুডিওতে ঢুকলাম। কিন্তু ভাষণটি শুনে আমি তাে প্রচণ্ড ভাবে উত্তেজিত, শিহরিত! চোখ তুলে দেখি, বহু সহকর্মীর ভিড়। শুধু আমি নই, সবাই ভাষণটি শুনে ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত। বঙ্গবন্ধু তার নিজস্ব ভঙ্গিতে জ্বালাময়ী সহজ-সরল ভাষায় পূর্ব-পাকিস্তারের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ, নানা অবিচার, অত্যাচার আর লাঞ্ছনার বেদনাময় কাহিনী অত্যন্ত জোরালাে ভাবে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। ভাষণের শেষ পর্বে উদাত্তকণ্ঠে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে আহবান জানিয়েছেন। মনে পড়ছে, বজ্রকণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর সেই তেজোদ্দীপ্ত ঘােষণা, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে ইনশাল্লাহ!” কি যাদু ছিল সেই ভাষণে জানি না- সেই মুহূর্তে যদি সুযােগ থাকতাে, তবে আমিও ওপার বাংলার ভাই বােনদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম, অস্ত্র হাতে ঝাপিয়ে পড়তাম তাদের মুক্তিযুদ্ধে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণে সাড়া দিয়ে-যার হাতে যা ছিল তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ।
একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, সেদিনের সংবাদ বিচিত্রার জন্য ভাষ্য লেখার প্রয়ােজন নেই। অংশুমানের গানের কিছু অংশ, তারপর বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশ, আবার অংশুমানের গান, আবার মুজিবের ভাষণ-এভাবেই গান আর ভাষণ দিয়ে সাজানাে হলাে সেদিনের সংবাদ বিচিত্রা’। এই বিশেষ অনুষ্ঠানটি শুধু দুই বাংলার অগণিত শ্রোতা নয়, ভারতের অন্যান্য রাজ্যে এমনকি বিদেশে বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেও বিপুল আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। অসংখ্য শ্রোতার দাবি মেনে, অনুষ্ঠানটি একাধিকবার প্রচারও করা হয়েছিল।
পরে অংশুমানের এই গানটি ক্যাসেটে রেকর্ড করে বাজারে ছাড়া হয়েছিল এবং সেখানেও গানটি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিয়েই শুরু করা হয়েছিল। এই গানটির ইংরেজী অনুবাদও একই সুরে অংশু রেকর্ড করেছিল। অনেকেই জানেন সেই ক্যাসেট তখন যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। আর শিল্পী অংশুমানের তাে তখন প্রাণ ওষ্ঠাগত! একদিন আকাশবাণীতে এসে আমাকে তাে প্রায় ধমক দিয়েই বললাে “তুমি আমায় কি সর্বনাশ করেছাে বল তাে! সকাল নেই বিকেল নেই অনুষ্ঠানে যেতে হবে আর শ্রোতাদের সেই এক দাবি, সেই গান শােনাতে হবে, শােন, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের আরে আমি কি অন্য কোন গান জানি না।” হেসে বলি, “তারকা শিল্পী হতে গেলে এই সব ঝামেলা সইতেই হবে।”

পৃষ্ঠা: ১৯
অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে আর একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। অনুষ্ঠানটি বেতারে প্রচারের পরের দিন আকাশবাণীতে গেছি। সব জায়গাতেই একই আলােচনা। অংশুমানের গান আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। অনুষ্ঠানটির জন্য সবার অভিনন্দনে উচ্ছ্বসিত হয়ে স্টুডিওতে ঢুকতেই দেখি, সামনে আমাদের তখনকার কেন্দ্র অধিকর্তা দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত। তিনি বেশ ধমকেই বললেন, “কাল সংবাদ-বিচিত্রায় কি করেছ? তােমায় আমি মেমাে দেবাে।” আমি তাে অবাক! কি এমন ভুল করলাম যাতে উনি এতটা উত্তেজিত হলেন! কিন্তু কয়েক মুহূর্তের জন্যই আমায় উদ্বিগ্ন থাকতে হয়েছিল। কেন্দ্র-অধিকর্তা হঠাৎ আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন শুধু খারাপ কাজের জন্য নয় ভাল কাজের জন্যও মেমাে দেয়া হয়। কাল তােমার ‘সংবাদ বিচিত্রা’ শুনে আমি কেঁদেছি।” সত্যিই, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেদিনের সংবাদ বিচিত্রা’র প্রশংসা করে উনি আমায় একটি মেমাে পাঠিয়েছিলেন। ঘটনাটি উল্লেখ করলাম আত্মপ্রচারের জন্য নয়। সেই সময় নীচু থেকে উঁচু, আকাশবাণীর প্রতিটি সহকর্মী কেমনভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন, আমাদের কেন্দ্র-অধিকর্তার কান্না তারই এক উজ্জ্বল নিদর্শন। প্রসঙ্গত জানাই, আকাশবাণী কলকাতার কেন্দ্রঅধিকর্তা দিলীপ কুমার সেনগুপ্তের বাংলাদেশ নিয়ে ‘রেডিও কার্টুন’ নামে অভিনব অনুষ্ঠানটি তখন যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছিল।
পরে, আমার কাছে বহু শিল্পী বন্ধু অনুযােগ করেছিলেন, অংশুমান রায়কে সংবাদ বিচিত্রার মাধ্যমে এমন ভাবে তুলে ধরা হলাে, অথচ তাদের কোন সুযােগ কেন দেয়া হয় না। গৌরীদাও সেই সময় বাংলাদেশ নিয়ে আর একটি গান লিখে একজন বিশিষ্ট শিল্পীকে আমার কাছে এনেছিলেন। আমিও সেই গান রেকর্ড করে কিছুটা অংশ ব্যবহার করেছিলাম সংবাদ বিচিত্রা’য়। কিন্তু সে গান তেমনভাবে সাড়া জাগাতে পারেনি। মুস্কিল হলাে কোন শিল্পীর গান এভাবে সংবাদ বিচিত্রায় প্রচার করা হয় না। অনুষ্ঠান থেকে রেকর্ড করে আনা গানের কিছু অংশ মাঝে মাঝে অবশ্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তা শুধু অনুষ্ঠানে কিছুটা বৈচিত্র্য আনার জন্য এবং বিষয়টি আরাে আকর্ষণীয় ভাবে তুলে ধরতে, উপযুক্ত পরিবেশ রচনার জন্য সেদিন অংশুমানের গান সবটাই ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত ভাষণটি শ্রোতাদের যাতে আরাে ভালােভাবে নাড়া দেয় সেই দিকে লক্ষ্য রেখেই এটা করা হয়েছিল।
আসলে গানের এ হৃদয়স্পর্শী ভাষা, মন মাতানাে সুর, দরদী কণ্ঠ আর বঙ্গবন্ধুর সেই রক্ত গরম-করা ভাষণ এবং সর্বোপরি দুই বাংলার মানুষের আবেগ আর উত্তেজনায় ভরা সে! সময়ের পরিবেশ, সব মিলিয়েই অনুষ্ঠানটি শ্রোতাদের মনকে এমনভাবে নাড়া দিতে পেরেছিল।

পৃষ্ঠা: ২০
সেদিনের সাড়াজাগানাে সেই সংবাদ বিচিত্রতার একটি রূপরেখা এখানে তুলে দেয়া হলাে, যাতে এই প্রজন্মের পাঠকরা যারা অনুষ্ঠানটি শােনেননি, তারা কিছুটা হলেও সেদিনের আবেগ আর উত্তেজনার উত্তাপ অনুভব করতে পারেন।
আকাশবাণী, কলকাতা
সংবাদ বিচিত্রা [অনুষ্ঠান পরিচায়ক সুর Signature Tune]
আজকের অনুষ্ঠানে
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
[অনুষ্ঠান-পরিচায়ক সুর]
(সুরের রেশ মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অংশুমানের গানের একটি অংশ)
শােন, একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে উঠে রণি
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ ।

[বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশ]
২৪ বছরের করুণ ইতিহাস-বাংলার অত্যাচারের-বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৪ বছরের ইতিহাস বাংলার নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস। ১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে দশ বছর পর্যন্ত আমাদের গােলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে দুর্বার আন্দোলনে-আমার ছেলেদের গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এ আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন খান সাহেব অবসর নিলেন-তিনি বললেন দেশের শাসনতন্ত্র দেবেন গণতন্ত্র দেবেন-আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল। নির্বাচন হলাে। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলা নয় পাকিস্তানের মেজরিটির নেতা হিসেবে তাকে অনুরােধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে হবে। আমরা বললাম ঠিক আছে। আমরা এ্যাসেমব্লীতে বসবাে। আমি বললাম, এসেমব্লীর মধ্যে আমরা আলােচনা করবাে। এমনকি, আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়-তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলােচনা করলেন। বললেন যে, আলােচনার দরজা বন্ধ হবে না, আলােচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনা করলাম। আপনারা আসুন আলােচনায় বসুন। আমরা আলাপ করে

পৃষ্ঠা: ২১
শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসেন তবে কসাই খানা হবে এ্যাসেমব্লী। তিনি বললেন যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেয়া হবে। যদি কেউ এ্যাসেমব্লীতে আসে তাহলে পেশােয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম এ্যাসেমব্লী চলবে। তারপর এক তারিখে হঠাৎ এ্যাসেমব্লী বন্ধ করে দেয়া হলাে। আমি বললাম শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করুন। আমি বললাম আপনারা কল কারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাে। তারা শান্তিপূর্ণ ভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাে। কি পেলাম আমরা? জামার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি-বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য। আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের ওপর! তার বুকের ওপর হচ্ছে গুলী। আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙ্গালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। দেখে যান কারা গরীবের উপর-আমার বাংলার মানুষের বুকের উপরে গুলি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।

(অংশুমান রায়ের গান)
সেই সবুজের বুক চেরা মেঠোপথে,
আবার এসে ফিরে যাবাে
আমার হারানাে বাংলাকে
আবার তাে ফিরে পাবাে
শিল্পে কাব্যে কোথায় আছে হায়রে
এমন সােনার দেশ ॥
শােন, একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে উঠে রণি
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।।

(বঙ্গবন্ধুর ভাষণ)
“ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে এ্যাসেমব্লী কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি ঐ শহীদের রক্তের উপর পা দিয়ে মুজিবুর রহমান যােগদান করতে পারে না। এ্যাসেমব্লী কল করেছেন আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম সামরিক আইন মার্শাল’ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লােকেদের ব্যারাকে ফেরত দিতে হবে। যেভাবে আমার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে

পৃষ্ঠা: ২২
তার তদন্ত করতে হবে। আর-জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবাে-আমরা এ্যাসেমব্লীতে বসতে পারবাে কি পারবাে না। এর পূর্বে এ্যাসেমব্লীতে বসতে আমরা পারি না। আমি-আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই। আমরা মানুষের অধিকার চাই।

(অংশুমানের গান)
বিশ্বকবির সােনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা
রূপের যে তার নেই কো শেষ, বাংলাদেশ।
‘জয় বাংলা’ বলতে মনরে আমার
এখনও কেন ভাবাে
আমার হারানাে বাংলাকে
আবার তাে ফিরে পাবাে,
অন্ধকারে পূবাকাশে উঠবে আবার দিনমণি।
শােন, একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে উঠে রণি।
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।।

[বঙ্গবন্ধুর ভাষণ]
“প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে। এবং রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার না পারি তােমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবাে-আমরা পানিতে মারবাে। তােমারা আমার ভাই, ব্যারাকে থাকো। কেউ তােমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করাে না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। মনে রাখবেন, শত্রু বাহিনী ঢুকেছে। নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর। আমাদের যেন বদনাম না হয়। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও আর চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়। বাঙালীরা বুঝে শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের

পৃষ্ঠা: ২৩
নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তােল, আর তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেব এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে ইনশাল্লাহ।”
“এবারের সংগ্রাম-আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।
এবারের সংগ্রাম-আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
(অনুষ্ঠান পরিচায়ক সুর)
(ঘােষণা)
সংবাদ বিচিত্রা এখানেই শেষ হলাে।
রচনা ও প্রযােজনা-উপেন তরফদার।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালাে দিন। ঐ দিন মধ্য রাতে বর্বর পাক-বাহিনী নিরীহ, নিরস্ত্র বাংলার মানুষের ওপর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আগেই বলেছি, পূর্ব পাকিস্তানের তীব্র আন্দোলনে জেরবার হয়ে ইয়াহিয়া খান দেশে নির্বাচনের ডাক দিলেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মুজিবরের নেতৃত্বে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলাে। স্বভাবতঃই তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভের দামামা বেজে উঠলাে। এরপর ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে আলােচনায় বসলেন। এই সবই ছিল সামরিক শাসকদের ছল-চাতুরী। পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণের প্রস্তুতির জন্য শুধু সময় নেয়া। এক সময় ভুট্টো-ইয়াহিয়া ঢাকায় এলেন আলােচনা করতে। কিন্তু আলােচনার বদলে ক্র্যাক ডাউন এর হুকুম দিয়ে ইয়াহিয়া খান কাপুরুষের মতাে গােপনে রাওয়ালপিণ্ডি পালিয়ে গেলেন ২৪শে মার্চ।
২৫শে মার্চ, ইয়াহিয়ার সেনা ট্যাঙ্ক, কামান আর মেশিনগান নিয়ে চুরমার করে দিল ঢাকা শহর। জারি হলাে মার্শাল ল’। মুজিবুর হলেন গৃহবন্দী। আর পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসকের বড়কর্তা হলেন টিক্কা খান। এরপর পূর্ব পাকিস্তানে রচিত হলাে হানাদার চেঙ্গিস খানকেও লজ্জা দেয়ার এক বর্বরতার ইতিহাস। সেখানে নিরীহ শান্তিপ্রিয় বাঙালীর ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ধর্ষণ আর নির্বিচারে হত্যার তাণ্ডব শুরু করলাে পাক-বাহিনী। ২৬শে মার্চ ইউ.এন.আই-এর টেলিপ্রিন্টারে আসা একটি- FIASH NEWS-এ আলােড়িত হলাে সারা বিশ্ব।
“MUJIBUR RAHMAN DECLARES BANGLADESH INDEPENDENT” দিকে দিকে প্রচারিত হলাে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বার্তা। শুরু হলাে প্রতিরােধ।

পৃষ্ঠা: ২৪
শেখ মুজিবের পূর্ব নির্দেশ মতাে যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাধারণ মানুষ। ঘরে ঘরে গড়ে উঠলাে প্রতিরােধের দুর্গ।
প্রতিরােধ যত জোরালাে হয় হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক তাণ্ডবও ততাে নারকীয় হয়। কামান, রাইফেল রকেট, মর্টার নিয়ে রাতের অন্ধকারে ওরা ঝাপিয়ে পড়ে অসহায় মানুষের ওপর। অতর্কিত এই আক্রমণে প্রাণ হারালেন হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ, লুষ্ঠিত হলাে অগণিত মা বােনের ইজ্জত।
মনে পড়ছে, ২৫শে মার্চ-এর এই তাণ্ডবলীলার কয়েকদিন পরেই বাংলাদেশের এক তরুণ আকাশবাণীতে এসে আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন একটি ক্যাসেট যাতে রেকর্ড করা ছিল ঢাকায় সেই অভিশপ্ত রাতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলাের ওপর হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের শব্দচিত্র। সেই গােলাগুলির শব্দচিত্র আর সীমান্ত পেরিয়ে আসা বুলেটবিদ্ধ মানুষের করুণ আর্তনাদ তুলে ধরেছিলাম সংবাদ বিচিত্রায়। মনে পড়ে, সেই অনুষ্ঠান চলাকালে টেলিফোনে অনেক শ্রোতা সহ্য করতে না পেরে প্রচার বন্ধ করার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন।
শয়তান পাক বাহিনীর নারকীয় অত্যাচারে বিপন্ন মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে সব কিছু হারিয়ে দলে দলে চলে এলাে ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। সে সময়ে আমার প্রধান কাজ ছিল সকালে টেপ রেকর্ডার নিয়ে সীমান্ত এলাকায় যাওয়া, সারাদিন বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের কাছ থেকে পাক বাহিনীর অত্যাচার আর স্বজনহারানাে অসহায় মানুষগুলাের কান্না রেকর্ড করে নিয়ে আসা, আর রাতে এই লাঞ্ছনা আর অত্যাচারের করুণ কাহিনী বেতারে তুলে ধরা। এই সময়ে সীমান্তে হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবের শিকার বিপন্ন মানুষগুলাের কথা ভাবলে আমার মন আজও বিষন্ন হয়ে পড়ে। কত পুত্রহারা মায়ের করুণ আর্তনাদ, কত স্বামীহারা স্ত্রীর আকুল কান্না, বুলেটবিদ্ধ তরতাজা কত তরুণের শেষ কথা জয় বাংলা আমায় রেকর্ড করতে হয়েছে।
সীমান্তে বনগাঁ হাসপাতালে বুলেটবিদ্ধ এক তরুণের এই পৃথিবী থেকে চিরদিনের মতাে বিদায়ের করুণ মুহূর্তটি আজও আমায় ব্যথিত করে তােলে। সীমান্তের ওপার থেকে বুলেটবিদ্ধ ওই তরুণকে সবে তখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। গায়ের জামা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ডাক্তার জরুরী অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। আর সেই তরুণ উত্তেজিত ভাবে সমানে চিৎকার করে চলেছে, “আমাকে আপনারা বাঁচান, আমাকে বাঁচান। আমার মা-বাবা ভাই-বােন সবাইকে ওরা শেষ করেছে। আমি ওদের ছাড়ব না। আমি বদলা …।” না, কথা শেষ করতে পারেনি সে। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লাে তরুণটি। আমরা অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলাম।
১৮ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আরাে একটি স্মরণীয় দিন। ১৭ এপ্রিল রাতে কাজের শেষে বাড়ী ফিরব ভাবছি তখন জানতে পারলাম

পৃষ্ঠা: ২৫
আজ রাতে বাড়ি ফেরা হবে না। কারণ সেই রাতেই আমাদের কোথাও গুরুত্বপূর্ণ কভারেজে যেতে হবে। এখানে বলে রাখি, আমাদের সে সময়ে এভাবেই যখনতখন এধার-ওধার ছুটতে হতাে। যাই হােক, আমরা শুধু জানতে পারলাম রাত তিনটায় আমাদের কলকাতা ময়দানে প্রেসক্লাবে যেতে হবে। সেখানে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জনসংযােগ আধিকারিক সমর বসুর সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ করতে হবে এবং তিনি আমাদের কোথাও নিয়ে যাবেন। এর বেশি আর কিছু জানানাে সম্ভব নয়বলেন আমাদের বার্তা সম্পাদক দ্বীপেশ ভৌমিক।
বন্ধু-সহকর্মী প্রণবেশ সেনকে আর আমাদের ড্রাইভার ভবতােষ দাশকে নিয়ে শেষ রাতে প্রেসক্লাবে উপস্থিত হলাম। সেখানে দেখলাম বেশ কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যেই দেশী-বিদেশী বহু সাংবাদিক হাজির। সমরদাকে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় আমরা যাচ্ছি? সমরদা শুধু মৃদু ধমক দিয়ে বললেন “চলই না”। ব্যস! শুধু এইটুকু বলেই গম্ভীর হয়ে সরে গেলেন। সবার মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম। তবে সেটা কি কেউ পরিষ্কার করে বলছে না। তবে গাড়িতে ওঠার আগে আমাদের জানিয়ে দেয়া হােল বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আমরা সেখানে যাচ্ছি। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি, কেনই বা যাচ্ছি, কিছুই জানতে পারলাম না। স্বভাবতঃই উত্তেজনা আরাে বাড়তে থাকলাে!
শেষ রাতের আলাে-আঁধারে প্রচন্ড গতিতে আমাদের গাড়িগুলাে ছুটছে। বুঝতে পারছি একটা কিছু বড় খবর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু কি সে খবর তাই জানি না। ধীরে ধীরে ভাের হয়ে এলাে। ফিকে আলােয় গাড়ি থেকে মুখ বার করে দেখলাম আমরা কৃষ্ণনগর পৌঁছে গেছি। আরাে কিছুটা পথ চলার পর আমাদের গাড়ি থামলাে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে এলাম। বলা হলাে, এবার আমাদের কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। হাঁটা শুরু হলাে।
বেশ কিছুটা পথ চলার পর দেখতে পেলাম বেশ কিছু মানুষের আনাগােনা। ততক্ষণে ভােরের আলােতে চারিদিক পরিষ্কার হয়ে এসেছে। অবশেষে আমাদের অভিযান শেষ হলাে। চারিদিকে আম গাছ ঘেরা একটা মাঠের মধ্যে অনেক মানুষ জড়াে হয়েছেন। মাঠের এধারে ওধারে কয়েকজন যুবক দাঁড়িয়ে। লক্ষ্য করলাম ওদের কারাে হাতে রাইফেল কারাে হাতে এলএমজি। মাঠের এক কোণে ছােট্ট একটি মঞ্চ তৈরী করা হয়েছে। এধারে ওধারে লাল-নীল-সবুজ কাগজ কেটে সাজানােনা হয়েছে। একটা উৎসবের আমেজ থাকলেও চাপা উত্তেজনাও রয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি জায়গাটি বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর। ওরা নতুন নামকরণ করেছে ‘মুজিবনগর’। আরাে জানতে পারলাম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রথম নতুন মন্ত্রিসভা আজ এখানে শপথ গ্রহণ করবে।

পৃষ্ঠা: ২৬
মনে পড়ছে, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি’ গানটি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হলাে। মঞ্চ থেকে এবার একে একে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এবং মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যদের নাম ঘােষণা করলেন। মুজিবুর রহমান তখন পশ্চিম পাকিস্তানের কোন অজানা স্থানে কারাগারে বন্দী। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া মন্ত্রিসভার আর যে সব সদস্য সেদিন শপথ গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন
(ক) মনসুর আলী
(খ) খােন্দকার মােস্তাক আহমদ
(গ) কামরুজ্জামান
আর, মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘােষণা করা হলাে। প্রতিটি ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে সমবেত হাজার হাজার মানুষ উল্লসিত হয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন তা দেখে আমার সেদিনই দৃঢ় ধারণা হয়েছিল বাংলাদেশকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। এরপর নেতৃবৃন্দ সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সেদিনের কিছু কথা এখানে তুলে দিচ্ছি। তিনি বলেছিলেন-
“আজকে হােক, আগামীকাল হােক, পরশু হােক আমরা জয়লাভ করবই। আমরা পরাজিত হওয়ার জন্য সংগ্রাম শুরু করি নাই। আর এই জয়লাভের ভিতর দিয়ে একটা নতুন জাতির জন্ম হবে।”
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু মুজিবরের পক্ষ থেকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতিদানের জন্য সবার কাছে আবেদন জানালেন। মুজিবনগরের সেদিনের সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানটি ছিল একেবারেই অনাড়ম্বর। কিন্তু আন্তরিকতা আর উষ্ণ আবেগে ভরা। সাধারণ মানুষের সেদিনের উল্লাস আর উন্মাদনা আজও আমাকে শিহরিত করে!
বাংলাদেশের জাতীয় নেতাদের ভাষণসহ সবকিছু রেকর্ড করে কলকাতায় ফিরলাম। ফেরার পথে ভাবছিলাম একদিন পলাশীর আম্রকুঞ্জে ভারতের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আজ সেই আম্রকুঞ্জ থেকে কিছু দক্ষিণে সীমান্তের ওপারে আর এক আম্রকাননে জন্ম নিল নতুন এক স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
স্টুডিওতে ফিরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য বেতারে পৌঁছে দিলাম শ্রোতাদের কাছে। মনে আছে, এই সংবাদ বিচিত্রা’য় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের শেষে আবার জুড়ে দিয়েছিলাম সেই অংশুমানের গান আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিয়ে তৈরি সেই বিশেষ সংবাদ বিচিত্রাটি।

পৃষ্ঠা: ২৭
মুজিবনগরে বাংলাদেশ মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণের পরের দিন, কলকাতার তখনকার পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব হােসেন আলী সদ্যঘােষিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করলেন। খবর পেয়েই টেপ রেকর্ডার নিয়ে ছুটলাম বাংলাদেশ মিশনে। মনে আছে আমি পদ্মাপাড়ের ছেলে শুনেই তিনি সেদিন আমায় প্রথম পরিচয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আসলে সেই সময়টাই ছিল আবেগ আর উত্তেজনার।
মি. আলীর সাক্ষাৎকার রেকর্ড করতে করতেই শুনছিলাম পাশের ঘরে বেগম আলীর আবেগ আর উত্তেজনায় ভরা কণ্ঠস্বর। মি. আলীর সাক্ষাৎকার শেষ হতেই অনুরােধ জানালাম বেগম আলীর একটি সাক্ষাৎকারের জন্য। অন্য সময় হলে মি. আলী রাজী হতেন কিনা জানি না, সেদিন কিন্তু কোন দ্বিধা না করেই বেগম আলীকে ডেকে নিলেন তাঁর ঘরে। আর বেগম আলীও সানন্দে রাজি হলেন আকাশবাণীকে কিছু বলতে। টেপ রেকর্ডার চালিয়ে সেদিনকার বাংলাদেশ মিশনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলাম। পাক বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডবের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি সেদিন বারে বারে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। আমার মনে আছে সাক্ষাৎকারটি শেষ করেছিলেন এই কটি কথা দিয়ে, “আমরা এখনাে গুলির আওয়াজ শুনছি, সেই রক্তস্রোত বয়ে আসছে ইন্ডিয়াতে, সাড়ে সাত কোটির প্রাণের রক্ত। সেই রক্ত দেখে আজ আর আমি সহ্য করতে পারলাম না। না পারার জন্য আজ আমি দেশ স্বাধীন ডিক্লেয়ার্ড করে দিলাম ‘জয়বাংলা’ বলে।”
কথা কয়টি আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে। কারণ স্টুডিওতে এসে অনেকবার আমায় কথা কয়টি বাজিয়ে শুনতে হয়েছিল। আমি দ্বিধায় ছিলাম, কথা কয়টি বেতারে প্রচার করা ঠিক হবে কিনা? আসলে বেগম আলী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করতে পারেন না। কিন্তু মুস্কিল হলাে যেভাবে তিনি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের করুণ কাহিনীর বিবরণ দিতে গিয়ে কথা কয়টি শেষ করেছিলেন সেখানে এডিট করে কথা কয়টি বাদ দেয়া সম্ভব ছিল না। বাদ দিতে হলে সবটাই বাদ দিতে হয়।
অনেক ভেবে আমার মনে হয়েছিল, বেগম আলী ‘আমি’ বলতে সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের নিপীড়িত লাঞ্ছিত অগণিত মানুষের প্রতিনিধি হয়েই নিজেকে তুলে ধরেছেন। কাজেই শ্রোতাদের তার আসল বক্তব্যটি বুঝতে অসুবিধা হবে না। তাই কোন রকম কাটছাট না করেই মি. আলীর সাক্ষাৎকারের সঙ্গে মিসেস আলীর সাক্ষাৎকারটিও বেতারে নানা তরঙ্গে প্রচার করা হয়েছিল বারে বারে। শ্রোতাদের অসুবিধা হয়নি। কারণ বহু শ্রোতা বেগম আলীর সাক্ষাৎকারটির প্রশংসা করেছিলেন, বিভিন্ন কাগজেও এই সাক্ষাৎকারের প্রশস্তি লেখা হয়েছিল।
এখানে মি. আলী ও মিসেস আলীর সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ তুলে ধরার লােভ সামলাতে পারছি না। মি. আলী সেদিন বলেছিলেন “আপনারা সবাই জানেন

পৃষ্ঠা: ২৮
বাংলাদেশে নৃশংস অত্যাচার করে হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে কেটে ফেলা হয়েছে। এটা Selected genocide chosen people-marked people তাদের ধরে ধরে-Professors, Students, intellectuals, আওয়ামী লীগ লীডারস-Other leaders of public opinion তাদের ধরে ধরে মারা হলাে। তারপরে The Machine of war was let loose on the common people-calcat aterats Populated areas, যেখানেই তারা মনে করেছে, যে এখানে একটু আওয়ামী লীগের Support আছে সেখানেই তারা ধ্বংস করিয়ে দিয়েছে। সেখানে কে আছে কে না আছে সে সমস্ত না ভেবে। যা খবর আমার কাছে এসেছে দুই চারজনের সঙ্গে আমি দেখা করেছি, যা report এসেছে-Independent observers, Foreign Corespondents, who have no stake in Pakistan, who are impartial তারা যে রকম Statement দিয়েছেন তাতে মনে হয় hundreds of thousands of people have been killed এবং একজন আজ আমাকে বললেন, authentic source-এ বােধ হয় এক লাখ লােক মারা গেছে। এবং সেই যে মারণাস্ত্র যেটা, সেটা আরাে জোরদার করে তােলা হয়েছে এবং সাধারণ লােককে মেরে ফেলা হচ্ছে। তাে এই অবস্থায় কোন মানুষ, যার কিছুটা বিবেক আছে তারা সেটা সহ্য করতে পারে না। এবং সমস্ত মানুষ জাতির এটা প্রতিরােধ করা দরকার। এবং বালাদেশের এই যে তাদের যুদ্ধ বলুন আর যাই বলুন, যেটা পশ্চিম পাকিস্তান সরকার-it is a war against entire people-যেটা করছে তার বিরুদ্ধে রুখে। দাঁড়ানাে উচিত। অন্ততঃ আমার এই ক্ষুদ্র শক্তিতে এই মিশনের আমি Head of Mission হিসেবে, আমার এইটুকু করা দরকার যে আমি সেই বাংলাদেশের পক্ষে আমার যে ছােট্ট Voice-টা সেটা raise করা দরকার। তা আমি এতদিন ভাবছিলাম যে একটা কিছু হবে হয়তাে, একটা Settlement করে ফেলবে। After all মানুষ যে এত বর্বর হতে পারে না, সে একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু এখন দেখলাম যে সেটা হচ্ছে না। তারা পুরাে জাতিটাকেই ধ্বংস করবে। একজন Correspondent বলেছে এটা might have a nation of slaves and prostitutes। এবং সেই ভাবেই তারা করছে। যাতে পঞ্চাশ বছরে বা একশ বছরে বাঙালী জাতি যাতে আর উঠতে না পারে। এ রকম বর্বরতা এবং তাদের aim and object যেটা। তাে সেখানে আমার no other alternative-but throw my love with my people and I have done that এটা মিশন হলো।
বাংলাদেশের সরকার হয়েছে এবং গতকাল তারা শপথ নিয়েছেন। তাদের Policy formulate করেছেন বাংলাদেশ সরকার, যেটা সারা বাংলাদেশের সরকার পুরাে জাতি যাকে সমর্থন করেছেন নির্বাচিত করেছেন। এখন তাদের, আনুগত্য

পৃষ্ঠা: ২৯
দেখিয়ে যারা এখনাে সমর্থন করে যাচ্ছেন সেই সরকার যেভাবে আমাকে কাজ করতে বলবেন সেই ভাবে আমি কাজ করবাে। আর Moral Support যেখানেin a cause of humanity-সেটা যদি intervention হয়, তবে সেটা যদি ভারত intervention করে তবে সেটা definitely intervention.”
বেগম হােসেন আলী সেদিন তার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন “দেশের বড় বড় লীডারকে ধরে ধরে একটা একটা করে বেছে বেছে মেরেছে যাতে দেশ স্বাধীন করতে না পারে। এটাই কি ইয়াহিয়া খানের কর্তব্য। ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন আমি তােমাদের স্বাধীনতা দেব আমি তােমাদের চার দফা মানবাে, আমি তােমাদের ছয় দফা মানবাে। মুজিবরকে বড় আশ্বাস দিয়ে বড় আশায় ওনাকে সহায়তা করলেন। সেই মতাে মুজিবরও মেনে নিলেন, যে ঠিক আছে আমাদের ইয়াহিয়া খান আমাদের দেশের ভাল বাঙালীদের ভালাের জন্যে বােধ হয় করছেন। কিন্তু মুজিবর রহমান সাহেব বুঝতে পারেননি যে উনি এই ২৫ তারিখ রাত্রে এই রকম গুলিবর্ষণ করে দিয়ে চোরের মতাে পালিয়ে চলে যাবে। শত সহস্র প্রাণের জান নিয়ে রক্তের স্রোত বইয়ে দিয়ে, সেই রক্তের স্রোত বইয়ে আসে ইন্ডিয়াতে। মাত্র কুড়ি মাইল দূরে বর্ডার। উনি জানতেন না যে মাত্র কুড়ি মাইল দূরে বর্ডারের থেকে এত কাছে যে ইন্ডিয়া। উনি যদি জানতেন, তাহলে বােধ হয় এ কাজ করতেন না।
আমি ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় গিয়েছিলাম কলকাতা থেকে বেড়াতে। তারপর একদিন সােমবার রাত থেকে কারফিউ আরম্ভ হলাে। কারফিউর পরে সেই প্রসেশন। মুজিবরের ছেলেরা সেই প্রসেশন করা আরম্ভ করেছে। সেই কারফিউর ভেতর ছেলেরা যখন প্রসেশান করে তখন আমার সামনে ২২টি গুলি – একটা একটা করে গুলি করে ছেলেদের হত্যা করে। আমি বসে বসে কাঁদি, আমার দু চোখ দিয়ে বারবার করে পানি পড়ে, আর আমি গুণতে থাকি।
[কান্নায় ভেঙে পড়েন] আমি গুণতে থাকি গুলির নিশানা আমাদের দেশের বাচ্চাদের মায়ের কোলের ছেলেদের একটা একটা করে টেনে নিয়ে মারছে। আমার দুই মেয়ে তাড়াতাড়ি তিন তলার ছাদে উঠে গেল দেখতে, যে কি হচ্ছে? তখন দেখি দু’দলে লাশ নিয়ে টানাটানি, একদিকে ছেলেরা টানছে আর একদিকে মিলিটারি টানছে। টানাটানি করতে করতে তারপর Student-রা সব লাশগুলাে নিয়ে যায়। তারপর চিৎকার-রক্ত চাই রক্ত চাই, পানি চাই পানি চাই, ডাক্তার ডাক্তার নার্স এ্যাম্বুলেন্স। কেউ আসে-কেউ আসে না, ভয়ে দূরে পালিয়ে যায়। তারপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যায় এবং একটার পর একটা মারা যায়। তারপরের থেকেই এই রকম দিনের পর দিন রাতের পর রাতে, একটা মিনিটের জন্যও বন্ধ হয়নি। আমার মনে হয় আর হবেও না। (কান্না) ইয়াহিয়া এত পাষাণ-পাথর যে তার জানে দয়ামায়া বলে কিছু নাই। তারও নিজের আছে ছেলে মেয়ে-বউ-আত্মীয়স্বজন। তারা

পৃষ্ঠা: ৩৯
কি একদিন গুলি খাবে না? তারাও একদিন গুলি খেয়ে এভাবে মারা যাবে। আমরা এখনাে গুলির আওয়াজ শুনছি। সেই রক্তস্রোত বয়ে আসছে ইন্ডিয়াতে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের রক্ত। সেই রক্ত দেখে আজ আর আমি সহ্য করতে পারলাম না। না পারার জন্য আজ আমি দেশ স্বাধীন ডিক্লেয়ার্ড করে দিলাম জয়বাংলা বলে। আর আমি কি করবাে? আমার এক জান যদি যায়, যাক্-আমার জানের মায়া আমি করি না। কারণ, এই জান আর কি করবাে আমি? এই নিজের জানকে নিজের ওপর tortured করছি আমি। খেতে বসে খেতে পারি না-শুতে গিয়ে শুতে পারি না। নিজের জানকে দিনরাত বুঝাচ্ছি। জানি না-আল্লা আমাদের ওপর, কতখানি ইসলাম ধর্ম এই বিচার আরম্ভ করেছে। ইসলাম ধর্মের ভিতর এই লেখা নাই যে, তুমি একটার পর একটা লােকের উপর গুলি করে ইসলাম ধর্ম পালন কর। এটা ইসলাম ধর্মের ভিতরে নাই-কোরান শরীফের ভিতরে নাই-কোন হাফিজ বাইবেল -পৃথিবীর কোন জিনিসের মধ্যে-হত্যার ব্যাপারে এ জিনিসটা নাই।”
বেগম আলীর কথা বলতে গিয়ে আমার আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় বুলেটবিদ্ধ তরতাজা যুবককে জয়বাংলা বলে চোখের সামনেই মরতে দেখেছি। শুনেছি বহু পুত্র-কন্যাহারা বৃদ্ধ পিতামাতার হাহাকার, স্বামীহারা স্ত্রীর আকুল কান্না। অবসর সময়ে সেদিনের কথা ভাবলে এমন অনেক ছবি আমার সামনে ভেসে ওঠে। এমনি একটি মুখ-আয়েশার।
আয়েশার কথা আজও আমি ভুলতে পারিনি। কলকাতা বাংলাদেশ মিশনের নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণার বেশ কয়েকদিন পর বেগম আলী আমায় একদিন টেলিফোনে বললেন, শীগগীর টেপরেকর্ডার নিয়া আমাদের এখানে আসেন। ছুটলাম সেখানে। পার্ক সার্কাসে বাংলাদেশ মিশনে গিয়ে দেখি মিসেস আলী বছর দশেকের একটি ছােট্ট মেয়েকে নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। যেতেই বললেন, পাকিস্তানি শয়তানদের অত্যাচারের আর একটি শিকার। কিভাবে এখানে এলাে জানতে চাইলে মিসেস আলী বললেন, “ওকেই জিজ্ঞেস করুন।” আমি টেপরেকর্ডার চালু করে মাইক্রোফোন ওর সামনে ধরতেই মেয়েটি আতঙ্কিত হয়ে মিসেস আলীকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করলাে, “ওটা কি?” মিসেস আলী ওকে বুঝিয়ে বললেন। টেপরেকর্ডার বন্ধ করে আমিও ওর সঙ্গে গল্প শুরু করলাম। নানা কথায় ওর আপনজন হবার চেষ্টা করলাম। আসলে, চোখের সামনে বাবা-মা-ভাই-বােন সবাইকে খুন হতে দেখে মেয়েটি কি রকম অস্বাভাবিক হয়ে গেছে—সব সময়েই যেন আতঙ্কে গুটিয়ে আছে। যাই হােক, কিছুটা স্বাভাবিক হলে টেপ চালিয়ে ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম। এবারে ও ধীরে ধীরে উত্তর দিল, “আ-য়ে-শা।” প্রশ্ন করলাম, “বাংলাদেশে তােমার কি হয়েছিল, আমায় সব বল।” আতংক আর ভয়ে আয়েশা আবার আমার কাছ থেকে সরে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে ওকে বুঝিয়ে বললাম, “তােমার আর এখানে

পৃষ্ঠা: ৩১
ভয় নেই। তুমি আমাদের দেশে এসেছ। এখানে ওরা আসবে কি করে? তাছাড়া আমরা এখানে সবাই আছি। ওরা এখানে ভয়ে আসতেই পারবে না। এবার আয়েশার যেন কিছুটা আস্থা ফিরে এল। মিসেস আলীও ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক বােঝালেন। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ও ফেলে আসা দিনের কথা বলতে শুরু করলাে। কিভাবে ওর চোখের সামনেই ওর বাবা-মা-ভাই-বােন সবাইকে শয়তানরা দল বেঁধে এসে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে। কিভাবে তাজা রক্তে সারাটা উঠোন ভেসে গেল। কিভাবে ওর দু’মাসের ছােট্ট বােনকে মাটিতে ওরা আছড়ে মেরে ফেললাে! এখানেই শেষ নয়। ছুরি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে কিভাবে ওর বাবাকে কেটে সেই জায়গায় শুকনাে লঙ্কার গুড়াে আর নুন ছিটিয়ে দিয়েছে ওরা। বলতে বলতে আয়েশা আবার অজ্ঞান হয়ে গেল। টেপরেকর্ডার বন্ধ করলাম। তাকিয়ে দেখি মিসেস আলী অঝােরে কাঁদছেন! মেয়েটির করুণ কাহিনী শুনে আমিও সেদিন চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। অনেকে বলেন, সাংবাদিকদের আবেগে ভেসে যেতে নেই। কিন্তু তারা বােধ হয় ভুলে যান, সাংবাদিকরাও রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ। তাদেরও আবেগ আছে, অনুভূতি আছে।
যাই হােক, আয়েশা আবার কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে ওকে জিজ্ঞেস করি, “তুমি আমাদের এখানে এলে কিভাবে?” উত্তরে আয়েশা বললাে, কিভাবে ওদের বাড়িতে হামলার সময় এক ফাঁকে পালিয়ে বাড়ির পাশেই ডােবাতে কচুরিপানা ভর্তি জলে ডুবে শুধু নাকটুকু ওপরে ভাসিয়ে রেখে সারাদিন নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল। তারপর রাতের অন্ধকারে জল থেকে উঠে ভয়ে আর আতঙ্কে ছুটতে শুরু করেছিল। বলতে বলতে আবার সে কান্নায় ভেঙে পড়লাে। কান্না থামলে প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য প্রশ্ন করি, “তুমি গান জানাে।” আশ্চর্য! আয়েশা সংগে সংগে “হ্যা” বলে গাইতে শুরু করলাে -“আমার সােনার বাংলা-আমি তােমায় ভালবাসি।” তাড়াতাড়ি আবার টেপ চালালাম। দু’চার কলি গাইবার পরই কান্নায় আয়েশার গলা ধরে এলাে। গান থামিয়ে কান্নাভেজা কন্ঠে সে বললাে, “আমি আর পারছি না।” টেপরেকর্ডার বন্ধ করে স্টুডিওতে ফিরে এলাম। মনটা খুবই বিষন্ন ছিল। তবু করুণ কাহিনীকে যতটা ভালভাবে সম্ভব বেতারে তুলে ধরলাম। সংবাদ-বিচিত্রা প্রচারের পরেই অনেক টেলিফোন পেয়েছি। তারপরও অনেকদিন অনেক মানুষ আমার কাছে আয়েশার খোঁজ করেছেন। তাঁদের বাংলাদেশ মিশনে যােগাযােগ করতে বলেছি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ঘরে ফিরে গেছেন সে দেশের মানুষ। ফিরে পেয়েছেন তাঁদের ভিটেমাটি, কেউ কেউ বা ফিরে পেয়েছেন তাঁদের আত্মীয়-স্বজন। নতুন করে দেশকে গড়ে তােলবার কাজে ব্রতী আজ বাংলাদেশের মানুষ। আমার কিন্তু আজও জানতে ইচ্ছে করে কি হলাে ছােট্ট মেয়ে আয়েশার? সে কি ফিরে গেছে

পৃষ্ঠা: ৩২
তার জন্মভূমিতে? ফিরে পেয়েছে সে কি তার কোন আপনজন? সে কি আজ নতুন করে ঘর বাঁধতে পেরেছে-না কি হারিয়ে গেছে চিরদিনের মতাে এই পৃথিবী থেকে?
পাক বাহিনীর নারকীয় অত্যাচারে সীমান্ত পেরিয়ে প্রায় এক কোটি বিপন্ন মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। শুধু পশ্চিম বাংলা নয়, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা যে যেখান দিয়ে পেরেছেন সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছেন এপারে। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সবাই এসেছেন। তাদের একমাত্র অপরাধ-তারা বাঙালি। পাকিস্তান বেতার কিন্তু তখনও সমানে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে-ভারতে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ হওয়ায় দলে দলে তারা পাকিস্তানে চলে আসছে। আর এই জন্যই অযথা আতঙ্কিত হয়ে সামান্য কিছু হিন্দু শরণার্থী ভারতে গেছে। তারা আরাে প্রচার করে চলেছে পূর্ব পাকিস্তানের অসংখ্য ত্রাণ শিবির ভারত থেকে চলে আসা মুসলমান শরণার্থীদের ভিড়ে ঠাসা!
পাকিস্তানী বেতারের এই মিথ্যা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল সীমান্তের ওপার থেকে আসা পৈশাচিক অত্যাচারের শিকার শরণার্থীদের নিজেদের কথা রেকর্ড করে এনে বেতারে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। আমরা জানতাম বাংলাদেশের দুরাবস্থার কথা, বিপন্ন বাঙালীদের নিজেদের কথা তুলে ধরবার সব পথ তখন বন্ধ। তাই আমাদের বাড়তি উদ্যোগ নিয়ে শরণার্থীদের কথা রেকর্ড করতে প্রায় প্রতিদিনই ছুটে যেতে হতাে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে। শুধু সল্ট লেক নয় পশ্চিম বাংলার সীমান্ত এলাকায় আরাে অনেক ত্রাণ শিবির গড়ে উঠেছিল। এই সব নির্যাতিত শরণার্থীদের অনেকেই ছিলেন আহত, অসুস্থ এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ত্রাণশিবির ছাড়াও পশ্চিম বাংলায় বহু আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতেও তখন আশ্রয় নিয়েছিলেন অসংখ্য শরণার্থী। এক মাস দু’মাস বা ছয় মাস নয় একটি বছর এই এক কোটি ছিন্নমূল উদ্বাস্তুর খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় আর চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছিল ভারত। বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষের হাহাকার প্রথমদিকে তেমনভাবে বিশ্বকে আলােড়িত করেনি। দিনের পর দিন বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদেছে। কিন্তু মিথ্যার বেসাতি দীর্ঘদিন চালানাে যায় না, সত্য একদিন প্রকাশ হবেই। পাক বাহিনীর ধ্বংসলীলার ব্যাপকতা, তাদের নারকীয় তাণ্ডবের বীভৎসতা ধীরে ধীরে অনেকের বিবেককেই দংশন করতে শুরু করলাে। আকাশবাণী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, ভারতীয় সাংবাদিক এবং কিছু কিছু বিদেশী সাংবাদিকের প্রচেষ্টায় ক্রমেই সত্য প্রকাশিত হতে লাগলাে। পাকিস্তানের অবিরাম মিথ্যা প্রচারের নির্লজ্জ প্রয়াস একদিন ধরা পড়লাে।
ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ার এমনি একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ব্রিটেন থেকে এক সংসদীয় প্রতিনিধি দল ভারতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা

পৃষ্ঠা: ৩৩
শরণার্থীদের দেখতে আসছেন। উদ্দেশ্য, সরজমিনে সবকিছু খতিয়ে দেখা। এই সংসদীয় প্রতিনিধি দলটি কিন্তু ভারতে আসার আগে পাকিস্তানের মিথ্যা দাবি অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানেও উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। খবর পেয়ে যথারীতি সকালেই টেপরেকর্ডার নিয়ে বনগাঁ সীমান্তে পৌছলাম। ওখানে গিয়ে দেখি নির্দিষ্ট স্থানে আরাে কিছু সাংবাদিক ও আলােকচিত্রী হাজির। কিন্তু কেন জানি না, ব্রিটিশ দলনেতা ফতােয়া জারি করলেন, তারা শিবির পরিদর্শনের সময় কোন সাংবাদিককেই তাদের সঙ্গে যেতে অনুমতি দেবেন না। তবে তারা বললেন শরণার্থীদের দেখে এসে বিকেলে তারা অবশ্যই সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করবেন।
যা বলবার তখনই তারা সাংবাদিকদের জানাবেন। এর জন্য বিকেলে নির্দিষ্ট করে সময়ও বলে দিলেন। যেহেতু আমাকে শরণার্থীদের সঙ্গে তাদের কথাবার্তাও টেপে ধরে রাখতে হবে, আমাকে এবং উপস্থিত দুই একজন আলােকচিত্রীকে তাদের সঙ্গে যাবার অনুমতি দেওয়া হলাে।
আমি তাে ত্রাণশিবিরে ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ঘুরছি আর শরণার্থীদের সঙ্গে ওদের কথা টেপে ধরে রাখছি। যতােদূর মনে পড়ছে এই সংসদীয় দলে ৬/৭ জন সদস্য ছিলেন আর সাহায্যকারী হিসেবে ২/১ জন সরকারি অফিসার দেয়া হয়েছিল এবং এদের পক্ষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব প্রতিনিধিদের সাহায্য করা সম্ভব ছিল না। আরাে একটি সমস্যা ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ঐ সব সাধারণ মানুষের ভাষা বােঝা এবং আবার তা সঙ্গে সঙ্গে বিদেশীদের ইংরেজিতে বুঝিয়ে বলা কঠিন ছিল। আমি প্রথম থেকেই প্রতিনিধিদলের নেতার সঙ্গে সঙ্গেই ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম অগণিত বিপন্ন মানুষের অসহায় অবস্থা আর কান্নাকাটি দেখে তারা সবাই মানসিকভাবে বিচলিত হয়ে উঠছেন। তাঁরা শরণার্থীদের কথা সঠিকভাবে জানার জন্য ব্যগ্র হয়ে আমাকে বারে বারে প্রশ্ন করছেন। যেহেতু আমার বাড়ি ছিল বাংলাদেশে তাই ওদের ভাষা আমার ভালােই জানা ছিল। শরণার্থীদের বক্তব্যকে প্রতিনিধিদলের নেতাকে এবার ইংরেজীতে বুঝিয়ে বলতে শুরু করলাম। এইভাবে এক সময়ে দেখি আমি প্রতিনিধিদলের নেতা আর শরণার্থীদের মধ্যে দোভাষী হিসেবে কাজ করছি।
একের পর এক পাক বাহিনীর বীভৎস অত্যাচারের বিবরণ শুনে ব্রিটিশ নেতা স্বগতােক্তির মতাে এক সময় বিড় বিড় করে বলছিলেন, “Impossible! Inhuman! It is genocide!” টেপ রেকর্ডার চালুই ছিল। সুযােগ বুঝে দলনেতার কাছে মাইক এগিয়ে দিয়ে জানতে চাই এখানকার শিবির পরিদর্শনে তার প্রতিক্রিয়া। দলনেতা কিন্তু সেইখানেই দ্বিধাহীনভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বললেন, “অকল্পনীয়! সহ্য করা যায় না। পাক বাহিনীর নিদারুণ অত্যাচারের সাক্ষী-এই লক্ষ লক্ষ মানুষের অবস্থা দেখে আমরা স্তম্ভিত। এভাবে একটা সমগ্র জাতিকে ধ্বংস করা যায় না।”

পৃষ্ঠা: ৩৪
এবার আমি প্রশ্ন করি, “সীমান্তের ওপারের ত্রাণ শিবিরে আপনারা কি দেখে এলেন?”
কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে গম্ভীর মুখে তিনি জবাব দিলেন, “A few Stray dogs!” অর্থাৎ কয়েকটি নেড়ী কুত্তা। এই ভাবেই সেদিন ব্রিটিশ দলনেতা পাকিস্তান বেতারের সমস্ত মিথ্যা অপপ্রচারের মুখােশ খুলে দিয়ে মাঠে হাড়ি ভেঙে দিয়ে গেলেন। মনে আছ আমি আর সেদিন বিকেলের সাংবাদিক বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করিনি। তাড়াতাড়ি আমাদের নিজেদের গাড়িতে আকাশবাণী ফিরে এসেছিলাম। ফিরে এসেই সব রেকর্ডিং লাইনে দিল্লী পাঠিয়েছিলাম। কিছু পরেই ব্রিটিশ দলনেতার সেই স্পষ্ট স্বীকারােক্তি বেতারের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। রাতে অবশ্য শরণার্থীদের সাক্ষাৎকারের সঙ্গে সঙ্গে সংসদীয় দলনেতার এই মাঠে হাড়ি ভাঙার খবরটিও সংবাদ বিচিত্রায় ভালাে ভাবেই প্রচার করা হয়।
পরে জেনেছিলাম বিকেলে সাংবাদিক বৈঠকে ব্রিটিশ দলনেতা এভাবে স্পষ্ট করে নিজের অনুভূতি জানাননি, কিছুটা রেখে ঢেকেই তাদের মতামত জানিয়েছিলেন। এটাই স্বাভাবিক। আসলে আবেগ আর অনুভূতিতে আলােড়িত মানুষ সেই মুহূর্তে যেভাবে নিজেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করে পরবর্তী সময়ে তাকে কিছুটা সংযত হতেই হয়। আর এই জন্যই বােধ হয় মিথ্যা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংবাদ বিচিত্রার মাইক বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে এক উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালনে সমর্থ হয়েছিল। বিশ্ব বিবেক বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের সমর্থনে ক্রমেই সােচ্চার হতে লাগলাে। শুধু আকাশবাণী নয়, শুধু ভারতীয় সংবাদপত্র নয় বিদেশের সাংবাদিকরাও নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর এই নির্মম অত্যাচারের বিবরণ বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সচেষ্ট হলেন। তাঁরা কেউ কেউ বললেন, এভাবে লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষকে ভারতে ঠেলে পাঠানাে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণারই নামান্তর। এক কোটি মানুষের আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র চিকিৎসার ব্যবস্থা অনির্দিষ্টকালের জন্য চালিয়ে যাওয়া ভারতের পক্ষে ক্রমেই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের এই সব ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানালেন। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ত্রাণ সামগ্রীও আসতে শুরু করলাে। তবে প্রয়ােজনের তুলনায় তা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল।
এই সময়ের একটি বিষয়ের প্রতি উল্লেখ করা বােধ হয় খুবই প্রয়ােজন। ওপার বাংলার বিপন্ন ভাই বােনদের যেভাবে এপার বাংলার মানুষ সেই দুঃসময়ে বুকে তুলে নিয়ে সাহায্য আর সহানুভূতির হাত প্রসারিত করেছিল তা মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। যুবক-যুবতী তরুণ-তরুণী দলে দলে তখন শহরের রাস্তায়

পৃষ্ঠা: ৩৫
নেমে ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করেছেন, পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কমিটি যারা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে ত্রাণকার্য চালিয়ে গেছেন। শুধু অর্থই নয়, অন্নবস্ত্র-ওষুধ যে যা পারেন তাই নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। এমনকি অনেক মহিলাকে তাদের নিজেদের গায়ের সােনার গয়না খুলে দিতে দেখেছি। দেখেছি শিশুদের নিজেদের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে ত্রাণের জন্য অর্থ সাহায্য পাঠাতে। আর এই সব সেবামূলক কাজে আরাে বেশি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সংবাদ বিচিত্রা’ও এই বিষয়ে প্রচারে এগিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে বিদেশী সাংবাদিক ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বও ছুটে এসেছিলেন ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের অবস্থা দেখতে। এসেছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন কেনেডির ভাই সিনেটর কেনেডি, এসেছিলেন রাষ্ট্রসংঘের পক্ষ থেকে প্রিন্স আগা খান। এদের প্রায় সবার সঙ্গেই কলকাতায় ত্রাণশিবির পরিদর্শনের সময় আমার থাকবার সুযােগ হয়েছিল। সিনেটর কেনেডিকে শরণার্থীদের শােচনীয় অবস্থা দেখে মানসিকভাবে খুবই বিচলিত দেখেছিলাম। এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আমায় বলেছিলেন, অসহনীয়। সাধারণ নিরীহ মানুষের ওপর ব্যাপকহারে এই ধরনের আক্রমণের নিদর্শন দেখে আমি হতবাক।
হতবাক স্তম্ভিত সবাই! বিশ্ব বিবেকও ক্রমেই আলােড়িত। কিন্তু নির্বিকার পশ্চিম পাকিস্তান। বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাক বাহিনীর অত্যাচার সমানে চলেছে। বিশেষ করে শিল্পী, লেখক এবং বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার মারণখেলায় তখন তারা মেতে উঠেছে। বাংলাদেশের বহু বুদ্ধিজীবী আর শিল্পীকে পাক-বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যা করতে লাগলাে। বাধ্য হয়ে ওপার থেকে এপারে চলে এলেন অনেকে। এঁদের মধ্যে শওকত ওসমান, সনজিদা খাতুন, কবরী চৌধুরী এবং জহির রায়হানের কথা আমার এই মুহূর্তে বিশেষভাবে মনে পড়ছে।
ওপারের শিল্পী আর বুদ্ধিজীবীদের উপর এই পরিকল্পিত আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলাে এপারের শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা। একদিকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ধিক্কার অপরদিকে শরণার্থীদের জন্য অর্থ আর ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ, এই ছিল সেই সময়ের পশ্চিম বাংলা বিশেষ করে কলকাতা মহানগরীর মানুষ আর বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজ। আসলে, এই সময়ে মহানগরীর প্রতিটি সন্ধ্যাই হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের সাহায্যে এক একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা!
এই মুহূর্তে এমনি এক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে আয়ােজিত সেই অনুষ্ঠানে অনেক শিল্পীর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন হেমন্ত মুখােপাধ্যায় আর নজরুল-পুত্র আমার সহকর্মী বন্ধু কাজী সব্যসাচী। মনে পড়ছে, অনুষ্ঠান থেকে রেকর্ড করে আনা হেমন্ত মুখােপাধ্যায়ের “আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি” আর সব্যসাচীর

পৃষ্ঠা: ৩৬
কণ্ঠে ‘মুজিবর তােমায় প্রণাম’ নামে একটি কবিতার আবৃত্তি সেদিনের সংবাদ বিচিত্রা’য় প্রচার করা হয়েছিল। পরের দিন মুক্তিযােদ্ধা বলে পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের একজন তরুণ আমার সঙ্গে দেখা করে। তার বক্তব্য ছিল সে প্রত্যেকটি সংবাদ বিচিত্রা’ই শােনে। কিন্তু গতকালই সে শুনতে পারেনি। অথচ ওর বন্ধুরা বলেছে, হেমন্ত মুখােপাধ্যায়ের ঐ গান আর সব্যসাচীর আবৃত্তি ছিল অসাধারণ। তার অনুরােধ ছিল যদি ঐ অনুষ্ঠানের একটি ক্যাসেট-কপি পাওয়া যেত, অন্যথায় যদি অন্তত পক্ষে একবার যদি অনুষ্ঠানটি শােনবার সুযােগ দেয়া হতাে। আমি বললাম, ক্যাসেট কপি আমরা দিতে পারি না, নিয়ম নেই। তবে ওর আকুতি দেখে জানালাম, আমি আজ ব্যস্ত কাল যদি বিকেলে একবার আসতে পার তবে হয়তাে তােমায় একবার শুনিয়ে দিতে পারি। হতাশ হয়ে বললাে, আগামীকাল তার বাংলাদেশে যাবার কথা কাজেই সে আসতে পারবে না। পর মুহূর্তেই বললাে, “আপনি ঐ অনুষ্ঠানটি রেখে দেবেন। আমি কয়েকদিন পর ফিরে এসেই আপনার কাছে আসবাে।” আমি তাকে উৎসাহিত করে বললাম, তােমরা যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে এসাে। আমি টেপটি নিশ্চয়ই রেখে দেব এবং তােমাকে শােনাবাে। আমি অনেক দিন যত্ন করে টেপটি রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই তরুণটি আমার কাছে কোনদিন ফিরে আসেনি। অনেকদিন ভেবেছি তবে কি আমার সেই তরুণ মুক্তিযােদ্ধা বন্ধুটি যুদ্ধক্ষেত্রেই চিরদিনের মতাে হারিয়ে গেল? বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের এমনি সব সামান্য ঘটনা-এমনি সব অজানা-অখ্যাত মুখ আমার কাছে আজ অনেক বড় হয়ে ভেসে ওঠে।
এমনি অনেক বন্ধুর কথাই আজ মনে পড়ে। ‘৭১ সালের সেই সংগ্রামী পর্বে বাংলাদেশের অনেকের সঙ্গেই আলাপ হয়েছে, বন্ধুত্ব হয়েছে, পাশাপাশি একই লক্ষ্যে কাজ করবার সুযােগ হয়েছে। এঁদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা যেমন আছেন তেমনি আছেন শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকে শহীদ হয়েছেন, কেউ বা পরবর্তীকালে হারিয়ে গেছেন। আবার অনেকের সঙ্গে সেদিনের সেই বন্ধুত্ব আজও অটুট রয়েছে। দুঃসময়ের বন্ধুত্বের সেই দিনগুলাের স্মৃতি আজও আমি গর্বের সঙ্গে স্মরণ করি। আমার এমনি এক বন্ধু বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান। মনে পড়ে, দিনের পর দিন আমরা আকাশবাণীতে কাজের ফাঁকে কত সময় কাটিয়েছি, সেই অনিশ্চয়তায় ভরা দিনগুলােতে। আবেদ ভাই মাঝে মাঝেই আসতেন আকাশবাণীতে। কোন সময়ে হয়তাে কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে, আবার কোন সময় কোন নতুন খবরের আশায় অথবা কখনাে স্রেফ আড্ডা দিতে। কিন্তু সদাহাস্যময় ঐ মানুষটি এলেই যেন এক ঝলক খুসীর হাওয়ায় আমরাও প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠতাম। এত সমস্যা, এত অনিশ্চয়তা কিন্তু আবেদ ভাইকে দেখেছি আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য নিয়ে তাঁর মধ্যে কোন দ্বিধা দেখিনি কোনদিন। পরে জানতে পেরেছি, কি নিদারুণ কষ্টের মধ্যে জীবন কাটাতে

পৃষ্ঠা: ৩৭
হয়েছে তাকে সে সময়ে। সল্ট লেকের শরণার্থী শিবির থেকে পায়ে হেঁটেই তাকে অনেক দিন আসতে হয়েছে আকাশবাণীতে। আকাশবাণী এবং স্থানীয় সংবাদপত্রে মাঝে মধ্যে লেখা দিয়ে যা কিছু সামান্য পেতেন তাই দিয়েই তাকে চলতে হয়েছে সে সময়ের কঠিন জীবন-সংগ্রামে। অথচ একদিনও আমাদের সে কথা জানতে দেননি বুঝতে দেননি। আজ অবাক হয়ে ভাবি এই অসাধারণ আত্মবিশ্বাস আর আত্মমর্যাদাবোেধ ছিল বলেই হয়তাে বাংলাদেশের মানুষ এতবড় বিপর্যয়কে কাটিয়ে আজ মাথা উঁচু করে বিশ্বের দরবারে স্বাধীন জাতি হিসেবে দাঁড়াতে পেরেছেন।
সীমান্তের ওপার থেকে আসা লক্ষ লক্ষ নির্যাতিত মানুষের অশ্রুসজল কাহিনী তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হয়েছে যাতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেন কোনভাবে পরিবেশকে কলুষিত না করে। শত্রু পক্ষের প্ররােচণার অভাব ছিল না। তাদের অপপ্রচারের কমতিও ছিল না। কিন্তু কি আশ্চর্য! শিবিরগুলােতে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃস্টান-জাতিধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কেমন সুন্দর ভাবে দিনের পর দিন এক সঙ্গে মিলেমিশে কাটিয়েছেন। অভাব ছিল, সমস্যা ছিল কিন্তু সব দুঃখ, সব যন্ত্রণাকে সমান ভাবে ভাগ করে নিয়ে সৌভ্রাতৃত্বের এক আশ্চর্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন শরণার্থী ভাইবােনেরা। সংহতির এই উজ্জ্বল নিদর্শনকেও নানা ভাবে সে সময়ে আমাদের তুলে ধরতে হয়েছে বেতারে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্ব, রহস্যে-রােমাঞ্চে ভরা উপন্যাসের মতাে। একের পর এক নাটকীয় ঘটনায় আলােড়িত হচ্ছে এই উপমহাদেশ।
বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের চোরাগুপ্তা আক্রমণে জেরবার হয়ে পাক বাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর অকথ্য নির্যাতন বাড়িয়েই চলেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পশ্চিম পাকিস্তানের এক অজ্ঞাত কারাগারে ফাঁসির অপেক্ষায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পূর্ব নির্দেশ মতাে তােফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণি, সাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদুস মাখন, টাইগার সিদ্দিকী এমনি অনেক যুবনেতা স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন।
এদিকে বাংলাদেশের প্রবীণ নেতা মৌলানা ভাসানী তখন কলকাতায়। তিনি মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন জানালেন।
এদিকে আমেরিকা ও চীন, পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই যাচ্ছে। এই সঙ্কটকালে রাশিয়া কিন্তু ভারতের পাশে দাঁড়ালাে। ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে ২০ বছরের এক মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হলাে। এদিকে, পরিস্থিতি ক্রমেই আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, শ্রীমতী গান্ধী এবং অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটলেন পরিস্থিতির গুরুত্ব বােঝাবার জন্য।

পৃষ্ঠা: ৩৮
বাংলাদেশের জনগণের সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে শ্রীমতী গান্ধী সেদিন বিভিন্ন স্থানে যে জোরালাে বক্তব্য রেখেছিলেন তার কিছু কিছু সারাংশ এখানে তুলে দেয়া হলাে। খবরগুলাে আকাশবাণী থেকে প্রচারিত সে সময়ের বিভিন্ন সংবাদবুলেটিনের হেড লাইনস থেকে নেওয়া।
ব্রাসেলস-এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে তা গৃহযুদ্ধ নয়-গণহত্যা।”
লন্ডনে, শ্রীমতী গান্ধী বলেছেন, “বাংলাদেশের মূল সমস্যাকে বিশ্ব সমাজ এড়িয়ে যেতে পারে না।”
ওয়াশিংটন-এ শ্রীমতী গান্ধী বলেছেন “শেখ মুজিবর রহমানকে যদি হত্যা করা হয় তবে পাকিস্তানেরই ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি।”
প্যারিসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “যে মানুষ মুক্তি চায় মানবিক মর্যাদা দাবি করে তাকে নিপীড়নের দ্বারা স্তব্ধ করা যায় না।”
বন-এ শ্রীমতী গান্ধী বলেছেন, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান কি হবে তা নির্ভর করবে শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশের অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর।” বাংলাদেশের বিশেষ দূত আবু সাইয়িদ চৌধুরীও রাষ্ট্রসংঘ ও লন্ডনে গিয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের কথা অত্যন্ত জোরালাে ভাবে তুলে ধরেন।
ইতিমধ্যে পাকিস্তান, বাংলাদেশে আরাে সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতে থাকে। আর একটি ঘটনাও ভারত-পাক সংঘাতকে নতুন মাত্রা এনে দেয়। কয়েকজন পাকিস্তানী একটি ভারতীয় বিমানকে হাইজ্যাক করে লাহােরে নিয়ে যায়। ভারত বদলা হিসেবে, পাকিস্তানী বিমান ভারতের আকাশপথে যাতায়াত নিষিদ্ধ করে দেয়। ফলে, ওদের বিমানের যাতায়াতের পথ হলাে শ্রীলংকার কলম্বাে হয়ে। অনেক ঘুরে যাতায়াতের এই পথে অনেক সময় আর বাড়তি খরচের ধাক্কায় নতুন সমস্যায় পড়লাে পাকিস্তান।
এদিকে বিশ্ব-বিবেক ক্রমেই জাগ্রত হচ্ছিল। ধীরে ধীরে পাক বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে উঠছিল বিশ্বের নানা প্রান্ত। এবারে প্রমাদ গুণলাে পশ্চিম পাকিস্তান। বিপদে বুদ্ধিনাশ! একটা ভুল সামলাতে দশটা ভুল করে বসে মানুষ। পাকিস্তানেরও তখন সেই দশা! হঠাৎ তারা ভারতের পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ করে বসলাে।
তারিখটি মনে আছে ৩রা ডিসেম্বর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সেদিন কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। পড়ন্ত বেলায় সেই জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঘােষণা করেছিলেন- “আমরা যুদ্ধ চাই , শান্তি চাই। আমরা চাই বাংলাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব সমাপ্ত হােক।”

পৃষ্ঠা: ৩৯
কিন্তু সেই আলাে-আঁধার ক্ষণে শান্তির আহবানে সাড়া না দিয়ে পাকিস্তান অতর্কিতে আক্রমণ চালালাে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের ৮টি বিমান ঘাঁটির ওপর। হঠাৎই মাঝপথে ভাষণ শেষ করে শ্রীমতী গান্ধী দ্রুত ফিরে গেলেন রাজভবনে এবং রাজভবন থেকে সােজা দিল্লী।
ইতিমধ্যে আকাশবাণী থেকে বারবার ঘােষিত হলাে রাত ১২টায় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ দেবেন।
রাত ১২-২০ মিনিট। আকাশবাণী থেকে শ্রীমতী গান্ধী ঘােষণা করলেন ?
“আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এর দরুন, আমার সরকার এবং ভারতের জনগণের ওপর গুরু দায়িত্ব এসে পড়েছে। দেশকে এখন যুদ্ধের পথে পরিচালিত করা ছাড়া আমাদের আর কোন বিকল্প নেই। আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি। কিন্তু আমরা জানি যদি আমরা আমাদের গণতন্ত্রকে এবং জীবন ধারাকে রক্ষা করতে না পারি, তবে এই শান্তি চিরস্থায়ী হতে পারে না। সুতরাং আজ আমরা শুধুমাত্র আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষার জন্য লড়ছিনা -লড়ছি একটি মৌল আদর্শের জন্য যা এই দেশকে শক্তি জুগিয়েছে এবং একমাত্র যার ভিত্তিতে আমরা উন্নততর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। আক্রমণকে প্রতিহত করতেই হবে। ভারতীয় জনগণ সহিষ্ণুতা, দৃঢ়সংকল্প, শৃঙ্খলা এবং সুগভীর ঐক্যবােধ নিয়ে এই আক্রমণের মােকাবিলা করবে।
এদিকে ভারতীয় বাহিনী সতর্ক ছিল। বিনা প্ররােচনায় পাক বাহিনীর আক্রমণের সমুচিত জবাব তারা ভালাে ভাবেই দিলেন। পশ্চিম সীমান্তে সুবিধা করতে না পেরে এবার তারা পূর্ব রণাঙ্গণে ঝাঁপিয়ে পড়লাে। যতদূর মনে পড়ছে, পাকিস্তানের ৫টি স্যাবার’ জেট বিমান পূর্ব সীমান্তে ভারতীয় এলাকায় সেদিন আক্রমণের উদ্দেশ্য ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু সদাসতর্ক ভারতীয় বিমান বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ভারতীয় মিগ পাকিস্তানের ঐ ৫টি স্যাবার’ জেটকেই ধরাশায়ী করেছিল। পরের দিনই তখনকার ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম নিজে এসে কলকাতা বিমানবন্দরে এক ছােট অনুষ্ঠানে ভারতীয় মিগ বিমানের পাঁচজন সাহসী চালককে অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। ঐ গর্বিত তরুণ বৈমানিকদের সাক্ষাৎকারও সেদিন সংবাদ বিচিত্রায় প্রচার করা হয়েছিল। এভাবেই পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গণেই ভারতকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলা হলাে।
৬ ডিসেম্বর। প্রতিটি ভারতবাসীর জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য এ এক আশ্চর্য দিন। লােকসভায় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ঘােষণা করলেন। আমাদেরই মতাে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানাবার সিদ্ধান্ত। নতুন দিল্লীতে লােকসভায় বেলা সাড়ে বারােটায় প্রধানমন্ত্রী এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘােষণা করলে

পৃষ্ঠা: ৪০
সভাকক্ষে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। সমস্ত সদস্য করতালি দিয়ে টেবিল চাপড়ে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান তাঁদের ‘জয় বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে সভাকক্ষ ফেটে পড়ে। এবার গড়ে উঠলাে ভারতীয় সেনাবাহিনী আর বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত ফৌজ।
এরপর দ্রুত এগিয়ে চলে ইতিহাসের অবধারিত পরিণতি। প্রতি মুহূর্তেই রণাঙ্গণের চমকপ্রদ খবর! দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে সম্মিলিত ফৌজ। জলে, স্থলে আকাশে তাদের অপ্রতিহত গতি! পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গণেই ভারত জিতেই চলেছে। পশ্চিম খন্ডে ভারতীয় বাহিনী প্রচণ্ড বিক্রমে এগিয়ে চলেছে। পূর্ব বাংলায় পাক-বাহিনী পর্যদস্ত। ঢাকার পতন আসন্ন, লাহাের পিন্ডি যায় যায়।
ইয়াহিয়া খান আশায় ছিলেন-মার্কিন সপ্তম নৌবহর আর ভারতের উত্তর দিকে চীনের আক্রমণের অপেক্ষায়। বস্তুতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সময় তাদের Seventh Fleet-কে ভারত মহাসাগরে পাঠিয়েও দিয়েছিল।
কিন্তু দিল্লীর রামলীলা ময়দানে এক বিশাল জনসভায় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আমেরিকাকে সাবধান করে দিলেন-“তােমার Seventh Fleet-কে আমি ভয় পাই না। মনে রেখাে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ভারতকে ভয় দেখানাের দিন আর নেই।”
সেই সময়ে রণাঙ্গণের নিত্য নতুন খবর দিয়ে সাজানাে হতাে সংবাদ বিচিত্রা। উত্তেজনায় ভরা ছিল সে সময়ের আমাদের কর্মব্যস্ত দিনগুলাে। এখানে দুটি ঘটনার কথা আজ আমার মনে পড়ছে।
রণাঙ্গণের অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে যাবার অনুমতি পেয়ে সেদিন আমি কলকাতা বিমানবন্দরে নির্ধারিত সময়ে হাজির হলাম, অবশ্যই টেপরেকর্ডার সঙ্গে নিয়ে। সেখানে পৌছে দেখি ইতিমধ্যে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিকও হাজির। আমাদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বন্ডে সই করতে হলাে। তারপর ভারতীয় বিমান বাহিনীর একখানি ডাকোটা বিমানে যশাের এবং সেখানে একেবারে রণাঙ্গণে। কাগজের বিবরণ থেকে রণাঙ্গণের একটা ধারণা অবশ্য ছিল কিন্তু সত্যিকারের বাস্তব অভিজ্ঞতা কিন্তু সেই দিনই প্রথম। বলতে দ্বিধা নেই, ভয় একটু ছিল তবে উত্তেজনা ছিল সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি, এই আনন্দ আর উত্তেজনায় সেদিনের ঐ ভীতিটুকু নিমেষে দূর হয়ে গেল। আমাদের সামনে পেছনে এগিয়ে চলেছে ভারতীয় বাহিনীর বেশ কিছু সশস্ত্র জওয়ান। সদাসতর্ক দৃষ্টি ওদের চারিদিকে। টেপ রেকর্ডার চালিয়ে আমি, আরাে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক তাদের সঙ্গে হেঁটে চলেছি রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে। আমাদের রাস্তার এপার-ওধার যেতে বিশেষভাবে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। কারণ তখন শত্রুপক্ষ রাস্তার দুই ধারে মাইন পুতে রেখেছে। তাছাড়া শত্রু পক্ষের ‘শেল’ যেকোন মুহূর্তে আছড়ে পড়বার আশঙ্কা তাে আছেই! আমাদের বলা হলাে প্রায় এক কিলােমিটার আগে ভারতীয় বাহিনী সাজোয়া গাড়ি নিয়ে বিনা প্রতিরােধে

পৃষ্ঠা: ৪১
দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। সেই মুহূর্তের অনুভূতি আর উত্তেজনা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবু চলার পথে মাঝে মাঝে ধারাবিররণী অর্থাৎ যাকে ‘স্পট কমেন্টারী’ বলে, তাই দিয়ে রণাঙ্গণের একটা বাস্তব ছবি টেপে ধরে রাখবার চেষ্টা করলাম। সহযাত্রী দু’ একজন বিদেশী সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করলাম। পরে সাধারণ দু’ চার জন স্থানীয় মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ফিরে এলাম। সেই দিন রাতেই রণাঙ্গণের একটি ছবি বেতারে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছিলাম।
আর একটি দিনের কথা মনে পড়ছে। সেদিন যশােরের পতন ঘটলাে। পতন বলে বলা উচিত হানাদার বাহিনীর কবল থেকে সেদিন যশাের মুক্ত হলাে। বাংলাদেশে যুদ্ধ তখন পুরােদমে চলেছে। যশাের ক্যান্টনমেন্টের যেদিন পতন হলাে সেদিন আমি আকাশবাণীর প্রতিনিধি হয়ে উপস্থিত ছিলাম সেখানে। ভারতীয় বাহিনীকে স্বাগত জানাতে-বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সেদিন কি উল্লাস আর আনন্দ! আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই আজ পথে নেমে এসেছেন। একের পর এক ভারতীয় জওয়ানদের গাড়ি শহরে ঢুকছে আর তাকে ঘিরে জনতার সে কি উন্মাদনা! চারিদিক ‘জয়বাংলা’ আর ‘ভারত-বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে মুখর। মুক্তির আনন্দে পাগল মানুষের আনন্দ আর উচ্ছাসের অসাধারণ দৃশ্য দেখবার সৌভাগ্য আমার সেদিন হয়েছিল। জানি না বিদেশী কোন সৈন্যবাহিনীকে স্বদেশের মাটিতে এভাবে স্বাগত জানাবার নজীর ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা? ভবিষ্যতেও এমন বিরল দৃশ্য দেখবার অসাধারণ সৌভাগ্য আবার কখনাে কারাে হবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।
মনে পড়ছে, যশােরে ভারতীয় বাহিনীর যিনি কমান্ডার ছিলেন তাকে ছাড়া ওখানকার চার্চের আর্চবিশপ তার সাক্ষাৎকারে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃস্টান নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালীর ওপর হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের বীভৎস বিবরণ দিতে গিয়ে সেদিন চোখের জল সামলাতে পারেননি। আর মনে আছে, অনেক অনেক মুক্তিপাগল মানুষের সঙ্গে একটি ছােট কিশােরকে। আমার ধরা মাইকের সামনে সেদিন সে কিছুই বলতে চায়নি। দুই চোখ তার জলে ভাসছিল আর ক্রমাগত শুধু ‘জয়বাংলা’ বলে আনন্দে চিৎকার করে যাচ্ছিল।
ইতিমধ্যে ভারতীয় জওয়ান আর বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। স্থলে একটার পর একটা ঘাঁটির পতন, আকাশে পাক বিমান ঘায়েল, সাগরে পাকিস্তানী যুদ্ধ জাহাজের সলিল সমাধি-ক্রমাগত এইসব চমকপ্রদ খবর আসছে।
১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকার কাছে পাকিস্তানের ১৬টি জঙ্গী বিমানই ধ্বংস করলাে। তাছাড়া ঢাকা বিমানবন্দরে এবং অন্যান্য স্থানে ভারতীয়

পৃষ্ঠা: ৪২
বৈমানিকেরা এমনভাবে বােমাবর্ষণ করলাে যাতে কোন নাগরিকের কোন ক্ষতি না হয়-শুধু সামরিক ঘাঁটি আর সরকারি বাড়িগুলােই তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল। আরাে লক্ষ্য ছিল -কত কম ক্ষতি করে ঢাকার দখল ত্বরান্বিত করা যায়। ইতিমধ্যে টিক্কা খান কোন রকমে প্রাণ বাঁচাতে পাকিস্তানে পালিয়ে গেলেন। পূর্ব রণাঙ্গণে পাক-বাহিনীর ভার নিলেন মেজর জেনারেল নিয়াজী।
ধীরে ধীরে সম্মিলিত ফৌজের যােদ্ধারা ঢাকার চারিদিক ঘিরে ফেললাে। পাকবাহিনীর পালিয়ে যাবারও কোন পথ রইলাে না।
ভারতীয় বাহিনী আর বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত ফৌজের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ম্যানেকশ অবিলম্বে আত্মসমর্পণের জন্য পাক সেনাদের উদ্দেশ্য আহ্বান জানিয়ে ঘােষণা করলেনঃ
“আমাদের সেনারা চারিদিক থেকে তােমাদের ঘিরে ফেলেছে। তােমাদের আর পালাবার পথ নেই। অবিলম্বে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করাে নতুবা চরম পরিণতির জন্য প্রস্তুত হও।” জেনারেল শ্যাম মানেকশার কণ্ঠে ঘােষিত সেদিনের সেই ইতিহাসের নির্দেশ –
“Time is running up too fast! Lay down your arms before it is too late! Indian Forces have encircled you. Your fate has been sealed. The Mukti Bahini and others fighting for liberation have encircled you. They are now prepared for taking revenge for the cruelities you have perpetuated! Now, for you, the only course is to lay down your arms to Indian Forces.”
অবশেষে এলাে সেই স্মরণীয় দিন ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন। ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে সূর্য তখন অস্ত যেতে বসেছে। পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনী আর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত ফৌজের সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিত সিং অরােরার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন ৭১ হাজার পাক সেনা নিয়ে পাক-বাহিনীর অধিনায়ক মেজর লেঃ জেনারেল নিয়াজী। চারিদিকে মুক্তির আনন্দে উল্লসিত বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। সে এক স্মরণীয় দৃশ্য। পরাজিত পাক-বাহিনীর বন্দী সৈনিকদের বিরুদ্ধে একদিকে প্রবল ঘৃণা ও ধিক্কার অপরদিকে বিজয়ী ভারতীয় সেনা আর বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে ঢাকায় জনতার সে কি উল্লাস!
অবশেষে এলাে সেই মুহূর্তটি। লেঃ জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলেন লেঃ জেনারেল অরাের কাছে। বন্দী হলাে ৭১ হাজার পাক সেনা। অবসান হলাে দীর্ঘ সংগ্রামের, হানাদার বাহিনী-মুক্ত হলাে স্বাধীন বাংলাদেশ।

পৃষ্ঠা: ৪৩
ভারতীয় সংসদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সম্মিলিত ফৌজের কাছে বিনা শর্তে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ সদস্যদের জানিয়ে ঘােষণা করলেন
“I have an announcement to make. The West Pakistan Forces have unconditionally surendered. [সদস্যদের উল্লাস] Dhaka is now a free capital of a free Country.”
উল্লাসে ফেটে পড়লাে সভাকক্ষ। বাঁধভাঙ্গা আনন্দের জোয়ার তখন সারা বাংলাদেশে। ঢাকা উল্লাস আর উচ্ছাসে প্লাবিত। ‘ভারত-বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ আমার দেশ তােমার দেশ বাংলাদেশ। ‘ভারত-বন্ধু জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। খুশীর জোয়ার এপারেও। মনে পড়ছে, এক ফাঁকে টেপ নিয়ে ছুটেছিলাম সল্টলেকের শরণার্থীর শিবিরে। সব দুঃখ-কষ্ট, স্বজনহারানাে বেদনার কথা ভুলে অসহায় মানুষগুলাে আগামী দিনের স্বদেশে ফেরার সম্ভাবনায় আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের লেঃ জেনারেল নিয়াজীকে বন্দী করে ঢাকা থেকে প্রথমে নিয়ে আসা হয় ভারতের পানাগড় বিমান ঘাঁটিতে। ঢাকা বিমান বন্দরে সেই সময় লেঃ জেনারেল নিয়াজীর একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, “আমি এখন বাতিল একশ’ টাকার নােট।” পশ্চিম পাকিস্তানে কিন্তু তখনও যুদ্ধ চলছে। এগিয়ে চলেছে ভারতীয় বাহিনী। শেষ আঘাত হানার জন্য তারা প্রস্তুত। পাকবাহিনী কোণঠাসা-মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলাে-এতদিন যারা প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষভাবে পাকিস্তানকে সাহায্য করে যাচ্ছিল—যারা এতদিন নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল তারা সবাই যুদ্ধ বিরতির জন্য ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে মরিয়া হয়ে উঠলাে। যাই হােক বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনুরােধ মেনে ভারত কয়েকদিনের মধ্যেই যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করলাে।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান তখনও পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে শেখ মুজিবের অবিলম্বে মুক্তির দাবি উঠলাে। বিপর্যস্ত পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত বিশ্ব জনমতের চাপে মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলাে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লণ্ডন হয়ে স্বদেশে ফিরবেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তাঁদের দুঃসময়ের সাথী ভারতকে তিনি ভুলতে পারেননি। তাই প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী গান্ধীর প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা জানাতে স্বদেশে ফেরার পথে নতুনদিল্লীতে তিনি থামলেন। নতুনদিল্লীতে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু সেদিন আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি। বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান বলেছিলেন,

পৃষ্ঠা: ৪৫
“I decided to stop at the historic capital of this great country on way to my Bangladesh. For, this is the least I could do to pay my personal tribute to the best friend of my people, the people of India and their government under the leadership of your magnificent Prime Minister, Mrs. Indira Gandhi. She is not only the leader of our men, but also mankind, who all have worked spontaneously and friendly to make my journey possible, the journey from the darkness to the light, from captivity to the freedom, from desolation to hope, and at last going back to my ‘SONAR BANGLA”.
তিনি আরাে বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি সেকুলারিজমে-আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে –আমি বিশ্বাস করি সােসালিজমে। আমাকে প্রশ্ন করা হয়-শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শে এত মিল কেন? আমি বলি—এটা আদর্শের মিল -এটা নীতির মিল-এটা মনুষ্যত্বের মিল-এটা বিশ্ব শান্তির মিল। আমি কিছুটা আজ ইমােশনাল … আপনারা বুঝতে পারেন আপনারা আমায় ক্ষমা করবেন। আবার আপনাদের ধন্যবাদ দিয়ে আমি বিদায় নিচ্ছি। জয় বাংলা, জয় হিন্দ-জয় ইন্দিরা গান্ধী।”
এর আগে-ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, তাঁর স্বাগত ভাষণে বলেন, “হামনে ইয়ে ভারত নে ভি তিন ওয়াদা কিয়ে থে আপনে জনতা সে। পহলে তাে শরণার্থী ইহা আয়ে হ্যায় ও সব ওয়াপস যায়েঙ্গে-দুস, ইয়ে হাম হর তরে সে মুক্তিবাহিনী কি সহায়তা করেঙ্গে-ঔর তিসরে শেখ সাহাব কো হামনে জরুর ছােড়ায়াঙ্গে জেল সে। হামনে ভি তিননা ওয়াদা পুরা কর দিয়া, ঔর আব শেখ সাহাব যা রহা হ্যায় আপনা পরিবার কে পাস, আপনি পেয়ারী জনতাকে পাস এক বড়ী চুনটিকো সামনা করনে। আপনা ইস জনতাকো ইসকো এক নয়া দেশ বানানাএক মজবুত দেশ বানানা-এক প্রগতিশীল দেশ বানানা যাহা ধর্মনিরপেক্ষতা, লােকতন্ত্রকে আদর্শ সদা উঁচে রহেঙ্গে। তাে অব উনি কি আপ সবকো তরফ সে উনকা স্বাগত করতি হু। ঔর দিল সে উননা সে বহুত হার্দিক শুভকামনায় আপকে তরফ সে উনকো-উনকো পরিবারকো বাংলাদেশকে ভবিষ্যকে লিয়ে দেতি হু। জয় বাংলা। অন্ধকার থেকে আলােয় ফিরে বঙ্গবন্ধু ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে, স্বদেশবাসীর সামনে হাজির হয়ে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার কিছু অংশও এখানে তুলে ধরার লােভ সামলাতে পারছি না। তার স্বপ্নের সােনার বাংলার মানুষের প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা, ভালােবাসা আর অগাধ বিশ্বাস। সমস্ত রকম ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সবার উপর মানুষ সত্য এই আদর্শকে সামনে রেখে এক নতুন বাংলা

পৃষ্ঠা: ৪৫
গড়ে তােলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। লাখাে লাখাে মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালােবাসায় অভিভূত বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন-
“আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারবাে না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছেন আমি তাদেরকে বলতে চাই আমি ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম যে আমার বাঙালীকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমার বাংলার মানুষ স্বাধীন হবেই। আমার যে সব ভাই আত্মবলিদান করেছে, শহীদ হয়েছে তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। আজ আমার বাংলার প্রায় বিশ লক্ষ লােককে মেরে ফেলেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ও প্রথম মহাযুদ্ধেও এত লােক মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই। আমি জানতাম না আপনাদের কাছে ফিরে আসবাে। আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম তােমরা যদি আমাকে মেরে ফেল ফেল আপত্তি নাই। মৃত্যুর পরে আমার লাশটা আমার বাঙালীর কাছে দিয়ে দিও এই একটা অনুরােধ করেছিলাম। আমি মুবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে। আমি মুবারকবাদ জানাই ভারতের সামরিক বাহিনীকে, আমি মুবারকবাদ জানাই ভারতের জনসাধারণকে, আমি মুবারকবাদ জানাই রাশিয়ার জনসাধারণকে, আমি মুবারকবাদ জানাই ব্রিটিশ, জার্মানি, ফ্রান্স এসব জায়গার জনসাধারণ ও গভর্নমেন্টকে। আমি মুবারকবাদ জানাই আমেরিকার জনসাধারণকে। আমি মুবারকবাদ জানাই বিশ্বদুনিয়ার জনসাধারণকে যারা আমার এই মুক্তির সংগ্রামকে সাহায্য করেছেন। আমার বলতে হয় এক কোটি লােক এই বাংলাদেশ থেকে ঘর বাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের জনসাধারণ, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাদের খাবার দিয়েছে থাকার জায়গা দিয়েছে। তাকে আমি মুবারকবাদ না দিয়ে পারি না। তবে মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে, বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। বাংলার মধ্যে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি বলেছিলাম যাবার আগে বাঙালী এবার তােমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবার তােমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। তােমরা পেরেছে। আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করাে তােমরা ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করে সংগ্রাম করেছে। আমি আমার সহকর্মীদের মুবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই, আমার বহু কর্মী আমার বহু মা বােন আজ দুনিয়ায় নাই। তাদের আমি দেখবাে না। আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়া অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি প্রণাম জানাই। আমার সােনার বাংলা তােমায় আমি বড় ভালােবাসি। বােধ হয় তার জন্য আমায় আবার ডেকে নিয়ে এসেছ। আমি আশা করি-দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আবেদন-আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট

পৃষ্ঠা: ৪৬
নাই, আমার খাবার নাই, আমার মানুষ গৃহহারা সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারী। তােমরা আমার মানুষকে সাহায্য কর। মানবতার খাতিরে তােমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তােমরা recognise করাে। সঙ্গে কাজ দাও। দিতে হবে উপায় নাই দিতে হবে। আমরা হার মানবাে না আমরা হার মানতে চাই না। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে বঙ্গজননী রেখেছে বাঙালী করে মানুষ করনি’। কবি গুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালী আজ মানুষ। আমার বাঙালী আজ দেখিয়ে দিয়েছেদুনিয়ার ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রামে এত লােক আত্মাহুতি, এত লােক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। আজ থেকে আমার অনুরােধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসাবে নেতা হিসাবে নয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয় আমি তােমাদের ভাই, তােমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ, মা-বােনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার যুবক শ্রেণী চাকরি না পায় বা কাজ না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ, কর্মীবাহিনী তােমাদের মুবারকবাদ জানাই।
তােমরা রক্ত দিয়েছে, রক্ত বৃথা যাবে না। একটা কথা বাংলায় যেন আজ থেকে চুরি ডাকাতি না হয়, বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। অন্য দেশের লােক পশ্চিম পাকিস্তানের লােক বাংলায় কথা বলে না। আজ বলছি তােমরা বাঙালী হয়ে যাও। আর আমি আমার ভাইদের বলছি তাদের উপর হাত তুলনা। আমরা মানুষ, আমরা সবাই এক।”
আজ অবসর জীবনে অনেক সময়ে বসে বসে ভাবি চেঙ্গিস খানকেও লজ্জা দেয়া পাক-বাহিনীর অমানুষিক অত্যাচার আর বর্বরতার কাহিনী ভারতের বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার মানুষকে কতটা গভীরভাবে আলােড়িত করেছিল সেদিন। মানবকিতার এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত রেখে এ দেশের প্রতিটি মানুষ সেদিন দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের পাশে। রাজনীতি, ভাষা, ধর্ম-সমস্ত ব্যবধান, সব ভেদাভেদ ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে গেল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতীয় সংহতি অক্ষুন্ন রাখার আবেদন তাে তেমন ভাবে প্রচার করতে হয়নি-সেদিন আয়ােজন করতে হয়নি কোন মিছিল অথবা আলােচনা সভার। কোন্ অদৃশ্য যাদু বলে আমরা সেদিন জাতি ধর্ম বর্ণের সংকীর্ণ গন্ডিকে অতিক্রম করে মানবিকতার জয়-পতাকাকে তুলে ধরতে পেরেছিলাম। সগর্বে ঘােষণা করতে পেরেছিলাম আমরা সবাই মানুষ, মনুষ্যত্বই আমাদের প্রথম এবং প্রধান পরিচয়।
ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমরা সেদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলাম। দুই দেশের অগণিত শহীদের মিলিত রক্তে যে মৈত্রীবন্ধন গড়ে উঠেছে ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে, বিশ্বের

পৃষ্ঠা: ৪৭
কোন শক্তিই তাকে কোনদিন ছিন্ন করতে পারবে না এই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়েই আমরা বেঁচে থাকতে চাই।
বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের জন্ম। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের বাণীকে আশ্রয় করেই একটি রাষ্ট্রের আবির্ভাব। বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশের অভ্যুত্থান এক বিস্ময়কর অধ্যায়, এক রােমাঞ্চকর ঘটনা, এক অনন্য নজীর।
পরবর্তীকালে দু’দশক পরে কোন এক ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ যুদ্ধের বিজয় উৎসব উপলক্ষে দূরদর্শনের জন্য একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রযােজনার কাজে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সেই অনুষ্ঠানের জন্য বেশ কয়েকজনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে হয়েছিল। তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা বােধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা-“It was an exciting scene! The whole Bangladesh were full of joy. They were overjoyed for rescuing them from invaders. We are very much satisfied that we are able to do something for liberating Bangladesh”.
বাংলাদেশ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আর এক ভারতীয় সেনা কর্নেল সব্যসাচী মুখার্জী-
“আমরা যে ভিন্ন দুটি দেশ সেটা আমাদের সেদিন মনে হয়নি। আমরা যুদ্ধ করতে যখন বাংলাদেশে গেছি তখনও মনে হয়েছে যে আমরা আমাদের দেশের জন্যই যুদ্ধ করছি। আবার বাংলাদেশের মানুষও অন্তত সেদিন মনে করেনি আমরা ভিন্ন দেশের সৈনিক। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ আমাদের কাছে ছিল এক বিরাট সমস্যা। যুদ্ধ যত কম সময়ে পাক বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে এক কোটি শরণার্থী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বদেশে ফেরৎ পাঠানাের ব্যবস্থা করাই ছিল আমাদের প্রধান লক্ষ্য।”
Lt. Col. S. Mukherjee-র জন্মস্থান ছিল ঢাকা বিক্রমপুর। তাই বাংলাদেশের স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে তিনি নিজেদের সেই ভাষাতেই কথা বলতেন।
“নিজেদের ভাষায় যখন আমি ওদের সঙ্গে কথা বলতাম ওরা তখন চিৎকার করে বলতাে- “আমাগাে মানুষ আইছেরে আমাগাে মানুষ আইছে।” স্বভাবতই আবেগে আপুত Lt. Col. Mukherjee বললেন –
“ভারতীয় বাহিনীকে যেভাবে ওরা স্বাগত জানিয়েছিল তার তুলনা হয় না। তাদের আশা স্বপ্ন পূরণে আমরা সাহায্য করতে গিয়েছিলাম। তাই তারা আমাদের ভাই-এর মতাে বুকে টেনে নিয়েছিল। আমরা তাে পাক-বাহিনীর মতাে উপনিবেশ গড়তে যাইনি।”
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর তখনকার Inspector General শ্রী গােলকবিহারী মজুমদার-
“দুই দেশের সেনারা সেদিন ঐক্যবদ্ধ কাজ করেছে। ডক্টর ত্রিগুণা সেন এবং অন্যান্য অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সেদিন ত্রাণকার্যে সাহায্য করতে

পৃষ্ঠা: ৪৮
এগিয়ে এসেছিলেন। একটি লােকও সেদিন অনাহারে মরেনি, কোন সংক্রামক ব্যাধিতে কেউ মরেনি। সবার ঐকান্তিক সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না।”
বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রী অমিতাভ চৌধুরী “মার্চ মাসে রমনা ময়দানে মুজিবের ভাষণ শুনে আমরা শিহরিত হয়েছিলাম। মুজিব বলেছিলেন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােল। শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয় আমরা যারা এপারে ছিলাম তারাও প্রত্যেকেই ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিলাম। ঘরের কাছে এই যুদ্ধ আর কোন দিন দেখিনি। ৯০ লক্ষ শরণার্থী শুধু ত্রাণশিবিরেই নয় এপারের প্রত্যেক ঘরেই ওপারের শরণার্থীরা সেদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন।”
আর এক প্রখ্যাত সাংবাদিক বরুণ সেন গুপ্ত-“সেদিন ছিল বিরাট উন্মাদনা। এই যুদ্ধের ফলে আমাদের হাজার হাজার সেনা প্রাণ দিয়েছিলেন। অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু সবাই হাসি মুখে সব মেনে নিয়েছিল। কারণ তারা বুঝেছিল এই মুক্তিযুদ্ধে এক নতুন রাষ্ট্র, এক নতুন বাঙালী জাতির জন্ম হচ্ছে। যাদের সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে।”
১৯৭১ থেকে ২০০০ দীর্ঘ ২৯ বছর আমরা পেরিয়ে এসেছি। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম প্রগিতশীল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত, অভিনন্দিত। আমরা যারা এই দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অথবা পরােক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম তারা বাংলাদেশের যে কোন সাফল্যে-তা সংস্কৃতি, শিক্ষা, ক্রীড়া অথবা রাজনীতি যেকোন অঙ্গনেই হােক-গর্ব অনুভব করি। কিন্তু হতাশ হতে হয় তখন যখন আমাদের দুই দেশের কিছু কিছু মানুষের কাছে সময় সময় অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন এপারের অনেকে প্রশ্ন করেন, “কি লাভ হলাে আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশীদার হয়ে? কেনই বা আমরা বাংলাদেশের জন্য এত রক্ত দিলাম?” কেউ কেউ আবার দুঃখ করে বলেন, “ওরা তাে অনেকে আজ স্বীকারই করতে চায় না যে ওদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কোন অবদান আছে।”
আমার তাে মনে হয় কোন স্বীকৃতি লাভের জন্য তাে ভারত সেদিন লড়েনি। আমরা তাে একটা অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইতে ওদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। সেদিক দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে মানবতার জয়পতাকাকে আমরা সগৌরবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছি।
আবার ওপারের অনেককে মন্তব্য করতে শুনেছি, “ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে নিজের স্বার্থে-পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই। কেউ কেউ আবার বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয়ী হতাে। পাকবাহিনী বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের লজ্জা এড়াতেই ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।”

দ্বিতীয় অধ্যায়

স্মৃতি তুমি বেদনা

বিশিষ্ট সাহিত্যিক অচিন্ত্য সেনগুপ্তের একটি সাক্ষাৎকার নিতে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। সাক্ষাৎকার রেকর্ড করার পর উনি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, “উপেন বাবু, আপনি ডাইরি লিখে রাখেন?” খানিকটা হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি “কেন বলুন তাে?” উনি হেসে সেদিন বলেছিলেন, “না, আপনার কর্মজীবনে, সমাজের নানা স্তরের মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আপনার এইসব বিচিত্র অভিজ্ঞতার বিবরণ লিখে রাখলে, ভবিষ্যতে মহামূল্যবান সম্পদে পরিণত হতে পারে।” সেদিন অচিন্ত্য বাবুর এই কথায় তেমন গুরুত্ব দেইনি।
দীর্ঘ চল্লিশ বছর বেতার ও দূরদর্শনে কাটিয়ে যখন অবসর জীবন যাপন করছি, তখন কিন্তু মনে হয় সত্যিই ভুল হয়ে গেছে। আজ কর্মজীবনের বহু স্মৃতি, বহু ঘটনা মাঝে মাঝে মনকে দোলা দেয়। কিন্তু বিস্মৃতির পাতায় অনেক ছবিই ঝাপসা হয়ে এসেছে। দিনক্ষণ, সময়, নামধাম স্পষ্টভাবে তেমন মনে পড়ে না। সেদিনের রােমাঞ্চকর উত্তেজনাময় দিনগুলির টুকরাে টুকরাে স্মৃতি মাঝে মাঝে এসে মনের মধ্যে ভিড় করে। আমি যখন আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সংবাদ বিচিত্রার প্রযােজনার দায়িত্বে ছিলাম, তখনতাে আমাদের দেশে দূরদর্শন আসেনি। প্রথমদিকে সংবাদ বিচিত্রা’ই ছিল বাইরে থেকে রেকর্ড করে আনা একমাত্র অনুষ্ঠান। স্বভাবতই এর জনপ্রিয়তা ছিল ভীষণ। আর সেইজন্যই বাইরে থেকে রেকর্ড করে আনা, নানা বিষয়ের উপর সাজানাে, এই সংবাদ ভিত্তিক অনুষ্ঠান তৈরিতে ছিল আমার সৃষ্টির উন্মাদনা, আনন্দ। প্রাকৃতিক বিপর্যয় হােক, দুর্ঘটনা অথবা উৎসব আনন্দের মুহূর্তই হােক, আর খেলার মাঠের উত্তেজনাময় পরিবেশই হােক, সবকিছুকে নিয়ে ফুলের ডালি সাজিয়ে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিল এক রােমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সারাদিনের নানা ঘটনাবলী, স্পট থেকে রেকর্ড করে আনা শব্দচিত্র সাজানাে এই সংবাদ শােনবার জন্য রাত দশটা পনেরাে মিনিটে অগণিত শ্রোতা রেডিও খুলে অপেক্ষা করতেন। সর্বশেষ সংবাদের বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরবার জন্য আমাদের সব সময় ঘড়ির কাঁটার পেছন পেছনই ছুটতে হতাে। অনেক সময় এমন হয়েছে, রাত নটায় রেকর্ডিং করে ফিরেছি, স্টুডিওতে ঢুকে টেপে পাঁচ মিনিটের প্রােগ্রাম করে, তিনটি ভাগে পনেরাে মিনিটের এই অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য ঘােষকের হাতে পৌঁছে দিয়েছি। কাজের প্রতিটি মুহূর্তে ছিল উত্তেজনা, রােমাঞ্চ আর আনন্দে ভরা। আর তাই চল্লিশ বছরের কর্মজীবনে কখনাে কোনাে ক্লান্তি অনুভব করিনি।
আমি আকাশবাণীর সংবাদ বিভাগে প্রথম যােগদান করি ১৯৫৪ সালে। তখন এক নম্বর গাষ্টিন প্লেসে ছিল আকাশবাণীর কোলকাতা কেন্দ্র। আমাদের দিয়েই শুরু হয় আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্র বাংলার স্থানীয় সংবাদ। আমার মনে আছে, সংবাদ পাঠক হিসেবে তখন যােগদান করেছিলেন আজকের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অবশ্য কয়েকমাস বাদেই তিনি সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করার জন্য নির্বাচিত হওয়ায় আকাশবাণী ছেড়ে দেন। সন্ধ্যা ৭-১৫ মিনিটে প্রচারিত ঐ স্থানীয় সংবাদ বিভাগে, শুরুতে আর যারা আমার সহকর্মী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট বেতার সাংবাদিক নির্মল সেনগুপ্ত আর বার্তা সম্পাদক বিভূতি বসু। অবশ্য আকাশবাণীর সেদিনের অন্যান্য জনপ্রিয় নামের মধ্যে ছিলেন, শিশু মহলের ইন্দিরাদি, মহিলা মহলের বেলাদি, গল্পদাদুর আসরের জয়ন্ত চৌধুরী, সঙ্গীত বিভাগে পঙ্কজ মল্লিক, দক্ষিণা মােহন ঠাকুর, নাট্য বিভাগের বীরেনদা অর্থাৎ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ দ্র, শ্রীধর ভট্টাচার্য, বাণী কুমার এমনি অনেকে। আসলে এঁরা ছিলেন শ্রোতাদের কাছে আজকের ফিল্মী দুনিয়ার তারকাদের মতােই এক-একটি উজ্জ্বল নাম। স্বভাবতই এতগুলাে জনপ্রিয় তারকার সান্নিধ্যে কাজ করার সুযােগ পেয়ে আমার ছিল আলাদা এক অনুভূতি।
গাষ্টিন প্লেসে যে বছর আমরা ছিলাম তেমন করে বলার মতাে, কিছু মনে নেই। আসলে আমাদের সংবাদ বিভাগটির সবে শুরু হলাে। আর তাই অন্যান্য বিভাগ থেকে আমাদের কিছুটা দূরত্ব যেন ছিল। তাছাড়া সেদিন ১৮ বছরের তরুণের কাছে আকাশবাণীর স্টুডিও ছিল এক স্বপ্নের জগৎ। নামীদামী শিল্পীদের আনাগােনায় সদাচঞ্চল ঐ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলাের সান্নিধ্যে যাবার ইচ্ছে থাকলেও সাহস তেমন ভাবে হয়নি সেদিন। তবু এরই মধ্যে দুটি ঘটনা আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে। ঘটনা দুটি যদিও সামান্য তবুও পাঠকদের জানাবার লােভ সামলাতে পারলাম না। আমাদের সংবাদ কক্ষটি ছিল তিন তলার এক কোণে। ঘরটির পেছনেই ছিল ছােট্ট ব্যালকনির মতাে আর তার ঠিক নিচেই বিশাল এক কবরখানা।
কবরখানার দৌলতেই কিনা জানিনা, আকাশবাণীর পোঁছবার কিছুদিন পরেই ভূতুড়ে নানা কাহিনী, বিশেষ করে সাহেব ভূতদের গল্প আমার কানে এলাে। সেদিনের বুলেটিন প্রচারের দায়িত্ব ছিল সংবাদ বিভাগের। যেহেতু আমাদের কোলকাতা এবং হাওড়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে হতাে, তাই আমাদের রাত তিনটে থেকেই অফিসের গাড়ি করে তুলে আনা হতাে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাকে সেদিন প্রথম তুলে এনে রাত তিনটেয় পৌঁছে দেয়া হলাে আকাশবাণীতে। আমাকে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি

পৃষ্ঠা: ৫২
চলে গেল হাওড়ায়, আর এক সহকর্মীকে আনতে। আমিতাে শীতের রাতে সেই ভূতুড়ে বাড়ির তিন তলায় আমাদের নির্দিষ্ট ঘরটিতে গিয়ে চুপচাপ বসলাম। চারিদিকে নিস্তব্ধতা, শুধু দেওয়াল ঘড়িতে ‘টিকটিক’ একটানা শব্দ। মনে যতই সাহস আনবার চেষ্টা করি, ততই বারেবারে আমার চোখ দুটি চলে যায় নিচের গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা কবরখানার দিকে। মাঝে মাঝে শুনতে পাই, ঘরের বাইরে একাধিক মানুষের পদচারণার শব্দ। শরীর ক্রমশ অবশ হয়ে আসে। হঠাৎ শুনতে পাই ঘরের মধ্যে পিয়ানাের টুং টাং মিষ্টি আওয়াজ। আমি আগেই শুনেছিলাম সাহেব ভূত নাকি মাঝে মাঝেই স্টুডিওতে এসে বেশী রাতে পিয়ানাে বাজাতে ভালবাসেন। পিয়ানাের টুং টাং আওয়াজ শুনে তখন আমার কোনাে ইন্দ্রিয়ই কাজ করছে না। অকস্মাৎ ঘরের মধ্যে কাদের যেন ফিস্ ফাস্ আওয়াজ শুনতে পাই। চেতনা ফিরে পেলাম সহকর্মীর ডাকে। হাওড়া থেকে তাকে ততক্ষণে তুলে আনা হয়েছে।
বেশ কিছুদিন আমি সেদিনের ঘটনার কোনাে যুক্তি খুঁজে পাইনি। কাউকে এনিয়ে কোনাে প্রশ্নও করিনি। পরবর্তী সময়ে এই ঘটনার কার্যকারণ আমি খুঁজে পেয়েছি।
প্রভাতী অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে ইঞ্জিনিয়ার সহকর্মী বন্ধুরা স্টুডিও পরীক্ষানিরীক্ষা করে যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক আছে কিনা দেখেন। তাদেরই কেউ হয়তাে পিয়ানাে বাজানাের লােভ সামলাতে পারেননি আর ফিসফাস্ আলােচনা তাঁদেরই মধ্যে। আমাদের সংবাদ কক্ষের মধ্যে ছিল একটি স্পিকার সেট। ইঞ্জিনিয়ার সংযােগ করে দিলে, আমরা সংবাদ বুলেটিন অথবা স্টুডিওতে অনুষ্ঠিত যাবতীয় কর্মকান্ড ঐ স্পিকারের মাধ্যমে শুনতে পেলাম। ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুরা সেদিন ভুল করে বুলেটিন চালু হবার আগেই আমাদের স্পিকারের সংগে কানেকশন্ দিয়ে দিয়েছিলেন। তাতেই হয়ত এই ভূতুড়ে বিপত্তি।
গাষ্টিন প্লেসের আরাে একটি ঘটনা আমি আজও ভুলিনি। সেদিন দুপুরে দোতলায় আমি আকাশবাণীর জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ঘরে বসে আছি। এমন সময় সেই ঘরের দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। কর্মকর্তাটি আমার সঙ্গে আলােচনা বন্ধ করে গম্ভীর মুখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ শােনা গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে উনি হুঙ্কার ছাড়লেন, “কাম ইন”। ফাইল বগলদাবা করে একজন ভীত সন্ত্রস্ত কর্মী ভিতরে ঢুকে নীরবে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। এবার তিনি ধমক দিয়ে বললেন, শ্যামবাজারের ষাঁড়ের মতাে দরজায় এসে গুতান ক্যান্? কাম্ থাকলে ঢুইক্যা যাইতে পারেন না? কর্মী ছেলেটি কাচুমাচু হয়ে তার সম্মতি জানিয়ে ফাইলে কী সই করিয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি ভাবলাম এতবড় কর্মকর্তার কাছে কাজের জন্য সকলের অবারিত দ্বার। মনটা প্রসন্ন হলাে আকাশবাণীর মতাে জায়গায় এই উদার মনােভাবই দরকার। ভবিষ্যতে আতঙ্কিত হয়ে কাজ করবার প্রয়ােজন নেই ভেবে আশ্বস্ত হলাম। হায় ভগবান! দুদিন পরের ঘটনা। একই কর্তার

পৃষ্ঠা: ৫৩
ঘর। আগন্তুকও সেই কর্মী। আর আমিও সেইদিনের মতাে ঘরে উপস্থিত। সেই ছেলেটি সেদিনের মতাে দরজায় ঠক্ ঠক্ না করে সরাসরি ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন। কর্তাটি কড়া দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বিগলিত হাসি হেসে বললেন, ‘আসেন, আমার পাশে এই সােফাটায় বসেন। ছেলেটি হকিয়ে গিয়ে কিছু না বুঝতে পেরে দাঁড়িয়ে রইলাে। এবার তিনি হুক্কার ছাড়লেন। “একবার নক্‌ কইর ্যা ঢুকতে পারেন না? অফিসের নিয়মকানুন কিছুই জানেন না দ্যাখতাচি।” ছেলেটি নীরবে চলে গেল। এবার তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলে উঠলেন, এইসব ছেলেপুলে লইয়া অফিস চালানাে যায়? সমর্থন অথবা প্রতিবাদ কি করা উচিত বুঝতে না পেরে, চুপ করে থাকাই সঙ্গত মনে করলাম। এটি অবশ্যই একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র। কিন্তু পরে দেখেছি কাজের দিক থেকে এই কর্তাটি যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। তাঁর রসজ্ঞানও ছিল প্রচুর। আমরা তখন আকাশবাণীতে সবাই একটি পরিবারের মতােই থাকতাম। সৃষ্টিধর্মী কাজের প্রয়ােজনের জন্যই হােক অথবা তখনকার পরিবেশের জন্যই হােক, আমরা শুধু পেশাগত কারণে নয়, পরস্পরের প্রতি ভালােবাসার টানে এক আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম। কয়েকবছর পর আমরা ইডেনে নবনির্মিত আকাশবাণী ভবনে চলে এলাম। এখানে এসে ধীরে ধীরে আমাদের কাজের পরিধি বেড়ে গেল। স্টুডিওতে নিজের হাতে কিছু সৃষ্টি করার স্বপ্ন এতদিন দেখে এসেছিলাম তা সফল হলাে। আমি ধীরে ধীরে সংবাদ বিচিত্রা’ প্রযােজনার দায়িত্ব পেলাম।
‘সংবাদ বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানটি তৈরি সম্পর্কে মােটামুটি একটা ধারণা দেওয়া যাক। যে কোন উল্লেখযোেগ্য ঘটনা, তা আনন্দেরই হােক আর বিষাদেরই হােক-যেখানে ঘটেছে বা ঘটছে, সেখানে টেপ রেকর্ডার নিয়ে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ছুটে যেতে হতাে। সেখানে গিয়ে ঘটনার প্রয়ােজনীয় শব্দচিত্র, কিছু কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার, তাঁদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি রেকর্ড করে ফিরে আসতে হতাে স্টুডিওতে। যাতে ঘটনাটির একটি বাস্তব ছবি তুলে ধরা যায় শ্রোতাদের কাছে। স্বভাবতই বেশীর ভাগ সময়ে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে, কিছুটা পরিকল্পনা মাথায় রেখে ঘটনাস্থলে যেতে পারতাম। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই হঠাৎ মাইক হাতে ছুটতে হতাে ঘটনাস্থলে। যেমন কোন দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় অথবা কোনাে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের আকস্মিক মৃত্যু। আগেই বলেছি, তখন তাে দূরদর্শন চালু হয়নি, আর প্রথম দিকে বেতারেও বাইরে থেকে রেকর্ড করে আনা বিভিন্ন বিষয়ের উপর তৈরি অনুষ্ঠান বলতে ছিল একমাত্র “সংবাদ বিচিত্রা” আর সেইজন্যই এই অনুষ্ঠানের কাছে শ্রোতাদের দাবী ছিল অনেক। সেই দাবী মেটানাের জন্য আমাদের সদা-সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হতাে। প্রস্তুত থাকতে হতাে যাতে ঘটনাস্থলে যত তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারি। কারণ বিপর্যয় বা দুর্ঘটনার সেই মুহূর্তের পরিবেশ, স্থানীয় মানুষের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, এইসব বাস্তব ছবিটি তুলে ধরার পক্ষে অত্যন্ত প্রয়ােজনীয়। বিলম্বে অনেক কিছু হারিয়ে যায়। মানুষের আবেগ, উত্তেজনা অনেকটা থিতিয়ে যায়। আর এই আবেগ উত্তেজনার

পৃষ্ঠা: ৫৪
টুকরাে টুকরাে ছবি দিয়ে যত বেশী অনুষ্ঠানটি সাজানাে যাবে, ততবেশী শ্রোতাদের মনকে নাড়া দেওয়া সম্ভব হবে। এক কথায় শ্রোতাদের সেই ঘটনাস্থলে বেতারের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস, যাতে তারা অনুষ্ঠানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েন।
মনে পড়ে, আসানসােলের কাছে রতিবাটি কয়লাখনির দুর্ঘটনার কথা। সেদিন বিকেলে অফিসে পৌঁছেই এক নাটকীয় সংবাদ পেলাম, কিছুদিন আগে রতিবাটি কয়লাখনিতে আকস্মিক এক দুর্ঘটনায় বেশ কিছু শ্রমিক কর্মরত অবস্থায় জলপ্লাবিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। কিছু শ্রমিকের মৃতদেহ উদ্ধার করা গেলেও কায়েকজনের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। ধরেই নেওয়া হয়েছিল তারা বেঁচে নেই। কিন্তু প্রায় সপ্তাহ তিনেক বাদে আকস্মিকভাবে সেই বিধবস্ত খনির নিচে প্রাণের সন্ধান পাওয়া গেছে।
বাড়িতে বলা নেই, তৈরি হয়েও আসিনি অথচ সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়। টেপ রেকর্ডার নিয়ে ছুটলাম দুর্ঘটনাস্থলে। পৌঁছে শুনলাম, বেশ কয়েকজন শ্রমিক কয়লা খনির ১৫০/ ২০০ ফুট নিচে তখনাে জীবিত আছেন। তাঁদের সেখান থেকে উদ্ধার করার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। রাতে কয়লাখনির নিচে নামবার অনুমতি পেলাম না।
পরদিন সকালে খনির নিচে নির্দিষ্ট এলাকাতে পৌঁছেই জীবনের এক রােমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হলাে। সেই নিখােজ শ্রমিকদের কয়েকজন তখনাে জীবিত আছে বলে সন্ধান পাওয়া গেছে এবং তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করা সম্ভব হয়েছে। যােগাযােগের একমাত্র মাধ্যম হলাে ৬০/৭০ ফুট দীর্ঘ এ্যালুমিনিয়ামের পাইপ। জানা গেল, বিধ্বস্ত ঐ এলাকায় কোনােক্রমে একটি এয়ার পকেটের সৃষ্টি হয়েছে এবং সেই খানেই ঐ হতভাগ্য কয়েকজন শ্রমিক বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়িয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন। সরু একটি পাইপ ঢুকিয়ে প্রথমে ঐ এয়ার পকেটের জীবিত মানুষগুলির সন্ধান পাওয়া গেছে। পরে অপেক্ষাকৃত আরাে একটি মােটা পাইপ সেখানে ঢুকিয়ে সেই অসহায় মানুষগুলােকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঐ পাইপের মধ্য দিয়ে দড়ির সাহায্যে বােতলে পানীয় জল, শুকনাে রুটি পাঠানাে হচ্ছে এবং যােগাযােগ রক্ষা করা হচ্ছে। বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ঐ মানুষগুলাের মানসিক অবস্থার কথা একবার ভাবুন। গভীর অন্ধকারে এক টুকরাে ঐ ফাঁকা জায়গা, হাটুজলে দাঁড়িয়ে তাঁরা একদিন নয়, দুদিন নয় দীর্ঘ ১৯ দিন অনিশ্চয়তা আর আতঙ্কে দিন কাটিয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে তাদের সামনে মৃত্যুর হাতছানি। কারণ যে কোনাে মুহূর্তে ধসে চাপা পড়ে চিরদিনের জন্য সমাধি হতে পারে। আমি যখন সেখানে গেলাম তখন উদ্ধারকারীদলের একজন পাইপের মধ্য দিয়ে মৃত্যু গহ্বরে আটকে পড়া শ্রমিকদের সংগে কথা বলছেন। সময় নষ্ট না করে টেপ রেকর্ডার চালিয়ে দিলাম। এপার থেকে একজন আটকে পড়া শ্রমিকদের মনােবল ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করছিলেন এবং তাদের কি কি প্রয়ােজন জানতে চাইলেন। এবার ওপার থেকে পাইপের মধ্য দিয়েই ভেসে এলাে শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর। তারপর ঐ পাইপের মধ্য দিয়েই সুতাের সাহায্যে প্রথমে শুকনাে রুটি পরে বােতলে পানীয়

পৃষ্ঠা: ৫৫
জল তাদের কাছে পৌছে দেওয়া হলাে। সবকিছুই আমার টেপ রেকর্ডারে ধরে রাখলাম। এইভাবে যখন একদিকে হতভাগ্য শ্রমিকদের কোনক্রমে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করা হচ্ছে, অপরদিকে উদ্ধারকারী দলের কয়েকজন মাত্র একটি শাবলের সাহায্যে গর্ত খুঁড়ে ওদের কাছে পৌছাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এছাড়া অন্য কোনাে উপায়ও ছিলনা। কারণ ভয় ছিল যে কোনাে সামান্য আঘাতে আবার ধস নেমে ঐ আটকে পড়া শ্রমিকেরা চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতে পারেন। খনির নিচে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ঐ শ্রমিকদের বাঁচিয়ে আনার সেই মরণপণ লড়াইয়ের রােমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আমি জীবনে ভুলবাে না।
অবশেষে এলাে উত্তেজনার সেই চরম মুহূর্ত। শাবলের সাহায্যে সেই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে একে একে বের করে আনা হলাে কয়েকজন অর্ধমৃত শ্রমিককে। সেই মুহূর্তে তাদের কথা বলার মতাে অবস্থা ছিলনা। আর স্বাভাবিক কারণেই উপস্থিত চিকিৎসকরা সে অনুমতিও দেননি। কিন্তু পরে হাসপাতালে শুনেছিলাম তাঁদের সেই অনিশ্চয়তায় ভরা দিনগুলির কথা। আকস্মিক বিপর্যয়ে হঠাৎই তারা আবিষ্কার করেছিলেন বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। চারদিকে শুধু গাঢ় অন্ধকার। একফালি জায়গায় হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য নির্বাসিত কয়েকজন মানুষ। এভাবে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটির নিচে তাঁরা ১৯ দিন কাটিয়েছেন। ঐ সময় তাদের সাথে খাবার এবং পানীয় জল ছিল না। তবে তাঁরা বলেছিলেন ঐ সময় বাচার তাগিদে পায়ের নিচের জল থেকে জেলি জাতীয় মাছ ধরে কাঁচা খেতেও বাধ্য হয়েছিলেন। খনির নিচে কয়েকটি অমূল্য জীবনকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে আনার সেই অসাধারণ লড়াইকে আমি সেদিন তুলে এনে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করেছিলাম বেতারের মাধ্যমে। মনে পড়ে, সংবাদ বিচিত্রা’র সেদিনের সেই অনুষ্ঠান নিয়ে অসংখ্য শ্রোতা যেমন টেলিফোনে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, সংবাদপত্রেও তেমনি খনির নিচে থেকে শ্রমিকদের উদ্ধারের জীবন্ত ছবি প্রচারের জন্য প্রশংসা করা হয়েছিল। আর এখানেই তাে আমার সত্যিকারের তৃপ্তি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, এই নাটকীয় ঘটনার ভিত্তিতে রচিত একটি নাটক পরে বহুদিন সাফল্যের সঙ্গে রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয়েছিল।
খনি দুর্ঘটনার কথা বলতে গিয়ে আমার মনে পড়ছে ধানবাদের কাছে চাসনালা কয়লাখনিতে পরবর্তী আর একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথা। এই দুর্ঘটনায় যতদূর মনে পড়ছে পাশের কোনাে জলাশয় থেকে প্রচন্ড বেগে জল ঢুকে কর্মরত শ্রমিকদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আচমকা এতাে বেশী জল প্রচন্ড বেগে ঢুকে পড়ে যে হতভাগ্য মানুষগুলাে কোনাে সুযােগও পায়নি নিচে থেকে উপরে উঠে আসার। খুব সম্ভব তিনশাে থেকে তিনশাে পঞ্চাশ জন কর্মীর সলিল সমাধি হয়েছিলাে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায়। আমাকে প্রায় একমাস থাকতে হয়েছিল ধানবাদে ঐ দুর্ঘটনার সংবাদ ও রেকর্ডিং কোলকাতায় পাঠানাের জন্য। খনির নিচে সমস্ত এলাকা জলপ্লাবিত হয়ে

পৃষ্ঠা: ৫৬
গিয়েছিল। কর্মরত শ্রমিকদের কারােরই বাঁচার সম্ভাবনা নেই এটাই প্রথম থেকে সবাই আশঙ্কা করেছিলেন। তবুও ক্ষীণ আশা ছিল, যদি কোনভাবে রতিবাটি কয়লাখনির মতাে অবিশ্বাস্যভাবে কেউ বেঁচে যান। আকস্মিক এই বিপর্যয়ের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে প্রথমে জলপ্লাবিত খনি থেকে জল তুলে ফেলার কাজ পুরােদমে শুরু হলাে। কিন্তু জলের পরিমাণ তাে বিশাল। দিনের পর দিন চললাে ঐ জল তােলার কাজ। এদিকে ভাের না হতেই অসংখ্য মানুষের ভিড়। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই খনিমুখে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। চোখেমুখে আতংক আর উৎকণ্ঠার ছাপ, যদি কোনােভাবে প্রিয়জনেরা বেঁচে থাকেন এই ক্ষীণ আশায়। বেশ কিছুদিনের নিরলস প্রয়াসের পর খনিকে জলমুক্ত করা সম্ভব হলাে। তারপর সেই নিদারুণ করুণ দৃশ্য! প্রতিদিন একের পর এক নিচ থেকে তুলে আনা মৃতদেহের মিছিল। আর প্রিয়জনের বুকফাটা আর্তনাদ। একদিন নয় , দুইদিন নয় দিনের পর দিন সেই একই দৃশ্য। একদিকে পাম্প করে জল তােলা হচ্ছে অপরদিকে শবদেহগুলিকে এক এক করে বের করে আনা হচ্ছে। প্রথমদিকে প্রতিদিন মৃতদেহের সংখ্যা ছিল অনেক। দিন যত এগিয়ে যেতে থাকে সংখ্যা ততাে কমতে থাকে। কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত খনিমুখে প্রিয়জনের ভিড় কমেনি। থামেনি তাঁদের আকুল কান্না। আর এই কান্নাকেই চেপে ধরে রেখে পাঠাতে হতাে সর্বশেষ সংবাদের সঙ্গে সংবাদ বিচিত্রার মাধ্যমে প্রচারের জন্য।
অনেকে বলে থাকেন, সাংবাদিকদের আবেগ জড়িত হতে নেই। তাদের নির্বিকার – ভাবে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির কোন স্থান নেই। কিন্তু কাজটি কত কঠিন আমি সেই দিনগুলিতে মনে প্রাণে বুঝতে পেরেছি। অনেক পুত্রহারা পিতামাতা অথবা স্বামীহারা স্ত্রীর বুকফাটা কান্না আমার বহু রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। আজও সেইসব দৃশ্য মাঝে মাঝে আমার মনকে ব্যথিত করে তােলে। সাংবাদিক হলেও তাঁরা মানুষ তাদেরও আবেগ অনুভূতি আছে।
আবেগ অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে মনে পড়েছে ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট ইডেনে সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইষ্ট বেঙ্গল ও মােহনবাগানের মধ্যে সেই খেলায় ইডেনে ভিড় করেছিলেন হাজার হাজার ফুটবলপ্রেমী দর্শক। খেলার প্রথম থেকেই ছিল উত্তেজনা। মাঝে মাঝে দু’দলের কয়েকজন খেলােয়াড়ের অখেলােয়াড়ী আচরণ সেই উত্তেজনাকে আরাে বাড়িয়ে দেয়। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে কিছু কর্মকর্তা আর সমর্থকদের মধ্যে। খেলার শেষদিকে উত্তেজনা চরমে পৌছায়। দেখতে পেলাম ইটের ঘায়ে আহত বেশ কয়েকজন সমর্থককে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর শুরু হলাে ইডেনের গ্যালারীতে দু’দলের সমর্থকদের মধ্যে ধস্তাধস্তি আর খন্ডযুদ্ধ। চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে খেলা শেষ হলাে। আমরা কিন্তু তখন কল্পনাও করিনি কী কলঙ্কময় এক ইতিহাস রচিত হলাে কোলকাতা ময়দানে। খেলার শেষে অফিসে ফেরার পথে শুনলাম নানা গুজব। কেউ

পৃষ্ঠা: ৫৭
বললেন, বহু মানুষ মারা গেছে, অসংখ্য দর্শক আহত। সঠিক সংবাদটা জানবার জন্য ক্লাব হাউসের মেডিক্যাল ইউনিটে গেলাম। সেখানে ডাঃ সুনীল ঠাকুর আমাকে বললেন, “পারলে এখুনি আপনি পি.জি. হাসপাতালে যান। এখানে আমি আর কিছু এখন বলতে পারবাে না।” তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। সংবাদ বিচিত্রা’ প্রচারিত হবে রাত ১০টা ১৫ মিনিটে। মাঠের সমস্ত রেকর্ডিং এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান এডিট করে স্ক্রিপ্ট লিখে প্রােগ্রাম তৈরি করতে সময় লাগবে ২/৩ ঘন্টা। হাতে সময় নেই, তবু বিরাট কিছু ঘটে গেছে জানতে পেরে পাশেই আকাশবাণীতে সংবাদ দিয়ে এক সহকর্মীকে নিয়ে ছুটলাম পি. জি. হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করতে একজন নিয়ে গেলেন একতলার একটি ঘরে। আমি চমকে উঠলাম। সেই ঘরে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে বেশ কিছু মৃতদেহ।
জানলাম এগুলাে ইডেনের খেলার মাঠ থেকেই আনা হয়েছে। ঘড়িতে দেখলাম ৭-৩০ বেজে গেছে। অথচ এখানে মৃতদেহের আত্মীয় পরিজনদের কোন ভিড় নেই। থাকবে কি করে? তাঁরা তাে জানেনই না কার কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল এই খেলার মাঠে। কিন্তু প্রিয়জনদের সেই হাহাকার না পেলে কিভাবে পৌছে দেব শ্রোতাদের কাছে আমার সেই মুহূর্তের ক্ষোভ? কিভাবে পৌঁছে দেব অগণিত মানুষের কাছে খেলার মাঠের এই মারণ যজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ! কয়েক মিনিটের মধ্যেই পরিকল্পনা করে ফেললাম হৃদয়হীন মানুষের মতাে ভাবনা। তবু এই নারকীয় ঘটনার যন্ত্রণা মানুষের বিবেকের কাছে পৌছে দিতে হলে এই সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া আমার সেদিন আর কোনাে উপায় ছিলনা। হাসপাতাল থেকে ফোন করলাম আকাশবাণীর সংবাদ কক্ষে। সহকর্মী বন্ধু প্রণবেশ সেনকে সংক্ষেপে সব জানিয়ে বললাম, ৭-৫০ মিনিটের বুলেটিনে সংবাদটি যেন ভালভাবে অবশ্যই প্রচারিত হয়। আমি জানতাম বেতারে খবর পেয়ে আত্মীয় পরিজনরা ছুটে আসবে।
রাত আটটায় বুলেটিন শেষ হলাে। আমি আমার সহকর্মীকে নিয়ে সেই ঘরটিতে ফিরে এলাম যেখানে সারি সারি মৃতদেহগুলি শায়িত ছিল। সাদা কাপড়ে তাদের সারা শরীর ঢাকা ছিল। শুধু মুখটুকু অনাবৃত। একে একে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে হাসপাতালে। মৃতদেহগুলি শনাক্ত করণের জন্যে সারিবদ্ধ ভাবে ঐ ঘরে ঢােকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমি আমার সহকর্মীকে ঘরের একপাশে টেপ রেকর্ডার নিয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াতে বললাম,নির্দেশ দিলাম আমি ইসারা করলেই যেন সে টেপ রেকর্ডার চালিয়ে দেয়। একে একে মানুষ সারিবদ্ধভাবে মৃত দেহগুলির মুখ দেখে এগিয়ে যাচেছ। চোখে মুখে তাদের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার ছাপ। হঠাৎ চলমান মিছিলে থমকে দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধ ও নির্বিকার চোখে তাকিয়ে নিচে শায়িত তরুণের দিকে। সারামুখে অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ। আমি সহকর্মীকে নির্দেশ দিলাম টেপ রেকর্ডার চালাতে। ধীরে ধীরে যন্ত্রণাবিদ্ধ সেই বৃদ্ধটি হাঁটুমুড়ে বসে নিচে চিরনিদ্রায় শায়িত ঐ তরুণের মুখটি দু’হাতে আঁকড়ে ধরলেন। কয়েকটি নীরব মুহূর্তমাত্র। তারপর ডুকরে

পৃষ্ঠা: ৫৮
কেঁদে উঠলেন। বাবারে তুই কোথায় গেলিরে? সদ্য পুত্রহারা বৃদ্ধের আর্তনাদে ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল। ছুটে এলেন বাইরে অপেক্ষারতা বৃদ্ধের স্ত্রী। পুত্রহারা পিতামাতার কান্না আর সহ্য করা সম্ভব ছিলনা, আর সময়ও হাতে ছিলনা। পি. জি. হাসপাতাল থেকে ছুটে এলাম আকাশবাণীর স্টুডিওতে। পুত্রহারা মাতা পিতার আকুল আর্তনাদ দিয়ে আমি সেদিন প্রশ্ন রেখেছিলাম, তাদের এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য দায়ী কে? বিবেকবান মানুষের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, খেলার নামে এই নারকীয় তান্ডব আর কতদিন চলবে কোলকাতা ময়দানে? মানুষের কাছে সরাসরি এই প্রশ্নগুলি রাখবার জন্যে আমার প্রয়ােজন ছিল পুত্রহারা বৃদ্ধের ঐ কান্না। ফুটবলপ্রেমী সকল মানুষের বিবেককে আমি হয়তাে জাগাতে পারিনি, কিন্তু অনেকেরই হৃদয়কে নাড়া দিতে পেরেছিলাম সেদিন। মনে পড়ে, আকাশবাণীতে বসেই সেদিন অনুষ্ঠান শুনছিলাম। বৃদ্ধের কান্না শুরু হতেই টেলিফোন বেজে উঠলাে “stop it, stop it” আপনারা কি মানুষ! “এই কান্না সহ্য করা যায় না। একের পর এক টেলিফোন বেজে চললাে। একই অনুযােগ “এভাবে কান্না প্রচার করবেন না, মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না।” সবিনয়ে বলি, “বাস্তবকে যেন কোনদিন কলুষিত করতে না পারে তার জন্য সবাই চেষ্টা করি।” বুঝতে পারি কিছুটা হলেও অনেক মানুষের বিবেকের কাছে আমি পৌঁছাতে পেরেছি। তাদের মনকে নাড়া দিতে পেরেছি। আর এখানেই আমার সৃষ্টির সার্থকতা।
সন্তানহারা পিতার আকুল আর্তনাদের কথা বলতে গিয়ে আমার মনে পড়ছে। আর এক কান্নার কথা। কিন্তু সে কান্না বেদনার ছিলনা, ছিল আনন্দের। আগেরটি যেমন ছিল পুত্রহারা পিতার বুকফাটা আর্তনাদ। এবারের ঘটনাটি হলাে দীর্ঘ দিন বাদে হারিয়ে যাওয়া কন্যাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে পিতার আকুল কান্না। ঘটনাটি বলতে গেলে একটু পিছনের ইতিহাস বলা দরকার। মেয়েটির নাম জ্যোৎস্না, বছর আটেক বয়স হবে তখন। কোন কারণে বাবা বকাবকি করার অভিমানে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। তারপর রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে নানাপথ ঘুরতে ঘুরতে হাওড়া ষ্টেশনে পৌঁছায়। সন্দেহজনক ভাবে ঘােরাঘুরি করতে দেখে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে এসে কোর্টে হাজির করে। কোর্টও যথারীতি মেয়েটিকে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠিয়ে দেয়। এখানে বলা দরকার নিরাপত্তার স্বার্থে মেয়েদের তখন কারাগারের Safe custody তে পাঠিয়ে দেওয়া হতাে। ১৯৮৫-৮৬ সাল হবে, তখন তরুণ আইনজীবী শিবশঙ্কর চক্রবর্তী, নিরপরাধ মেয়েদের নিরাপত্তার অজুহাতে এভাবে বছরের পর বছর কারাগারে রাখার অধিকার নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানালেন কোর্টে। মাননীয় বিচারপতি রায় দিলেন, এভাবে মেয়েদের কারাগারে রাখা যায় না। কারাগারের অন্ধকার জীবন থেকে তারা মুক্ত হলাে। অনেক নিরপরাধ মেয়েকে পাঠিয়ে দেওয়া হলাে বিভিন্ন উদ্ধার অথবা অনাথ আশ্রমে। বর্তমান ঘটানার নায়িকা জ্যোৎস্নাও ছাড়া পেয়ে আশ্রয় পেল লিলুয়া হােমে। ইতিমধ্যে মেয়েটির সাত বছর জেল খাটা হয়ে গেছে। অর্থাৎ

পৃষ্ঠা: ৫৯
হারিয়ে যাওয়া জ্যোৎস্নার বয়স এখন ১৫ বছর। কিছুদিন বাদে লিলুয়া হােম থেকে জ্যোৎস্না মর্মস্পশী ভাষায় একখানি ছােট্ট চিঠি পাঠায় আইনজীবী শিবশঙ্কর চক্রবর্তীর কাছে। মেয়েটির আবেদন ছিল, কারাগার থেকেও এই আশ্রমের জীবন তার কাছে আরাে করুণ। এখান থেকে তাকে যেন উদ্ধার করে বাঁচানাে হয়। শিবশঙ্কর বাবু কোন উপায় না দেখে সেই বিচারপতির কাছে চিঠিটা পেশ করেন। এদিকে মেয়েটি শুধু আদালতে তার নাম, বাবার নাম রতিকান্ত মিস্ত্রী, বাড়ি বুদবুদ বাজার এইটুকু মনে করতে পেরেছিল। আর বলেছিল তাঁর বাবা কাঠের মিস্ত্রী। মাননীয় বিচারপতি শিবশঙ্কর বাবুকেই অনুরােধ করলেন, “আপনি একবার পুলিশের সাহায্যে বুদবুদ বাজারে গিয়ে দেখুন না মেয়েটির বাবার কোন খোঁজ করতে পারেন কিনা।” পরদিনই শিবশঙ্কর বাবু পুলিশ নিয়ে গাড়ি করে মেয়েটিকে নিয়ে ছুটলেন বর্ধমানের বুদবুদে। সেখানে সারাদিন থানা-পুলিশ, স্থানীয় ক্লাব, নানা জায়গায় খোঁজ করেও হারিয়ে যাওয়া জ্যোৎস্নানার বাবা রতিকান্ত মিস্ত্রী অথবা তার বাড়ির কোন খোঁজ পেলেন না। বাধ্য হয়েই বুদবুদে রাতটুকু কাটিয়ে পরদিন ভােরে ফিরে এলেন কোলকাতায়। এদিকে যেদিন জ্যোৎস্নাকে নিয়ে তার বাবাকে খুঁজতে যাওয়া হয়েছিল সেদিন ছিল সেখানকার হাটবার। হাটের পর নদী পার হয়ে অনেকেই ফিরে যাচ্ছিলেন খেয়া নৌকা করে ওপারে বাঁকুড়ায় তাদের বাড়িতে। পারাপারের সময় সবাই যখন হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির কথা আলােচনা করছিল তখনই সেই খেয়ানৌকার মাঝি শুনতে পেয়ে অধীর আগ্রহে তাদের কাছে সব জানতে চায়। আসলে ঐ মাঝিটিই হলাে রতিকান্ত মিস্ত্রী। জ্যোৎস্নার বাবা। লােকমুখে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির বর্ণনা শুনে তাঁর মনে কেমন সন্দেহ হয় এই মেয়েটিই যদি তার হয়। পরদিন সকালেই সে বর্ধমানের বুদবুদে থানায় হাজির হয়। কিন্তু ততক্ষণে শিবশঙ্কর বাবু জ্যোৎস্নাকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে গেছেন। সব কথা শুনে থানার বড়বাবু একখানা চিঠি লিখে কলকাতায় শিবশঙ্কর বাবুর কাছে পাঠিয়ে দেন তাকে। এদিকে জ্যোৎস্নাকে লিলুয়া হােমে রেখে, কোর্টে গিয়ে শিবশঙ্করবাবু দেখেন এক বৃদ্ধ ছােট্ট একটি পুঁটলি হাতে তার জন্য অপেক্ষা করছে। থানার বড় বাবুর চিঠিটি পড়েই শিবশঙ্কর বাবু বৃদ্ধকে নিয়ে হাজির হলেন সেই বিচারপতির কাছে। সেই বিচারপতি সব প্রশ্ন করলেন, “জ্যোৎস্না আপনারই মেয়ে প্রমাণ কি?” বৃদ্ধ উত্তর দিলেন “আমার কাছে জ্যোৎস্নার রেশন কার্ড আছে আর ওর ছােটবেলার জামা কাপড় আছে। বিচারপতি তখন ৪/৫ দিন সময় দিয়ে বললেন, “আপনি সব নিয়ে আসুন। এর পরেই শিবশঙ্কর বাবু আমায় সবকিছু জানিয়ে সেই নির্দিষ্ট দিনটির কথা জানালেন। অসাধারণ একটি নাটকীয় মুহূর্ত ধরে রাখার আগ্রহে, নির্দিষ্ট দিনে বেশ কিছু আগেই টেপ রেকর্ডার নিয়ে হাজির হয়েছিলাম কোর্টে। অবশেষে এল সেই চরম নাটকীয় মুহূর্ত। বাবার সামনে হাজির করা হলাে সাত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটিকে। বৃদ্ধকে দেখেই মেয়েটি অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলাে, ‘বাবা’! সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ পিতা প্রচন্ডভাবে

পৃষ্ঠা: ৬০
চিৎকার করে উঠলাে। “ওরে মারে কোথায় ছিলি এতদিন আমায় ফেলে।” চিৎকার করে কোর্টের মধ্যেই কাদতে কাঁদতে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লাে বাবার বুকে। কতক্ষণ তাঁরা কেদেছিল পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আমরা খেয়াল করিনি। কিন্ত সেই অভাবনীয় বাবা-মেয়ের মিলনের মুহূর্ত, অনেকের চোখেই জল এনেছিল। পরে কাঁদতে কাঁদতে বাবা ও মেয়ে তাঁদের হারিয়ে যাওয়া জীবনের সাতটি বছরের বেদনার কাহিনী শুনিয়েছিলেন আমাকে। মনে আছে, সেদিনের সংবাদ বিচিত্রা শুরু করেছিলাম বৃদ্ধের ঐ বুকফাটা কান্না দিয়েই। তবে ধারাভাষ্যে বলেছিলাম, এ কান্না কিন্তু বেদনারই নয় আনন্দের। আর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি কান্না সে বেদনারই হােক আর আনন্দেরই হােক মানুষের মনকে নাড়া দেবেই। আর মানুষের মনকে নাড়া দিতে পারলেই শ্রোতাদের কাছে প্রয়ােজনীয় বার্তাটি পৌছে দেওয়া সহজ হয়।
রেল, বিমান, বাস এমন অনেক দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, খরা-বন্যা, ভূমিকম্প যেখানেই ঘটেছে সেখানেই ছুটে গেছি টেপ রেকর্ডার নিয়ে। রেকর্ড করে নিয়ে এসেছি সেখানকার কিছু জীবন্ত ছবি। তুলে ধরেছি শ্রোতাদের কাছে যাতে তাঁরা বিপন্ন মানুষগুলাের পাশে এসেদাঁড়াতে পারে, প্রসারিত করতে পারে তাদের সাহায্যের হাত। কলকাতাকে অনেকে বলে থাকেন মিছিল নগরী। নানা ঘটনাকে উপলক্ষ করে মহানগরীর রাজপথে শােভাযাত্রা ও মিছিল লেগেই আছে। কিন্তু অতীতে এমন কিছু মিছিলে সামিল হবার সুযােগ আমার হয়েছে। সেগুলিকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। মনে পড়ে বুলগানিন আর ক্রুশ্চেভের কলকাতা আগমনের দিনে রাজপথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষের যে ঢল নেমেছিল তাকে ঐতিহাসিক বলা যায়। বিমানবন্দর থেকে রাজ ভবনের রাস্তার দুধারের জনসমুদ্রের দুর্বার ঢেউ পেরিয়ে রাজভবন পৌছাতে রাশিয়া থেকে আগত ঐ দুই শীর্ষনেতার বেশ কয়েক ঘন্টা লেগেছিল। আজকের মতাে তখনতাে নিরাপত্তার এমন ঘেরাটোপের কড়াকড়ি ছিলনা। তাই বিদেশী অতিথিদের প্রতি অগণিত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছাস আর অভিনন্দনের অবিস্মরণীয় মুহূর্তগুলাে তুলে এনে শ্রোতাদের কাছে পৌছে দেবার জন্য সারাক্ষণ তাদের পাশে পাশে থাকতে হয়েছিল।
আর একটি অবিস্মরণীয় মিছিলের কথা মনে পড়েছে। মিছিল না বলে শােকযাত্রা বলাই ভালাে। বিল্পবী ত্রৈলক্য নাথ চক্রবর্তীর মহাপ্রয়াণে মহানগরীর রাজপথে সেই শােকযাত্রায় সামিল হওয়ার আশ্চর্য অনুভূতি আমি কোনদিন ভুলবাে না। বিপ্লবী মহারাজের মরদেহ সামনে রেখে হাজার হাজার মানুষ এগিয়ে চলেছেন মহা শ্মশানের দিকে। সামনের সারিতে ছিলেন অনেক জননেতা, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী আর স্বাধীনতা সংগ্রামী। রাস্তার দু’ধারে, দু’পাশের বাড়ির ছাদে, বারান্দায় অগণিত মানুষের ভিড়। সবাই মহারাজকে শেষ প্রণাম জানতে ব্যাকুল। আমিও টেপ হাতে মহারাজের মরদেহের পিছনে পিছনে এগিয়ে চলেছি। উদ্দেশ্য বিপ্লবী সংগ্রামীর মৃত্যুতে বেদনাহত মানুষের প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করে, অনুষ্ঠান প্রচার করা। নিজে কিছুটা ধারা বিবরণী

পৃষ্ঠা: ৬১
দিয়ে, কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া রেকর্ড করে বুঝলাম এভাবে শােকাহত নীরব মিছিলের ব্যথা-বেদনার গভীরতা ধরে রাখা সম্ভব হয়। মিছিলে অনেকের সংগে সেদিন হাঁটছিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুর। যার কন্ঠ, যার শব্দ চয়নের দক্ষতা ছিল অসাধারণ। তার হাতে আমার ছােট্ট মাইকটি ধরিয়ে দিতে বললেন, আমি কী বলব? আমি বললাম এই মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে, চারদিকের অগণিত মানুষের চোখের জলে মহারাজকে শেষ প্রণাম জানাতে দেখে আপনার এই মুহূর্তে যে অনুভূতি আবেগ সেটাই আমি ধরে রাখতে চাই। প্রথমে কিছুটা দ্বিধা সত্ত্বেও আমার পীড়াপীড়িতে সৌমেন বাবু বলতে শুরু করলেন, আমি টেপ রেকর্ডার চালু করে দিলাম। মহা শ্মশান পর্যন্ত চলার পথে, এমনি করে মাঝে মাঝে তিনি বলে গেলেন, স্টুডিওতে ফিরে এসে তার সেই টুকরাে টুকরাে মনের আবেগ অনুভূতি দিয়ে আধ ঘন্টার বিশেষ সংবাদ বিচিত্রা প্রচার করা হয়েছিল। সৌমেন বাবুর আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে ধরা সেদিনের মহামিছিলের শােকের গভীরতা অগণিত শ্রোতার হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল।
আর একটি শােক মিছিলের কথাও মনে পড়েছে। মহানায়ক উত্তমকুমারের আকস্মিক মৃত্যুর খবর পেয়ে, ভােরেই পৌঁছে গিয়েছিলাম ভবানীপুরে তাদের বাড়িতে। কেমন করে জানিনা এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদটি তাদের কাছে পৌছল। ভাের রাত থেকে পিলপিল করে লােক আসছে তাে আসছেই। এই আসার বিরাম নেই। চোখে মুখে তাদের স্বজন হারানাের বেদনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির চারিদিকে জনসমুদ্র হয়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য, এত মানুষ, কারাে মুখে কথা নেই। কোন আলােচনা নেই। আকস্মিক আঘাতে সবাই যেন বােবা হয়ে গেছে পরে, উত্তম কুমারের মরদেহ নিয়ে যখন মহাশ্মশানের পথে চলা শুরু হলাে তখনাে কিন্তু লাখাে মানুষ তার পিছনে চলতে শুরু করলাে। আর মিছিল যত এগিয়ে চলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। পথের দু’পাশে কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। বাড়ির ছাদে,বারান্দায়, গাছে, যেখানে যে জায়গা পেয়েছে সেখান থেকেই সে তাঁর প্রিয় শিল্পীকে শেষবারের মত দেখতে চায়। সেই মিছিল। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী আর অগণিত সাধারণ চলচ্চিত্রপ্রেমী। রাস্তার দু’পাশে লাখাে লাখাে মানুষের মধ্যে ছিল আবাল বৃদ্ধ বণিতা, শিশু, কিশাের, কিশােরী, তরুণ, তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, সব বয়সের মানুষ। তাদের অনেককেই সেদিন কান্নায় ভেসে যেতে দেখেছি। দেখেছি বুক চাপড়ে চিৎকার করতে। যেন প্রত্যেকেই তাঁর একান্ত প্রিয়জনের বিয়ােগ-ব্যথায় কাতর। দর্শকদের হৃদয়ের মণিকোঠায় উত্তম কুমার এমনভাবে স্থান করে নিয়েছেন, এত ব্যাপক তাঁর জনপ্রিয়তা, তার মৃত্যুতে অগণিত মানুষের বেদনার এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখে আমি আরাে ভালভাবে উপলব্ধি করলাম। সেদিন সাধারণ মানুষ ছাড়াও চলার পথে যাত্রা-মঞ্চচলচ্চিত্র জগতের সমস্ত বিশিষ্ট শিল্পী কলাকুশলী পরিচালকের প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন। শুনেছিলাম সুচিত্রা সেন ভাের রাতে ভবানীপুরের বাড়িতে গিয়ে উত্তম কুমারের

পৃষ্ঠা: ৬২
মরদেহে মালা দিয়ে ফিরে গেছেন। আর আসেননি। বেশ কয়েকবার সেদিন বালিগঞ্জে সুচিত্রা সেনের বাড়িতে ছুটে গেছি কিন্তু প্রতিবারই দারােয়ান বলেছেন, “ম্যাডাম বাড়ি নেই।” অথচ পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি তিনি বাড়িতেই ছিলেন। হয়তাে তিনি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছেন। সাক্ষাৎকার দিতে চাননি। কিন্তু পরে যখন সবার সাক্ষাৎকার এক ঘন্টার বিশেষ সংবাদ বিচিত্রায় প্রচারিত হলাে তখন অসংখ্য মানুষ জানতে চেয়েছিলেন “কেন সুচিত্রা সেনের প্রতিক্রিয়া নেওয়া হলাে না। আমাদের সমস্যা হলাে এই কেন’র উত্তর লক্ষ লক্ষ শ্রোতার কাছে সব সময় পৌছে দেওয়া সম্ভব নয়। তবুও বলি, উত্তম কুমারের মৃত্যুতে সুচিত্রা সেনের প্রতিক্রিয়া না শােনানাের সেদিনের ব্যর্থতার বেদনা আজও আমি ভুলতে পারিনি। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। উত্তম কুমার চলে যাওয়ার পর। কিন্ত তার সেই অসামান্য জনপ্রিয়তা আজও অম্লান বরং মনে হয় বেড়েই চলেছে। দূরদর্শনে দেখেছি উত্তম কুমারের ছবি থাকলে দর্শকের সংখ্যা সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যায়। বিজ্ঞাপন থেকে আয়ও হয় সব থেকে বেশী। আবার সিনেমা হলে উত্তম কুমারের ছবি এলে, দর্শকের ভিড় উপচে পড়ে। রূপালী পর্দার মায়াবী আকর্ষণে হয়তাে সেদিনের দর্শক মাতােয়ারা ছিলেন কিন্তু আজকের প্রজন্মের কিশাের-কিশােরী, যুবক-যুবতীও তাে উত্তম কুমার বলতে অজ্ঞান। উত্তম কুমার নিয়ে কেন এই উন্মাদনা। তার অসাধারণ জনপ্রিয়তার মূল চালিকা কী প্রশ্নটি একদিন রেখেছিলাম শিল্পীর কাছেই। উত্তরটা সরাসরি না দিয়ে হেসে বলেছিলেন “আপনারাই খুঁজে বার করুন।”
অবসর সময়ে অফুরন্ত সময়ে অনেক প্রশ্নের সঙ্গে এই প্রশ্নটারও উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। এবং খুঁজতে খুঁজতে তার সান্নিধ্যে যাবার স্মরণীয় মুহূর্ত, স্মৃতির পাতা থেকে বারে বারে উঁকি দেয়।
এতবড় শিল্পী, এত বিরাট জনপ্রিয়তা কিন্তু আকাশবাণীর সঙ্গে তাঁর কোন যােগাযােগ নেই, ব্যাপারটা আমায় অবাক করতাে। শুনেছিলাম যখন তিনি উত্তম কুমার হননি অরুণ কুমার ছিলেন তখন আকাশবাণীর নাট্য বিভাগে একাধিকবার ‘অডিশন দিয়েছিলেন। কিন্তু পাশ করেননি। সেই অভিমানেই নাকি আকাশবাণীর কোন অনুষ্ঠানে পরবর্তীকালে অংশ নিতে রাজী হননি। আমার কিন্তু লক্ষ্য ছিল যে করেই হােক উত্তম কুমারকে সংবাদ বিচিত্রায় প্রচার করবাে।
এমনি দু’একবার কোন অনুষ্ঠানে তাঁর সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার রেকর্ড করার সুযােগ পেয়ে গেলাম। কিন্তু ঐসব ছােট ছােট সাক্ষাৎকার শ্রোতাদের মন ভরেনা। আমিও খুশি থাকতে পারিনি। কাজেই অনেক ভেবে চিন্তে দুই প্রজন্মের দুই খ্যাতনামা শিল্পীর সাক্ষাৎকার ভিত্তিক একটি অনুষ্ঠান প্রচারের পরিকল্পনা মাথায় এলাে। সে যুগের প্রবীণ অভিনেতা অহীন্দ্র চৌধুরী আর এযুগের জনপ্রিয় শিল্পী উত্তম কুমার। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যবিভাগের যখন ছাত্র ছিলাম তখনই অহীন্দ্র বাবুর সান্নিধ্যে আসার সুযােগ পেয়েছিলাম। কাজেই তার সম্মতি পেতে অসুবিধা হলাে

পৃষ্ঠা: ৬৩
না। কিন্তু উত্তম কুমার? বন্ধু সহকর্মী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশেষ বন্ধু উত্তম কুমারের ভাই তরুণ কুমারের শরণাপন্ন হলাম। তার অনুরােধে উত্তম বাবু আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন। সবকিছু পরিকল্পনা তাঁকে বুঝিয়ে বলতে তিনি রাজি হলেন সাক্ষাৎকার দিতে। বললেন “বেশি লােক নয় শুধু আপনি আসবেন।” নির্দিষ্ট দিনে ছােট্ট একটি টেপরেকর্ডার নিয়ে হাজির হলাম উত্তম বাবুর ভবানীপুরের বাড়িতে। বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে আলােচনা করার পর তিনি সাক্ষাৎকার দিলেন, দীর্ঘ সময় ধরে। উত্তম কুমারের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার আকাশবাণীতে প্রথম প্রচারের সুযােগ পেয়ে স্বভাবতই আমি রােমাঞ্চিত। এবার তিনি বললেন, ছাইপাশ কী বললাম একটু শুনি। আমি তাড়াতড়ি টেপ গুটিয়ে শুরু থেকে চালিয়ে দিলাম। হায় ভগবান! যা রেকর্ডিং! এতবড় শিল্পী, এত ব্যস্ততা, তবুও এত বেশী সময় দিয়ে আমাকে সাক্ষাৎকার দিলেন আর আমি উত্তম কুমারের সাক্ষাৎকার প্রথম আকাশবাণী থেকে প্রচারের সুযােগ এমনভাবে হারালাম! এই অবস্থায় কি করবাে ভেবে ঠিক করতে পারছিলাম না। কি আশ্চর্য! আমার যখন এই দিশেহারা অবস্থা তখন উত্তম কুমার মৃদু হেসে বললেন, “কি রেকর্ডিং হয়নি?” আমি দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে আমতা আমতা করে বললাম “না”, মানে মেশিনটা ঠিক– আমাকে শেষ করতে দিলেন না। অত্যন্ত মােলায়েম কণ্ঠে বললেন “ঠিক আছে আর একদিন আসবেন আরাে ভালাে করে করা হবে”। এই আমাদের উত্তম কুমার। যাকে এতদিন অহংকারী বলে জেনে এসেছি, কারাে সঙ্গে সহজে দেখা করেন না, ভালােভাবে সকলের সঙ্গে কথা বলেন না। সবকিছু ধ্যান-ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, এক সহজ, সরল অমায়িক উত্তম কুমারকে সেদিন আবিষ্কার করেছিলাম। দুদিন বাদেই আবার সেই বাড়িতে গিয়ে দীর্ঘ সময় তাঁর সাক্ষাৎকার রেকর্ডিং করে প্রচার করেছিলাম, অহীন্দ্র চৌধুরীর সাক্ষাৎকারের সঙ্গে। মনে পড়ে উত্তম কুমারের মৃত্যুর পরেই শ্রদ্ধেয় বিমান ঘােষ এইচ, এম, ভির ক্যাসেট করার জন্য উত্তম কুমারের সেই সাক্ষাৎকারের খোঁজ করছিলেন। কিন্তু সেই সাক্ষাৎকারটি আকাশবাণীতে আর ছিলনা। দুর্ভাগ্য আমাদের উত্তম কুমারের কোন সাক্ষাৎকারের রেকর্ডিং আর নেই। অবশ্য এর পরেও খ্যাতনামা শিল্পী সুপ্রিয়া চৌধুরীর ময়রা স্ট্রীটের ফ্লাটে বেশ কয়েকবার গেছি। উত্তম কুমারের সাক্ষাৎকার নিয়ে এসে প্রচার করব।
মানুষ উত্তম কুমারের পরিচয় পেয়েছিলাম আরাে একটি অনুষ্ঠানে। বন্যাকবলিত অসহায় বিপন্ন মানুষের সাহায্যের জন্যে বােম্বাই (মুম্বাই), কলকাতা, মাদ্রাজ চিত্রতারকাদের নিয়ে একটি প্রদর্শনী ক্রিকেট প্রতিযােগিতার আয়ােজন করা হয়েছিল ইডেনে। প্রধানতঃ উত্তম কুমারের উদ্যোগেই আয়ােজিত হয়েছিল ঐ আকর্ষণীয় প্রতিযােগিতা। অসুস্থ শরীর নিয়ে সে সময় বিপন্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মহানায়ক। ছােটাছুটির এক ফাঁকে ধরেছিলাম তাঁকে সংবাদ বিচিত্রার সাক্ষাৎকারের জন্য। হেসে তিনি বললেন, “আজ আমাকে কেন? অতিথিদের ধরুন এই বলে

পৃষ্ঠা: ৬৪
নিজেই আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে পরিচয় করিয়ে দিলেন মাদ্রাজের প্রখ্যাত চিত্র-তারকা শিবাজী গনৌশানের সাথে। শুধু তাই নয় আমার হয়ে অনুরােধ করলেন, আকাশবাণীকে কিছু বলবার জন্য। এই হলাে উত্তম কুমার। যেকথা দিয়ে আলােচনা শুরু করেছিলাম উত্তম কুমারের অসামান্য জনপ্রিয়তার কারণ কি? আমার তাে মনে হয় শুধু সৌন্দর্য নয়, শুধু অভিনয় দক্ষতা নয়, শুধু তাঁর সেই মন ভােলানাে হাসি নয়; সকলের জন্য সংবেদনশীল এই সহজ সরল অমায়িক মানুষটির আচারআচরণও তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে। তাই আমি রূপালী পর্দার উত্তম কুমার নয়-মানুষ উত্তম কুমার কে আজও ভুলতে পারিনি।
পেশাগত প্রয়ােজনে, অসংখ্য মানুষের সান্নিধ্যে আসতে হয়েছে সেখানে যেমন আছেন, রাজনৈতিক নেতা, শিল্পী, ক্রীড়াবিদ, সাহিত্যিক, সমাজেসেবী শিক্ষাবিদ আবার সমাজের একেবারেই দুর্বল শ্রেণীর মানুষ। এদের অনেকের কথাই আজ মনে পড়ে। বিশেষ করে মনে পড়ে, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বিধান চন্দ্র রায়, চৌএন-লাই, দালাইলামা, নাসের এমনি কত জননেতার কথা। ক্রীড়া জগতের দিকপাল ওয়েষ্ট ইন্ডিজের ওরেল, সােবার্স, লয়েড-সমাজসেবী মাদার টেরিসা এমনি অসংখ্য মানুষের সান্নিধ্যে এসে আমি ধন্য হয়েছি। তাদের কাছে যাবার নানা স্মরণীয় মুহূর্ত, টুকরাে টুকরাে ঘটনা আমার মনকে নাড়া দিয়ে যায়।
পুরুলিয়ার একটি ঘটনা মনে পড়েছে। ইন্দিরা গান্ধী সেই সময় এসেছিলেন একটি জনসভায় ভাষণ দিতে। সভায় যাবার আগে সার্কিট হাউসে তিনি স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংগে দেখা সাক্ষাৎ করেছিলেন। বাইরে তখন অসংখ্য মানুষের ভিড়। তাদের মধ্যে বেশকিছু মানুষ ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে একটানা স্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন। চারিদিকে উত্তেজনা, পুলিশ নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীরা ছােটাছুটি করে অবস্থা সামাল দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। বিক্ষোভের মাত্রা যখন বেড়েই চলেছে ইন্দিরা গান্ধী তখন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে নেমে এলেন লনে জনতার সামনে। স্লোগান আর চিৎকার বেড়েই চললাে। প্রশাসন কর্তৃপক্ষ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীরা আকস্মিক এই ঘটনায় দিশেহারা। ইন্দিরা গান্ধী কিন্তু অচঞ্চল। হঠাৎই তিনি উঠে পড়লেন দাঁড়িয়ে থাকা একটি জীপের ওপরে। হাত তুলে জনতার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে শুরু করলেন। আমি আমার মাইকটি এক ফাঁকে তার হাতে তুলে দিয়ে টেপ রেকর্ডারটি চালিয়ে দিলাম। এবার শুরু হলাে ইষ্টক বৃষ্টি। ইন্দিরা গান্ধীকে লক্ষ্য করে জনতার মধ্য থেকে কিছু দুষ্কৃতকারী ইট-পাটকেলের টুকরাে ছুঁড়তে শুরু করলাে। কে যেন ইটের আঘাত থেকে বাঁচবার জন্য ইন্দিরা গান্ধীর মাথায় একটি ছাতা তুলে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছাতাটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে আবেগময় অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জনতার উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, তাঁর আবেগ আপ্লুত কণ্ঠের সামনে জনতার বিক্ষোভ আধা মিনিটের মধ্যেই থেমে গেল। যারা “ইন্দিরা গান্ধী মুর্দাবাদ” বলে এতক্ষণ গলা ফাটাচ্ছিলেন

পৃষ্ঠা: ৬৫
তাঁরাই এবার ‘ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ’ বলে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুললাে। ছােট্ট ঘটনা, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর সেদিনের সাহসিকতা, অসীম মনােবল আর জন-আকর্ষণী শক্তি দেখে আমার মতাে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য এমন একজন নেত্রীকে এই দেশেরই ঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হলাে!
ইন্দিরাজীর কথা বলতে গিয়ে আমার আর একটি ছােট্ট ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সেবার উনি শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন অচার্য হিসেবে বিশ্বভারতীর সমাবর্তন উৎসবে যােগদান করতে। তখন পৌষ মেলা আর সমাবর্তন অনুষ্ঠান একই সময়ে হােত। আমি জানতাম ইন্দিরাজী এক সময়ে গুরুদেবের শান্তিনিকেতনে বেশ কিছুদিন পড়াশুনা করেছিলেন। কাজেই আমার ইচ্ছে ছিল সমাবর্তন উৎসবের ফাঁকে বাংলায় ইন্দিরাজীর একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করা। পশ্চিম বাংলার তখনকার মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের শ্রী প্রীতিন ভট্রাচার্যের শরণাপন্ন হলাম। তিনি আমাকে কথা দিলেন যথাসম্ভব চেষ্টা করবেন। ঘন্টা খানেকের মধ্যে সেই আমার ছােট্ট টেপ রেকর্ডারটি নিয়ে হাজির হলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরই ইন্দিরাজী ঘর থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এসে বললেন “কি বলব বলুন?”
দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখােমুখি হয়ে এভাবে তাঁর এই আকস্মিক প্রশ্নে প্রথমে সেদিন আমি বেশ কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে সবিনয়ে বলি, “ম্যাডাম, বাংলায় আপনার একটি ছােট্ট সাক্ষাৎকার।” উনি হেসে বললেন, “বাংলায়? আমি তাে বাংলায় ভাল বলতে পারি না।” আমি বললাম, “আপনি তাে এক সময়ে শান্তিনিকেতনে ছিলেন, তাই পশ্চিম বাংলার মানুষ আপনার ভাষা বাংলা শুনলে খুশি হবেন।” আমার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত তিনি সেদিন সংবাদ বিচিত্রার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার বাংলায় দিয়েছিলেন। আমার বেশ মনে আছে- রেকর্ডিং শেষ হতেই তিনি বলেছিলেন, “ভাল হােল না।” অথচ যারা সেই সাক্ষাৎকারটি শুনেছিলেন তাঁদের হয়তাে অনেকেরই আজও মনে আছে কত সহজ সুন্দর আর সাবলীলভাবে তিনি বড়দিন উপলক্ষে দেশবাসীর কাছে জাতীয় সংহতি অক্ষুন্ন রাখার আবেদন রেখেছিলেন। কিন্তু বাংলায় আরাে ভালাে আরাে সুন্দর করে না বলতে পারার জন্য তিনি নিজে খুশি হতে পারেননি।
বেতার আর দূরদর্শনে দীর্ঘ চল্লিশ বছর কাজ করেছি। এর মধ্যে ২৫ বছরেরও বেশি আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রে সংবাদ বিচিত্রা প্রযােজনার দায়িত্বে ছিলাম। বেতার সাংবাদিক হিসেবে এই সময়ে যেমন মিশতে হয়েছে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে তেমনি ছুটতে হয়েছে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এর মধ্যে আবার উত্তরবঙ্গের বিশেষ করে ডুয়ার্স অঞ্চলের প্রতি রয়েছে আমার বিশেষ দুর্বলতা। কখনাে স্টেট ব্যাংক, কখনাে ইন্ডিয়ান অয়েল অথবা অপর কোন সরকারী বা বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে বারে বারে যেতে হয়েছে উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। তাছাড়া ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ এই চার বছর আকাশবাণী শিলিগুড়ি কেন্দ্রের অধিকর্তা হিসেবে কাজ

পৃষ্ঠা: ৬৬
করার সুযােগ আমার হয়েছে। উত্তরবঙ্গের কথা বলতে গেলেই আমার কবিগুরুর সেই লাইন ক’টি মনে পড়ে-
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,
একটি ধানের শীষের উপর।
একটি শিশির বিন্দু।”

সত্যি প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছে এখানে। কোথাও পাহাড়, কোথাও বা সবুজ অরণ্য আবার কোথাও বা সবুজ কার্পেটে মােড়া চায়ের বাগান। আর এই সবের মাঝে মাঝে রূপােলী পাড়ের মত বয়ে চলেছে তিস্তা, ধরলা, ভােগ, জলঢাকা, মহানন্দা এমনি অসংখ্য পাহাড়ী নদী। এখানে প্রকৃতি যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি বৈচিত্র্যে ভরা এখানকার মানুষ। কেউ পাহাড়ের, কেউ অরণ্যের আবার কেউবা সমতলের। মেচ রাঙ্গা, ওরাও, মুন্ডা কেঁচো নানা উপজাতি আদিবাসীবিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে বর্ণময় সাংস্কৃতিক জীবন।
জলপাইগুড়ি জেলার জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে ছােট্ট একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। বন্ধুবর প্রাক্তন ফুটবলার নীলেশ সরকারের আমন্ত্রণে স্টেট ব্যাংকের হয়ে সেবার উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম। কাজের ফাঁকে একদিন সকালে জলদাপাড়ায় হাতির পিঠে উঠে আমরা সবাই গণ্ডার দেখতে বেরিয়েছিলাম। একটা হাতিতে আমি, বন্ধু ও সহকর্মী প্রণবেশ সেন আর নীলেশ। অপর দু’টি হাতিতে অন্যান্য সাংবাদিক বন্ধুরা। আমাদের হাতিটা ঘণ্টাখানেক ঘুরতে ঘুরতে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গভীরে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে আমরা হতাশ হয়ে পড়েছি। ভাবছি এবারে বােধ হয় আর গণ্ডার দেখা হলাে না। হঠাৎ দেখি আমাদের থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে এক বিরাট গণ্ডার। চিড়িয়াখানায় অবশ্য আগেই গণ্ডার দেখেছি। কিন্তু এমন কালাে কুচকুচে রং-এর স্বাস্থ্যবান গণ্ডার আর দেখিনি। গণ্ডরটি তখন কেন জানি না রাগে গড় গড় করছিল আর আমাদের দিকে তাকিয়ে অনবরত পা দিয়ে মাটি খুঁড়ছিল। হয়তােবা ওর চলার পথে হঠাৎ আমরা এসে পড়ায় তার এই আক্রোশ! আমাদের অবস্থা তাে তখন কাহিল! যদিও আমরা হাতির পিঠে কিন্তু সেই হাতি তাে নির্বিকারচিত্তে দাঁড়িয়ে ঘাস চিবােচ্ছে। যদি গণ্ডারমশাই কোনক্রমে আমাদের ওপর লাফিয়ে পড়েন। সবাই ভয়ে জড়সড়, কারাে মুখে কোন কথা নেই, মানে কথা বলবার মতাে মনের জোর নেই। হঠাৎ কানের কাছে শুনি নীলেশের ফিসফিসানি-“এই-অ্যা-বাে-র-চার কত হবে-রে- ধমক দিয়ে থামিয়ে বলি, “মার না যা খুশি।” সঙ্গে সঙ্গে ওর ক্যামেরার শাটার টেপার আওয়াজ পেলাম কিন্তু ঐ একবারই! কতক্ষণ এভাবে চলছিল মনে নেই। কারণ, ভয়ে বােধ হয় আমাদের কারাে বিচার-বুদ্ধি কাজ করছিল না। এদিকে যেমনি আকস্মিকভাবে গণ্ডার মহারাজ আমাদের সামনে উদয় হয়েছিলেন তেমনি রাজকীয়ভাবে মুহূর্তের মধ্যে গভীর অরণ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমরা

পৃষ্ঠা: ৬৭
কিন্তু তখনও আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক হতে পারছি না। আস্তে আস্তে হাতি আমাদের নিয়ে এগিয়ে চললাে। হঠাৎ প্রণবেশ বলে উঠলাে, “আমার চটি?” চেয়ে দেখি ওর এক পায়ের চটি নেই। ভয়ে কম্পমান অবস্থায় কখন একপাটি চটি পা থেকে খুলে নীচে পড়ে গেছে এতক্ষণ খেয়ালই করেনি। আমাদের আলােচনা আর হাসি শুনতে পেয়ে মাহুত তার হাতিটিকে আবার সেই জায়গাটিতে ফিরিয়ে আনলাে যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা গণ্ডার দেখছিলাম। কিন্তু হায় ভগবান। এখানে ১০/১২ হাত লম্বা ঘাসের ঘন জঙ্গল। হাতি নিয়ে আমরা সবাই সেই ঘাসের বনে ডুবে যাচ্ছি। এখানে ঐ ছােট্ট চটি খুঁজে বের করা অসম্ভব। কিন্তু কি আশ্চর্য। মাহুত কি ইসারা করলাে জানি না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঐ গভীর জঙ্গলের মধ্য থেকে ঐ চটি হাতি শুড় দিয়ে তুলে এনে আমাদের কাছে তুলে ধরলাে। আর হা কলকাতায় ফিরে নীলেশের কাছে সেই গণ্ডারটির ছবি চেয়েছিলাম। কিন্তু জানতে পারলাম গণ্ডারের কোন ছবি ওঠেনি। নীলেশের অজুহাত-“ভয়ে হাতটা তখন এমন কাপছিল না …।”
হাতির বুদ্ধির আর এক নমুনা দেখেছিলাম ঐ জলদাপাড়ার কাছেই এক বস্তিতে। হাতিরা সাধারণত বর্ষাকালে দল বেঁধে নিচে মাঝে মাঝে নেমে আসে খাবারের সন্ধানে। ঐ সময় স্থানীয় মানুষেরা হাতির উপদ্রব থেকে বাঁচবার জন্য টিন, পটকা নিয়ে সব সময় প্রস্তুত থাকে। সেবার সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর অবসন্ন। খাওয়াদাওয়া সেরে শােবার কথা ভাবছি। এমন সময় শুনতে পেলাম পাশের বস্তিতে তুমুল চীৎকার আর চেঁচামেচি। সেই সঙ্গে টিন পেটানাে আর পটকার বিকট আওয়াজ। আমাদের দেখাশােনার ভার ছিল যার ওপর সেই ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যাপার কি?” নির্বিকারভাবে সে জবাব দিল, “কিছু না, পাশের বস্তিতে হাতি এসেছে।” উত্তেজিত হয়ে বললাম, “হাতি দেখা যাবে?” “দেখবেন? চলুন জঙ্গলে।” বলে ছেলেটি আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে পাশের সেই বস্তিতে গেল যেখানে হাতি তাড়াতে গ্রামের মানুষ উঠে পড়ে লেগেছে। সেটা ছিল পূর্ণিমার রাত। চাঁদের আলােতে পরিষ্কার দেখলাম একটি বিরাট হাতি নির্বিকারচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। আর দূরে দাঁড়িয়ে গ্রামবাসীরা টিন পেটাচ্ছে আর মাঝে মাঝে পটকা ছুঁড়ে মারছে কিন্তু অবাক কাণ্ড! যতবার তার দিকে পটকা ছুঁড়ে মারা হচ্ছে ততবারই অসাধারণ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সেটিকে মাটিতে পড়ে ফাটবার আগেই পা দিয়ে মাটিতে চেপে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। মনে হলাে এটা যেন ওর কাছে একটা খেলা। ভাবটা এমনই যে মারবে? মারাে কত পটকা আছে তােমাদের? এমনিভাবে এক সময়ে পটকার মজুদ ভাণ্ডার শেষ হয়ে এল টিন পেটাতে পেটাতে হাতও বােধ হয় অবশ হয়ে এল সবার। আর হাতিও বােধ হয় মানুষের শক্তির দৌড় বুঝতে পেরে খানিকটা অবজ্ঞাভরেই ধীরে ধীরে পাশের গভীর অরণ্যে ফিরে গেল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে ঘরে ফিরে এলাম।
আর একবার বকসা ব্যাঘ্র প্রকল্প দেখতে গিয়ে বাঘের সামনে পড়েছিলাম। তখন সন্ধ্যে হয় হয়। ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জয়ন্তী পাহাড়ী এলাকার

পৃষ্ঠা: ৬৮
বকসা ব্যাঘ্র প্রকল্পের কয়েকটি এলাকা ঘুরে ফিরে আসছিলাম। দু’টি জীপে করে ফিরছি আমরা। প্রথম জীপটিতে আমি, ব্যাঘ্র প্রকল্পের কর্মকর্তা এবং আমার আর এক সহকর্মী। পেছনের জীপটিতে বন্দুক হাতে একজন নিরাপত্তারক্ষী এবং আরাে কয়েকজন। কাজ শেষে ফেরার তাগিদেই হয়তাে আমাদের জীপটি অনেকটা এগিয়ে এসেছে। পেছনের জীপটা তখন অনেক পিছিয়ে। গভীর জঙ্গলে বেশ কিছুটা পথ চলার পর আচমকাই চালক ব্রেক কষলাে। গাড়ি থেমে গেল। চালক কি যেন ইশারা করতেই আমার সঙ্গী প্রকল্প অধিকর্তা নিচে নেমে আমাকে নামতে বললেন। আমি কিছু বুঝতে না পেরে খানিকটা ভয়ে ভয়ে জীপ থেকে রাস্তায় নামলাম। সর্বনাশ! বেশ কয়েক গজ দূরে রাস্তার ঠিক মাঝখানে শুয়ে বিরাট এক বাঘ। তার দৃষ্টি আমাদের দিকেই-কিন্তু সে দৃষ্টি ভাবলেশহীন। কিন্তু আমার তাে হার্টফেল করার মতাে অবস্থা! পেছনের জীপটিরও দেখা নেই। আমার সঙ্গী ইশারা করে অভয় দিলেও আমি জীপে উঠতে পারলেই বাঁচি। কিন্তু পায়ে তাে কোন শক্তি নেই। কে যেন মাটির সঙ্গে পা দু’ টিকে বেঁধে রেখেছে। ভাগ্য ভাল আমার, হঠাৎ-ই ব্যাঘ্র মহােদয় উঠে আমাদের দিকে একবার ভাল করে তাকিয়ে একলাফে পাশের গভীর অরণ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মহারাজার এমন রাজকীয় প্রস্থান আমার বহুদিন মনে থাকবে। পরে অবশ্য সঙ্গী ভদ্রলােকটি আমায় বলেছিলেন, “উত্তরবঙ্গের বাঘ অত্যন্ত নিরীহ, হিংস্র নয়। মানুষখেকো তাে নয়ই।”
আরে বাঘ বাঘই! তার আবার আমিষ আর নিরামিষ আহারী কি? বিশেষ করে বাঘের সামনে পড়ে তখন কি ভাববার মতাে মনের অবস্থা থাকে যে কে হিংস্র আর কে নিরীহ?
বাঘের কথা উঠলেই সুন্দর বনের কথা মনে পড়বেই। এই শ্বাপদসংকুল সুন্দরবনে আমি বহুবার গেছি—গভীর জঙ্গলে বহু রাত কাটিয়েছি। সেখানে কুমীর দেখেছি, সাপ দেখেছি, আরাে অনেক জন্তু-জানােয়ার দেখেছি। কিন্তু সেই রয়াল বেঙ্গল টাইগারের দর্শন কিন্তু একবারও আমি পাইনি। অথচ বকসা ফরেস্টে একবার গিয়েই তার দেখা পেলাম।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আর এক অপরূপ ভাণ্ডার হলাে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। আন্দামানে আমি বার ছয়েক গেছি। কিন্তু যতবারই গেছি ততবারই এর নয়ন ভােলাননা রূপ আমায় নতুন করে মুগ্ধ করেছে। পাের্ট ব্লেয়ার থেকে আশেপাশের মাত্র কয়েকটি দ্বীপে যাবার আমার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু অসংখ্য দ্বীপ নিয়ে গঠিত সমগ্র এলাকা এবং সেখানকার অধিবাসীদের বিচিত্র জীবনধারা দেখতে গেলে অন্ততঃ কয়েকমাস আপনাকে আন্দামানে কাটাতে হবে। কারণ, পাের্ট ব্লেয়ারের সঙ্গে এখনও অনেক দ্বীপের নিয়মিত যােগাযােগই নেই। আবার অনেকগুলির সঙ্গে সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন মাত্র যােগাযােগ ব্যবস্থা আছে। অবশ্য বর্তমানে নিশ্চয়ই যােগাযােগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে।

পৃষ্ঠা: ৬৯
যে কথা বলছিলাম-কেন বারে বারে আন্দামান আপনাকে আকর্ষণ করবে? আসলে সমুদ্র অনেক জায়গাতেই দেখতে পাওয়া যায়। আর ইচ্ছে করলে পাহাড়েও আপনি ছুটে যেতে পারেন। কিন্তু সমুদ্রের এমন বর্ণময় রূপ আর সেই স্বচ্ছ নীল জলরাশির মধ্য থেকে মাঝে মাঝে উঠে আসা সবুজ পাহাড়ের হাতছানিকে আপনার পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
প্রথম যেবার আমি আন্দামানে যাই তখন শুধু আমার অবাক হবার পালা। সত্যি কথা বলতে কি আন্দামান সম্পর্কে আমার চিরাচরিত ধারণার সঙ্গে মিল খুঁজে না পাওয়াতেই এই বিস্ময়। আমার ধারণা ছিল কালাপানির ওপারে বহু দূরে জন্তুজানােয়ারে ভরা এই দ্বীপ মানুষের বসবাসের অযােগ্য বলেই এখানে কয়েদীদের চির নির্বাসনে পাঠানাে হতাে। দেশ স্বাধীন হবার পর অবস্থার নিশ্চয়ই কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সাগর আর সবুজ পাহাড়ের এমন মনমাতানাে রূপ দেখতে পাবাে বলে আমি আশা করিনি। সবচেয়ে অবাক হলাম যখন দেখলাম, আমাদের মতােই অনেক মানুষ বিশেষ করে পূর্ব বাংলার মানুষ সেখানে দিব্যি চাষ আবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেশ সুখেই আছেন। একদিন ভারি এক মজার ব্যাপার হলাে। পাের্টব্লেয়ার থেকে বেশ দূরে কয়েকটি এলাকা দেখতে বেরিয়েছি। হঠাৎ এক জায়গায় শুনতে পেলাম পূর্ব বাংলার ভাষায় মেয়েদের সমবেত কণ্ঠে বিয়ের গান। আমরা তাে কোলকাতায় এখন পূর্ব বাংলার সেই বিয়ের গান আর শুনতে অভ্যস্ত নই। স্বভাবতই কৌতূহলী হয়ে গাড়ি থামাতে বললাম। গাড়ি থেকে নেমে সেই বাড়িটি খুঁজে বার করলাম। দিনটা ছিল বিয়ের আগে মেয়ের গায়ে হলুদ। গানের একটি লাইন আমার আজও মনে আছে-“হলুদ গুইল্যা বাইটা আনাে” ইত্যাদি। আশ্চর্য পশ্চিম বাংলায় তাে আরাে বেশি উদ্বাস্তু পূর্ব বাংলা থেকে এসে নতুন করে জীবন শুরু করেছেন। কিন্তু সেখানেও তাে এই গান আর তেমনভাবে শােনা যায় না। আমরা কেমন করে এত সহজে আমাদের সেই গ্রামীণ সংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেললাম। অথবা শহরের কৃত্রিম জীবনধারায় আমাদের সেই সহজ-সরল গ্রামীণ সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে আমরা সঙ্কুচিত। অথচ প্রকৃতির এই ভােলামেলা পরিবেশে মনের সেই অবরুদ্ধ উৎস আবার বাঁধ ভাঙ্গা নদীর মতাে চারিদিকে আছড়ে পড়ছে। আরাে মজার ব্যাপার! শহর থেকে আসা এই মানুষগুলােকে দেখে তাদের আনন্দে ভেসে যাওয়া থমকে গেল না। বরং দ্বিগুণ উৎসাহে তারা মেতে উঠলেন। এক সময়ে দেখলাম আমরাও সেই উৎসবের অংশীদার হয়ে পড়েছি। এটাই বােধ হয় স্বাভাবিক। যেখানে এখনও কৃত্রিমতার ছোঁয়া লাগেনি সেখানে পরিচিত অপরিচিতের ভেদাভেদ থাকে না। মানুষ মানুষকে কত সহজেই না আপন করে নিতে পারে।
আর একবার আন্দামানে আমরা ট্রলারে করে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা দেখতে গেছি। বন্দর থেকে ৫০ কিলােমিটারের বেশি দূরে গভীর সমুদ্রে জাল ফেলা হয়েছে। যখন ধীরে ধীরে সেই জালকে গুটিয়ে ট্রলারের কাছাকাছি আনা হলাে তখন দেখি

৭০
পৃষ্ঠা: সেই জালে পােনা জাতের অসংখ্য সামুদ্রিক মাছ। নীল স্বচ্ছ জল একেবারে মাছে মাছে সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু মাছভর্তি সেই জালের বাইরে পেছন পেছন আসছে এক ঝক হাঙ্গর। তারা ঐ জালের ছােট ছােট মাছ খেতে খেতে আসছে। আমাদের ট্রলারের কয়েকজন কর্মী একটি শক্ত দড়িতে বড় একটা বড়শিতে মাছ গেঁথে সেই হাঙ্গরের ঝাঁকে ফেলে দিলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেই বড়শিতে গেঁথে জাহাজে টেনে তুললাে বিরাট এক হাঙ্গর মাছ। পরে যখন সেই মাছভর্তি জাল জাহাজে তোলা হলাে তখন দেখা গেল কয়েক মণ মাছ এক টানেই উঠে এসেছে। সেদিন ফেরার পথে আরাে একটি নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মাঝপথে দেখলাম আমাদের জাহাজের পাশে পাশে চলেছে একঝাক ডলফিন। বেশ কয়েক কিলােমিটার পথ এই ডলফিনের দল আমাদের সঙ্গ দিয়েছিল। মাঝে মাঝেই ওরা কেউ লাফিয়ে উঠে যেন ওদের আনন্দ প্রকাশ করছিল। কেউ কেউ আবার ওদের মধ্যে আগে আগে ছুটে গিয়ে যেন আমাদের পথ দেখাতে চাইছিল।
বিভিন্ন এলাকার নানা ঘটনার কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ছে এক পাহাড়ী তরুণীর কথা। দুর্বল শ্রেণীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেবার যে কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল তা দেখাবার জন্য স্টেট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন দার্জিলিং জেলার ছােট পুরাং-এ। ঐ এলাকার মানুষের সহজ-সরল ব্যবহার আর আন্তরিক আপ্যায়নে আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন ওদেরই একজন হয়ে গেলাম। ওদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা রেকর্ড করার পর আমি সেই নেপালী তরুণীটিকে জিজ্ঞেস করলাম সে গান গাইতে পারে কি না? উদ্দেশ্য ছিল ওদের নিজস্ব সংস্কৃতির কিছু ছবি তুলে ধরা। আমাকে অবাক করে কোন রকম দ্বিধা না করেই সে পরিষ্কার বাংলায় গেয়ে উঠলাে ‘হিমেল রাতের ঐ গগনের দীপগুলি’। সেদিন শীতের সন্ধ্যায় কি ভেবে সে গুরুদেবের ঐ গানটি গেয়েছিল জানি না, আমার কিন্তু মনে হয়েছিল গুরুদেব ওর মতাে কোন পাহাড়ী তরুণীকে এমনি কোন শীতের রাতে দেখেই গানটি লিখেছিলেন। গান শেষ হবার পর বেশ কিছু সময় আমরা কেউ কোন কথা বলতে পারিনি। সেই গানের আবেশ আজও আমি ভুলতে পারিনি। মাঝে মাঝে ভাবি রাজনীতির আবর্তনে আমাদের সেই সহজ-সরল জীবন যেখানে কোন হিংসা নেই ভেদাভেদ নেই, আছে শুধু মানুষে মানুষে ভালােবাসা-কোথায় হারিয়ে গেল! ভাবি যদি কোনদিন এমন ছােট পুরাং-এ যাই তেমনি করে কি সেখানকার পাহাড়ী ভাই-বােনেরা আমাকে আপন করে কাছে টেনে নেবেন, তেমনিভাবে কি কোন তরুণী স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠবে “হিমেল রাতের ঐ গগনের দীপগুলি”।
রবীন্দ্র সংগীতের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়লাে বিশিষ্ট শিল্পী এম, এস শুভলক্ষ্মীর কথা। সেবার তিনি এসেছিলেন শান্তি নিকেতনে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি গ্রহণের জন্য। অনুষ্ঠানের আগের দিন সন্ধ্যায় হাজির হলাম তার কাছে একটি সাক্ষাৎকারের জন্য। সাক্ষাৎকার রেকর্ডিং শেষ হবার পর আমাদের অনুরােধে তিনি সেদিন কয়েকটি

পৃষ্ঠা: ৭১
রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছিলেন যার মধ্যে একটি এখনও আমার কানে বাজে “আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি”। নিজের আস্তানায় ফিরে এসে রেকর্ডিং শুনতে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। যান্ত্রিক গােলযােগের জন্যই হােক অথবা ক্যাসেটের জন্যই হােক রেকর্ডিং পরিষ্কার হয়নি। সাক্ষাৎকারটি যদিও বা প্রচার করা যাবে কিন্তু গান? মনটা খারাপ হয়ে গেল। শুভলক্ষ্মীর কণ্ঠে বাংলায় রবীন্দ্র সংগীত এমন স্মরণীয় ঘটনা লক্ষ লক্ষ শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেবার সুযােগ পেয়েও আমি হারালাম। পরদিন কোন রকমে বিশ্ব ভারতীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানের কাজ শেষ করে কোলকাতায় ফিরছি। বােলপুর স্টেশনে দেখা হলাে শুভলক্ষ্মী দেবী ও তার স্বামীর সঙ্গে। একই ট্রেনে ওরাও কোলকাতায় ফিরছেন। সুযােগ পেয়ে একই বগিতে উঠে পাশাপাশি বসলাম। ট্রেন চলতে শুরু করলাে। গল্প করার এক ফাঁকে তাঁকে অনুরােধ করলাম একটি গান শােনাবার জন্য। চমকে উঠে একমুখ হাসি নিয়ে তিনি বললেন, “এইখানে?” তাঁর হাসিতে প্রশ্রয় পেয়ে খানিকটা মরিয়াভাবে বললাম, “আমরা আপনার গান শুনবােই।” দাবি তাে জানালাম। কিন্তু আমার নিজেরও যথেষ্ট আশঙ্কা ছিল। চারিদিকে হকারদের চীৎকার-স্টেশনে স্টেশনে যাত্রীদের ওঠানামার গােলমাল আর তার মাঝে ট্রেন চলার একটানা খটাখট আওয়াজ। এমন পরিবেশে শিল্পী গান গাইতে রাজি হলেও ট্রেনের যাত্রীরা এটাকে কিভাবে নেবেন? শেষকালে ট্রেনের কামরায় একটা অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হবে না তাে? শুভলক্ষ্মী দেবী কিন্তু ততক্ষণে গুনগুন করে সুর ভাজতে শুরু করেছেন। তাড়াতাড়ি টেপ রেকর্ডার বের করে চালিয়ে দিলাম। অবাক কাণ্ড! শিল্পীর সুরেলা কণ্ঠের যাদুতে মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত কামরা একেবারে চুপ! একটার পর একটা রবীন্দ্র সংগীত সেদিন শিল্পী আপন মনেই সারাটা পথ গেয়ে চলেছিলেন। খালি গলায় তাঁর ঐ মিষ্টি কণ্ঠ অদ্ভুত এক পরিবেশ রচনা করেছিল। চলমান ট্রেনের অবিরাম খটাখট আওয়াজটাও যেন সেদিন গানের পেছনে এক অপূর্ব ছন্দ রচনা করে চলেছিল। এখন ভাবি কেমন করে এত বড় শিল্পী ঐ পরিবেশে এত সহজে আমাদের অনুরােধ মেনে নিলেন? কেমন করেই বা গাইলেন গানের পর গান? হয়তােবা একেই বলে স্থান মাহাত্ম্য! রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন হয়তাে বা এমনিভাবে মানুষের মনকে উদাস করে দেয়-খসে পড়ে আমাদের তথাকথিত সভ্য জীবনের সব কৃত্রিমতা। আর শুভলক্ষ্মী দেবী লতা জাত শিল্পী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আকাশবাণীর বিশেষ করে কলকাতা কেন্দ্রের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। নির্যাতিত নিপীড়িত বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে একদিন আমরা আবিষ্কার করলাম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরােচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে ওপার বাংলার সংগ্রামী ভাইবােনদের সঙ্গে আমরাও একজন সৈনিক হয়ে লড়াই করছি। কিন্তু আমাদের লড়াইটা ছিল রণক্ষেত্রে নয় বেতারের মাধ্যমে। ৭০-৭১ সালে প্রায় এক বছর ব্যাপী এই যুদ্ধে আমরা এমনভাবে একাত্ম হয়ে পড়েছিলাম যে আমরা অনেকেই এই সময় সাপ্তাহিক ছুটি নেবার সুযােগও

পৃষ্ঠা: ৭২
পাইনি। মনে পড়ে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর তখনকার জনসংযােগ আধিকারিক শ্রদ্ধেয় সমর বসু একদিন ঠাট্টা করে বলেছিলেন-কি হে! বাংলাদেশের যুদ্ধ তাে তােমরা ত্রিমূর্তিই জিতিয়ে দেবে। ত্রিমূর্তি বলতে সমরদা বােঝাতে চাইছিলেন আমি, সহকর্মী প্রণবেশ সেন যিনি সংবাদ পরিক্রমা লিখতেন আর দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় যার অসাধারণ কণ্ঠ আর বাচনভঙ্গী দিয়ে আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরতেন। অবশ্য সংবাদ বিভাগে আরাে অনেক একনিষ্ঠ কর্মী তখন একইভাবে এই কাজে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন বিশিষ্ট বেতার সাংবাদিক নির্মল সেনগুপ্ত, সংবাদ পাঠক তরুণ চক্রবর্তী ও গৌতম বসু এবং আমাদের তখনকার বার্তা সম্পাদক দীনেশ ভৌমিক যিনি পরবর্তী সময়ে আকাশবাণীর সংবাদ বিভাগের সর্বোচ্চ পদে উন্নীত হয়েছিলেন। আসলে, সবার মিলিত প্রচেষ্টায় সেদিনের লক্ষ্যে আমরা পৌছাতে পেরেছিলাম। স্মরণীয় সংগ্রামের অনেক চরিত্র, অনেক ঘটনা, অনেক মুহূর্ত আজও আমাকে আবেগে উত্তেজনায় সময় সময় উদ্বেল করে তােলে।
মনে পড়ে সেই গানটির কথা-“শােন, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি”। গানটি যিনি গেয়েছিলেন সেই শিল্পী অংশুমান রায় আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐ গানটি চিরদিন ইতিহাস হয়ে থাকবে। এই গানটির ইতিহাস হবার পেছনেও আর একটি ইতিহাস রয়েছে। সংবাদ পাঠক দেব দুলালের বাড়িতে বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী কামরুল হাসান এসেছেন। খবর পেয়েই সেখানে টেপরেকর্ডার নিয়ে ছুটলাম। সেখানে গৌরী প্রসন্ন মজুমদার আর আমাদের শিল্পীবন্ধু অংশুমান রায় এবং দীনেন্দ্র চৌধুরী। কামরুল হাসানের সাক্ষাৎকার রেকর্ডিং এর পর আংশুমান গৌরীদার লেখা ঐ গানটি কামরুল হাসানকে শােনাতে চাইলাে। হারমােনিয়াম যা করে তােক একটি জোগাড় হলাে কিন্তু তবলা? অগত্যা দীনেশ একটি খাতা টেনে নিয়ে তার ওপরেই তবলার কাজ চালাতে লাগলাে। যেহেতু বাংলাদেশ নিয়েই গানটি লেখা আমিও তাই গানটি টেপে তুলে নিলাম। কারণ, আমরা এখন বাংলাদেশকে নিয়ে যা কিছু হতাে তাই রেকর্ড করে প্রচার করতে বিশেষ তৎপর ছিলাম। স্টুডিওতে ফিরে এসে শুনলাম আগের দিন ঢাকায় বঙ্গবন্ধু মুজিবের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ আমাদের স্টুডিওতে রেকর্ড করা হয়েছে। ভাষণটির গুরুত্ব বিবেচনা করে সংবাদ বিচিত্রায় তার কিছু অংশ প্রচার করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে। আমি কিন্তু ভাষণটি তখনও শুনিনি। স্বভাবতই মনটা দমে গেল। এতক্ষণ মনে মনে ছক কষছিলাম কামরুল হাসানের সাক্ষাৎকার আর অংশুমানের গান দিয়ে কিভাবে অনুষ্ঠান করা যায়। যাই হােক মুজিবের ভাষণটি শুনে দেখলাম বঙ্গবন্ধু জ্বালাময়ী ভাষায় বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানের একের পর বৈষম্যমূলক আচরণ আর পাক-বাহিনীর অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরেছেন। আহবান জানিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষকে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। মুজিবের সেদিনের সেই তেজোদৃপ্ত ঘােষণা আজও আমাকে উদ্দীপ্ত করে।

পৃষ্ঠা: ৭৩
“এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরাে দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে ইনশাল্লাহ।” সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম অংশুমানের গানের কিছু অংশ আর তার সংঙ্গে মুজিবের ভাষণের কিছু নির্বাচিত অংশ এমনি ভাবে পরপর গান আর ভাষণ দিয়ে সাজানাে হলাে সেদিনের সংবাদ বািচত্রা’। সেদিন গান আর ভাষণ দিয়েই তৈরি হলাে যে অনুষ্ঠান তা এবার বিপুল আলােড়নের সৃষ্টি করেছিল। অসংখ্য শ্রোতার দাবী ছিল অনুষ্ঠানটি বারে বারে প্রচারের জন্য। আমরা শ্রোতাদের সেই দাবী মেনে নিয়েছিলাম।
এই প্রসঙ্গে, আমার আরাে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। এই সংবাদ বিচিত্রা সেদিন প্রথম প্রচারিত হয়, তার পরের দিন স্বভাবতই খুশীমনে অফিসে পৌছেছি। সবার মুখে বঙ্গবন্ধুর সেই উদ্দীপ্ত ভাষণ আর অংশুমানের আবেগ ভরা সেই গানেরই আলােচনা। নীচে স্টুডিওতে ঢুকতেই আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে তখনকার অধিকর্তা দিলীপ কুমার সেনগুপ্তের মুখােমুখি হলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে তিনি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় আমাকে বললেন “কাল তুমি করেছ কি? তােমাকে আমি মেমাে দেব।” আমি তাে হতবাক! কি অপরাধ করে ফেললাম এর মধ্যে? কয়েকটি মুহূর্তমাত্র হঠাৎ জড়িয়ে ধরে দিলীপ বাবু আমায় বললেন, উপেন, কাল তুমি আমায় কাঁদিয়েছ। বিশ্বাস করাে তােমার সংবাদ বিচিত্রা শুনে কাল আমি কেঁদেছি। শুধু খারাপ কাজের জন্যই নয় ভাল কাজের জন্যও মেমাে খেতে হয়। সেদিনের সংবাদ বিচিত্রার জন্য সঙ্গে সঙ্গেই আমায় মেমাে পাঠিয়েছিলেন তবে তিরস্কারের নয় প্রসংশার। প্রসঙ্গতঃ বলি, আমাদের তখনকার কেন্দ্র অধিকর্তা দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের মতােই একাত্ম হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর প্রযােজিত সে সময়ের ‘রেডিও কার্টুন’ অনুষ্ঠানটির কথা নিশ্চয়ই এখনও অনেকের মনে আছে।
‘শােন, একটি মুজিবরের কণ্ঠে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি’-গানটি সঙ্গে সঙ্গেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। সেই সময় প্রতিদিনই একাধিক অনুষ্ঠানে অংশুমানের ডাক আসতে লাগলাে, আর শ্রোতাদের দাবি মতাে তাঁকে প্রতিটি অনুষ্ঠানে এই গানটি গাইতেই হােত। অংশুমান একদিন আমায় অনুযােগ করে বলেছিল, তুমি আমায় কি করে দিলে বলতাে? আমি কি আর অন্য কোন গান জানি না? যেখানেই যাই সেই এক দাবি ‘শােন একটি মুজিব আর শােন একটি মুজিব’ ভালাে লাগে এক গান গাইতে? পরে ওর গাওয়া এই গানের ক্যাসেটও অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। আজ আর অংশুমান নেই কিন্তু তার ঐ গানের মধ্য দিয়ে চিরদিন সে অমর হয়ে থাকবে। পরে আমার কোন কোন শিল্পী বন্ধু অভিমান করে বলেছেন, “তুমি অংশুমানকে এভাবে তুলে ধরলে অথচ আমার জন্যে কিছুই করলে না?” আসলে তারা বুঝতেই চান না এভাবে কেউ কাউকে তুলে ধরতে পারেনা। গানের ঐ ভাষা, ঐ মন মাতানাে সুর আর দরদী কণ্ঠ বঙ্গবন্ধুর সেই রক্তগরম করা ভাষণ আর সর্বোপরি দুই বাংলার মানুষের আবেগ আর উত্তেজনায় ভরা সে সময়ের পরিবেশ এই সবকিছু মিলিয়ে ঐ অনুষ্ঠানটি শ্রোতাদের মনকে আকর্ষণ করতে পেরেছিল।

পৃষ্ঠা: ৭৪
একদিন পলাশীর আম্রকুঞ্জে ভারতের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। সেই আম্রকুঞ্জ থেকে কিছু দক্ষিণে সীমান্তের ওপারে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর গ্রামে আর এক আম্রকাননে জন্ম নিল আনুষ্ঠানিকভাবে আর এক স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। আগের দিন সন্ধ্যায় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর তখনকার জনসংযােগ আধিকারিক শ্রদ্ধেয় সমর বসু আমাদের জানালেন পরদিন ভােরে জরুরী কোন কভারেজে তাঁর সঙ্গে যেতে হবে। আমরা যেন নির্দিষ্ট সময়ে প্রেস ক্লাবে হাজির থাকি। যথাসময়ে টেপ রেকর্ডার নিয়ে হাজির হলাম। কোথায় যাবাে, কেনই বা যাচ্ছি সমরদা তাে কিছুই বলেন নি। সাংবাদিক দলকে নিয়ে যখন গাড়ি ছাড়ল—তখন জিজ্ঞেস করতেই সেই মৃদু ধমক “চলই না বাবা বেড়িয়েই না হয় ফিরবে”। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রতিদিন তখন নানা নাটকীয় ঘটনা। প্রতি মুহূর্তেই টা টান উত্তেজনা। বাংলাদেশের ঘটনাবলীতে সারা বিশ্ব তখন আলােড়িত। এমনি টালমাটাল অবস্থায় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী সাংবাদিকদের নিয়ে ছুটছে অজানা এক ঠিকানার উদ্দেশ্যে। আমরা সবাই বুঝতে পারছিলাম বিরাট কিছু খবর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা যত উত্তেজনায় ছটফট করছি ততটাই নির্বিকার সমরদা। সেই নির্লিপ্ত কণ্ঠের একই জবাব “চলােই না জায়গায় গেলে তাে দেখতেই পাবে”। অবশেষে পৌঁছলাম সেই মেহেরপুরে। একটি অচেনা গ্রাম। নাম দেয়া হয়েছে ‘মুজিবনগর’। তৈরি হয়েছে ছােট একটি সভামঞ্চ। সেখানে ভিড় করেছেন আশপাশের অনেক গ্রামের অসংখ্য মানুষ। প্রচন্ড তাদের উৎসাহ আর উদ্দীপনা। কিন্তু সবার মধ্যে রয়েছে চাপা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। মনে পড়ছে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’ গানটি দিয়ে শুরু হলাে সভার কাজ। মঞ্চ থেকে এরপর ঘােষণা করা হােল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের উপস্থিতিতে একে একে শপথ গ্রহণ করলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং তাঁর মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যগণ। প্রতিটি ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে সমবেত জনতা উল্লসিত হয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন তা দেখেই আমাদের মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। ছােট্ট অনুষ্ঠান একেবারেই অনাড়ম্বর। কিন্তু সেদিনের জনগণের উন্মাদনা আজও আমাকে শিহরিত করে। সমরদার নীরবতার কারণ অবশ্য অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছেই বুঝি। কারণ তখনও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি।
পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর শুরু হলাে শাসকদের অমানুষিক অত্যাচার। এক সময়ে পাক হানাদার বাহিনী হঠাৎ কামান, রাইফেল, রকেট, মটার প্রভৃতি আধুনিক অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল অসহায় মানুষগুলাের ওপর। লক্ষ লক্ষ মানুষকে তারা হত্যা করল, লুণ্ঠিত হলাে অগণিত মা বােনদের ইজ্জত। শয়তান পাক-বাহিনীর নারকীয় অত্যাচারে বিপন্ন মানুষ সবকিছু হারিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে দলে দলে চলে এলাে ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। এক লক্ষ নয় দুই বা দশ

পৃষ্ঠা: ৭৫
লক্ষ নয় প্রায় এক কোটি বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষকে সে সময় আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। সল্টলেক এবং সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হয়েছিল হাজার হাজার ত্রাণ শিবির। একমাস-দুমাস নয় এক বছরেরও বেশী সময় ধরে এই এক কোটি উদ্বাস্তুকে খাদ্য বস্ত্র আশ্রয় আর চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছিল ভারত।
পশ্চিম বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থাও তখন ভাল ছিলনা। নকশাল এবং অন্যান্য আন্দোলনে রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থাও ছিল টালমাটাল। অথচ এই অবস্থায় পশ্চিমবাংলার মানুষ কিন্তু জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবকিছু ভেদাভেদ ভুলে এগিয়ে এসেছিলেন ওপারের অসহায় মানুষগুলাের সাহায্যে। সেদিন সাধারণ মানুষের এমন অকুণ্ঠ সহযােগিতা না পেলে কোন সরকারের পক্ষেই সম্ভব ছিল না এই বিরাট সমস্যা মােকাবেলা করার।
বাংলাদেশের অত্যাচারিত মানুষের হাহাকার প্রথমদিকে তেমনভাবে বিশ্বকে আলােড়িত না করলেও পাক-বাহিনীর ধ্বংসলীলার ব্যাপকতা নারকীয় অত্যাচারের বীভৎসতা ধীরে ধীরে অনেকের বিবেককেই দংশন করেছিল। বাধ্য হয়ে পরে অনেকেই ছুটে এসেছিলেন বাস্তুহারাদের অবস্থা নিজের চোখে দেখতে। এ সময়ের অনেক বিক্ষিপ্ত ঘটনার কথাই মনে পড়ে। আমি মাত্র দুটি ছােট ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করবাে।
সল্টলেকে উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে এসেছেন আমেরিকার সিনেটর রবার্ট কেনেডি। রবার্ট কেনেডি ছিলেন রাষ্ট্রপতি কেনেডির ভাই। আমি যথারীতি টেপ রেকর্ডার নিয়ে তার সঙ্গে ঘুরছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই লক্ষ লক্ষ মানুষের অসহায় অবস্থা দেখে স্বজন হারানাে মানুষগুলাের আকুল কান্নায়-দৃশ্যতই বিচলিত হয়ে উঠলেন। রবার্ট কেনেডি এক সময় যেন স্বগতােক্তির মতই বলে উঠলেন, “President should have come here and see for himself what is happening here!” ঘটনাটি এখনও মনে আছে এই জন্যে যে এটি আমার পেশাগত জীবনে এক নিদারুণ ব্যর্থতা। বিপন্ন মানুষগুলাের ভিড়ে সিনেটরের পাশে সেই মুহূর্তে সাংবাদিকদের মধ্যে একমাত্র আমি উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু আমি সিনেটরের স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত এই স্বগতােক্তিকে সেদিন আমার টেপরেকর্ডারে ধরে রাখতে পারিনি। আমি ভাবতে পারিনি হঠাৎ তিনি এভাবে ঐ কথাগুলি বলবেন। হয়তাে তিনিও ভেবে বলেননি। মানুষের কান্নায় বিচলিত হয়েই তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল মন্তব্যটি। আজও আমার কষ্ট হয় আর একটু সচেতন হলে হয়তাে টেপরেকর্ডার চালাতে ব্যর্থ হতাম না সেদিন।
আর একটি ঘটনা। ব্রিটেন থেকে ৪/৫ জনের এক সংসদীয় দল এসেছেন ভারতে উদ্বাস্তু শিবিরগুলির সত্যিকারের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। ভারতে আসার আগে তাঁরা পাকিস্তানের শিবিরগুলি দেখে এসেছেন। সে সময় পাকিস্তানও প্রচার চালাচ্ছিল যে ভারত থেকেও লক্ষ লক্ষ মুসলমান আক্রান্ত হয়ে ওপারের ত্রাণ শিবিরে

পৃষ্ঠা: ৭৬
আশ্রয় নিয়েছে। বনগাঁ সীমান্তে ত্রাণ শিবির পরিদর্শনে যাবার আগে তারা বললেন যে তাঁদের সঙ্গে কোন সাংবাদিককে যেতে অনুমতি দেবেন না। শিবির পরিদর্শন করে এসেই সাংবাদিকদের যা বলার বলবেন। আমি শুধু অনুরােধ জানিয়ে আকাশবাণীর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের সঙ্গে যাবার অনুমতি পেলাম। কারণ উদ্বাস্তুদের সঙ্গে তাঁদের কথাবার্তাও আমার রেকর্ড করা প্রয়ােজন। কিন্তু সংসদীয় দলের নেতা ফিরে এসেই আমার সঙ্গে কথা বলবেন তার আগে নয়। শিবির পরিদর্শনের কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি লক্ষ্য করলাম প্রতিনিধি দলের সবাই উদ্বাস্তুদের মর্মান্তিক বর্ণনায় বিচলিত। অসংখ্য মানুষ তাঁদের সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন—কেউবা আবার কাঁদতে কাঁদতেই পাক-বাহিনীর সেই নিদারুণ অত্যাচারের কাহিনী শােনাচ্ছেন। মুস্কিল হলাে প্রতিনিধি দলের সংঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে প্রতিনিধি ছিলেন তিনি বাংলাদেশের গ্রামের পূর্ববঙ্গীয় ভাষা তেমন বুঝতে পারছিলেন না-আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চার পাঁচ জন প্রতিনিধির প্রশ্নের জবাব দেয়া তার একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে, এক সময় দেখা গেল আমি সেই ব্রিটিশ সংসদীয় দলনেতার দোভাষীর কাজ করছি অর্থাৎ উদ্বাস্তুদের কথাগুলাে যথাসম্ভব ইংরেজি তর্জমা করে তাঁদের বােঝাবার চেষ্টা করছি। আমার বাড়তি সুবিধা ছিল আমি পূর্ববাংলারই ছেলে কাজেই পূর্ব বঙ্গীয় ভাষা আমার জানা। দোভাষীর কাজ করলেও এবার কিন্তু আমি আমার টেপরেকর্ডার চালাতে ভুল করিনি। একসময় দেখলাম সেই নেতা স্বগতােক্তির মতােই বিড়বিড় করে বলে চলেছেন, “Impossible! Inhuman it is a genocide.” এমনি। আরাে অনেক মন্তব্য। সুযােগ বুঝে তার সামনে মাইক ধরে আমার মােক্ষম প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিই, “এখানকার শিবির পরিদর্শনের আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। ” দ্বিধাহীন কণ্ঠে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “অকল্পনীয়–সহ্য করা যায় না। এভাবে সমগ্র জাতিকে ধ্বংস করা যায় না।” তিনি আরাে বলেন,“পাক বাহিনীর নিদারুণ অত্যাচারের সাক্ষী এই লক্ষ লক্ষ মানুষের অবস্থা দেখে সত্যি আমরা স্তম্ভিত।” সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা প্রশ্ন করি-“আর সীমান্তের ওপারে ত্রাণ শিবির গুলিতে আপনারা কি দেখে এলেন?” বিরক্তভাবেই সেদিন জবাব দিয়েছিলেন তিনি- “A few stray dogs! Nothing else!” অর্থাৎ পাক বেতারে এতদিন যে মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছিল যে ওপারের ত্রাণ শিবিরগুলিও এপার থেকে যাওয়া উদ্বাস্তুদের ভিড়ে পরিপূর্ণ বৃটিশ সংসদীয় দলের এই খােলাখুলি স্বীকারােক্তি মাঠে হাঁড়ি ভেঙে দিল-তাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রতিপন্ন করলাে। তারা বলে গেলেন ওপারে কয়েকটি মাত্র শিবির দেখা গেছে। আর সেখানে গুটিকয়েক রাস্তার কুকুর ছাড়া আর কিছুই তারা দেখতে পাননি। বৃটিশ সংসদীয় দলনেতার এই সাক্ষাৎকারটি সে সময় আমাদের বিদেশী প্রচার তরঙ্গেও বারে বারে প্রচার করা হয়েছিল এবং সত্যকে তুলে ধরতে সাহায্য করেছিল। প্রসঙ্গত বলি, পরে যখন ঐ দলনেতা সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন তখন কিন্তু এমন খােলামেলাভাবে তার মনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেননি। অনেক

পৃষ্ঠা: ৭৭
রেখেঢেকে কথা বলছিলাে। আসলে, বিশেষ মুহূর্তে যে কোন মানুষের সত্যিকারের চিন্তা-ভাবনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে। মাইক হাতে আমার লক্ষ্যই থাকত মানুষের ঐ দুর্বল মুহূর্তটিকে ধরে রাখা।
মেহেরপুরে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের পরের দিনই কোলকাতার তখনকার পাকিস্তানি ডেপুটি হাই কমিশনার মিঃ হােসেন আলী সদ্যঘােষিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করলেন। ছুটলাম টেপরেকর্ডার নিয়ে বাংলাদেশ মিশনে।মিঃ হােসেন আলীর সাক্ষাৎকার রেকর্ড করতেই শুনছিলাম-পাশের ঘরে বেগম আলীর আবেগ আর উত্তেজনায় ভরা কণ্ঠস্বর। মিঃ হােসেন আলীর সঙ্গে সাক্ষাত্তার শেষ হতেই অনুরােধ জানালাম মিসেস হােসেন আলীর একটি সাক্ষাৎকারের জন্য। কোনরকম দ্বিধা না করেই মিসেস হােসেন আলী বলতে রাজি হলেন। পাক-বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডবের বর্ণনা দিতে গিয়ে তখন তিনি আবেগ আর উত্তেজনায় কাঁপছিলেন। আমার মনে পড়ছে সাক্ষাৎকারটি শেষ করেছিলেন এই কটি কথা দিয়ে-“তাই আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না বাংলাদেশকে স্বাধীন কইরা দিলাম। উড়াইয়া দিলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।” কথা কয়টি আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে। কারণ, স্টুডিওতে এসে অনেকবার আমাদের লাইন দু’টি শুনতে হয়েছিল। আমরা দ্বিধায় ছিলাম কথাটা বেতারে প্রচার করা ঠিক হবে কি না? আসলে, মিসেস আলী তাে আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করতে পারেন না আর তিনি বাংলাদেশ মিশনে জাতীয় পতাকাও উড়াতে পারেন না। পারেন তার স্বামী মিঃ হােসেন আলী। কিন্তু মুশকিল হলাে যেভাবে উনি অত্যাচারের বীভৎস চিত্র তুলে ধরে ঘােষণাটি করেছিলেন সেখানে কাঁচি চালানাে সম্ভব ছিল না। আমাদের মনে হয়েছিল মিসেস আলী “আমি” বলতে সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের নিপীড়িত লাঞ্ছিত মানুষের প্রতিনিধি হয়েই বলেছিলেন। আর শ্রোতাদের মিসেস আলীর আসল বক্তব্যটি বুঝতে অসুবিধা হবে না। তাই আমরা সেদিন কোনরকম কাটছাট না করেই ঐ সাক্ষাৎকারটি আকাশবাণীর নানা তরঙ্গে বারে বারে প্রচার করেছিলাম। অসুবিধা হয়নি। কারণ, বহু শ্রোতা মিসেস আলীর আবেগ জড়িত কণ্ঠের এই সাক্ষাৎকারটির জন্য প্রশংসা করেছিলেন।
কয়েকদিন পরের বাংলাদেশ মিশনেরই আর একটি ঘটনা। মিসেস হােসেন আলী আমায় ফোন করে বললেন-“শীগৃগীর টেপরেকর্ডার নিয়্যা আমাদের এখানে আসেন।” ছুটলাম সেখানে। পার্ক সার্কাসে বাংলাদেশ মিশনে গিয়ে দেখি মিসেস আলী ১০/১২ বছরের একটি মেয়েকে নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। যেতেই বললেন-“পাকিস্তানি শয়তানদের অত্যাচারের আর একটি শিকার।” আমি টেপরেকর্ডার বের করতেই আতঙ্কিত হয়ে মিসেস আলীকে জড়িয়ে ধরে বললাে, “ওটা কি?” মিসেস আলী ওকে বুঝিয়ে বললাে। আমিও নানা কথায় ওর আপন হবার চেষ্টা করলাম। কিছুটা স্বাভাবিক হলে টেপ রেকর্ডার চালিয়ে ওর নাম জিজ্ঞেস

পৃষ্ঠা: ৭৮
করলাম। ধীরে ধীরে উত্তর দিল “আয়েশা”। প্রশ্ন করলাম, “বাংলাদেশে কি হয়েছিল বলাে আমায়।” এবার আতঙ্ক আর ভয়ে সরে দাঁড়ালাে। আস্তে আস্তে ওকে বুঝিয়ে বললাম, “তােমার আর ভয় নেই। তুমি আমাদের দেশে এসেছে। এখানে তােমাকে ওরা কিছু করতে পারবে না। ওরা এখানে আসবে কি করে?” আবার স্বাভাবিক হয়ে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলাে। কিভাবে ওর চোখের সামনেই ওর বাবা, মা আর সবক’টি ভাই-বােনকে শয়তানরা কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে। কিভাবে ওর ছােট বােনের রক্তে সারা উঠোন ভেসে গেল। এখানেই শেষ নয়। ছুরি দিয়ে কুপিয়ে কিভাবে সেই জায়গায় শুকনাে লঙ্কার গুড়াে আর নুন ছিটিয়ে দিয়েছিল ওরা। বলতে বলতে আয়েশা আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লাে। কিছুটা সুস্থ হলে আবার জিজ্ঞেস করি, “তুমি এখানে এলে কিভাবে?” উত্তরে ও জানাল কিভাবে পালিয়ে বাড়ির পাশেই পুকুরে কচুরিপানার মধ্যে শুধু নাকটুকু ভাসিয়ে রেখে সারাদিন লুকিয়ে ছিল। তারপর রাতের অন্ধকারে ভয়ে আর আতঙ্কে ছুটতে শুরু করেছিল। বলতে বলতে উদভ্রান্তের মতাে এক সময় কান্নায় ভেঙে পড়লাে। কান্না কিছুটা থামলে প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য প্রশ্ন করলাম, “তুমি গান জাননা?” সঙ্গে সঙ্গে “হ্যা” বলে আয়েশা গাইতে শুরু করলাে, “আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি।” দু’এক কলি গাইবার পরই ওর গলা ধরে এলাে। কান্নাভেজা কণ্ঠে গান থামিয়ে বললাে, “আমি আর পারছি না।” টেপরেকর্ডার বন্ধ করে স্টুডিওতে ফিরে এলাম।
জানি না কোন বিদেশী বাহিনীকে এভাবে স্বাগত জানাবার নজীর ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যাবে কি না? মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিকেল তখন ৪-২০ মিনিট। ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে সূর্য তখন অস্ত যেতে বসেছে। রেসকোর্স ময়দানে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ। অবশ্য তার আগে বেশকিছু সময়ের রুদ্ধশ্বাস নাটক। জল স্থল আর আকাশ পথে ঘিরে ফেলেছে পাকবাহিনীকে। বেতারে বারে বারে ঘােষিত হচ্ছে চরম বার্তা। অবশ্যই পাক বাহিনীর উদ্দেশ্যে। “হয় আত্মসমর্পণ করাে নয়তাে চরম পরিণতির জন্য প্রস্তুত হও! তােমাদের পালাবার কোন পথ নেই।” কোন উপায় নাই দেখে শেষ পর্যন্ত হানাদার বাহিনী মাথা নীচু করে এগিয়ে এল পরাজয় স্বীকার করে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলেন পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার কাছে। মনে পড়ছে সেই স্মরণীয় দৃশ্য! একদিকে পরাজিত পাক বাহিনীর সৈনিকেরা একে একে এসে যখন নত মস্তকে তাদের অস্ত্র সমর্পণ করছে তখন অপরদিকে গর্বিত ভারতীয় বাহিনীর সেনাদের নিয়ে ঢাকার রাজপথে জনতার সে কি উল্লাস! সমবেত জনতার উচ্ছাস আর অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে গেলেন সেদিন আমাদের সেনাপতি জেনারেল অরােরা।

Reference: বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ – উপেন তরফদার

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!