জীবনচিত্র নামঃ ডা. রফিক আহমেদ
Dr. Rafiq Ahmed
ডাকনামঃ রফিক
পিতার নামঃ মো. সিরাজউদ্দিন
পিতার পেশাঃ ডাক্তার, রেলওয়ে হাসপাতাল
মাতার নামঃ আছিয়া খাতুন
ভাইবোনের সংখ্যাঃ পাঁচ ভাই ও তিন বোন; নিজক্ৰম-দ্বিতীয়
ধর্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ উত্তর চাড়ীপুর মুক্তার বাড়ি,
ডাকঘর/থানা/উপজেলা/জেলা-ফেনী
শহীদ ডা. রফিক আহমেদ
নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ পাকশী রেলওয়ে কলোনি, ডাকঘর-পাকশী, উপজেলা/জেলা-পাবনা
জন্মঃ মার্চ ১৯১৮
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
ম্যাট্রিকঃ দ্বিতীয় বিভাগ, ফেনী পাইলট হাইস্কুল
আইএসসিঃ দ্বিতীয় বিভাগ, ফেনী কলেজ
এলএমএফঃ দ্বিতীয় বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
শখঃ গান, কবিতা। ভালো খাওয়া-দাওয়া। আতিথেয়তা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া
চাকরির বর্ণনা (সরকারি)
মেডিকেল অফিসারঃ ফেনী হাসপাতাল, নোয়াখালী হাসপাতাল, রামগঞ্জ হাসপাতাল, বেগমগঞ্জ হাসপাতাল, ফুলচুরীঘাট হাসপাতাল, ভরতখালী হাসপাতাল, লালমনিরহাট হাসপাতাল, বোনারপাড়া হাসপাতাল
রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার (আরএমও): চট্টগ্রাম হাসপাতাল, প্রদ্যুৎনগর হাসপাতাল, সৈয়দপুর হাসপাতাল, পাকশী রেলওয়ে হাসপাতাল
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ পাকসেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী, অবাঙালি ও বাঙালি রাজাকার।
নিহত হওয়ার তারিখঃ ১৩ এপ্রিল ১৯৭১
মরদেহঃ
প্রাপ্তি স্থানঃ পাকশী রেলওয়ে কলোনির বাসার সামনে পাকসেনারা দুর্বৃত্ত সহযোগে ডা. রফিক আহমেদ এবং তাঁর তিন পুত্রকে জবাই করে হত্যা করে। সেই সাথে রেলওয়ে হাসপাতালের হেড ক্লার্ককেও হত্যা করে। পরে ১৪ এপ্রিল হত্যাকারীরা সবাইকে একসাথে বাসার সামনে রাস্তার পাশে দাফন করে যায়।
প্রাপ্তিতারিখঃ ১৪ এপ্রিল ১৯৭১
সন্ধানদানকারীর পরিচয়ঃ প্রতিবেশী
কবরস্থানঃ পাকশী রেলওয়ে কলোনির রাস্তার পাশে
স্মৃতিফলক স্মৃতিসৌধঃ পরবর্তীকালে ডা. রফিক আহমদের অবশিষ্ট সন্তানরা রেলওয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সহায়তায় ঐ কবর পাকা করে। পাকশীতে ঐ কবরস্থান ‘পাঁচ শহীদের মোড়’ নামে পরিচিত।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ ডা. রফিক আহমদের স্ত্রী কিছুদিন সরকারি-বেসরকারিভাবে ৫০০ ও ১০০০ টাকা হিসেবে মাসিক ভাতা পেয়েছিলেন। বছর তিনেক পর তা বন্ধ হয়ে যায়
স্ত্রীর নামঃ বেগম ফাতেমা আহমেদ
বিয়েঃ জুন, ১৯৪০
সন্তান-সন্ততিঃ ১১ জন; পুত্রঃ আটজন, কন্যাঃ তিনজন। বর্তমানে পাঁচজন জীবিত
সাজেদা ইসলামঃ এইচএসসি, গৃহকর্ত্রী
আ জ ম জামাল উদ্দিনঃ ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (অব.), ওয়াপদা
এ এইচ এম বাহাউদ্দিনঃ বিএ (সম্মান) এমএ, ব্যবসায়ী
ডা. আ জ ম মেজবাহউদ্দিনঃ এমবিবিএস, সহকারী পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মহাখালী, ঢাকা। মেডিকেল অফিসার, সিভিল সার্জন রাঙ্ক।
আ জ ম জিয়াউদ্দিনঃ বিএ, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ পিতার সাথে শহীদ
ছালেহা খাতুনঃ বিএ (সম্মান) এমএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুগ্ম-প্রধান, পরিকল্পনা কমিশন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
ফেরদৌস আরা বেগমঃ বিএ, গৃহকর্ত্রী
আ জ ম রুকুন উদ্দিনঃ এমএ, ব্যবসায়ী
আ জ ম রকীব উদ্দিনঃ বিকম, সহকারী অ্যাকাউন্টট্যান্ট, বিজেএমসি
আ জ ম রইস উদ্দিনঃ অষ্টম শ্রেণী, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ পিতার সাথে শহীদ
আ জ ম ছাইফুদ্দিনঃ নবম শ্রেণী, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ পিতার সাথে শহীদ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নিকটাত্মীয়ঃ শহীদ ডা. রফিক আহমদের তিন পুত্র
আ জ ম জিয়াউদ্দিন
আ জ ম রইস উদ্দিন
আ জ ম ছাইফুদ্দিন
তথ্য প্রদানকারী
ছালেহা খাতুন
শহীদ চিকিৎসকের কন্যা
যুগ্ম-প্রধান, পরিকল্পনা কমিশন, শিল্প ও
শক্তি বিভাগ, ব্লক ন-৩, -১৮,
শোরেবাংলা নগর, ঢাকা। এবং
জলি ভিউ, ফ্ল্যাট নং-২সি, ২২/১৩-এ,
ব্লক-বি, খিলজী রোড, শ্যামল,
মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩০৩
আমার বাবা
শহীদ ডা. রফিক আহমেদ
ছালেহা খাতুন
হত্যাকাণ্ডের পটভূমি ও বিবরণ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ডাক্তার রফিক আহমেদ পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালে কর্তব্যরত ছিলেন। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতনের পর পাক প্ৰধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো যখন শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের আলোচনা বাতিল করে পাকসেনাদের বাংলাদেশে লেলিয়ে দেন তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পল্টনের বিশাল জনসভা থেকে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তারপর পাক সেনানায়ক টিক্কা খান বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ডাক্তার রফিক আহমেদ অর্থাৎ আমার বাবা তখনই বলতেন যে টিক্কা খান এসেছে, এখন দেশে টিকটিক করে আগুন জ্বলবে। আমার বাবা রাজনৈতিক কোনো দলের সাথে কখনোই সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে দেশের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে বাবা বলতেন, ব্রিটিশরা যত খারাপ ছিল পাকিস্তানিরা তার চেয়েও বেশি খারাপ; কাজেই কার হায়াত কতক্ষণ আছে বলা মুশকিল। ২৫ মার্চ ঢাকায় যখন পাকসেনারা অতর্কিত আক্রমণ চালায়। তখনই সমগ্ৰ দেশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এরই জের হিসেবে পাকশীতেও বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। আগেই লিখেছি, আমার বাবা তখন পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালের ডাক্তার। গণ্ডগোলের কারণে হাসপাতালের এ.ও.ম. ডি.ও.ম. সবাই বাবাকে চাবি দিয়ে সপরিবারে নিরাপদ জায়গায় চলে যায়। বাবা তখন সারা দিনরাত হাসপাতালের রোগী এবং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত।
এরপর ১২ এপ্রিল বিকেলে পাকশী গার্লস হাইস্কুলে বাঙালি রাজাকাররা কিছু অবাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সে কারণে ১৩ এপ্রিল পাকবাহিনী অবাঙালি ও বাঙালি রাজাকারদের সহায়তায় বাসায় বাসায় ঢুকে যেখানে যে বাঙালিকে পেয়েছে সেখানেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। উল্লেখ্য, এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই আমরা এবং বাবার অনেক বন্ধু বাবাকে চলে যাওয়ার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু বাবা বলতেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বাইরে বোম্বিং
৩০৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. রফিক আহমেদ
হচ্ছিল কিন্তু ফেনী হাসপাতালের ভেতরে আমি রোগীর চিকিৎসা করেছি। ওরা ডাক্তারদের মারে না। তাছাড়া আমার সাথে কারো শত্রুতা নেই। আর আমার ছেলেমেয়ে বেশি, এরকম দুঃসময়ে কাকে কষ্ট দেব! আমি গেলে হাসপাতালের রোগীদের কী হবে?’ ইত্যাদি। আমার বড় দু’ভাই তখন ঢাকায় লেখাপড়া করতেন। আমরা ছোটরা আম্মাসহ কুমিল্লায় বড় বোনের বাসায় গিয়ে আটকা পড়েছিলাম। বাসায় বড় দু’ভাই, ছোট দু’ভাই, কাজের ছেলে এবং বাবা ছিলেন।
আমি ১৩ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতারে রাত ৮টার খবরে হঠাৎ শুনতে পাই যে ঐদিন পাকশীতে পাকবাহিনীরা অবাঙালিদের সহায়তায় পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালের ডাক্তার রফিক আহমেদ এবং তাঁর তিন ছেলেকে বাসার সামনে হত্যা করেছে। খবরটা শুনে আমি প্রথমে হতভম্ব হয়ে পড়ি। তারপর মাকে কিছু না বলে বিষয়টা আমার আপা এবং দুলাভাইয়ের (চান্দিনা হাসপাতালের ডাক্তার শহীদুল ইসলাম) সাথে আলাপ করি। দুলাভাই তখন বিভিন্ন মারফতে খবর নিয়ে দেখে খবরটা সত্যি। পরে আমরা চিন্তা করতে থাকি বাসায় আমার আর একটা ভাই এবং কাজের ছেলে ছিল। ওদের কী হলো। তিনদিন পর হঠাৎ দেখি আমার বড় ঐ ভাই এ জেড এম মেজবাহ উদ্দিন এবং কাজের ছেলে হেঁটে হেঁটে গ্রামগঞ্জ দিয়ে কুমিল্লায় বড় বোনের বাসায় পৌঁছেছে। পরে তাদের কাছে সব জানতে পারি। পাকবাহিনী যখন আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যায় তখন ছোট দুটি ভাই বাবার সাথে বের হলে ওদেরও জবাই করে হত্যা করে। সেই সাথে রেলওয়ে হাসপাতালের হেড ক্লার্ককেও হত্যা করে। ওদের চিঙ্কার শুনে বড় ভাই খাটের তলা থেকে বের হয়ে ওদের দেখতে গেলে তাকেও মেরে ফেলে। অপর ভাই এবং কাজের ছেলে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল। তারা বের না হওয়ায় বেঁচে গেছে। পরে রাতে তারা দু’জনে বাসা থেকে বের হয়ে গ্রামগঞ্জ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বড় আপার বাসায় পৌছায়।
এরপর আমাদের জীবন-সংগ্রাম শুরু হয়। মায়ের স্নেহে এবং বড় ভাইবোনদের সহায়তায় বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত এবং প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা বড় হই। পরবর্তীকালে হত্যাকারীরা ১৪ এপ্রিল ১৯৭১ সালে পাকশী রেলওয়ে কলোনিতে আমাদের বাসার সামনে রাস্তার পাশে তাঁদের দাফন করে। পরে আমরা পাকশীর কলোনির স্থানীয় লোক এবং রেল কর্মকর্তাদের সহায়তায় বাবা ও ভাইদের কবরটি পাকা করে। নেমপ্লেট দিয়ে দিয়েছি। সময় পেলে মাঝে মধ্যে গিয়ে কবর জিয়ারত করে আসি। পাকশীতে ঐ কবরস্থানটি পাঁচ শহীদের মোড় নামে পরিচিত।
উল্লেখ্য, আমাদের বাসার কোনো জিনিস, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ইত্যাদি কিছুই আমরা আনতে পারিনি। সে কারণে বাবার কোনো রেকর্ডপত্র আমাদের কাছে নেই। আমরা যা জানি তাই লিখলাম।
ব্যক্তিমানুষ
আমরা আট ভাই এবং তিন বোন ছিলাম। আমার বড় এক বোন এবং চার ভাইয়ের পর আমার জন্ম। সে কারণে ভাইবোনদের মধ্যে আমার স্থান ষষ্ঠ। আমার বাবা কঠোর পরিশ্রমী, সৎ এবং আল্লাহভক্ত মানুষ ছিলেন। তিনি সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন। অতি সহজে সবাইকে বিশ্বাস করতেন। শিক্ষক এবং মৌলভিদের সম্মান করতেন। আতিথেয়তা, মানুষকে তৃপ্তি সহকারে খাওয়ানো ছিল তাঁর স্বভাবসুলভ আচরণ। বৈষয়িক সম্পদের প্রতি তাঁর কোনো লোভ ছিল না। সে কারণে তাঁর কোনো শত্রুও ছিল না।
আমার অত্যন্ত প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন আমার বাবা। তিনি আমাদের অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বাবা বাইরে থেকে ঘরে ফিরলেই প্রথমে খবর নিতেন আমরা ভাইবোনেরা কে কোথায় আছি? কী করছি? বাবা শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। তিনি আমার চাচা, মামাদের পড়াশোনা করিয়েছেন। কারো ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় ভালো রেজাল্ট করেছেন শুনলে আমার বাবা ভীষণ খুশি হতেন, সে যার সন্তানই হোক। আমাদের সর্বদাই বলতেন, ‘আমার জীবিতকালে তোমরা লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াও। মনে রাখা মানুষের টাকা-পয়সা, বাড়িঘর চুরি হয়, আগুনে পুড়ে যায়, পানিতে ডুবে যায়। কিন্তু বিদ্যা কেউ চুরি করতে পারে না। কাজেই লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকাটাই বড় সম্পদ। তিনি আরও বলতেন, ‘বিপদে কিংবা কষ্টে পড়লে ধৈর্যহারা হবে না। মানুষ দুনিয়াতে আসে একা, যায় একা। সর্বদা স্মরণ রাখবে-বল বল আল্লাহর বল। বল বল বাহু বল।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩০৫
শহীদ ডা. রফিক আহমেদ
আমার বাবা অত্যন্ত দৃঢ় মনোবলের লোক ছিলেন। কেউ তাঁর সাথে শত্ৰুতা করলে বা খারাপ ব্যবহার করলে তিনি তাঁর সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন। তাঁর মত হলো, খারাপ লোকের সঙ্গ ত্যাগ করবে। তবে শত্রুদের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন আচরণ করবে যাতে তারা তোমার প্রতি ক্ষুব্ধ না হয়। আমার বাবা অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে এমন সহজভাবে মেনে নিতেন যা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হতো। তাঁর অভিজ্ঞতার কারণেই হয়তো এটা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল। বাবা তাঁর রোগীদের কথা, পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়, দেশের রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলি নিয়ে প্রায়ই আমার সাথে খোলামেলা আলাপ করতেন। তিনি ছিলেন ব্যক্তি হিসেবে আমার কাছে স্মরণীয়, বরণীয়, অমর ও অক্ষয়। আমি জীবনে চলার পথে যখনই কোনো দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনায় পড়ি, তখন কেবলই বাবা-মায়ের কথা মনে হয়। বিশেষ করে বাবার উপদেশ, পরামর্শগুলো আমার কানে বাজে। আর স্বপ্নে দেখি বাবা আমাকে সাহায্য করছেন।
বাবার মৃত্যুকালে আমি এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী। প্রথমে আমি নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কাঁদতে পারিনি। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতাম। মনে হতে আমরা কি বাবার স্বপ্নের মানুষ হতে পারব। অতঃপর আমার স্নেহময়ী মা এবং বড় ভাইবোন ও ছোট মামার সাহায্য-সহযোগিতায় আল্লাহ আমাকে এ পর্যায়ে এনেছেন। বর্তমানে আমি বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে যুগ্ম-প্রধান হিসেবে কর্মরত আছি। আমি কখনোই তাদের ভুলতে পারি না। তাদের সহনশীল আচরণ, উৎসাহ, অনুপ্রেরণা আমার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আশার সঞ্চার করেছে। আমিও যে কোনোদিন মরে যাব। তবুও আমার মনে হয় আল্লাহ যেন আমার মতো কাউকে পিতৃহারা, স্বজনরা না করেন।
আমি ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা, নিজ ব্যক্তিসত্তা এবং আত্মমর্যাদাকে অধিক গুরুত্ব দিতাম। সে কারণে কারো অতিরিক্ত দয়া, কাউকে বেশি বিশ্বাস করা বা প্রশ্রয় দেয়া ও অযাচিত কোনো ঘটনাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারতাম না। এ প্রসঙ্গে আমার বাবা-মা আমাকে বলতেন, ‘কেউ তোমার প্রশংসা করলে বুঝবে সে তার কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এটা করছে। আর সমালোচনা করলে মনে করবে তুমি কোনো ভুল করছ। সুতরাং কখনো প্রশংসা শুনে খুশি হবে না। আবার সমালোচনা শুনে দুঃখ পাবে না। প্রতিমুহূর্তে নিজেকে শুধরাবার চেষ্টা করবে আর আল্লাহর ওপর ভরসা করবে। আমার মনে হয়, আমার বাবা-মার এই সহজ-সরল জীবনযাপনের জন্য এবং বৈষয়িক সম্পত্তির ওপর আকর্ষণ না থাকার জন্য আমাদের জীবনে অনেক উত্থানপতন, অনুকূল-প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছে ঠিকই কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা প্রত্যেকটা ভাইবোন গ্র্যাজুয়েট হতে পেরেছি। মোটামুটিভাবে নিজ চেষ্টায় জীবনযাপন করে যাচ্ছি। আমার বাবা-মার সৎ জীবনযাপনের জন্য আল্লাহর রহমতে আমার ভাইবোনেরা কেউ বিপথে যায়নি এটাই আল্লাহর কাছে আমাদের শুকরানা।
চিকিৎসক হিসেবে
বাবা নিয়মানুবর্তী মানুষ ছিলেন। তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্যে ছিল সকালে কোরআন শরীফ পড়া, নামাজ আদায় করা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথানিয়মে মসজিদে আদায় করা, নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে গিয়ে অফিসিয়াল কাজগুলো সম্পন্ন করা।
শহীদ ডাক্তার রফিক আহমেদ একজন সুচিকিৎসক ছিলেন। তাঁর রোগী এবং হাসপাতালের প্রতি তিনি অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন। বাবার রোগী দেখার কাজ ছিল সার্বক্ষণিক। অফিসের আগে-পরে দিন-রাত; একমাত্র মসজিদে যাওয়ার সময় ছাড়া তিনি কখনো রোগীদের ফিরিয়ে দিতেন না। বাবার খাওয়ার সময়, বিশ্রামের সময়, কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় ছিল না। হাসপাতাল আর রোগী দেখাই ছিল তাঁর একমাত্র জীবন। আমরা বিরক্তবোধ করলে তিনি বলতেন রোগী দেখাটা আমার ধর্মেরই একটা অংশ। জটিল রোগী হলে বাবার চিন্তার শেষ ছিল না। যতক্ষণ রোগী সুস্থ না হতেন ততক্ষণ বাবা খুবই দুশ্চিন্তাগ্ৰস্ত থাকতেন। তিনি মনে করতেন, ‘জনসেবা করে যেজন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর।’
বাবা খুবই কম ওষুধ দিতেন আর রোগীদের ব্যায়াম করার পরামর্শ দিতেন। আমার বাবা মেয়েদের বেশি। সম্মান করতেন এবং ভালোবাসতেন। রোগীরা এটা বুঝতে পারতো। অনেক রোগী বাবার থেকে প্রেসক্রিপশন
৩০৬ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. রফিক আহমেদ
এবং ওষুধ নিয়ে বাবাকে জিগ্যেস করতেন, ‘ডাক্তার সাহেব আপনার কয় মেয়ে?’ বারা বলতেন, ‘তিন মেয়ে। বড় মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। আর ছোট দুই মেয়ে স্কুলে পড়ে।’ তখন রোগীরা ফিস না দিয়ে ছোট দুই প্যাকেট চানাচুর আর দুটি চুল বাঁধার ফিতা দিয়ে দিত। বাবা ঐগুলো নিয়ে বাসায় এসে আমার হাতে দিলে আমি ভীষণ রাগ করতাম আর বলতাম, আপনি কেন নিলেন? আপনি রোগী দেখেছেন, নিয়মমতো ওনারা আপনাকে ফিস দেবেন। প্রতি উত্তরে বাবা জানাতেন, ওনাদের এখন আর্থিক অসুবিধা আছে তাই ফিস দেননি।
তিনি কোনোদিন কোনো রোগীর কাছে ফিস চেয়েছেন আমরা দেখিনি। যার ইচ্ছা ফিস দিত আর বেশিরভাগ এভাবে চুলের ফিতা এবং চানাচুর দিত। তাছাড়া কোনো রোগীর বাবা, বোন, ভাই, চাচা কেউ যদি ডাক্তার থাকতো তাহলে ঐ রোগীর ফিস চিরদিনের জন্য মাফ হয়ে যেত। এভাবেই আমার বাবা ডাক্তারি করেছেন। তাঁর রোগীরা কখনো অন্য ডাক্তারের কাছে যেত না। কারণ বাবাকে যে কোনো সময় ডাকলেই পাওয়া যেত আর ফিস ছাড়া রোগী দেখানো যেত।
দেশপ্রেমিক হিসেবে
ডাক্তার রফিক আহমেদ অত্যন্ত দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন যেখানে পোস্টিং হতে নির্দ্বিধায় চলে যেতেন। যেহেতু তিনি ডাক্তার ছিলেন, সেহেতু তিন বছর পরপর তাঁর বদলি হতো। এতে করে আমাদের পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হতো। বিশেষ করে স্কুল বদলির কারণে সিলেবাস পরিবর্তন হয়ে যেত। কিন্তু বাবা কখনো বদলি পরিবর্তনের জন্য তদবির করতেন না। তিনি কেবলি বলতেন, ডাক্তার হিসেবে জনসেবাই আমার মূল দায়িত্ব।
বাবা কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে কখনোই সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হোক, দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বসবাস করুক, এটা তিনি মনেপ্রাণে কামনা করতেন। তাই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, খাদ্যদ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি সবরকম সেবা দিয়ে যখন যেভাবে পারতেন নিজের অবস্থান থেকে সাহায্য করতেন। দেশের প্রতি দরদ ছিল তাঁর অপরিসীম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও তিনি ফেনী সদর হাসপাতালে আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩০৭
পশুর মতো মাটিতে শুইয়ে জবাই করলো
আ জ ম রকিব উদ্দিন
না, তাদের জানাজা হয়নি, যদিও তারা শুয়ে আছেন কবরে। আমার বাবা ডা. রফিক আহমেদ ছিলেন একজন সহজ-সরল অতি সাধারণ মানুষ। যার ছিল নিরহঙ্কার মন। ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। কখনো কারো প্রতি কড়া মেজাজে তাঁকে কথা বলতে শুনিনি। আমাদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল বন্ধুর মতো। আট ভাই ও তিন বোনকে নিয়ে কী যে শান্তির সংসার ছিল আজ তা চিন্তা করলে বড় কষ্ট হয়। ঐশ্বর্য ছিল না। কিন্তু শান্তি ছিল।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাক হানাদার বর্বর বাহিনী ঈশ্বরদীতে ঘাঁটি করলো। শুরু হলো বাঙালি নিধন। ৩ এপ্রিল বর্বর বাহিনীরা পাকশী নৰ্থ বেঙ্গল পেপার মিল জ্বালিয়ে দিল। ৫ এপ্রিল এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গাজী ও মুসলিম শহীদ হলেন। শহরের যুবক ভাইদের মতো আমার বড় ভাইয়েরা রাতে তীর-ধনুক নিয়ে শহরে পাহারা দিতেন। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ঐ শহরের আহত মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাসায় আসতেন। বাবা তাঁদের চিকিৎসা করতেন, ওষুধ দিতেন। বাবা এমনিতেই অনেক রোগীর কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতেন না। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পয়সা নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আহতদের সেবায় বাবা সারক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন।
১৩ এপ্রিল ১৯৭১। যে তারিখটি রক্তের অক্ষরে লেখা হয়ে আছে আমার বুকের গভীরে। ঐ দিনই হারিয়েছি আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি আমার বড় তিন ভাইকে। সকাল ৯টা। একটা জিপ ও একটা লরি এসে থামলো বাড়ির সামনে। চোখের নিমেষে সৈন্যরা বাড়ি ঘিরে ফেললো। আমরা সবে নাশতা খাওয়া শেষ করেছি। এর মধ্যে চার-পাঁচজন যমদূতের মতো অবাঙালি এসে ড্রইং রুমের দরজায় দুমদাম ধাক্কা দিলো। বাবা নিজেই ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। ওরা জানতে চাইলো ‘ডা. রফিক কে?’ বাবা বললেন, ‘আমি।’ আলবদররা জানালো, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে আমরা আপনাকে এসকট করে নিয়ে যেতে এসেছি।’
বাবাকে ড্রইং রুমে দাঁড় করিয়ে রাখলো। আলবদররা ছড়িয়ে পড়লো বাড়ির ভেতরে। প্রতিটি রুম, বাথরুম, রান্নাঘর তছনছ করে খুঁজলো। আমার বড় তিন ভাইকে খাটের নিচে পাওয়ার পর টেনে-হিঁচড়ে বের করলো। এর পরের ঘটনা
৩০৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. রফিক আহমেদ
কীভাবে লেখা সম্ভব? কলম সরতে চায় না। কতটা নির্মমই না ছিল সে দৃশ্য! আমারা বাইরে এসে দেখি বাড়ির সামনে বড় দুই ভাইকে অবাঙালিরা পশুর মতো মাটিতে শুইয়ে জবাই করেছে। তাঁরা কলেমা তৈয়্যব পড়তে পড়তে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে আমার আরেক ভাই পালাতে চাইলো। বাবা অবাঙালিদের জিগ্যেস করলেন, ‘আমার ছেলেদের কেন হত্যা করা হলো? তারা তো কোনো দোষ করেনি। আমাকে অজু করার সময় দাও… ‘কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই তাঁর পেটের ভেতর অবাঙালি গুণ্ডারা বেয়নেট দিয়ে। খোঁচাতে লাগলো… বাবা কলেমা পড়তে পড়তে মাটিতে শুয়ে পড়লেন…। তারপর কারফিউ জারি করা হলো।
এই লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড দেখে তখন আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। ১৪ এপ্রিল কারফিউ শিথিল হলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা শ্ৰদ্ধেয় বাবা ও তিন ভাইয়ের লাশ একত্রে বাড়ির সামনে কারা যেন কোনো রকম গোসল-জানাজা ছাড়াই মাটি চাপা দিয়ে চলে যায়। একই সাথে নিহত রেলওয়ে হাসপাতালের হেড ক্লার্ককেও সমাধিস্থ করে। কবর দেয়ার সময় তাঁরা দেখেছিল ডা. রফিক আহমেদ ও তাঁর তিন ছেলের শরীরে কোনো মাছি বসেনি। মনে হচ্ছিল এই মাত্র তাঁরা মারা গেছেন। তাঁদের কবরের নামানুসারে পাকশি রেলওয়ে কলোনির সামনের রাস্তার মোড়টার নাম দেয়া হয়েছে পাঁচ শহীদের মোড়। বাবা ও তিন ভাইকে হারাবার পরপরই দুই বোনসহ মাকে নিয়ে পায়ে হেঁটে কীভাবে যে দীর্ঘ চার মাস ২০ দিন পর চান্দিনায় বড় বোনের বাড়িতে উঠলাম মনে করতে পারছি না বলে কলম তুলে নিচ্ছি।
(*গোলাম মোর্তজা সম্পাদিত ভুলি নাই ভুলি নাই, স্বাধীনতার পঁচিশ বছর, স্বাধীনতা অনন্তকালের থেকে সঙ্কলিত)
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রকাশকাল; ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ ।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকাঃ বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কাৰ্যালয় বিএমএ ভবনে (তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার; প্রকাশকাল: আষাঢ় ১৩৯১ জুন ১৯৮৪; ৮ম খন্ড; পূ. ৭০৭ ।
ঘ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ৯ম খণ্ড প্রথম পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ কার্তিক ১৪০৬, নভেম্বর ১৯৯৯; পূ. ৫৭।
ঙ. *ভুলি নাই ভুলি নাই, স্বাধীনতার পঁচিশ বছর, স্বাধীনতা অনন্তকালের; সম্পাদনাঃ (গোলাম মোর্তজা; প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশ; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি বইমেলা ১৯৯৭; পূ. ৬০-৬১ ।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩০৯
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ