You dont have javascript enabled! Please enable it!

জীবনচিত্র   নামঃ ডা. মিহির কুমার সেন

Dr. Mihir Kumar Sen

ডাকনামঃ শঙ্কর সেন

পিতার নামঃ হেমচন্দ্র সেন

পিতার পেশাঃ আইনজীবী

মাতার নামঃ সাধনাময়ী সেনগুপ্ত

ভাইবোনের সংখ্যাঃ দুই ভাই ও চার বোন; নিজক্ৰম-তৃতীয়।

ধর্মঃ সনাতন (হিন্দু)

স্থায়ী ঠিকানাঃ মোক্তারপাড়া, ওয়ার্ড-৭,

ডাকঘর-নেত্রকোনা-১৮০০, উপজেলা/জেলা-নেত্রকোনা

 

শহীদ ডা. মিহির কুমার সেন

 

নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ ঐ

জন্মঃ ১৯৩৬ খ্রি.

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ

ম্যাট্রিকঃ দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়, নেত্রকোনা

আইএসসিঃ বিদ্যাসাগর কলেজ, কলকাতা

এলএমএফঃ লিটন মেডিকেল স্কুল, ময়মনসিংহ, ১৯৫৯-১৯৬০

শখঃ সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, বিশেষত গান-বাজনা

সমাজসেবাঃ বিএমএ, নেত্রকোনা (মহকুমার) শাখার সদস্য

চাকরির বর্ণনাঃ

অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন, ঠাকুরকোনা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, ঠাকুরকোনা, নেত্রকোনা

অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন, মদনপুর স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, মদনপুর, নেত্রকোনা

অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন, দিঘাপাইত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, জামালপুর

হত্যাকারীর পরিচয়ঃ পাক হানাদার বাহিনী

নিহত হওয়ার তারিখঃ ১৫ বৈশাখ ১৩৭৮, ২৯ এপ্রিল ১৯

মরদেহঃ পাওয়া যায়নি

স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ নেই

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ২০০০ টাকা (রাষ্ট্ৰীয় চেক)

স্ত্রীর নামঃ কৃষ্ণা সেনগুপ্ত

বিয়ে : ২১ মাঘ, ১৩৭২ বঙ্গাব্দ

সন্তান-সন্ততিঃ দুইজন পুত্র, দুইজন কন্যা

কবিতা সেন গুপ্তঃ এমএসএস, বিএসএস, অর্থনীতি (সম্মান) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এমফিলের ছাত্রী, গৃহিণী

পিনাকী সেনগুপ্তঃ ডিপ্লোমা প্রকৌশলী (তড়িৎ), গ্রামীণ শক্তি, বিভাগীয় ব্যবস্থাপক, সুনামগঞ্জ

রুমা সেনগুপ্তঃ বিএসসি (এজি) (সম্মান), বাকৃবি, ময়মনসিংহ, আরডিআরএস, রংপুর

ধূতব্রত সেন লিটনঃ এমএসএস, বিএসএস, (সম্মান) (অর্থনীতি), প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণ বিভাগ, প্রশিকা

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নিকটাত্মীয়ঃ

হেমচন্দ্র সেন (শহীদ ডা. মিহির কুমার সেনের পিতা);

অখিলচন্দ্র সেন (শহীদ ডা. মিহির কুমার সেনের জ্যাঠা)

 

তথ্য প্রদানকারী

ধৃতব্ৰত সেন লিটন

শহীদ চিকিৎসকের ছোট ছেলে

প্রশিকা আরডিআরডিসি, ময়মনসিংহ,

৩৭, ব্রাহ্মপল্লী, ময়মনসিংহ

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ২৮৯

 

আমার বাবা

শহীদ ডা. মিহির কুমার সেন

ধৃতব্ৰত সেন লিটন।

 

উনিশ শ’ একাত্তর! মাৰ্চ-এপ্রিলে উত্তাল সারাদেশ। প্রতিরোধের স্পৃহা ও মুক্তির সংগ্রামে ক্ষেপেছে বাঙালি জনতা। অন্যদিকে, পাক হানাদার বাহিনী ও দখলে নিচ্ছে এক এক জেলা, সাবেক মহকুমা, থানা, গ্রাম। প্রয়োজনে বোমা ফেলছে। ধ্বংস করে দিচ্ছে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ব্যুহক’দিন আগে বোমা ফেলা হয়েছে নেত্রকোনা মহ কুমাতেও। সবাই ভীত-সন্ত্রস্তমুক্তিবাহিনী সংগঠিত হচ্ছে প্রতিরোধ সংগ্রামে। ব্যতিব্যস্ত পাক হানাদার বাহিনীএমনি পরিস্থিতিতে নেত্রকোনার ঠাকুরকোনার স্বাস্থ্য প্রকল্পে কর্মরত(জেলা বোর্ডের অধীনে) তিরিশোর্ধ্ব ডা. মিহির কুমার সেন।

নেত্রকোনা শহর পাক হানাদার বাহিনী এখনো দখলে নেয়নি। ডা. মিহির কুমার সেনের পরিবার তখন শহর ছেড়ে গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। হঠাৎ সেন পরিবারের কাছে খবর পৌঁছায় শহরে তাদের অরক্ষিত বাড়ি দখল। করার প্রস্তুতি চলছে। ডা. মিহির কুমার সেন মনে করলেন, শহরে গিয়ে বাসাটা একটু গোছগাছ করে রেখে আসা দরকার। শহরে যাত্রাকালে সঙ্গে নিলেন দুই শ্যালক সিদ্ধার্থ ও শঙ্কর সেন এবং পরিবারের বিশ্বস্ত লোক করুণা সরকারকে। তাঁরা মগড়া নদী পেরিয়ে, সদর রাস্তা পেরিয়ে শহরে প্রবেশ করলেন। পথিমধ্যে বিলম্ব ঘটেছে তাদের যাত্রায়। অবশেষে নদী পেরিয়ে শহরে ঢুকলেন মহকুমা প্রশাসকের (বর্তমান জেলা প্রশাসকের) বাসভবনের পাশ দিয়ে। প্রবেশ মাত্রই টের পেলেন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে মৃত্যুদূতের সাক্ষাৎ উপস্থিতি। পরিবারের সঙ্গীদেরসহ তিনি পড়ে গেলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ট্রাকের সামনে। ওইদিনই সবেমাত্র মহকুমা সদরে প্রবেশ করেছে পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী। ট্রাকে দাড়িয়ে ঘাতক বাহিনীর প্রবেশের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা পর্বে নেতৃত্ব দিয়েছেন শহরের একটি প্রাচীন ও বেসরকারি স্কুলের সর্বজনবিদিত একজন শিক্ষক। তিনি ডা. মিহির, সিদ্ধার্থ ও শঙ্করের স্কুলজীবনের শিক্ষক। ইতোমধ্যে পাক হানাদার বাহিনী শহরে প্রবেশের সাথে সাথে মুক্তিফৌজের লোক সন্দেহে ট্রাকলরিতে তুলে নিয়েছে ক’জনকে। সামনে যাকেই পাচ্ছে,

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ২৯০

 

শহীদ ডা. মিহির কুমার সেন

 

সন্দেহের বশে তুলে নিচ্ছে ট্রাকে। তাদের হিংস্র থাবায় মিহির সেন ও তার সহযোগীরাও রেহাই পেলেন না। দু’পক্ষের মুখোমুখিতে ঐ স্কুল শিক্ষকের অশুভ ইঙ্গিত, ‘ওরা হিন্দু ও মুক্তিফৌজের লোক। মুহূর্তের মধ্যে তুলে নেয়া হলো ট্রাকে।

ডা. মিহির কুমার সেনের শহরে পেশাদারি খ্যাতি ছিল তখন। শ্যালক সিদ্ধাৰ্থ ছিল ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও নেত্রকোনা সরকারি কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্র। সুরেলা কণ্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে শহরের পরিচিত মুখঅপর শ্যালক শঙ্কর এসএসসি পাস করে তখন কলেজের দ্বারপ্রান্তে। পরিবারের বিপদে-আপদের সাথী ঝরনা সরকার মাঝবয়সীবাড়ি নেত্রকোনার আটপাড়া থানার মঙ্গলসিদ্ধ গ্রামে। পাক হানাদার বাহিনী অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, একাত্তরে দেশের জন্য সহায়তাকারী ও মুক্তিফৌজের প্রত্যেকটি ঘর হলো তাদের বিরুদ্ধশক্তি। তাই তারা মুক্তিফৌজের নাম-নিশানা মুছে ফেলার নেশায় মাতলোট্রাকে করে তুলে নিয়ে গেল ডা. মিহির সেনসহ অপর সহযাত্রীদেরনেত্রকোনার পূর্বধলা সড়কের ত্রিমোহনী ব্রিজের ওপর। দিনটি ছিল ১৫ বৈশাখ ১৩৭৮ বাংলা । লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয় ডা. মিহির সেন, সিদ্ধার্থ, শঙ্কর ও করুণাকে। গুলিতে সবাই মারা গেলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেন শঙ্কর। একসাথে বাঁধা দড়ির টানে টানে তিনি একটু আগেই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পানিতে পড়ে যাওয়ার পর শঙ্করকে টার্গেট করে বেশ ক’টি গুলি করে হানাদার বাহিনীগুলি লাগে হাতে, পায়ে এবং বুকে। তবুও তিনি বেঁচে যান।

ঘাতক বাহিনী স্থান ত্যাগ করলে মৃতপ্রায় শঙ্করকে নদী থেকে বাঁশ ফেলে তুলে আনেন ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী পরিবারের সদস্যরা। সিদ্ধার্থ ও শঙ্করকে তাঁরা চিনতেন। তাদের সহায়তায় রাতের আঁধারে চলে শঙ্করের শরীরে অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা সেবা। সুস্থ হয়ে উঠছিলেন (প্রায় ৮ বছর বেঁচে তিনি ১৯৭৯ সালে মারা যান)।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়।

ডা. মিহির সেনের পিতা হেমচন্দ্র সেন এবং জেঠা অখিল চন্দ্র সেন দু’জনই তখন শহরের খ্যাতিমান উকিল। শহরের অবস্থা তাদের ভালোগভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে শহরের পরিস্থিতি ভালো জানিয়ে খবর পাঠানো হলো অখিল সেনকে গ্রামের বাড়িতে। খবর পাঠালেন দীর্ঘদিনের এক প্রতাপশালী সহকৰ্মী। বন্ধুদের ভরসায়, মাটির টানে, সন্তানহার যন্ত্রণায় সপরিবারে শহরে ফিরে এলেন দু’ভাই। ২২ শ্রাবণ ১৩৭৮ (ডা. মিহির সেন শহীদ হওয়ার তিন মাস পরই) দিবাগত রাত ২টায় রাজাকার সোনা মিয়া গংরা বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় তাদের৷ মোক্তারপাড়া ব্রিজে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে দুই ভাইকে। মৃত্যুকালে ঘনিষ্ঠ আশ্রয়দাতাদের নাম ধরে ডেকেও কোনো সাড়া পাননি হতভাগ্য দুই ভাই।

বাঙালির রক্তস্নাত এ বাংলায় মুক্তির সংগ্রামে, রক্তের মোহনায় মিশেছে এদের রক্তএরা অমর। এদের ঋণ কি সহজে ভোলা যায়? সিদ্ধার্থের স্মৃতির মিনার আজও নেত্রকোনা বহন করে চলেছে। স্থানীয়দের উদ্যোগে ও ছাত্রনেতাদের প্রচেষ্টায় শহরের সাতপাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধের পাশে শোভা পাচ্ছে ‘সিদ্ধার্থ স্মৃতি মিনার।’ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এদের আত্মদানে যে স্বাধীনতা তা কি শুধু একখণ্ড পতাকা কিংবা জাতীয় সঙ্গীতে বৃত্তাবদ্ধ হয়ে থাকবে? যদি তাই হয় তাহলে শহীদ পরিবারের বাকি সদস্যরা কী সান্ত্বনা নিয়ে বাঁচবে?

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ২৯১

 

সিঁদুর যাদের মুছে গেল

আতোয়ার রহমান

 

একাত্তরঃ নির্যাতনের কড়চা

সম্পাদনাঃ আতোয়ার রহমান

প্রকাশনাঃ দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড

প্রকাশকালঃ ১৯৯২; পৃ. ৫১-৫৬

 

সাংসারের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে নেত্রকোনা শহর থেকে মাইল দুয়েক দূরের গ্রাম কালিয়াটির বাসিন্দা হেম সেনের স্ত্রী সাধনাময়ী সেন আর তাঁদের ছেলে ডা. মিহিরকুমার সেনের স্ত্রী শিবানী সেনকেও। তাঁদের সাংসারিক অবস্থা ছিল যথেষ্ট সচ্ছল।

সাধনাময়ীদের করুণ কাহিনী শুনেছি আমার প্রতিবেশিনী কল্পনা গুপ্তের কাছে। তাঁরা তার বড় দাদার শ্বশুর পরিবারের মানুষ।

এই পরিবারের সদস্য হেম সেনরা ছিলেন চার ভাই। পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে দু’ভাই আগেই ভারতে চলে যান। দেশ ছাড়তেন হেম সেনও। কিন্তু বাধা আসে মন থেকে। বড় দাদা অখিল সেন বৃদ্ধ, বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান। তবু ছোট ভাইয়ের ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখেই দিন কাটানহেম সেন তাঁকে একা ফেলে রেখে চলে গেলে তাঁর দশা দাঁড়াবে কেমন? দাদার প্রতি মমতায় তিনি দেশ ছাড়বার কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলেন।

অখিল সেন, হেম সেন এক সম্ভ্রান্ত বনেদি পরিবারের সন্তান। কালিয়াটিতে পৈতৃক ভদ্রাসন। সেখানকার দালানকোঠা, জমিজমা, পুকুর ইত্যাদি সাক্ষ্য দেয়, তাঁরা প্রাক্তন জমিদার। এদিকে, পেশায় দুই ভাই-ই আইনজীবী। পসার ভালোথাকেন তাঁরা নেত্রকোনা শহরের মোক্তারপাড়ায়, টিনের ছাদওয়ালা কিন্তু পাকা দেয়ালের এক বিরাট বাংলো প্যাটার্নের বাড়িতে। হেম সেনের বড় ছেলে মিহির ডাক্তার। নেত্রকোনার মদন থানায় চাকরি করেন। স্ত্রী এবং চারটি শিশুসন্তান নিয়ে তিনি সেখানেই থাকেন।

একাত্তরের এপ্রিল মাস। হানাদার বাহিনী নেত্রকোনার দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের সহচর দেশের শত্রু রাজাকারের দল। হানাদাররা বাঙালিদের ধরে, মারেরাজাকাররা চালায় লুটতরাজ। অনেক দিন থেকেই তাদের

 

 

২৯২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

শহীদ ডা. মিহির কুমার সেন

লোভী চোখ ছিল সেন পরিবারের ধনসম্পদের ওপর। তাঁদের যদি দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া কিংবা দুনিয়া থেকে একেবারে সরিয়ে ফেলা যায়, তাহলে ওই সম্পদ আসবে তাদেরই দখলে। কিন্তু সেসবের কথা থাক, আপাতত বড় প্রয়োজন প্রাণের নিরাপত্তার । অখিল সেন, হেম সেন তাই শহরের বাড়ি ছেড়ে চলে যান কালিয়াটিতে। মগড়া নদীর ওপারে। সেখানকার পরিস্থিতি একটু ভালো।

মাস দুয়েকের মতো তাঁরা কালিয়াটিতেই ছিলেন, নানারকম ভাবনাচিন্তা নিয়ে। জুন মাসের শেষ দিকে তাঁদের মনে হয়, শহরের বাড়িটার একটু খবর নেয়া দরকার। সেখানে অনেক জিনিস পড়ে আছে। সেগুলাোর এখন কী হাল, কে জানে?

ইতোমধ্যে ডা. মিহির সেনও সপরিবারে কালিয়াটির বাড়িতে এসে উঠেছেন। ঠিক হয়, নেত্রকোনা শহরের বাড়ির অবস্থা জানতে তিনিই যাবেন। তবে একা নয়। তাঁর দুই শ্যালক-শঙ্কর এবং সিদ্ধার্থ সঙ্গে থাকবেন।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিনজনে সকালে শহরে গিয়ে বিকেলেই গ্রামের দিকে রওনা হন। শহরের বাসায় পুরনো ভূত্য বৃদ্ধ রামুকে নিয়ে। এর মধ্যে তেমন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু শহর থেকে বেরিয়ে খানিক দূর এগোতেই যেন অকস্মাৎ বিনা মেঘে বজ্ৰপাত হয়তাঁরা জানতেন না, সেদিনই হানাদারদের গাড়ি প্রথম নদী পেরিয়ে শহরে ঢুকেছিলতিনজনে ওই গাড়ির সামনে পড়ে যান। তারপর ঘটনার আকস্মিকতায় আতঙ্কিত এবং হতবুদ্ধি তিনজনেই দৌড় দেন; পালানোর চেষ্টা করলে হানাদারদের মনে সন্দেহ জাগাতে পারে, এ হিসাব না করেই। এর ফল যা হওয়ার তা-ই হয়। তাঁদের পালাতে দেখেই হানাদাররা রাইফেল উঁচিয়ে হুকুম ঝাড়ে, হল্ট।

সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা থেমে যান। আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত তুলে দাঁড়ান। হানাদাররা তখন গাড়ি থামিয়ে তাদের উঠিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

ক্যাম্পে গিয়ে ডা. মিহির সেন দেখতে পান, প্রতিবেশী এবং পরিচিত অনেকেই সেখানে আছে। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে চোখে পড়ে এক লোক। সে রীতিমতো বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং জনপ্রিয় আর লোকহিতৈষীসবাই তাকে ‘হক চাচা’ বলে ডাকে। তাকে দেখে মিহির আশ্বস্ত বোধ করেন। সে নিশ্চয়ই তাঁদের ছাড়িয়ে নেবে।

রাতটা তাঁদের মিলিটারি ক্যাম্পেই কাটে। এর মধ্যে হানাদারদের সাথে হিতৈষী চাচার কী কথাবার্তা হয়, তাঁরা জানেন না। কিন্তু সকালবেলা দেখেন, কয়েকজন বন্দুকধারী তাঁদের চারজনকে ঘিরে ধরেছে। কোথায় জানি নিয়ে যাবে।

কিন্তু মিহির যেতে আপত্তি জানান। তাঁর ভয়, লোকগুলো তাঁদের মেরে ফেলবে। তিনি বিশিষ্ট লোকটিকে বলেন, চাচা, ওরা আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে চায়? আপনি তো জানেন, আমার কোনো দোষ নেইআমাদের কথাটা ওদের একটু বুঝিয়ে বলুন না!

কাকে কী বলা? মিহিরদের ধরিয়ে দিয়েছিল তা আসলে সে-ই। তাদের সম্পত্তি বাগানোর জন্য।

চাচা উত্তর দেয়, না, না, তোর কোনো ভয় নেই। কিছু করবে না। ওদের সাথে চলে যা।

ডা. মিহির সেন হানাদারদের সাথে যেতে আর আপত্তি করেননি। বন্দুকধারীরা তাঁদের চারজনকে নিয়ে গিয়ে মগড়া নদীর পুলের ওপর দাঁড় করায়। কাছেই যাঠে খোঁটায় বাঁধা গরু চরছিল। হানাদারদের একজন গিয়ে গরু ছেড়ে দিয়ে দড়ি নিয়ে আসে। সেই দড়িতে চারজনকে জড়িয়ে বেঁধে ফেলে। তারপর তাঁদের লক্ষ্য করে চালায় গুলিতাতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া, রক্তাক্ত দেহগুলো নদীতে গড়িয়ে পড়ে। তবু হানাদারদের বন্দুক থামে না। তখন বিকেল তিনটা-চারটা।

এই ঘটনার কথা অন্য কারো জানার উপায় ছিল না। তবু লোকে জেনে ফেলে শঙ্করের মুখে। তাঁদের যখন দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়, তিনি প্রাণ বাঁচানোর জন্য একটু চেষ্টা করেন গায়ে কয়েকটি মোচড় মেরেতাতে বাঁধন একটু আলগা হয়ে যায়। আর গুলির মুহূর্তখানেক আগেই তিনি নদীতে গিয়ে পড়েনসেখানে ডুব দিয়ে খানিকটা দূরে সরে যানএতে তিনি প্রাণে রক্ষা পান। বন্দুকধারীরা যখন নদীতেও গুলি চালায়, তাঁর শুধু পায়ে গুলি লাগে।

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ২৯৩

 

শহীদ ডা. মিহির কুমার সেন

 

হানাদাররা চলে গেলে তিনি নদী থেকে ওঠে আসেন। সাবধানে, অতি কষ্টে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তীরের অদূরে একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে একটু সুস্থ হয়ে আবার আসেন নদীর ধারে; দেখেন, তাঁর সঙ্গী-প্ৰিয়জনদের সবাই এক দড়িতেই বাঁধা অবস্থায় নদীতে ভাসছেন।

আশপাশের লোকজনের সাহায্যে তিনি কালিয়াটির বাড়িতে ফিরে আসেন; যেখানে তাঁদের অপেক্ষায় মিহিরের বাবা, জেঠা, মা এবং স্ত্রী তাঁর অবোধ শিশুদের নিয়ে গভীর উৎকণ্ঠায় প্রহর গুনছিলেন। শঙ্করের মুখে নিদারুণ দুঃসংবাদ শুনে সবার পাঁজর ভেঙে যায়। বৃদ্ধ বাবা-জেঠা বারবার আর্তনাদ করে বলতে থাকেন, আমরাই ওদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি। কেন ওদের পাঠিয়েছিলাম শহরে?

 

 

প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ

ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা; বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কাৰ্যালয়, বিএমএ ভবনে (তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)

থ. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্রাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি, পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনপ্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯৮; পৃ. ২৬, ৪৩। গ. একাত্তরঃ নির্যাতনের কড়চা; সম্পাদনা; আতোয়ার রহমান; প্রকাশনাঃ দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড; প্রকাশকালঃ ১৯৯২; পৃ. ৫১-৫৬।

ঘ. সেই রাজাকার; প্রকাশনাঃ মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, জনকণ্ঠ প্রকাশনী; প্রকাশকাল; জুলাই ২০০১;  পূ. ২৪৪ ৷

 

 

২৯৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!