জীবনচিত্র নামঃ ডা. মোহাম্মদ শামশাদ আলী
Dr. Mohammad Shamshad Ali
ডাকনামঃ আচ্ছা সাহেব
পিতার নামঃ আলহাজ্ব ক্যাপ্টেন ডা. আবুল হোসেন
পিতার পেশাঃ ডাক্তার কাম ক্যাপ্টেন
মাতার নামঃ আনওয়ারী বেগম
ভাইবোনের সংখ্যাঃ ছয় ভাই ও তিন বোন; নিজক্ৰম-দ্বিতীয়
ধর্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ মাজাফ্ফর নগর, ওয়ার্ড নং-৩, নতুন ৰাজার,
পার্বতীপুর ফার্মেসি, উপজেলা-পার্বতীপুর, জেলা-দিনাজপুর
শহীদ ডা. মোহাম্মদ শামশাদ আলী
নিহত/নিখোঁজ হওয়ার সময় ঠিকানাঃ ঐ
জন্মঃ ৯ মার্চ ১৯৩৪ । এলাহাবাদ (বিহার), নানার বাড়ি
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
এমবিবিএসঃ ১৯৬৩ (অনুমেয়), মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
শখঃ
গানের ভক্ত ছিলেন। নিজেও চমৎকার গান গাইতেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত। যদিও প্রতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছিল না।
খেলাধুলা পছন্দ করতেন। পার্বতীপুরের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়া সংগঠন ‘প্রগতি সংঘ’ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান ছিল। প্রবাদপ্রতিম ফুটবল জাদুকর আবদুস সামাদ বয়সে অনেক বড় হলেও দু’জনের বন্ধুত্বপূর্ণ গাঢ় সম্পর্ক ছিল
চাকরির বর্ণনাঃ
কুমিল্লা থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সঃ দুই বছর
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ নির্দেশ দিয়েছেঃ কামরুজ্জামান (মুসলিম লীগের এমপি), বাচ্চা খান, জল্লাদ মির্জা। ধরে নিয়ে যায়ঃ জাকির খান এবং ৬ জন পাকিস্তানি আর্মি
নিহত/নিখোঁজ হওয়ার সময়ঃ ধরে নিয়ে যায়ঃ ৮ এপ্রিল ১৯৭১; মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়ঃ ৯ এপ্রিল ১৯৭১
মরদেহঃ রেল ইঞ্জিনের কয়লার চেম্বারের আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল
স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ আলাদা কোনো স্মৃতিসৌধ নেই। পার্বতীপুর সার্কিট হাউস রোডের গণকবরে সব শহীদ স্মরণে স্মৃতিসৌধ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাৰ্বতীপুর নতুন বাজারস্থ সিনেমা হলের সামনের রাস্তার নামকরণ হয়েছে শহীদ ডা. শামশাদ আলী সড়ক (বেসরকারি উদ্যোগে)
স্ত্রীর নামঃ শামছুন্নাহার বেগম
বিয়েঃ ১৯৬১
সন্তান-সন্ততিঃ চারজন (পুত্র)
মো. ফাইয়াজ আলী, এসএসসি, ব্যবসায়ী, পার্বতীপুর, দিনাজপুর
মো. ইব্রাশাদ আলীঃ বিকম, হিসাব রক্ষণ অফিসার, র্যাংগস, ঢাকা
মো. ইমতিয়াজ আলীঃ বিএসসি (ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার), ইঞ্জিনিয়ার, ফটিকছড়ি চা বাগান, চট্টগ্রাম
মো. শমশের আলীঃ বিকম, ইয়োকোহামা ইলেকট্রনিকস, ঢাকা
তথ্য প্রদানকারী
আফরোজা কামাল (সেকো আফতাব)
শহীদ চিকিৎসকের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী
রিসার্চ অফিসার, গবেষণা ও তথ্য সংরক্ষণ
বিভাগ, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, ৩,
সার্কিট হাউস রোড, ঢাকা-১০০০।
আই-এ/৫, ই-ব্লক, কাজী নজরুল ইসলাম
রোড, ঢাকা-১২০৭
২৭৮ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
আমার ভাশুর
শহীদ ডা. মোহাম্মদ শামশাদ আলী
সেকো আফতাব
তাঁকে আমি দেখিনি। কিন্তু আমার বিয়ের পর তাঁর সম্পর্কে নানা বিষয় শুনে ও জেনে তিনি আমার অদেখা-স্মৃতিতে হয়ে উঠেছেন এক অসাধারণ মানুষ ও ব্যক্তিত্ব। দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর রেলওয়ে জাংশন। ঝিকঝিক শব্দ করে প্রতিদিন একের পর এক চলে যায় রেলগাড়ি। ব্রডগেজ ও মিটারগেজ রেললাইনের বৃহত্তম এই জাংশন স্টেশন পার হলেই পশ্চিমে পার্বতীপুর বাজার। বাজারের গা ঘেঁষে সুন্দর একটা দোতলা দালানবাড়ি। সেই দালানবাড়ির ছাদে উঠলেই মনের অজান্তে বারবার চোখ পড়ে যায় কার্নিশের কোনায়; যেখানে একাত্তরের ঘাতকদের চোখ এড়িয়ে আমার বিশালদেহী ভাশুর ভীষণ কষ্টে তাঁর শরীর লুকিয়েছিলেন। কিন্তু নিষ্ঠুর, নির্মম পশুদের হাত থেকে কিছুতেই সেদিন বাঁচতে পারেন নি তিনি।
ব্রিটিশ আর্মির অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ডা. আলহাজ আবুল হোসেনের প্রথম পুত্র ডা. শামশাদ আলী। ছয় ভাই এবং তিন বোনের ভেতর তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। পড়াশোনায় তেমন মেধাবী না হলেও পারিবারিক চাপে পড়াশোনা চালিয়ে যান। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন তাঁর পড়াশোনায় ভীষণ ব্যাঘাত ঘটে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বন্ধুবৎসল, আড্ডাবাজ এবং দপুটে স্বভাবের শামশাদ আলীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছেড়ে চলে আসতে হলো ঢাকায়। ঢাকার মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি ডাক্তারি পাস করে বের হলেন। ডাক্তারি পাস করার সাথে সাথেই তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু কোনো বাধ্যবাধকতা তাঁর চরিত্রে ছিল না বলে সরকারি চাকরিতে মন বসাতে পারেননি। অল্প সময় চাকরি করে অবশেষে পার্বতীপুর চলে আসেন। পার্বতীপুরে শুরু করেন স্বাধীন চিকিৎসা প্র্যাকটিস। পারিবারিকভাবেই এ চিকিৎসা ব্যবসায় চলে আসছিল। মেজো ভাশুর জুলফিকার আলী তখন ওষুধের ব্যবসা ও সংসারের সার্বিক দায়িত্বে। চার নম্বর ভাশুর মমতাজ আলী তাঁকে সহযোগিতা করছেন।
ডা. শামশাদ আলী সাধারণ দুঃখী মানুষের কাছাকাছি এসে তাঁদের সেবায়
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৭৯
শহীদ ডা. মোহাম্মদ শামশাদ আলী
নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন নির্ভীক, স্বাধীনমনা এবং দরদি স্বভাবের। তাঁর এ নরম মন ও দরদি স্বভাবের কারণেই স্থানীয় অন্য ডাক্তারদের মতো আয় করতে পারতেন না। বেশিরভাগ সময় রোগীর কাছ থেকে নিজের ফিস নেয়া তো দূরের কথা; ওষুধ, এমনকি পথ্য পর্যন্ত কিনে দিতেন। রোগীরা এসব নিতে দ্বিধা করলেও তাঁর স্নেহপূর্ণ ধমকের চোটে সবকিছু গ্রহণ করতে বাধ্য হতেন। মা, বাবা, স্ত্রী আর চার পুত্রসন্তান নিয়ে ছিল তাঁর মুখরিত সুখের জীবন।
মা অবাঙালি নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর বংশধর হওয়া সত্ত্বেও বিয়ের পর বাঙালি জাতীয়তাবোধ তাঁকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে এবং শিক্ষিত হওয়ার কারণেই বাঙালির রাজনৈতিক অধিকারের তিনি ছিলেন কট্টর সমর্থক।
আমার শ্বশুর বগুড়া জেলার বর্তমান সোনাতলা থানার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ডাক্তারি পাস করে তিনি ব্রিটিশ আর্মিতে যোগদান করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বৃহত্তম সামরিক ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে পার্বতীপুরে অবস্থানের সময় সেখানকার সাধারণ মানুষের ভালোবাসা তাঁকে আঁকড়ে ধরে। মহাযুদ্ধের পর ব্রিটিশ আর্মিতে ইস্তফা দিয়ে পার্বতীপুরেই শুরু করেন স্বাধীন চিকিৎসা ব্যবসা। পার্বতীপুরবাসীদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সেখানেই শুরু করেন স্থায়ী ব্যবসা। অল্পদিনের মধ্যেই গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকেই তিনি ‘ক্যাপ্টেন ডাক্তার’ নামে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
সে সময়ে পার্বতীপুর শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে ৯৫ ভাগই ছিল অবাঙালি এবং প্রধানত বিহারি। এ কারণেই পার্বতীপুরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারিদের অত্যাচারে আশপাশের গ্রামে প্রায় কেউই টিকতে পারেনি। মাইলকে মাইল ছিল শূন্য। প্রায় সবাই নিকটবর্তী বর্ডার পার হয়ে ভারতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। স্বভাবতই বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় আমাদের এ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ছিল বেশি।
১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের কিছুদিন পর থেকেই বাঙালি-অবাঙালি দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো। বাঙালি-অবাঙালি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যুবক শামশাদের ভূমিকা থাকতো অগ্রণী। সাহসী শামশাদের ছিল অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। খেলাধুলা ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ছিল তাঁর অনুরাগ। ছবি দেখে বুঝি, তার মতো সুদর্শন ও সুপুরুষ সহজে চোখে পড়ে না।
আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিকে, ১৯৬৯ সালে বিহারিদের উর্দু ভোটারলিস্টের দাবির বিরুদ্ধে এবং তৎপরবর্তী স্থানীয় বাঙালি-অবাঙালি নানা সংঘর্ষে তার প্রতিবাদী ভূমিকায় বিহারিরা বুঝতে পারে যে, শামশাদের উপস্থিতিতে বাঙালিদের ওপর ইচ্ছামতো নির্যাতন করা সম্ভব নয় এবং তখন থেকেই তারা তাকে হত্যার সুযোগ খুঁজতে থাকে।
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত কুখ্যাত পাঠান বাচ্চা খান এবং শোয়েব কন্ট্রাক্টর অবাঙালিদের নেতা ছিল। শোয়েবের ছোট ভাই কামরুজ্জামান ছিল মুসলিম লীগের এমপি। তারাই অবাঙালিদের সংগঠিত করে বাঙালিদের পেছনে লেলিয়ে দিত এবং সব ধরনের অস্ত্র জোগান দিতো। অথচ শামশাদ আলীর ব্যক্তিত্বের কাছে তারাও নত ছিল এবং তাঁর সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলার মতো সৎসাহস তাদের ছিল না। গ্রামবাসীদের অনেকেই শহরে বাজার-হাট করতে এসে প্রায়ই এদের হাতে নির্যাতিত হতো। বাঙালিদের এরা নিম্নমানের মানুষ বলে মনে করতো। অবাঙালিদের সংখ্যা বেশি হওয়াতে তাদেরই প্রাধান্য ছিল। এমনকি পৌরসভার চেয়ারম্যানও ছিল বিহারি। ঊনসত্তরে বিহারি বাঙালিদের সংঘর্ষে শামশাদ আলীর ছোট ভাই মুহাম্মদ আলীকে অবাঙালিরা ভীষণ মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দেয়। তিনি ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। অথচ তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ।
ডা. শামশাদ আলী ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ মাঝামাঝি সময়ে অবাঙালিদের কাছে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়লে তাঁর বাবা ক্যাপ্টেন ডাক্তার তাকে কিছুদিন বাড়ি থেকে সরে থাকতে নির্দেশ দেন। দ্রোহের আগুন তখন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। রক্তে যার বিদ্রোহের আগুন, দেশপ্রেম যার অস্থিমজ্জায়, তিনি কী করে নিজের মানুষদের কাছ থেকে দূরে থাকতে পারেন।
‘৭১-এর পঁচিশ মার্চের কালরাত আতঙ্কিত করেছিল হাজারো পরিবারের মতো এ পরিবারটিকেও। আমার
২৮০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. মোহাম্মদ শামশাদ আলী
স্বামী আফতাব আহমেদ এবং ছোট ভাশুর মুহাম্মদ আলী তখন ছাত্র। ছেলে নিয়ে সর্বদা ভয়ে দিশেহারা আমার শ্বশুর-শাশুড়ি। সেজো ভাশুর ডা. সরফরাজ আলী ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে চাকরিরত। সেই পরিবারেও নেমে এসেছিল বিভীষিকা। কে জানে, ক’জন খবর রাখে মুক্তিযুদ্ধ কত পরিবারের সোনার ছেলে কেড়ে নিয়েছে, মায়ের বুক খালি করে দিয়েছে! কত সন্তান হারিয়েছে তাঁর স্নেহময় বাবাকে! আর স্বামীহারা কত মেয়েকে সোহাগ মুছে নামতে হয়েছে নিষ্ঠুর পৃথিবীর কর্কশ পথে! কেউ তার খোঁজ রাখে না।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরদিন থেকে যেন কোথায় কী গণ্ডগোল হয়ে গেল। যাদের সাথে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক তারা হঠাৎ যেন অচেনা হয়ে গেল। এমন এক বিভ্রান্তিকর পরিবেশে এই সৎ, সচ্ছল, মুখরিত পরিবারটি যেন নীরব। ২৫ মার্চের আগের দিন পর্যন্ত বাঙালি-অবাঙালি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা সত্ত্বেও ডা. শামশাদ। সবসময় বিপদে-আপদে তাদের পাশে ছিলেন। কিন্তু তখন চরম কৃতার্থ ব্যক্তির কাছেও সহানুভূতি আশা করার সাহস হয়নি। পাছে উল্টো ফল হয়। ছেলেরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে ওপারে যাওয়ার প্রস্তাবে বাবা দ্বিধান্বিত হন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ সপরিবারে বগুড়ায় চাচার বাড়িতে ওঠার। চারদিকে বিহারিদের বসবাস। মাঝখানে একটি মাত্র বাঙালি পরিবার। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কী করে পার্বতীপুর ছেড়ে চলে যাওয়া যায় তা ভাবতে ভাবতেই দিন কেটে গেল। এরপর এলো সেই বিভীষিকাময় রাত।
১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। কিছুক্ষণ পরেই ভারি বুটের লাথি। দরজা না খুললে ভেঙে ফেলবে এই ভয়ে আমার স্বামী দরজা খুলে দিলেন। ভেতরে ঢুকে বাচ্চা খানের ভাতিজা জাকির খান এবং তার সাথে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরা নয়জন পাকিস্তানি সৈনিক। তারা অন্দর মহলে তল্লাশির কথা বলে সোজা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। একে একে সবাইকে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করিয়ে আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে সমস্ত গয়না ও টাকা-পয়সা গুছিয়ে দিতে বললো। দোতলায় আমার ঘুমন্ত বড় ভাশুর ডা. শামশাদ আলী সদর দরজায় বুটের লাথির শব্দ পেয়ে বিপদ আঁচ করতে পেরে ছাদের কার্নিশে লুকিয়ে পড়লেন।
আর্মিদের কয়েকজন তখন আমার স্বামীকে নির্দেশ করলো হারিকেন হাতে তাদের অনুসরণ করতে। একতলা ছাদের চারপাশে তল্লাশি করতে করতে একসময় ছাদের কার্নিশে লুকিয়ে থাকা আমার বড় ভাশুরের গায়ে হারিকেনের আলো পড়ে। নামিয়ে নিয়ে এসে অন্য চারজনের কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়। বাড়ির উঠোনে দাঁড়ানো চারজনের বুকের ওপর পাঁচটি বন্দুকের নল তাক করা। ইতোমধ্যে আমার স্বামী পালিয়ে গেছেন। আমার চার নম্বর ভাশুর মমতাজ আলী মনে মনে তখন কোনোমতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি বললেন, আমি টয়লেটে যাবো। ওরা ওর বাঁধন খুলে দিল। টয়লেটের কাছে অন্ধকারে এসেই তিনি পেছনের দেয়াল টপকে পালিয়ে গেলেন দ্রুত। তাকে খোঁজার কথা বলে পাঁচ নম্বর ভাই মুহাম্মদ আলীও পালিয়ে গেলেন। এরই মধ্যে পাকসেনারা সোনাদানা, নগদ টাকা ও আমার শ্বশুরকে দিয়ে দুটি ব্ল্যাংক চেক জোর করে সই করিয়ে সাথে করে নিয়ে গেল আমার বড় ও মেজো ভাশুকে।
কিছু দূর গিয়ে আমার নিরীহ মেজো ভাশুরকে ভীষণভাবে মেরে রাস্তার ওপর বেহুঁশ অবস্থায় ফেলে দিয়ে ধরে নিয়ে গেল ডা. শামশাদ আলীকে। পরে সবাই বুঝতে পেরেছিলেন বড় ভাইজানই ছিলেন ওদের টার্গেট। তিনি খালি পায়ে হাঁটতে পারতেন না। কিন্তু নির খানসেনারা পায়ের চপ্পল নিতে দেয়নি বিদায়ের সময়। আমার শাশুড়ি কাঁদতে কাঁদতে তাঁর হাতে একটি কোরআন শরিফ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এটা সাথে রাখো, আল্লাহ তোমার সহায় হবেন। কিন্তু সেটাও সাথে নিতে দেয়নি সেই পশুগুলো। দরদি এ মানুষটিকে আর কখনও তারা ফিরে আসতে দেয়নি তাঁর আপন সংসারে; যেখানে তাঁর বাবা-মা, ভাইবোন, স্ত্রী ও চার ছেলে অধীর প্রতীক্ষায় দিন কাটিয়েছেন।
পরে শোনা গেছে, লাশ পোড়ানোর জন্য একটি কয়লার রেল ইঞ্জিন যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে থাকতো তার কাছেই খালের পাশে জল্লাদের দায়িত্বে নিয়োজিত মির্জা খান নামের কুখ্যাত এক অবাঙালি থ্রি-নট-থি রাইফেল দিয়ে ক্লোজ রেঞ্জ থেকে তাঁকে গুলি করে। এ সময় প্রবল শক্তিশালী ডা. শামশাদ বন্দুকের নল ধরে ফেলেন এবং কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি হয়। কিন্তু কয়েকটি গুলি তার শরীর ভেদ করে গেলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৮১
শহীদ ডা. মোহাম্মদ শামশাদ আলী
পড়েন। এরপর তাঁর দুই বাহু কাঁধ থেকে কেটে এবং শরীর কয়েক টুকরো করে ইঞ্জিনের কয়লার চেম্বারের গনগনে আগুনে ছুঁড়ে দেয়। তার বিশাল দেহ ঐ আগুনের চেম্বারে ঢোকেনি বলেই এ নিষ্ঠুর তাণ্ডব খেলা তাদের। মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে! এত নিষ্ঠুর, এত পিশাচ মানুষ হতে পারে বিশ্বাস হতে চায় না। অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবেন না যে, রেলস্টেশনের উত্তরদিকে প্রতি সন্ধ্যায় একটি কয়লার ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে থাকতো শুধু লাশ পোড়ানোর জন্য । ইঞ্জিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত অবাঙালি ড্রাইভার বিশেষ প্রক্রিয়ায় ইঞ্জিন স্টার্ট করতেই দু’তিন মিনিটে মানুষের দেহের হাড়-মাংস পুড়ে ছাই হয়ে যেতো। থাকতো না কোনো চিহ্ন। লাশের কোনোরকম চিহ্ন না থাকায় পাকসেনারাও জানতে পারেনি অবাঙালিরা কত বাঙালিকে এভাবে হত্যা করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপিতে এক উজ্জ্বল নাম ডা. শামশাদ আলী। এ নাম হয়তো কেউ লিখে রাখেনি। ইতিহাসের পাতায়। খোদাই করেনি কোনো পাথরের গায়ে। কিন্তু স্বাধীন বাংলার পতাকায় তাঁর রক্তের বিন্দু আছে, লেখা আছে তাঁর নাম। আর যে কষ্ট বহন করে ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছেন তাঁর স্ত্রী, স্বামী হারানো সে কষ্ট লেখা ছিল তাঁর রক্তলাল হৃৎপিণ্ডে।
মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় নির্মলা গোমেজ নামে খ্রিষ্টান নার্সটি তাঁর ধর্ম, গোত্র, বাবা-মা, ভাইবোনদের মায়া ত্যাগ করে সুদর্শন যুবক ডা. শামশাদ আলীকে ভালোবেসে বিয়ে করে হয়েছিলেন শামসুন্নাহার বেগম। তিনি হলেন অকাল বিধবা। জীবনযুদ্ধে পরাজিত, সত্যিকার অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ এই মহিলা আর কোনোদিনই তাঁর বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাননি। নিজের শরীরের প্রতি চরম অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে কয়েক বছরের মধ্যেই চারটি শিশুপুত্রকে শোক সাগরে ভাসিয়ে বিদায় নিলেন তিনি সমস্ত জাগতিক যন্ত্ৰণা থেকে। আমার স্বামী আফতাব আহমেদ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তাঁর সামনে বড় ভাইজানের কথা তুলতে পারি না। ওর মুখে কষ্টের ছায়া পড়ে। ও মনে করে, সেদিন যদি ছাদের কার্নিশে ওর হাতে ধরা হারিকেনের আলো না পড়তে তাহলে হয়তো ভাইজানকে ওরা খুঁজে পেতো না। ভাইজান পালিয়ে যেতে পারতেন। ও তো জানতো না ভাইজান অতটুকু কার্নিশে তাঁর অতবড় শরীর নিয়ে লুকিয়ে রয়েছেন।
স্বাধীনতার অনেক পরে আমি এ বাড়ির ছোট বউ হয়ে এসেছি। শাশুড়িকে আমি পাইনি। তখন তিনি মারা গেছেন। এসবই পাকসেনা ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের শিকার আমার শ্বশুর, ভাশুর, স্বামী, জা এবং
২৮২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. মোহাম্মদ শামশাদ আলী
ননদের কাছ থেকে শোনা। ডা. শামশাদ আলীর চার ছেলে মিলন, মনজু, মিন্টু আর পল্লব। ওরা বড় হয়েছে দাদা-দাদি, ফুফু আর চাচা-চাচিদের স্নেহের ছায়ায়। কিন্তু বাবা-মায়ের ভালোবাসা কি আর দিতে পেরেছেন তাঁরা? আজ বিয়ে-শাদি করে ওরা বাবা হয়েছে। বাবার কথা ওদের আবছা মনে পড়ে। ওরা চারজনই খুব ছোট ছিল। ছোট ভাই পল্লব তখন তিন বছরের। সবার কাছে যখন ওরা ওদের সাহসী বাবার গল্প শোনে তখন ওদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, গর্বে উদ্ভাসিত হয় ওদের মুখ; যদিও অন্তরে যে রক্তক্ষরণ হয় তার শব্দ শুধু সংবেদনশীল ব্যক্তিরাই বুঝতে পারেন।
ওদের বাবা মারা যাওয়ার পর সরকারের কাছে থেকে ওরা কোনো সাহায্য পায়নি। এমনকি স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব তহবিল থেকে প্রতিটি শহীদ পরিবারকে দেয়া দু’হাজার টাকা, তাও না। অবশ্য কোনোরকম সাহায্য চাওয়ার মতো মানসিকতাও হারিয়ে ফেলেছিল এ পরিবারের প্রতিটি মানুষ। তিনি বেঁচে থাকলে যুদ্ধের দিনগুলোতে দেশের জন্য অনেক কাজ করে যেতে পারতেন। কিন্তু তার আগেই তিনি শেষ হয়ে গেলেন পাকসেনা ও তাদের দোসর স্থানীয় অবাঙালিদের হাতে। এরপরেও এই পরিবারে মৃত্যু এসেছে। এই সেদিনও আমার লন্ডন প্রবাসী সেজো ভাশুর ডা. সরফরাজ আলী মারা গেলেন। কিন্তু ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বড় ভাইজানের এ নিষ্ঠুর অকাল মৃত্যু সব শোক ছাপিয়ে খুব বেশি কষ্টের জন্ম দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের হাজারো শহীদের মাঝে ডা. শামশাদ আলী হারিয়ে গেলেও তাঁর সন্তান আর ভাইবোনদের স্মৃতির আগুনে আজও ঝলকে ওঠে সেই নাম। তাঁকে নিয়ে ঘিরে থাকা হাজারো স্মৃতি। বৰ্তমান প্রজন্মকে জানতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁরা বলি হয়েছিলেন নিষ্ঠুর বর্বরদের হাতে, ডা. শামশাদ আলী ছিলেন তাঁদেরই একজন। অসীম সাহসী এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। একটি উজ্জ্বল স্বতঃস্কূর্ত নাম।
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশনাঃ বাংলাদেশ ডাক বিভাগঃ ৯ম পর্যায়; ২০০০। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
খ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ১২শ খণ্ড; প্রকাশকালঃ ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪০৬, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯৯; পৃ. ৩২৷
গ. সেই রাজাকার, প্রকাশনাঃ মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, জনকণ্ঠ প্রকাশনী, প্রকাশকালঃ জুলাই ২০০১; পৃ. ১৩৪।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ২৮৩
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ