You dont have javascript enabled! Please enable it! ডা. মো; শাখাওয়াৎ হোসেন | মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক - সংগ্রামের নোটবুক

জীবনচিত্র   নামঃ ডা. মো; শাখাওয়াৎ হোসেন

Md. ShakhWat Hossain

ডাকনামঃ ছকা ভাই

পিতার নামঃ মো. ইউসুফ আলী

পিতার পেশাঃ ব্যবসা

মাতার নামঃ বিনোদা বিবি

ভাইবোনের সংখ্যাঃ এক ভাই, দুই বোন, নিজক্ৰম-প্রথম

ধর্মঃ  ইসলাম

স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম-বানিয়ালি, ইউনিয়ন-হৈবতপুর,

ডাকঘর/উপজেলা-যশোর সদর, জেলা-যশোর

 

শহীদ ডা. মো. শাখাওয়াৎ হোসেন

 

নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ পুরাতন কসবা (যশোর বিমান অফিসের পাশে), যশোর সদর, যশোর

জন্মঃ ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ

ম্যাট্রিকঃ ভারতের স্কুল

এলএমএফঃ নীলরতন মেডিকেল কলেজ, কলকাতা

শখঃ সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা

নীলরতন মেডিকেল কলেজ, কলকাতা

বাংলাদেশে সরকারি চাকরি; নড়াইল, মাগুরা, খুলনা ও যশোর সদর হাসপাতাল (আমৃত্যু)

হত্যকারীর পরিচয়ঃ দরিয়া খান (বিহারি) সহযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনী

নিহত হওয়ার তারিখঃ ০৫ এপ্রিল ১৯৭১

মরদেহঃ যশোর সদর হাসপাতাল চত্বরে মাটি চাপা দেয়া হয়

স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ শহীদ শাখাওয়াৎ হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বানিয়ালি, যশোর সদর

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি

স্ত্রীর নামঃ তাহেরা খাতুন

বিয়েঃ ১৯৪৪/৪৫ খ্রিষ্টাব্দ

সন্তান-সন্ততিঃ

সালমা খাতুন-গৃহিণী

রহিমা খাতুন-অধ্যাপক(অব.), শাহীন কলেজ, যশোর

মো. মকবুল হোসেন বাবু-ব্যবসা, যশোর

হালিমা খাতুন-প্রিন্সিপাল অফিসার, অগ্রণী ব্যাংক, যশোর

নাসিমা খাতুন-কুয়েত

 

তথ্য প্রদানকারী

মো. ফরহাদ হোসেন

শহীদ চিকিৎসকের পুত্র

২৩-১৪, স্ট্রিট ২৮, এস্টোরিয়া, এলআইসি

নিউইয়র্ক-১১১০৫, ইউএসএ

মো. মকবুল হোসেন বাবু

শহীদ চিকিৎসকের পুত্ৰ

পুরাতন কসবা, কাজীপাড়া, যশোর সদর,

যশোর-৭৪০০

 

২৭৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

 

আমার বাবা

শহীদ ডা. মো. শাখাওয়াৎ হোসেন

মো. মকবুল হোসেন বাবু

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা ডা. মো. শাখাওয়াৎ হোসেনকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করে। আমি তখন আইএসসি পরীক্ষার্থী, বয়স ১৮/১৯ বছর। স্মৃতির মণিকোঠায় সেই মর্মান্তিক ঘটনা এখনো জ্বলজ্বল করছে।

৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাবাকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। তিনি দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে মনস্থির করলেন। আমাদের ডেকে বললেন, “আমার আশা আর করো না, আমার আশা ছেড়ে দাও। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। আমার যা কিছু আছে আমি সব দিয়ে এ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বো।” মা এ কথা শুনে কেঁদেকেটে একাকার; আমরা ভাইবোনরাও ভয় পেয়ে গেলাম।

২৯ মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্টে মেজর হাফিজ (পরবর্তীকালে পানিসম্পদ মন্ত্রী) তাঁর সৈন্যদের নিয়ে বিদ্রোহ করলেন। আমাদের যশোর শহরের বাসা ছিল ক্যান্টনমেন্ট থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে। আমরা ব্যাপক গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম।

এপ্রিলের একবারে শুরুতে যশোরে পাক সেনাবাহিনী ক্র্যাকডাউন করলো। শুরু হলো পাকসেনাদের ধ্বংসযজ্ঞ। ওদের ভারি বুটের শব্দ আর গোলাগুলিতে লোকালয় কেঁপে উঠল। নির্বিচারে গণহত্যা আর অমানবিক নির্যাতনের খবর আসতে লাগলো। যশোর শহর থেকে সব বাঙালি গ্রামে বা ভারতে পালিয়ে যেতে থাকল।

 বাবা কর্মরত ছিলেন যশোর সদর হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবেবাবার বয়স তখন ৫৫ বছর। ঐ বয়সেও ভীষণ পরিশ্রমী এবং কর্মতৎপর। হাসপাতালে যুদ্ধাহত রোগীদের চিকিৎসাসেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। অন্যান্য ডাক্তার, নার্স সবাই হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কিন্তু বাবা নাছোড়বান্দা। দু’একজন ওয়ার্ড বয় ছিল। ওদের নিয়েই রোগীদের সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখলেন। রোগীদের নিজেই এনেসথেশিয়া দিতেন, নিজেই অপারেশন করতেন, ব্লাড-স্যালাইন পুশ করতেন, ওষুধ খাইয়ে দিতেনহাসপাতাল থেকে ফিরেও রোগীর

 

 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ   ২৭৫

 

শহীদ ডা. মো. শাখাওয়াৎ হোসেন

 

ডাক এলে ছুটে যেতেন সেবা দিতে। খন্দকার ট্রান্সপোর্টের মালিক মনি ভাই পাকবাহিনী দ্বারা গুলিবিদ্ধ হলেন। খবর পেয়ে কার্ফুর ভেতরে বাবা চিকিৎসা দিয়ে এলেন।

এদিকে যশোর শহরের পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হতে লাগল। আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ি বানিয়ালিতে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। ট্রাক আনা হলো। মালামাল তোলা হলো। আমরা ট্রাকে উঠতে প্রস্তুতি; কিন্তু বাবা কিছুতেই আমাদের সাথে যাবেন না। তিনি কঠোরভাবে জানিয়ে দিলেন, তিনি এখানেই থাকবেন। এবং রোগীদের সেবা দেবেন। আমার বোনের লালফিতা দিয়ে রেডক্রসের চিহ্ন বানিয়ে শার্টে লাগালেন; হাসপাতালের পথে পা বাড়ালেন। আমি সর্বশক্তি দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা বললেন, “তোমার বাপকে শুধু বাঁচাবে, অন্যদের বাপকে বাঁচাতে দেবে না”কথাটা শুনে আমারে শরীরের ভেতর বিদ্যুৎ বয়ে গেল। আমি বাবাকে ছেড়ে দিলাম। সেই ছেড়ে দেয়াই সর্বনাশ ডেকে আনলো। বাবা আমাদের ফেলে চলে গেলেন হাসপাতালে। মা জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। তাঁকে কোনোরকমে সুস্থ করে তুলে বাবাকে অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরা চললাম গ্রামের বাড়িতে।

গ্রামের বাড়িতেই বাবার শহীদ হওয়ার খবর পেলাম৫ এপ্রিল পাকসেনারা হাসপাতালে প্রবেশ করল। তারা দাবি করল, হাসপাতালে বাঙালি সৈন্য-মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছে এবং চিকিৎসকরা তাদের সেবা দিচ্ছে। অভিযোগটা সত্যি। বাবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআর সদস্যদের গোপনে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছিছিলেন। বাবা চিকিৎসক হিসেবে হিপোক্রেতিসের শপথের কথা পাকসেনাদের বললেন, জেনেভা কনভেনশনের কথা বললেন, মানবিক যুক্তি তুলে ধরলেন। কিন্তু কিছুই তাদের মনে ধরল না। বাবার সাথে ওদের কথাকাটাকাটি হয়ে গেল। ভয়ানক ক্ষেপে গেল ওরা।

হাসপাতালের ভেতরেই বাবাসহ চার/পাঁচজনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করলো। তারপর ব্রাশফায়ার করলোএকজন কেবল বুলেটবিদ্ধ হয়েও পালিয়ে যেতে পারলো। বাবাসহ বাকিরা শহীদ হলেনহাসপাতালের ভেতরে তাদের মাটি চাপা দেয়া হলো।

বাবার এ নির্মম মৃত্যু মাকে প্রচণ্ড আঘাত করলো। মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। মানসিক-শারীরিক নানা রোগে ভুগতে ভুগতে মা বিদায় নিলেন চার বছর পরই ১৯৭৪ সালেআমরা এতিম পাঁচ ভাই-দুই বোন উদ্বাস্তুর মতো বেড়ে উঠতে লাগলাম।

শত কষ্ট-সংগ্রামেও বাবাকে হারিয়ে যেতে দেইনি আমাদের স্মৃতি থেকে। আমরা অবস্থাসম্পন্ন নই। তবু নিজেদের দুই বিঘা জমিতে গ্রামের বাড়িতে গড়ে তুলেছি বাবার নামে স্কুল। এখন তা সরকারি শিক্ষা প্ৰতিষ্ঠান-নাম শহীদ শাখাওয়াৎ হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

 

প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ

 

Bangladesh 1971: addressing claims of war crimes genocide and Crimes Against Humanity শীর্ষক সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত বুকলেট; প্রকাশনাঃ Bangladesh Study Group, Kean University, New Jersy, USA: প্রকাশকালঃ ১৮ অক্টোবর ২০০৯; পৃ. ১০।

 

 

২৭৬ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ

Reference:  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ