You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা বাড়ছে
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ভলি-১: নং৪
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর,১৯৭১

বাংলাদেশ বাহিনীর ধৈর্যশীলতা
ও দক্ষতা অর্জন

বাংলাদেশ চার মাসেরও কম সময়ে দুইটি সৈন্যবাহিনীর শাখা- নিয়মিত সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী- সংগঠিত করেছে। উভয় শাখাই পশ্চিম পাকিস্তানের পেশাদার সেনাবাহিনী, যারা ২০০ বছরেরও অধিক সময়ের সামরিক ঐতিহ্যের বাহক এবং অত্যাধুনিক আমেরিকান ও কমিউনিস্ট অস্ত্রে সজ্জিত, তাদের বিরুদ্ধে অপারেশনে বেশ ভালো ধৈর্যশীলতা ও দক্ষতা অর্জন করেছে, যদিওবাংলাদেশ বাহিনীনতুন এবং আকারে ছোট।
মার্টিন ওলাকট, একজন ব্রিটিশ সংবাদদাতা, সাম্প্রতিককালে মনোবলহীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে নৌকায় অভিযানে বাংলাদেশের ১৬ জন সৈন্য ও ২ জন অফিসার এর সঙ্গী হন। (১৮ সেপ্টেম্বরের ওয়াশিংটন পোস্ট এ উদ্ধৃত)-
১৬ জোড়া শূন্য চরণ, তিনটি পুরানো হালকা মেশিনগান, তিনটি ভগ্ন ব্রিটিশ দুই ইঞ্চি মর্টার এবং এক ডজন মর্টার বোমা, যেগুলো এখনো তাদের সীল করা খোলসে আছে, সেগুলোসহ একটি ঝোলা- ওয়ারেন্ট অফিসারের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় উদ্ভাসিত হয় ।
ক্যাপ্টেন, চশমা পরিহিত একজন লম্বা তরুণ যিনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সার্ভিস কোরের একজন কর্মকর্তা ছিলেন, ডোরা কাটা শার্ট আর লম্বা স্কার্ট সদৃশ পোশাক, যা লুঙ্গি নামে বাঙ্গালিদের কাছে পরিচিত, পরিধান করে তাঁর তাঁবু থেকে বের হোন। ওয়ারেন্ট অফিসার তাঁকে স্যালুট ঠুকেন।ক্যাপ্টেন লোকগুলোকে বাংলায় সম্বোধন করেন। ইংরেজি শব্দ “ডিসিপ্লিন”, “ডিসিপ্লিন্ড ফোর্স”, “নো স্মোকিং”বেশ কয়েকবার উচ্চারিত হয়।
তিনি ইংরেজিতেই শেষ করেন, বলেন, “আমি লক্ষ্যে দ্রুত গুলি করা এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়া দেখতে চাই”। ওয়ারেন্ট অফিসার আবার স্যালুট দেন, এবং এই ১৮ জন, পিছনে অনুসরণকারী ২ জন প্রতিনিধিসহ সেনা-শিবির থেকে কলকাতার ৫৫ মাইল উত্তর-পূর্বের এক সীমান্ত এলাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
ক্যাপ্টেন আগেই বলেছিলেন, তার দলের মুখোমুখি আছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুইটি ব্যাটেলিয়ন, উভয়ই সীমান্ত বাহিনী রেজিমেন্ট থেকে আসা। রাতের দলটি ছিল যাকে বলে “বিরক্তকারী দল” এবং কপোতাক্ষ নদীর বাঁকে পূর্ববঙ্গের চার মাইল ভিতরে “মাসলিয়া” নামক স্থানে পাকিস্তানের সেনা দলের ঘুম ও মনের শান্তি নষ্ট করাই এদের মূল লক্ষ্য ছিল।
সেনাশিবির থেকে প্রায় এক মাইল দূরে, দলটি তিনটি বড় দেশী নৌকায় আরোহণ করে। কেউ আমার হাতে একটি মর্টার নামিয়ে রাখে, সেখানে শুধু রক্ষা খিলের (সেফটি ক্যাচের) টকটক শব্দ, এবং ক্যাপ্টেনের কড়াকড়ি স্বত্বেও অনেকেই সিগারেট জ্বালায়।
নৌকাটি পানিতে এগোনো শুরু করে-ঠিক এখনকার নদীগুলোর মত না, বরং বৃহৎ ও বাঁকানো হ্রদের মতন, কারণ এটিকে বন্যায় গ্রাস করেছে।তারার আলোয় দূরের গাছগুলো ও পরিষ্কার দেখা যায়।

আমি আতঙ্কিত হয়েই লক্ষ্য করি, অনেকেই স্বাভাবিক আলাপচারিতার স্বরেই কথা বলছিল, কিন্তু তাদের কথোপকথনম্লান হয়ে যায় যখন আমরা আরও গহীনে প্রবেশ করি। নৌকা তীরে ভিড়তেই সবাই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং জমির দিকে সাঁতরে অগ্রসর হই,একদল লোক ছোট মেশিনগান হাতে, আরেক দল মর্টার সহ, বামদিকের আঁধারে মিলিয়ে যাচ্ছে, এবং আমরা বাকিরা দুইটি হাল্কা মেশিনগান আর দুইটি মর্টার নিয়েএক সারিতে বনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
সেখানে অসংখ্য ব্যাখ্যাতীত পথমধ্য বিরতি ছিল, এবং তরুণ গেরিলা যারা আমাদের দেখাশোনার জন্য বরাদ্দ ছিল, তারা খানিকটা অর্থহীনভাবেই বলতে থাকলোযে , “আমরা এখন বাংলাদেশে”।
প্রায়২০ মিনিট পর আমরা বড় একটি গ্রামে আসি,নীরবে তা পার হয়ে নদীতীরে পৌঁছাই।বন্দুক ও মর্টারগুলো তাক করা হয়, বোমাগুলো তাদের খোলস থেকে বের করা হয়। গোলাগুলির দলের কাছাকাছি অবস্থিত কুঁড়েঘরগুলোতে প্রায় ২০০ জন গ্রামবাসী ঘুম থেকে জেগে উঠে দ্রুত বের হয়, ছুটতে থাকে গাঁটরি-বোঁচকা নিয়ে,সম্ভবত গ্রামের অপর প্রান্তের ঘরগুলোর দিকে।
আগের সকল ফিসফিসানি ও অদলবদলের পর অবিশ্বাস্য রকমপ্রবল আওয়াজ করে,এরপর শুরু হয় গুলিবর্ষণ, মেশিনগান এর আকস্মিক বিস্ফোরণ , মর্টারের ধপধপ – ঠুসঠাস শব্দ, অন্যদের ৩০৩ রাইফেলের একক গুলি। আমাদের বামে একদল যোগ দেয়। এটি সম্ভবত ৮ মিনিট টিকে থাকে।“শত্রু এলাকা” থেকে কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না , সার্জেন্ট রহস্যময়ভাবে ঘোষণা দেন “আমরা এখন গোলাগুলি আরম্ভ করবো, তারা ২০ মিনিট পর গোলাবর্ষণ করবে”।
আমরা সামান্য গতিতে নৌকায় ফিরে যাই। ওয়ারেন্ট অফিসারদলটি গুনেন , এবং আমরা পুনরায় পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ২০ মিনিট পর, যেই আমি ঘড়ি দেখি –নৌকা থেকে ৪০০ গজ দূরে বোমা বর্ষণের বিকট আওয়াজ আসে।
১০ মিনিট পর আমরা নৌকা থেকে বের হই এবং আধঘণ্টার মধ্যে শিবিরে ফিরি, কলের পানি মাথায় দিয়ে আমরা তাজা হই। ক্যাপ্টেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘুমাতে যান যে তার “বিরক্তকারী দল”এর কোন ক্ষতি হবে না। টহল দল, সর্বেসর্বা ভাবে একটি উপযুক্ত প্রয়াস। তারা জানে কিভাবে অস্ত্র কাজে লাগাতে হবে, তারা দ্রুত তাদের অবস্থান নিয়ে নেয়
সত্যিকার অর্থে মুক্তিবাহিনীরপ্রধান কাজ “বিরক্তকারী দল” হিসেবে ছিল না।ক্যাপ্টেনের নিয়মিত বাহিনী দাবি করে যে তাদের ৪ মাসের সময়ে তারা ১২৫ জন পাকি সেনাদের হত্যা করেছেন, এর মধ্যে দুইজন অফিসারও ছিলেন। তিনি আরওবলেন, এই চার মাসে ,পাকিস্তানিরা কোনও পাল্টা ওঁত পাতেনি, পাল্টা খনন করেনি এবং “শুধুমাত্র একবার” বিবাদের সময় মুক্তিবাহিনীর উপর বাটপারি করতে চেয়েছিল।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!