শিরোনামঃ- সম্পাদকীয়ঃ বাংলাদেশে জনযুদ্ধ
সংবাদপত্রঃ- স্ফুলিঙ্গ ; কুবেক নম্বর ২
তারিখঃ- ১ লা অগাস্ট, ১৯৭১
বাংলাদেশে জনগণের যুদ্ধ
বাংলাদেশের জনগণ এখন যুদ্ধের সম্মুখীন। ভুট্টো – ইয়াহিয়া চক্রের ফ্যাসিস্ট বাহিনী সাড়ে ৭ কোটি বাঙালীকে পরাধীন করে রাখার উদ্দেশ্যে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম সন্ত্রাস এবং বর্বরতর আক্রমণের প্রয়াশ চালিয়েছে। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা সর্বাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর পরিবর্তে, স্বাধীনতা সংগ্রামে অটল বাঙালী সফলতার সাথে একতাবদ্ধ হয়েছে। পূর্ব বাংলার জনগণ এখন শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণ থেকেই নয় বরং পশ্চিমা বহির্বিশ্বের ঔপনিবেশিক সম্রাজ্যবাদ থেকেও বেরিয়ে আসার জন্য সোচ্চার।
বর্তমান বিশ্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশ্বের জনগণের উপর পর্যায়ক্রমে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ ও পরাধীনতার শিকল পরাতেই মার্কিন সাম্রাজ্যের মূল স্বার্থ নিয়োজিত। যখনই মানুষ এই শোষণের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে, তখন মার্কিন সাম্রাজ্য এই বিরুদ্ধাচরণ দমনের জন্য তাদের সেনা বাহিনী ব্যবহার করে ( ভিয়েতনাম যুদ্ধ ) , অথবা তাদের নিয়োজিত তথাকথিত “উন্মুক্ত বিশ্ব” র শোষক শ্রেণীর সাহায্য নেয়। পাকিস্তানও এই ব্যবস্থার ব্যতিক্রম নয়। সেকারনেই, এটা মোটেও বিস্ময়জনক ঘটনা নয় যে, আমেরিকা পাকিস্তানকে সরাসরি সমর্থন করে এবং পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সাহায্যার্থে পুলিশ বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। [ সূত্রঃ- নিউজ উইক, অগাস্ট ২, ১৯৭১। ” এবং এই বিষয়ে তিনি ( সিনেটর কেনেডি ) আন্তরিকভাবে মত পোষণ করেন যে, ইয়াহিয়ার পাঞ্জাবী সেনাদের বাঙালী বিদ্রোহ দমনের সাহায্যার্থে , পূর্ব পাকিস্তানে আমেরিকার পুলিশ বাহিনী পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল ” ]। এখন তারা কম্পমান পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির জন্য জাতিসংঘকে ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
সংকল্পবদ্ধ বাঙালীদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান রক্ষার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলে, ভবিষ্যতে ষড়যন্ত্রের ভিন্ন উপায়ও মার্কিন সাম্রাজ্যের আছে।
যারা প্রকৃত অর্থেই আমাদের দেশের স্বাধীনতা চান তাদের অবশ্যই মার্কিন সাম্রাজ্যের এসব অসৎ পরিকল্পনার প্রতি নজর রাখতে হবে। বাংলার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের স্বার্থে কাজ করবে। এতে বিশ্বাস করার মত কোন কারণ নাই যে, তাদের কৌশলগত নীতির পরিবর্তন বাঙালী জনগণের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই বিশ্বের জনগণের শ্ত্রূ, এবং এই সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসের উপরই সবার মুক্তি নির্ভর করে। বাংলার জনগণ এখন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া , মধ্যপ্রাচ্য , আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার জনগণের সাথে সম্মিলিত ভাবে বিশ্বব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে অগ্রসর হচ্ছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক পদ্ধতি এখন বাংলার জনগণের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং ঐতিহাসিক ইন্দো-চীন সংগ্রাম এবং বিশ্বের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সংগ্রামের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া যায় যে, ” শ্রেণী সংগ্রাম ” এবং ” গণ যুদ্ধ ” র উপর ভিত্তি করা দীর্ঘায়িত গেরিলা পদ্ধতিই একমাত্র পন্থা যার মাধ্যমে অধিক শক্তিধর শত্রূকে পরাজিত করা সম্ভব। এই পরীক্ষিত পদ্ধতি অনেক যুদ্ধেই দৈত্যসম আমেরিকান শক্তিকে পরাজয়ে বাধ্য করেছে।
অতীতের অনেক ভুল এবং দুর্বলতা এখন সুস্পষ্ট। পরিস্থিতি বোঝার সীমাবদ্ধতার ফলশ্রুতি সীমিত জয়ের জন্য সীমিত সংগ্রাম। কিন্তু ভয়ঙ্কর শত্রূর সামনে এই জয় অকার্যকর এবং কাম্যও নয়, যেহেতু এতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদে শোষিত অধিকাংশ জনগণের সামগ্রিক অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। যখন শত্রূপক্ষ আপাদমস্তক অস্ত্র সজ্জিত এবং স্বেচ্ছায় নিজ অবস্থান থেকে নড়বে না তখন অহিংসা , অসহযোগ এবং গনতান্ত্রিক পদ্ধতির ধারণা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। অস্ত্র এবং যুদ্ধ প্রস্তুতির অভাব জনগণকে রক্ত পিপাসু শত্রূর সামনে সহজ ও অসহায় শিকারে পরিণত করেছে।
বাংলার জনগণ অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কার্যকরী যোদ্ধায় পরিণত হচ্ছে। বাঙালী আজ বিশ্বাস করে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং স্থানীয় কিছু লোকের সাহায্যপ্রাপ্ত এই সশস্ত্র শত্রূকে শুধুমাত্র বাঙালী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেতৃত্বে এবং প্রতিনিধিত্বে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে দীর্ঘায়িত গণ যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করা সম্ভব ; অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক এবং বৃহত্তর গরীব জনগোষ্ঠী।