শিরোনামঃ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ তৎপরতা
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার শিকাগোঃ নং ১৪
তারিখঃ ১০ নভেম্বর, ১৯৭১
আমেরিকা জুড়ে বাংলাদেশ বিষয়ক কর্মকাণ্ড
সান ফ্রান্সিসকো উপকূলীয় এলাকাঃ
নভেম্বরের ২ তারিখে ড এআর মল্লিক এবং ড এ হক, জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রায় ২৫০ জন ছাত্র ও শিক্ষকদের সমাবেসে বক্তব্য রাখেন। আমেরিকান লিগ ফর বাংলাদেশ জনসাধারণের মাঝে এবং ক্যাম্পাসে মিছিলের জন্য ব্যাপক প্রচারণার আয়োজন করে। আয়োজনটি সম্পর্কে স্ট্যানফোর্ড ডেইলি এবং স্থানীয় পালো আল্টো টাইমস আয়োজনটি সম্পর্কে যথাযথ প্রচার করে। মিছিলের ঠিক আগমুহূর্তে আগতরা স্থানীয় সংবাদকর্মীদেরকে উদ্দেশ্য করে তাদের বক্তব্য জানান। যেখানে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট ও ধরন ব্যাখ্যা করেন।
তারা বারংবার উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতা একটি শত্রু রাষ্ট্র থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছে, যে শত্রুরা জুলুমবাজ এবং যাদের অত্যাচারের কায়দা মধ্যযুগীয়। মিছিলটি বাংলাদেশকে নিয়ে লেখা জোয়ান বায়েজ এর একটি গানের মাধ্যমে সূচনা হয় তারপর মি: নিক্সনের তথাকথিত শান্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কীভাবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনবহুল ও দরিদ্র দেশ আক্রান্ত হয়েছে তা তুলে ধরা হয়।
ড মল্লিক তার উদ্বোধনী ভাষণে বাংলাদেশে বিদ্যমান গণহত্যামূলক যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেন। তিনি সেই র্যালিতে জানান বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি একটি সত্য ও ন্যায়ের স্বাধীনতা সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তাদের এই সংগ্রাম মৃত্যুর বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার।
তিনি পাকিস্তানি চলমান শাসনের বর্বর এবং মধ্যযুগীয় চরিত্রের কথা তুলে ধরেন। শত্রু যেখানে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার পায়তারা করে চলেছে।
ড মল্লিক এর পর ড হক এই সমাবেসে বক্তব্য রাখেন। তিনি নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন এবং সমাবেশে বলেন, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জনতার মুক্তির সংগ্রাম ক্রমাণ্বয়েই এগিয়ে চলেছে এবং জয় আসবেই। বাংলাদেশের জনগণের বাহিনী অপ্রতিরোধ্য। মিছিল শেষে স্ট্যানফোর্ড উইমেন ফর পিস এর মুখপাত্র মিসেস হুবার্ট মার্শাল, বাংলাদেশে চলমান গণহত্যার প্রতি নিক্সন প্রশাসনের সমর্থনের তীব্র সমালোচনা করেন।
স্ট্যানফোর্ড ক্যাম্পাস ছাড়াও বক্তারা ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ বার্কলে এবং সান্টা ক্রুজেও বক্তব্য রাখেন।তারা নাগরিকদের প্রতি আহবান জানান জুলুমবাজ ও অত্যাচারি পাকিস্তান সরকারের প্রতি যেকোনোরকমের সাহায্য সহযোগিতা বন্ধে সোচ্চার হতে।
সান্তা ক্রুজ, ক্যালিফোর্নিয়া:
১০ই নভেম্বর সান্তা ক্রুজের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে ছাত্র ও শিক্ষকদের একটি মিটিংয়ে ‘ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ’ নামে একটি ক্যাম্পাস গ্রুপ সৃষ্টির প্রস্তাব রাখা হয়, যেখানে ক্রিস মেইয়ার এবং ইভলিন লিগ থাকবেন সমন্বয়ক এবং প্রফেসর দিলিপ বসু থাকবেন উপদেষ্টা। এই গ্রুপটির কাজ হবে ক্যাম্পাস এবং স্থানীয় কমিউনিটিগুলোতে বাংলাদেশের ব্যাপারটি সম্পর্কে জানানো, যার জন্য তারা লিফলেট, লেকচার, টিচ-ইন এবং চলচিত্র প্রদর্শন ইত্যাদি উপায়ের কথা ভাবেন। শিক্ষার্থীদের এই বিষয়ে তাদের নিজ নিজ পিতামাতা/অভিভাবকদের প্রাসঙ্গিক লেখালেখি মেইল করতে অনুরোধ করা হয়, যাতে তারা সেগুলোর ভিত্তিতে ত্রাণ সাহায্য চাইতে পারে এবং তাদের ক্রংগ্রেসম্যান ও সিনেটরদের চিঠি দিতে পারে। নভেম্বরের ১০ তারিকে প্রায় আড়াইশো জন শিক্ষার্থী অনশনের জন্য স্বাক্ষর দেয়, বাংলাদেশের পীড়িত জনগণের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনই এই অনশনের উদ্দেশ্য। নিজেদের মিল টিকেটের টাকা তারা শরণার্থীদের ত্রাণে দান করতে পারে।
পূর্ব ল্যানসিং, মিশিগান
ডিসেম্বরের ১ তারিখে অনশনের আয়োজন চলছে ১৬টি ডরমিটরিতে, ২০টি মেয়েদের সংঘে, ৩০টি ফ্র্যাটার্নিটি এবং ১৩টি কোঅপ হাউজিংয়ে। অনশনের আয়োজন থেকে উত্তোলিত সমুদয় অর্থ ইত্যাদি শরণার্থীদের দানে পাঠানো হবে। বাংলাদেশি বক্তারা বিভিন্ন ডরমিটরি এবং উচ্চ-বিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশ বিষয়ে শিক্ষামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন অবিরাম। বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহের আবেদনের কথা অল্পসময়ের জন্য হলেও স্থানীয় টিভিতে প্রচার পেয়েছে। নভেম্বরের ১৪ তারিখে, বাংলাদেশে সংঘটমান ইতিহাসের চরমতম মানবিক বিপর্যয় এবং তার ফলে সৃষ্ট শরণার্থীদের দুর্দশার কথা নিয়ে ১৫ মিনিট ব্যাপী আলোচনা করেন ল্যানসিং এরিয়া কমিটি ফর ইমার্জেন্সি রিফিউজি ফান্ডের রেভ ওয়ারেন ডে এবং মি এস পোদ্দার। নভেম্বরের ২১ তারিখে পুরো ল্যানসিং এলাকার সকল প্রেসবাইটারিয়ান চার্চগুলো শরণার্থীদের সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহ করে।
ডিউইট, মিশিগান
নভেম্বরের ১৮ তারিখে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে ডিউইট-ল্যানসিং এর লায়নস ক্লাব তাদের সভায় বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ জানায়। তিনি সেই সভায় বাংলাদেশের বিদ্যমাণ পরিস্থিতি সবাইকে অবহিত করেন এবং তহবিল ও শীতবস্ত্র দানের অনুরোধ জানান। এ বিষয়ে লিখিত প্রবন্ধ এবং লিফলেটও বিলি করা হয়।
অ্যান আরবর, মিশিগান
নভেম্বরের ২২ তারিখে মিশিগান ইউনিভার্সিটির সাউথ কোয়াড্রাঙ্গেল এর প্রায় ১০০০ শিক্ষার্থী বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনশন পালন করে। সন্ধ্যায় অনশনরত শিক্ষার্থীদের জন্য গণসভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য রাখেন মি রব হিউবার এবং মি হ্যাংক হেইটোউইট। রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুরে মিস বেথ লিন্ডবার্গ, মি অশোক তালওয়ার এবং মিস্টার ও মিসেস রাজা দম্পতির গানের সাথে নৃত্য পরিবেশন করেন মিস শেরন লোয়ার এবং মিস ইন্দু মালিনি। অনুষ্ঠানটির পরিচালনা ও সমন্বয়ে ছিলেন মি পিটার হক এবং মিস স্নেহলতা দীক্ষিত। অনশনটির আয়োজনে ছিলেন মি বার্ট টাউব। ইউনিভার্সিটি সেন্টারে সাপ্তাহিকভাবে একটি বাংলাদেশ ইনফরমেশন ডেস্ক পরিচালিত হয় একটি সাব-কমিটির চেয়ারম্যান মিস টেরি ক্লাইন এর তত্ত্বাবধানে, তাদের কাজ ছিল বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচারপত্র বিলি করা।
আরবানা, ইলিনয়েস
ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়েসের বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন, স্থানীয় কসমোপলিটান ক্লাবের অর্থায়নে একটি প্যানেল ডিসকাশনে অংশগ্রহণ করে। অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে মি মোহাম্মদ এইচ মণ্ডল এবং ইস্টার্ন ইলিনয়েস ইউনিভার্সিটি অ্যাট ক্লেসটন তিন এর ড এম রহমান বাংলাদেশের বিদ্যমান শোকাবহ পরিস্থিতি নিয়ে আলোকপাত করেন এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও আলোচনা করেন। অ্যাসোসিয়েশনটি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি চলচিত্র প্রদর্শন করবে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের জন্য শীতবস্ত্র সংগ্রহের জন্যও একটি উদ্যোগ চলমান রয়েছে।
গিনসবার্গ এবং ভজনেসেনস্কি এর কবিতা আবৃত্তি
নিউ ইয়র্ক:
প্রথমবারের মতো অ্যালেন গিনসবার্গ এবং খ্যাতনামা রাশিয়ান কবি আন্দ্রেই ভজনেসেনস্কি একসাথে কবিতা আবৃত্তি করবেন। আবৃত্তি অনুষ্ঠানটি হবে, সিক্সটিন্থ স্ট্রিট ২০৮ই এর সেইন্ট জর্জ চার্চে, ২০শে নভেম্বর, সন্ধ্যা ৭টায়। বাংলাদেশে বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে সাধারণ্যের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আমেরিকানরা তার নিরসণে কী ভূমিকা রাখতে পারে, তাই অনুষ্ঠানটির প্রতিপাদ্য।
গিনসবার্গ, যিনি সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে এসেছেন, যেভাবে বলেন:
[কোটি ভাইয়েরা আছে বিপদে
কোটি বোনের নেই কোনো যাবার জায়গা,
কোটি শিশু ভিজছে বর্ষায়,
কোটি মা কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়
যশোর রোডে বইছে সেপ্টেম্বরের বন্যার জল।]
তাঁদের সাথে যোগ দেবেন কেনেথ কচ, এড স্যান্ডার্স, গ্রেগরি করসো, পিটার অরলোভস্কি, অ্যান ওয়াল্ডম্যান, মাইকেল ব্রাউনস্টেইন, ডিক গ্যালাপ এবং রন প্যাজেট।
আবৃত্তি অনুষ্ঠানটির ব্যয় নির্বাহ করবে আমেরিকানস ফর বাংলাদেশ নামে বাংলাদেশের বিদ্যমাণ দুর্দশা সাধারণের মাঝে তুলে ধরে শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সাহায্য সংগ্রহে নিবেদিত একটি সচেতন নাগরিক সংঘ।
কবিতা আবৃত্তি ইংল্যান্ডে
বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহের জন্য, ৭১-এর ১৪ই নভেম্বর, অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন স্যাডলার্স ওয়েলস থিয়েটার কনসার্টে একটি বাংলা কবিতা পাঠ করবেন সেই সাথে পড়ে শোনাবেন শেক্সপিয়ার এবং ইয়েটস থেকেও। বিখ্যাত সেতার বাদক রবি শঙ্কর এর ভাগনে বীরেন্দর শঙ্কর এবং প্রখ্যাত বাঙালি লোকসঙ্গীতশিল্পীরাও থাকবেন সেখানে।