You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.01 | বাংলাদেশ (পশ্চিম তীর নিউজ বুলেটিন) ক্যালিফোর্নিয়া - সংগ্রামের নোটবুক

শিরোনামঃ সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদন
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ (পশ্চিম তীর নিউজ বুলেটিন) ক্যালিফোর্নিয়াঃ নম্বর ২
তারিখঃ ১ জুলাই, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

আমেরিকার হাতে বাঙালিদের রক্তঃ

অবশেষে আমেরিকার হাত বাঙালিদের রক্তে রঞ্জিত হল। দুঃখের ব্যাপার এই যে আমেরিকার মত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্বাধীনতার ধারণাকে চূর্ণ করে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের সাথে হাত মিলিয়েছে, যাদের কার্যকলাপ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে যে কারণ দেখিয়ে আমেরিকা যুদ্ধ লড়ছে তার বিপরীত।
বিশ্বব্যাপী ধিক্কার এবং আমেরিকান সিনেটর, কংগ্রেসম্যান ও নাগরিকদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও দুই জাহাজ ভর্তি অস্ত্র-গোলাবারুদ পাকিস্তানে পাঠানো আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ)তে যে মানবিক দুর্দশার জন্ম দিয়েছে তার প্রতি এক স্থূল অবজ্ঞা প্রকাশ করছে। ইয়াহিয়ার নেকড়ের পালের পাশবিক আচরণে আমেরিকান করদাতাদের টাকায় অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে আমেরিকান সরকার তার নাগরিকদের বাংলাদেশে চলমান গণহত্যার এক অনিচ্ছুক অংশীদারে রূপান্তরিত করে নিয়েছে।
এর মাধ্যমে নিক্সন সরকার শুধুমাত্র নিরস্ত্র বাঙালিদের মানবাধিকার ক্ষুণ্নই করছে না, সাথে সাথে আমেরিকান নাগরিকদের সাথে এক বিদ্রুপাত্মক ছলের আশ্রয়ও নিচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমবর্ধমান বিরোধিতা এবং ইয়াহিয়াকে সরাসরি আমেরিকান সাহায্যের পরেও তাদের মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, এবং তার জন্য তারা আমেরিকান জনগণ, লীগের সদস্য ও তাদের সহযোগী বন্ধুদের নিকট হতে অভিনন্দন পাবার যোগ্য।
আমরা লীগ এবং আমেরিকান জনগণের পক্ষ থেকে জনাব নিক্সন এবং তার সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি তারা যেন মানবতার শত্রুদের সবরকম সাহায্য করা থেকে বিরত থাকে এবং ইয়াহিয়া ও তার সামরিক জান্তা বাংলাদেশে থেকে চলে না আসা পর্যন্ত তাদের প্রতি সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা মুলতবি রাখে।

ধর্ষণের পেছনের কাহিনী
বাংলাদেশে মানুষ উৎপাদনের কেন্দ্রঃ

কিছুদিন আগে বাংলাদেশে সামরিক আক্রমণের সাথে যুক্ত একজন কর্নেলের ছেলে, এক পাঞ্জাবি ছাত্র, এমন কিছু জঘন্য মনোভাব প্রকাশকারী মন্তব্য করে যা হালকা ভাবে নেয়া উচিৎ নয়। সে মাত্র ১০ দিন আগে করাচী থেকে লস অ্যাঞ্জেলসে এসে পৌঁছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের মাঝে বর্তমানে বিরাজমান এক সাধারণ মনোভাবের উল্লেখ করে – বাঙালিদের প্রতি অপরিসীম ঘৃণা ও বিদ্বেষ।
তার গর্বিত বিবৃতি থেকে প্রতীয়মান হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্বে তাদের কলোনিকে রক্ষা করতে এখন আন্তঃজাতি মিলন ঘটাতে উন্মুখ হয়ে উঠেছে। অফিসার এবং সেনা সকলকেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেকোনো উপায়ে বাঙালি নারীদের সাথে জোরপূর্বক যৌনমিলন ঘটাতে, যাতে করে পশ্চিম পাকিস্তানী বাবার ঔরসে জন্ম নেয়া সন্তানদের দ্বারা বাংলাদেশে অবাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এমন অশুভ, জঘণ্য ও ঘৃণিত কার্যকলাপ বাঙালি জনগণের ওপর এক চরম আঘাত, কেননা এসব সন্তান যখন বেড়ে উঠবে এবং শারীরিক দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে মিল খুঁজে পাবে, স্বাভাবিকভাবেই তাদের আনুগত্য পশ্চিমের প্রতি ঝুঁকে পড়বে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা বিশ্বাস করে তাদের এই পরিকল্পনা পরবর্তী প্রজন্ম থেকেই প্রভাব ফেলা শুরু করবে এবং বাংলাদেশ চিরকালের জন্য কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে।
সরাসরি বলতে গেলে বাঙালি নারীরা- আমাদের মা, মেয়ে, বোন, স্ত্রী, ভাতিজি, ভাগ্নী পাকিস্তানী সেনাদের হাতে চরম অপমান ও অবমাননার স্বীকার হচ্ছে। তাদের কথা একদা তারা কেবল ১৭ জন ঘোড়সওয়ার দিয়েই বাংলা দখল করে নিয়েছিল। এই বিংশ শতকে এসে তাদের ৭০,০০০ সেনা এই কাজটা আবার করে দেখাবে। পাঞ্জাবি ছাত্রটির কথা শুধুমাত্র ফাঁকা বুলিই নয়, হয়ত এর মাঝে কিছু সত্যতাও লুকিয়ে আছে।

নিজের বোকামীর কারাদণ্ড

ম্যাককার্থিজমের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলিতে আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতি ছিল “যারা আমাদের পক্ষে নেই, তারা আমাদের বিপক্ষে।“ ‘দূরদর্শী’ রাষ্ট্রসচিব জনাব জন ফস্টার ডুলস-এর মস্তিষ্ক প্রসূত এই নীতি আইজেনহাওয়ারের দিনগুলোতে আমেরিকাকে ৪৭ টি কৃত্রিম ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পথে পরিচালিত করে। স্নায়ুযুদ্ধকালীন পররাষ্ট্র নীতির মূল বিষয়গুলোর একটি ছিল “ চীনের নিয়ন্ত্রণ”, যার মাধ্যমে চীনের সীমান্তবর্তী দেশগুলোকে এক কৌশলগত আবরণের ভেতর নিয়ে আসা হয়। ভারত ও পাকিস্তান উভয়কেই এক দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় সামরিক সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ভারত এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও পাকিস্তানের ভারতভীতি তাদের এই প্রস্তাব গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। ভারত স্বাভাবিকভাবেই উপলব্ধি করে উপমহাদেশে এরূপে অস্ত্রের আমদানি এ অঞ্চলে সামরিক ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি করবে এবং এই চালান ঠেকানোর জন্য তারা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে । ভারতের বিরোধিতার মুখে আমেরিকার আনুষ্ঠানিক বিবৃতি ছিল এইসকল অস্ত্র এই শর্তেই দেয়া হচ্ছে যে পাকিস্তান তাদের কেবল চীনের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারবে। এই বিবৃতি যে মিথ্যা তা সকলের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে পাকিস্তান যখন ১৯৬৫ সালে এইসকল অস্ত্র ব্যবহার করেই ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ চালিয়ে বসে। ‘কূটনৈতিক বিরোধিতা’ ব্যর্থ হলে আমেরিকা নতুন করে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। প্রাণঘাতী নয় এমন তৈরী জিনিস, যেমন যন্ত্রাংশ, জিপ, ট্রাক প্রভৃতি এই আংশিক নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে ছিল। বিনাশর্তে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগের লক্ষ্যে পাকিস্তান চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগ করে এবং তাদের কাছ থেকে বেশ বড় পরিমাণে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে। এভাবে এক বৃহৎ শক্তিকে আরেকটির বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান সফলতা লাভ করে এবং গত অক্টোবরে আমেরিকা আবারো পাকিস্তানে নতুন অস্ত্রের চালান শুরু করে। তারা কারণ দেখায় যে তা না হলে পাকিস্তান তার সামরিক সরঞ্জামের জন্য সমাজতান্ত্রিক শিবিরের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এই নিষ্ঠুর কপটতা এখন জন্ম দিয়েছে মধ্যযুগের নৃশংসতার সাথে তুলনীয় এক গণহত্যার। নিক্সন সরকারের কর্মকর্তাদের হাত এখন বাঙালিদের রক্তে রঞ্জিত, যাদের একমাত্র অপরাধ ছিল নিজ দেশের সরকারে যথাযথ প্রতিনিধিত্ব দাবী করা। পাকি যুদ্ধযন্ত্রের নৃশংসতার সাথে বাঙালিদের অবমাননায় যুক্ত হয়েছে ভারতে পালিয়ে যাওয়া অসংখ্য শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশার প্রতি আমেরিকান সরকারের নির্লজ্জ অনীহা। কিউবা থেকে নির্বাসিতদের আমেরিকায় এনে ‘স্বাধীনতা’ দান করার পেছনে আজ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। কিন্তু অপর দিকে ৬ মিলিয়ন(৬০ লাখ) শরণার্থীর শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করবার জন্য অর্থ ও অন্যান্য সরবরাহের বড়ই অভাব। আমেরিকা এখনো নিজেকে মানবিক মূল্যবোধ ও গণতান্রিক অধিকারের বৈশ্বিক রক্ষাকর্তা হিসেবে বিবেচনা করে গর্ব বোধ করে। এই হিপোক্রেসি শেষ হবে কবে?
এ কে এম
লস অ্যাঞ্জেলেস