You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
সম্পাদকীয় ও ঘোষণা বাংলাদেশ নিউজ লেটার শিকাগোঃ নং ২* ২৫ মে, ১৯৭১

 

[*এই সংখ্যা হতে বাংলাদেশ লীগ অফ আমেরিকার শিকাগো শাখার নাম ‘বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ’ উল্লেখ করা হয়েছে]

বাংলাদেশের মাটিতে এখনো মৃত্যু হানা দিয়ে যাচ্ছে। বাঙ্গালিদের দমন করার কৌশলের অংশ হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে প্রতিদিন নিহত হচ্ছে শত-হাজার জনতা। বাড়িঘর-সহায়সম্পদ যখন তখন ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে, এরই মধ্যে তিন মিলিয়নেরও বেশি (নিউ ইয়র্ক টাইমস, মে ২২ দ্রষ্টব্য) বাংলাদেশী পার্শ্ববর্তী ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে; প্রতিদিনই ৫০০০০ এরও বেশি মানুষ ঢুকছে। এখনো বিশ্ব-সরকারের বিবেক এতটুকু টলেনি বলেই মনে হয়। তারা এখনো তাদের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে চিন্তিত। পাকিস্তানের ক্রমপতনশীল অর্থনীতিকে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে সাম্প্রতিক চুক্তিটি, বিশেষ কিছু শর্তাধীনে এরকমই একটা ঘটনা (নিউ ইয়র্ক টাইমস, মে ২০ দ্রষ্টব্য)। এ চুক্তিটি বাঙ্গালিদের জন্য বৃহত্তর ন্যায়বিচারের আহ্বান জানায়, কিন্তু পাকিস্তানিদের বর্তমান প্রচারণার ভেতরে বাস্তবতাকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, বাঙ্গালিদের লাশের নিচে চাপা পড়ে আছে মৃত পাকিস্তান। সংশ্লিষ্ট সকলেই যত তাড়াতাড়ি এটা মেনে নেন, ততই ভালো। মার্চ ২৫, ১৯৭১ এর আগে যেমন পাকিস্তানের অস্তিত্ব ছিল, সেখানে যে কোন ভাবে ফিরে যাবার স্বপ্নই এখন অসাড়। ওই তারিখ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত এক মিলিয়ন বাঙ্গালির রক্ত বৃথা যেতে পারে না। বাকি ৭৪ মিলিয়ন বাঙালির দায় তাদের নিহত ভাইদের প্রতি, নিজেদের রক্তের শেষ বিন্দু ত্যাগ করে হলেও বাংলাদেশের পবিত্রতা, সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা। এবং তারা সেই সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত। বাঙ্গালিদের দৃঢ়প্রত্যয় সম্পর্কে কারো সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
এটা সত্য, জাতির মুক্তিসংগ্রামের প্রথম ধাপগুলোতে বাঙালি প্রতিরোধ বাহিনী বিশাল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নগরের পর নগর হারিয়েছে। তবে এর মানে এই নয় যে প্রতিরোধী শক্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বের দৌড় এর অস্ত্রশস্ত্রের পাল্লা পর্যন্তই। এর বাইরে বাংলাদেশের সমগ্র গ্রামাঞ্চল বিস্তীর্ণ, নিশানাবিহীন এবং মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এই বাহিনীর সদস্যরা আবার একজোট হয়েছে এবং গত দেড় মাস ধরে চোরাগোপ্তা হামলার প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তারা এখন পাকিস্তানি বাহিনীকে সর্বদাই পর্যুদস্ত করছে। আর্থিক এবং সেনাবাহিনীর হতাহতের সংখ্যা, দু’দিক দিয়েই শত্রুপক্ষের কার্যক্রম ব্যয়বহুল হচ্ছে।
বিশ্বের বৃহৎ শক্তিসমূহ এবং দাতা দেশগুলো অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তান শাসনব্যবস্থায় সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক কার্যক্রম চালু রাখতে পারে। বর্তমানে যে গণহত্যা নির্মম দক্ষতায় চালানো হচ্ছে, এ সাহায্যপ্রদান সেটিকেই কেবল প্রলম্বিত করতে পারে। এ বর্বর বাহিনীর পোড়ামাটি নীতি অর্থনীতিকে আরো পঙ্গু করে ফেলতে পারে, সমগ্র বাংলাদেশকে বিরানভূমিতে পরিণত করতে পারে। অবশ্য, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙ্গালিদের আর শাসন করতে পারবে না, তারা তাদের বিচ্ছিন্ন ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোকে যতই শক্তিশালী করুক না কেন। সেনাবাহিনীর অবস্থা হবে বিক্ষুব্ধ সাগরের মধ্যে দ্বীপাশ্রিতের মতো, সাহায্য নেয়ার মতো কোন মিত্রশক্তি যাদের নেই। এরই মধ্যে বাঙালি সরকারী চাকুরিজীবীদের ৮০% এরও বেশি মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি লড়াইয়ে শরিক হয়েছে – যার ফলে প্রশাসনকে বিকল হয়ে গেছে। বাঙালি পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী দলে দলে লড়াইয়ে যোগদান করেছে।
জনগণের জীবন এবং ভোগান্তির ব্যাপারে দায়িত্ব নেয় এমন যে কোন সরকার যদি এরূপ বাস্তবতার ব্যাপারে সচেতন হয়, তাহলে তাদের পদক্ষেপ নেয়ার কেবল একটি রাস্তাই খোলা থাকে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বাধ্য করা উচিত বাংলাদেশের মাটি থেকে সরে যাবার জন্য। বিশ্ব যদি সত্যিই বিশালসংখ্যক নিরাপরাধ মানুষের জীবন বাঁচাতে চায়, যদি গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার কোন মানে থেকে থাকে বিশ্বের কাছে, তাহলে বাংলাদেশকে সাহায্য করতেই হবে এবং এখনই।
বাংলাদেশ তাই সমগ্র বিশ্বের কাছে আবেদন জানাচ্ছে। চীনা বন্দুক, আমেরিকান গোলাবারুদ, ব্রিটিশ এবং সোভিয়েত সাজসরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে এ গণহত্যায়। আজ বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থের প্রতি আগ্রহ তাদেরকে মুক্তি এবং ন্যায়বিচারের পক্ষ নেয়ার পথে বাধা তৈরি করছে। যদি এই শক্তিগুলো শুধুমাত্র এটুকু ইঙ্গিত দেয় যে তাদের নিজেদের যন্ত্রপাতি গণহত্যার কাজে ব্যবহার করা যাবে না, আর কোন সাহায্য নিয়ে পাকিস্তানের কাছে আসা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মাটি থেকে অপসারণ না করে – যে বাংলাদেশে জনগণ আগের সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো, যেখানে বাঙ্গালিদের রক্তের বন্যায় বিরোধ নিষ্পত্তির সকল আশা ডুবে গেছে –তাহলে সামরিক শোষণযন্ত্র ধীরে ধীরে নিশ্চল হয়ে পড়বে।
ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্ববাসীর সরকার প্রধানদের উদ্দেশ্যে আবেদন জানাতে হবে, তাঁদের অনুরোধ করতে হবে যাতে তাঁরা তাঁদের সরকারকে জানান যে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানও সাময়িক। এ অঞ্চলে তাঁরা যে ভবিষ্যৎ খুঁজছেন, সে ভবিষ্যৎ নিহিত এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যেই, তাদের শোষকদের মধ্যে নয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক জনগণ, সমাজতন্ত্রী এবং মানবিকতাপূর্ণ সকল মানুষের উদ্দেশ্যে আমাদের আবেদন, তাঁরা যাতে তাদের যতটুকু ক্ষুদ্র প্রভাবই থাকুক সেটুকু ব্যবহার করেন যাতে করে এ গণহত্যা আর চলতে না পারে। আমাদের দ্বন্দ্ব কখনোই তাদের সাথে ছিলো না, তাদের অবশ্যই একত্রিত মানবতার উদ্দেশ্যে একীভূত হতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে তাদের শাসকদের মধ্যে যাতে বিচারবুদ্ধির সুস্থতা ফিরে আসে। তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের বক্তব্য এই যে, বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের অস্থি-রক্ত-মাংস থেকে কখনোই পশ্চিম পাকিস্তানে ন্যায়বিচারসম্পন্ন সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমাদের ধ্বংসাবশেষ থেকে আমরা উঠে দাঁড়াবো, নতুন সমাজ গঠন করবো, কিন্তু তাদের পরোক্ষ সম্মতিসূচক মনোভাবের কারণে তারা চিরকাল সে বুটের আঘাতে পিষ্ট হবে যেটি আমাদের পিষে ফেলতে চেয়েছিলো।
আমাদের নিজেদের জন্য আমরা অনুরোধ করি, আমরা যেন ১৯৪৭ এর অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি না ঘটাই, যেখানে পাকিস্তানের লক্ষ্যে সংগ্রামের মাধ্যমে তৈরি হওয়া সকল উৎসাহ মুছে গিয়েছিল বিশেষাধিকার এবং লোভের সমাজ গঠনের ফলে। আমাদের দ্বিতীয় জন্মের দুর্লভ সুযোগ হয়েছে। চলুন আমরা গড়ে তুলি সব কিছু, জনগণের সাথে, জনগণের জন্য।
ঘোষণা
১) বাংলাদেশে সংকট শুরু হবার পর থেকে এদেশে বসবাসরত বাঙ্গালিরা ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের কাজকর্মের সমন্বয় সাধনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনের প্রয়োজন অনুভব করেছে। এর ফলে, শিকাগোর একটি ল ফার্মের কাছ থেকে আইনি পরামর্শ নেয়া হয়েছে, এবং সে পরামর্শ অনুসারে একটি নতুন সংগঠন তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ ইলিনয়ে গঠিত হয়েছে একটি অলাভজনক, করমুক্তসংগঠন হিসেবে; যদিও এ সংগঠনে কোন চাঁদার ওপর কর মওকুফ হবে না।
মে ২৩, রবিবার শিকাগোতে এক সভায় বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগের একটি বোর্ড অব ডিরেক্টরস গঠন করা হয়েছে, যার মধ্যে সভায় উপস্থিত গ্রুপগুলোর প্রতিটি থেকে একজন করে সদস্য রয়েছেন। বোর্ড অব ডিরেক্টরস হবে লীগের সিদ্ধান্তগ্রহণকারী অংশ, এবং তাঁরা অনুদান সংগ্রহ এবং তদবির ইত্যাদি কার্যক্রম সমন্বয় করবে। এখন পর্যন্ত বোর্ড অব ডিরেক্টরস এ মিশিগান, ইলিনয়, ওহিও, ইন্ডিয়ানা এবং টেক্সাসের যে গ্রুপগুলো মে ২৩ এর সভায় প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল, তাদের থেকে একজন করে সদস্য রয়েছেন। যে সময়ের মধ্যে আপনার হাতে এই নিউজলেটারটি পৌঁছেছে, সে সময়ের মধ্যে সেটি বোর্ডেও প্রকাশ করা হবে।
২) বাংলাদেশ ইমার্জেন্সি ওয়েলফেয়ার আপীল নামের আরেকটি নতুন সংগঠনও ইলিনয়ে গঠিত হয়েছে, যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বাংলাদেশের যুদ্ধাক্রান্ত এবং উদ্বাস্তু জনগণের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করা। আপিল এ দেয়া চাঁদার কর মওকুফ করা হবে, এর মানে লোকজন তাদের বার্ষিক আয়কর থেকে ‘আপীল’ এ তাদের প্রদত্ত চাঁদার পরিমাণ বাদ দিয়ে দিতে পারবেন। বিডিএল এর মত, বিইডব্লু এ ও এ দেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রুপের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ড অব ডিরেক্টরের মাধ্যমে ব্যবস্থাপিত হবে। বোর্ডের চেয়ারম্যান ড এফ আর খান, শিকাগোর প্রখ্যাত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার।
বিইডব্লু এ শীঘ্রই দেশব্যাপী অনুদান সংগ্রহের জন্য আবেদন করবে। আরো তথ্য এবং রিসিপ্ট বুক স্থানীয় গ্রুপগুলোর সচিবদের কাছে মেইল করে দেয়া হবে।
৩) এদেশের বাঙ্গালিরা যুক্তরাষ্ট্রের অনেকাংশ জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আপনাদের অনেকেই যারা এই নিউজলেটারটি পাবেন, তারা হয়ত এরই মধ্যে কোন গ্রুপ তৈরি করে ফেলেছেন, যার ব্যাপারে আমরা এখনো জানি না। জুন ৬ তারিখে শিকাগোতে বিডিএল এর বোর্ডের পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হবে। যদি আপনি এ সভায় প্রতিনিধিত্ব করতে চান তাহলে এই ঠিকানায় আপনার প্রতিনিধির নাম পাঠিয়ে দিন, সেক্রেটারি, বিডিএল, ৫২৪৫, সাউথ কেনউড এভিনিউ, ইলিনয়, ৬০৬১৫।
৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বিচারক আবু সাঈদ চৌধুরী সোমবার, মে ২৪ এ নিউ ইয়র্কে আসছেন। তাঁর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তিনি জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করবেন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!