শিরোনামঃ যুক্তরাজ্য ডায়েরী
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজলেটার লন্ডনঃ নং ৭
তারিখঃ ২১ জুন, ১৯৭১
ইউনাইটেড কিংডম ডায়েরী
আন্থনি মাসকারেনাস
“ পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক পুর্ব বাংলার মানুষের উপর গণহত্যা” বিষয়ক “The bombshell of the week” প্রকাশনায় আন্টনি মাসকারেনাস , মর্নিং নিউজের(করাচি) উপ-সপাদক, টাইমস ও সানডে টাইমস এর পক্ষ থেকে পাকিস্তানে নিযুক্ত।
২রা মে “সানডে টাইমস” প্রকাশ করে টনির একটি লেখা যেখানে বাঙালীদের দ্বারা অবাঙালী ও বিহারীদের উপর ভহাবহ হত্যাকান্ডের কথা বলা আছে যা আমরা অতিরঞ্জিত, একপেশে ও বিরুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং ইহার উপর ভিত্তি করে বলা যায় বিষয়গুলো আর্মি ও “ইসলামিস্ট”দের দ্বারা সরবরাহকৃত । আমরা তখন বলেছিলাম যে বাস্তবিকপক্ষে ইহা ‘ইন্টার সার্ভিস রিলেশনের’ হস্তক্ষেপে করা এবং টনি’সহ আরো পাকিস্তানি সাংবাদিক যারা ব্রিটিশ ও আমেরিকান পত্রিকায় লিখেন তাদেরকে জোরপূর্বক তাই লিখতে দেওয়া হয়েছে যা আর্মি তাদেরকে লিখাতে চেয়েছিলো। বর্তমানে ১৩ জুন টনি নিজে “সানডে টাইমস”এর একটি নিবন্ধে প্রকাশ করেন তার বন্দুকসম্মুখে লিখা রিপোর্টের কথা। আমরা টনিকে সাধুবাদ জানাই এবং আনন্দিত যে সে রক্তপিপাসুদের দেশ থেকে দূরে আছে ও গণতন্ত্রের এমন দেশে নিরাপদে আছে যেহানে কারো কলম অথবা জবান বুলেট এবং বেয়নেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না । তার নিবন্ধ “genocide by the Pakistani army ” (পাকিস্তানি আর্মিদের দ্বারা গণহত্যা) সমগ্র প্ররথিবীকে চিরকাল তাড়িয়ে বেড়াবে। যদি নির্বাচনের পর পরই ক্ষমতা আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করা হত তাহলে কোন সন্দেহই ছিলো না যে শেখ মুজিবুর রহমান এই সাম্প্রদায়িক এবং বিভাগীয় হত্যাকান্ড নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন যেভাবে তিনি তার তিন সপ্তাহের “অভন্তরীণ আনুগত্য” ও সাম্প্রতিক সাপ্রদায়িক দাঙা হাঙ্গামার সময় শাশন কার্য নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
রেহমান সোবহান
আমাদের সর্বশেষ ইস্যু প্রকাশিত হওয়ার পর রেহমান সোবহান যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসেন। রেহমান যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেছিলেন দাতা দেশগুলোর প্রতিবনিধিদের সাথে দেখা করতে এবং ইহাহিয়ার প্রুধান অর্থ সচিব এমএমআহমেদের ভোজবাজির বিরোধীতা করতে যে কিনা প্রত্যাশিত আমেরিকার সকল দরজায় ভিক্ষার থালা নিয়ে ঘুরছিলেন।
লন্ডনে রেহমান যোগাযোগ করেন নিউ স্টেটম্যান এ থাকা তার বন্ধুদের এবং পত্রিকাটি “corpse in the sun” নামে একটি শক্তিশালী সম্পাদকীয় নিয়ে প্রতিভূত হয়। পরবর্তী দিন থেকে “গার্ডিয়ান” ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে থাকে তার নিবন্ধ “prelude to an order and genocide”(শাসন ও গনহত্যার উপক্রমনিকা) এবং “helping yahya to himself”(ইয়াহিয়ার নিজ সাহায্য )
বাংলাদেশ নিউজলেটার এক্টিভিটিস্ট ও বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সম্পর্কযুক্ত মানুষদের নিয়ে রেহমান দুই ঘন্টা স্থায়ী একটি প্রীতিসম্মেলনের ব্যবস্থা করেন “Ganges Restaurant” যা যথেষ্ট নজর আকর্ষনে সচেষ্ট হয়েছিলো।
প্রধান সম্পাদক , কলামিস্ট, লেখক, সংসদ সদস্য এবং বাণিজ্যিক নেতাদের সাথে রেহমান অনেকগুলো মিটিং করেন। “স্টুডেন্ট একশন কমিটি”র একটি জনসভায় উনি যোগদান করেন যেথায় উনি দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করেন।
ত্রাণের লক্ষ্যে নারী মিছিল
৫-ই মার্চ এক শত পঞ্চাশ বাংলাদেশী নারী ও শিশু প্রধান মন্ত্রী ও
ত্রাণ সংস্থার জন্য প্রতিবাদের চিঠি হাতে ওয়েস্টমিন্সটারে মিছিল করে।
এই প্রতিবাদ গ্রেট ব্রিটেন এর বাংলাদেশ উওমেন্স এ্যাসোসিয়েশন দ্বারা সংগঠিত হয়। মিঃ হিথ, যিনি উপস্থিত ছিলেন না, এই চিঠিতে পাকিস্তান এ ত্রাণ কাজ বহাল রাখার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য তাকে আহবান জানান হয়।
প্ল্যাকার্ডে গণহত্যা শেষ করার জন্য, পাকিস্তানের জন্য সাহায্য, এবং পাকিস্তান সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য বলা হয়।
মিসেস জাহানারা রহমান, সংগঠক, বলেন, নারীরা ভারতের বাঙালি উদ্বাস্তুদের মধ্যে কলেরা মহামারি নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিল। কিন্তু তারা আশঙ্কা করছিল যে, কলেরা ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ পাঠানোর জন্যে খাদ্য ছাড়া শরণার্থীদের ভুলে যাওয়া হবে।
সমিতিটি ব্রিটেনে ৪০০ ইউরো, এবং একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিশুদের পোশাক সংগ্রহ করে। কিন্তু যখন এটি প্রেরণ করা হয়, এটা তাদের মানুষের কাছে পৌঁছাবে- এই আশ্বাস এর জন্য তারা অপেক্ষা করতে থাকে।
পাকিস্তানে এইড থামাতে প্রচারণা
ব্রিটেনে বাংলাদেশের সমর্থকদের একটি বড় বিক্ষোভ মিছিল ১৩ জুন পাকিস্তান এইড থামাতে একটি প্রচারণা Hyde Park থেকে শুরু করে বৈদেশিক উন্নয়ন, কানাডিয়ান হাইকমিশন ও মন্ত্রণালয়, ফরাসি, বেলজিয়ান, জার্মান, অস্ট্রিয়ান, আমেরিকান, জাপানি, ডাচ ও ইতালিয়ান দূতাবাস, যার সরকারগুলো পাকিস্তানে সাহায্য পাঠান তাদের কাছে পৌঁছান। মিছিলটি পার্ক লেন, পিকাডিল্লি, ডাউনিং স্ট্রিট এবং ট্রাফাল্গার স্কয়ারে মনোযোগ আকর্ষণ করে। মিছিলের একজন মানুষ পবিত্র কুরআন থেকে আবৃত্তি করে নেতৃত্বে ছিল। অন্য যুবক কবিতাও আবৃত্তি করেন। বিক্ষোভ কিছু দিনের জন্য¬¬¬¬¬ চলতে থাকবে।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক নেতা “গণহত্যা দোষী”
ছয় প্রিভি কাউন্সিলর লেবার পার্টির চেয়ারম্যান সহ তিন শতাধিক শ্রমিক এমপি, জনাব ইয়ান মিকারডো এবং লেবার এর জাতীয় নির্বাহী, অন্য তিন সদস্য প্র্যাঙ্ক এলাউন, জনাব টম ড্রিবারগ, জনাব টম ব্র্যাডলে, জনাব জন স্টোন হাউস, প্রাক্তন পোস্ট ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী দ্বারা স্পন্সরক্রিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন- “জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশন ভাঙার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক নেতাদের আসামি করে বিচারের জন্য দায়ি করা হচ্ছে।”
সভায় প্রস্তাবিত বিষয় এর মতেঃ “সংসদ বিশ্বাস করে বিপুল পরিমাণ সাধারণ মানুষের হত্যা এং পুর্ব বাংলায় পাকিস্তানি আর্মিদের এই নিষ্ঠুরতা জাতিসংঘ গনহত্যা কনভেনশনের বিরুদ্ধ যা কিনা পাকিস্তানি সরকার দ্বারা সাক্ষরিত যার মাধ্যমে নিশ্চিত করে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ শাসনের জন্য সব অধিকার রাখে না এবং ইহার নীতি অমান্য করেই জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা যা তারা ১৯৭০ এর নির্বাচনের মাদ্গ্যমে প্রকাশ করেছিলো অমান্য করছে; এর ফলে বিশ্বাস রাখা যায় যে অতিশীঘ্রই আন্তর্জাতিক শান্তি হুমকি ও গনহত্যা কনভেনশনের প্রতি লঙন ; উভয় অবস্থার উপর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পর্ষদের অধিবেশন হবে; এবং পরবর্তীতে বিশ্বাস রাখা যায় যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের সাময়িক সরকার পুর্ব বাংলার গণমানুষের স্বীয়সিন্ধ্বান্তের পরিচায়ক হবে।”
দ্বিতীয় আরেকটি প্রস্তাবনা সাক্ষরিত হয় সকল দলের প্রায় ২৫০ সদস্যের দ্বারা যেখানে পাকিস্তান সরকারের নিন্দা করা হয় এবং আশা করা হয় “যতদিন পুর্ব পাকিস্তানে যথাযথ রাজনৈতিক অবকাঠামো তৈরি না হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক সাহায্য ব্বন্ধ থাকবে… রাজ অনুগত সরকার আসন্ন সভায় পাকিস্তানি সাহায্য তহবিলের বিষয় এমনভাবে প্রস্তাব করুক যেন সাহায্য শরনার্থী চাহিদা পুরণে সহায়ক হয়।”
সংসদ এই মাসের ০৯ ও ১০ তারিখ “বাংলাদেশ”এর উপর দুইবার অধিবেশন করে (বিতর্ক) করে।
পাঁচ লক্ষ পাউন্ডের দুর্যোগ তহবিল
দুই সপ্তাহ আগে করা জাতীয় আবেদনের পর প্রায় পাঁচ লক্ষ পাউন্ডের সাহয্য তহবিল গঠন করা হয় “Disaster Emergency Committee” দ্বারা পাকিস্তানি শরনার্থীদের সাহায্য করার জন্য।
পুর্ব বাংলার শরনার্থীদের মল্ডিং
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মিঃ মল্ডিং ১৫ জুন বলেন যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাঙালী শরনার্থিদের উপর তদন্ত করবে যারা যেখানে তাদের নিকট আত্মীয়দের সাথে থাকতে চায় কিন্তু পুর্ব বাংলার যুদ্ধাবস্থার কারণে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রের ব্যবপ্সথা করতে পারছে না ।
বাংলাদেশ তহবিলে দান
পুর্ব ANGLIA ‘য় “The Bengali Association” (সভাপতি এমএনরাহমান সম্পাদক মোঃ আকসার ) প্রায় এক হাজার পাঁচশ পাউন্ড দান করেন বাংলাদেশের পক্ষে “ঈস্ট ১১ গোরিং স্ট্রিট,লন্ডন ই সি ৩” থেকে। তারা ১৩ তারিখ থেকে সাপ্তাহিক অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা চালু করে। আমরা তাদেরকে সাধুবাদ জানাই এবং আশা করি অন্যরাও তাদেরকে অনুসরণ করবে।
শান্তি সংবাদ
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গণহত্যার পর থেকেই “মুভমেন্ট ফর বাংলাদেশ” পক্ষএ শান্তি সংবাদ প্রকাশ শুরু হয়। ইহা রজার মোডি এবং আরো অনেকের কিছু শক্তিশালী নিবন্দ প্রকাশ করে। আমাদের পাঠকরা ইহা অত্যন্ত ভালো নিয়মিত লেখা হিসেবে গ্রহণ করে। ইহা ৫ পাউন্ড মুল্যের ছিলো এবং 5 Caledonian Road, London N L(OL-837
9794/5) থেকে পাওয়া যেত।
উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম লন্ডন সভা
উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম লন্ডনে Rt Hon A J Stallard MP সভাপতিত্বে তদানিন্তন গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার একটি সভার ব্যবস্থা করে। অন্যতম প্রধান বক্তারা ছিলেন লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি জনাব বিচারপতি এএসচৌধুরী, তৎকালীন জাতীয় অধিবেশনে জয় পাওয়া আওয়ামীলীগ সদস্য আব্দুল মান্নান এবং বাংলাদেশ ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সভাপতি জনাব শাহ-জাহান(যিনি গত সপ্তাহে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল লেবর অর্গানাইজেশন কনফারেন্সে উপস্থিত থেকে ফিরেছেন )। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জনাব স্ট্যালার্ড তার সম্পুর্ণ সহোযোগিতা ও সমর্থন প্রকাশ করেন এবং সভায় উপস্থিত যেকোন পাকিস্তানি প্রতিনিধির প্রটি বলেন তারা যেন তাদের প্রভুদের বলে উনাকে শিরোনামের মাধ্যমে ভিত্তিহীন কিছু না পাঠায়। তিনি বলেন তিনি নিয়মিত বাংলাদেশ নিউজলেটার পড়েন এবং বাংলাদশের ভিতরের চলমান অবস্থার উপর প্রকাশিত সংবাদকে সাধুবাদ জানান।
জনাম জাস্টিস চৌধুরী আওলোকপাত করেন সাধীনতা ঘোষণা এবং সবার প্রটি আহবান করেন যেন সবাই এক থাকে, মুক্তিযুদ্ধের জন্য সচেষ্ট কাজ করে এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বের এগিয়ে আসে।
লন্ডনের শরম ও বাণিজ্য সংস্থাদের প্রতি জনাব শাহ জাহান বাংলাদেশের শ্রমিক যারা গণতন্ত্র ও নিজ অধিকার আদায়ে কড়াই করছে তাদের প্রতি একাত্মতার প্রকাশে আহবান করেন।
জনাব মান্নান একজন বাকপটু এবং উনি বাংলায় বকৃতা দেওার সময় কেউই তার কথা বুঝুক আর নাইবা বুঝুক কিন্তু সবাইকে অশ্রুসজল করেন যখন উনি গণহত্যার দৃশ্যমান অবস্থা সবার সামনে উপস্থাপন করেন।
হাইড পার্ক র্যালী
১৯ জুন হাইড পার্ক, লন্ডনে বাঙ্গালীদের প্রতিবাদ সভায় জনাব পিটার শোর (এমপি) এবং অর্থনৈথিক সংযোগের প্রাক্তন কর্মসচিব বলেন “ব্রিটিশরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের অগ্রনী ভূমিকা রাখা উচিত।আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাদের এইটা নিশ্চিত করতে হবে যে পাকিস্তানি অর্থনীতি আর কোন সাহায্য পাবে না যতক্ষণ পাকিস্তান সরকার তাদের গুলিবর্ষণ বন্ধ করে এবং সাধারণ ও গণতান্ত্রিক স্বায়ত্বশাস্ন নিশ্চিত না করছে । ”
লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশেরর প্রতিনিধি জনাব জাস্টিস চৌধুরী প্রায় সম্পুর্ণ ব্রিটেনে ভ্রমণ করেন এবং ব্র্যাডফোর্ট, ম্যানচেস্টার, লীডস, বার্মিংটন, কার্ডিফ ও স্কটল্যান্ডে বিভিন্ন জায়গায় বিপুল জনসমাবেশের ব্যবস্থা করেন ।