শিরোনামঃ আমেরিকার চিঠি
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ নিউজ লেটার লন্ডনঃ নং ৪
তারিখঃ ২৬ এপ্রিল, ১৯৭১
আমেরিকার চিঠি
নিউ ইয়র্ক (এয়ার মেইলে )
ইয়াহিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের প্রয়োগ করে যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, এ খবরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং লাতিন আমেরিকার জনসাধারণ গভীরভাবে শঙ্কিত।
জনমত পূর্ব বাংলার জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার রক্ষার দাবীতে সম্পূর্ণ একাত্ম , যে দাবী উত্থাপন করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।
ইস্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকার ব্যানারে সংগঠিত, আমেরিকায় বসবাসরত বাঙ্গালী ছাত্ররা , ২ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘটনার রাজনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে এবং বাংলাদেশের দাবীকে এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে । তারা জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তৃতা, শিক্ষণ, সমাবেশ এবং লবিং এর জন্য জোরেশোরে প্রচারণা চালানোর জন্য সংগঠিত হচ্ছে। বেঙ্গল একশন কমিটি অব ইস্ট পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকার ২ মার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেটির প্রধান কার্যালয় নিউ ইয়র্কে অবস্থিত। এই একশন কমিটি গঠনের ফলে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয় :
(ক) হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতির উপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। সারা দেশজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিপীড়িত বাঙ্গালিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গের বক্তৃতা এবং শিক্ষণে এটি একটি নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করছে।
(খ) ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস কালচারাল অরগানাইজেশন বেংগল একশন কমিটির স্বাধীনতা আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন।
(গ) “আমেরিকানস কনসারনড ফর বাংলাদেশ” নামে অন্য একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যার কার্যালয় নিউ ইয়র্কের 145 East 14th Street-এ। ইতোমধ্যে এই সংগঠন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের মিশনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে।
একশনর কমিটির প্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপ ছিল নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির সাক্ষাৎকার প্রার্থনার উদ্যোগ গ্রহণ করা। তারা সভাপতিকে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের উপর তার ব্যক্তিগত প্রভাব খাটানোর জন্য একান্ত অনুরোধ জানান , যাতে তারা নিপীড়িত মানবতার স্বার্থে পূর্ব বাংলায় হস্তক্ষেপ করে এবং তাঁকে পূর্ব বাংলার দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সহায়তার অনুরোধ জানান।
একশন কমিটির উদ্যোগে প্রথম বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ৯ মার্চ , জাতিসংঘ ভবনের সামনে। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা কিছু আমেরিকান ছাত্রসহ নিউ ইয়র্কের বেশ কিছু প্রধান সড়ক প্রদক্ষিন করে এবং অবশেষে পাকিস্তানের কন্স্যুলেট জেনারেল এর কার্যালয়ের সামনে এসে তা শেষ হয়। তারা কয়েক ঘন্টার জন্য কার্যালয় দখল করে এবং সাংগঠনিক বিষয়ে বেশী কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।
এ্যাকশন কমিটি বাংলাদেশের জনসাধারণের উপর গনহত্যা বন্ধ করতে , কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ জানায়।
এ্যাকশন কমিটি অপর একটি টেলিগ্রামে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে জাতিসংঘ সনদের ৯৯ ধারার আওতায় নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহবান করার জন্য অনুরোধ জানায় এবং পূর্ব বাংলার জনসাধারণের ওপর পরিচালিত নির্দয় এবং বাছাইকৃত গণহত্যা বন্ধে একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর অনুরোধ জানায়। এ্যাকশন কমিটি ফ্রান্স সহ নিরাপত্তা পরিষদের সকল সদস্যকে আহ্বান জানান এবং বাংলার ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। ফ্রান্স , আর্জেন্টিনা এবং ভারতের প্রতিনিধিগণ এ্যাকশন কমিটির সদস্যদের একাধিকবার সাক্ষাৎ মঞ্জুর করেন।
এছাড়াও আমেরিকার পত্র-পত্রিকায় চিঠি-পত্র পাঠানো এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানে উপস্থিতির পাশাপাশি, একশন কমিটি বহু সংখ্যক বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজন করে। ২৬ মার্চ বিক্ষোভকারীরা জাতিসংঘ ভবনের সামনে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। এছাড়া পূর্ব বাংলায় ইয়াহিয়ার সৈন্য বহনকারী পশ্চিম পাকিস্তানি নৌ ও বিমানবহরে সুবিধাদি প্রদান বন্ধ করার দাবী জানিয়ে তারা শ্রীলঙ্কান মিশনের সামনে বিক্ষোভ করে।
এই বিক্ষোভ সমাবেশ এবং পূর্ববঙ্গের নৃশংস গণহত্যার কথা টেলিভিশন এবং বেতারে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সম্প্রচারিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র , কানাডা এবং লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের বড় বড় শহরে অবস্থানরত বাঙালী ছাত্ররা স্থানীয় ছাত্রদের সঙ্গে মিলে একশন কমিটির শাখা প্রতিষ্ঠা করেছে।
একশন কমিটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে ত্রাণ কর্মকাণ্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যে তহবিল সংগ্রহের জন্য ১৬ সদস্য বিশিষ্ট ফাইন্যান্স কমিটি গঠন করে।