শিরোনামঃ বিশ্ব জনমত
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ১
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বিশ্ব সংবাদ
বাংলাদেশ সমস্যা সম্বন্ধে জাতিসংঘের পলায়নপর মনোভাবের ছাপ দেখা যায় সাধারণ অধিবেশনের নবনির্বাচিত সভাপতি, ইন্দোনেশিয়ার ড আদম মালিকের কৌতূহল উদ্রেককারী বিবৃতিতে। তিনি জনসম্মুখে মনোভাব প্রকাশ করেন যে এ ব্যাপারটিতে তিনি কোনো বিতর্কের পক্ষপাতী নন। এটা অবশ্যই তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি, কিন্তু সভাপতির এরূপ সময়ের আগেই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ অধিবেশনের বিচারকে প্রভাবান্বিত করবে এমন সংশয় রয়ে যায়। এই বিশ্ব সংস্থাটির উদ্দেশ্য হল স্বাধীন আলোচনা এবং মতামত ও ধারণার মুক্ত আদান-প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোর সমাধানে সাহায্য করা। এটা কিছুটা অবাক হবার মতই ব্যাপার যে সাধারণ অধিবেশন (সবকটি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত এবং তাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি সভা) এর সভাপতি মৌলিক মানবিক অধিকারের জন্য সংগ্রামরত সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ক্ষেত্রে এই একই পদ্ধতি অনুসরণের বিপক্ষে। তার এই মনোভাবের স্বপক্ষে তিনি যুক্তি দিয়েছেন এই বলে যে “এই আলোচনা কখনো সমাপ্ত হবে না এবং এ সমস্যার দ্রুত সমাধান সম্ভবপর নয়”। তিনি “পর্দার অন্তরালে” কাজ করতে আগ্রহী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তিনি লীগ অব নেশনস এর চুক্তিপত্র দ্বারা নিষিদ্ধ গোপন কূটনীতির যুগ ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছেন। যদি সময়ক্ষেপণ আলোচনার বিপক্ষে অবস্থান নেবার যুক্তিসিদ্ধ কারণ হতে পারে তবে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাই নাকচ করে দিতে হবে। সাধারণ অধিবেশন কি গণতন্ত্রের সমাধিফলক লিখতে চলেছে?
এরূপ অনুমান করা কি খুব কঠোর হয়ে যায় যে ড মালিকের বাংলাদেশ সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনার বিপক্ষে অবস্থানের পেছনে ইয়াহিয়ার শাসনকে প্রকাশ্যে আসা থেকে রক্ষা করতে তার ইচ্ছাই তাকে চালিত করেছে? এই শাসনের অপকর্ম সমূহ সম্পর্কে এখন বিশ্ব বেশ ভালভাবেই ওয়াকিবহাল। তবু বিশ্বমঞ্চে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হবার কলঙ্ক থেকে বাঁচতে ইসলামাবাদ স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন। এক্ষেত্রে পাকিস্তানকে সুরক্ষা দেয়া ড মালিকের কর্তব্য নয়। যদি অন্যান্য রাষ্ট্র পাকিস্তানকে মানবসৃষ্ট আইন ভঙ্গ করে চালানো পাশবিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তবে পবিত্র পাকিস্তান নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের যথেষ্ট সুযোগ পাবে। পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে এই বিতর্কে অংশ নেবার। গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্তদের সামনে কেবলমাত্র একটি সম্মানজনক পথই খোলা থাকে, আর তা হল কার্যকরীভাবে সেই অভিযোগের খণ্ডন। যদি ইয়াহিয়া ও তার সাগরেদরা সেপথ গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে তবে তাদের এর ফলও ভোগ করতে হবে। সাধারণ অধিবেশনের কাজ হল বিশ্বমানবের মনোভাব প্রকাশে সহায়তা করা, তাকে রুদ্ধ করা নয়। ড মালিক গণতন্ত্র এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্বচ্ছতার বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর নজির স্থাপন করছেন।
ড মালিকের তত্ত্বের যা কিছু অভিনবত্ব তা এইক্ষেত্রে পাকিস্তানের আইনগত অবস্থান সম্বন্ধে তার ধারণা থেকে উদ্ভূত, এবং এই ধারণা বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হওয়া অব্দি পাকিস্তানের উৎসাহী বন্ধুদের দিয়ে আসা বক্তব্যের প্রতিধ্বনি মাত্র। ‘আপনি পারেন না’ তিনি বলেন ‘পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে কারণ এটা তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা’। ইহুদী নিধন হিটলারের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সমস্যাই ছিল! ড মালিকের দাওয়াই হল ভারত এবং পাকিস্তানকে ‘চাপ প্রয়োগ’ যেন তারা একত্রিতভাবে ‘এই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করে’। এই ‘চাপ প্রয়োগ’ কিভাবে হবে, কে বা কারা করবে? পাকিস্তান কেন তাদের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ এ ‘চাপ প্রয়োগ’ বরদাস্ত করবে? আবার কেন ভারত এবং পাকিস্তানকে একত্রিতভাবে কাজ করতে হবে? এই ‘রাজনৈতিক সমস্যা’ যা এখন পুরো বিশ্বের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা তৈরীতে কি ভারতের হাত ছিল? ড মালিক বহুবছর ধরে পশ্চিমা শক্তিগুলোর গ্রহণ করা পথেই চলতে চেয়েছেন, আর তা হল এই উপমহাদেশের সকল ব্যাপারেই ভারত ও পাকিস্তানকে একত্রিতভাবে পদক্ষেপ নিতে চাপ প্রয়োগ করা। এই কৌশল কাশ্মীরের ক্ষেত্রে খুবই সামান্য সুফল এনেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, যেখানকার জনগণ স্বাধীনতা লাভে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেখানে এটা বিন্দুমাত্র ফলপ্রসূ হবে না। সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি এক ঐতিহাসিক ঘটনা; এটা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বা সাধারণ অধিবেশনের সভাপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।