শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
যুদ্ধেই বাংলাদেশের মুক্তি | দ্য নেশন
খণ্ড ১: সংখ্যা ২ |
৮ অক্টোবর, ১৯৭১ |
কেবল যুদ্ধই পারে বাংলাদেশকে বাঁচাতে
(বিশেষ জাতীয় প্রতিবেদন)
কখন, কীভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সমাপ্তি হবে? প্রায়ই জিজ্ঞাসিত এই প্রশ্নের উত্তর এক শব্দে দেয়া সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার এ ইস্যুকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকা বিষয়গুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের একজন আগ্রহী পাঠক খুব শক্ত একটি উপসংহারে পৌঁছবেন। আমাদের মুক্তিবাহিনীই কেবলমাত্র বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পারে, এবং সেটি কবে হবে তা পুরোপুরিই নির্ভর করে শত্রুকে একই সঙ্গে স্থলে-জলে-আকাশে সমানে-সমানে আঘাত করতে মুক্তিবাহিনী কতটা প্রস্তুত তার ওপর।
সমাধানটা ওখানেই, অন্যত্র নয়। এ ধরনের যুদ্ধে নিয়ামক মুক্তিবাহিনীর অভ্যন্তরীণ সামরিক ও মানসিক শক্তি, যা আমাদের ভাগ্য, সামর্থ্য এবং চারিত্রিক দৃঢ়তাকে নির্ধারণ করতে পারে।অন্য কোন পথে অগ্রসর হওয়াটা হবে আসল উদ্দেশ্যের সাথে প্রতারণার সামিল, এটা আত্মপ্রতারণা বা বুনোহাঁস খোঁজার মতই ব্যাপার হবে।
উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশ ইস্যুটি ক্যান্সারের মতো হয়ে পড়েছে, এটি সত্য। অন্য কোন দেশ তাদের হয়ে লড়াই করে জয় এনে দেবে, এ বিভ্রমজাল থেকে বাঙালি জাতিকে বের হয়ে আসতে হবে। “ভিক্ষা চেয়ে মুক্তি অর্জন হয় না। শক্তি প্রয়োগ করেই একে অর্জন করতে হয়, রক্তের মুল্য দিয়েই।”–এইবেদবাক্যবাঙ্গালিকেতাইসর্বাংশেঅনুসরণকরতেহবে।এরবিকল্পপ্রস্তাবনাহচ্ছে“পিঠটানদেয়া”, বাস্তবতাকে অস্বীকার করে সম্মুখযুদ্ধে এ মাটির সন্তানদের বীরত্বকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করার জঘন্য প্রচেষ্টা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ছয়টা রুদ্ধশ্বাস মাস অন্তত একটি জিনিস প্রমাণ করেছে, সামরিক জান্তাকে তোষামোদ করে এবং তাদের মিষ্টি কথায় ভুলে গিয়ে কোন লাভ হবে না। তারা এই সংহারী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তারা এখনো গণহত্যা চালানোর ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
জাতিসংঘে জ্ঞানগর্ভ বিতর্ক, চিন্তা-জাগানিয়া সিদ্ধান্ত অথবা কোন লোকদেখানো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভোটাভুটি করাটা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ নিরর্থক হবে। এরই মধ্যে কাঁচের মত স্বচ্ছ হয়ে গেছে যে, প্রচণ্ড শক্তিতে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আর কোন কিছুই দখল করে রাখা ভূখণ্ড থেকে শত্রুদের এক ইঞ্চিও সরাতে পারবে না।
অন্য দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একটি মাত্র শক্তির ক্ষমতা উপলব্ধি করতে পেরেছে, মুক্তিবাহিনী, যাদের অদম্য উদ্দীপনা এবং জেদি অধ্যবসায়ের কারণে শত্রুসেনারা হতাহত হচ্ছে, এক ফ্রন্ট থেকে আরে ফ্রন্টে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের সাহসী যোদ্ধাদের স্থলযুদ্ধে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। বিমানবাহিনীর বদৌলতেই দখলদার বাহিনী এখনকার মতো কিছুটা সুবিধা পাচ্ছে। প্রশিক্ষিত জনশক্তির দিক দিয়ে সংখ্যাগত সীমাবদ্ধতা মুক্তিবাহিনী কাটিয়ে উঠেছে। এখন তারা সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার মত সমান শক্তিশালী। তাদের নৈতিক শক্তিও একই রকম দুর্দান্ত। এ ভূখণ্ডের দাবিদাররা আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সুনিশ্চিতভাবে সুবিধানজনক অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশ যুদ্ধের প্রসঙ্গে, আশু করণীয় হচ্ছে: বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবংজটিল অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধবিমানের যোগান, এর মধ্যে প্রথমটির সাথে পরেরটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের স্বীকৃতিলাভ না হলে কারা অস্ত্র সরবরাহ করবে? এমনকি নব্বই লক্ষ মানুষের অন্নসংস্থান করতে বাধ্য হওয়া ভারতও বাংলাদেশের স্বীকৃতিলাভের আগে এদেশে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে না।
সারা বিশ্ব জানে, ২৬ মার্চে বিদ্রোহ শুরু করার সময় ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং সহায়তাকারী বাহিনীগুলোর হাতে যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল, প্রধানত তা দিয়েই মুক্তি বাহিনী লড়াই করে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি আমাদের যোদ্ধারা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া বিশাল অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও লড়াই করছে।
আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব এবং যুদ্ধবিমান না থাকার কারণে মুক্তিবাহিনীকে গেরিলা যুদ্ধকৌশলেই আটকে থাকতে হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, গেরিলা যুদ্ধ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের উপায় নয়। সার্বিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সার্বিক যুদ্ধ প্রয়োজন। সার্বিক স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি যোদ্ধা এবং সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে অন্য কোন কিছুই মেনে নেয়ার মতো নয়।
তাছাড়া, গেরিলা যুদ্ধ হবার মানে দীর্ঘস্থায়ী একটি যুদ্ধ, যেখানে আমাদের ভাগ্য অনিশ্চয়তায় ঘেরা। বাঙালি জাতি কি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে সন্তুষ্ট হবে? না, কখনোই না, কারণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনতা কামনা করা বাঙালি জাতির মুক্তির তাড়নার সাথে এ সন্তুষ্টি বেমানান। এ জন্য, প্রচলিত যুদ্ধের মতোই, শত্রুর ওপর পূর্ণ আক্রমণ বাধ্যতামূলক বলেই বাংলাদেশের যুদ্ধপরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী ব্যক্তিদের জোরালো অনুভূতি।
যাঁরা ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের সমাপ্তির ওপর বিশ্বাস রাখেন, যাঁরা এক দল মানুষের জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে বিশ্বাসী, তাঁদেরকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। মুক্তিবাহিনীতে জনশক্তির অভাব নেই। অভাব হচ্ছে জটিল অস্ত্রশস্ত্রের, এর পরেই রয়েছে যুদ্ধবিমানের অভাব। আধুনিক সমরাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান সজ্জিত মুক্তিবাহিনী আরো তাড়াতাড়ি শত্রুবাহিনীকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করতে পারবে। তখন হয় শত্রু পলায়ন করবে, নয়তো আত্মসমর্পণ করবে, নয়তো ধ্বংস হবে।
তারা যদি সমুদ্রপথে পালানোর চেষ্টা করে, তাদের ব্যবস্থা করার জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনী অবশ্যই পাহারায় থাকবে।
এটা পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জাতির বাঁচামরার প্রশ্ন। বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রেমী জাতিসমূহ কি একটি স্বাধীনতাকামী জাতির সংকটের মুহূর্তে নীরব দর্শক হয়ে থাকবে? মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী হিসেবে তাদের দায়িত্ব, জাতিগতভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার সমুন্নত রাখার। তারা যাতে ভুলে না যায়, বর্তমানে জাতিসংঘের বেশিরভাগ সদস্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপজাত, যে যুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল।
মানবতার অপেক্ষাকৃত প্রকৃতিস্থ অংশের ওপর, বিশেষ করে যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন দেশগুলোর ওপর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়াটা যৌক্তিকভাবে অবশ্যপালনীয়, যাতে করে আরেকটি ঔপনিবেশিক রাজত্বের পতন ঘটে এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।