You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়, রাজনৈতিক সমাধান কোথায়
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ২
তারিখঃ ৮ অক্টোবর, ১৯৭১

অনিশ্চিত রাজনৈতিক সমাধান

বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক সমাধান একটি প্রায়শই প্রস্তাবিত এবং আবেদন করা কৌশল। উভয় পূর্ব এবং পশ্চিমে এই উদাহরণগুলো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী এবং খ্যাতিমান ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের পর্যন্ত পরিবেষ্টন করেছে। এটা ঠিক যে এই পরামর্শ গুলো লাখ লাখ মানুষের বেদনাময় কান্না, যারা এখন পশ্চিম পাকিস্তানের রক্তপিপাসুদের শিকার এদের প্রতি তাদের উদ্বেগ ও মর্মপীড়ার প্রতীক।এই ধ্বংসলীলা এখনো চলছে এবং নিকৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা বেড়েই চলেছে। যত দিন যাচ্ছে নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনদের মৃত্যু দ্বিগুণ হচ্ছে। স্মরণকালের সর্ববৃহৎ দেশত্যাগ অব্যাহত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষেই অন্ধকার ইতিহাসের গায়ে একটি কালো পালক।
বাংলাদেশের ব্যপার নিয়ে সরাসরি সম্পৃক্ত দলগুলো হচ্ছে সম্পূর্ণ বাঙালি জাতি, এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা, যারা বাঙালি জাতির অধিকার জবরদখল করেছে। উভয়পক্ষই রক্তাক্ত সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তী পক্ষ অর্থাৎ পকিস্তানি সামরিক জান্তা যে মাটি তাদের নয় তা জোর-জবরদস্তি দখলের লড়াইয়ে জড়িত এবং প্রথম পক্ষ অর্থাৎ বাঙালি জাতি শক্তভাবে লড়াই করছে হানাদারদের তাড়িয়ে স্বদেশ নিজেদের আয়ত্বে আনার। লড়াই দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে এবং বাঙালি জাতির ভাগ্য সুস্পষ্ট ভাবে নির্ধারিত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার দিন দ্রুত এগিয়ে আসছে।
তৃতীয় পক্ষ যারা সরাসরি যুক্ত তারা হচ্ছে ভারত। ভারত ইচ্ছাকৃত ভাবে এর সাথে জড়ায় নি। পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়েই তারা এই ইস্যুতে জড়িয়েছে, মানবিক মূল্যবোধ এবং মানবতার প্রতি ভালোবাসা থেকেই। বিশ্বের ইতিহাসে অদ্বিতীয় এই ব্যাপক গণহত্যার পর প্রায় ১ কোটি বাঙালি নিরাপত্তার জন্য ভারতের মাটিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ভারতের জনতা এবং সরকারের এই ত্যাগ স্বীকার আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে দেখি। “আমরা ৯০ লক্ষ শরনার্থী কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিবনা” ইন্দিরা গান্ধীর এই সাহসী বিবৃতিতে আমরা অভিভুত।
অনির্দিষ্ট কালের জন্য প্রায় ১ কোটি মুখের অন্য জোগারের বোঝা বইবার তারিফ আমরা করি। ভারতের অর্থনীতির জন্য এটি একটি বোঝা। আমরা চাইব আমাদের উপকারী বন্ধুরা যেন সত্যিটি বুঝেন। বাঙালিরা স্বাধীনতা ব্যাতিত অন্যকিছু মেনে নিবেনা। প্রায় ১০ লক্ষ বাঙালিকে নৃশংস ভাবে হত্যা করার পর, হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করার পর, এক কোটি বাঙালিকে গগৃহহীন নিঃস্ব করার পর রাজনৈতিক সমাধান আমরা কিভাবে মেনে নেই? এই অসন্তোষজনক বিষয়ের সকল খুঁটিনাটি দেখার পর বাংলাদেশ সরকার মনে করে যে, “স্বাধীনতা ব্যাতিত অন্য কোন সমাধান গ্রহণযোগ্য নয় এবং স্বাধীনতাই কেবল পারে শরনার্থিদের স্বাধীন এবং নিরাপত্তার সাথে দেশে ফেরানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে।
রাজনৈতিক সমাধানের সর্বশেষ ওকালতকারী হচ্ছে আমেরিকা। যারা এযাবৎ পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান করে এসেছে, এমনকি তাদের উৎস– এবং বিশ্বব্যাংক স্টাডি টিম দ্বারা ওয়াশিংটনে গণহত্যার নিশ্চিত খবর যাওয়ার পরেও। যখন মুক্তি বাহিনী তাদের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে এবং মৃত্যুকে তুচ্ছ করে লুটেরাদের একের পর এক রণক্ষেত্রে পরাজিত করছে আমেরিকা কর্কশ স্বরে কাঁদছে। রজার্সের থ্রী পয়েন্ট পরিকল্পনা হলঃ উপমহাদেশে সংযমের চর্চা অবশ্যই করতে হবে। এবং একটি কার্যকরী রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আবশ্যক, দুর্ভিক্ষ এড়াতে এবং শরনার্থিদের ফেরার জন্য অনুকুল পরিস্থিতি তৈরিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা কর্মসূচীকে অবশ্যই সম্প্রসারিত করতে হবে।
এবং এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এবং এর জনগনের অবস্থান একদম অকপট। একটি কার্যকরী রাজনৈতিক সমাধান তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন তা ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির পূর্বশর্ত সমূহ মেনে চলবে। পূর্বশর্ত সমুহ হচ্ছেঃ শেখ মুজিবর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সম্পুর্ন স্বীকৃতি, পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সম্পূর্নরূপে প্রত্যাহার এবং মিলিটারি ক্র্যাকডাউনের সময় থেকে মানুষ এবং সম্পদ রক্ষার ক্ষতিপূরণ। যদি যুক্তরাষ্ট্র তাদের থ্রী পয়েন্ট ফরমুলায় যা বলেছে আসলেই তা তাদের উদ্দেশ্য হয় তাদের উচিৎ হবে তার রক্ষিতা ইয়াহিয়া খান কে যাতে সে সম্পুর্ন রূপে পুর্বশর্তগুলো মেনে নেয়।
এটা অবশ্যই বুঝতে হবে যে যেকোন গ্রহণযোগ্য এবং অর্থপূর্ণ সমাধানের জন্য রজার্সের প্রস্তাব প্রসঙ্গে, সম্পুর্ন স্বাধীনতাই শেষ কথা। বাঙালিরা যারা তাদের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব ত্যাগে প্রস্তুত, স্বাধীনতা ব্যাতিত অন্য কিছু তাদের তৃষ্ণা মেটাতে পারেবনা। স্বাধীনতা মুল্য রক্ত, এবং আমরা এর মুল্য পরিশোধ করেছি। শেষ লক্ষ্যে পৌছুতে পৃথিবীর ৮ম সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র আরো রক্তদানের জন্য প্রস্তুত আছে। কোন শক্তিই তা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ৭৫ কোটি জনতার আওয়াজ চাপা দিতে পারবেনা, যারা একদম শেষ সৈনিকটি, শেষ গুলিটি পর্যন্ত লড়াই করে যেতে এবং তাদের মাটিকে স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রস্তুত। বিশ্ব মোড়লদের কুমন্ত্রনা এবং ষড়যন্ত্র তাদেরকে তাদের ঠিক করা পথ থেকে সরাতে পারবেনা এবং সেই পথটি হল সম্পুর্ন স্বাধীনতা।