You dont have javascript enabled! Please enable it!

শিরোনামঃ সম্পাদকীয়ঃ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন
সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ১
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

[ দি নেশনঃ পাক্ষিক। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের মুখপাত্র। সম্পাদক আবদুস সোবহান। দি ন্যাশন পাবলিকেশন্স মুজিবনগর, বাংলাদেশের পক্ষে আবদুস সোবহান কর্তৃক মূদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৯, ক্রুকড লেন, কলিকাতা-১ ]

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন

পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এখন সঙ্কটে। তাদের শুদ্ধবাদীবিকার এবং দূরদৃষ্টির অভাবে, মুক্ত চিন্তা, সঠিক এবং সচেতন মানবতাবোধ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্নতার ফলে তারা হত্যা ও ধ্বংসের পথকেই আঁকড়ে ধরেছে।তাদের এই গণহত্যা এবং তাদের পথে যে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাকেই নির্মূল করার নীতি সমাজে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের মূল ধারণাটিকেই সরাসরি নাকচ করে দেয়।মানুষের এই অধিকার সর্বসম্মতভাবেই প্রকৃতি প্রদত্ত , এবং একই সাথে জাতিসংঘের বিশ্ব পরিষদ কর্তৃক সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত । এছাড়াও, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার স্রষ্টা প্রদত্ত অধিকার যাকে কোনক্রমেই খর্ব করা যায় না।
কিন্তু বাংলাদেশে পাকিস্তানি জান্তা যে নির্দয় এবং নির্বিচার অপরাধকর্ম সংঘটন করছে তা কেবল বাঙালি জাতির বিরুদ্ধেই নয় , সামগ্রিকভাবে মানবতার বিরুদ্ধেও বিরাট অপরাধ। এটি ধর্মীয় নির্দেশনারও অমার্জনীয় লঙ্ঘন। মানবতার বিরুদ্ধে এই নির্বোধ আগ্রাসন এবং মানবতার অস্তিত্ব রক্ষা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পীড়াদায়ক প্রসঙ্গ যা বিশ্ব-বিবেক কে নাড়া দিতে বাধ্য, যে বিশ্ব মানবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এবং মানবসভ্যতার ধংস ও বিলোপের যে কোন ধারণা কে ঘৃণা করে।
শত্রু একটি ধারালো ছুরির ওপর দিয়ে হাঁটছে, এবং সে অনুধাবন করতে পারছে না যে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা কোন ছেলেখেলা নয়। এবং অন্যদিকে আমরা একটি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছি যারা মুমূর্ষু বাঙালিদের করুণ দুরবস্থায় নির্লজ্জ পরিহাসের হাসি হেসে যাচ্ছে ।
এই সর্বনাশা পরিবর্তন নতুন ভোরের দিগন্তকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করেছে।নতুন দিনের রক্তিম আভাকে নৈরাশ্যের অপশক্তি গ্রাস করতে চাইছে । রক্তাক্ত একটি জাতি অনন্যোপায় হয়ে বিশ্বের অন্যান্য জাতির কাছে স্বীকৃতি চাইছে।মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার একটি স্বতঃসিদ্ধ এবং তা স্বীকৃতি অর্জনের দাবিকে যোগ্য প্রমাণ করে।প্রত্যক্ষ উপস্থিতি যদি একটি অঞ্চলের স্বীকৃতির পূর্বশর্ত হয়, তবে বাংলাদেশ সরকার সেই পূরণ করেছে। বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, যারা বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন তাঁরা এর সাক্ষী। বাংলাদেশ সরকারের মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে এবং দেশের জনগণ এবং ভূখণ্ডের ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের নির্লজ্জ মিথ্যাচার এরই মধ্যে মিথ্যাবাদী পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা সহকারে প্রত্যাঘাত হিসেবে ফিরে এসেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে মূল চালিকাশক্তি হলো পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম এই জাতিগোষ্ঠীর স্বশাসনের ন্যায়সঙ্গত আকাঙ্ক্ষা, যা অন্য কোথাও থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে না।একমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকদের থেকে বিচ্ছিন্নতাই এই জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুমোদনবিহীন শাসন এবং ক্রমাগত শোষণের ফলে এই ঔপনিবেশিক প্রভুদের বিদায় জানানো এখন অনিবার্য, যাদের উপস্থিতি ইতিহাসের এক দুর্ঘটনা মাত্র। তাই আমরা বিদ্রোহ করেছি।সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অক্টপাসকে বাঙালি এমন প্রবল শক্তিতে আঘাত করেছে, যে সেই হিংস্র প্রানী তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী , জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান যেমন স্পষ্টভাবে বলেছেন, “সে অনুযায়ী স্বীকৃতির বিষয়টি এখন আমাদের প্রকৃত বন্ধুদের জন্য একটি এসিড টেস্ট”। আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান মানেই অনিবার্যকে স্বীকার করে নেওয়া। বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে একটি বাস্তবতা, টিকে থাকার জন্যই আত্মপ্রকাশ করেছে । যারা একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে বিশ্বাস করেন , যে জাতির একটি নিজস্ব ভূখণ্ড, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রয়েছে, তাদের বাঙ্গালি জাতির প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের এই বাস্তব সত্য কে স্বীকার করে নেওয়ায় ব্যতীত আর কোন বিকল্প নেই। ঔপনিবেশিক শাসনের বিলুপ্তিতে বিশ্বাসী এবং একটি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতি সংহতি পোষণকারী কোন জাতির পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি আদায়ের এই আহবান উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আমরা আশাবাদী যে,এই সরকার কে স্বীকৃতি প্রদানে আমাদের মিত্রদের অনুপ্রাণিত করতে মানবতার জন্য ভালোবাসা এবং মানবিক মর্যাদার প্রতি সম্মান সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে, যে সরকার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির পক্ষে মুজিবনগর থেকে কাজ করে যাচ্ছে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!