You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.25 | পৃথিবীর এক একটি রাষ্ট্র অথবা জাতিকে ধ্বংসের জন্য একটিমাত্র শক্তিদর্পী মূর্খের প্রয়োজন | অভিযান - সংগ্রামের নোটবুক

সংবাদপত্রঃ অভিযান ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১

পৃথিবীর এক একটি রাষ্ট্র অথবা জাতিকে ধ্বংসের জন্য একটিমাত্র শক্তিদর্পী মূর্খের প্রয়োজন এ যুগের তেমন একটি মূর্খ পাকিস্তানী চন্ড চক্রের চন্ডতম নায়ক ইয়াহিয়া

দখলীকৃত বাংলাদেশের প্রত্যেকটি অঞ্চল মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁদের প্রবল আক্রমণের মুখে পাকিস্তানী ঘাতক বাহিনী ধিরে ধিরে পিছু হটে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের প্রতিটি সীমান্তে একের পর এক এলাকা মুক্তিবাহীনির দখলে আসছে। প্রায় আট মাসে নির্যাতন শিবিরতুল্য দখলীকৃত এলাকায় অবরুদ্ধ থাকার পর মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন পশু শক্তি হতে নৃশংসভাবে উৎপীড়িত বাঙালী নারী- পুরুষ। তাঁরা আশা করছেন আর কতদিনে দখলীকৃত গোটা বাংলাদেশ পাকিস্তানী দুশমনের কবল মুক্ত হবে। আমরা জানি সেদিনের খুব বেশী আর বিলম্ব নেই কয়েক সপ্তাহেরই মাত্র ব্যাবধান।
এই উজ্জ্বল বাস্তবের সামনে দাঁড়িয়েও কিন্তু পাকিস্তানী জঙ্গীচক্রের আস্ফলন কিছুমাত্র হ্রাস পায়নি। তাঁদের প্রচারণার সুরে এবং বক্তব্যেও কিছুমাত্র তারতম্য ঘটেনি। সেই একই বস্তাপচা অজুহাত ভারতীয় চক্রান্ত এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী। লক্ষাধিক সুশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধার হাতে বস্তুতঃ গোটা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিযোদ্ধার হাতে বেধড়ক মার খেয়েও ইয়াহিয়া চক্র তা স্বীকার করতে পারছে না। কারণ খেলা শেষ হয়েছে এই সত্য মেনে নেবার আগে মুখ রক্ষার মত একটা বিরাট অজুহাত সৃষ্টি করতেই হবে তাদের।

তাই ভারতের বিরুদ্ধে ব্যাপক যুধেরই তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। চীনা প্রতিনিধি দলের ভোজসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া খাঁ যে কথাগুলি বলেছেন তা থেকেও সে কথাই প্রমাণ হচ্ছে। ইয়াহিয়া বলেছে, ‘দিন দশেকের ভিতরেই নিজের হাতে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আমি যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যাবো’। শ্রীমতি গান্ধীর কাছে পাঠানো মৈত্রী প্রস্তাবে উপেক্ষিত হওয়ায় ক্রুদ্ধ ইয়াহিয়া বলেছে ‘ঐ মেয়ে মানুষটা যদি মনে করে থাকে আমাকে ভয় দেখিয়ে ঘায়েল করা যাবে তাহলে সে জেনে রাখুক, আমি সে পাত্র নই’। আমরা বারবার লক্ষ করে আসছি দেশে বিদেশে যে কোন প্রসঙ্গে শ্রীমতি গান্ধীর নাম উল্লেখ করতে হলে ইয়াহিয়া তাকে সেই মেয়ে মানুষটি, ঐ মেয়ে মানুষটি সূচক অশালীন বিশেষণেই চিহ্নিত করে, তাঁর মত অমার্জিত লোকের মুখে হয়ত সেটাই শোভা পায়। কিন্তু তার পক্ষে এটাও ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় যে বাংলাদেশ প্রশ্নে শ্রীমতি গান্ধীর ভারতের ষাট কোটি মানুষের মুখপাত্র। তাহলে শ্রীমতি গান্ধীর নাম উল্লেখেও তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠার কারণটি কি এই যে ভদ্রমহিলার সামনে তার মত একজন জবরদস্ত জঙ্গী জেনারেল কোন রকমেই হালে পানি পাচ্ছে না। ফলে ধিকৃত পৌরুষের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে সাধারণ সৌজন্য এবং ভদ্রতার লেবাস ফেলে দিয়ে ইয়াহিয়া খাঁ গোটা বিশ্বের সামনে অমন প্রগলভ হয়ে উঠছেন?

এই বক্তৃতায় প্রসঙ্গান্তরে ইয়াহিয়া উক্তিঃ ‘সে (শ্রীমতি গান্ধী) যদি যুদ্ধ চায় আমি তার যুদ্ধ সাধ অবশ্যই মিটিয়ে দেব’ অর্থাৎ পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করতে চাচ্ছে। কিন্তু কেন? কিছুদিন আগেও ইয়াহিয়া বলেছে ‘ পাঁচগুণ বেশী শক্তিশালী ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া পাকিস্তানের পক্ষে বাতুলতা’ তবু সেই বাতুল প্রয়াসে কেন জড়িয়ে পড়তে চাইছে পাকিস্তানী জঙ্গিচক্র সেটাই বিবেচ্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে একটি স্বীকৃত সত্য সে কথা আজ বৃহৎ শক্তিবর্গসহ পৃথিবীর সকলেই এক রকম মেনে নিয়েছেন। চীনের বিশ্বাসও তা থেকে আলাদা নয় বলেই আমরা মনেকরি। পশ্চিম পাকিস্তান এবং পাকিস্তানী জঙ্গী শাসকচক্রও এ কথা জানে। বিশ্বের দরবারে নানাভাবে ধর্ণা দিয়ে ব্যার্থ হয়ে তাদের সে ধারণা এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট। তারা জানে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হবে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে তা থাকতে হবে। টিকিয়ে রাখতে হবে সেনাবাহিনী। পশ্চিম পাকিস্তানে অন্ততঃ অটুট রাখতে হবে শাসন ক্ষমতা। ফলে জঙ্গী সরকার যে নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে গোটা পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশ প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক বিরুদ্ধমত সোচ্চার হয়ে উঠছে। গত কিছুকাল থেকে এই বিরুদ্ধমত যাতে দেশব্যাপী একটা জনমত সৃষ্টি করতে না পারে তার অন্যতম প্রতিরোধ ব্যাবস্থায় জঙ্গী চক্র ওয়ালী ও ভাষানী ন্যাপকে রাজনৈতিক দল হিসেবে অবৈধ ঘোষণা করে নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে জনমতের কণ্ঠরোধ বর্তমান পর্যায়ে প্রথম শুরু হল। কিন্তু অপর দিকে ইয়াহিয়া এখনো বলে চলেছে যে জনগণের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন এ ভাঁওতা সে কাকে দিচ্ছে তা অবশ্য অনুমান করা শক্ত। কারণ যত দালালি করুক ইয়াহিয়ার হাত থেকে গণপরিষদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ক্ষমতা গ্রহণের সাহস যে কারও হবে এমন মনে হয় না। প্রমাণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের গনপরিত্যাক্ত যাবতীয় দালাল নেতারা এখন পশ্চিম পাকিস্তানেই ভীড় জমিয়েছে এবং তারা হয়ত লাশ না হয়ে আর বাংলাদেশে ফিরবে না।
পশ্চিম পাকিস্তানে জনমতের কন্ঠরোধ জঙ্গীচক্রের পক্ষে একটা মামুলী ব্যাপার হলেও বর্তমানে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ প্রশ্নে দুটি রাজনৈতিক মতের দ্বন্দ পশ্চিম পাকিস্তানে ঘোরালো হয়ে উঠেছিল। একদল এই মত পোষণ করেছিলেন যে বাংলাদেশ যখন ছেড়ে আসতেই হবে তখন আরও ক্ষতিগ্রস্থ না হয়ে মানে মানে সড়ে পড়া ভাল। কিন্তু ক্ষমাতাসীন জঙ্গীজোটের ধারণা। তাতে মুখরক্ষা হবেনা বলে সেনাবাহিনী ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে। কাজেই ৬০ কোটি ভারতের বিরুদ্ধে ৫ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানের লড়ে যাওয়াই সর্বদিক দিয়ে সমিচিন। কয়েক দিন যুদ্ধ চালিয়ে গেলে তারপর জাতিসংঘ ত’ হস্তক্ষেপ করবেই। তখণ বাঙালী সকলে না মরলেও পাকিস্তানী লাঠীটা অন্ততঃ অটুট নিয়ে ফেরা যাবে। ইতিমধ্যে বেপরোয়া বোমাবাজী করে ভারতের সীমান্ত এলাকা এবং শিবিরে শরনার্থী বাঙ্গালীদের বেশ কিছুটা ঘায়েল করা যাবে।
এই পরিকল্পনা অনুসারেই পাকিস্তানের জঙ্গীচক্র কাজ করে যাচ্ছে এবং হয়ত দু’ চারদিনের ভেতরেই তারা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করে বসবে।